রকম রকম/ডাকের চুরি
(১) ডাকের চুরি।
ডাকঘরে আজকাল অনেক প্রকারের চুরি ও জুয়াচুরি আরম্ভ হইয়াছে, তাহার মধ্যে এই প্রবন্ধে আমি দুইটী বিষয় আজ পাঠকগণকে উপহার প্রদান করিতেছি। এই দুইটী বিষয় আইন অনুসারে চুরি হইলেও, ইহাকে জুয়াচুরির শ্রেণী-ভুক্ত করাই কর্ত্তব্য। উভয়কেই এক কথায় ডাকের চিঠি চুরি বলা যাইতে পারে; কিন্তু আমি উহার নাম এইরূপ প্রভেদ করিলাম যথা;—১(ক) চিঠিতে জুয়াচুরি। (খ) হুণ্ডিতে জুয়াচুরি।
(ক) চিঠিতে জুয়াচুরি।
গোবিন্দচন্দ্র একজন পুরাতন জুয়াচোর। অনেক সময় অনেক্ জুয়াচুরি ব্যবসা অবলম্বন করিয়া সে মফঃস্বলের অনেক লোককে একাল পর্য্যন্ত ঠকাইয়া আসিয়াছিল; কিন্তু নিজে কিছুমাত্র সংস্থান করিয়া উঠিতে পারে নাই। সে অসৎ উপায় অবলম্বন করিয়া যাহা কিছু উপার্জ্জন করে, তাহার ব্যয়ও প্রায় সেইরূপেই হইয়া থাকে। তবে তাহার লাভের মধ্যে কেবল এইমাত্র দেখিতে পাই যে, কোন কোন সময় দুই বেলা অন্নের সংস্থান হয়; কিন্তু কোন কোন সময় আবার তাহাও হয় না। কখন কখন গাড়ি ঘোড়ায় চড়িয়া, কখন বা টম্টম্ হাঁকাইয়া, কলিকাতার রাস্তায় সে ছুটাুছুটী করিয়া থাকে, কখন বা মলিন বস্ত্রে শরীর আবৃত করিয়া চটিজুতা পরিয়া রাস্তায় গমন করিবার কালীন, পূর্ব্ব-নিয়োজিত সহিস-কোচবানগণের বেতন বাকী থাকা প্রযুক্ত, তাহাদের নিকট “সুমধুর” বাক্য শ্রবণ করিয়া থাকে, বা কখন কখন তাহাদিগের “আদরের” চড় চাপড় সহ্য করিয়া ধীরে ধীরে আপন পৃষ্ঠে হস্ত বুলাইতে থাকে। কখন বা বেশ্য়া-পল্লীর ভিতর গমন করিয়া সুরাদেবীর প্রকট-শিষ্য হইয়া বার-নারীদিগের “সুমধুর আদরের” প্রেম-সাগরে সন্তরণ করিয়া থাকে, কখন বা তাহাদিগের দেনা পরিশোধ করিতে না পারিয়া হাসিতে হাসিতে তাহাদিগের “আদর-মিশ্রিত” পাদুকার ধূলি সকল আপন মস্তক হইতে ঝাড়িতে ঝাড়িতে স্থানান্তরে প্রস্থান করে। গোবিন্দ চন্দ্র এইরূপে কলিকাতার ভিতর অনেক দিবস পর্য্যন্ত আপনার লীলা খেলা করিয়া আসিতেছে। তাহার এইরূপ লীলা খেলা করিতে যে সকল অর্থ ব্যয়িত হয়, তাহার সমস্তই জুয়াচুরি-লব্ধ। সে অনেকরূপ জুয়াচুরির নূতন উপায় বাহির করিয়া অনেক লোককে ঠকাইয়াছে, এবং ক্রমে সেই সকল জুয়াচুরির বিষয় অনেকে অবগত হইবার লঙ্গে সঙ্গে তাহা পরিত্যাগ করিয়া অপর উপায় অবলম্বন করিয়াছে। আজকাল সে যে জুয়াচুরির উপায় অবলম্বন করিয়া আপনার খরচ-পত্রের সংস্থান করিতেছে, তাহার বিবরণ নিম্নে প্রদত্ত হইল।
গোবিন্দ যে স্থানে বাস করে, সেই স্থানে পোষ্টাফিসের যে পিয়ন চিঠি-পত্র বিলি করিয়া থাকে, তাহার সহিত একটু আলাপ করিবার মানসে সে প্রথমতঃ সুযোগ অনুসন্ধান করে। ক্রমে ক্রমে এক একজন করিয়া দুইজন পিয়নের সহিত উত্তমরূপ আলাপ করিয়া লয়। কোন স্থান হইতে তাহার পত্র আসিলে যে পিয়ন সেই পত্র তাহাকে প্রদান করিতে যাইত, তাহাকে প্রায়ই দুই চারি আনা পারিতোষিক না দিয়া গোবিন্দ ছাড়িত না। তদ্ব্যতীত পূজা-পার্ব্বণে প্রায়ই তাহাদিগকে ডাকিয়া বক্সিস্ বলিয়া কিছু না কিছু প্রদান করিত। এইরূপে কিছু দিবসের মধ্যেই পিয়নদ্বয়কে এরূপ ভাবে আপনার বশীভূত করিয়া লইল যে, গোবিন্দ যাহা বলিত, তাহারা তাহাই শুনিত। পিয়নদ্বয় কোন পত্রাদি তাহার নিকট বিলি করিতে আসিলে, তখন প্রায়ই তাহাদিগের নিকট অপরের যে সকল পত্র থাকিত, তাহার শিরোনামা, ও পোষ্টকার্ড হইলে তাহাতে যাহা লেখা থাকিত, গোবিন্দ তাহা পড়িয়া লইত। কেন যে সে এইরূপ ভাবে চিঠিপত্র পড়িয়া দেখিত, ডাকপিয়নদ্বয় তাহার কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিত না। পাঠ সমাপ্ত হইলে কিছু পারিতোষিকের সহিত সেই সকল পত্র পুনরায় ডাকপিয়নের হস্তে প্রদান করিত। তাহারা সেই সকল পত্র লইয়া, যে যে স্থানে বিলি করা আবশ্য়ক, পরে সেই সেই স্থানে তাহা বিলি করিত। এইরূপে কিছু দিবস অতিবাহিত হইয়া গেলে, একদিবস গোবিন্দ উহাদিগের একজন পিয়নকে জিজ্ঞাসা করিল, “তোমরা যে সকল পত্র বিলি করিয়া থাক, তাহাদের মধ্যে যদি কোন পত্র তোমাদিগের হস্ত হইতে হারাইয়া যায়, তাহা হইলে তোমাদিগকে কি কোনরূপ দণ্ড গ্রহণ করিতে হয়?”
পিয়ন। পোষ্টকার্ড বা যে সকল পত্রে টিকিট দেওয়া আছে, তাহা হারাইয়া গেলে, আমাদিগকে কোনরূপ দণ্ড লইতে হয় না; কারণ, সেই সকল পত্রের কোনরূপ হিসাব থাকে না। উহাদের মধ্যে কোন পত্র যদি আমরা হারাইয়া ফেলি, তাহা হইলে আমরা উহা হারাইয়া ফেলিয়াছি, কি বিলি করিয়াছি, তাহা কিরূপে জানিতে পারা যাইবে? কারণ, সে সকল বিলি হইলে, তাহার জন্য় কেহ সহিও করেন না, বা কেহ পয়সাও দেন না।
গোবিন্দ। আর যে সকল পত্র বেয়ারিং?
পিয়ন। তাহা হারাইয়া গেলেও সবিশেষ কোনরূপ ক্ষতি হয় না। সেই পত্রের মাশুল চারি পয়সা ঘর হইতে দিলেই সকল গোল মিটিয়া যায়।
গোবিন্দ। এরূপ অবস্থায় একজনের পত্র অনায়াসেই তোমরা অপরকে প্রদান করিতে পার?
পিয়ন। পারি। দুই একখানা অপরকে বিলি করিলে, সবিশেষ কোনরূপ ক্ষতি হয় না। ধরা পড়িলে, এই বলিয়া বুঝাইতে পারি যে, ভুল-ক্রমে একজনের পত্র অপরের নিকট বিলি করা হইয়াছে।
গোবিন্দ। অনেক হইলে?
পিয়ন। তাহাতে আমাদিগের সবিশেষ বিপদের সভাবনা!। এই সকল কথা যদি কোন গতিতে আমাদিগের উপরওয়ালা জানিতে পারেন, তাহা হইলে তাঁহারা আমাদিগের নাম কাটিয়া দিতে পারেন, এবং ইচ্ছা করিলে, আমাদিগকে জেলেও পাঠাইতে পারেন।
গোবিন্দ। যাহাতে এরূপ বিপদের সম্ভাবনা, সেইরূপ কার্য্যে কোন-কোন পিয়ন হস্তক্ষেপ করিতে কিরূপে সমর্থ হয়, তাহা আমি বুঝিয়া উঠিতে পারি না।
পিয়ন। কেন মহাশয়! আপনি এ সকল কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন?
গোবিন্দ। তোমরা যে সকল চিঠি বিলি কর, সেই সকল চিঠি আমি মধ্যে মধ্যে যেরূপ দেখিয়া লই, ইতিপুর্ব্বে একজন পিয়নের নিকট হইতে আমি সেইরূপে চিঠি সকল দেখিয়া লইতাম, এবং তাহার মধ্যে আমার আবশ্য়ক মত দুই একখানি পত্র গ্রহণও করিতাম। তাহার পরিবর্ত্তে প্রত্যেক পত্রের নিমিত্ত আমি তাহাকে চারি আনা করিয়া প্রদান করিতাম। এইরূপে সময়ে সময়ে সে আমার নিকট হুইতে প্রত্যহ এক টাকা দুই টাকার কায করিয়া যাইত।
পিয়ন। সেই সকল পত্র লইয়া আপনি কি করিতেন?
গোবিন্দ। আমি প্রথমে উহা পড়িয়া দেখিয়া পরিশেষে ছিঁড়িয়া ফেলিয়া দিতাম।
পিয়ন। সেইরূপ পত্র আপনার নিকট দুই একখানি আছে কি?
গোবিন্দ। আমার নিকট এখন আর উহা কোথা হইতে থাকিবে? উহা আমি সেই সময়েই পড়িয়া ছিঁড়িয়া ফেলিয়া দিয়াছি।
পিযন। আপনার কার্য্য শেষ হইয়া গেলে, যদি আপনি উহা ছিঁড়িয়া ফেলিয়া দেন, তাহা হইলে অনায়াসেই আপনাকে ওরূপ পত্র আমরাও প্রদান করিতে পারি। কারণ, সেই পত্র আপনি লইলে পরে যদি অপর কাহারও হস্তে পতিত না হয়, তাহা হইলে তাহা লইয়া কোন গোলযোগের সম্ভাবনা বা আমাদিগের আর কোনরূপ বিপদের আশঙ্কা থাকে না।
গোবিন্দ। সে ভাবনা আর তোমাদিগকে ভাবিতে হইবে না। আমার কার্য্য শেষ হইবার সঙ্গে সঙ্গে আমি সেই পত্র নষ্ট করিয়া ফেলিব। যে কার্য্যের নিমিত্ত আমি সেই সকল পত্র গ্রহণ করিব, সেই কার্য্য শেষ করিতে অধিক বিলম্বও হইবে না। সেই পত্রগুলি একবার উত্তমরূপে পড়িয়া লইতে বোধ হয়, অর্দ্ধ ঘণ্টার অধিক সময় লাগিবে না। অর্দ্ধঘণ্টার মধোই আমি সেই পত্র নষ্ট করিয়া ফেলিব।
পিয়ন। তাহা হইলে আপনার যে সকল পত্রের প্রয়োজন হইবে, তাহা সেই পিয়নের ন্যায় আমরাও আপনাকে প্রদান করিব। কিন্তু সাবধান! সঙ্গে সঙ্গে পত্রগুলি বিনষ্ট করিয়া ফেলিবেন।
গোবিন্দ। তাহার আর কোনরূপ সন্দেহ আছে? আমার কার্য্য শেষ হইবামাত্রই আমি উহা নষ্ট করিয়া ফেলিব। তুমি এই বিষয় অপর পিয়নকেও বলিয়া দিও। বিলি করিবার নিমিত্ত পত্র পাইলেই প্রথমতঃ পত্রগুলি আমাকে দেখাইয়া লইয়া যাইও। উহার মধ্যে যে কোন পত্র আমি লইবার প্রয়োজন বিবেচনা করিব, তাহা লইয়া, তখন আমি প্রত্যেক পত্রের নিমিত্ত চারি আনা হিসাবে প্রদান করিব।
গোবিন্দের কথায় পিয়ন সন্মত হইল, এবং সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবার পর, সমস্ত কথা অপরাপর পিয়নকেও বলিয়া দিল। সেই দিবস হইতেই বিলি করিবার নিমিত্ত উহারা যে সকল পত্র ডাকঘর হইতে প্রাপ্ত হইত, তাহার একখানিও বিলি না করিয়া, সর্ব্বপ্রথমে সেই পত্রগুলি লইয়া গোবিন্দের নিকট গিয়া উপস্থিত হইত। উহার মধ্য হইতে যদি কোন পত্র গোবিন্দ গ্রহণ করিত, তাহা হইলে তাহাদের প্রত্যেক পত্রের নিমিত্ত চারি আনা হিসাবে গ্রহণ করিয়া অবশিষ্ট পত্রগুলি যে যে স্থানে বিলি করা আবশ্য়ক, সেই সেই স্থানে বিলি করিত।
গোবিন্দ যে কেন এইরূপ অসৎ উপায় অবলম্বন করিয়া অপরের পত্র গ্রহণ করিত, তাহার কিছু অর্থ পাঠকগণ বুঝিতে পারিয়াছেন কি? যদি না পারিয়া থাকেন, তাহা হইলে আমি আপনাদিগকে বুঝাইয়া দিতেছি।
কলিকাতা সহর আজকাল ঔষধের বিজ্ঞাপনে পরিপূর্ণ। ইহার মধ্যে সকলই যে নিতান্ত অসার ঔষধ, তাহা নহে; তাহার মধ্যে কতকগুলি ঔষধ ভাল বলিয়া লোকে অবগত আছে, এবং সেই সকল ঔষধ একরূপ বিক্রয়ও হইয়া থাকে। পাঠকগণ ইহাও অবগত আছেন যে, মফঃস্বলের লোকই সেই সকল ঔষধ অধিক পরিমাণে ক্রয় করিয়া থাকেন। আরও অবগত আছেন, যে নামে ও ঠিকানায় সেই সকল ঔষধের বিজ্ঞাপন বাহির হয়, সেই সকল নামে ও ঠিকানায় মফঃস্বলের গ্রাহকগণ সেই সকল ঔষধ ভেলুপেয়েবল পোষ্টে পাঠাইবার নিমিত্ত অনুরোধ করিয়া পত্র লিখিয়া থাকেন।
যে সকল পত্রে উক্তরূপে ওষধ পাঠাইয়া দিবার নিমিত্ত লেখা থাকিত, গোবিন্দচন্দ্র সেই সকল পত্র অন্যান্য পত্রের মধ্য হইতে বাছিয়া বাছিয়া প্রত্যহ দুই চারিখানি গ্রহণ করিত, এবং মফঃস্বলবাসী সেই সকল নিরীহ লোকদিগের নামে সেই ঔষধ বলিয়া অন্য কিছু ভেলুপেয়েবল ডাকে পাঠাইয়া দিয়া তাহার যথেষ্ট মূল্য আদায় করিয়া লইত। বলা বাহুল্য, যিনি প্রকৃত মূল্য দিয়া সেই ঔষধ গ্রহণ করিতেন, তাঁহার রীতিমত অর্থ ব্যয় হইত; কিন্তু ঔষধের উপকার কিছুমাত্র প্রাপ্ত হইতেন না। সুতরাং অর্থ নষ্টই হইত মাত্র। এইরূপে গোবিন্দচন্দ্র মফঃস্বলবাসী অনেক লোকের সর্ব্বনাশ করিয়া অনেক অর্থ উপার্জ্জন করিয়াছে, এবং এখনও সময় সময় কিছু কিছু করিতেছে।
তিন চারি বৎসর অতীত হইল, এই জুয়াচুরি-কাণ্ড আমা কর্ত্তৃক প্রকাশিত হইয়া পড়ে, এবং অপরের পত্র চুরি করা অপরাধে কয়েকজন পিয়নকেও শ্রীঘরে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু সেই জুয়াচুরি কলিকাতা সহর হইতে যে একবারে বন্ধ হইয়া গিয়াছে, তাহা পাঠকগণ মনে করিবেন না। বিশেষতঃ যে সকল মফঃস্বলের লোক ভেলুপেয়েবল পোষ্টে ঔষধাদি গ্রহণ করিয়া থাকেন, তাঁহারা একটু বিশেষ সতর্ক হইবেন, ইহাই এই প্রবন্ধ-লেখকের প্রধান উদ্দেশ্য; এবং তজ্জন্য়ই এই ঘটনা-বর্ণনার অবতারণা।
(খ) হুণ্ডিতে জুয়াচুরি।
যেরূপ ভাবে চিঠি লইয়া পূর্ব্ব-বর্ণিত জুয়াচুরি হইয়া থাকে, হুণ্ডির জুয়াচুরি তাহা অপেক্ষা অধিক ভয়ানক। কিরূপ ভাবে হুণ্ডির জুয়াচুরি হয়, তাহা পাঠকগণকে বলিবার পূর্ব্বে হুণ্ডি যে কি, তাহা বোধ হয়, অনেক পাঠককে বুঝাইয়া দেওয়ার প্রয়োজন হইবে। হুণ্ডি একরূপ বরাতচিঠি মাত্র। মনে করুন, আপনার এলাহাবাদে একটী ব্যবসার স্থান আছে, এবং কলিকাতাতেও একটী স্থান আছে। অপর এক ব্যক্তির এলাহাবাদ হইতে দুই হাজার টাকা কলিকাতায় পাঠাইতে হইবে। মনি-অর্ডার বা অপর কোন উপায়ে সেই টাকা কলিকাতায় পাঠাইতে হইলে, কিছু অধিক পরিমাণে অর্থ ব্যয় করিবার প্রয়োজন হইয়া পড়ে; কিন্তু হুণ্ডির দ্বারা পাঠাইতে হইলে ব্যয় অপেক্ষাকৃত অনেক অল্প হয়। এই নিমিত্ত যে দুই হাজার টাকা তাঁহার কলিকাতায় পাঠাইয়া দিবার প্রয়োজন, সেই টাকা লইয়া গিয়া তিনি আপনার এলাহাবাদস্থিত গদিতে জমা করিয়া দিলেন, এবং নিয়মিত কমিশনও প্রদান করিলেন। সেই টাকা গ্রহণ করিয়া, আপনি আপনার কলিকাতার গদির নামে একখানি হুণ্ডি লিখিয়া তাঁহার হস্তে প্রদান করিলেন। আপনি যেমন তাঁহাকে এলাহাবাদে হুণ্ডি প্রদান করিলেন, অমনি আপনি এই সংবাদ আপনার কলিকাতার গদিতে লিখিয়া পাঠাইলেন। এদিকে যাঁহার নিকট টাকা পাঠাইবার প্রয়োজন, তাঁহার নামীয় একখানি পত্রের ভিতর সেই হুণ্ডিখানি তিনি পুরিয়া তাঁহার নামে কলিকাতায় পাঠাইয়া দিলেন। যাঁহার নামে সেই হুণ্ডিখানি আসিল, তিনি সেই হুণ্ডিসহ আপনার কলিকাতার গদিতে গমন করিবামাত্র হুণ্ডির লেখা অনুযায়ী টাকাগুলি তিনি প্রাপ্ত হইলেন। হুণ্ডি সম্বন্ধে আরও অনেক কথা বলিবার আছে; কিন্তু এস্থানে মোটামুটি যাহা বলা হইল, তাহাতেই পাঠকগণ আলোচ্য ঘটনার অবস্থা উত্তমরূপে বুঝিতে পারিবেন।
যাহা হউক, কিরূপ ভাবে সেই হুণ্ডি সম্বন্ধে নিত্য জুয়াচুরি হইতেছে, তাহাই এখন পাঠকবর্গকে বলিব।
গোবিন্দচন্দ্র যেরূপ ভাবে জুয়াচুরি করিয়া ডাকপিয়নের যোগে জুয়াচুরি ব্যবসা চালাইয়া আসিতেছিল, বড়বাজারের ভিতর সেই প্রকার কয়েকজন লোক আছে, তাহারা প্রায় হুণ্ডির জুয়াচুরি ব্যবসা করিয়া, আপন আপন সংসার প্রতিপালন ও বাবুগিরি করিয়া থাকে, মধ্যে মধ্যে জেলে গিয়াও বাস করিয়া থাকে।
বড়বাজার অঞ্চলে যে সকল পিয়ন পত্র বিলি করিয়া থাকে, সেই সকল পিয়নের সহিত উহাদিগের প্রণয় অধিক। কারণ, এমন দিনই নাই, যে দিবস সেই অঞ্চলে শত শত হুণ্ডি সম্বলিত পত্র বিলি না হয়। গোবিন্দচন্দ্র যেমন সামান্য় চারি আনা দিয়া অপরের পত্র গ্রহণ করে, ইহারা পিয়নদিগকে সেইরূপ ভাবে সামান্য় অর্থ প্রদান করে না। গোবিন্দের লভ্য অংশের সহিত তুলনায় ইহাদিগের লভ্য অংশ অনেক অধিক। সুতরাং ইহাদিগের সহিত যে সকল পিয়ন মিলিত আছে, তাহাদিগের উপার্জ্জনও অনেক অধিক।
যে পিয়নের সহিত উহাদিগের পরামর্শ আছে, সে বিলি করিবার নিমিত্ত ডাকঘর হইতে পত্র পাইবার পরই, একটী নির্দ্দিষ্ট স্থানে গমন করে। সেই স্থানে তাহাদিগের দলস্থিত কোন না কোন ব্যক্তির সহিত সাক্ষাৎ হইলে, তাহার হস্তে সেই পিয়ন তাহার নিজের নির্ব্বাচন অনুসারে দুই একখানি পত্র দিয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করে।
যাহার হস্ত দিয়া প্রত্যহ শত শত হুণ্ডি সম্বলিত পত্র বিলি হয়, তাহার হস্তে হুণ্ডি-পূরিত খাম আসিয়া উপস্থিত হইলেই, সে অনায়াসেই অনেকটা উপলব্ধি করিয়া লইতে পারে যে, ইহার ভিতর হুণ্ডি আছে, কি না। সুতরাং সেইরূপ ভাবের দুই তিনখানি পত্র বাছিয়া লইয়া পূর্ব্বোক্ত দলস্থিত কোন ব্যক্তির হস্তে প্রদান করিয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করে। পিয়ন সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলে পর, সেই ব্যক্তি সেই পত্রগুলি সবিশেষ সতর্কতার সহিত খুলিয়া দেখে যে, উহার ভিতর প্রকৃতই হুণ্ডি আছে কি না, এবং যদি হুণ্ডি থাকে, তাহা হইলে যে গদি হইতে উহার টাকা আনিতে হইবে, সেই স্থান হইতৈ সেই টাকা সহজেই প্রাপ্ত হইবার সম্ভাবনা কি না। এ সকল বিষয় বিবেচনা করা, আমাদিগের পক্ষে যেরূপ দুরূহ বলিয়া অনুমান হইতেছে, উহাদিগের পক্ষে কিন্ত সেরূপ নহে। কারণ, বড় বাজারের ভিতর যত মহাজনের হুণ্ডির কারবার আছে, তাহাদের সমস্তই তাহারা অবগত আছে, এবং কাহার গদিতে তাহাদিগের পরিচিত লোক আছে, ও কাহার গদি হইতে সহজেই সেই টাকা বাহির হইবার সম্ভাবনা, তাহাও তাহারা অনায়াসেই বুঝিতে পারে। পিয়ন প্রদত্ত পত্র খুলিয়া যদি তাহার ভিতর তাহাদিগের মনের মত হুণ্ডি প্রাপ্ত হয়, তাহা হইলে তাহা উহারা গ্রহণ করিয়া সেই পত্র নষ্ট করিয়া ফেলে। অন্যথা সেই সকল পত্র পূর্ব্বের ন্যায় বন্ধ করিয়া পরিশেষে সেই পিয়নের হস্তেই প্রত্যর্পণ করে। তৎপরে পিয়নও সেই পত্রগুলি যথাস্থানে বিলি করিয়া দেয়।
পুর্ব্ব-কথিত উপায়ে একখানি হুণ্ডি বাছিয়া লইতে পারলেই, তাহাদিগের একমাস বা সময় সময় দুই তিনমাসের কার্য্য হইয়া যায়। সুতরাং সেই সময়ের মধ্যে তাহাদিগকে সেইরূপ কার্য্যে আর হস্তক্ষেপ করিতে হয় না।
পূর্ব্ব-কথিত উপায়ে একখানি হুণ্ডি তাহাদিগের হস্তগত হইলে সেই হুণ্ডি যে কত টাকার, কেবল যে তাহাই তাহারা অবগত হইতে পারে, তাহা নহে। কারণ, সেই হুণ্ডির সহিত যে পত্র থাকে, তাহা পড়িয়া উহা কে পাঠাইতেছে, কোথা হইতে আসিতেছে, কোন্ স্থানে ও কয়দিবস পরে ইহার টাকা পাওয়া যাইবে, তাহার সমস্ত অবস্থা অবগত হইয়া সেই দলস্থিত একটী লোক সেই হুণ্ডিসহ সেই গদিতে গিয়া উপস্থিত হয়। পরে সেই হুণ্ডি সেই স্থানে প্রদান করিলে, তথাকার নিয়ম অনুযায়ী যে টাকা পাইবার কথা, তাহা অনায়াসেই পাইয়া থাকে। এইরূপ উপায়ে একখানি হুণ্ডির টাকা প্রাপ্ত হইতে পারিলে, তাহাদিগের মনোবাঞ্ছা উত্তমরূপে পূর্ণ হইয়া থাকে। কারণ এক একখানি হুণ্ডিতে সময় সময় দশ হাজার পর্য্যন্ত টাকাও পাওয়া যায়। এইরূপে অসৎ উপায়ে জুয়াচোরগণ যে টাকা বাহির করিয়া লয়, তাহা তাহাদিগের মধ্যে নিয়ম অনুসারে সকলে মিলিয়া বণ্টন করিয়া লয়। ডাকঘরের পিয়নের অংশ, প্রায় অপর সকলের অংশ হইতে অধিক পরিমাণে হইয়া থাকে। এইরূপে একখানি হুণ্ডির টাকা তাহারা হস্তগত করিলে পর, কিছু দিবস পর্য্যন্ত আর এরূপ কার্য্যে হস্তক্ষেপ করে না। যে ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে হুণ্ডি পাঠাইয়াছেন, যখন তিনি জানিতে পারেন, তাঁহার হুণ্ডির টাকা বাহির হইয়া গিয়াছে, অথচ যাহার পাইবার কথা, তিনি পান নাই, তখন ইহার অনুসন্ধান আরম্ভ হয়, এবং ক্রমে এই জুয়াচুরির বিষয় প্রকাশিত হইয়া পড়ে; কিন্ত প্রায়ই প্রকৃত দোষী ধরা পড়ে না। এইরূপে হুণ্ডির জুয়াচোর কয়েকজন, কয়েকজন পিয়নের সহিত কয়েকবার আমা কর্ত্তৃক ধৃত হয়, এবং দীর্ঘকালের নিমিত্ত কারাবাসে প্রেরিত হইয়াছে কিন্তু অদ্যাপিও এই জুরাচুরি বন্ধ হয় নাই।