যোগাযোগ/১১
১১
সন্ধ্যার অন্ধকার মেঘের ছায়ায় বৃষ্টির জলে নিবিড়। কুমুর আসবাবপত্র বেশি কিছু নেই। এক পাশে ছােটো খাট, আলনায় গুটি দুয়েক পাকান শাড়ি আর চাঁপা রঙের গামছা। কোণে কাঁঠাল-কাঠের সিন্ধুক, তার মধ্যে ওর ব্যবহারের কাপড়। খাটের নিচে সবুজ রঙ-করা টিনের বাক্সে পান সাজবার সরঞ্জাম, আর একটা বাক্সে চুল বাঁধবার সামগ্রী। দেয়ালের খাঁজের মধ্যে কাঠের থাকে কিছু বই, দোয়াতকলম, চিঠির কাগজ, মায়ের হাতের পশমে-বােনা বাবার সর্বদা ব্যবহারের চটিজুতাে-জোড়া; শোবার খাটের শিয়রে রাধাকৃষ্ণের যুগলরূপের পট। দেয়ালের কোণে ঠেসানাে একটা এসরাজ।
ঘরে কুমু আলাে জ্বালায় নি। কাঠের সিন্দুকের উপর বসে জানলার বাইরে চেয়ে আছে। সামনে ইঁটের কলেবরওআলা কলিকাতা, আদিম কালের বর্মকঠিন একটা অতিকায় জন্তুর মতো, জলধারার মধ্য দিয়ে ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে তার গায়ে গায়ে আলােকশিখার বিন্দু। কুমুর মন তখন ছিল অদৃষ্টনিরূপিত তার ভাবীলােকের মধ্যে। সেখানকার ঘরবাড়ি-লােকজন সবই তার আপন আদর্শে গড়া। তারই মাঝখানে নিজের সতীলক্ষ্মী-রূপের প্রতিষ্ঠা, কত ভক্তি, কত পূজা, কত সেবা। তার নিজের মায়ের পুণ্যচরিতে এক জায়গায় একটা গভীর ক্ষত রয়ে গেছে। তিনি স্বামীর অপরাধে কিছুকালের জন্যেও ধৈর্য হারিয়েছিলেন। কুমু কখনো সে-ভুল করবে না।
বিপ্রদাসের পায়ের শব্দ শুনে কুমু চমকে উঠল। দাদাকে দেখে বললে, “আলো জ্বেলে দেব কি?”
“না কুমু দরকার নেই” বলে বিপ্রদাস সিন্দুকে তার পাশে এসে বসল। কুমু তাড়াতাড়ি মেজের উপর নেমে বসে আস্তে আস্তে তার পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।
বিপ্রদাস স্নিগ্ধস্বরে বললে, “বৈঠকখানায় লোক এসেছিল তাই তোক ডেকে পাঠাই নি। এতক্ষণ একলা বসে ছিলি?”
কুমু লজ্জিত হয়ে বললে, “না, ক্ষেমা পিসি অনেকক্ষণ ছিলেন।” কথাটা ফিরিয়ে দেবার জন্যে বললে, “বৈঠকখানায় কে এসেছিল, দাদা?”
“সেই কথাই তোকে বলতে এসেছি। এ-বছর জষ্টি মাসে তুই আঠারো পেরিয়ে উনিশে পড়লি, তাই না?”
“হাঁ দাদা, তাতে দোষ হয়েছে কী?”
“দোষের কথা না। আজ নীলমণি ঘটক এসেছিল। লক্ষ্মী বোন, লজ্জা করিস নে। বাবা যখন ছিলেন, তোর বয়স দশ—বিয়ে প্রায় ঠিক হয়েছিল। হয়ে গেলে তোর মতের অপেক্ষা কেউ করত না। আজ তো আমি তা পারি নে। রাজা মধুসূদন ঘোষালের নাম নিশ্চয়ই শুনেছিস। বংশমর্যাদায় ওঁরা খাটো নন। কিন্তু বয়সে তোর সঙ্গে অনেক তফাত। আমি রাজি হতে পারি নি। এখন, তোর মুখের একটা কথা শুনলেই চুকিয়ে দিতে পারি। লজ্জা করিস নে কুমু।”
“না লজ্জা করব না।” বলে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। “যার কথা বলছ নিশ্চয়ই তাঁর সঙ্গে আমার সম্বন্ধ ঠিক হয়েই গেছে।” এটা সেই ঘটকের কথার প্রতিধ্বনি—কখন কথাটা এর মনের গভীরতায় আটকা পড়ে গেছে।
বিপ্রদাস আশ্চর্য হয়ে বললে, “কেমন করে ঠিক হল?”
কুমু চুপ করে রইল।
বিপ্রদাস তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললে, “ছেলেমানুষি করিস নে, কুমু।”
কুমুদিনী বললে, “তুমি বুঝবে না দাদা, একটুও ছেলেমানুষি করছি নে।”
দাদার উপর তার অসীম ভক্তি। কিন্তু দাদা তাে দৈববাণী মানে না, কুমুদিনী জানে এইখানেই দাদার দৃষ্টির ক্ষীণতা।
বিপ্রদাস বললে, “তুই তাে তাঁকে দেখিস নি।”
“তা হােক আমি যে ঠিক জেনেছি।”
বিপ্রদাস ভালাে করেই জানে এই জায়গাতেই ভাইবােনের মধ্যে অসীম প্রভেদ।
কুমুর চিত্তের এই অন্ধকার মহলে ওর উপর দাদার একটুও দখল নেই। তবে বিপ্রদাস আর একবার বললে, “দেখ কুমু, চির জীবনের কথা, ফস করে একটা খেয়ালের মাথায় পণ করে বসিস নে।”
কুমু ব্যাকুল হয়ে বললে, “খেয়াল নয় দাদা, খেয়াল নয়। আমি তােমার এই পা ছুঁয়ে বলছি আর কাউকে বিয়ে করতে পারব না।”
বিপ্রদাস চমকে উঠল। যেখানে কার্যকারণের যােগাযােগ নেই সেখানে তর্ক করবে কী নিয়ে? অমাবস্যার সঙ্গে কুস্তি করা চলে না। বিপ্রদাস বুঝেছে কী একটা দৈব-সংকেত কুমু মনের মধ্যে বানিয়ে বসেছে। কথাটা সত্য। আজই সকালে ঠাকুরকে উদ্দেশ করে মনে মনে বলেছিল, এই বেজোড় সংখ্যার ফুলে জোড় মিলিয়ে সবশেষে যেটি বাকি থাকে তার রঙ যদি ঠাকুরের মতাে নীল হয় তবে বুঝব তাঁর ইচ্ছা। সব-শেষের ফুলটি হল নীল অপরাজিতা।
অদূরে মল্লিকদের বাড়িতে সন্ধ্যারতির কাঁসরঘণ্টা বেজে উঠল। কুমু জোড়হাত করে প্রণাম করলে। বিপ্রদাস অনেকক্ষণ রইল বসে। ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে; বৃষ্টি ধারার বিরাম নেই।