◄  ৪৩
৪৫  ►

৪৪

 বাইরে অন্ধকারে দরজার আড়ালে একটি মানুষ এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল— হাবলু। কম সাহস না। মধুসূদনকে যমের মতো ভয় করে, তবু ছিল কাঠের পুতুলের মতো স্তব্ধ হয়ে। সেদিন মধুসূদনের কাছে তাড়া খাওয়ার পর থেকে জেঠাইমার কাছে আসবার সুবিধে হয় নি, মনের ভিতর ছটফট করেছে। আজ এই সন্ধ্যাবেলায় আসা নিরাপদ ছিল না। কিন্তু ওকে বিছানায় শুইয়ে রেখে মা যখন ঘরকন্নার কাজে চলে গেছে এমন সময় কানে এল এসরাজের সুর। কী বাজছে জানত না, কে বাজাচ্ছে বুঝতে পারে নি, জেঠাইমার ঘর থেকে আসছে এটা নিশ্চিত; জেঠামশায় সেখানে নেই এই তার বিশ্বাস, কেননা তাঁর সামনে কেউ বাজনা বাজাতে সাহস করবে এ-কথা সে মনেই করতে পারে না। উপরের তলার দরজার কাছে এসে জেঠামশায়ের জুতোজোড়া দেখেই পালাবার উপক্রম করলে। কিন্তু যখন বাইরে থেকে চোখে পড়ল ওর জেঠাইমা নিজে বাজাচ্ছেন, তখন কিছুতেই পালাতে পা সরল না। দরজার আড়ালে লুকিয়ে শুনতে লেগেছে। প্রথম থেকেই জেঠাইমাকে ও জানে আশ্চর্য, আজ বিস্ময়ের অন্ত নেই। মধুসূদন চলে যেতেই মনের উচ্ছ্বাস আর ধরে রাখতে পারলে না-ঘরে ঢুকেই কুমুর কোলে গিয়ে বসে গলা জড়িয়ে ধরে কানের কাছে বললে, “জেঠাইমা।”

 কুমু তাকে বুকে চেপে ধরে বললে, “এ কী, তােমার হাত যে ঠাণ্ডা! বাদলার হাওয়া লাগিয়েছ বুঝি।”

 হাবলু কোনাে উত্তর করলে না, ভয় পেয়ে গেল। ভাবলে জেঠাইমা এখনই বুঝি বিছানায় শুতে পাঠিয়ে দেবে। কুমু তাকে শালের মধ্যে ঢেকে নিয়ে নিজের দেহের তাপে গরম করে বললে, “এখনও শুতে যাও নি গােপাল?”

 “তােমার বাজনা শুনতে এসেছিলুম। কেমন করে বাজাতে পারলে, জেঠাইমা?”

 “তুমি যখন শিখবে তুমিও পারবে।”

 “আমাকে শিখিয়ে দেবে?”

 এমন সময় মােতির মা ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকেই বলে উঠল, “এই বুঝি দস্যি, এখানে লুকিয়ে বসে! আমি ওকে সাতরাজ্যি খুঁজে বেড়াচ্ছি। এদিকে সন্ধ্যাবেলায় ঘরের বাইরে দু পা চলতে গা ছম ছম করে, জেঠাইমার কাছে আসবার সময় ভয়ডর থাকে না। চল্ শুতে চল্।”

 হাবলু কুমুকে আঁকড়ে ধরে রইল।

 কুমু বললে, “আহা, থাক্‌-না আর-একটু।”

 “এমন করে সাহস বেড়ে গেলে শেষকালে বিপদে পড়বে। ওকে শুইয়ে আমি এখনই আসছি।”

 কুমুর বড়াে ইচ্ছে হল হাবলুকে কিছু দেয়, খাবার কিংবা খেলার জিনিস। কিন্তু দেবার মতো কিছু নেই, তাই ওকে চুমো খেয়ে বললে, “আজ শুতে যাও, লক্ষ্মী ছেলে, কাল দুপুরবেলা তোমাকে বাজনা শোনাব।”

 হাবলু করুণ মুখে উঠে মায়ের সঙ্গে চলে গেল।

 কিছুক্ষণ পরেই মোতির মা ফিরে এল। নবীনের ষড়যন্ত্রের কী ফল হল তাই জানবার জন্যে মন অস্থির হয়ে আছে। কুমুর কাছে বসেই চোখে পড়ল, তার হাতে সেই নীলার আংটি। বুঝলে যে কাজ হয়েছে। কথাটা উত্থাপন করবার উপলক্ষ্য-স্বরূপ বললে, “দিদি, তোমার এই বাজনাটা পেলে কেমন করে?”

 কুমু বললে, “দাদা পাঠিয়ে দিয়েছেন।

 “বড়ঠাকুর তোমাকে এনে দিলেন বুঝি?”

 কুমু সংক্ষেপে বললে, “হাঁ।”

 মোতির মা কুমুর মুখের দিকে তাকিয়ে উল্লাস বা বিস্ময়ের চিহ্ন খুঁজে পেলে না।

 “তোমার দাদার কথা কিছু বললেন কি?”

 “না।”

 “পরশু তিনি তো আসবেন, তাঁর কাছে তোমার যাবার কথা উঠল?”

 “না, দাদার কোনো কথা হয় নি।”

 “তুমি নিজেই চাইলে না কেন, দিদি?”

 “আমি ওঁর কাছে আর যা-কিছু চাই নে কেন, এটা পারব না।”

 “তোমার চাবার দরকার হবে না, তুমি অমনিই ওঁর কাছে চলে যেয়ো। বড়ঠাকুর কিছুই বলবেন না।”

 মোতির মা এখনও একটা কথা সম্পূর্ণ বুঝতে পারে নি যে, মধুসূদনের অনুকূলতা কুমুর পক্ষে সংকট হয়ে উঠেছে; এর বদলে মধুসূদন যা চায় তা ইচ্ছে করলেও কুমু দিতে পারে না। ওর হৃদয় হয়ে গেছে দেউলে। এইজন্যেই মধুসূদনের কাছে দান গ্রহণ করে ঋণ বাড়াতে এত সংকোচ। কুমুর এমনও মনে হয়েছে যে, দাদা যদি আর কিছুদিন দেরি করে আসে তো সেও ভালো।

 একটু অপেক্ষা করে থেকে মোতির মা বললে, “আজ মনে হল বড়ঠাকুরের মন যেন প্রসন্ন।”

 সংশয়ব্যাকুল চোখে কুমু মোতির মার মুখে তাকিয়ে বললে, “এ-প্রসন্নতা কেন ঠিক বুঝতে পারি নে, তাই আমার ভয় হয়; কী করতে হবে ভেবে পাই নে।”

 কুমুর চিবুক ধরে মোতির মা বললে, “কিছুই করতে হবে না; এটুকু বুঝতে পারছ না, এতদিন উনি কেবল কারবার করে এসেছেন, তোমার মতো মেয়েকে কোনদিন দেখেন নি। একটু একটু করে যতই চিনছেন ততই তোমার আদর বাড়ছে।”

 “বেশি দেখলে বেশি চিনবেন, এমন কিছুই আমার মধ্যে নেই, তাই। আমি নিজেই দেখতে পাচ্ছি আমার ভিতরটাশূন্য। সেই ফাঁকটাই দিনে দিনে ধরা পড়বে। সেইজন্যেই হঠাৎ যখন দেখি উনি খুশি হয়েছেন, আমার মনে হয় উনি বুঝি ঠকেছেন। যেই সেটা ফাঁস হবে সেই আরও রেগে উঠবেন। সেই রাগটাই যে সত্য, তাই তাকে আমি তেমন ভয় করি নে।”

 “তোমার দাম তুমি কী জান দিদি। যেদিন এদের বাড়িতে এসেছ, সেইদিনই তোমার পক্ষ থেকে যা দেওয়া হল, এরা সবাই মিলে তা শুধতে পারবে না। আমার কর্তাটি তো একেবারে মরিয়া, তোমার জন্য়ে সাগর লঙ্ঘন না করতে পারলে স্থির থাকতে পারছেন না। আমি যদি তোমাকে না ভালোবাসতুম তবে এই নিয়ে ওঁর সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়ে যেত।”

 কুমু হাসলে, বললে, “কত ভাগ্যে এমন দেবর পেয়েছি।”

 “আর তোমার এই জা-টি বুঝি ভাগ্যস্থানে রাহু না কেতু।”

 “তোমাদের একজনের নাম করলে আর-একজনের নাম করবার দরকার হয় না।”

 মোতির মা ডান হাত দিয়ে কুমুর গলা জড়িয়ে ধরে বললে, “আমার একটা অনুরোধ আছে তোমার কাছে।”

 “কী বলো।”

 “আমার সঙ্গে তুমি ‘মনের কথা’ পাতাও।”

 “সে বেশ কথা, ভাই। প্রথম থেকে মনে-মনে পাতানো হয়েই গেছে।”

 “তাহলে আমার কাছে কিছু চেপে রেখো না। আজ তুমি অমন মুখটি করে কেন আছ কিছুই বুঝতে পারছি নে।”

 খানিকক্ষণ মোতির মার মুখের দিকে চেয়ে থেকে কুমু বললে, “ঠিক কথা বলব? নিজেকে আমার কেমন ভয় করছে।”

 “সে কী কথা! নিজেকে কিসের ভয়?”

 “আমি এতদিন নিজেকে যা মনে করতুম আজ হঠাৎ দেখছি তা নই। মনের মধ্যে সমস্ত গুছিয়ে নিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েই এসেছিলুম। দাদারা যখন দ্বিধা করেছেন, আমি জোর করেই নতুন পথে পা বাড়িয়েছি। কিন্তু যে-মানুষটা ভরসা করে বেরোেল তাকে আজ কোথাও দেখতে পাচ্ছি নে।”

 “তুমি ভালোবাসতে পারছ না। আচ্ছা, আমার কাছে লুকিয়ো না, সত্যি করে বলো, কাউকে কি ভালোবেসেছ? ভালোবাসা কাকে বলে তুমি কি জান?”

 “যদি বলি জানি, তুমি হাসবে। সূর্য ওঠবার আগে যেমন আলো হয় আমার সমস্ত আকাশ ভরে ভালোবাসা তেমনি করেই জেগেছিল। কেবলই মনে হয়েছে সূর্য উঠল বলে। সেই সূর্যোদয়ের কল্পনা মাথায় করেই আমি বেরিয়েছি—তীর্থের জল নিয়ে, ফুলের সাজি সাজিয়ে। যে-দেবতাকে এতদিন সমস্ত মন দিয়ে মেনে এসেছি, মনে হয়েছে তাঁর উৎসাহ পেলুম। যেমন করে অভিসারে বেয়ােয় তেমনি করেই বেরিয়েছি। অন্ধকার রাত্রিকে অন্ধকার বলে মনেই হয় নি, আজ আলােতে চোখ মেলে অন্তরেই বা কী দেখলুম, বাইরেই বা কী দেখছি! এখন বছরের পর বছর, মুহূর্তের পর মুহূর্ত কাটবে কী করে?”

 “তুমি কি বড়ঠাকুরকে ভালােবাসতে পারবে না মনে কর?

 “পারতুম ভালােবাসতে। মনের মধ্যে এমন কিছু এনেছিলুম যাতে সবই পছন্দমতাে করে নেওয়া সহজ হত। গােড়াতেই সেইটেকে তােমার বড়ঠাকুর ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন। আজ সব জিনিস কড়া হয়ে আমাকে বাজছে। আমার শরীরের উপরকার নরম ছালটাকে কে যেন ঘষড়ে তুলে দিল, তাই চারি দিকে সবই আমাকে লাগছে, কেবলই লাগছে; যা কিছু ছুঁই তাতেই চমকে উঠি; এর পরে কড়া পড়ে গেলে কোনাে একদিন হয়তাে সয়ে যাবে, কিন্তু জীবনে কোনােদিন আনন্দ পাব না তাে।”

 “বলা যায় না ভাই।”

 “খুব বলা যায়। আজ আমার মনে একটুমাত্র মােহ নেই। আমার জীবনটা একেবারে নির্লজ্জের মতো স্পষ্ট হয়ে গেছে। নিজেকে একটু ভােলাবার মতাে আড়াল কোথাও বাকি রইল না। মরণ ছাড়া মেয়েদের কি আর কোথাও নড়ে বসবার একটুও জায়গা নেই? তাদের সংসারটাকে নিষ্ঠুর বিধাতা এত আঁট করেই তৈরি করেছে?”

 এতক্ষণ ধরে এমনতরাে উত্তেজনার কথা কুমুর মুখে মােতির মা আর কোনােদিন শােনে নি। বিশেষ করে আজ যেদিন বড়ঠাকুরকে ওরা কুমুর প্রতি এতটা প্রসন্ন করে এনেছে, সেইদিনই কুমুর এই তীব্র অধৈর্য দেখে মােতির মা ভয় পেয়ে গেল। বুঝলে লতার একেবারে গােড়ায় ঘা লেগেছে, উপর থেকে অনুগ্রহের জল ঢেলে মালী আর একে তাজা করে তুলতে পারবে না।

 একটু পরে কুমু বলে উঠল, “জানি, স্বামীকে এই যে শ্রদ্ধার সঙ্গে আত্মসমর্পণ করতে পারছি নে এ আমার মহাপাপ। কিন্তু সে-পাপেও আমার তেমন ভয় হচ্ছে না যেমন হচ্ছে শ্রদ্ধাহীন আত্মসমর্পণের গ্লানির কথা মনে করে।”

 মােতির মা কোনাে উত্তর না ভেবে পেয়ে হতবুদ্ধির মতাে বসে রইল। একটু চুপ করে থেকে কুমু বললে, “তােমার কত ভাগ্যি ভাই, কত পুণ্যি করেছিলে, ঠাকুরপােকে এমন সমস্ত মনটা দিয়ে ভালােবাসতে পেরেছ। আগে মনে করতুম, ভালােবাসাই সহজ—সব স্ত্রী সব স্বামীকে আপনিই ভালােবাসে আজ দেখতে পাচ্ছি ভালােবাসতে পারাটাই সব চেয়ে দুর্লভ, জন্মজন্মান্তরের সাধনায় ঘটে। আচ্ছা ভাই, সত্যি বলো, সব স্ত্রীই কি স্বামীকে ভালােবাসে?”

 মােতির মা একটু হেসে বললে, “ভালাে না বাসলেও ভালাে স্ত্রী হওয়া যায়, নইলে সংসার চলবে কী করে?”

 “সেই আশ্বাস দাও আমাকে। আর কিছু না হই ভালাে স্ত্রী যেন হতে পারি। পুণ্য তাতেই বেশি, সেইটেই কঠিন সাধনা।”

 “বাইরে থেকে তাতেও বাধা পড়ে।”

 “অন্তর থেকে সে বাধা কাটিয়ে উঠতে পারা যায়। আমি পারব, আমি হার মানব না।”

 “তুমি পারবে না তাে কে পারবে?”

 বৃষ্টি জোর করে চেপে এল। বাতাসে ল্যাম্পের আলাে থেকে থেকে চকিত হয়ে ওঠে। দমকা হাওয়া যেন একটা ভিজে নিশাচর পাখির মতো পাখা ঝাপটে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। কুমুর শরীরটা মনটা শির শির করে উঠল। সে বললে, “আমার ঠাকুরের নামে আর জোর পাচ্ছি নে। মন্ত্র আবৃত্তি করে যাই, মনটা মুখ ফিরিয়ে থাকে, কিছুতে সাড়া দিতে চায় না। তাতেই সব চেয়ে ভয় হয়।”

 বানানো কথায় মিথ্যে ভরসা দিতে মোতির মার ইচ্ছে হল না। কোনো উত্তর না করে সে কুমুকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরলে।এমন সময় বাইরে থেকে আওয়াজ পাওয়া গেল, “মেজোবউ।”

 কুমু খুশি হয়ে উঠে বললে, “এস, এস ঠাকুরপো।”

 “সন্ধাবেলাকার ঘরের আলোটিকে ঘরে দেখতে পেলুম না, তাই খুঁজতে বেরিয়েছি।”

 মোতির মা বললে, “হায় হায়, মণিহারা ফণী যাকে বলে!”

 “কে মণি আর কে ফণী তা চক্র নাড়া দেখলেই বোঝা যায়, কী বল বউরানী।”

 “আমাকে সাক্ষী মেনো না ঠাকুরপো।”

 “জানি, তাহলে আমি ঠকব।”

 “তা তোমার হারাধনকে তুমি উদ্ধার করে নিয়ে যাও, আমি ধরে রাখব না।”

 “হারাধনের জন্যে ওঁর কোনো উৎসাহ নেই দিদি, ছুতো করে বউরানীর চরণ দর্শন করতে এসেছেন।”

 “ছুতোর কি কোনো দরকার আছে? চরণ আপনি ধরা দিয়েছে। সব চেয়ে যা অসাধ্য তার সাধনা করবে কে? সে যখন আসে সহজেই আসে। পৃথিবীতে হাজার হাজার মানুষ আছে আমার চেয়ে যোগ্য, তবু অমন সুন্দর পা-দুখানি আমিই পারলুম ছুঁতে, তারা তো পারলে না। নবীনের জন্ম সার্থক হয়ে গেল বিনা মূল্যে।”

 “আঃ, কী বল ঠাকুরপো, তার ঠিক নেই। তোমার এনসাইক্লোপীডিয়া থেকে বুঝি—”

 অমন কথা বলতে পারবে না, বউরানী। চরণ বলতে কী বোঝায় তা ওরা জানবে কী করে? ছাগলের খুরের মতো সরু সরু ঠেকোওআলা জুতোর মধ্যে লক্ষ্মীদের পা কড়া জেনানার মধ্যে ওরা বন্দী করে রেখেছে। সাইক্লোপীডিয়াওআলার সাধ্য কী পায়ের মহিমা বোঝে। লক্ষ্মণ চোদ্দটা বৎসর কেবল সীতার পায়ের দিকে তাকিয়েই নির্বাসন কাটিয়ে দিলেন, তার মানে আমাদের দেশের দেওররাই জানে। তা পায়ের উপরে শাড়ি টেনে দিচ্ছ তো দাও। ভয় নেই তোমার, পদ্ম সন্ধ্যেবেলায় মুদে থাকে বলে তো বরাবর মুদেই থাকে না—আবার তো পাপড়ি খোলে।”

 “ভাই মনের কথা, এমনিতরে স্তব করেই বুঝি ঠাকুরপো তোমার মন ভুলিয়েছেন?”

 “একটু ও না দিদি, মিষ্টিকথার বাজে খরচ করবার লোক নন উনি।”

 “স্তুতির বুঝি দরকার হয় না?”

 “বউরানী, স্তুতির ক্ষুধা দেবীদের কিছুতেই মেটে না, দরকার খুব আছে। কিন্তু শিবের মতো আমি তো পঞ্চানন নই, এই একটিমাত্র মুখের স্তুতি পুরোনো হয়ে গেছে, এতে উনি আর রস পাচ্ছেন না।

 এমন সময় মুরলী বেয়ারা এসে নবীনকে খবর দিলে, “কর্তামহারাজা বাইরের আপিস-ঘরে ডাক দিয়েছেন।”

 শুনে নবীনের মন খারাপ হয়ে গেল। সে ভেবেছিল মধুসূদন আজ আপিস থেকে ফিরেই একেবারে সোজা তার শোবার ঘরে এসে উপস্থিত হবে। নৌকো বুঝি আবার ঠেকে গেল চড়ায়।

 নবীন চলে গেলে মোতির মা আস্তে আস্তে বললে, “বড়ঠাকুর কিন্তু তোমাকে ভালোবাসেন সে-কথা মনে রেখো।”

 কুমু বললে, “সেইটেই তো আমার আশ্চর্য ঠেকে।”

 “বল কী, তোমাকে ভালোবাসা আশ্চর্য! কেন? উনি কি পাথরের?”

 “আমি ওঁর যোগ্য না।”

 “তুমি যার যোগ্য নও সে-পুরুষ কোথায় আছে?”

 “ওঁর কতবড়ো শক্তি, কত সম্মান, কত পাকা বুদ্ধি, উনি কত মস্ত মানুষ। আমার মধ্যে উনি কতটুকু পেতে পারেন? আমি যে কী অসম্ভব কাঁচা তা এখানে এসে দুদিনে বুঝতে পেরেছি। সেইজন্যেই যখন উনি ভালোবাসেন তখনই আমার সবচেয়ে বেশি ভয় করে। আমি নিজের মধ্যে যে কিছুই খুঁজে পাই নে। এতবড়ো ফাঁকি নিয়ে আমি ওঁর সেবা করব কী করে? কাল রাত্তিরে বসে বসে মনে হল আমি যেন বেয়ারিং লেফাফা, আমাকে দাম দিয়ে নিতে হয়েছে, খুলে ফেললেই ধরা পড়বে যে ভিতরে চিঠিও নেই।”

 “দিদি, হাসালে। বডঠাকুরের মস্তবড়ো কারবার, কারবারি বুদ্ধিতে ওঁর সমান কেউ নেই সব জানি। কিন্তু তুমি কি ওঁর কারবারের ম্যানেজারি করতে এসেছ যে, যোগ্যতা নেই বলে ভয় পাবে? বড়ঠাকুর যদি মনের কথা খোলসা করে বলেন তবে নিশ্চয় বলবেন তিনিও তোমার যোগ্য নন।’

 “সে-কথা তিনি আমাকে বলেছিলেন।

 “বিশ্বাস হয় নি?

 “না। উলটে আমায় ভয় হয়েছিল। মনে হয়েছিল আমার সম্বন্ধে ভুল করলেন, সে-ভুল ধরা পড়বে।”

 “কেন তোমার এমন মনে হল বলো দেখি?”

 “বলব? এই-যে আমার হঠাৎ বিয়ে হয়ে গেল, এ তো সমস্ত আমি নিজে ঘটিয়ে তুললুম। কিন্তু কী অদ্ভুত মোহে, কী ছেলেমানুষি করে? যা-কিছুতে আমাকে সেদিন ভুলিয়েছিল তার মধ্যে সমস্তই ছিল ফাঁকি। অথচ এমন দৃঢ় বিশ্বাস, এমন বিষম জেদ যে, সেদিন আমাকে কিছুতেই কেউ ঠেকাতে পারত না। দাদা তা নিশ্চিত জানতেন বলেই বৃথা বাধা দিলেন না, কিন্তু কত ভয় পেয়েছেন, কত উদ্বিগ্ন হয়েছেন তা কি আমি বুঝতে পারি নি? বুঝতে পেরে নিজের ঝোঁকটাকে একটুও সামলাই নি, এতবড়াে অবুঝ আমি। আজ থেকে চিরদিন আমি কেবলই কষ্ট পাব, কষ্ট দেব, আর প্রতিদিন মনে জানব এ-সমস্তই আমার নিজের সৃষ্টি।”

 মােতির মা কী যে বলবে কিছুই ভেবে পেলে না। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করলে, “আচ্ছা দিদি, তুমি যে বিয়ে করতে মন স্থির করলে কী ভেবে?”

 “তখন নিশ্চিত জানতুম স্বামী ভালােমন্দ যাই হােক না কেন স্ত্রীর সতীত্বগৌরব প্রমাণের একটা উপলক্ষ্য মাত্র। মনে একটুও সন্দেহ ছিল না যে, প্রজাপতি যাকেই স্বামী বলে ঠিক করে দিয়েছেন তাকেই ভালোবাসবই। ছেলেবেলা থেকে কেবল মাকে দেখেছি, পুরাণ পড়েছি, কথকতা শুনেছি, মনে হয়েছে শাস্ত্রের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে চলা খুব সহজ।

 “দিদি, উনিশ বছরের কুমারীর জন্যে শাস্ত্র লেখা হয় নি।”

 “আজ বুঝতে পেরেছি সংসারে ভালােবাসাটা উপরি-পাওনা। ওটাকে বাদ দিয়েই ধর্মকে আঁকড়ে ধরে সংসারসমুদ্রে ভাসতে হবে। ধর্ম যদি সরস হয়ে ফুল না দেয়, ফল না দেয়, অন্তত শুকনাে হয়ে যেন ভাসিয়ে রাখে।

 মোতির মা নিজে বিশেষ কিছু না বলে কুমুকে দিয়ে কথা বলিয়ে নিতে লাগল।