যোগাযোগ/৪০
৪০
মধুসূদন চলে যেতেই কুমু খাট থেকে নেমে মেজের উপর বসে পড়ল। চিরজীবন ধরে এমন সমুদ্রে কি তাকে সাঁতার কাটতে হবে যার কূল কোথাও নেই? মধুসূদন ঠিকই বলেছে ওদের সঙ্গে তার চাল তফাত। আর সকল রকম তফাতের চেয়ে এইটেই দুঃসহ। কী উপায় আছে এর?
এক সময় হঠাৎ কী মনে পড়ল, কুমু চলল নীচের তলায় মোতির মার ঘরের দিকে। সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় দেখে, শ্যামাসুন্দরী উপরে উঠে আসছে।
“কী বউ, চলেছ কোথায়? আমি যাচ্ছিলুম তোমার ঘরেই।”
“কোনো কথা আছে?”
“এমন কিছু নয়। দেখলুম ঠাকুরপোর মেজাজ কিছু চড়া, ভাবলুম তোমাকে একবার জিজ্ঞাসা করে জানি, নতুন প্রণয়ে খটকা বাধল কোন্খানটাতে। মনে রেখো বউ, ওর সঙ্গে কী রকম করে বনিয়ে চলতে হয় সে-পরামর্শ আমরাই দিতে পারি। বকুলফুলের ঘরে চলেছ বুঝি? তা যাও, মনটা খোলসা করে এস গে।”
আজ হঠাৎ কুমুর মনে হল, শ্যামাসুন্দরী আর মধুসূদন একই মাটিতে গড়া এক কুমোরর চাকে। কেন এ-কথা মাথায় এল বলা শক্ত। চরিত্র বিশ্লেষণ করে কিছু বুঝেছে তা নয়, আকারে-প্রকারে বিশেষ যে মিল তাও নয়, তবু দুজনের ভাবগতিকের একটা অনুপ্রাস আছে, যেন শ্যামাসুন্দরীর জগতে আর মধুসূদনের জগতে একই হাওয়া। শ্যামাসুন্দরী যখন বন্ধুত্ব করতে আসে তাও কুমুকে উলটো দিকে ঠেলা দেয়, গা কেমন করে ওঠে।
মোতির মার শোবার ঘরে ঢুকেই কুমু দেখলে, নবীনে তাতে মিলে কী একটা নিয়ে হাত-কাড়াকাড়ি চলছে। ফিরে যাবে-যাবে মনে করছে, এমন সময় নবীন বলে উঠল, “বৌদিদি, যেয়ো না যেয়ো না। তোমার কাছেই যাচ্ছিলুম; নালিশ আছে।”
“কিসের নালিশ?”
“একটু ব’সো, দুঃখের কথা বলি।”
তক্তপোশের উপর কুমু বসল।
নবীন বললে, “বড়ো অত্যাচার! এই ভদ্রমহিলা আমার বই রেখেছেন লুকিয়ে।”
“এমন শাসন কেন?”
“ঈর্ষা,—যেহেতু নিজে ইংরেজি পড়তে পারেন না। আমি স্ত্রীশিক্ষার পক্ষে, কিন্তু উনি স্বামী-জাতির এডুকেশনের বিরোধী। আমার বুদ্ধির যতই উন্নতি হচ্ছে, ওঁর বুদ্ধির সঙ্গে ততই গরমিল হওয়াতে ওঁর আক্রোশ। অনেক করে বোঝালেম যে, এতবড়ো যে সীতা তিনিও রামচন্দ্রের পিছনে পিছনেই চলতেন; বিদ্যেবুদ্ধিতে আমি যে তোমার চেয়ে অনেক দূরে এগিয়ে এগিয়ে চলছি এতে বাধা দিয়ো না।”
“তোমার বিদ্যের কথা মা সরস্বতী জানেন, কিন্তু বুদ্ধির বড়াই করতে এসো না বলছি।”
নবীনের মহা বিপদের ভান-করা মুখভঙ্গি দেখে কুমু খিল খিল করে হেসে উঠল। এ-বাড়িতে এসে অবধি এমন মন খুলে হাসি এই ওর প্রথম। এই হাসি নবীনের বড় মিষ্টি লাগল। সে মনে-মনে বললে, “এই আমার কাজ হল, আমি বউরানীকে হাসাব।”
কুমু হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলে, “কেন ভাই ঠাকুরপাের বই লুকিয়ে রেখেছ।”
“দেখাে তো দিদি। শােবার ঘরে কি ওঁর পাঠশালার গুরুমশায় বসে আছেন? খেটেখুটে রাত্তিরে ঘরে এসে দেখি, একটা পিদ্দিম জলছে, তার সঙ্গে আর-একটা বাতির সেজ, মহাপণ্ডিত পড়তে বসে গেছেন। খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যায়, তাগিদের পর তাগিদ, হুঁশ নেই।”
“সত্যি ঠাকুরপাে?”
“বউরানী, খাবার ভালােবাসি নে এতবড়াে তপস্বী নই, কিন্তু তার চেয়ে ভালােবাসি ওঁর মুখের মিষ্টি তাগিদ। সেইজন্যেই ইচ্ছে করে খেতে দেরি হয়ে যায়, বই পড়াটা একটা অছিলে।”
“ওঁর সঙ্গে কথায় হার মানি।”
“আর আমি হার মানি যখন উনি কথা বন্ধ করেন।”
“তাও কখনাে ঘটে নাকি ঠাকুরপাে?”
“দুটো একটা খুব তাজা দৃষ্টান্ত দিই তা হলে। অশ্রুজলের উজ্জ্বল অক্ষরে মনে লেখা রয়েছে।”
“আচ্ছা আচ্ছা, তােমার আর দৃষ্টান্ত দিতে হবে না। এখন আমার চাবি কোথায় বলো। দেখাে তে দিদি, আমার চাবি লুকিয়ে রেখেছেন।”
“ঘরের লােকের নামে তাে পুলিস-কেস করতে পারি নে, তাই চোরকে চুরি দিয়ে শাসন করতে হয়। আগে দাও আমার বই।”
“তােমাকে দেব না, দিদিকে দিচ্ছি।” ঘরের কোণে একটা ঝুড়িতে রেশম-পশম, টুকরা কাপড়, ছেঁড়া মােজা জমে ছিল; তারই তলা থেকে একখানা ইংরেজি সংক্ষিপ্ত এন্সাইক্লোপীডিয়ার দ্বিতীয় খণ্ড বের করে মোতির মা কুমুর কোলের উপর রেখে বললে, “তোমার ঘরে নিয়ে যাও দিদি, ওঁকে দিয়ো না; দেখি তোমার সঙ্গে কী রকম রাগারাগি করেন।”
নবীন মশারির চালের উপর থেকে চাবি তুলে নিয়ে কুমুর হাতে দিয়ে বললে, “আর কাউকে দিয়ো না বউদিদি, দেখব আর কেউ তোমার সঙ্গে কী রকম ব্যবহার করেন।”
কুমু বইয়ের পাতা ওলটাতে ওলটাতে বললে, “এই বইয়ে বুঝি ঠাকুরপোর শখ?”
“ওঁর শখ নেই এমন বই নেই। সেদিন কোথা থেকে একখানা গো-পালন জুটিয়ে নিয়ে পড়তে বসে গেছেন।”
“নিজের দেহরক্ষার জন্যে ওটা পড়ি নে, অতএব এতে লজ্জার কারণ কিছু নেই।”
“দিদি, তোমার কী একটা কথা বলবার আছে। চাও তো, এই বাচালটিকে এখনই বিদায় করে দিই।”
“না, তার দরকার নেই। আমার দাদা দুই-একদিনের মধ্যে আসবেন শুনেছি।”
নবীন বললে, “হাঁ, তিনি কালই আসবেন।”
“কাল!” বিস্মিত হয়ে কুমু খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। নিশ্বাস ফেলে বললে, করে তাঁর সঙ্গে দেখা হবে?”
মোতির মা জিজ্ঞাসা করলে, “তুমি বড়ঠাকুরকে কিছু বল নি?”
কুমু মাথা নেড়ে জানালে যে—না।
নবীন বললে, “একবার বলে দেখবে না?”
কুমু চুপ করে রইল। মধুসূদনের কাছে দাদার কথা বলা বড়ো কঠিন। দাদার প্রতি অপমান ওর ঘরের মধ্যে উদ্যত, তাকে একটুও নাড়া দিতে ওর অসহ্য সংকোচ।
কুমুর মুখের ভাব দেখে নবীনের মন ব্যথিত হয়ে উঠল। বললে, “ভাবনা ক’রো না বউদিদি, আমরা সব ঠিক করে দেব, তোমাকে কিছু বলতে কইতে হবে না।”
দাদার কাছে নবীনের শিশুকাল থেকে অত্যন্ত একটা ভীরুতা আছে। বউদিদি এসে আজ সেই ভয়টা ওর মন থেকে ভাঙালে বুঝি।
কুমু চলে গেলে মোতির মা নবীনকে বললে, “কী উপায় করবে বলো দেখি? সেদিন রাত্রে তোমার দাদা যখন আমাদের ডেকে নিয়ে এসে বউয়ের কাছে নিজেকে খাটো করলেন তখনই বুঝেছিলুম সুবিধে হল না। তার পর থেকে তোমাকে দেখলেই তো মুখ ফিরিয়ে চলে যান।”
“দাদা বুঝেছেন যে, ঠকা হল, ঝোঁকের মাথায় থলি উজাড় করে আগাম দাম দেওয়া হয়ে গেছে, এদিকে ওজনমতো জিনিস মিলল না। আমরা ওঁর বোকামির সাক্ষী ছিলুম তাই আমাদের সইতে পারছেন না।”
মোতির মা বললে, “তা হোক, কিন্তু বিপ্রদাসবাবুর উপরে রাগটা ওঁকে যেন পাগলামির মতো পেয়ে বসেছে, দিনে দিনে বেড়েই চলল। এ কী অনাছিষ্টি বলো দিকি।”
নবীন বললে, “ও মানুষের ভক্তির প্রকাশ ওই রকমই। এই জাতের লোকেরাই ভিতরে ভিতরে যাকে শ্রেষ্ঠ বলে জানে বাইরে তাকে মারে। কেউ কেউ বলে, রামের প্রতি রাবণের অসাধারণ ভক্তি ছিল, তাই বিশ হাত দিয়ে নৈবেদ্য চালাত। অমি তোমাকে বলে দিচ্ছি, দাদার সঙ্গে বউরানীর দেখাসাক্ষাৎ সহজে হবে না।”
“তা বললে চলবে না, কিছু উপায় করতেই হবে।”
“উপায় মাথায় এসেছে।”
“কী বলো দেখি।”
“বলতে পারব না।”
“কেন বলো তো?”
“লজ্জা বোধ করছি।”
“আমাকেও লজ্জা?”
“তোমাকেই লজ্জা।”
“কারণটা শুনি?”
“দাদাকে ঠকাতে হবে। সে তোমার শুনে কাজ নেই।”
“যাকে ভালোবাসি তার জন্যে ঠকাতে একটুও সংকোচ করি নে।”
“ঠকানো বিদ্যেয় আমার উপর দিয়েই হাত পাকিয়েছ বুঝি?”
“ও-বিদ্যে সহজে খাটাবার উপযুক্ত এমন মানুষ পাব কোথায়!”
“ঠাকুরুণ, রাজিনামা লিখে-পড়ে দিচ্ছি, যখন খুশী ঠকিয়ো।”
“এত ফুর্তি কেন শুনি?”
“বলব? বিধাতা তোমাদের হাতে ঠকাবার যে-সব উপায় দিয়েছেন তাতে মধু দিয়েছেন ঢেলে। সেই মধুময় ঠকানোকেই বলে মায়া।”
“সেটা তো কাটানোই ভালো।”
“সর্বনাশ! মায়া গেলে সংসারে রইল কী? মূর্তির রঙ খসিয়ে ফেললে বাকি থাকে খড় মাটি। দেবী, অবোধকে ভোলাও, ঠকাও, চোখে ঘোর লাগাও, মনে নেশা জাগাও, যা খুশি করো।”
এর পরে যা কথাবার্তা চলল সে একেবারেই কাজের কথা নয়, এ গল্পের সঙ্গে তার কোনো যোগ নেই।