◄  ৩৪
৩৬  ►

৩৫

 এদিকে নবীন ও মােতির মা বুঝেছে, এবারে ভিত গেল ভেঙে, পালিয়ে বাঁচবার আশ্রয় তাদের আর কোথাও রইল না। মােতির মা বললে, “এখানে যে-রকম খেটে খাচ্ছি সে-রকম খেটে খাবার জায়গা সংসারে আমার মিলবে। আমার দুঃখ এই যে, আমি গেলে এ-বাড়িতে দিদিকে দেখবার লােক আর কেউ থাকবে না।”

 নবীন বললে, “দেখাে মেজোবৌ, এ-সংসারে অনেক লাঞ্ছনা পেয়েছি, এ-বাড়ির অন্নজলে অনেকবার আমার অরুচি হয়েছে। কিন্তু এইবার অসহ্য হচ্ছে যে, এমন বউ ঘরে পেয়েও কি করে তাকে নিতে হয়, রাখতে হয়, তা দাদা বুঝলে না— সমস্ত নষ্ট করে দিলে। ভালাে জিনিসের ভাঙা টুকরো দিয়েই অলক্ষ্মী বাসা বাঁধে।”

 মােতির মা বললে, “সে-কথা তােমার দাদার বুঝতে দেরি হবে না। কিন্তু তখন ভাঙা আর জোড়া লাগবে না।”

 নবীন বললে, “লক্ষ্মণ দেওর হবার ভাগ্য আমার ঘটল না, এইটেই আমার মনে বাজছে। যা হােক, তুমি জিনিসপত্তর এখনই গুছিয়ে ফেলো, এ-বাড়িতে যখন সময় আসে তখন আর তর সয় না।”  মােতির মা চলে গেল। নবীন আর থাকতে পারলে না, আস্তে আস্তে তার বৌদিদির ঘরের বাইরে এসে দেখলে, কুমু তার শােবার ঘরের মেজের বিছানার উপর পড়ে আছে। যে-চিঠিখানা ছিঁড়ে ফেলেছে তার বেদনা কিছুতেই মন থেকে যাচ্ছে না।

 নবীনকে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে বসল। নবীন বললে, “বউদিদি, প্রণাম করতে এসেছি, একটু পায়ের ধুলাে দাও।”

 বউদিদির সঙ্গে নবীনের এই প্রথম কথাবার্তা।

 কুমু বললে, “এস, ব’সো।”

 নবীন মাটিতে বসে বললে, “তােমাকে সেবা করতে পারব এই খুশিতে বুক ভরে উঠেছিল। কিন্তু নবীনের কপালে এতটা সৌভাগ্য সইবে কেন? কটা দিন মাত্র তােমাকে পেয়েছি, কিছুই করতে পারি নি এই আফসােস মনে রয়ে গেল।”

 কুমু জিজ্ঞাসা করলে, “কোথায় যাচ্ছ তােমরা?”

 নবীন বললে, “দাদা আমাদের দেশেই পাঠাবে। এর পরে তােমার সঙ্গে বােধ হয় আর দেখা হবার সুবিধা হবে না, তাই প্রণাম করে বিদায় নিতে এসেছি।” বলে যেই সে প্রণাম করলে মােতির মা ছুটে এসে বললে, “শীঘ্র চলে এস। কর্তা তােমার খোঁজ করছেন।”

 নবীন তাড়াতাড়ি উঠে চলে গেল। মােতির মাও গেল তার সঙ্গে।

 সেই বাইরের ঘরে দাদা তার ডেস্কের কাছে বসে; নবীন এসে দাঁড়াল। অন্যদিনে এমন অবস্থায় তার মুখে যে-রকম আশঙ্কার ভাব থাকত আজ তা কিছুই নেই।

 মধুসূদন জিজ্ঞাসা করলে, “ডেস্কের চিঠির কথা বড়ােবউকে কে বললে?

 নবীন বললে, “আমিই বলেছি।”

 “হঠাৎ তােমার এত সাহস বেড়ে উঠল কোথা থেকে?”

 “বড়োবউরানী আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন তাঁর দাদার চিঠি এসেছে কি না। এ-বাড়ির চিঠি তাে তােমার কাছে এসে প্রথমটা ওই ডেস্কেই জমা হয়, তাই আমি দেখতে এসেছিলুম।”

 “আমাকে জিজ্ঞাসা করতে সবুর সয় নি?”

 “তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন তাই—”

 “তাই আমার হুকুম উড়িয়ে দিতে হবে?”

 “তিনি তাে এ-বাড়ির কর্ত্রী, কেমন করে জানব তাঁর হুকুম এখানে চলবে না? তিনি যা বলবেন আমি তা মানব না এতবড়াে আস্পর্ধা আমার নেই। এই আমি তােমার কাছে বলছি, তিনি তাে শুধু আমার মনিব নন তিনি আমার গুরুজন, তাঁকে যে মানব সে নিমক খেয়ে নয়, সে আমার ভক্তি থেকে।”

 “নবীন, তােমাকে তো এতটুকু বেলা থেকে দেখছি, এ-সব বুদ্ধি তােমার নয়। জানি তােমার বুদ্ধি কে যােগায়। যাই হােক, আজ আর সময় নেই, কাল সকালের ট্রেনে তােমাদের দেশে যেতে হবে।”

 “যে আজ্ঞে” বলেই নবীন দ্বিরুক্তি না করেই দ্রুত চলে গেল।

 এত সংক্ষেপে “যে আজ্ঞে” মধুসূদনের একটুও ভালো লাগল না। নবীনের কান্নাকাটি করা উচিত ছিল, যদিও তাতে মধুসূদনের সংকল্পের ব্যত্যয় হত না। নবীনকে আবার ফিরে ডেকে বললে, “মাইনে চুকিয়ে নিয়ে যাও, কিন্তু এখন থেকে তােমাদের খরচপত্র যােগাতে পারব না।”

 নবীন বললে, “তা জানি, দেশে আমার অংশে যে জমি আছে তাই আমি চাষ করে খাব।”

 বলেই অন্য কোনাে কথার অপেক্ষা না করেই সে চলে গেল।

মানুষের প্রতি নানা বিরুদ্ধ ধাতু মিশােল করে তৈরি, তার একটা প্রমাণ এই যে, মধুসূদন নবীনকে গভীরভাবে স্নেহ করে। তার অন্য দুই ভাই রজবপুরে বিষয়সম্পত্তির কাজ নিয়ে পাড়াগাঁয়ে পড়ে আছে, মধুসূদন তাদের বড়ো একটা খোঁজ রাখে না। পিতার মৃত্যুর পর নবীনকে কে মধুসূদন কলকাতায় নিয়ে পড়াশুনো করিয়েছে এবং তাকে বরাবর রেখেছে নিজের কাছে। সংসারের কাজে নবীনের স্বাভাবিক পটুতা। তার কারণ সে খুব খাঁটি। আর একটা হচ্ছে, তার কথাবার্তায় ব্যবহারে সকলেই তাকে ভালােবাসে। এ-বাড়িতে যখন কোনাে ঝগড়াঝাঁটি বাধে তখন নবীন সেটাকে সহজে মিটিয়ে দিতে পারে। নবীন সব কথায় হাসতে জানে, আর লোকদের শুধু কেবল সুবিচার করে না, এমন ব্যবহার করে যাতে প্রত্যেকেই মনে করে, তারই ’পরে বুঝি ওর বিশেষ পক্ষপাত।

 নবীনকে মধুসূদন যে মনের সঙ্গে স্নেহ করে তার একটা প্রমাণ, মােতির মাকে মধুসূদন দেখতে পারে না। যার প্রতি ওর মমতা তার প্রতি ওর একাধিপত্য চাই। সেই কারণে মধুসূদন কেবল কল্পনা করে মােতির মা যেন নবীনের মন ভাঙাতেই আছে। ছােটো ভাইয়ের প্রতি। ওর যে পৈতৃক অধিকার, বাইরে থেকে এক মেয়ে এসে সেটাতে কেবলই বাধা ঘটায়। নবীনকে মধুসূদন যদি বিশেষ ভালাে না বাসত তাহলে অনেক দিন আগেই মােতির মার নির্বাসনদণ্ড পাকা হত।

 মধুসুদন ভেবেছিল, এইটুকু কাজ সেরেই আবার একবার আপিসে চলে যাবে। কিন্তু কোনােমতেই মনের মধ্যে জোর পেলে না। কুমু সেই যে চিঠিখানা ছিড়ে দিয়ে চলে গেল সেই ছবিটি তার মনে গভীর করে আঁকা হয়ে গেছে। সে এক আশ্চর্য ছবি, এমনতরো কিছু সে কখনাে মনে করতে পারত না। একবার তার চিরকালের সন্দেহ-করা স্বভাববশত মধুসূদন ভেবেছিল, নিশ্চয় কুমু চিঠিখানা আগেই পড়ে নিয়েছে, কিন্তু কুমুর মুখে এমন একটি নির্মল সত্যের দীপ্তি আছে যে, বেশিক্ষণ তাকে অবিশ্বাস করা মধুসূদনের পক্ষেও অসম্ভব।

 কুমুকে কঠিনভাবে শাসন করবার শক্তি মধুসূদন দেখতে দেখতে হারিয়ে ফেলেছে, এখন তার নিজের তরফে যে-সব অপূর্ণতা তাই তাকে পীড়া দিতে আরম্ভ করেছে। তার বয়স বেশি, এ-কথা আজ সে ভুলতে পারছে না। এমনকি তার যে চুলে পাক ধরেছে সেটা সে কোনোমতে গোপন করতে পারলে বাঁচে। তার রঙটা কালো বিধাতার সেই অবিচার এতকাল পরে তাকে তীব্র করে বাজছে। কুমুর মনটা কেবলই তার মুষ্টি থেকে ফসকে যাচ্ছে, তার কারণ মধুসূদনের রূপ ও যৌবনের অভাব এতে তার সন্দেহ নেই। এইখানেই সে নিরস্ত্র, সে দুর্বল। চাটুজ্যেদের ঘরের মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছিল, কিন্তু সে যে এমন মেয়ে পাবে বিধাতা আগে থাকতেই যার কাছে তার হার মানিয়ে রেখে দিয়েছেন, এ সে মনেও করে নি। অথচ একথা বলবারও জোর মনে নেই যে তার ভাগ্যে একজন সাধারণ মেয়ে হলেই ভালো হত যার উপরে তার শাসন খাটত।

 মধুসূদন কেবল একটা বিষয়ে টেক্কা দিতে পারে। সে তার ধনে। তাই আজ সকালেই ঘরে জহরি এসেছিল। তার কাছ থেকে তিনটে আংটি নিয়ে রেখেছে, দেখতে চায় কোন্‌টাতে কুমুর পছন্দ। সেই আংটির কৌটা তিনটি পকেটে নিয়ে সে তার শোবার ঘরে গেল। একটা চুনি, একটা পান্না, একটা হীরের আংটি। মধুসূদন মনে-মনে একটি দৃশ্য কল্পনাযোগে দেখতে পাচ্ছে। প্রথমে সে যেন চুনির আংটির কৌটা অতি ধীরে ধীরে খুললে, কুমুর লুব্ধ চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তার পরে বেরোল পান্না, তাতে চক্ষু আরও প্রসারিত। তার পর হীরে, তার বহুমূল্য উজ্জ্বলতায় রমণীর বিস্ময়ের সীমা নেই। মধুসূদন রাজকীয় গাম্ভীর্যের সঙ্গে বললে, তােমার যেটা ইচ্ছে পছন্দ করে নাও। হীরেটাই কুমু যখন পছন্দ করলে তখন তার লুব্ধতার ক্ষীণ সাহস দেখে ঈষৎ হাস্য করে মধুসুদন তিনটে আংটিই কুমুর তিন আঙুলে পরিয়ে দিলে। তার পরেই রাত্রে শয়নমঞ্চের যবনিকা উঠল।

 মধুসূদনের অভিপ্রায় ছিল এই ব্যাপারটা আজ রাত্রের আহারের পর হবে। কিন্তু দুপুরবেলাকার দুর্যোগের পর মধুসূদন আর সবুর করতে পারলে না। রাত্রের ভূমিকাটা আজ অপরাহ্ণে সেরে নেবার জন্যে অন্তঃপুরে গেল।

 গিয়ে দেখে কুমু একটা টিনের তােরঙ্গ খুলে শোবার ঘরের মেজেতে বসে গােছাচ্ছে। পাশে জিনিসপত্র কাপড়চোপড় ছড়ানাে।

 “এ কী কাণ্ড? কোথাও যাচ্ছ নাকি?”

 “হাঁ”

 “কোথায়?”

 “রজবপুরে।”

 “তার মানে কী হল?”

 “তােমার দেরাজ খােলা নিয়ে ঠাকুরপােদের শাস্তি দিয়েছ। সে-শাস্তি আমারই পাওনা।”

 “যেয়াে না” বলে অনুরােধ করতে বসা একেবারেই মধুসূদনের স্বভাববিরুদ্ধ। তার মনটা প্রথমেই বলে উঠল—যাক না দেখি কতদিন থাকতে পারে। এক মুহূর্ত দেরি না করে হন হন করে ফিরে চলে গেল।