◄  ৪২
৪৪  ►

৪৩

 চাটুজ্যে জমিদারদের সঙ্গে কালুর পুরুষানুক্রমিক সম্বন্ধ। সমস্ত বিশ্বাসের কাজ এর হাত দিয়েই সম্পন্ন হয়। এর কোনো এক পূর্বপুরুষ চাটুজ্যেদের জন্যে জেল খেটেছে। কালু আজ বিপ্রদাসের হয়ে এক কিস্তি সুদ দিয়ে রসিদ নিতে মধুসূদনের আপিসে এসেছিল। বেঁটে, গৌরবর্ণ, পরিপুষ্ট চেহারা, ঈষৎ কটা ড্যাবড্যাবা চোখ, তার উপরে ঝুঁকে-পড়া রোমশ কাঁচাপাকা মোটা ভুরু, মস্ত ঘন পাকা গোঁফ, অথচ মাথার চুল প্রায় কাঁচা, সযত্নে কোঁচানো শান্তিপুরে ধুতি পরা এবং প্রভু-পরিবারের মর্যাদা রক্ষার উপযুক্ত পুরানো দামি জামিয়ার গায়ে। আঙুলে একটা আংটি—তার পাথরটা নেহাত কম দামি নয়।

 কালু ঘরে প্রবেশ করতে কুমু তাকে প্রণাম করলে। দুজনে বসল কার্পেটের উপর। কালু বললে “ছোটো খুকী, এইতো সেদিন চলে এলে দিদি, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন কত বৎসর দেখি নি।”

 “দাদা কেমন আছেন আগে বলো।”

 “বড়োবাবুর জন্যে বড়ো ভাবনায় কেটেছে। তুমি যেদিন চলে এলে তার পরের দিনে খুব বাড়াবাড়ি হয়েছিল। কিন্তু অসম্ভব জোরালো শরীর কিনা, দেখতে-দেখতে সামলে নিলেন। ডাক্তাররা আশ্চর্য হয়ে গেছে।”

 “দাদা কাল আসছেন?”

 “তাই কথা ছিল। কিন্তু আরও দুটো দিন দেরি হবে। পূর্ণিমা পড়েছে, সকলে তাকে বারণ করলে, কী জানি যদি আবার জ্বর আসে। সে যেন হল, কিন্তু তুমি কেমন আছ দিদি?”

 “আমি বেশ ভালোই আছি।”

 কালু কিছু বলতে ইচ্ছে করল না, কিন্তু কুমুর মুখের সে-লাবণ্য গেল কোথায়? চোখের নীচে কালি কেন? অমন চিকন রঙ তার ফ্যাকাশে হয়ে গেল কী জন্যে? কুমুর মনে একটা প্রশ্ন জাগছে, সেটা সে মুখ ফুটে বলতে পারছে না, “দাদা আমাকে মনে করে কি কিছু বলে পাঠান নি?” তার সেই অব্যক্ত প্রশ্নের উত্তরের মতোই যেন কালু বললে, “বড়োবাবু আমার হাত দিয়ে তোমাকে একটি জিনিস পাঠিয়েছেন।”

 কুমু ব্যর্থ হয়ে বললে, “কী পাঠিয়েছেন, কই সে?”

 “সেটা বাইরে রেখে এসেছি।”

 “আনলে না কেন?”

 ব্যস্ত হয়ো না দিদি। মহারাজা বললেন, তিনি নিজে নিয়ে আসবেন।”

 “কী জিনিস বলো আমাকে।”

 “ইনি যে আমাকে বলতে বারণ করলেন।” ঘরের চারি দিকে তাকিয়ে কালু বললে, “বেশ আদরযত্নে তোমাকে রেখেছে—বড়োবাবুকে গিয়ে বলব, কত খুশি হবেন। প্রথম দুদিন তোমার খবর পেতে দেরি হয়ে তিনি বড়ো ছটফট করেছেন। ডাকের গোলমাল হয়েছিল, শেষকালে তিনটে চিঠি একসঙ্গে পেলেন।”

 ডাকের গোলমাল হবার কারণটা যে-কোন্‌খানে কুমু তা আন্দাজ করতে পারলে।

 কালুদাকে কুমু খেতে বলতে চায়, সাহস করতে পারছে না। একটু সংকোচের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলে, “কালুদা, এখনও তোমার খাওয়া হয় নি?”

 “দেখেছি, কলকাতায় সন্ধ্যের পর খেলে আমার সহ্য হয় না দিদি, তাই আমাদের রামসদয় কবিরাজের কাছ থেকে মকরধ্বজ আনিয়ে খাচ্ছি। বিশেষ কিছু তো ফল হল না।”

 কালু বুঝেছিল, বাড়ির নূতন বউ, এখনও কর্তৃত্ব হাতে আসে নি, মুখ ফুটে খাওয়াবার কথা বলতে পারবে না, কেবল কষ্ট পাবে।

 এমন সময় মোতির মা দরজার আড়াল থেকে হাতছানি দিয়ে কুমুকে ডেকে নিয়ে বললে, “তোমাদের ওখান থেকে মুখুজ্যেমশায় এসেছেন, তাঁর জন্যে খাবার তৈরি। নীচের ঘরে তাঁকে নিয়ে এস, খাইয়ে দেবে।”

 কুমু ফিরে এসেই বললে, “কালুদা, তোমার কবিরাজের কথা রেখে দাও, তোমাকে খেয়ে যেতেই হবে।”

 কী বিভ্রাট! এ যে অত্যাচার! আজ থাক্‌, না-হয় আর-একদিন হবে।”

 “না, সে হবে না—চলো।”

 শেষকালে আবিষ্কার করা গেল, মকরধ্বজের বিশেষ ফল হয়েছে, ক্ষুধার লেশমাত্র অভাব প্রকাশ পেল না।

 কালুদাদাকে খাওয়ানো শেষ হতেই কুমু শোবার ঘরে চলে এল। আজ মনটা বাপের বাড়ির স্মৃতিতে ভরা। এতদিনে নুরনগরে খিড়কির বাগানে আমের বোল ধরেছে। কুসুমিত জামরুল গাছের তলায় পুকুরধারের চাতালে কত নিভৃত মধ্যাহ্নে কুমু হাতের উপর মাথা রেখে এলোচুল ছড়িয়ে দিয়ে শুয়ে কাটিয়েছে—মৌমাছির গুঞ্জনে মুখরিত, ছায়ায় আলোয় খচিত সেই দুপুরবেলা। বুকের মধ্যে একটা অকারণ ব্যথা লাগত, জানত না তার অর্থ কী। সেই ব্যথায় সন্ধ্যেবেলাকার ব্রজের পথের গোখুর-ধূলিতে ওর স্বপ্ন রাঙা হয়ে উঠেছে। বুঝতে পারে নি যে, ওর যৌবনের অপ্রাপ্ত দোসর জলে স্থলে দিয়েছে মায়া মেলে, ওর যুগল রূপের উপাসনায় সেই করেছে লুকোচুরি, তাকেই টেনে এনেছে ওর চিত্তের অলক্ষ্যপুরে এসরাজে মুলতানের মিড়ে মূর্ছনায়। ওর প্রথম-যৌবনের সেই না-পাওয়া মনের মানুষের কত আভাস ছিল ওদের সেখানকার বাড়ির কত জায়গায়, সেখানকার চিলেকোঠায়, যেখান থেকে দেখা যেত গ্রামের বাঁকা রাস্তার ধারে ফুলের আগুন-লাগা সরষেখেত, খিড়কির পাঁচিলের ধারের সেই ঢিবিটা, যেখানে বসে পাঁচিলের ছাতলাপড়া সবুজে কালোয় মেশা নানা রেখায় যেন কোন্ পুরাতন বিস্তৃত কাহিনীর অস্পষ্ট ছবি—দোতালায় ওর শোবার ঘরের জানালায় সকালে ঘুম থেকে উঠেই দূরের রাঙা আকাশের দিকে সাদা পালগুলো দেখতে পেত, দিগন্তের গায়ে গায়ে চলেছে যেন মনের নিরুদ্দেশ কামনার মতো। প্রথম-যৌবনের সেই মরীচিকাই সঙ্গে সঙ্গে এসেছে কলকাতায় ওর পূজার মধ্যে, ওর গানের মধ্যে। সেই তো দৈবের বাণীর ভান করে ওকে অন্ধভাবে এই বিবাহের ফাঁসের মধ্যে টেনে আনলে। অথচ প্রখর রৌদ্রে নিজে গেল মিলিয়ে।

 ইতিমধ্যে মধুসূদন কখন পিছনে এসে দেয়ালে-ঝোলানো আয়নায় কুমুর মুখের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে রইল। বুঝতে পারলে কুমুর মন যেখানে হারিয়ে গেছে সেই অদৃশ্য অজানার সঙ্গে প্রতিযোগিতা কিছুতেই চলবে না। অন্য দিন হলে কুমুর এই আনমনা ভাব দেখলে রাগ হত। আজ শান্ত বিষাদের সঙ্গে কুমুর পাশে এসে বসল; বললে, “কী ভাবছ বড়োবউ?”

 কুমু চমকে উঠল। মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। মধুসূদন তার হাত চেপে ধরে নাড়া দিয়ে বললে, “তুমি কি কিছুতেই আমার কাছে ধরা দেবে না?”

 এ কথার উত্তর কুমু ভেবে পেলে না। কেন ধরা দিতে পারছে না সে-প্রশ্ন ও যে নিজেকেও করে। মধুসূদন যখন কঠিন ব্যবহার করছিল তখন উত্তর সহজ ছিল, ও যখন নতি স্বীকার করে তখন নিজেকে নিন্দে করা ছাড়া কোনো জবাব পায় না। স্বামীকে মনপ্রাণ সমর্পণ করতে না পারাটা মহাপাপ, এ সম্বন্ধে কুমুর সন্দেহ নেই, তবু ওর এমন দশা কেন হল? মেয়েদের একটিমাত্র লক্ষ্য, সতী সাবিত্রী হয়ে ওঠা। সেই লক্ষ্য হতে ভ্রষ্ট হওয়ার পরম দুর্গতি থেকে নিজেকে বাঁচাতে চায়—তাই আজ ব্যাকুল হয়ে কুমু মধুসূদনকে বললে, “তুমি আমাকে দয়া করো।”

 “কিসের জন্যে দয়া করতে হবে?”

 “আমাকে তোমার করে নাও—হুকুম করো, শাস্তি দাও। আমার মনে হয় আমি তোমার যোগ্য নই।”

 শুনে বড়ো দুঃখে মধুসূদনের হাসি পেল। কুমু সতীর কর্তব্য করতে চায়। কুমু যদি সাধারণ গৃহিণী মাত্র হত তাহলে এইটুকুই যথেষ্ট হত, কিন্তু কুমু যে ওর কাছে মন্ত্র-পড়া স্ত্রীর চেয়ে অনেক বেশি, সেই বেশি। টুকুকে পাবার জন্যে ও যতই মূল্য হাঁকছে সবই ব্যর্থ হচ্ছে। ধরা পড়ছে নিজের খর্বতা। কুমুর সঙ্গে নিজের দুর্লঙ্ঘ্য অসাম্য কেবলই ব্যাকুলতা বাড়িয়ে তুলছে।

 দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে মধুসূদন বললে, “একটি জিনিস যদি দিই তো কী দেবে বলো।”

 কুমু বুঝতে পারলে দাদার দেওয়া সেই জিনিস, ব্যগ্রতার সঙ্গে মধুসূদনের মুখের দিকে চেয়ে রইল।

 “যেমন জিনিসটি তারই উপযুক্ত দাম নেব কিন্তু,” বলে খাটের নীচে থেকে রেশমের খোল দিয়ে মোড়া একটি এসরাজ বের করে তার মোড়কটি খুলে ফেললে। কুমুর সেই চিরপরিচিত এসরাজ, হাতির দাঁতে খচিত। বাড়ি থেকে চলে আসবার সময় এইটি ফেলে এসেছিল।

 মধুসূদন বললে, “খুশি হয়েছ তো? এইবার দাম দাও।”

 মধুসূদন কী দাম চায় কুমু বুঝতে পারলে না, চেয়ে রইল। মধুসূদন বললে, “বাজিয়ে শোনাও আমাকে।”

 এটা বেশি কিছু নয়, তবু বড় শক্ত দাবি। কুমু এইটুকু আন্দাজ করতে পেরেছে যে, মধুসূদনের মনে সংগীতের রস নেই। এর সামনে বাজানোর সংকোচ কাটিয়ে তোলা কঠিন। কুমু মুখ নিচু করে এসরাজের ছড়িটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল। মধুসূদন বললে, “বাজাও না বড়োবউ, আমার সামনে লজ্জা করো না।”

 কুমু বললে, “সুর বাঁধা নেই।”

 “তোমার নিজের মনেরই সুর বাঁধা নেই, তাই বলো না কেন?”

 কথাটার সত্যতায় কুমুর মনে তখনই ঘা লাগল; বললে, “যন্ত্রটা ঠিক করে রাখি, তোমাকে আর একদিন শোনাব।”

 করে শােনাবে ঠিক করে বলো। কাল?”

 “আচ্ছা, কাল।”

 “সন্ধ্যেবেলায় আফিস থেকে ফিরে এলে?”

 “হাঁ, তাই হবে।”

 “এসরাজটা পেয়ে খুব খুশি হয়েছ?”

 “খুব খুশি হয়েছি।”

 শালের ভিতর থেকে একটা চামড়ার কেস বের করে মধুসূদন বললে, “তােমার জন্যে যে মুক্তার মালা কিনে এনেছি, এটা পেয়ে ততখানিই খুশি হবে না?”

 এমনতরাে মুশকিলের প্রশ্ন কেন জিজ্ঞাসা করা? কুমু চুপ করে এসরাজের ছড়িটা নাড়াচাড়া করতে লাগল।

 “বুঝেছি, দরখাস্ত নামঞ্জুর।”

 কুমু কথাটা ঠিক বুঝলে না।

 মধুসূদন বললে, “তােমার বুকের কাছে আমার অন্তরের এই দরখাস্তটি লটকিয়ে দেব ইচ্ছে ছিল—কিন্তু তার আগেই ডিসমিস।”

 কুমুর সামনে মেজের উপর গয়নাটা রইল খােলা। দুজনে কেউ একটিও কথা বললে না। থেকে থেকে কুমু যে-রকম স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে যায়, তেমনি হয়ে রইল। একটু পরে যেন সচেতন হয়ে মালাটা তুলে নিয়ে গলায় পরলে, আর মধুসূদনকে প্রণাম করলে। বললে, “তুমি আমার বাজনা শুনবে?”

 মধুসূদন বললে, “হাঁ, শুনব।”

 “এখনই শােনাব” বলে এসরাজে সুর বাঁধলে। কেদারায় আলাপ আরম্ভ করলে; ভুলে গেল ঘরে কেউ আছে, কেদারা থেকে পৌছল ছায়ানটে। যে-গানটি সে ভালােবাসে সেইটি ধরল, “ঠাড়ি রহো মেরে আঁখনকে আগে।” সুরের আকাশে রঙিন ছায়া ফেলে এল সেই অপরূপ আবির্ভাব, যাকে কুমু গানে পেয়েছে, প্রাণে পেয়েছে, কেবল চোখে পাবার তৃষ্ণা নিয়ে যার জন্যে মিনতি চিরদিন রয়ে গেল—“ঠাড়ি রহো মেরে আঁখনকে আগে।”

 মধুসূদন সংগীতের রস বোঝে না, কিন্তু কুমুর বিশ্ববিস্মৃত মুখের উপর যে-সুর খেলছিল, এসরাজের পর্দায় পর্দায় কুমুর আঙুল ছোঁয়ার যে ছন্দ নেচে উঠছিল তাই তার বুকে দোল দিলে, মনে হতে লাগল ওকে যেন কে বরদান করছে। আনমনে বাজাতে বাজাতে কুমু হঠাৎ একসময়ে দেখতে পেলে, মধুসূদন তার মুখের উপর একদৃষ্টে চেয়ে, অমনি হাত গেল থেমে, লজ্জা এল, বাজনা বন্ধ করে দিলে।

 মধুসূদনের মন দাক্ষিণ্যে উদ্বেল হয়ে উঠল, বললে, “বড়োবউ, তুমি কী চাও বলো।” কুমু যদি বলত, কিছুদিন দাদার সেবা করতে চাই, মধুসূদন তাতেও রাজি হতে পারত; কেননা আজ কুমুর গীতমুগ্ধ মুখের দিকে কেবলই চেয়ে চেয়ে সে নিজেকে বলছিল, “এই তো আমার ঘরে এসেছে, এ কী আশ্চর্য সত্য।”

 কুমু এসরাজ মাটিতে রেখে, ছড়ি ফেলে চুপ করে রইল।

 মধুসূদন আর-একবার অনুনয় করে বললে, “বড়োবউ, তুমি আমার কাছে কিছু চাও। যা চাও তাই পাবে।”

 কুমু বললে, “মুরলী বেয়ারকে একখানা শীতের কাপড় দিতে চাই।”

 কুমু যদি বলত কিছু চাই নে, সেও ছিল ভালো, কিন্তু মুরলী বেহারার জন্যে গায়ের কম্বল! যে দিতে পারে মাথার মুকুট, তার কাছে চাওয়া জুতোর ফিতে।

 মধুসূদন অবাক। রাগ হল বেহারাটার উপর। বললে, “লক্ষ্মীছাড়া মুরলী বুঝি তোমাকে বিরক্ত করছে?”

 “না, আমি আপনিই ওকে একটা আলোয়ান দিতে গেলুম, ও নিল না। তুমি যদি হুকুম কর তবে সাহস করে নেবে।”

 মধুসুদন স্তব্ধ হয়ে রইল। খানিক পরে বললে, “ভিক্ষে দিতে চাও? আচ্ছা দেখি, কই তোমার আলোয়ান।”

 কুমু তার সেই অনেক দিনের পরা বাদামি রঙের আলোয়ান নিয়ে এল। মধুসূদন সেটা নিয়ে নিজের গায়ে জড়াল। টিপায়ের উপরকার ছোটো ঘণ্টা বাজিয়ে দিতে একজন বুড়ি দাসী এল; তাকে বললে, “মুরলী বেহারাকে ডেকে দাও।”

 মুরলী এসে হাত জোড় করে দাঁড়াল; শীতে ও ভয়ে তার জোড়া হাত কাঁপছে।

 “তোমার মা-জি তোমাকে বকশিশ দিয়েছেন, বলে মধুসূদন পকেট-কেস থেকে এক-শো টাকার একটা নোট বের করে তার ভাঁজ খুলে সেটা দিলে কুমুর হাতে। এ-রকম অকারণে অযাচিত দান মধুসূদনের দ্বারা জীবনে কখনো ঘটে নি। অসম্ভব ব্যাপারে মুরলী বেহারার ভয় আরও বেড়ে উঠল; দ্বিধাকম্পিত স্বরে বললে, “হুজুর—”

 “হুজুর কী রে বেটা! বোকা, নে তোর মায়ের হাত থেকে। এই টাকা দিয়ে যত খুশি গরম কাপড় কিনে নিস।”

 ব্যাপারটা এইখানে শেষ হল—সেই সঙ্গে সেদিনকার আর সমস্তই যেন শেষ হয়ে গেল। যে-স্রোতে কুমুর মন ভেসেছিল সে গেল হঠাৎ বন্ধ হয়ে, মধুসূদনের মনে আত্মত্যাগের যে-ঢেউ চিত্তসংকীর্ণতার কূল ছাপিয়ে উঠেছিল তাও সামান্য বেহারার জন্য তুচ্ছ প্রার্থনায় ঠেকে গিয়ে আবার তলায় গেল নেমে। এর পরে সহজে কথাবার্তা কওয়া দুই পক্ষেই অসাধ্য। আজ সন্ধ্যের সময় সেই তালুক-কেনা ব্যাপার নিয়ে লোক এসে বাইরের ঘরে অপেক্ষা করছে, এ-কথাটা মধুসূদনের মনেই ছিল না। এতক্ষণ পরে চমকে উঠে ধিক্‌কার হল নিজের উপরে। উঠে দাঁড়িয়ে বললে,“কাজ আছে, আসি।” দ্রুত চলে গেল।

 পথের মধ্যে শ্যামাসুন্দরীর ঘরের সামনে এসে বেশ প্রকাশ্য কণ্ঠস্বরেই বললে, “ঘরে আছ?”

 শ্যামাসুন্দরী আজ খায় নি! একটা র্যাপার মুড়ি দিয়ে মেজেয় মাদুরের উপর অবসন্ন ভাবে শুয়ে ছিল। মধুসূদনের ডাক শুনে তাড়াতাড়ি দরজার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলে, “কী ঠাকুরপো?”

 “পান দিলে না আমাকে?”