◄  ৩৫
৩৭  ►

৩৬

 মধুসূদন বাইরে গিয়ে নবীনকে ডেকে পাঠিয়ে বললে, “বড়োবউকে তোরা খেপিয়েছিস।”

 “দাদা, কালই তো আমরা যাচ্ছি, তোমার কাছে ভয়ে-ভয়ে আর ঢোঁক গিলে কথা কব না। আমি আজ এই স্পষ্ট বলে যাচ্ছি, বড়োবউরানীকে খেপাবার জন্যে সংসারে আর কারও দরকার হবে না, তুমি একাই পারবে। আমরা থাকলে তবু যদি বা কিছু ঠাণ্ডা রাখতে পারতুম, কিন্তু সে তোমার সইল না।

 মধুসূদন গর্জন করে উঠে বললে, “জেঠামি করিস নে। রজবপুরে যাবার কথা তোরাই ওকে শিখিয়েছিস।”

 “এ-কথা ভাবতেই পারি নে তো শেখাব কী।”

 “দেখ্, এই নিয়ে যদি ওকে নাচাস তোদের ভাল হবে না, স্পষ্টই বলে দিচ্ছি।”

 “দাদা, এ-সব কথা বলছ কাকে? যেখানে বললে কাজে লাগে বলো গে।”

 “তোরা কিছু বলিস নি?”

 “এই তোমার গা ছুঁয়ে বলছি, কল্পনাও করি নি।”

 “বড়োবউ যদি জেদ ধরে বসে তাহলে কী করবি তোরা?”

 “তোমাকে ডেকে আনব। তোমার পাইক বরকন্দাজ পেয়াদা আছে, তুমি ঠেকাতে পার। তার পরে তোমার শত্রুপক্ষেরা এই যুদ্ধের সংবাদ যদি কাগজে রটায় তাহলে মেজোবউকে সন্দেহ করে বোসো না।”

 মধুসূদন আবার তাকে ধমক দিয়ে বললে, “চুপ কর্! বড়োবউ যদি রজবপুরে যেতে চায় তো যাক, আমি ঠেকাব না।”

 “আমরা তাঁকে খাওয়াব কী করে?”

 “তোমার স্ত্রীর গহনা বিক্রি করে। যা, যা বলছি। বেরো বলছি ঘর থেকে।”

 নবীন বেরিয়ে গেল। মধুসূদন ওডিকলোন-ভিজনো পটি কপালে জড়িয়ে আবার একবার আপিসে যাবার সংকল্প মনে দৃঢ় করতে লাগল।

 নবীনের কাছে মোতির মা সব কথা শুনে দৌড়ে গেল কুমুর শোবার ঘরে। দেখলে তখনও সে কাপড়চোপড় পাট করছে তোলবার জন্যে। বললে, “এ কী করছ, বউরানী।”

 “তোমাদের সঙ্গে যাব।”

 “তোমাকে নিয়ে যাবার সাধ্য কী আমার।”

 “কেন?”

 “বড়ঠাকুর তাহলে আমাদের মুখ দেখবেন না।”

 “তাহলে আমার ও দেখবেন না।”

 “তা সে যেন হল, আমরা যে বড়ো গরিব।”

 “আমিও কম গরিব না, আমারও চলে যাবে।”

 “লোকে যে বড়ঠাকুরকে নিয়ে হাসবে।”

 “তা বলে আমার জন্যে তোমরা শাস্তি পাবে, এ আমি সইব না।”

 “কিন্তু দিদি, তোমার জন্যে তো শাস্তি নয়, এ আমাদের নিজের পাপের জন্যেই।”

 “কিসের পাপ তোমাদের?”

 “আমরাই তো খবর দিয়েছি তোমাকে।”

 “আমি যদি খবর জানতে চাই তাহলে খবর দেওয়াটা অপরাধ?”

 “কর্তাকে না জানিয়ে দেওয়াটা অপরাধ।”

 “তাই ভালো, অপরাধ তােমরাও করেছ আমিও করেছি। একসঙ্গেই ফল ভােগ করব।”

 “আচ্ছা বেশ, তাহলে বলে দেব তােমার জন্যে পালকি। বড়ঠাকুরের হুকুম হয়েছে, তােমাকে বাধা দেওয়া হবে না। এখন তবে তােমার জিনিসগুলি গুছিয়ে দিই। ওগুলাে নিয়ে যে ঘেমে উঠলে।”

 দুজনে গােছাতে লেগে গেল।

 এমন সময় কানে এল বাইরে জুতাের মচ মচ ধ্বনি। মোতির মা দিল দৌড়।

 মধুসূদন ঘরে ঢুকেই বললে, “বড়ােবউ, তুমি যেতে পারবে না।”

 “কেন যেতে পারব না?”

 “আমি হুকুম করছি বলে।”

 “আচ্ছা, তাহলে যাব না। তার পরে আর কী হুকুম বলো।”

 “বন্ধ করে তােমার জিনিস প্যাক করা।”

 “এই বন্ধ করলুম।” বলে কুমু উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মধুসূদন বললে, “শােনাে, শােনাে।”

 তখনই কুমু ফিরে এসে বললে, “কী বলো।”

 বিশেষ কিছুই বলবার ছিল না। তবু একটু ভেবে বললে, “তােমার জন্যে আংটি এনেছি।”

 “আমার যে-আংটির দরকার ছিল সে তুমি পরতে বারণ করেছ, আর আমার আংটির দরকার নেই।”

 “একবার দেখোই-না চেয়ে।”

 মধুসুদন একে একে কৌটো খুলে দেখালে। কুমু একটি কথা ও বললে না।

 “এর যেটা তােমার পছন্দ সেইটেই তুমি পরতে পার।”

 “তুমি যেটা হুকুম করবে সেইটেই পরব।”

 “আমি তাে মনে করি তিনটেই তিন আঙুলে মানাবে।”

 “হুকুম কর তিনটেই পরব।”

 “আমি পরিয়ে দিই।”

 “দাও পরিয়ে।”

 মধুসূদন পরিয়ে দিলে। কুমু বললে, “আর কিছু হুকুম আছে?”

 “বড়ােবউ রাগ করছ কেন?”

 “আমি একটুও রাগ করছি নে।” বলে কুমু আবার ঘর থেকে চলে গেল।

 মধুসুদন অস্থির হয়ে বলে উঠল, “আহা, যাও কোথায়? শােনো, শােনো।”

 কুম তখনই ফিরে এসে বললে, “কী বলো।”

 ভেবে পেলে না কী বলবে। মধুসূদনের মুখ লাল হয়ে উঠল।

 ধিক্‌কার দিয়ে বলে উঠল, “আচ্ছা, যাও।” রেগে বললে, “দাও আংটিগুলাে ফিরিয়ে দাও।”

 তখনই কুমু তিনটে আংটি খুলে টিপায়ের উপর রাখলে।

 মধুসূদন ধমক দিয়ে বললে, “যাও চলে।”

 কুমু তখনই চলে গেল।

 এইবার মধুসূদন দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করলে যে, সে আপিসে যাবেই। তখন কাজের সময় প্রায় উত্তীর্ণ। ইংরেজ কর্মচারীরা সকলেই চলে গেছে টেনিস খেলায়। উচ্চতন বড়ােবাবুদের দল উঠি-উঠি করছে। এমন সময় মধুসূদন আপিসে উপস্থিত হয়ে একেবারে খুব কষে কাজে লেগে গেল। ছটা বাজল, সাতটা বাজল, আটটা বাজে, তখন খাতাপত্র বন্ধ করে উঠে পড়ল।