রকম রকম/বিবাহে জুয়াচুরি
বিবাহে জুয়াচুরি।
আজকাল ব্রাহ্মণ ও কায়স্থগণের মধ্যে কন্যার বিবাহ যে কি ভয়ানক ব্যাপার হইয়া দাঁড়াইয়াছে, তাহা আমার সবিশেষ করিয়া বর্ণন করিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। কারণ, পাঠকগণের মধ্যে অনেকেই এ বিষয়ে সবিশেষরূপে ভুক্ত-ভোগী।
একটা কন্যার বিবাহ দিতে হইলে সময় সময় কন্যা-কর্ত্তাকে তাঁহার ভদ্রাসন বাটী পর্য্যন্ত বিক্রয় করিতে হয়। সমাজের এরূপ অবস্থা যে পুর্ব্বাপর ছিল, তাহা নহে; পাশ্চাত্য-শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে যে ইহা আমাদিগের দেশে প্রচারিত হইতেছে, তাহা কেহ কেহ অনুমান করিয়া থাকেন। পাশ্চাত্যগণের কন্যার বিবাহে একটা পয়সামাত্রও ব্যয় নাই, ইহা যখন সর্ব্ব-বিদিত, তখন পাশ্চাত্য-শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে কেন এরূপ প্রথা আমাদের দেশে প্রচলিত হইল, ইহাই আশ্চর্য্য!
যাঁহারা পাশ্চাত্য-শিক্ষায় শিক্ষিত, তাঁহারা সেইরূপ বা ততোধিক শিক্ষিত ব্যক্তির হস্তে তাঁহাদিগের কন্যাগণকে প্রদান করিতে যত্নশীল হন। সুতরাং যে সকল বালক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি প্রাপ্ত হন, সেই সকল বালকের উপরই তাঁহাদিগের প্রধান লক্ষ্য হয়। এইরূপে দুই চারিজনের লক্ষ্য একটী বালকের উপর পতিত হইলেই সেই বালকের পিতা মাতাও সেই সুযোগ অবলম্বন করিয়া আপনাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিয়া থাকেন। এরূপ অবস্থায় অর্থের প্রতিযোগিতা ভিন্ন কেহই সেই বালককে হস্তগত করিতে পারেন না। এই সকল কারণেই যে বালক বিশ্ববিদ্যালয়ের যেরূপ উচ্চ পদবী প্রাপ্ত হইয়াছে, তাহার বিবাহে সেইরূপ পরিমাণে অর্থ গ্রহণ করা হইয়া থাকে। এইরূপ অবস্থা হইতেই ক্রমে শিক্ষিত ও অশিক্ষিত সকল বালকেরই প্রায় একরূপ মূল্য (?) স্থির হইয়া পড়িয়াছে, এবং সময় সময় ইহার মধ্যে অনেক প্রকার জুয়াচুরি হইতেও আরম্ভ হইয়াছে। এ সম্বন্ধে পাত্র ও কন্যা উভয় পক্ষেরই একটী একটী জুয়াচুরির বিষয়, পাঠকগণকে সতর্ক করিবার নিমিত্ত নিম্নে বর্ণিত হইল।
(ক) কন্যাপক্ষের জুয়াচুরি।
কন্যার পিতা রামরতন, এই কলিকাতার একজন গৃহস্থ। টাকা-কড়ি অধিক নাই, কোনরূপে সংসারযাত্রা নির্ব্বাহ করিয়া থাকেন মাত্র। নিজের একখানি বাড়ী আছে, তাঁহার কন্যার বয়ঃক্রম প্রায় বার বৎসর হইল; কিন্তু এ পর্য্যন্ত তাহার বিবাহের কিছুমাত্র স্থির করিয়া উঠিতে পারেন নাই। অথচ তাঁহার ইচ্ছা যে, একটী শিক্ষিত, বা পিতামাতার কিছু সংস্থান আছে, এরূপ একটী পাত্রের হস্তে তাহাকে অর্পণ করেন। তিনি অনেক দিবস পর্য্যন্ত এইরূপ একটী পাত্রের অনুসন্ধান করিয়া নিতান্ত জ্বালাতন হইয়া পড়িয়াছিলেন। কারণ, সুবিধা মত সেরূপ পাত্র তিনি জুটাইতে পারিতেছিলেন না। যদিও দুই একটীর সন্ধান পাইতেছিলেন, কিন্তু অর্থাভাবে তাহার পিতামাতার নিকট তিনি অগ্রসর হইতে সমর্থ হইতেছিলেন না। সেইরূপ পাত্রের পিতা-মাতার নিকট গমন করিয়া বিবাহের কথা পাড়িতেন সত্য; কিন্তু টাকার ফর্দ্দ দেখিয়া আস্তে আস্তে তিনি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিতেন। পাত্রের পিতামাতা যে পরিমিত অর্থ প্রার্থনা করিতেন, তাহার ভদ্রাসন বাটী পর্য্যন্ত বিক্রয় করিয়া দিলেও তাহাতে কুলাইত না।
রামরতন যখন বুঝিতে পারিলেন, সৎপথ অবলম্বন করিয়া কোনরূপেই আপন কন্যার নিমিত্ত পাত্রের সন্ধান করিয়া উঠিতে পারিলেন না, তখন অসৎপথ অবলম্বন করিতেও তিনি আর কোনরূপে কুণ্ঠিত না হইয়া একটী ভাল পাত্রের অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন।
এইরূপে দিন কয়েক অনুসন্ধানের পর, তিনি জানিতে পারিলেন যে, তিনি যেরূপ একটী পাত্রের অনুসন্ধান করিতেছেন, তাহা অপেক্ষাও একটী উৎকষ্ট পাত্র এক স্থানে আছে; কিন্তু সেই পাত্রের পিতামাতা যেরূপ ভাবে অলঙ্কার-পত্র প্রার্থনা করিয়া থাকেন, তাহাতে কোন পাত্রীরই পিতামাতা সেই অলঙ্কারাদি দিতে স্বীকৃত হইতে পারেন না। সেই জন্যই আজ পর্য্যন্ত তাহার বিবাহ হয় নাই।
রামরতন এই সংবাদ পাইয়া সেই পাত্রের বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলেন। তাহার পিতার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া তাঁহার কন্যার বিবাহের কথার উল্লেখ করিয়া কহিলেন, “আমি শুনিয়াছি, আপনি আপনার পুত্রের বিবাহের নিমিত্ত একটী সুরূপা পাত্রীর অনুসন্ধান করিতেছেন। আমার একটী কন্যা আছে, আমার ইচ্ছা, আমি আমার সেই কন্যাটীকে আপনার পুত্রের হস্তে প্রদান করি।”
পিতা! উত্তম কথা। আপনার কন্যাটী কেমন? কারণ, আমি সুরূপা কন্যা না পাইলে, আমার পুত্রের বিবাহ দিতে অভিলাষী নহি।
রামরতন। একথা আমি পূর্ব্বেই শুনিয়াছি। তাই আমি সাহস করিয়া আপনার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি। পিতার নিকট তাহার কন্যামাত্রই সুশ্রী; ‘আমার মেয়ে ভাল’ একথা সকলেই বলিয়া থাকেন। অতএব আপনি আমার কন্যাটীকে একবার স্বচক্ষে দর্শন করুন, তাহা হইলে আপনি বুঝিতে পারিবেন যে, আমার কন্যা আপনার পুত্ত্রের উপযুক্ত কি না?
পিতা। দেখুন মহাশয়! কন্যা দেখিতে দেখিতে আমি জ্বালাতন হইয়া পড়িয়াছি। সকলেই আসিয়া বলেন, তাঁহার কন্যা খুব সুশ্রী; কিন্তু যখন দেখিতে যাই, তখন দেখি তিনি সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা কহিয়াছেন। এইরূপে এ পর্য্যন্ত আমি যত কন্যা দেখিয়াছি; তাহাদের একটীও প্রায় আমার মনোমত হয় নাই। দুই একটী যাহা মনোমত হয়, তাহার পিতামাতা আমার পুত্ত্রের উপযুক্ত অর্থ প্রদান করিতে চাহেন না। এত ব্যয় করিয়া আমি আমার পুত্ত্রের লেখা পড়া শিখাইয়াছি, সে এবার বি-এ, পাস করিয়া এম-এ, পড়িতেছে। তদ্ব্যতীত এই কলিকাতা সহরে আমার এত বড় বাড়ী, চাকরী না করিলেও রাজার হালে তাহার দিন অতিবাহিত হইবে। এরূপ পাত্রের হস্তে কন্যা দান করা কি যাহার তাহার অদৃষ্টে ঘটিয়া উঠে? কন্যার যে কখনই কষ্ট হইবে না, রাণীর মত সে দিন অতিবাহিত করিতে পারিবে, ইহা কি কন্যার পিতামাতার কম আনন্দের বিষয়? এরূপ অবস্থা অবগত হইয়াও তাঁহারা কিছুমাত্র খরচ করিয়া কন্যা দান করিতে চাহেন না, ইহা কি কম দুঃখের বিষয়!
রামরতন। আপনার কথা প্রকৃত; কিন্তু সকলে কি অর্থের সংকুলান করিয়া উঠিতে পারে?
পিতা। আমি কাহারও নিকট এরূপ অধিক অর্থ চাহি নাই যে, তিনি তাহা দিতে না পারেন। মূল কথা, আজকাল সকলেই ফাঁকি দিয় আপন আপন কার্য্য উদ্ধার করিতে চাহেন। তাহা কি কখন হয়? কিছু খরচ না করিলে, বড় মানুষের বাড়ীতে কি কন্যার বিবাহ দেওয়া যায়?
রামরতন। আপনি কত টাকা প্রার্থনা করিয়াছিলেন?
পিতা। অতি সামান্য। আমি নগদ এক পয়সাও চাহি নাই, তবে কি না, বিবাহে আমাকে যে কিছু সামান্য খরচ করিতে হইবে, তাহা আমি আপন ঘর হইতে করিব কেন? কেবল মাত্র সেই খরচের টাকাটা প্রদান করিলেই হইতে পারিত। তবে গহনা, তাহা ত তাহার কন্যারই থাকিবে।
রামরতন। খরচের নিমিত্ত কত টাকা হইলে হইতে পারে?
পিতা। চারি হাজার টাকার অধিক নহে।
রামরতন। অলঙ্কার বলিয়া কি দিতে হইবে?
পিতা। আমি হীরামতি চাহিতেছি না। কন্যাটীর গাত্রে যাহা কিছু সোণার অলঙ্কার ধরিবে, তাহার সমস্তই দিতে হইবে।
রামরতন। কত ভরি সোণা হইলে সেই সমস্ত গহনা প্রস্তত হইতে পারে?
পিতা। অধিক নহে। বোধ হয়, তিনশত ভরি সোণা হইলেই সকল গহনা হইয়া যাইবে।
রামরতন। মহাশয়! আমি আপনার মনোভাব কতক পরিমাণে অবগত হইলাম। এখন আপনি অনুগ্রহ করিয়া একবার আমার কন্যাটীকে অগ্রে স্বচক্ষে দর্শন করুন। কন্যাটী দেখিয়া যদি আপনার মনোনীত হয়, তাহা হইলে তখন দেনা পাওনার বন্দোবস্ত করিব; কিন্তু আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহার মধ্যে কোন কোন বিষয় কিছু কিছু বিবেচনা করিতে হইবে।
পিতা। আপনি কি করিয়া থাকেন?
রামরতন। সামান্য চাকরী।
পিতা। সামান্য় চাকরী করিয়া আপনি কিরূপে এত টাকা প্রদান করিতে সমর্থ হইবেন?
রামরতন। সে ভাবনা আমার। যে ব্যক্তি সামান্য চাকরী করে, তাহার কি পৈত্রিক বা অন্য কোন উপায়ে প্রাপ্ত কোনরূপ অর্থ থাকিতে নাই?
পিতা। আচ্ছা মহাশয়! আপনি কল্য প্রাতঃকালে এখানে আগমন করিবেন। আপনার সহিত গমন করিয়া আমি আপনার কন্যাটীকে দেখিয়া আসিব।
পাত্রের পিতার কথা শুনিয়া রামরতন বাবু তাহাতে সম্মত হইলেন, এবং পরদিবস প্রাতঃকালে তিনি আসিয়া তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইবেন, এইরূপ স্থির করিয়া সেই দিবস সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন।
রামরতন বাবুর কন্যাটী বেশ সুরূপা। এই নিমিত্তই তাঁহার মনে মনে বিশ্বাস ছিল যে, কোন বড়লোক তাঁহার কন্যাটী পাইলে অর্থ না চাহিয়াই তাহাকে গ্রহণ করিবে। এই নিমিত্তই তিনি ভাল পাত্রের অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতেছিলেন। তাঁহার ইচ্ছা ছিল যে, একটী ভাল পাত্র পাইলে, তাহার নিমিত্ত তিনি সর্ব্বপ্রকারে দুই তিন সহস্র পর্য্যন্ত টাকা প্রদান করিবেন। এই টাকা যে তিনি সহজে অর্পণ করিতে পারিবেন তাহা নহে, তাহার নিমিত্ত তাঁহাকে ঋণ-জালে আবদ্ধ হইতে হইবে।
পরদিবস অতি প্রত্যুষে রামরতন বাবু সেই পাত্রের বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলেন; এবং তাহার পিতাকে সঙ্গে করিয়া আপন বাড়ীতে আনিলেন। বাড়ীর স্ত্রীলোকগণ পূর্ব্ব হইতেই কন্যাটীকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করিয়া সাজাইয়া রাখিয়াছিলেন। পাত্রের পিতার সহিত আরও দুই তিন জন লোক আগমন করিয়াছিলেন। তাঁহারা সকলেই কন্যাটীকে উত্তম রূপে দেখিলেন, কন্যা দেখিয়া সকলেই সন্তুষ্ট হইলেন, সকলেরই মনোমত হইল। তাহার মধ্যে একজন প্রকাশ্যে পাত্রের পিতাকে বলিয়াও ফেলিলেন, “আমরা আপনার পুত্ত্রের নিমিত্ত এ পর্য্যন্ত যত পাত্রী দেখিয়াছি, তাহার মধ্যে একটীও এরূপ সুশ্রী নহে। এই পাত্রীটীর সহিত আপনার পুত্ত্রের বিবাহ দিতে হইবেই হইবে। আপনি অর্থের নিমিত্ত এই পাত্রটীকে যেন কোন রূপেই হস্তান্তর করিবেন না।”
কন্যা দেখা সমাপ্ত হইলে সকলেই প্রস্থান করিলেন। যাইবার সময় পাত্রের পিতা বলিয়া গেলেন, “কল্য বৈকালে আপনি আমার নিকট গমন করিবেন। সেই সময় দেনা পাওনা সম্বন্ধে কথা বার্ত্তা হইবে। পাত্রী আমার মনোনীত হইয়াছে। ইনি খুব সুরূপা না হউন, ইহাকে আমার পুত্ত্রবধূ করিতে আমার কোনরূপ আপত্তি নাই।”
পরদিবস কথিত সময়ে রামরতন পাত্রের পিতার নিকট গিয়া উপস্থিত হইলেন; এবং তাঁহাকে কহিলেন, “মহাশয়ের যদি পাত্রীটী পসন্দ হইয়া থাকে এবং আমার কন্যার সহিত আপনার পুত্ত্রের বিবাহ দিবার মতও যদি আপনার পরিবারবর্গের হইয়া থাকে, তাহা হইলে আমাকে কি কি আয়োজন করিতে হইবে, তাহা আমাকে বলিয়া দিন; যদি আমার সাধ্য হয়, তাহা হইলে আমি তাহার চেষ্টায় নিযুক্ত হই।”
রামরতনের কথা শুনিয়া পাত্রের পিতা কহিলেন, “আমি আপনাকে ত একরূপ পূর্ব্বেই বলিয়া দিয়াছি। যদি চাহেন, তাহা হইলে আমি একটা ফর্দ্দ করিয়া আপনাকে দিতেছি। আপনি যদি তাহাতে সম্মত হন, তাহা হইলে আপনি যাহা জানিতে চাহিতেছেন, তাহার সমস্তই স্থির হইয়া যাইবে।”
এই বলিয়া তিনি তাঁহার বাক্স হইতে একটী ফর্দ্দ বাহির করিয়া রামরতনের হস্তে প্রদান করিলেন। সেই ফর্দ্দখানির মর্ম্ম এইরূপ;—
বরাভরণ—
সোণার ঘড়ি একটী |
৩০০৲ |
সুবর্ণ ৩০০ ভরি ২৫৲ হিসাবে |
৭৫০০৲ |
ফর্দ্দখানি হস্তে পাইবামাত্রই রামরতন বাবু একবারে অবাক্! যদি তিনি তাঁহার যথাসর্ব্বস্ব বিক্রয় করিয়া ফেলেন, তাহা হইলে তিনি উহার অর্দ্ধেক টাকার সংগ্রহ করিতে পারেন, কি না সন্দেহ। কিন্ত এবার রামরতন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এই পাত্রের সহিত তিনি তাঁহার কন্যার বিবাহ দিবেনই, মনে মনে তাঁহার এই প্রতিজ্ঞা।
রামরতন বাবু সেই ফর্দ্দখানি হস্তে করিয়া পাত্রের পিতাকে কহিলেন, “মহাশয়! ফর্দ্দটী কিছু অধিক হইয়াছে। আমি আপনাকে যেরূপ বলিতেছি, সেইরূপ নগদ ও সুবর্ণ আদি প্রদান করিতে সম্মত আছি; ইহাতে যদি আপনি সম্মত হয়েন, দেখুন; নতুবা আমাকে আপনার আশা পরিত্যাগ করিতে হয়।
“বরাভরণের নিমিত্ত আপনি যে তিনশত টাকা মূল্যের ঘড়ি চাহিয়াছেন, তাহা আমি প্রদান করিতে সম্মত আছি।
“সোণার চেন এক ছড়া তিনশত টাকা মূল্যের, তাহাও দিব।
“হীরার আংটী পাঁচশত টাকা মূল্যের তাহাও আমি দিতে প্রস্তুত আছি।
“গার্ডচেন এক ছড়া পচিঁশ ভরি ওজনের কমে যদি না হয়, তাহা হইলেও উহা আমাকে প্রদান করিতে হইবে। কিন্ত বেণারসী চেলী আমি প্রদান করিতে পারিব না।
“কন্যাভরণের নিমিত্ত স্বর্ণ তিনশত ভরি আমি প্রদান করিতে প্রস্তুত আছি। উহাতে যে যে অলঙ্কার প্রস্তত করিতে হইবে, তাহা আমাকে স্পষ্ট করিয়া বলিবেন, আমি সেই সকল গহনা প্রস্তুত করিয়া দিব। কেবল সুবর্ণ বা তাহার মূল্য বলিয়া নগদ কোন অর্থ আমি আপনাকে প্রদান করিব না।
“রৌপ্য একশত ভরি আমি প্রদান করিব না। চল্লিশ ভরি দিয়া কেবলমাত্র মল প্রস্তুত করিয়া দিব।
“পিত্তল-কাসার দানসামগ্রী এক প্রস্থ আমি প্রদান করিব; কিন্তু তাহার মূল্য চল্লিশ পঞ্চাশ টাকার অধিক হইবে না।
“চাঁদির বাসন এক প্রস্থ এক হাজার ভরি প্রদান করা আমার পক্ষে অসম্ভব। তবে যদি আপনি একান্তই না ছাড়েন, তাহা হইলে কাজেই আমাকে উহা প্রদান করিতে হইবে।
“খাট বিছানা আমি প্রদান করিতে পারিব না। উহা দিবার রীতি আমাদিগের নাই।
“নমস্কারী ও ফুলশয্যার নিমিত্ত পাঁচশত টাকা প্রদান করা আমার পক্ষে একবারে অসম্ভব। সেই সকল খরচের নিমিত্ত জোর আমি একশত টাকা প্রদান করিতে পারি।
“নগদ যে চারি হাজার এক টাকা চাহিয়াছেন, উহা আমাকে একবারেই ছাড়িয়া দিতে হইবে। নগদ টাকা আমি একবারেই প্রদান করিতে পারিব না। নিতান্ত না ছাড়েন, চারিশত এক টাকা প্রদান করিব।”
বরের পিতা দেখিলেন, তিনি যাহা যাহা চাহিয়াছিলেন, রামরতন প্রায় তাহাতেই স্বীকৃত হইলেন, অপরাপর দ্রব্যের মধ্য হইতে কেবল কমাইলেন—একশত টাকা মূল্যের চেলী, রৌপ্য ষাট টাকা, পিত্তল-কাসা পঞ্চাশ টাকা, খাট বিছানা দুইশত টাকা ও নমস্কারী প্রভৃতি চারিশত টাকা, মোট আটশত দশ টাকা। কিন্ত নগদ টাকা প্রায় দিতে চাহিতেছেন না। অপরাপর দ্রব্যের নিমিত্ত তিনি একরূপ সম্মত হইলেন; কিন্ত নগদ টাকা একবারে পরিত্যাগ করিতে কিছুতেই সম্মত হইলেন না। অনেক কসা-মাজার পর চারি হাজার এক টাকার পরিবর্ত্তে এক হাজার পাঁচশত এক টাকায় তিনি সম্মত হইলেন।
দেনা-পাওনার বিষয় স্থির হইয়া গেলে, কত ওজনের কি কি অলঙ্কার প্রস্তুত করিতে হইবে, রামরতন তাহার একটী তালিকা লইয়া আপন স্থানে প্রস্থান করিলেন। বিবাহের দিন স্থির হইল। উভয়পক্ষেই বিবাহের উদ্যোগ আরস্ত হইল। রামরতন অলঙ্কার-পত্র সকলের বন্দোবস্ত করিতে লাগিলেন।
যাঁহার এত টাকার সঙ্গতি নাই, তিনি কিরূপে এই সকল অলঙ্কার-পত্রের সংগ্রহ করিলেন, তাহা কি পাঠকগণ অবগত হইতে চাহেন?
সোণার ঘড়ির পরিবর্ত্তে চল্লিশ টাকা মূল্যের একটী রৌপ্য ঘড়ি ক্রয় করিয়া তাহাতে সুবর্ণের গিল্টি করিয়া লইলেন। চেন, গার্ডচেন, অলঙ্কার গ্রতৃতি যাহা যাহা সুবর্ণের দ্রব্য দেওয়ার কথা ছিল, তাহার সমস্তই পিত্তলের ক্রয় করিয়া, তাহা ভাল করিয়া সোণার গিল্টি করাইলেন। হীরার আংটীর পরিবর্ত্তে একটী উৎকৃষ্ট পোকরাজের বা নকল হীরার আংটী ক্রয় করিলেন। রৌপ্যের দানসামগ্রীর বন্দোবস্তও সেইরূপ করিলেন, কম মূল্যে জর্ম্মণ সিল্ভারের বাসন সকল প্রস্তত করিয়া লইলেন। প্রকৃত দ্রব্যের মধ্যে কেবল প্রদান করিলেন, চল্লিশ ভরির মল, চল্লিশ টাকা মুল্যের পিত্তল-কাঁসা, এবং নগদ এক হাজার ছয়শত এক টাকা। পিত্তলের দ্রব্যাদি ক্রয় করিয়া তাহাতে গিল্টি প্রভৃতি করাইতেও প্রায় তাঁহার দুইশত টাকা ব্যয়িত হইল। ইহার উপর বরযাত্রীদিগকে আহার-আদি করাইতে তাঁহার যে টাকা ব্যয়িত হইল, তাহার সর্ব্বশুদ্ধ হিসাব করিলে, একুশ শত কি বাইশ শত টাকার মধ্যেই তাঁহার সমস্ত খরচ সম্পন্ন হইয়া গেল।
দেখিতে দেখিতে শুভ কার্য্য সম্পন্ন হইয়া গেল। বিবাহের পর নববধূ লইয়া বরের পিতা আপন স্থানে গমন করিলেন। ক্রমে তাঁহার সাধ্যমত পাকস্পর্শ প্রভৃতি কার্য্য সকলও শেষ হইয়া গেল। এই সকল কার্য্য শেষ হইয়া যাইবার প্রায় একমাস পরে বরের পিতা জানিতে পারিলেন যে, রামরতন বাবু তাঁহাকে সম্পূর্ণরূপে ঠকাইয়াছেন। এই ব্যাপার জানিতে পারিয়াই তিনি ক্রোধে একবারে অধীর হইয়া পড়িলেন, ও রামরতন বাবুকে ডাকাইয়া তাঁহাকে কহিলেন, “এরূপ ভাবে আমাকে প্রতারণা করা কি আপনার কর্ত্তব্য হইয়াছে?” উত্তরে রামরতন বাবু কহিলেন, “এরূপ প্রতারণা না করিলে, আপনার পুত্ত্রের সহিত আমার কন্যার বিবাহ কি কোনরূপে সম্পন্ন হইতে পারিত? অত টাকা আমি কোথায় পাইব যে, কন্যার সহিত অত টাকা আমি আপনাকে প্রদান করিতে পারি? আপনার সহিত এরূপ জুয়াচুরি করিয়াও, আমাকে যে টাকা ব্যয় করিতে হইয়াছে, তাহাতেও আমি অপরের নিকট ঋণগ্রস্ত। এখন যাহা হইবার হইয়াছে, যাহা করিবার করিয়াছি! এখন আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। আমি যে আপনাকে আর একটীমাত্র পয়সাও এখন প্রদান করিতে পারি, সে ক্ষমতা আমার নাই। এখন অনুগ্রহ করিয়া আপনি আমাকে ক্ষমা করুন, এই আমার প্রার্থনা।”
উত্তরে পাত্রের পিতা কহিলেন, “ক্ষমা! তাহা আমার দ্বারা কখনই হইবে না। আমার প্রাপ্য টাকাগুলি এখন আপনি আমাকে প্রদান করুন, তাহা হইলে আমি আপনাকে ক্ষমা করিতে পারি। নতুবা কখনই আমি আপনাকে ক্ষমা করিব না।”
রামরতন। আমি ত আপনাকে পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে, আর একটা মাত্র পয়সাও আমি আপনাকে প্রদান করিতে পারিব না। ইহাতে চাই আপনি আমাকে ক্ষমা করুন, আর নাই করুন।
উত্তরে বৈবাহিক পুনরায় কহিলেন, ক্ষমা ত কিছুতেই আমা হইতে হইবে না। আমার প্রাপ্য টাকা প্রদান না করিলে আপনার উপর নালিশ করিয়া, আমি আপনাকে কারাগারে প্রেরণ করিব; এবং পরিশেষে আপনার কন্যাকে পরিত্যাগ করিয়া আমার পুত্রের পুনরায় বিবাহ দিব।”
“আপনার যাহা ইচ্ছা হয়, তাহা আপনি করিতে পারেন। এই বলিয়া রামরতন সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন।”
বরের পিতা বড় মানুষ হইলেও, অর্থ-লালসা তাঁহার অতিশয় বলবতী। সুতরাং তিনি সেই অর্থের আশা একবারে পরিত্যাগ করিতে পারিলেন না। মুখে যাহা বলিয়াছিলেন, কার্য্যেও তাহাই করিলেন। রামরতন বাবু তাঁহাকে প্রতারণা করিয়াছেন বলিয়া, তিনি তাঁহার নামে এক ফৌজদারী মোকদ্দমা আরম্ভ করিলেন। রামরতন বাবু কন্যার বিবাহের নিমিত্ত একে ত জুয়াচুরি করিয়াছিলেন; যখন দেখিলেন, তাঁহার বিপক্ষে ফৌজদারী মৌকদ্দমা উপস্থিত করা হইয়াছে, তখন তিনি মিথ্যা বলিতে আরম্ভ করিলেন। মাজিষ্ট্রেট সাহেবের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া তিনি কহিলেন, “ধর্ম্মাবতার! আমি আমার যথা-সর্ব্বস্ব বিক্রয় করিয়া স্বর্ণ-অলঙ্কার প্রভৃতি যাহা কিছু আমার দিবার কথা ছিল, তাহা আমি সমস্তই প্রদান করিয়াছি। বিবাহের পর দিবস আমার বাড়ী হইতে আমার কন্যাকে লইয়া যাইবার পূর্ব্বে, আমার বৈবাহিক মহাশয় আমার প্রদত্ত সমস্ত অলঙ্কারগুলি উত্তম রূপে স্বচক্ষে দেখিয়া লন; কিন্তু তাহাতেও সন্তুষ্ট না হইয়া পরিশেষে একজন স্বর্ণকারকে ডাকাইয়া সকলের সম্মুখে গহনাগুলি ওজন ও যাচাই করিয়া লন। সেই স্বর্ণকার এখন পর্য্যন্ত বর্ত্তমান আছে। বিশেষতঃ যাহাদিগের সম্মুখে সেই সকল গহনা যাচান হইয়াছিল, তাহারাও এখন পর্য্যন্ত বর্ত্তমান। আবশ্যক হইলে তাহারা সকলেই আপনার সম্মুখে উপস্থিত হইয়া সাক্ষ্য প্রদান করিতে প্রস্তুত। মহাশয়! দুঃখের কথা বলিব কি, আমার বৈবাহিক মহাশয় আমার নিকট হইতে আরও কিছু অর্থ প্রার্থনা করেন। সেই অর্থ প্রদানে আমি অসমর্থ হওয়ায়, আমার সহিত উঁহার মনান্তর উপস্থিত হয়; এবং পরিশেষে আমি আমার মেজাজ ঠিক রাখিতে না পারিয়া, অনেকের সম্মুখে উঁহাকে গালি প্রদান করি। উহার প্রতিশোধ লইবার মানসে, আজ তিনি আপনার নিকট আমার নামে এই মিথ্যা অভিযোগ আনয়ন করিয়াছেন”
রামরতন বাবু মুখে যাহা কহিলেন, কার্য্যেও তাহাই করিলেন। আর কিছু অর্থ ব্যয় করিয়া একজন স্বর্ণকার ও অপর কয়েকজন ভদ্রবেশী লোক দিয়া, সেইরূপ ভাবেই সাক্ষ্য গ্রদান করাইলেন। মাজিষ্ট্রেট সাহেবও তাঁহার কথা বিশ্বাস করিয়া তাঁহাকে অব্যাহতি প্রদান করিলেন। রামরতন হাসিতে হাসিতে আপন গৃহে গমন করিলেন।
রামরতন বাবুর বৈবাহিক মোকদ্দমা হারিয়া নিতান্ত দুঃখিত মনে আপন বাড়ীতে গমন করিলেন, এবং মনে মনে স্থির করিলেন, রামরতন বাবু যদি তাঁহাকে সেই সকল অর্থ প্রদান না করেন, তাহা হইলে তিনি তাঁহার কন্যাকে আর আনিবেন না এবং পুনরায় অন্য স্থানে আপনার পুত্ত্রের বিবাহ দিবেন।
মনে মনে এই কথা স্থির করিয়া, একদিবস তিনি তাঁহার মনের ভাব তাঁহার স্ত্রীর নিকট কহিলেন। কিন্তু বালিকাটী অতিশয় সুরূপা ছিল বলিয়া, তাঁহার স্ত্রী তাঁহার প্রস্তাবে সম্মত হইলেন না। ক্রমে সেই কথা তাঁহার পুত্ত্রেরও কর্ণগোচর হইল পুত্ত্রটীও পুনরায় বিবাহ করিতে অসম্মত হইলেন। কাজেই তাঁহার মনের দুঃখ মনেই রাখিয়া রামরতন বাবুর কন্যাকে পুত্রবধূরূপে গ্রহণ করিতে হইল। এইরূপে কিছুদিবস অতিবাহিত হইলে পর, রামরতন বাবু আপন বৈবাহিকের সহিত কিছুদিবস পর্য্যন্ত তোষামোদ করিয়া চলিতে লাগিলেন। পরিশেষে সকল গোলযোগ মিটিরা গেল। রামরতন বাবু এইরূপে জুয়াচুরি করিয়া আপন কার্য্য উদ্ধার করিয়া লইয়াছিলেন।
(খ) বরপক্ষের জুয়াচুরি।
সনাতন বাবু দালালী করিয়া চিরকাল আপন জীবিকা নির্ব্বাহ করিয়া আসিয়াছেন। এখন তাঁহার বয়স একটু অধিক হওয়া-প্রবুক্ত, আর অধিক পরিশ্রম করিতে পারেন না। সুতরাং তাঁহার আয় পূর্ব্ব হইতে অনেক কমিয়া আসিয়াছে। তাঁহার তিন পুত্ত্র। প্রথমটীর বয়ঃক্রম প্রায় ত্রিশ বৎসর হইবে, তাহার বিবাহ হইয়া গিয়াছে, একটা পুত্ত্রও জন্মিয়াছে। কোন একটী সওদাগরি আফিসে মাসিক সত্তর টাকা বেতনে তিনি কর্ম্ম করিয়া থাকেন। অধিক পরিমাণে লেখাপড়া শিক্ষা করা তাঁহার ভাগ্যে ঘটিয়া উঠে নাই। এণ্ট্রেন্স পাস করিয়া কিছুদিবস এল-এ, পর্য্যন্ত পড়িয়াছিলেন; কিন্তু কোন কারণ বশতঃ লেখাপড়া পরিত্যাগ করিয়আ তাঁহাকে চাকরীতে প্রবৃত্ত হইতে হয়।
সনাতন বাবুব দ্বিতীয় পুত্ত্রের নাম সতীন্দ্রনাথ। তাহার বয়ঃক্রম প্রায় সাতাশ বৎসর। লেখাপড়া কিছুমাত্র শিক্ষা করে নাই। কোন কায কর্ম্মের চেষ্টা যে করিতে হয়, তাহা তাহার মনে একদিবসের নিমিত্তও কখন উদিত হয় নাই। বাড়ী হইতে কোনরূপে অর্থ সংগ্রহ করিয়া সুরাপান ও বেশ্যালরে গমন করাই তাহার জীবনের একমাত্র মুখ্য উদ্দেশ্য়। তাহার বিবাহ হয় নাই। সনাতন বাবু তাহার বিবাহের নিমিত্ত অনেক চেষ্টা করিয়াছিলেন; কিন্ত তাহার চরিত্র দেখিয়া, বা তাহার বিষয় লোকমুখে শুনিয়া এ পর্য্যন্ত কেহই তাহাকে আপন কন্যা প্রদান করিতে সম্মত হন নাই। সতীন্দ্রের গুণের মধ্যে এই ছিল যে, সে অতিশয় মিষ্টভাষী, সকলের সহিত বেশ মিলিতে পারিত, ও ভদ্র-ব্যবহারে সকলকে সন্তুষ্ট রাখিতে পারিত।
সনাতনের তৃতীয় পুত্রের নাম শচীন্দ্রনাথ। সে অতিশয় বুদ্ধিমান, এখনকার কালে লেখাপড়ায় যতদূর উতকৃষ্ট হইতে হয়, তাহা হইয়াছে। এণ্ট্রেন্স হইতে আরম্ভ করিয়া, এল-এ, বি-এ, এম-এ প্রভৃতিতে সর্ব্বোচ্চ হইয়া আসিয়াছে। এবার ষ্টুডেণ্টশিপ পরীক্ষায় পাস হওয়াতে, তাহাকে দশ হাজার[১] টাকা পারিতোষিক দিবার জন্য শিক্ষা-বিভাগ আদেশ প্রদান করিয়াছেন।
এই সংবাদ সংবাদ-পত্রে প্রকাশিত হইবার পরই শচীন্রের সহিত নিজ নিজ কন্যার বিবাহ দিবার নিমিত্ত চারিদিক হইতে কন্যাকর্ত্তাগণ সনাতনের বাটীতে আসিতে আরম্ভ করিলেন। কেহবা বংশের প্রলোভন দেখাইয়া, কেহবা অর্থের প্রলোভন দেখাইয়া, এবং কেহবা সুশ্রী বালিকার প্রলোভন দেখাইয়া, সনাতন বাবুর নিকট শচীন্দ্রের বিবাহের কথা উত্থাপন করিতে লাগিলেন। সনাতন বাবু পুরাতন দালাল। তিনি কাহাকেও কোনরূপে অসন্তুষ্ট না করিয়া, বা কাহাকেও কোনরূপ পরিষ্কার উত্তর না দিয়া, সকলকেই হাতে রাখিলেন।
পূর্ব্বে তিনি সতীন্দ্রনাথের বিবাহের নিমিত্ত অনেক চেষ্টা করিরাছিলেন; কিন্ত কোনরূপেই কৃতকার্য্য হইতে পারেন নাই। এখন শচীন্দ্রনাথের বিবাহের উপলক্ষে তাঁহার মনে নানাপ্রকার চিন্তা আসিয়া উপস্থিত হইতে লাগিল। প্রথম চিন্তা, এই সময় পুনর্ব্বার সতীন্দ্রনাথেরও বিবাহের চেষ্টা করেন। একটী বড় বালিকার সহিত তাহার বিবাহ দিতে না পারিলে, উহার চরিত্র সংশোধনের আর কোনরূপ উপায় নাই। দ্বিতীয় চিন্তা, শচীন্দ্রনাথের বিবাহের সময়ও উপস্থিত হইয়াছে। এই সময়ে তাহার বিবাহ দেওয়াও সম্পূর্ণরূপে কর্ত্তব্য; কিন্তু তাহার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা সতীন্দ্রনাথের বিবাহ অগ্রে না হইলে কনিষ্ঠের বিবাহই বা হিন্দু হইয়া কিরূপে প্রদান করিতে পারেন।
এইরূপ ও অন্যান্য নানা চিন্তায় তিনি একবারে অধীর হইয়া পড়িলেন কিন্তু আপনার মনের ভাব কাহারও নিকট প্রকাশ না করিয়া, কোন্ উপায় অবলম্বন করিলে, চারিদিক বজায় রাখিতে পারেন, কোন দিকে কোন গোলযোগ না হইয়া, সুশৃঙ্খলার সহিত তাঁহার মনের অভিলাষ সফল করিতে পারেন, কেবল সেই চিন্তাতেই আপন মন নিযুক্ত করিলেন।
সনাতন অনেকরূপ ভাবিয়া চিন্তিয়া দেখিলেন যে, জুয়াচুরি ভিন্ন কোনরূপেই তিনি সতীন্দ্রনাথের বিবাহ দিতে পারেন না। সুতরাং পুত্ত্রের বিবাহের নিমিত্ত জুয়াচুরি-ব্যবসা অবলম্বন করিতেও তিনি কোন প্রকারেই কুণ্ঠিত হইলেন না। বিশেষতঃ তিনি মনে মনে যেরূপ জুয়াচুরির উপায় স্থির করিলেন, তাহা কার্য্যে পরিণত করিতে পারিলে যে, কেবলমাত্র তিনি তাঁহার দুশ্চরিত্র পুত্র সতীন্দ্রনাথের বিবাহ দিতে পারিবেন, তাহা নহে; সেই সঙ্গে সঙ্গে কন্যাপক্ষীয় লোকের নিকট হইতে তিনি কিছু অর্থও সংগ্রহ করিতে পারিবেন। মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া, এখন হইতে যে কোন ব্যক্তি শচীন্দ্রনাথের বিবাহের প্রস্তাব করিতে তাঁহার নিকট আগমন করিতে লাগিলেন, তাঁহাদিগের মধ্যে কন্যাকর্ত্তার অবস্থা ও বুদ্ধিমত্তার অভাব বিবেচনায় শচীন্দ্রনাথের পরিবর্ত্তে সতীন্দ্রনাথকে দেখাইয়া, তাহারই বিবাহের কথা ঠিক করিতে লাগিলেন।
বিবাহের কথাবার্ত্তা ঠিক করিবার পূর্ব্বে সনাতন যে কন্যাকর্ত্তাদিগকে একটু চালাক-চতুর বিবেচনা করিলেন, বা যাঁহারা আইন-কানুন অবগত আছেন, এরূপ বুঝিলেন, এবং যে সকল ব্যক্তিকে বড়লোক বলিয়া জানিতে পারিলেন, তাঁহাদিগের নিকট তাঁহার স্থিরীকৃত জুয়াচুরি-সংশ্লিষ্ট বিবাহের প্রস্তাব করিতে সাহসী হইলেন না। যে মধ্যবিত্ত লোকদিগকে নিতান্ত নিরীহ বলিয়া তাঁহার বিশ্বাস হইল, তাঁহাদিগের সহিতই সেই জুয়াচুরি-বিবাহের কথাবার্ত্তা ঠিক করিতে প্রবৃত্ত হইলেন।
সনাতন মনে মনে যেরূপ ভাবিতেছিলেন, কার্য্যেও ঠিক সেইরূপ জুটিয়া গেল। একদিবস তিনি আপন বাড়ীতে বসিয়া আছেন, এরূপ সময় একটী লোক আসিয়া তাঁহার বাড়ীতে উপস্থিত হইলেন। সনাতনকে দেখিয়া তিনি কহিলেন, “মহাশয়! আপনার একটী পুত্ত্র এবার ষ্টুডেণ্টশিপ পরীক্ষায় পাস হইয়াছে, একথা কি প্রকৃত?”
সনাতন। হাঁ। কেন মহাশয়!
আগন্তুক। আপনি নাকি তাহার বিবাহের নিমিত্ত চেষ্টা করিতেছেন?
সনাতন। হাঁ, অনেকেই তাহার বিবাহের নিমিত্ত আমার নিকট আসিতেছেন।
আগন্তুক। আপনার সেই পুত্ত্রের নাম কি?
সনাতন। শচীন্দ্রনাথ।
আগন্তুক। আপনি বলিলেন, শচীন্দ্রনাথের বিবাহের নিমিত্ত অনেকেই আপনার নিকট আগমন করিতেছেন; কিন্তু তাহার বিবাহের স্থির হইতেছে না কেন?
সনাতন। আমি মনোমত কন্যা পাইতেছি না বলিয়া, এ পর্য্যন্ত বিবাহের ঠিক হয় নাই।
আগন্তুক। আপনি কিরূপ কন্যা চাহেন?
সনাতন। কন্যাটী বড় চাহি, এবং বেশ সুশ্রী চাহি।
আগন্তুক। পুত্ত্রবধূ করিতে সুশ্রী কন্যা পিতা মাত্রই অনুসন্ধান করিয়া থাকেন; কিন্তু বড় কন্যা চাহিতেছেন কেন?
সনাতন। আমার পুত্ত্রটীর বয়ঃক্রম একটু অধিক হইয়াছে, তাহাতেই একটী বড়গোছের বালিকার অনুসন্ধান করিতেছি। নতুবা মানাইবে কেন?
আগন্তুক। আপনার পুত্ত্রটীর বয়ঃক্রম কত হইয়াছে?
সনাতন। পঁচিশ বৎসর।
আগন্তুক। এ অধিক বয়স কি? আপনি কত বড় বালিকা চাহেন?
সনাতন। হিন্দুর ঘরে যত বড় সেয়ানা কন্যা থাকিতে পারে।
আগন্তক। বার বৎসরের অধিক বযস্কা কন্যা হিন্দুর ঘরে কখনই আপনি পাইবেন না।
সনাতন। বার বৎসর হইলেই যথেষ্ট হইল; কিন্তু কন্যাটী বেশ সুশ্রী হওয়া আবশ্যক। কেন মহাশয়! আপনি এত কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন?
আগন্তুক। আমি কন্যাদায়-গ্রস্ত বলিয়াই আপনার নিকট আসিয়াছি।
সনাতন। আপনার কন্যাটী কেমন? এবং তাহার বয়সই বা এখন কত হইয়াছে?
আগন্তুক। আপনি যেরূপ চাহিতেছেন, তাহাই। আমার কন্যা এগার বৎসর অতিক্রম করিয়া, বার বৎসরে উপনীত হইয়াছে। দেখিলে জানিতে পারিবেন, এরূপ সুশ্রী কন্যা এক হাজার কন্যার মধ্যে একটী পাওয়া যায় কি না। এই নিমিত্ত আমার প্রার্থনা, আপনি আমার সেই কন্যাটীকে একবার স্বচক্ষে দর্শন করুন।
সনাতন। আপনার নিবাস কোথায়?
আগন্তুক। বর্দ্ধমান জেলার অন্তর্গত * * গ্রামে।
সনাতন। আচ্ছা মহাশয়! আপনি কল্য আমার নিকট আগমন করিবেন, হয় আমি নিজে আপনার সহিত গমন করিব, না হয়, অপর কোন এক ব্যক্তিকে আপনার সহিত যাইতে বলিব, তিনি গিয়া দেখিয়া আসিলেই হইবে।
আগন্তুক। আমি সাহস করিয়া বলিতে পারি, আমার কন্যা যিনি দেখিবেন, তাঁহারই মনোনীত হইবে। কিন্তু পূর্ব্বে একবার দেনা-পাওনার কথাটী বলিলে হইত না? তাহা হইলে আমি জানিতে পারিতাম, সেই পরিমিত টাকার সংস্থান করিবার ক্ষমতা আমার আছে কি না।
সনাতন। কন্যা মনোনীত হইলে, দেনা-পাওনার নিমিত্ত ততটা বাধা রহিবে না। তবে কি না, যেরূপ বিদ্বান্ বালকের হস্তে আপনি কন্যাদান করিতে প্রবৃত্ত হইতেছেন, তাহাতে একবারেই যে কিছু লাগিবে না, তাহা নহে। অগ্রে কন্যা মনোনীত হউক, তাহার পর সকল বিষয় সহজেই মিটিয়া যাইবে।
আগন্তুক। আচ্ছা মহাশয়! তাহাই হইবে। আমি কল্য অতি প্রত্যূষে আপনার নিকট আগমন করিব; কিন্তু আমার ইচ্ছা, আপনি নিজে গিয়া আমার কন্যাটীকে স্বচক্ষে দর্শন করেন।
সনাতন। আচ্ছা দেখিব, পারি যদি আমি নিজেই যাইব।
আগন্তুক। মহাশয়! আমি আর একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করি।
সনাতন। কি?
আগন্তুক। আপনার পুত্রটী এখন কোথায়?
সনাতন। বাড়ীতেই আছে।
আগন্তুক। তাহাকে একবার আমি দেখিতে পাই কি?
সনাতন। কেন পাইবেন না? আপনি যাহাকে জামাতা করিতে চাহিতেছেন, তাহাকে দেখিতে পাইবেন না, একথা কি হইতে পারে? আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি তাহাকে আপনার সম্মুখে এখনই আনিতেছি।
এই বলিয়া সনাতন বাটীর ভিতর প্রবেশ করিলেন, এবং কিছু পরেই তাঁহার সেই মূর্খ ও বেশ্যাসক্ত পুত্র সতীন্দ্রনাথকে সঙ্গে করিয়া আনিয়া, তাহাকে কহিলেন, “মহাশয়! ইনিই আমার পুত্ত্র। আমি অনেক কষ্টে ইহাকে লেখা পড়া শিখাইয়াছি। ইনিই এবার দশ হাজার টাকা পারিতোষিক পাইয়াছেন।”
সনাতনের এই কথা শুনিয়া আগন্তুক একবার তাহার আপাদ-মস্তক নিরীক্ষণ করিলেন, এবং তাহাকে কহিলেন, “বাবা! তোমার নাম কি?”
সতীন্দ্রনাথ অবলীলাক্রমে কহিল, “আমার নাম শচীন্দ্রনাথ।” সে যে এই মিথ্যা কথা আপনার ইচ্ছানুযায়ী কহিল, তাহা নহে। পিতার শিক্ষামতই সে তাহার মিথ্যা নাম বলিয়া আপনার পরিচয় প্রদান করিল।
আগন্তুক পাত্র দেখিয়া সন্তুষ্ট হইলেন ও কহিলেন, “বেশ ছেলে।” সনাতনকে কহিলেন, “আপনি বলিতেছিলেন, আপনার পুত্ত্রের বয়স কিছু অধিক হইয়াছে। কৈ, আমার বিবেচনার ইহার বয়ঃক্রম কিছুমাত্র অধিক হয় নাই; বিবাহের উপযুক্ত বয়সই এখন হইয়াছে। আমার কন্যার সহিত ইহাকে বেশ মানাইবে।” এই বলিয়া তিনি সতীন্দ্রকে কহিলেন, “যাও বাবা! তুমি এখন বাড়ীর ভিতর গমন কর।” সতীন্দ্রনাথ সেই স্থান হইতে উঠিয়া অন্য স্থানে প্রস্থান করিল।
সতীন্দ্রনাথ দেখিতে নিতান্ত মন্দ ছিল না। তাহাকে দেখিয়া আগন্তুকের বেশ পসন্দ হইল। তাহার উপর সে যেরূপ উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত শুনিলেন, তাহাতে এরূপ পাত্রকে কে পসন্দ না করিয়া থাকিতে পারে?
পরদিবস সনাতন কন্যার পিতার সহিত বর্দ্ধমানে গমন করিয়া কন্যাটী দেখিয়া আসিলেন। দেখিলেন, কন্যাটী অতি সুরূপা, ও বয়ঃক্রম প্রায় তের বৎসর। কন্যাটী দেখিয়া সনাতন তাহার পিতাকে কহিলেন, “আপনার কন্যাটী সুশ্রী, ইহাকে আমি আমার পুত্ত্রবধূ করিতে পারি; কিন্তু এখন দেনা-পাওনার বিষয়টা কি হইবে?”
কন্যার পিতা। আমার অবস্থা ত আপনি স্বচক্ষে দেখিয়া গেলেন। আপনাকে এখানে আনিবার আমার প্রধান উদ্দেশ্য, আমার অবস্থা আপনাকে দেখান। এখন বিবেচনা-মত আপনি যাহা কহিবেন, তাহাই আমি আপনাকে প্রদান করিতে প্রস্তুত আছি। কারণ, আপনার পুত্ত্রের সদৃশ বিদ্বান্ পাত্রের হস্তে কন্যা সমর্পণ করিতে কোন্ ব্যক্তি পরাঙ্মুখ হয়েন? তবে আমার প্রতি একটু অনুগ্রহ করিবেন, এই প্রার্থনা।
সনাতন। দেখুন মহাশয়। আমার পুত্ত্র নিজেই দশ হাজার টাকা পারিতোষিক পাইয়াছে। কন্যাটী যখন আমার একরূপ পসন্দ হইয়াছে, তখন টাকার নিমিত্ত আমি তত পীড়াপীড়ি করিব না। তবে এখন বিবেচনা মত আপনি নিজেই বলিয়া দিন, আপনি অলঙ্কার-পত্র প্রভৃতি সমস্ত দ্রব্যের জন্য মোট আমাকে কত টাকা দিতে পারিবেন?
কন্যার পিতা। মহাশয়! সর্ব্বশুদ্ধ আমি এক হাজার পাঁচশত টাকা আপনাকে প্রদান করিব। ইহাতেই অনুগ্রহ করিয়া আমার উপর আপনাকে সদয় হইয়া, কন্যাদায় হইতে আমাকে উদ্ধার করিতে হইবে।
সনাতন। অত কম টাকায় কিরূপে আপনি এইরূপ পাত্র পাইতে পারেন? আমি অধিক টাকা চাহিতেছি না, সর্ব্বশুদ্ধ আমাকে দুই হাজার পাঁচশত টাকা প্রদান করিবেন।
সনাতনের এই কথা শুনিয়া কন্যার পিতা অনেক তোষামোদ করিয়া পরিশেষে সনাতনকে দুই হাজার টাকায় সম্মত করাইলেন।
ক্রমে বিবাহের সমস্ত ঠিক হইয়া গেল। সনাতন কন্যাকর্ত্তার জাতি-কুল সম্বন্ধে একটু অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিলেন, জাত্যাদির বিষয়ে কোনরূপ গোলযোগ নাই। কন্যার পিতাও সে সম্বন্ধে একটু অনুসন্ধান করিলেন, তিনিও জাতি-কুল সম্বন্ধে কোনরূপ দোষ বাহির করিতে পারিলেন না। কন্যাপক্ষীয়গণ আরও একটু অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিলেন যে, সেই বৎসর সনাতনের পুত্র শচীন্দ্রনাথ প্রকৃতই ষ্টুডেণ্টশিপ পরীক্ষার উত্তীর্ণ হইয়া দশ হাজার টাকা পারিতোষিক পাইয়াছে।
উভয় পক্ষের ভিতরের অনুসন্ধান শেষ হইয়া গেল। তখন উভয় পক্ষের মতানুসারে বিবাহের দিন স্থিরীকৃত হইল। সনাতন উদ্যোগ করিয়া যাহাতে অতি শীঘ্র এই বিবাহ দেওয়াইতে পারেন, তাহাই করিয়া আসিতেছিলেন। কারণ, বিলম্ব হইলে, পাছে তাঁহার জুয়াচুরির কথা প্রকাশ হইয়া পড়ে; সেই ভয়ে, তিনি যত নিকটে বিবাহের দিন পাইলেন, তত নিকটেই দিনস্থির করিলেন। দুইদিন পরেই দিন হইল। বিবাহের পূর্ব্ব-দিবেই আয়ুর্বৃদ্ধ্যন্ন প্রভৃতি সমস্ত কার্য্য শেষ হইয়া গেল। বিবাহের দিবস সকাল সকাল বর লইয়া গিয়া বিবাহ-কার্য্য সম্পন্ন করাইলেন। দূর-পথের ভান করিয়া সনাতন নিজের নিতান্ত নিকট-আত্মীয় অর্থাৎ যাঁহাদের না পাইলে কার্য্য উদ্ধার হইবে না, তাঁহাদের দুই চারিজনমাত্রকে বরবাত্রী স্বরূপে লইয়া গিয়াছিলেন। যাহা হউক, যথানিয়মে বিবাহ শেষ হইয়া গেল।
এখানে বলা বাহুল্য যে, সনাতনের তৃতীয় পুত্র ষ্টুডেণ্টশিপ পরীক্ষোত্তীর্ণ শচীন্দ্রনাথের সহিত এ বিবাহ হইল না; সেই দুশ্চরিত্র মধ্যম পুত্র সতীন্দ্রনাথের সহিত হইয়া গেল।
এখন পাঠক! বুঝিতে পারিলেন যে, এইরূপ জুয়াচুরি করিয়া সনাতন আপনার মূর্খ, লম্পট ও সুরাপায়ী পুত্ত্রের বিবাহ দিয়া দুই সহস্র টাকা গ্রহণ করিলেন।
বিবাহের সময় কন্যার পিতা প্রকৃত কথা কিছুই জানিতে পারিলেন না। বিবাহের প্রায় দুই তিনমাস পরে তিনি যে কিরূপ জুয়াচোরের হস্তে পতিত হইয়া চিরদিবসের নিমিত্ত আপন কন্যার সর্ব্বনাশ-সাধন করিয়াছেন, তাহা অবগত হইতে পারিলেন। কিন্তু হিন্দুর বিবাহ! সুতরাং সমস্তই তাঁহাকে সহ্য করিয়া থাকিতে হইল।
সনাতনের ভাগ্যবলেই হউক, বা কন্যার পিতার মনোকষ্টের নিমিত্তই হউক, অথবা সুকুমারী বালিকার অদৃষ্টক্রমেই হউক, বিবাহের পর হইতেই সতীন্দ্রনাথের চরিত্রের পরিবর্ত্তন আরম্ভ হইল। সে সুরা পরিত্যাগ করিল, বেশ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করিয়া বৈষয়িক কার্য্যে আপনার মন নিযুক্ত করিল, এবং একটী ব্যবসা আরম্ভ করিয়া তাহা হইতেই বেশ দশ টাকা উপার্জ্জন করিতে লাগিল।
কিছুদিবস পরে প্রকৃত শচীন্দ্রনাথেরও বিবাহ হইয়া গেল। এই বিবাহে কন্যাকর্ত্তার নিকট হইতে সনাতন প্রায় ছয় সাত হাজার টাক গ্রহণ করিলেন। *
সম্পুর্ণ।
* ফাল্গুন মাসের সংখ্যা,
“দায়ে খুন”
(অর্থাৎ যেমন জুয়াচুরি তেমনই সাজা!)
যন্ত্রস্থ।
- ↑ ষ্টুডেণ্টশিপ পরীক্ষার পারিতোষিক, কোম্পানীর কাগজের সুদ কমিয়া যাওয়ার নিমিত্ত এখন আট হাজার টাকা হইয়াছে; কিন্তু আমি যে সময়ের কথা বলিতেছি, সেই সময় উক্ত পরীক্ষার পারিতোষিক দশ হাজার টাকা ছিল।