◄  ৪০
৪২  ►

৪১

 মীটিঙে এইবার মধুসূদনের প্রথম হার। এ পর্যন্ত ওর কোনো প্রস্তাব, কোনাে ব্যবস্থা কেউ কখনাে টলায় নি। নিজের ’পরে ওর বিশ্বাস যেমন, ওর প্রতি ওর সহযােগীদেরও তেমনি বিশ্বাস। এই ভরসাতেই মীটিঙে কোনাে জরুরি প্রস্তাব পাকা করে নেবার আগেই কাজ অনেকদূর এগিয়ে রাখে। এবারে পুরােনাে নীলকুঠিওআলা একটা পত্তনি তালুক ওদের নীলের কারবারের শামিল কিনে নেবার বন্দোবস্ত করছিল। এ নিয়ে খরচপত্রও হয়ে গেছে। প্রায় সমস্তই ঠিকঠাক; দলিল স্ট্যাম্পে চড়িয়ে রেজেস্টারি করে দাম চুকিয়ে দেবার অপেক্ষা; যে-সব লোক নিযুক্ত করা আবশ্যক তাদের আশা দিয়ে রাখা হয়েছে। এমন সময় এই বাধা। সম্প্রতি ওদের কোনাে ট্রেজারারের পদ খালি হওয়াতে সম্পর্কীয় একটি জামাতার জন্য উমেদারি চলেছিল, অযােগ্য-উদ্ধারণে উৎসাহ না থাকাতে মধুসূদন কান দেয় নি। সেই ব্যাপারটা বীজের মতাে মাটি চাপা থেকে হঠাৎ বিরুদ্ধতার আকারে অঙ্কুরিত হয়ে উঠল। একটু ছিদ্রও ছিল। তালুকের মালেক মধুসূদনের দূরসম্পর্কীয় পিসির ভাশুরপাে। পিসি যখন হাতে-পায়ে এসে ধরে তখন ও হিসেব করে দেখলে, নেহাত সস্তায় পাওয়া যাবে, মুনফাও আছে, তার উপরে আত্মীয়দের কাছে মুরুব্বিয়ান করবার গৌরব। যাঁর অযােগ্য জামাই ট্রেজারার-পদ থেকে বঞ্চিত, তিনিই মধুসূদনের স্বজনবাৎসল্যের প্রমাণ বহু সন্ধানে আবিষ্কার ও যথাস্থানে প্রচার করেছেন। তা ছাড়া কোম্পানির সকল রকম কেনাবেচায় মধুসূদন যে গােপনে কমিশন নিয়ে থাকেন, এই মিথ্যা সন্দেহ কানে-কানে সঞ্চারিত করবার ভারও তিনিই নিয়েছিলেন। এ-সকল নিন্দার প্রমাণ অধিকাংশ লােক দাবি করে না, কারণ তাদের নিজের ভিতরে যে-লোভ আছে সেই হচ্ছে অন্তরতম ও প্রবলতম সাক্ষী। লােকের মনকে বিগড়িয়ে দেওয়া একটা কারণে সহজ ছিল, সে কারণ হচ্ছে মধুসূদনের অসামান্য শ্রীবৃদ্ধি, এবং তার খাঁটি চরিত্রের অসহ্য সুখ্যাতি। মধুসূদনও ডুবে ডুবে জল খায় এই অপবাদে সেই লােলুপরা পরম শান্তি পেল, গভীর জলে ডুব দেবার আকাঙ্ক্ষায় যাদের মনটা পানকৌড়ি-বিশেষ অথচ হাতের কাছে যাদের জলাশয় নেই।

 মালেককে মধুসূদন পাকা কথা দিয়েছিল। ক্ষতির আশঙ্কায় কথা খেলাপ করবার লােক সে নয়। তাই নিজে কিনবে ঠিক করেছে, আর পণ করেছে কোম্পানিকে দেখিয়ে দেবে, না কিনে তারা ঠকল।

 মধুসূদন বাড়ি ফিরে এল। নিজের ভাগ্যের প্রতি মধুসূদনের অন্ধ বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিল, আজ তার ভয় লাগল যে, জীবনযাত্রার গাড়িটাকে অদৃষ্ট এক পর্যায়ের লাইন থেকে আর-এক পর্যায়ের লাইনে চালান করে দিচ্ছে বা। প্রথম ঝাঁকানিতেই বুকটা ধড়াস করে উঠল। মীটিং থেকে ফিরে এসে আপিস-ঘরে কেদারা হেলান দিয়ে গুড়গুড়ির ধূমকুণ্ডলের সঙ্গে নিজের কালাে রঙের চিন্তাকে কুণ্ডলায়িত করতে লাগল।

 নবীন এসে খবর দিলে, বিপ্রদাসের বাড়ি থেকে লােক এসেছে দেখা করতে। মধুসূদন ঝেঁকে উঠে বললে, “যেতে বলে দাও, আমার এখন সময় নেই।”

 নবীন মধুসূদনের ভাবগতিক দেখে বুঝলে, মীটিঙে একটা অপঘাত ঘটেছে। বুঝলে দাদার মন এখন দুর্বল। দৌর্বল্য স্বভাবত অনুদার, দুর্বলের আত্মগরিমা ক্ষমাহীন নিষ্ঠুরতার রূপ ধরে। দাদার আহত মন বউরানীকে কঠিনভাবে আঘাত করতে চাইবে এতে নবীনের সন্দেহমাত্র ছিল না। এ আঘাত যে করেই হােক ঠেকাতেই হবে। এর পূর্ব পর্যন্ত ওর মনে দ্বিধা ছিল, সে দ্বিধা সম্পূর্ণ গেল কেটে। কিছুক্ষণ ঘুরে ফিরে আবার ঘরে এসে দেখলে, ওর দাদা ঠিকানাওআলা নামের ফর্দর খাতা নিয়ে পাতা ওলটাচ্ছে। নবীন এসে দাঁড়াতেই মধুসূদন মুখ তুলে রুক্ষ স্বরে জিজ্ঞাসা করলে, “আবার কিসের দরকার? তোমাদের বিপ্রদাসবাবুর মোক্তারি করতে এসেছ বুঝি?”

 নবীন বললে, “না দাদা, সে-ভয় নেই। ওঁদের লোকটা এমন তাড়া খেয়ে গেছে যে, তুমি নিজেও যদি ডেকে পাঠাও তবু সে এ-বাড়িমুখো হবে না।”

 এ-কথাটাও মধুসূদনের সহ্য হল না। বলে উঠল, “কড়ে আঙুলটা নাড়লেই পায়ের কাছে এসে পড়তে হবে। লোকটা এসেছিল কী করতে?”

 “তোমাকে খবর দিতে যে, বিপ্রদাসবাবুর কলকাতা আসা দুদিন পিছিয়ে গেল। শরীর আর-একটু সেরে তবে আসবেন।”

 “আচ্ছা আচ্ছা, সেজন্যে আমার তাড়া নেই।”

 নবীন বললে, “দাদা, কাল সকালে ঘণ্টা দুয়ের জন্যে ছুটি চাই।”

 “কেন?”

 “শুনলে তুমি রাগ করবে।”

 “না শুনলে আরও রাগ করব।”

 “কুম্ভকোনাম থেকে এক জ্যোতিষী এসেছেন, তাঁকে দিয়ে একবার ভাগাপরীক্ষা করাতে চাই।”

 মধুসূদনের বুকটা ধড়াস করে উঠল, ইচ্ছে করল এখনই ছুটে তার কাছে যায়। মুখে তর্জন করে বললে, “তুমি বিশ্বাস কর?”

 “সহজ অবস্থায় করি নে, ভয় লাগলেই করি।”

 “ভয়টা কিসের শুনি।”

 নবীন কোনো জবাব না করে মাথা চুলকোতে লাগল।

 “ভয়টা কাকে বলোই না।”

 “এ-সংসারে তোমাকে ছাড়া আর কাউকে ভয় করি নে। কিছুদিন থেকে তোমার ভাবগতিক দেখে মন সুস্থির হচ্ছে না।”

 সংসারের লোক মধুসূদনকে বাঘের মতো ভয় করে এইটেতে তার ভারি তৃপ্তি। নবীনের মুখের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে গভীরভাবে সে গুড়গুড়ি টানতে টানতে নিজের মাহাত্ম্য অনুভব করতে লাগল।

 নবীন বললে, “তাই একবার স্পষ্ট করে জানতে চাই, গ্রহ কী করতে চান আমাকে নিয়ে। আর তিনি ছুটিই-বা দেবেন কোন্ নাগাত।”

 “তোমার মতো নাস্তিক, তুমি কিছু বিশ্বাস কর না, শেষকালে—”

 “দেবতার পরে বিশ্বাস থাকলে গ্রহকে বিশ্বাস করতুম না দাদা। ডাক্তারকে যে মানে না হাতুড়েকে মানতে তার বাধে না।”

 নিজের গ্রহকে যাচাই করে নেবার জন্যে মধুসূদনের যে পরিমাণ আগ্রহ হল, সেই পরিমাণ ঝাঁজের সঙ্গে বললে, “লেখাপড়া শিখে বাঁদর, তোমার এই বিদ্যে? যে যা বলে তাই বিশ্বাস কর?”

 “লোকটার কাছে যে ভৃগুসংহিতা রয়েছে—যেখানে যে-কেউ যে-কোনো কালে জন্মেছে, জন্মাবে, সকলের কুষ্ঠি একেবারে তৈরি, সংস্কৃত ভাষায় লেখা, এর উপর তো আর কথা চলে না। হাতে-হাতে পরীক্ষা করে দেখে নাও।”

 “বোকা ভুলিয়ে যারা খায়, বিধাতা তাদের পেট ভরাবার জন্যে যথেষ্ট পরিমাণে তোমাদের মতো বোকাও সৃষ্টি করে রাখেন।”

 “আবার সেই বোকাদের বাঁচাবার জন্যে তোমাদের মতো বুদ্ধিমানও সৃষ্টি করেন। যে মারে তার উপরে তাঁর যেমন দয়া, যাকে মারে তার উপরেও তেমনি। ভৃগুসংহিতার উপরে তোমার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি চালিয়ে দেখোই না।”

 “আচ্ছা বেশ, কাল সকালেই আমায় নিয়ে যেয়ো, দেখব তোমার কুম্ভকোনামের চালাকি।”

 “তোমার যে-রকম জোর অবিশ্বাস দাদা, ওতে গণনায় গোল হয়ে যেতে পারে। সংসারে দেখা যায় মানুষকে বিশ্বাস করলে মানুষ বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। গ্রহদেরও ঠিক সেই দশা, দেখো না কেন সাহেবগুলো গ্রহ মানে না বলে গ্রহের ফল ওদের উপর খাটে না। সেদিন তেরোস্পর্শে বেরিয়ে তোমাদের ছোটোসায়েব ঘোড়দৌড়ে বাজি জিতে এল—আমি হলে বাজি জেতা দুরস্তাং ঘোড়াটা ছিটকে এসে আমার পেটে লাথি মেরে যেত। দাদা, এই-সব গ্রহনক্ষত্রের হিসেবের উপর তোমাদের বুদ্ধি খাটাতে যেয়ো না, একটু বিশ্বাস মনে রেখো।”

 মধুসূদন খুশি হয়ে স্মিতহাস্যে গুড়গুড়িতে মনোযোগ দিলে।

 পরদিন সকাল সাতটার মধ্যে মধুসূদন নবীনের সঙ্গে এক সরু গলির আবর্জনার ভিতর দিয়ে বেঙ্কট শাস্ত্রীর বাসায় গিয়ে উপস্থিত। অন্ধকার একতলার ভাপসা ঘর; লোনা-ধরা দেয়াল ক্ষতবিক্ষত, যেন সাংঘাতিক চর্মরোগে আক্রান্ত, তক্তপোশের উপর ছিন্ন মলিন একখানা শতরঞ্চ, এক প্রান্তে কতকগুলো পুঁথি এলোমেলো জড়ো-করা, দেয়ালের গায়ে শিবপার্বতীর এক পট। নবীন হাঁক দিলে, “শাস্ত্রীজি”। ময়লা ছিটের বালাপোশ গায়ে, সামনের মাথা কামানো, ঝুঁটিওআলা, কালো বেঁটে বোগা এক ব্যক্তি ঘরে এসে ঢুকল; নবীন তাকে ঘটা করে প্রণাম করলে। চেহারা দেখে মধুসূদনের একটুও ভক্তি হয় নি—কিন্তু দৈবের সঙ্গে দৈবজ্ঞের কোনোরকম ঘনিষ্ঠতা আছে জেনে ভয়ে-ভয়ে তাড়াতাড়ি একটা আধাআধি রকম অভিবাদন সেরে নিলে। নবীন মধুসূদনের একটি ঠিকুজি জ্যোতিষীর সামনে ধরতেই সেটা অগ্রাহ্য করে শাস্ত্রী মধুসূদনের হাত দেখতে চাইল। কাঠের বাক্স থেকে কাগজ-কলম বের করে নিয়ে নিজে একটা চক্র তৈরি করে নিলে। মধুসূদনের মুখের দিকে চেয়ে বললে, “পঞ্চম বর্গ।” মধুসূদন কিছুই বুঝলে না। জ্যোতিষী আঙুলের পর্ব গুনতে গুনতে আউড়ে গেল, কবর্গ, চবর্গ, টবর্গ, তবর্গ, পবর্গ। এতেও মধুসূদনের বুদ্ধি খােলসা হল না। জ্যোতিষী বললে, “পঞ্চম বর্ণ।” মধুসূদন ধৈর্য ধরে চুপ করে রইল। জ্যোতিষী আওড়াল, প ফ ব ভ ম। মধুসূদন এর থেকে এইটুকু বুঝলে যে, ভৃগুমুনি ব্যাকরণের প্রথম অধ্যায় থেকেই তার সংহিতা শুরু করেছেন। এমন সময় বেঙ্কট শাস্ত্রী বলে উঠল, “পঞ্চাক্ষরকং।”

 নবীন চকিত হয়ে মধুসূদনের কানের কাছে চুপি চুপি বললে, “বুঝেছি দাদা।”

 “কী বুঝলে?”

 “পঞ্চম বর্গের পঞ্চম বর্ণ ম, তার পরে পঞ্চ অক্ষর ম-ধু-সূ-দ-ন। জন্ম-গ্রহের অদ্ভুত কৃপায় তিনটে পাঁচ এক জায়গায় মিলেছে।”

 মধুসূদন স্তম্ভিত। বাপ-মায়ে নাম রাখবার কত হাজার বছর আগেই নামকরণ ভৃগুমুনির খাতায়! নক্ষত্রদের এ কী কাণ্ড! তার পরে হতবুদ্ধি হয়ে শুনে গেল ওর জীবনের সংক্ষিপ্ত অতীত ইতিহাস, সংস্কৃত ভাষায় রচিত। ভাষা যত কম বুঝলে, ভক্তি ততই বেড়ে উঠল। জীবনটা আগাগােড়া ঋষিবাক্য মূর্তিমান। নিজের বুকের উপর হাত বুলিয়ে দেখলে, দেহটা অনুস্বার-বিসর্গ-তদ্ধিত-প্রত্যয়ের মসলা দিয়ে তৈরি কোন্ তপােবনে লেখা একটা পুঁথির মতাে। তার পর দৈবজ্ঞের শেষ কথাটা এই যে, মধুসূদনের ঘরে একদা লক্ষ্মীর আবির্ভাব হবে বলে পূর্ব হতেই ঘরে অভাবনীয় সৌভাগ্যের সূচনা। অল্পদিন হল তিনি এসেছেন নববধূকে আশ্রয় করে। এখন থেকে সাবধান। কেননা ইনি যদি মনঃপীড়া পান, ভাগ্য কুপিত হবে।

 বেঙ্কট শাস্ত্রী বললে, কোপের লক্ষণ দেখা দিয়েছে। জাতক যদি এখনও সতর্ক না হয় বিপদ বেড়ে চলবে। মধুসূদন স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল। মনে পড়ে গেল বিবাহের দিনেই প্রকাণ্ড সেই মুনফার খবর; আর তার কয়দিনের মধ্যেই এই পরাভব। লক্ষ্মী স্বয়ং আসেন সেটা সৌভাগ্য, কিন্তু তার দায়িত্বটা কম ভয়ংকর নয়।

 ফেরবার সময় মধুসূদন গাড়িতে স্তব্ধ হয়েই বসে রইল। এক সময় নবীন বলে উঠল, “ওই বেঙ্কট শাস্ত্রীর কথা একটুও বিশ্বাস করি নে; নিশ্চয় ও কারও কাছ থেকে তােমার সমস্ত খবর পেয়েছে।”

 “ভারি বুদ্ধি তােমার! যেখানে যত মানুষ আছে আগেভাগে তার খবর নিয়ে রেখে দিচ্ছে; সােজা কথা কিনা!”

 “মানুষ জন্মাবার আগেই তার কোটি কোটি কুষ্ঠি লেখার চেয়ে এটা অনেক সােজা। ভৃগুমুনি এত কাগজ পাবেন কোথায়, আর বেঙ্কট স্বামীর ওই ঘরে এত জায়গা হবে কেমন করে?”

 এক আঁচড়ে হাজারটা কথা লিখতে জানতেন তাঁরা।”

 “অসম্ভব।”

 “যা তােমার বুদ্ধিতে কুলােয় না তাই অসম্ভব। ভারি তােমার সায়ান্স! এখন তর্ক রেখে দাও, সেদিন ওদের বাড়ি থেকে যে-সরকার এসেছিল, তাকে তুমি নিজে গিয়ে ডেকে এনাে। আজই, দেরি করাে না।”

 দাদাকে ঠকিয়ে নবীনের মনের ভিতরটাতে অত্যন্ত অস্বস্তি বােধ হতে লাগল। ফন্দিটা এত সহজ, এর সফলতাটা দাদার পক্ষে এত হাস্যকর যে, তারই অমর্যাদায় ওকে লজ্জা ও কষ্ট দিলে। দাদাকে উপস্থিতমতো ছোটো অনেক ঝুঁকি অনেকবার দিতে হয়েছে, কিছু মনে হয় নি; কিন্তু এত করে সাজিয়ে এতবড়ো ফাঁকি গড়ে তোলার গ্লানি ওর চিত্তকে অশুচি করে রেখে দিলে।