◄  ৪১
৪৩  ►

৪২

 মধুসূদনের মন থেকে মস্ত একটা ভার গেল নেমে, আত্মগৌরবের ভার—যে-কঠোরগৌরব-বোধ ওর বিকাশোন্মুখ অনুরক্তিকে কেবলই পাথর-চাপা দিয়েছে। কুমুর প্রতি ওর মন যখন মুগ্ধ তখনও সেই বিহ্বলতার বিরুদ্ধে ভিতরে ভিতরে চলেছিল লড়াই। যতই অনন্যগতি হয়ে কুমুর কাছে ধরা দিয়েছে, ততই নিজের অগোচরে কুমুর ’পরে ওর ক্রোধ জমেছে। এমন সময়ে স্বয়ং নক্ষত্রদের কাছ থেকে যখন আদেশ এল যে লক্ষ্মী এসেছেন ঘরে, তাঁকে খুশি করতে হবে, সকল দ্বন্দ্ব ঘুচে গিয়ে ওর দেহমন যেন রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল; বার বার আপন মনে আবৃত্তি করতে লাগল—লক্ষ্মী, আমারই ঘরে লক্ষ্মী, আমার ভাগ্যের পরম দান। ইচ্ছে করতে লাগল, এখনই সমস্ত সংকোচ ভাসিয়ে দিয়ে কুমুর কাছে স্তুতি জানিয়ে আসে, বলে আসে, “যদি কোনো ভুল করে থাকি, অপরাধ নিয়ো না।” কিন্তু আজ আর সময় নেই, ব্যবসায়ের ভাঙন সারবার কাজে এখনই আপিসে ছুটতে হবে, বাড়িতে খেয়ে যাবার অবকাশ পর্যন্ত জুটল না।

 এদিকে সমস্তদিন কুমুর মনের মধ্যে তোলপাড় চলেছে। জানে কাল দাদা আসবেন, শরীর তাঁর অসুস্থ। তাঁর সঙ্গে দেখাটা সহজ হবে কি না নিশ্চিত জানবার জন্যে মন উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। নবীন কোথায় কাজে গেছে, এখনও এল না। সে নিঃসন্দেহ জানত আজ স্বয়ং মধুসূদন এসে বউরানীকে সকল রকমে প্রসন্ন করবে; আগেভাগে কোনো আভাস দিয়ে রসভঙ্গ করতে চায় না।

 আজ ছাতে বসবার সুবিধা ছিল না। কাল সন্ধ্যা থেকে মেঘ করে আছে, আজ দুপুর থেকে টিপ টিপ করে বৃষ্টি শুরু হল। শীতকালের বাদলা, অনিচ্ছিত অতিথির মতো। মেঘে রঙ নেই, বৃষ্টিতে ধ্বনি নেই, ভিজে বাতাসটা যেন মন-মরা, সূর্যালোেকহীন আকাশের দৈন্যে পৃথিবী সংকুচিত। সিঁড়ি থেকে উঠেই শোবার ঘরে ঢোকবার পথে যে-ঢাকা ছাদ আছে সেইখানে কুমু মাটিতে বসে। থেকে-থেকে গায়ে বৃষ্টির ছাঁট আসছে। আজ এই ছায়াম্লান আর্দ্র একঘেয়ে দিনে কুমুর মনে হল, তার নিজের জীবনটা তাকে যেন অজগরের মতো গিলে ফেলেছে, তারই ক্লেদাক্ত জঠরের রুদ্ধতার মধ্যে কোথাও একটুমাত্র ফাঁক নেই। যে-দেবতা ওকে ভুলিয়ে আজ এই নিরুপায় নৈরাশ্যের মধ্যে এনে ফেললে তার উপরে যে-অভিমান ওর মনে ধোঁয়াচ্ছিল আজ সেটা ক্রোধের আগুনে জ্বলে উঠল। হঠাৎ দ্রুত উঠে পড়ল। খুলে বের করলে সেই যুগল-রূপের পট। রঙিন রেশমের ছিট দিয়ে সেটা মোড়া। সেই পট আজ ও নষ্ট করে ফেলতে চায়। যেন চীৎকার করে বলতে চায়, তোমাকে আমি একটুও বিশ্বাস করি নে। হাত কাঁপছে, তাই গ্রন্থি খুলতে পারছে না; টানাটানিতে সেটা আঁট হয়ে উঠল, অধীর হয়ে দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ফেললে। অমনি চিরপরিচিত সেই মূর্তি অনাবৃত হতেই আর সে থাকতে পারলে না! তাকে বুকে চেপে ধরে কেঁদে উঠল। কাঠের ফ্রেম বুকে যত বাজে ততই আরও বেশি চেপে ধর।

 এমন সময়ে শোবার ঘরে এল মুরলী বেহারা বিছানা করতে। শীতে কাঁপছে তার হাত। গায়ে একখানা জীর্ণ ময়লা ব্যাপার। মাথায় টাক, রগ টেপা, গাল বসা, কিছুকালের না-কামানো কঁচাপাকা দাড়ি খোঁচা খোঁচা হয়ে উঠেছে। অনতিকাল পূর্বেই সে ম্যালেরিয়ায় ভুগেছিল, শরীরে রক্ত নেই বললেই হয়, ডাক্তার বলেছিল কাজ ছেড়ে দিয়ে দেশে যেতে, কিন্তু নিষ্ঠুর নিয়তি!

 কুমু বললে, “শীত করছে মুরলী?”

 “মা, বাদল করে ঠাণ্ডা পড়েছে।”

 “গরম কাপড় নেই তোমার?”

 “খেতাব পাবার দিনে মহারাজা দিয়েছিলেন, নাতির খাঁসির বেমারি হতেই ডাক্তারের কথায় তাকে দিয়েছি মা।”

 কুমু একটি পুরোনো ছাই রঙের আলোয়ান পাশের ঘরের আলমারি থেকে বের করে এনে বললে, “আমার এই কাপড়টি তোমাকে দিলুম।”

 মুরলী গড় হয়ে বললে, “মাপ করো মা, মহারাজা রাগ করবেন।”

 কুমুর মনে পড়ে গেল, এ-বাড়িতে দয়া করবার পথ সংকীর্ণ। কিন্তু ঠাকুরের কাছ থেকে নিজের জন্যেও যে ওর দয়া চাই, পুণ্যকর্ম তারই পথ। কুমু ক্ষোভের সঙ্গে আলোয়ানটা মাটিতে ফেলে দিলে।

 মুরলী হাত জোড় করে বললে, “রানীমা, তুমি মা লক্ষ্মী, রাগ ক’রো না। গরম কাপড়ে আমার দরকার হয় না। আমি থাকি হুঁকাবদারের ঘরে, সেখানে গামলায় গুলের আগুন, আমি বেশ গরম থাকি।”

 কুমু বললে, “মুরলী, নবীন ঠাকুরপো যদি বাড়ি এসে থাকেন তাঁকে ডেকে দাও।”

 নবীন ঘরে ঢুকতেই কুমু বললে, “ঠাকুরপো, তোমাকে একটি কাজ করতেই হবে। বলো, করবে?”

 “নিজের অনিষ্ট যদি হয় এখনই করব, কিন্তু তোমার অনিষ্ট হলে কিছুতেই করব না।”

 “আমার আর কত অনিষ্ট হবে? আমি ভয় করি নে।” বলে নিজের হাত থেকে মোটা সোনার বালাজোড়া খুলে বললে, “আমার এই বালা বেচে দাদার জন্যে স্বস্ত্যয়ন করাতে হবে।”

 “কিছু দরকার হবে না, বউরানী, তুমি তাঁকে যে ভক্তি কর তারই পুণ্যে প্রতিমুহূর্তে তাঁর জন্যে স্বস্ত্যয়ন হচ্ছে।”

 “ঠাকুরপো, দাদার জন্যে আর কিছুই করতে পারব না। কেবল যদি পারি দেবতার দ্বারে তাঁর জন্যে সেবা পৌঁছিয়ে দেব।”

 “তোমাকে কিছু করতে হবে না, বউরানী। আমরা সেবক আছি কী করতে?”

 “তোমরা কী করতে পার বলো?”

 “আমরা পাপিষ্ঠ, পাপ করতে পারি। তাই করেও যদি তোমার কোনো কাজে লাগি তাহলে ধন্য হব।”

 “ঠাকুরপো, এ-কথা নিয়ে ঠাট্টা ক’রো না।”

 “একটুও ঠাট্টা নয়। পুণ্য করার চেয়ে পাপ করা অনেক শক্ত কাজ, দেবতা যদি তা বুঝতে পারেন তাহলে পুরস্কার দেবেন।”

 নবীনের কথার ভাবে দেবতার প্রতি উপেক্ষা কল্পনা করে কুমুর মনে স্বভাবত আঘাত লাগতে পারত, কিন্তু তার দাদাও যে মনে মনে দেবতাকে শ্রদ্ধা করে না, এই অভক্তির ’পরে সে রাগ করতে পারে না যে। ছোটো ছেলের দুষ্টমির ’পরেও মায়ের যেমন সকৌতুক স্নেহ, এই রকম অপরাধের পরে ওরও সেই ভাব।

 কুমু একটু ম্লান হাসি হেসে বললে, “ঠাকুরপো, সংসারে তোমরা নিজের জোরে কাজ করতে পার; আমাদের যে সেই নিজের জোর খাটাবার জো নেই। যাদের ভালোবাসি অথচ নাগাল মেলে না, তাদের কাজ করব কী করে? দিন যে কাটে না, কোথাও যে রাস্তা খুঁজে পাই নে। আমাদের কি দয়া করবার কোথাও কেউ নেই?”

 নবীনের চোখ জলে ভেসে উঠল।

 “দাদাকে উদ্দেশ করে আমাকে কিছু করতেই হবে ঠাকুরপো, কিছু দিতেই হবে। এই বালা আমার মায়ের, সেই আমার মায়ের হয়েই এ বালা আমার দেবতাকে আমি দেব।”

 “দেবতাকে হাতে করে দিতে হয় না বউরানী, তিনি এমনি নিয়েছেন। দুদিন অপেক্ষা করো, যদি দেখ তিনি প্রসন্ন হন নি, তাহলে যা বলবে তাই করব। যে-দেবতা তোমাকে দয়া করেন না তাঁকেও ভোগ দিয়ে, আসব।”

 রাত্রি অন্ধকার হয়ে এল —বাইরে সিঁড়িতে ওই সেই পরিচিত জুতোর শব্দ। নবীন চমকে উঠল, বুঝলে দাদা আসছে। পালিয়ে গেল না, সাহস করে দাদার জন্যে অপেক্ষা করেই রইল। এদিকে কুমুর মন এক মুহূর্তে নিরতিশয় সংকুচিত হয়ে উঠল। এই অদৃশ্য বিরোধের ধাক্কাটা এমন প্রবল বেগে যখন তার প্রত্যেক নাড়িকে চমকিয়ে তুললে, বড়ো ভয় হল। এ পাপ কেন তাকে এত দুর্জয় বলে পেয়ে বসেছে?

 হঠাৎ কুমু নবীনকে জিজ্ঞাসা করলে, “ঠাকুরপো, কাউকে জান যিনি আমাকে গুরুর মতো উপদেশ দিতে পারেন?”

 “কী হবে বউরানী?”

 “নিজের মনকে নিয়ে যে পেরে উঠছি নে।”

 “সে তোমার মনের দোষ নয়।”

 “বিপদটা বাইরের, দোষটা মনের, দাদার কাছে এই কথা বার বার শুনেছি।”

 “তোমার দাদাই তোমাকে উপদেশ দেবেন— ভয় ক’রো না।”

 “সেদিন আমার আর আসবে না।”

 মধুসূদনের বিষয়বুদ্ধির সঙ্গে তার ভালোবাসার আপস হয়ে যেতেই সেই ভালোবাসা মধুসূদনের সমস্ত কাজকর্মের উপর দিয়েই যেন উপচে বয়ে যেতে লাগল। কুমুর সুন্দর মুখে তার ভাগ্যের বরাভয় দান। পরাভবটি কেটে যাবে আজই পেল তার আভাস। কাল যারা বিরুদ্ধে মত দিয়েছিল আজ তাদেরই মধ্যে কেউ কেউ সুর ফিরিয়ে ওকে চিঠি লিখেছে। মধুসূদন যেই তালুকটা নিজের নামে কিনে নেবার প্রস্তাব করলে অমনি কারও কারও মনে হল ঠকলুম বুঝি। কেউ কেউ এমনও ভাব প্রকাশ করলে যে, কথাটা আর-একবার বিচার করা উচিত।

 গরহাজির অপরাধে আপিসের দরোয়ানের অর্ধেক মাসের মাইনে কাটা গিয়েছিল, আজ টিফিনের সময় মধুসূদনের পা জড়িয়ে ধরবামাত্র মধুসূদন তাকে মাপ করে দিলে। মাপ করবার মানে নিজের পকেট থেকে দরোয়ানের ক্ষতিপূরণ; যদিচ খাতায় জরিমানা রয়ে গেল। নিয়মের ব্যত্যয় হবার জো নেই।

 আজকের দিনটা মধুর পক্ষে বড়ো আশ্চর্যের দিন। বাইরে আকাশটা মেঘে ঘোলা, টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে, কিন্তু এতে করে ওর ভিতরের আনন্দ আরও বাড়িয়ে দিলে। আপিস থেকে ফিরে এসে রাত্রে আহারের সময়ের পূর্ব পর্যন্ত মধুসূদন বাইরের ঘরে কাটাত। বিয়ের পরে কয়দিন অসময়ে নিয়মের বিরুদ্ধে অন্তঃপুরে যাবার বেলায় লোকের দৃষ্টি এড়াবার চেষ্টা করেছে। আজ সশব্দ পদক্ষেপে বাড়িসুদ্ধ সবাইকে যেন জানিয়ে দিতে চাইলে যে, সে চলেছে কুমুর সঙ্গে দেখা করতে। আজ বুঝেছে, পৃথিবীর লোকে ওকে ঈর্ষা করতে পারে এতবড়ো ওর সৌভাগ্য।

 খানিকক্ষণের জন্যে বৃষ্টি ধরে গেছে। তখনও সব ঘরে আলো জ্বলে নি। আন্দিবুড়ি ধুনুচি হাতে ধুনো দিয়ে বেড়াচ্ছে; একটা চামচিকে উঠোনের উপরের আকাশ থেকে লণ্ঠনজ্বালা অন্তঃপুরের পথ পর্যন্ত কেবলই চক্রপথে ঘুরছে। বারান্দায় পা মেলে দিয়ে দাসীরা উরুর উপরে প্রদীপের সলতে পাকাচ্ছিল, তাড়াতাড়ি উঠে ঘােমটা টেনে দৌড় দিলে। পায়ের শব্দ পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল শ্যামাসুন্দরী, হাতে বাটাতে ছিল পান। মধুসূদন আপিস থেকে এলে নিয়মমতাে এই পান সে বাইরে পাঠিয়ে দিত। সবাই জানে, ঠিক মধুসূদনের রুচির মতাে পান শ্যামাসুন্দরীই সাজতে পারে; এইটে জানার মধ্যে আরও কিছু-একটা জানার ইশারা ছিল। সেই জোরে পথের মধ্যে শ্যামা মধুর সামনে বাটা খুলে ধরে বললে, “ঠাকুরপাে, তােমার পান সাজা আছে, নিয়ে যাও।” আগে হলে এই উপলক্ষে দুটো-একটা কথা হত, আর সেই কথায় অল্প একটু মধুর রসের আমেজও লাগত। আজ কী হল কে জানে পাছে দুর থেকেও শ্যামার ছোঁয়া লাগে সেইটে এড়িয়ে পান না নিয়ে মধুসূদন দ্রুত চলে গেল। শ্যামার বড়াে বড়াে চোখদুটো অভিমানে জ্বলে উঠল, তার পর ভেসে গেল অশ্রুজলের মােটা মােটা ফোঁটায়। অন্তর্যামী জানেন, শ্যামাসুন্দরী মধুসূদনকে ভালােবাসে।

 মধুসূদন ঘরে ঢুকতেই নবীন কুমুর পায়ের ধুলাে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললে, “গুরুর কথা মনে রইল, খোঁজ করে দেখব।” দাদাকে বললে, “বউরানী গুরুর কাছ থেকে শাস্ত্র-উপদেশ শুনতে চান। আমাদের গুরুঠাকুর আছেন, কিন্তু—”

 মধুসুদন উত্তেজনার স্বরে বলে উঠল, “শাস্ত্র-উপদেশ! আচ্ছা সে দেখব এখন, তােমাকে কিছু করতে হবে না।”

 নবীন চলে গেল।

 মধুসূদন আজ সমস্ত পথ মনে মনে আবৃত্তি করতে করতে এসেছিল, “বড়ােবউ, তুমি এসেছ, আমার ঘর আলাে হয়েছে।” এ-রকম ভাবের কথা বলবার অভ্যাস ওর একেবারেই নেই। তাই ঠিক করেছিল, ঘরে ঢুকেই দ্বিধা না করে প্রথম ঝোঁকেই সে বলবে। কিন্তু নবীনকে দেখেই কথাটা গেল ঠেকে। তার উপর এল শাস্ত্র-উপদেশের প্রসঙ্গ, ওর মুখ দিলে একেবারে বন্ধ করে। অন্তরে যে আয়ােজনটা চলছিল, এই একটুখানি বাধাতেই নিরস্ত হয়ে গেল। তার পরে কুমুর মুখে দেখলে একটা ভয়ের ভাব, দেহমনের একটা সংকোচ। অন্যদিন হলে এটা চোখে পড়ত না। আজ ওর মনে যে একটা আলাে জ্বলেছে তাতে দেখবার শক্তি হয়েছে প্রবল, কুমু সম্বন্ধে চিত্তের স্পর্শবােধ হয়েছে সুক্ষ্ম। আজকের দিনেও কুমুর মনে এই বিমুখতা, এটা ওর কাছে নিষ্ঠুর অবিচার বলে ঠেকল। তবু মনে-মনে পণ করলে, বিচলিত হবে না, কিন্তু যা সহজে হতে পারত সে আর সহজ রইল না।

 একটু চুপ করে থেকে মধুসূদন বললে, “বড়ােবউ, চলে যেতে ইচ্ছে করছ? একটুক্ষণ থাকবে না?”

 মধুসূদনের কথা আর তার গলার স্বর শুনে কুমু বিস্মিত। বললে, “না, যাব কেন?”

 “তােমার জন্যে একটি জিনিস এনেছি খুলে দেখাে।” বলে তার হাতে ছােটো একটি সােনার কৌটো দিলে।

 কৌটো খুলে কুমু দেখলে দাদার দেওয়া সেই নীলার আংটি। বুকের মধ্যে ধক করে উঠল, কী করবে ভেবে পেল না।

 “এই আংটি তােমায় পরিয়ে দিতে দেবে?”

 কুমু হাত বাড়িয়ে দিলে। মধুসূদন কুমুর হাত কোলের উপর ধরে খুব আস্তে আস্তে আংটি পরাতে লাগল। ইচ্ছে করেই সময় নিলে একটু বেশি। তার পরে হাতটি তুলে ধরে চুমাে খেলে, বললে, “ভুল করেছিলুম তােমার হাতের আংটি খুলে নিয়ে। তোমার হাতে কোনো জহরতে কোনো দোষ নেই।”

 কুমুকে মারলে এর চেয়ে কম বিস্মিত হত। ছেলেমানুষের মতো কুমুর এই বিস্ময়ের ভাব দেখে মধুসূদনের লাগল ভালো। দানটা যে সামান্য নয় কুমুর মুখভাবে তা সুস্পষ্ট। কিন্তু মধুসূদন আরও কিছু হাতে রেখেছে, সেইটে প্রকাশ করলে, বললে, “তোমাদের বাড়ির কালু মুখুজ্যে এসেছে, তাকে দেখতে চাও?”

 কুমুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললে, “কালুদা?”

 “তাকে ডেকে দিই। তোমরা কথাবার্তা কও, ততক্ষণ আমি খেয়ে আসি গে।”

 কৃতজ্ঞতায় কুমুর চোখ ছল ছল করে এল।