১০

 বাদলা করেছে। বিপ্রদাসের শরীরটা ভালাে নেই। বালাপােশ মুড়ি দিয়ে আধশােওয়া অবস্থায় খবরের কাগজ পড়ছে। কুমুর আদরের বিড়ালটা বালাপােশের একটা ফালতো অংশ দখল করে গােলাকার হয়ে নিদ্রামগ্ন। বিপ্রদাসের টেরিয়র কুকুরটা অগত্যা ওর স্পর্ধা সহ্য করে মনিবের পায়ের কাছে শুয়ে স্বপ্নে এক-এক বার গোঁ গোঁ করে উঠছে।

 এমন সময়ে এল আর-এক ঘটক।

 “নমস্কার।”

 “কে তুমি।”

 “আজ্ঞে, কর্তারা আমাকে খুবই চিনতেন, (মিথ্যে কথা) আপনারা তখন শিশু। আমার নাম নীলমণি ঘটক, ৺গঙ্গামণি ঘটকের পুত্র।”

 “কী প্রয়ােজন?”

“ভালাে পাত্রের সন্ধান আছে। আপনাদেরই ঘরের উপযুক্ত।”

 বিপ্রদাস একটু উঠে বলল। ঘটক রাজাবাহাদুর মধুসূদন ঘােষালের নাম করলে।

 বিপ্রদাস বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলে, “ছেলে আছে না কি?”

 ঘটক জিভ কেটে বললে, “না তিনি বিবাহ করেন নি। প্রচুর ঐশ্বর্য। নিজে কাজ দেখা ছেড়ে দিয়েছেন, এখন সংসার করতে মন দিয়েছেন।”

 বিপ্রদাস খানিকক্ষণ বসে গুড়গুড়িতে টান দিতে লাগল। তার পরে হঠাৎ এক সময়ে একটু যেন জোর করে বলে উঠল, “বয়সের মিল আছে এমন মেয়ে আমাদের ঘরে নেই।”

 ঘটক ছাড়তে চায় না, বরের ঐশ্বর্যের যে পরিমাণ কত, আর গবর্নরের দরবারে তার আনাগােনার পথ যে কত প্রশস্ত ইনিয়ে-বিনিয়ে তাই ব্যাখ্যা করতে লাগল।

 বিপ্রদাস আবার স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল। আবার অনাবশ্যক বেগের সঙ্গে বলে উঠল, “বয়সে মিলবে না।”

 ঘটক বললে, “ভেবে দেখবেন, দু-চারদিন বাদে আর-এক বার আসব।”

 বিপ্রদাস দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে আবার শুয়ে পড়ল।

 দাদার জন্যে গরম চা নিয়ে কুমু ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিল। দরজার বাইরে গামছাশুদ্ধ একটা ভিজে জীর্ণ ছাতি ও কাদামাখা তালতলার চটি দেখে থেমে গেল। ওদের কথাবার্তা অনেকখানি কানে পৌঁছল। ঘটক তখন বলছে, “রাজাবাহাদুর এবার বছর না যেতে মহারাজা হবেন এটা একেবারে লাটসাহেবের নিজ মুখের কথা। তাই এতদিন পরে তাঁর ভাবনা ধরেছে, মহারানীর পদ এখন আর খালি রাখা চলবে না। আপনাদের গ্রহাচার্য কিনু ভটচাজ দূরসম্পর্কে আমার সম্বন্ধী, তার কাছে কন্যার কুষ্ঠি দেখা গেল—লক্ষণ ঠিকটি মিলেছে। এই নিয়ে শহরের মেয়ের কুষ্ঠি ঘাঁটতে বাকি রাখি নি—এমন কুষ্ঠি আর-একটিও হাতে পড়ল না। এই দেখে নেবেন, আমি আপনাকে বলে দিচ্ছি, এ-সম্বন্ধ হয়েই গেছে, এ প্রজাপতির নির্বন্ধ।

 ঠিক এই সময়ে কুমুর আবার বাঁ চোখ নাচল। শুভলক্ষণের কী অপূর্ব রহস্য! কিনু আচার্যি কতবার তার হাত দেখে বলেছে, রাজরানী হবে সে। করকোষ্ঠীর সেই পরিণত ফলটা আপনি যেচে আজ তার কাছে উপস্থিত। ওদের গ্রহাচার্য এই কদিন হল বার্ষিক আদায় করতে কলকাতায় এসেছিল; সে বলে গেছে, এবার আষাঢ় মাস থেকে বৃষরাশির রাজসম্মান, স্ত্রীলোকঘটিত অর্থলাভ, শত্রুনাশ; মন্দের মধ্যে পত্নীপীড়া, এমন কি হয়তো পত্নীবিয়োগ। বিপ্রদাসের বৃষরাশি। মাঝে মাঝে দৈহিক পীড়ার কথা আছে। তারও প্রমাণ হাতে হাতে, কাল রাত থেকে স্পষ্টই সর্দির লক্ষণ। আষাঢ় মাসও পড়ল—পত্নীর পীড়া ও মৃত্যুর কথাটা ভাববার আশু প্রয়োজন নেই, অতএব এবার সময় ভালো।

 কুমু দাদার পাশে বসে বললে, “দাদা মাথা ধরেছে কি?”

 দাদা বললে, “না।”

 “চা তাে ঠাণ্ডা হয়ে যায় নি? তােমার ঘরে লােক দেখে ঢুকতে পারলুম না।”

 বিপ্রদাস কুমুর মুখের দিকে চেয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে। ভাগ্যের নিষ্ঠুরতা সব চেয়ে অসহ্য, যখন সে সােনার রথ আনে যার চাকা অচল। দাদার মুখভাবে এই দ্বিধার বেদনা কুমুকে ব্যথা দিলে। দৈবের দানকে কেন দাদা এমন করে সন্দেহ করছেন? বিবাহ-ব্যাপারে নিজের পছন্দ বলে যে একটা উপসর্গ আছে এ চিন্তা কখনো কুমুদিনীর মাথায়। আসে নি। শিশুকাল থেকে পরে পরে সে তার চার দিদির বিয়ে দেখেছে। কুলীনের ঘরে বিয়ে—কুল ছাড়া আর বিশেষ কিছু পছন্দর বিষয় ছিল তাও নয়। ছেলেপুলে নিয়ে তবু তারা সংসার করছে, দিন কেটে যাচ্ছে। যখন দুঃখ পায় বিদ্রোহ করে না; মনে ভাবতেও পারে যে, কিছুতেই এটা ছাড়া আর কিছুই হতে পারত। মা কি ছেলে বেছে নেয়? ছেলেকে মেনে নেয়। কুপুত্রও হয়, সুপুত্রও হয়। স্বামীও তেমনি। বিধাতা তো দোকান খােলেন নি। ভাগ্যের উপর বিচার চলবে কার?

 এতদিন পরে কুমুর মন্দভাগ্যের তেপান্তর মাঠ পেরিয়ে এল রাজপুত্র ছদ্মবেশে। রথচক্রের শব্দ কুমু তার হৃৎস্পন্দনের মধ্যে ওই যে শুনতে পাচ্ছে। বাইরের ছদ্মবেশটা সে যাচাই করে দেখতেই চায় না।

 তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়েই সে পাঁজি খুলে দেখলে আজ মনােরথ-দ্বিতীয়া। বাড়িতে কর্মচারীদের মধ্যে যে-কয়জন ব্রাহ্মণ আছে সন্ধ্যাবেলা ডাকিয়ে তাদের ফলার করালে, দক্ষিণাও যথাসাধ্য কিছু দিলে। সবাই আশীর্বাদ করলে, রাজরানী হয়ে থাকো, ধনে-পুত্রে লক্ষ্মীলাভ হােক।

 দ্বিতীয়বার বিপ্রদাসের বৈঠকখানায় ঘটকের আগমন। তুড়ি দিয়ে শিব শিব বলে বৃদ্ধ উচ্চস্বরে হাই তুললে। এবারে অসম্মতি দিয়ে কথাটাকে শেষ করে দিতে বিপ্রদাসের সাহস হল না। ভাবলে এতবড়াে দায়িত্ব নিই কী করে? কেমন করে নিশ্চয় জানব কুমুর পক্ষে এ-সম্বন্ধ সব চেয়ে ভালাে নয়? পরশুদিন শেষকথা দেবে বলে ঘটককে বিদায় করে দিলে।