রকম রকম/নিলামে জুয়াচুরি
নিলামে জুয়াচুরি।
মফঃস্বলবাসী প্রায় সমস্ত লোকেরই বিশ্বাস যে, সময় সময় কলিকাতায় নিলামে অত্যন্ত সুলভ মূল্যে অনেক মাল বিক্রীত হইয়া থাকে। বাস্তবিক সময়ে সময়ে কোন কোন দ্রবা নিলাষে প্রকৃতই সুলভ মূল্যে বিক্রীত হয়!
জুয়াচুরিই যাহাদিগের ব্যবসা, তাহারা কি উপায়ে লোক ঠকাইতে পারিবে, রাত্রিদিন কেবল সেই চিন্তাতেই ঘুরিয়া বেড়ায়। “সুলভ মূল্যে নিলামে মাল বিক্রর হয়,” ইহাই মফঃস্বলবাসীগণের বিশ্বাস। এই কথা যেমন জুয়াচোরগণ জানিতে পারিল, অমনি তাহারা সহরের মোড়ে মোড়ে এক একটা নিলামের দোকান খুলিয়া বসিল। এইরূপ নিলামের দোকান সহরের মধ্যে এক সময় অনেক গুলি স্থাপিত হইয়াছিল; আজকাল যে সে সমস্ত গুলিই একবারে অন্তর্হিত হইয়াছে, তাহা নহে। এই সহরের স্থানে স্থানে এখনও সেইরূপ এক একটী নিলামের দোকান বর্ত্তমান আছে, এবং প্রায়ই তাহারা মফঃস্বলবাসী কোন বাক্তিকে দেখিতে পাইলে, তাহার নিকট হইতে কিছু না কিছু গ্রহণ করিয়া থাকে। উহাদিগের কার্য্য-প্রণালী এইরূপ;—
রাস্তার ধারে একটা দোকানের মধ্যে অনেকরূপ উত্তম উত্তম দ্রব্যাদি সজ্জিত থাকে। দেই দোকানের সম্মুখে একজন বসিয়া অনবরত ঘণ্টাধ্বনি করিতেছে। দোকানের মধ্যে এক ব্যক্তি সেই সকল দ্রব্যের মধ্যস্থিত কোন একটী দ্রব্য হস্তে লইয়া অপরে যে মূল্য বলিয়াছে, সেই মুল্য বারে বারে উচ্চারণ করিয়া উহার মূল্য-বৃদ্ধি করিবার চেষ্টা করিতেছে। অর্থাৎ একজন কহিল, “এক টাকা” যে ব্যক্তি সেই দ্রব্য বিক্রয় করিতে বসিয়াছে, সে উহার দাম “এক টাকা এক টাকা” বলিয়া, যে পর্য্যন্ত অপর কোন বাক্তি উহার অধিক দাম না বলিল, সেই পর্য্যন্ত অনবরত সেইরূপেই চীৎকার করিতে লাগিল। অপর কোন ব্যক্তি যেমন তাহার দাম কিছু বাড়াইয়া বলিল, বিক্রেতার সুরও সেইরূপ পরিবর্ত্তিত হইল। এইরূপে যাহার দরের উপর অপর আর কেহ অধিক দাম প্রদান করিতে স্বীকৃত না হয়, সেই দ্রব্য তখন সেই বাক্তি তাহার কথিত মূল্যেই পাইয়া থাকে। ইহাই নিলামের পদ্ধতি! কিন্ত এ নিলাম সেই প্রকারের হইলেও, ইহার উদ্দেশ্য স্বতন্ত্র! এই স্থানে প্রকৃত ক্রেতা একজনও নাই, ক্রেতারূপে যে সকল ব্যক্তি দোকানের ভিতর দাঁড়াইয়া বিক্রেয় দ্রবোর দাম বর্দ্ধিত করিবার চেষ্টা করিতেছে, তাহারা সকলেই একদল-ভুক্ত-জুয়াচোর, কেহবা জুয়াচোরের চাকর। উহারা যেমন দেখিল, একজন পল্লীগ্রাম-নিবাসী নিরীহ লোক সেই দোকানের সম্মুখ দিয়া গমন করিতেছে, অমনি তাহারা চীৎকারস্বরে নিলাম আরম্ভ করিয়া দিল। সেই আগন্তক ব্যক্তি নিলামের প্রলোভনে ভুলিয়া যেমন দোকানের ভিতর প্রবেশ করিল, অমনি দেখিতে পাইল, একটা লোক প্রয়োজনীর দ্রব্য—যাহার দাম পাঁচ টাকার কম নহে, তাহা পাঁচ পয়সায় বিক্রয় করিতে বসিয়াছে। এক ব্যক্তি ডাকিল, ছয় পয়সা, অপরে কহিল, “নয় পয়সা” আগন্তক ডাকিল, “দশ পয়সা।” তাহার পর হয় ত আর কেহই ডাকিল না, যদি ডাকিল, কেবল উহার দাম আর এক পয়সা বাড়াইয়া দিল। সেই ব্যক্তি যেমন বার পয়সা ডাকিল, অমনি সকলে চুপ করিল। সুতরাং সেই দ্রব্য যিনি সর্ব্বশেষে ডাকিয়াছেন, তাঁহারই হইল। আগন্তুক সবিশেষ হৃষ্ট অন্তঃকরণে সেই দ্রব্যটী আপন হস্তে গ্রহণ করিয়া তাঁহার ব্যাগ হইতে বারটা পয়সা বাহির করিয়া দিল। ব্যাগ হইতে সেই পয়সা বাহির করিবার কালীন জুয়াচোরগণ দেখিয়া লইল, তাঁহার নিকট আর কতগুলি টাকা আছে। তাহার পরই উহার সহিত গোলযোগ আরম্ভ করিল, যদি উহার নিকট আর সাত টাকা থাকে, তাহা হইলে সেই দ্রব্য-বিক্রেতা বলিয়া উঠিল, “কি মহাশয়! কেবল পয়সা বারটী দিলেন, টাকা কয়েকটী দিলেন না?” আগন্তুক বিস্মিত হইয়া কহিল, “সে কি মহাশয়! টাকা কিসের?” উত্তরে বিক্রেতা কহিল, “কেন, ওই দ্রব্য যে আট টাকা তিন আনায় বিক্রীত হইয়া গেল। আপনি কি ভাবিতেছেন যে, কেবল তিন আনায় আপনি ওই দ্রব্য প্রাপ্ত হইলেন?” দোকানদারের এই কথা শুনিয়া, আগন্তক একবারে বিস্মিত হইয়া পড়িল। দেখিল, ক্রেতারূপী জুয়াচোরগণও সেই দোকানদারের কথা সমর্থন করিয়া কহিল, “দোকানদার মহাশয় যাহা কহিতেছেন, তাহা প্রকৃত। ওই দ্রব্যের ‘বিট’ প্রথমেই আটটাকা হইতে আরম্ভ হইয়া জাট টাকা তিন আনায় বিক্রীত হইয়াছে।”
এই কথা শুনিয়া আগন্তুক চতুর্দ্দিক অন্ধকার দেখিল, এবং উহাদিগের সকলের ভাব-গতি দেখিয়া অনন্যোপায় হইয়া সেই দ্রব্য গ্রহণ করিতে অসম্মত হইল; কিন্তু যখন দেখিল, সেই দ্রব্য গ্রহণ না করিলে তাহার আর উপার নাই, তখন তাহার নিকট যে সাত টাকা ছিল, তাহা প্রদান করিয়া পরিশেষে অব্যাহতি পাইল। আর যদি সে একটু উগ্রমূর্ত্তি ধারণ করিয়া সেই টাকা প্রদান করিতে অসম্মত হইলে, তাহা হইল সেই দোকানের সমস্ত লোক একত্র হইয়া বল-পুর্ব্বক তাহার নিকট যে কিছু অর্থ পাইল, তাহা কাড়িয়া লইয়া তাহাকে সেই স্থান হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিল। অনন্যোপায় হইয়া সে তখন আস্তে আস্তে আপন দেশ অভিমুখে প্রস্থান করিল। আর এইরূপে ঠকিয়া কোন ব্যক্তি যদি কলিকাতাবাসী কোন লোকের পরামর্শ মত থানায় গিয়া নালিশ করিলেন, তাহা হইলে পুলিস-কর্ম্মচারীও তাঁহার অভিযোগ শ্রবণ করিয়া এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইলেন বটে; কিন্ত কার্য্যে কিছুই করিয়া উঠিতে পারিলেন না। সেই পল্লীগ্রাম-নিবাসী লোকটীর সপক্ষে একটীমাত্রও প্রমাণ সংগৃহীত হইল না। অধিকন্তু জুয়াচোরগণ একত্র মিলিত হইয়া সেই নিলাম-কার জুয়াচোরের পক্ষ-সমর্থন করিয়া, ফরিয়াদীর বিপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করিল, ও ইহাই প্রতিপন্ন করিয়া দিল যে, দোকানদারের কিছুমাত্র অপরাধ নাই; সমস্ত দোষই সেই মফঃস্বল-বাসীর।
এইরূপে কত নিরীহ মফঃস্বলবাসী-লোক সুলভ মূল্যে নিলামে দ্রব্যাদি ক্রয় করিতে গিয়া নিত্য যে কত জুয়াচোরের হস্তে পড়িতেছেন, তাহার আর সংখ্যা নাই।
ইহা ব্যতীত মফঃস্বলবাসীগণকে ঠকাইয়া লইবার নিমিত্ত কোন কোন জুয়াচোর নিলামের ন্যায় আর এক প্রকার জুয়াচুরির দোকান খুলিয়া বসিয়া আছে, এবং দোকানের ভিতর প্রবেশ করিয়া নিত্য কত লোককে যে ঠকাইতেছে, তাহার ইয়ত্তা নাই। এই দোকানও নিলামের দোকান-সদৃশ; দোকানের সম্মুখে নিলামের ন্যায় ঘণ্টাও বাজিয়া থাকে। সেই দোকানে নিলাম হইতেছে ভাবিয়া, মফঃস্বলবাসীগণ প্রায়ই সেই দোকানে প্রবেশ করিয়া থাকেন। সেই দোকানের মধ্যভাগে পাতিত একটী টেবিলের উপর বা দোকানের মধ্যস্থিত গ্লাসকেসের মধ্যে নানা প্রকারের বহুমূল্য দ্রব্য সকল সাজান আছে। উহাদিগের কোন দ্রব্যেরই দাম পঁচিশ টাকার কম নহে, বরং একশত দুইশত টাকা পর্য্যন্ত হইতে পারে। সেই সকল দ্রব্যের প্রত্যেকগুলিরই উপর কাগজের টিকিটে একটী একটী নম্বর লেখা আছে। যিনি দোকানের অধিকারী বলিয়া পরিচয় প্রদান করিয়া থাকেন, তাহার সম্মুখে একটী খোলা বাক্সের মধ্যে কতকগুলি সাদা “কার্ড” আছে, উহাতেও একটী একটী নম্বর লেখা আছে। তাহার সম্মুখে পূর্ব্ব-বর্ণিত নিলামের দোকানের ন্যায় সেই দলের অপর কতকগুলি জুয়াচোর ক্রেতারূপে দণ্ডায়মান হয়। ইহাদিগের মধ্যে না-আছে-এমন জাতিই নাই। সাহেব আছেন, ইহুদি আছেন, মুসলমান আছেন, বাঙ্গালি আছেন, এক কথায় অনেক জাতির অনেক লোক সেই স্থানে এরূপ ভাবে দেখিতে পাওয়া যায় যে, তাহাদিগের অবস্থা বা চালচলন দেখিয়া, তাহাদিগের সহিত আলাপ পরিচয় করিয়া, কেহই বুঝিয়া উঠিতে পারেন না যে, উহারা জুয়াচোর।
আগন্তক দোকানের মধ্যে প্রবেশ করিবামাত্রই একজন নিজের পকেট হইতে একটা টাকা বাহির করিয়া সেই দোকানদারের হস্তে প্রদান করিল। দোকানদার তাহার সম্মুখস্থিত সেই খোলা কার্ডের বাক্সটী দেখাইয়া দিয়া কহিল, “উহার ভিতর হইতে আপনি একখানি কার্ড বা টিকিট গ্রহণ করুন।” তিনি তাহার ভিতর হইতে একখানি টিকিট গ্রহণ করিয়া সেই দোকানদারের হস্তে প্রদান করিলেন। দোকানদার সেই টিকিটের দিকে একবার লক্ষা করিয়া কহিল, “আপনার টিকিটের নম্বর এক হাজার দুইশত দুই। এই নম্বর সংযুক্ত যে দ্রব্য এই দোকানে সাজান আছে, তাহা আপনার।” এই কথা শুনিয়া তিনি দোকানের ভিতর অনুসন্ধান করিয়া দেখিতে লাগিলেন, কোন্ দ্রব্যের উপর এক হাজার দুইশত দুই নম্বর আছে। অমনি দোকানদারের আর একজন সাহায্যকারী সেই টেবিলের উপর হইতে একটী সুবর্ণ-নির্ম্মিত একটী ঘড়ি বাহির করিয়া দিল ও কহিল, “ইহাই এক হাজার দুইশত দুই নম্বরের দ্রব্য।” এই কথা বলিয়া সেই ঘড়িটী তাহার হস্তে প্রদান করিল ও কহিল, “আপনার অদৃষ্ট খুব ভাল, এক টাকায় আপনি দুইশত টাকা মূল্যের ঘড়িটী পাইলেন।”
ইহার পরই আর একজন আর একটা টাকা দিয়া একখানি টিকিট ক্রয় করিল। সেও একখানি বড়গোছের গেলাস বা আয়না পাইল; তাহার মূল্যও চল্লিশ টাকার কম নহে।
আগন্তক ব্যক্তি ইহা দেখিয়া, এবং মধ্যে মধ্যে ক্রেতারূপী জুয়াচোরগণের প্রলোভন-যুক্ত বাক্য শুনিয়া তিনিও একটী টাকা বাহির করিয়া একখানি টিকিট ক্রয় করিলেন; কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, তিনি মূলাবান্ দ্রব্যের পরিবর্ত্তে এক পয়সা মূলোর একটী পেন্সিল পাইলেন। জুয়াচোরগণের প্রতারণায় পড়িয়া পুনরায় আর একটী টাকা বাহির করিলেন, সে বারে—পাইলেন এক বাণ্ডিল সুচি। তাঁহার নিকট আঠারটী টাকা ছিল, এইরূপে তাঁহার অনিচ্ছাসত্বে, অথচ জুয়াচোরগণের প্রতারণায় পড়িয়া ক্রমে ক্রমে তিনি তাঁহার সেই আঠার টাকাই সেই স্থানে অর্পণ করিলেন; কিন্তু তাহার পরিবর্ত্তে তিনি আঠার পয়সা মূল্যের দ্রব্য পাইলেন কি না, সন্দেহ। যে দোকানে এইরূপ কাণ্ড সকল অহরহ চলিতেছে, জুয়াচোরগণ সেই দোকানের নাম দিয়াছে—মনোরম্য সখের বাজার। (Fancy Bazar.)
এইরূপে মফঃস্বলের কত লোক কলিকাতায় আসিয়া যে জুয়াচোরগণের হস্তে পতিত হইতেছে, তাহার সংখা করা নিতান্ত সহজ নহে।