রথযাত্রা ও অন্যান্য গল্প/প্যারীর মাসী
প্যারীর মাসী
--১--
হঠাৎ আমার মন কি রকম খারাপ হয়ে গিয়ে আমি সংসারের বাইরে এসে দাঁড়ালাম। বিরক্তি, কি বৈরাগ্য, কি বিবেক, অত-শত বিচার করা আমার হয়ে ওঠে নি। আমার চোখে ঠুলি দিয়ে ঘানিগাছে জুড়ে দেবার সব ঠিকঠাক হয়েচে, অর্থাৎ আমার বিয়ে দিয়ে আমার বুকে জগদ্দল পাথর চাপাবার আয়োজন হচ্চে, এমন সময় আমি দড়ী ছিঁড়ে, তিড়িং-মিড়িং করে’ লাফিয়ে মাঠে ছুটে বেরিয়ে গেলাম। রাতারাতি উঠে কাউকে কিছু না বলে’ সরে’ পড়লাম।
পেড়ে কাপড় ছেড়ে গেরুয়া ধারণ করলাম। সঙ্গে দু’চারখানা পুঁথি ছিল—গীতা, মোহমুদ্গর, খানকতক উপনিষদ, এই রকম। একখানা কম্বল আর একটা কমণ্ডলু সঞ্চয় করা গেল। তার পর অবারিত খোলা পথ, যেদিকে দু’চক্ষু যায়, সেই দিকে চললাম। কয়েক দিন বৈদ্যনাথে, তার পর গোটা কতক দিন গয়ায় আর বৌদ্ধ গয়ায় কেটে গেল। কোন ঝঞ্ঝাট, কোন বালাই নেই, যেদিন যেমন জোটে, সেদিন সেইরূপ যায়। সাধু-সন্ন্যাসীর সঙ্গ, তার মধ্যেও কখন সৎসঙ্গ, কখন অসৎসঙ্গ, কেউ পারমার্থিক কথা কয়, কেউ সাধু সেজেও ঘোর বিষয়ী। বেগতিক দেখলে আমি পাশ কাটিয়ে আর কোথাও চ’লে যেতাম।
কাশী যাব বলে’ এক দিন বক্সরে রেলগাড়ীতে উঠচি, দেখি, একখানা গাড়ীতে এক জন সাধু বসে’ রয়েচেন। দিব্য প্রমাণ দেহ, উজ্জ্বল কান্তি, মাথায় বড় বড় চুল, জটা নয়, দাড়ী-গোঁফ প্রায় পাকা, বড় বড় চোখের কোণে লাল ছড়া, কপালে বিভূতি-তিলক, গলায় রুদ্রাক্ষমালা। আমি যুক্তহস্ত মাথায় ঠেকিয়ে বললাম, নমো নারায়ণ!
সন্ন্যাসী বললেন, এস, এস, এই গাড়ীতে এস। কোথায় যাবে?
আমি বললাম, কাশী যাব।
গাড়াতে উঠে এক ধারে বসতে যাচ্ছি, এমন সময় তিনি নিজের পাশে যায়গা করে’ দিয়ে বললেন, এইখানে ব’স।
আমি বসলে পর বললেন, তোমার বয়স ত বড় অল্প মনে হচ্ছে। এরি মধ্যে এ ভেক?
—গৃহস্থ আশ্রমে তৃপ্তি নাই।
—ভাল ভাল। সাধুকে পরিচয় জিজ্ঞাসা করতে নেই। কাশী এর আগে দেখা হয়েচে?
— আজ্ঞে না, আমার কিছুই দেখা হয় নি, আমি কিছু জানি নে।
—তা হ’লে আমাদের সঙ্গে চল না? আমরাও কাশী যাচ্ছি।
—যদি আপনাদের কোন অসুবিধে না হয়—
—আরে, ও-সব লোক-সমাজের কথা ভুলে যাও। আমাদের আবার সুবিধে অসুবিধে কি? সর্ব্বত্র সমান, আরাম কি কষ্ট, কোন জিনিষই নেই, সব স্থানে দরিদ্র নারায়ণ, সবই লীলাময়ের লীলা। কুণ্ঠা সঙ্কোচ লোকালয়ে, সে-সব আমরা লোকালয়ে রেখে এসেছি।
—কেমন অভ্যাসের দোষ—
—আর বলতে হবে না, অমন সকলেরই নতুন নতুন হয়। তোমার হাতে পুঁথি দেখছি। কিছু পড়া-শোনা আছে?
—যৎসামান্য, বলতে গেলে কিছুই নয়। যদি কোন ভাল গুরুর আশ্রয় পাই, তা হ’লে কিছু পাঠাভ্যাস করি।
—নিষ্ঠা থাক্লেই পাবে। পুঁথি-পাঁজি ত কত লোকে পড়ে, তাতে কি হয়? কেউ ঘোর দাম্ভিক, কেউ ঘোর নাস্তিক। সদ্গুরু কে? সদ্গুরু বত্তাওয়ে বাট, যে পথ দেখায়, সেই সদ্গুরু। যে পথ চায়, সে পথ পায়; যে সব ছাড়ে, সে সব পায়। সব ছোড়ো তো সব মিলেগা।
সন্ন্যাসীর কথার বেশ চটক। আর কিছু কথার পর বল্লেন, তোমাকে কি ব’লে ডাক্ব? বাপ-মায়ের-রাখা নাম জিজ্ঞাসা করছিনে, এ আশ্রমে এসে একটা কিছু নাম হয়েছে ত? আমার নাম বালানন্দ।
—আমি সুনন্দ ব্রহ্মচারী।
—বেশ নাম। শ্রীকৃষ্ণের পার্শ্বচর। এই আমাদের যাত্রা ফুরাল।
মোগলসরাইতে গাড়ী বদলাতে হয় নি, বরাবর রাজঘাট কাশী ষ্টেশনে এসে গাড়ী থাম্ল। আমরা গাড়ী থেকে নাম্লাম।
মেয়েদের গাড়ী থেকে একটি স্ত্রীলোক নেমে বালানন্দ স্বামীর কাছে এল। কি আপদ! সন্ন্যাসীর সঙ্গে আবার মেয়েমানুষ কেন? আমার মনে কেমন খট্কা লাগল। কথাবার্ত্তায় ত জ্ঞানীর মত, লোকটা বামমার্গী নয় ত? আমি কি করব ভাব্ছি, এমন সময় স্ত্রীলোকটি মুখের দিকে চেয়ে দেখ্লাম। দেখামাত্র মনের সংশয় ঘুচে গেল।
গেরুয়া-পরা, শুভ্রকেশী, তেজস্বিনী রমণী। মুখে বার্দ্ধক্যের কোনো চিহ্ন নেই। টানা টানা নাক-চোখ, রং ফরসা, মুখ সুন্দর না হ’লেও তেজে ভরা, চোখের চাউনি তীক্ষ্ণ, তীব্র। বালানন্দ স্বামীর কাছে এসে বল্লে,বাবা-ঠাকুর, হেঁটে যাবে?
—কি দরকার? সারারাত্রি রেলে ভাল ঘুম হয়নি, তোমারও কষ্ট হ’য়ে থাক্বে, চল গাড়ী ক’রে যাই।
আমার দিকে ফিরে বালানন্দ স্বামী বল্লেন, ইনি আমার শিষ্যা, তীর্থ-পর্য্যটনে বেরিয়েচেন।
রমণীকে বল্লেন, উনি নতুন ব্রহ্মচারী হয়েচেন, কখন কোথাও যান নি। ওঁকে আমাদের বাসায় নিয়ে যাচ্চি।
—বেশ ত, চলুন না।
রমণীর স্বর মধুর, কিন্তু কথা স্পষ্ট, কোনোরূপ সঙ্কোচ অথবা জড়তা কিছুমাত্র নেই।
একখানা ঠিকা-গাড়ীতে বালানন্দ স্বামী আর আমি এক দিকে বস্লাম, রমণী অন্য দিকে বস্ল।
দশাশ্বমেধ থেকে একটু দূরে একটা গলিতে একখানি ছোট পরিষ্কার বাড়ীতে আমরা উঠ্লাম। বাড়ীতে লোক ছিল, তারা খুব সম্মান ক’রে আমাদের দোতলায় নিয়ে গেল। মুখ-হাত ধুয়ে বালানন্দ স্বামী বল্লেন, প্যারীর মাসী! আমরা গিয়ে এই দশাশ্বমেধ ঘাটে বসি। তোমার কিছু দরকার আছে?
—আমি যাব উজ্জুগ ক’রে নেব, তোমরা বেরিয়ে যাও না। বেলাও ত আর বড় নেই, আমিও কাজ সেরে যাচ্ছি। আরতি দর্শন করতে হবে ত?
—আরতি দেখ্তে আমরাও যাব। তুমিও কি আগে ঘাটে যাবে?
—তাই যাব।
আমরা বাড়ীর বাইরে এলাম।
—২—
প্যারীর মাসী! কোন্ দেশী নাম! যে সংসার থেকে বেরিয়েচে, তার আবার মাসী-পিসী সম্বন্ধ কি? আর যদি সন্ন্যাসিনী হয়েও নাম না বদ্লায়, তা হ’লেও নিজের ত একটা নাম আছে, সেই নামে ডাকে না কেন? অমুকের স্ত্রী, অমুকের মাসী পাড়াগাঁয়ে ব’লে থাকে বটে, কিন্তু সন্ন্যাস আশ্রমেও কি সেই পরিচয় থাক্বে?
আমি ভুরু কুঁচকে ভাব্চি, বালানন্দ স্বামী আমার মুখ চেয়ে হাস্লেন। বল্লেন, তোমার মন গোলোকধাঁধায় ঘুরচে! তুমি প্যারীর মাসীর কথা ভাব্চ, না?
আমি চমকে উঠ্লাম। জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কেমন ক’রে জান্লেন? সন্ন্যাসী হেসে কৌতুক ক’রে বল্লেন, মানুষের মনে ডুব দিয়ে যদি মনের কথা তুল্তে না পারব, তা হ’লে আমার সাধুগিরি কিসের? আর এ ত সোজা কথা প’ড়ে রয়েছে। তোমার মনে হ’তেই পারে যে, সাধু-সন্ন্যাসীর সঙ্গে মেয়েমানুষ কেন? আমি বৈষ্ণব নই যে, বৈষ্ণবী সঙ্গে ক’রে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াব, বামাচারী তান্ত্রিকও নই যে, আমার সঙ্গে অবিদ্যা থাকবে। কথাটা যখন তোমার মনে উঠেচে, তখন প্যারীর মাসীর বিষয়ে তোমার কিছু জেনে রাখা ভাল। ওর বিষয়ে সব কথা আমি নিজে জানিনে, যেটুকু জানি, বল্তে আমার কোনো আপত্তি নেই। প্যারীর মাসী ছাড়া ওর অন্য কোনো নাম আমি কখন শুনিনি। প্যারী কে, তা কিছুই জানিনে, প্যারী বেঁচে আছে কি নেই, তাও বল্তে পারিনে। প্যারীর মাসীকে জিজ্ঞাসা করলে সে কিছু বলে না, পূর্ব্বের কোনো কথা জিজ্ঞাসা করতে নিষেধ করে। ও ডাকনামটা বদ্লে আমি এ আশ্রমের একটা নাম রাখ্তে চাইলাম, তাতে ও রাজি নয়। যখন সংসার ত্যাগ করিনি, আমাদের গ্রামের নিকটে আর একটা গ্রামে প্যারীর মাসী থাকত। একাই ছিল, আপনার লোক কেউ ছিল না। স্বভাব-চরিত্র খুব ভাল, ওর নামে কেউ কখনো একটা কথাও বল্তে পারে নি। শুন্তাম—কেমন যেন ছেমো-ছেমো, সময় সময় এলোমেলো কথা কয়, কিন্তু পাগল কেউ বল্ত না। কয়েক বছর আগে কালীঘাটে একবার দেখা হয়, সেখানে আমার কাছে মন্ত্র নেয়। সেই পর্য্যন্ত আমার সঙ্গে ঘোরে। সব কাজে তৎপর, বেশ পড়াশোনা আছে। তবে ঐ যা বল্লাম, ঠিক সহজ মানুষ নয়, পাগলও নয়। আমি ঠিক বুঝ্তে পারি নে, কিন্তু আমার মনে হয়, ওর কোনো দৈবশক্তি আছে।
এ-সব কথা আমি ত কিছুই বুঝতে পারলাম না। এর ভিতর একটা কিছু রহস্য আছে, কিন্তু সে ভাবনায় আমার কি কাজ? আজ এদের সঙ্গে রয়েচি, কাল কোথায় থাক্ব, তার ঠিক নেই। আমি আর কোনো কথা কইলুম না।
আমি ত এর আগে বারাণসী কখন দেখি নি, তবু গঙ্গার ধারে দশাশ্বমেধ ঘাটে ব’সে আমার মনে হ’ল যে, এই তীর্থক্ষেত্র চিরকাল যেমন ছিল, ঠিক তেমনি রয়েচে। গঙ্গার একটানা স্রোতে সব ভেসে যায়, কেবল এই শিবপুরী অটলভাবে বিদ্যমান রয়েচে। পুরাকালে যেমন, এখনও সেইরূপ! কত রাজা, কত রাজ্য গেল, এই কাশীতেই কত অত্যাচার হয়েছিল, কিন্তু কার সাধ্য এই তীর্থের মাহাত্ম্য লোপ করে? ভাগীরথী-বিধৌত অসিবরুণাবেষ্টিত এই পুণ্যক্ষেত্র কালবিজয়ী। বারাণসী নামই বরুণা ও অসি এই দুই নদী থেকে। তিন দিক থেকে এই ত্রিধারা কালের পথ আগ্লে রয়েচে।
সন্ধ্যা হয়েছে। আকাশের কোমল নীল ছায়া গঙ্গার ঢেউয়ে ভাঙ্গচে, নৌকা ভেসে যাচ্চে কিংবা দাঁড় টেনে উজানে বাইচে। বড় বড় বাঁশের ছাতার তলায় ব’সে ভস্মদিগ্ধাঙ্গ সন্ন্যাসী, সাম্নে ধুনি জ্বল্চে। ঘাটে স্ত্রীলোকেরা কাপড় কাচ্ছে, কাশীবাসীরা বেড়িয়ে বেড়াচ্ছে। আমাদের পাশে আর দু’জন সাধু এসে বস্ল। হিন্দুস্থানী। এক জন বল্লে, বম্ মহাদেও!
সাম্নে একটা ছোঁড়া অমনি চেঁচিয়ে উঠ্ল, টন্গণেশ! তার পর ধমক খেয়ে স’রে গেল।
সাধুর মধ্যে এক জন লম্বা সরু গাঁজার কল্কে বের করলে। তাতে ভিজে ন্যাক্ড়া গোঁজা ছিল, গাঁজার ধোঁয়ায় রং ঠিক তামার মত। গাঁজা বের ক’রে হাতের তেলোয় একটু জল দিয়ে বুড়ো আঙ্গুলের টিপ দিয়ে খুব খানিক ড’লে কল্কেতে পূরে, এক জন সাধুর ধুনি থেকে একটু আগুন চেয়ে নিয়ে এল। গাঁজা সেজে কল্কে আর ন্যাক্ড়া বালানন্দ স্বামীর হাতে দিয়ে বল্লে, লেও মহারাজ!
বালানন্দ একটান টেনে আমার দিকে করে আগিয়ে দিয়ে বল্লেন, এক টান হবে? ভোলানাথের প্রসাদ?
আমি বল্লাম, ওটা আমাকে মাপ করতে হবে। ও পথে আমি নেই।
—আমিও সচরাচর খাইনে, প্যারীর মাসী পসন্দ করে না। তবে এদের পাল্লায় পড়লে এক-আধ টান টান্তে হয়।
সন্ন্যাসী সাধুকে কল্কে ফিরিয়ে দিলেন। সে কল্কের নীচে ন্যাক্ড়া টিপে দু’চারবার টেনে লাগালে দম্। ছিলিমের মাথা দপ্ ক’রে জ্ব’লে উঠ্ল, সাধু সঙ্গীর হাতে ছিলিম দিল, নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া বেরুতে লাগল। দুই চক্ষু টকটকে লাল হয়ে উঠ্ল, মুখ দিয়ে টপ্-টপ্ ক’রে লাল পড়তে লাগ্ল, বল্তে লাগ্ল, কাশী কৈলাসপতি! বম্ ভোলা! হর, হর, হর, মহাদেও!
গাঁজা টেনে সাধুরা উঠে গেল। আমরা ঘাটে ব’সে ঘাটের ও জলের সান্ধ্য দৃশ্য দেখ্তে লাগ্লাম। আমি ভাব্ছিলাম যে, কাশী মহাদেবের ত্রিশূলের উপর স্থির হ’য়ে আছে কেমন ক’রে? ত্রিশূল যাঁর হাতে থাকে, তিনি ত ভাঙ্গ ধুতুরায় সব সময় চুর হ’য়ে থাকেন, আর তাঁর নন্দীভৃঙ্গীর দল সব নেশাখোর, ত্রিশূল ধ’রে থাকে কে? বাসুকি যেন মাঝে মাঝে মাথা নাড়া দেয়, তাতে অপর জায়গায় ভূমিকম্প হয়, কিন্তু কাশীতে ভূমিকম্প কৈ ত শুনতে পাওয়া যায় না! তা না হ’লে কাশীর এত মাহাত্ম্য হবে কেন?
ঘোর-ঘোর হ’য়ে আস্তে প্যারীর মাসী এসে উপস্থিত হ’ল। তার হাঁট্বার ধরণেও যেন কেমন একটা তেজ আছে, দ্রুত লঘু পদক্ষেপে আমাদের পাশে এসে দাঁড়াল। বল্লে, বাবাঠাকুর, বিশ্বেশ্বরের আরতি দেখ্বে চল।
বালানন্দ স্বামী বল্লেন, আমরা তোমার অপেক্ষায় ছিলাম।
আরতি দেখ্বার জন্য বিশ্বেশ্বরের মন্দিরে ভিড় হয়েছে। তার ভিতর দিয়ে গিয়ে প্যারীর মাসী দরজার এক পাশে দাঁড়াল, আমরা তার পিছনে দাঁড়ালাম।
তখন শিবলিঙ্গকে স্নান করানো হচ্ছে। স্নানের পর মহাদেবের বিভূতি ক’রে আরতি আরম্ভ হ’ল। ধূনার ধূমে মন্দির সুবাসিত হয়েছে, পাঁচ জন পাণ্ডা পাঁচটি ঘণ্টা হাতে ক’রে উঠে দাঁড়াল। পাঁচটি পাঁচ রকম, ছোট বড়।
এর পূর্ব্বে কখন কাশী দেখি নি, বিশ্বেশ্বরের আরতিও দেখি নি। ঘণ্টার আওয়াজ বড় মধুর, ছোট বড় ঘণ্টার ধ্বনি মিশে একটা ঐক্যতান মাধুরীর আবেশ, ঘণ্টাশুদ্ধ হাত উঠ্ছে—নাম্ছে। পরে পাণ্ডারা সাধা গলায় রুদ্রস্তোত্র আরম্ভ করলে। শম্ভু—শম্ভু—শম্ভু! শিব—শিব—শম্ভু! ছন্দিত, গভীর, লয়শুদ্ধ কণ্ঠধ্বনি আর সেই সঙ্গে ঘণ্টার মিলিত নিক্কণ! আমার অঙ্গ রোমাঞ্চিত হ’য়ে উঠ্ল, হৃদয়ে স্তোত্রের বিচিত্র উদার শব্দাবলী ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হ’তে আরম্ভ হ’ল। স্তোত্রের প্রত্যেক শ্লোকের আবৃত্তি শেষে বার বার সেই ধীর গম্ভীর ধ্রুবক—শম্ভু, শম্ভু, শম্ভু, শিব, শিব, শম্ভু!
আরতি শেষ হ’লে আমরা সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলাম। প্যারীর মাসীর চক্ষু ভাবে ঢল্-ঢল্ করছে, জলে ভ’রে এসেছে। আঁচল দিয়ে চক্ষুর জল মুছতে লাগ্ল। মন্দিরের কোণে আর এক জন গালবাদ্য ক’রে, মাথা চালিয়ে কেবলি বল্ছিল, বম্ বম্ ভোলা! বব-বম্ বব-বম্ শিব শঙ্কর ভোলা!
—৩—
বাসায় ফিরে বালানন্দ জপে বস্লেন, আমি হাত-মুখ ধুয়ে আচমন ক’রে সন্ধ্যা করতে গেলাম। ঘণ্টাখানেক পরে প্যারীর মাসী এসে বল্লে, প্রস্তুত। তোমরা এস।
পাশের ঘরে দুখানি কম্বলের আসন পাতা, দুখানি শালপাতে খাবার বাড়া। রুটী আর তরকারি। ব্যঞ্জনের রকম বেশী নয়, কিন্তু পরিপাটী রান্না। খেতে খেতে বালানন্দ স্বামী জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন খাচ্ছ? প্যারীর মাসীর রান্না কেমন?
—অমৃত। এমন সুন্দর রান্না কখন খাই নি।
প্যারার মাসী সাম্নে দাঁড়িয়েছিল। বল্লে, যেমন জানি সেই রকম রাঁধি। আর একটু ধোঁকা দেব?
—দাও।
তার পরদিন সকালবেলা আমরা গঙ্গাস্নান করতে গেলাম। স্নান ক’রে ফিরে এসে আমরা বসেছি, প্যারীর মাসী এসে বালানন্দ স্বামীকে দণ্ডবৎ ক’রে প্রণাম করলে। তারপর আমাকেও করতে আসে দেখে আমি তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালাম, বল্লাম, ও কি কর? স্বামীজী তোমার গুরু আর আমি দুদিনের ব্রহ্মচারী, ওঁর শিষ্য হবারও যোগ্য নই। প্রণাম করতে হয় আমি করব। তুমি আমার মাতৃতুল্য, আমি কি তোমার প্রণম্য?
প্যারীর মাসী বল্লে, সাধুমাত্রেই প্রণম্য; সন্ন্যাসী কি ব্রহ্মচারী, বয়স অল্প কি বেশী, সে খোঁজে আমার কি কাজ? আর তুমি ত ব্রাহ্মণ?
—আমার গলায় কি পৈতা আছে? আর এ আশ্রমে ব্রাহ্মণ অব্রাহ্মণের কোনো ভেদ নাই।
বালানন্দ স্বামী বল্লেন, কথা ঠিক। জাতের ধার আমরা কি কি ধারি? ও ছেলেমানুষ, কুণ্ঠিত হচ্ছে, ওকে নমস্কার করলেই হবে।
আমিই আগে নমস্কার করলাম। প্যারীর মাসী আমাকে নমস্কার ক’রে নিজের কাজে গেল।
যে কয় দিন কাশীতে আমরা ছিলাম, আমি ঘুরে ঘুরে বেড়াতাম। তীর্থস্থানে যথেচ্ছাচারের অভাব নেই, কাশীতেও অনেক দুর্বৃত্ত, দুশ্চরিত্র লোক আছে, কিন্তু বিশ্বাসের বলও অপরিসীম। ধর্ম্মে একাগ্রতা দেখে চমৎকৃত হ’তে হয়। যারা সে-ভাবে তন্ময় হ’য়ে আছে, তাদের আর কোনো দিকে দৃষ্টি নেই, মনের কোনো রকম বিকার নেই। বিশ্বাসের মূল এমন দৃঢ়বদ্ধ হ’য়ে আছে যে, উৎপাটন করা ত দূরের কথা, শিথিল করবারও কারও শক্তি নেই। বিশ্বেশ্বরের প্রাচীন মন্দির ভেঙ্গে সেই স্থানে মসজিদ নির্ম্মিত হয়েছিল, ফলে কিছুই হ’ল না, যে কাশী সেই কাশীই র’য়ে গেল। উচ্চ চূড়া-সম্বলিত নূতন মসজিদ তৈয়ার হ’ল, কিছু দিন পরে সেই চূড়া বেণীমাধবের ধ্বজা হ’য়ে গেল। যত টানাটানি হয়, ততই শিকড় আরও নীচে নেমে যায়। বিশ্বাসের হিমাচলকে কে টলাবে?
মণিকর্ণিকার ঘাটে অনেক সময় ব’সে থাকতাম। শ্মশানের উদাস শূন্যতার কোনো চিহ্নই নেই, আছে শুধু অনির্ব্বচনীয় শান্তি ও নিশ্চিন্ততা। শববাহীরা বা আত্মীয়স্বজনরা কোনো প্রকার শোক প্রকাশ করে না, কাহারও মুখে বিষাদের লেশ নেই। প্রজ্বলিত চিতার পাশে ব’সে লোকে হাসিমুখে গল্প করচে। কাশীতে ত লোক মরবার জন্যই আসে, এখানে আবার মৃত্যুভয় কি? এ যে মৃত্যুঞ্জয়ের নগরী, মৃত্যু হার মেনে এখানে শান্ত বন্দীর মত হ’য়ে রয়েছে। হলাহল পানে যাঁর কণ্ঠ নীল হয়েছিল, আর কোনোরূপ বিকার হয় নি, তাঁর নগরে মৃত্যুর বিভীষিকার কেমন ক’রে স্থান হবে? অমৃতের জয়, মৃত্যুর পরাজয়!
দিন কয়েক পরে আমার মনে হ’ল যে, কোনো ধর্ম্মশালায় যাই, কিম্বা কাশী ছেড়ে আর কোথাও চ’লে যাই। বালানন্দ স্বামী কৃপা ক’রে আমাকে আশ্রয় দিয়েছেন। কিন্তু এ-রকম আশ্রিত হ’য়ে থাক্লে ত এক রকম সংসারীই হ’য়ে পড়তে হয়। তিন চার দিন ইতস্ততঃ ক’রে এক দিন আমি কথাটা পাড়লাম। আর কোথাও চ’লে যেতে চাই শুনে বালানন্দ স্বামী বল্লেন, আবার কি হ’ল? আমাদের এখানে তোমার ভাল লাগ্ছে না?
—আজ্ঞে, তা কেন, বেশ আছি, কিন্তু—
আর আমার কথা এগোলো না। স্বামীজী আমার কথায় বাধা দিয়ে বল্লেন, ঐ কিন্তুটাই যত নষ্টের গোড়া! তোমার আবার কিন্তু কিসের? কিন্তুর মুলুক ত ছেড়ে এসেছ, আবার ফিরে যাবে না কি? সংসারে ফিরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে?
—মহাভারত! ও জঞ্জালে আবার জড়াব!
—তবে আবার কিন্তুর সঙ্গে কুটুম্বিতা কিসের? এখানে থাক ব’লে, এখানে খাও ব’লে? তাতে কি হয়েছে? তুমি নির্লিপ্ত বৈরাগী, ভোজনং যত্র তত্র আর শয়ন হট্টমন্দিরেই হোক আর গাছতলাতেই হোক, সর্ব্বত্র সমান। গৃহস্থ, সাধু সন্ন্যাসী, পথিক যে শ্রদ্ধা ক’রে অন্ন দেবে, তারই অন্ন গ্রহণ করবে। এতে আবার দ্বিধা কি, কিন্তুই বা কিসের? আমাকে ভিক্ষা করতে হয় না, তার কারণ, কয়েকটি শিষ্য আমার অন্ন-সংস্থান ক’রে দেন, তাতে তুমি ছাড়া আরও অতিথির গুজরান হয়। প্যারীর মাসীকে এ কথা বলেচ?
—কৈ, না, বলা কি দরকার?
তাকে না ব’লে কি কোনো কাজ হয়? ও প্যারীর মাসী।
প্যারীর মাসী আটা মাখছিল, আটা মাখা হাতে বেরিয়ে এল। জিজ্ঞাসা করলে, কি বল্চ, বাবাঠাকুর?
—ইনি আর আমাদের কাছে থাক্বেন না, বল্চেন।
—কেন, কি হ’ল?
প্যারীর মাসী আমার দিকে চেয়ে দেখ্লে। সে দৃষ্টিতে জিজ্ঞাসা, বিস্ময়, কৌতুক, সব জড়ানো। মুখ গম্ভীর ক’রে বল্লে, ও-বেলা কি তরকারি নুণে পুড়ে গিয়েছিল, না, ডাল ধ’রে গিয়েছিল?
বালানন্দ হো হো ক’রে হেসে উঠ্লেন, বললেন, ঐ রকম একটা কিছু নিশ্চয় হ’য়ে থাকবে।
আমি অত্যন্ত অপ্রস্তুত হ’য়ে বল্লাম, রান্না ত চমৎকার খাচ্ছি, কিন্তু—
অমনি আমার মুখ চাপা পড়ল, বালানন্দ ব’লে উঠ্লেন, আবার ঐ! ওকে কিন্তু রোগে ধরেছে, বড় কঠিন ব্যারাম! প্যারীর মাসী, তুমি কিছু টোটকা-টুটকি জান?
প্যারীর মাসী ঘাড় নাড়লে, বল্লে, ও রোগ হ’লে এ আশ্রম ছাড়তে হয়। হ্যাঁ বাছা, তোমার আবার কিন্তু কিসের? কিন্তু থাক্লে বাবাঠাকুর আমাকে তাড়িয়ে দিতেন। পরন্তু আমরা বৃন্দাবন যাব, তুমি যাবে না? তবে একটা কথা বলি। যদি তোমার মনে আর এক ভাব হয়, যদি সব ছেড়ে-ছুড়ে নির্জ্জনে সাধনা করতে চাও, তা হ’লে কেউ তোমায় কোনো বাধা দেবে না। গোবর্দ্ধন বেশ নিরিবিলি জায়গা, সেখানে গুহা আছে, তপস্যা করবার বেশ সুবিধা।
আমার আর কথা কইবার মুখ রইল না। সেখানেই আমার ‘কিন্তুর’ কাশীপ্রাপ্তি হ’ল।
—8—
কৃষ্ণসলিলা কালিন্দীতটে সমৃদ্ধশালিনী মথুরা নগরী। চারিদিকে কোঠা বাড়ী, বিস্তর দোকান-পসার, শেঠেদের বড় অট্টালিকা। পথে লোকের ভিড়,—যাত্রী, ব্যবসায়ী সব চলেচে। আমরা একটা ধর্ম্মশালায় উঠ্লাম।
স্নানাহার ক’রে আমরা বৃন্দাবনে গেলাম। মথুরা-বৃন্দাবনে ধূলো বল্তে নেই, সেখানে পবিত্র রজ, সকলে তুলে মাথায় দিচ্চে, কাপড়ে এক মুঠা ক’রে বেঁধে নিচ্চে। হরিদ্বারে হিন্দুস্থানী যাত্রীরা পানী বল্লে পাণ্ডারা তাদের বুঝিয়ে দেয়, জল বল্তে হয়, পানী বল্লে দোষ হয়। বৃন্দাবনে পুলিন প্রকাণ্ড চড়া, যমুনা খানিক দূরে। কোথায় সে বংশীমুখরিত কুঞ্জ, কোথায় সে পুলকিত রোমাঞ্চিত পুষ্পশোভিত নীপরাজি! কদম্বমূলে ত্রিভঙ্গ মুরলীধারী কোথায়! কোথায় ভাই বলরাম, কোথায় শ্রীদাম সুদাম সুবল মিতা, স্থূলবুদ্ধি সর্ব্বভুক বটু মধুমঙ্গল! কোথায় বৃষভানু-নন্দিনী ব্রজেশ্বরী রাধা, সখী ললিতা বিশাখা চম্পকলতা চিত্রা।
চোখের দেখাই কি দেখা? স্মৃতিপটের চিত্র কে মুছে ফেল্তে পারে? পথে ঘাটে যেখানে যার সঙ্গে দেখা হয়, সেই বলে রাধেশ্যাম! মুখে মুখে বিন্দরাবন, বিন্দরাবন! চারিদিকে ব্রজসঙ্গীত—
ব্রজমে ঐসী হোরী মচাই!
শ্যামলিয়া কি লট্কী চাল জিয়া যে বস গই রে!
জুতা পায়ে দেওয়া নিষিদ্ধ, সকলে শুধু পায়ে রেণু উড়িয়ে চলেছে। সকলের মুখে আনন্দের চঞ্চলতা, সকলে ব্যস্তভাবে আনাগোনা করছে। কেবল চৌবেদের কোনো তাড়া নেই। বিশালকায় দীর্ঘমূর্ত্তি সব, হেলে দুলে পথের মাঝখান দিয়ে চলেছে। এদের দেখে চানূর-মুষ্টিককে মনে পড়ে। আবালবৃদ্ধ সকাল থেকে রাত্রি পর্য্যন্ত ভাঙ্গ ঘুঁট্ছে আর ঘটী ঘটী ভাঙ্গ খাচ্চে। এক জায়গায় কোনো ধনী যাত্রী চৌবেদের খাওয়াচ্চে। অন্য সামগ্রীর সঙ্গে এক সের ওজনের এক একটা মিঠাই প্রত্যেকের পাতে পড়ছে আর চৌবেরা হাঁক্ছে, বাঃ মেরা লাল, লড্ডু লুড়কা দেও!
সন্ধ্যার সময় মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে বেড়ান গেল। প্যারীর মাসী নিবিষ্টচিত্ত, মুখে বড় কথা নেই, কেবল কৃষ্ণ, কৃষ্ণ, রাধাকৃষ্ণ! শ্রীমধুসুদন! মন্দিরে যেতে-আসতে চৌবেদের যুবতী কন্যাবধূ বেছে বেছে ধনী যাত্রীদের কাপড় ধরচে আর বলচে, লালজী, কিছু দিয়ে যাও। বালানন্দ দেখে আমার দিকে চেয়ে বল্লেন, এখানে এরা লজ্জা কাকে বলে, জানে না। না দিলে কেড়ে নেয়।
বৃন্দাবন থেকে গোবর্দ্ধন। পথে একটা খালি গরুর গাড়ী যাচ্ছিল, গাড়োয়ান আমাদের দেখে বালানন্দকে বল্লে, বাবা, গোবর্দ্ধন যাতে হো?
স্বামীজী বল্লেন, হাঁ।
গাড়োয়ান আমাদের গাড়ীতে উঠ্তে বল্লে, আমরা উঠে বস্লাম। গাড়ী ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে চল্ল।
গোবর্দ্ধন পৌঁছুতে রাত্রি হ’ল। গাড়ী একটা ধর্ম্মশালার সাম্নে দাঁড়াল। গাড়োয়ান বল্লে, মথুরার শেঠের নতুন ধর্ম্মশালা। এখানে সাধুদের থাক্বার জায়গা আছে।
ধর্ম্মশালার একটা ঘরে আমরা রাত্রিবাস করলাম।
গোবর্দ্ধনে লোকসংখ্যা অল্প। কোথাও ভাঙ্গা বাড়ী, কোথাও প্রাচীন ভগ্ন মন্দির। গিরি গোবর্দ্ধন আঁকা-বাঁকা যৎসামান্য উঁচু পাহাড়। সাধুরা কেউ মাধুকরী ভিক্ষা করচে, কোথাও এক টুক্রা রুটী, কোথাও অর্দ্ধমুষ্টি অন্ন। কেউ কেউ মৌনী, জীর্ণ ভাঙ্গা ঘরে ব’সে আছে। ভিক্ষা করতে যায় না, লোকেরা তাদের আহার দিয়ে যায়। তাদের দেখে বালানন্দ স্বামী মলুকা দাসের কবিৎ আবৃত্তি করলেন—
পন্থী করে ন চাকরী, অজগর করে ন কাম।
দাস মলুকা কহ গয়ে সবকো দাতা রাম॥
প্যারীর মাসী আমার দিকে চেয়ে ঘাড় নেড়ে বল্লে, এ বেশ তপস্যার স্থান। এখানে মৌনী হ’য়ে বস্তে তোমার মন নিচ্চে?
—কৈ, এখনো সে-রকম কিছু বুঝ্তে পারিনে। এখনো চঞ্চলতাই বেশী, পরিব্রাজকতা এই সবে আরম্ভ হয়েছে। সেতুবন্ধ রামেশ্বর থেকে অমরনাথ পর্য্যন্ত ঘুরে দেখি, তারপর কি হয় দেখা যাবে।
—বৃন্দাবনেও সব বনের পরিক্রমা করতে হয়। তারপর যার ভাগ্যে থাকে, তার মন যুগলরূপের শ্রীপাদপদ্মে নিবিষ্ট হয়। ভোমরার আগে ভন্ভনানি, তারপর নীরবে মধুপান।
প্যারীর মাসীর এ-রকম কথা শুনে বালানন্দ স্বামী কেন যে তাকে অনুগ্রহ করেন, তা বুঝ্তে পারলাম।
গোবর্দ্ধনের নির্জ্জন স্তব্ধতা মনে শান্তি ও বৈরাগ্য আনে। অনেক তীর্থস্থানেই যাত্রীর ভীড়, নিয়ত জনস্রোত, কেবল আসা-যাওয়া সে কোলাহলের মধ্যে যারা চিত্তজয়ী, তারাই নিশ্চিন্তভাবে স্থির হ’য়ে থাক্তে পারে, আর সকলে কেবল গোলে হরিবোল।
দিন পাঁচ ছয় আমরা গোবর্দ্ধনে কাটালাম। স্বামীজীর কাছে কখন কখন দু’এক জন সাধু আস্ত, তিনি তাদের সঙ্গে ধর্ম্মালাপ করতেন, আমি ব’সে ব’সে শুন্তাম। বালানন্দ স্বামীর অনেক পড়াশোনা, তার উপর চিন্তা-সাধনাও অনেক, তাঁর কথায় অনেক শিক্ষালাভ করা যায়। বেদান্তবাদীর অটল বিশ্বাসের সঙ্গে তাঁর হৃদয়ে মধুর কোমলতা ছিল, প্যারীর মাসী আর আমি সর্ব্বদাই তা অনুভব করতাম।
একা থাক্লে আমার মনে হ’ত, যে শান্তির জন্য সংসারের বন্ধন ছিঁড়ে এলাম, সে শান্তি কৈ? পিপাসিত ব্যক্তির যেমন মরীচিকায় জলভ্রম হয়, আমারও কি সেই অবস্থা? কোথাও ত স্থির হ’তে পারি নে, কে যেন কি যেন ভিতর থেকে তাড়া দিচ্চে আর বল্চে চল্ চল্, চল,—কেবলি আগে চল্। শেষটা কি শুধু ভবঘুরে হওয়াই সার হবে? বালানন্দ স্বামীকে একদিন একান্তে পেয়ে মনের সংশয় তাঁকে জানালাম। তিনি একটু মুচ্কে হেসে বল্লেন, এই ত নিয়ম। সংসার-গারদ থেকে বেরুলে প্রথমে ছুটোছুটি ক’রে বেড়াতে ইচ্ছে করে। বাঁধা গরু ছাড়া পেলে কি করে দেখেছ ত? সাধুদের সোজা কথায় কত জ্ঞান আছে, তুমি ত এই রকম ঘুরতে ঘুরতেই শিখবে। শোন সাধুর কথা—
চলতা সাধু অওর বহতা পানী।
সাধুরও চলা থামে না, জলেরও প্রবাহ বন্ধ হয় না। জলের কলনাদিনী অশ্রান্ত গতি বন্ধ হয় কখন্? না, যখন গিয়ে অনন্ত সাগরে মেশে, যখন নিস্তরঙ্গ মহাম্বুধিতে মিলিত হ’য়ে যায়। মহাসাগরের সঙ্গে একপ্রাণ হ’য়ে নিজেকে ভুলে যায়, সমুদ্রের শান্তিতে তার শান্তি, সমুদ্রের বিশাল তরঙ্গে তার আনন্দ, সমুদ্রের দিগন্তব্যাপী—আকাশব্যাপী সামগানে তার কলকণ্ঠ মিশে যায়। সাধুরও পর্য্যটন শেষ হয়—যখন সে অনন্ত ব্রহ্মকে ধ্যানে ধারণা করে, অনন্তে লীন হয়; যখন চঞ্চলতার পরিবর্ত্তে স্থিরতা, অশান্তির পরিবর্ত্তে শান্তি আসে। চলতা সাধু তব ঠহর যাতা হয়।
গোবর্দ্ধন থেকে আমরা ভরতপুরের অভিমুখে যাত্রা করলাম। ভরতপুরের কাছাকাছি একজন প্রসিদ্ধ পরমহংস থাক্তেন। বালানন্দ স্বামীর ইচ্ছা, তাঁকে দর্শন করেন। সেখান থেকে কুরুক্ষেত্র হ’য়ে হরিদ্বার, হৃষীকেশ, লছমনঝোলায় আমাদের যাবার কথা।
সারা দিন হেঁটে সন্ধ্যার সময় আমরা একটা মস্ত বাড়ী দেখ্তে পেলাম। নিকটে কোনো গ্রাম কিম্বা লোকালয় নেই। পথের পরিশ্রমে আমরা শ্রান্ত হয়েছিলাম। স্বামীজী বল্লেন, এ-বাড়ীতে লোকজনও দেখতে পাচ্ছি নে। চল, দেখা যাক্, যদি পারি ত এখানেই রাত কাটানো যাবে।
বাড়ীর বাইরে কিছু দূরে একটি ছোট কুঁড়ে-ঘরে একটি বৃদ্ধ লোক আর তার বৃদ্ধা স্ত্রী বাস করে। আমরা তাদের কাছে গেলাম। বৃদ্ধ লোকটিকে স্বামীজী জিজ্ঞাসা করলেন, এই বড় বাড়ীতে কেউ আছে?
বৃদ্ধ বল্লে, না, মহারাজ, বাড়ী প’ড়ে আছে, কেউ থাকে না।
—আমরা এখানে রাত্রি বাস করতে পারি?
—স্বচ্ছন্দে। বারণ করবার কেউ ত নেই।
বৃদ্ধা সেইখানে দাঁড়িয়েছিল। কি একটা কথা বল্তে গিয়ে থেমে গেল। তার পর বল্লে, বাড়ীর ভিতর বড় অন্ধকার, তোমাদের একটা আলো দি।
কুটীরের ভিতর থেকে বুড়ী একটা কেরোসিন তেলের টিনের আলো নিয়ে এল; বল্লে, এতে আমি আজই তেল পুরে দিয়েছি, সমস্ত রাত জ্বল্বে।
আলো আমি হাতে নিয়ে আগে চল্লাম। বৃদ্ধ কুটীর থেকে এক গাদা খড় নিয়ে এল। বল্লে, তোমরা রাত্রে পেতে শোবে। আহারের জন্য কিছু আন্ব?
স্বামীজী বল্লেন, পথে আমরা আহার করেচি, এখন আর কিছু খাব না।
কয়েকটা সিঁড়ি উঠে বাড়ীর প্রকাণ্ড দরজা। দরজা চেপে ভেজান ছিল। বৃদ্ধ দরজার সাম্নে খড়ের গাদা নামিয়ে কিছু না ব’লে চ’লে গেল।
এক হাতে আমার আলো, এক হাত দিয়ে ঠেলে দরজা খুল্তে পারলাম না। স্বামীজী বল্লেন, আমি খুল্ছি।
তিনি বলবান্, জোরে ঠেলে দরজা খুল্লেন। খুল্তে পুরানো কলকব্জার শব্দ হ’ল, ভিতরে প্রতিধ্বনি হ’ল। দরজা খুল্তেই কয়েকটা বাদুড় উড়ে বেরিয়ে গেল।
ভিতরে ঢুকে দেখি, মস্ত দরাজ ঘর, মাথার উপর ছাদ খুব উঁচু। একটু শব্দ হ’লেই চারিদিকে প্রতিধ্বনি হয়।
স্বামীজী দরজা ভেজিয়ে দিলেন। প্যারীর মাসী ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে এ-দিক্ ও-দিক্ চেয়ে বল্লে, আমার কেমন গা ছম্-ছম্ করচে!
স্বামীজী বল্লেন, ভয় করচে? তোমার ত কিছুতে ভয় করে না।
—ভয় আবার কিসের? সমস্ত রাত্রি শ্মশানে একা কাটিয়েচি, কোনো ভয় হয় নি! এ বাড়ীতে যেন কেমন-কেমন মনে হচ্ছে।
—রাত্রিবেলা পুরানো প’ড়ো-বাড়ীতে ও-রকম হয়। এ ঘরটা বড্ড বড়; এস, আমরা আর একটা ঘর দেখি।
সেই ঘরের পাশে আর একটা মাঝারি রকমের ঘর ছিল, সেইখানে খড় পেতে আমরা শয়ন করলাম। স্বামীজী আর আমি পাশাপাশি, প্যারীর মাসী একটু দূরে। আলো প্যারীর মাসীর কাছে কোণে রাখা রইল।
—৫—
গভীর রাত্রে যেন কার গলার শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ খুলে দেখি, প্যারীর মাসী আপনার মনে কি বল্চে। পাশ ফিরে দেখি, বালানন্দ স্বামীও জেগে রয়েচেন, একদৃষ্টে প্যারীর মাসীর দিকে চেয়ে রয়েচেন। আমাকে দেখে ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে আমাকে চুপ ক’রে থাক্তে ইঙ্গিত করিলেন।
প্যারীর মাসী কি ঘুমের ঘোরে কথা কইচে? তার চোখ খোলা, কিন্তু আমাদের দিকে দৃষ্টি নেই, ঘরের ভেজানো দরজার দিকে চেয়ে কথা কইচে। কথায় কোনো রকম জড়তা নেই, সব কথা স্পষ্ট শোনা যাচ্চে, কিন্তু কথার ভাবে এক রকমের ব্যগ্রতা, কোনো অভূতপূর্ব্ব ঘটনা দেখে কথায় যেমন বিস্ময়ের ভাব আসে—সেই রকম।
প্যারীর মাসী বল্ছিল, এই ত এত সব লোক গেল, এরা খাবার কারা? কি-রকম সব পোষাক পরেচে? এদের আগে আগে ও কে আস্চে? রাজপুত্তর না কি? কার্ত্তিকের মত দেখ্তে, মাথার পাগড়ীতে হীরা জ্বল্চে, গায়ের পোষাক ঝক্মক্ করচে। কোমরে বাঁধা তলোয়ার, তার মুঠোয় হাত দিয়ে মাথা উঁচু ক’রে আস্চে, আর সকলে তাকে মাথা নীচু ক’রে দু’হাতে সেলাম কর্চে। কি একটা কথা বল্লে, আমি ওদের কথা বুঝ্তে পারি নে।—এ আবার কোথায় এল, এ ঘর ত কখনো দেখি নি। ঘরের মাঝখানে হাঁটু গেড়ে গাল্চের উপর ব’সে সেই লোকটা না? দুই পাশে দাঁড়িয়ে এরা সব কে?
এ আবার কা’কে নিয়ে এল? দুই হাত বাঁধা, দুই দিকে দুটো যমদূতের মত মিন্ষে দাঁড়িয়ে! ও কি করেচে যে, ওকে চোরের মত বেঁধে এনেচে? তবু ভয় কিচ্ছু নেই, চোখ দুটো যেন জ্বল্চে! যে ব’সে আছে, সে রেগে-মেগে কি বল্চে? হাত বাঁধা থাকলে কি হয়, ও ভয় পাবার মানুষ নয়। বাঁধা হাত নেড়ে জোরে জোরে কেমন জবাব দিচ্চে! যে ব’সে রয়েচে, সে তলোয়ার কোমর থেকে টান্ছে—কেটে ফেল্বে নাকি? না, তলোয়ারের খাপ দিয়ে ধাঁ ক’রে ওর গালে মারলে। বাপ রে! কি তেজ! বাঁধা হাত দিয়েই খপ্ ক’রে খাপখানা কেড়ে নিলে—তুলে মারে আর কি, আর অম্নি সেই দুটো যমদূতের মত লোক তার হাত ধ’রে মুচড়ে খাপখানা কেড়ে নিলে। যে বসেছিল, সে লাফিয়ে উঠে চীৎকার ক’রে কি বল্লে, হাত বাড়িয়ে কোথায় দেখিয়ে দিলে। ওকে ধ’রে কোথায় নিয়ে যাচ্চে? যাই, গিয়ে দেখি!
প্যারীর মাসী ধড়মড় ক’রে উঠে বস্ল। ঘর থেকে কোথাও বেরিয়ে না যায় ভেবে আমি উঠ্তে গেলাম; বালানন্দ স্বামী আমার গায়ে হাত দিয়ে নিষেধ করলেন। আমরা দুই জনেই ত জেগে রয়েচি, আবশ্যক হয়, তখন প্যারীর মাসীকে আট্কান যাবে। প্যারীর মাসী উঠে দাঁড়াল না। মুখ আমাদের দিকে, কিন্তু দৃষ্টি স্থির, যেন কোথায় কত দূরে কি দেখ্চে। জাগন্ত মানুষের এ-রকম চাউনি কখন দেখা যায় না। খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে আবার কথা আরম্ভ হ’ল।
—ভোর বেলা সব কোথায় চলেচে? সেই হাত-বাঁধা মানুষ, দশ বারো জন লোক তাকে ঘিরে নিয়ে যাচ্চে, আর তাদের পিছনে ঘোড়ায় চ’ড়ে তলোয়ার-বাঁধা জাঁকালো পাগড়ীবাঁধা সেই লোক। চড়াইয়ের পথ, কেবল পাথর আর নুড়ি, আমার পায়ে লাগ্চে, উঠ্তে হাঁপ ধরচে!
আমরা অবাক্ হ’য়ে দেখ্লাম, পাহাড়ে উঠতে মানুষ যেমন হাঁপায়, প্যারীর মাসী সেই রকম হাঁপাচ্চে। একটু পরে সেটা বন্ধ হ’ল, আবার কথা কইতে লাগ্ল।
—এখানটা বুঝি পাহাড়ের উপর? জমি সমান, আর চড়াই নেই। ঐ যে ও-ধারে সুয্যি উঠ্চে, কিসের উপর আলো চিকচিক করচে? ও মা! ঐ যে নদী, ঠিক পাহাড়ের নীচে দিয়ে গিয়েচে। এমন জায়গায় এরা কি করতে এসেচে? পাহাড়ের পাশ দিয়ে নেমে যাবার ত পথ নেই, তবে এখানে কেন? সকলে দাঁড়িয়েচে, ঘোড়সোয়ার ঘোড়া থেকে নেমেচে। পাহাড়ের খানিকটা সরু হ’য়ে নদীর উপর ঝুঁকে আছে—কি সর্ব্বনাশ! ওর উপর সব যাচ্চে কেন?—না, সকলে ত নয়, যার হাত-বাঁধা আর সেই দুটো ষণ্ডা মিন্ষে আর তাদের পিছনে পাগড়ীধারী!
যার মাথায় পাগড়ী বাঁধা, সে কি বল্লে, আর অমনি সেই দুটো লোক হাত-বাঁধা লোকটার হাত খুলে দিলে। তার পর সেই পাগড়ীমাথায় লোকটা দুই হাত দিয়ে নীচে দেখিয়ে দিলে, কয়েদীকে ধাক্কা মেরে নীচে ফেলে দিতে বল্লে। অমন যে সুন্দর মুখ—ঠিক পিশাচের মত দেখাচ্চে! যেই বলা আর যাকে ফেলে দেবে, সে হাত ছিনিয়ে নিয়ে এক লাফে পাগড়ীবাঁধা লোকটাকে আঁকড়ে ধ’রে পাহাড়ের ধার থেকে নীচে লাফিয়ে পড়ল। একটা বিকট চীৎকার, আর সেই সঙ্গে একটা বিকট হাসি!—ঘুরতে—ঘুরতে—ঘুরতে—নীচে— নীচে—নীচে—
প্যারীর মাসী কয়েকবার শিউরে শিউরে উঠ্ল, তার পর খানিকক্ষণ স্থির হ’য়ে রইল। আবার তার কথা বেরুল।
—এক ঘর মেয়েমানুষ! এরা কোন্ দেশের মেয়ে সব? সব ঘাগরা-পরা, গায়ে হীরে-মুক্তোর গয়না। ঘরের চারি-পাশে ব’সে আছে, কেউ পান খাচ্চে, কেউ আলবোলায় তামাক টান্চে। খোট্টা মেয়েদের মতন এরা তামাক খায়। ঘরের মাঝখানে চার পাঁচ জন আলাদা ব’সে আছে, এরা কারা? ওঃ, এরা বাঈজী, বাঈনাচ হবে। এক জন উঠে নাচ্চে আর দু’জন সারিঙ্গী বাজাচ্চে, আর একজন বাঁয়া-তবলা বাজাচ্চে; বাঃ, বেশ নাচ, ঠম্কে ঠম্কে, ভুরু নাচিয়ে, পায়ের ঘুঙ্গুরে তাল?
ঐ দরজার পাশে যে মেয়েটি ব’সে আছে, সে ত নাচ দেখ্চে না। এরা ত সব সুন্দরী, কিন্তু এর মতন সুন্দরী কেউ নেই। ওর মন যেন আর কোনো দিকে রয়েচে। চোখের কি-রকম চঞ্চল দৃষ্টি, কেমন যেন উস্খুস্ করচে, কেউ না টের পায়, এই ভাবে দরজার দিকে একটু একটু ক’রে স’রে যাচ্চে।
নাচ বন্ধ ক’রে বাঈজীরা গান ধরেছে। গান যেই বেশ জমেচে, অমনি সে মেয়েটি কাউকে কিছু না ব’লে উঠে গেল। পায়ে নূপুর নেই, হাতের গয়না হাতের উপরে টেনে চাপা, কোনো শব্দ নেই। ঘর থেকে বেরিয়ে দেওয়ালের পাশ দিয়ে ছায়ার মত চলেচে, মাটীতে পা পড়ে, কি পড়ে না। ছায়া —ছায়া —ছায়া—
একটা ছোট দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। দরজায় চাবি দেওয়া, মেয়েটির হাতে চাবি ছিল, দরজা খুল্তেই আর একটি ছায়া ভিতরে এল, দুটি ছায়া মিশে গেল। দরজার কাছে একটা ধাপ ছিল, দুই জনে তার উপরে বস্ল। দূর থেকে গানের সুর আস্চে।
হঠাৎ দু’জনের গায়ে কোত্থেকে আলো পড়ল! দু’জনে ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল—দু’জনের মুখের উপর আলো—রতি-কাম—
কালো জামা-আঁটা একটা হাত আলোতে এল, মানুষ অন্ধকারে। হাতের ছুরী হাতে চক্মক্ ক’রে উঠল। মেয়েটির কাছে যে সুন্দর যুবা দাঁড়িয়েছিল, তার বুকে ব’সে গেল। একবার অল্প যন্ত্রণার শব্দ, তারপর সে প’ড়ে গেল। মেয়েটি আর্ত্তনাদ ক’রে তার বুকের উপর পড়্ল।
ছুরী আবার উঠ্ল, আবার পড়ল, এবার মেয়েটি একবার কাতরোক্তি ক’রে উঠ্ল। আলো দু-একবার তাদের দু’জনের সর্ব্বাঙ্গে পড়্ল—সব স্থির—রক্ত মাটীতে ব’য়ে যাচ্চে—আলো নিভে গেল—আবার অন্য দুটো ছায়া অন্ধকারে মিলিয়ে গেল—
গানের আওয়াজ এখনো শোনা যাচ্চে, ঘরের ভিতর আলোয় আলো, চারিদিকে হাসি-তামাসা, আর এখানে—এই অন্ধকারে—
কথা বন্ধ হ’য়ে গেল। প্যারীর মাসী আস্তে আস্তে শুয়ে তৎক্ষণাৎ ঘুমিয়ে পড়্ল। বালানন্দ স্বামী আমার কাণে কাণে অত্যন্ত লঘু স্বরে বল্লেন, তুমি যা শুন্লে, প্যারীর মাসীকে কিছু ব’লো না।
আমি ঘাড় নেড়ে সায় দিলাম।
—৬—
সকালে উঠে বাড়ীর পিছনে একটা পুষ্করিণী ছিল, তাতে আমরা স্নান করলাম। প্রাতঃকৃত্য সমাপন ক’রে স্বামীজী সেই বুড়ো মানুষটিকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, কাছাকাছি কোনো গ্রাম কি সহর আছে?
—আধ ক্রোশ দূরে একটা ছোট গ্রাম আছে। সহর অনেক দূর।
প্যারীর মাসী স্নান-আহ্নিক ক’রে দাঁড়িয়েছিল। স্বামীজী জিজ্ঞাসা করলেন, রাত্রে ঘুম হয়েছিল কেমন?
হেসে প্যারীর মাসী বল্লে, বেশ ঘুম হয়েছিল।
—আমরা কি এখনি বেরিয়ে পড়্ব, না এখান থেকে খাওয়াদাওয়া ক’রে যাব?
—বাবাঠাকুর, কাল রাত্রে তোমাদের খাওয়া হয় নি, এখান থেকে খেয়ে গেলে ভাল হয়। কিন্তু এখানে জিনিষপত্র ত কিছু নেই।
—কাছেই গ্রাম আছে, আমরা সব নিয়ে আস্চি! তুমি ততক্ষণ এদের সঙ্গে কথাবার্ত্তা কও।
—বেশ, তোমরা বাজার ক’রে এস।
পথে যেতে যেতে স্বামীজী বল্লেন, দেখ্লে, কাল রাত্রে প্যারীর মাসী যে-সব কথা বল্ছিল, ওর কিছু মনে নেই। তুমি কিছু বুঝ্তে পার্লে?
—না, মহারাজ, কিছুই বুঝ্তে পারিনি। কিন্তু আমার মনে হ’ল, ও-সব ভয়ানক ঘটনা সত্য, অতীতের ছায়া ঘুমন্ত অবস্থায় প্যারীর মাসীর মনে পড়েছিল।
—সত্য কথা, আর এই বাড়ীর সঙ্গে ঐ দুটা ভীষণ ঘটনার সম্বন্ধ আছে। প্যারীর মাসী একটু যেন কি-রকম কি-রকম, সে-কথা তোমাকে বলেচি। এটা কিন্তু নতুন। ঘুমের ঘোরে ওকে কখনো কখনো কথা কইতে শুনেছি, কিন্তু এ-রকম নয়। স্বপ্নের কিছু না কিছু মনে থাকে, প্যারীর মাসীর কিছুই মনে নেই। এ এক রকম আবেশ। ভূত-প্রেত নয়, ওর একটা কোনো শক্তি আছে, যা ও জানে না, আমরাও বুঝ্তে পারিনে।
গ্রামে গিয়ে আমরা প্রথমে হাটে গেলাম না। এক জন আধাবয়সী লোককে দেখে স্বামীজী জিজ্ঞাসা করলেন, এ গ্রামে কোনো অতিবৃদ্ধ লোক আছে?
—হাঁ, বাবাজী! ঐ সামনের বাড়ীতে ত্রিলোচন দাস আছেন, লোকে বলে, তাঁর বয়স একশো বছর হয়েছে।
আমরা সেই বাড়ীতে গেলাম। ছোট পরিষ্কার খোলার ঘর, দাওয়ায় কম্বলের উপর ব’সে শীর্ণ-দেহ, স্থবির পুরুষ। চুল, ভুরু, গোঁফদাড়ী সব সাদা, কিন্তু চক্ষু নির্ম্মল। আমাদের দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বল্লে, আজ আমার কি সৌভাগ্য! প্রাতঃকালে সাধু-দর্শন!
স্বামীজী বল্লেন, আপনাকে আমরা কিছু জিজ্ঞাসা করতে এসেছি।
—সেও আমার সৌভাগ্য। বসুন।
আমরা ত্রিলোচন দাসের পাশে বস্লাম। স্বামীজী বল্লেন, এখান থেকে পশ্চিমে কিছু দূরে একটা পুরাতন বড় বাড়ী আছে। সে বাড়ীর ইতিহাস আপনি জানেন?
—জানি।
প্যারীর মাসী স্বপ্নে কি আর কোনো অবস্থায় যেমন দেখেছিল, স্বামীজী সংক্ষেপে সেই সকল কথা বল্লেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, এই সব ঘটনা কি সত্য? সেই বাড়ীর সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ আছে?
—ঘটনা সত্য, আর ঐ বাড়ীর সঙ্গে সম্বন্ধও আছে, কিন্তু আপনি জান্লেন কেমন ক’রে? তবে আপনারা সর্ব্বদর্শী, আপনাদের কাছে ভূত ও বর্ত্তমান সমান।
—যদি পূর্ব্বের কথা আমাদের বলেন, তা হ’লে আমাদের কৌতূহল নিবৃত্তি হয়।
বৃদ্ধ বল্লেন, মোগলের রাজ্যকালে ঐ বাড়ীতে কোনো ধনী মোগল বাস কর্ত। কয়েক পুরুষ কাটায়। সকলেই দেখ্তে সুপুরুষ, কিন্তু দুর্ব্বৃত্ত ও ঘোর অত্যাচারী। দুই ঘটনাই ঐ বাড়ী-সংক্রান্ত। কিছু দূরে একটা ছোট পাহাড় ও নদী আছে।
গ্রাম থেকে চাল, মুগের ডাল, ঘি, গোটাকতক আলু আর খানকতক কাঠ নিয়ে আসা গেল। সেই সঙ্গে একটা নতুন হাঁড়ি। দেখে প্যারীর মাসী বল্লে, ভাতে-ভাত হবে?
স্বামীজী বল্লেন, যাকে বলে ঘৃতপক্ক, তাকেই বলে ভাতে-ভাত।
ভরতপুরের কাছে এসে আমরা শুন্লাম, পরমহংস কোথায় পরিব্রজা করতে গিয়েছেন, মাসকতক ফিরবেন না। সেখান থেকে আমরা কুরুক্ষেত্রে গেলাম। কুরুক্ষেত্রে মেলায় বিস্তর লোকের সমাগম, আমরা একটা বাসা দেখে নিয়ে জনতার ভিতর ঘুরে বেড়ালাম। এক জায়গায় দেখি, একটা গাছতলায় তিন জন সাধু ব’সে মাথা হেঁট ক’রে কি কর্ছে। তাদের মাথা-মুখ কামানো, কৌপীন-আঁটা, গায়ে এক একখানা কম্বল। দেখি, তারা কোমর থেকে গেঁজে খুলে হাতে টাকাপয়সা ঢেলে গুণ্ছে। বালানন্দ স্বামী একটু হেসে বল্লেন,—
শিল মুণ্ডিদে তুণ্ড মুণ্ডিদে চিত্ত ন মুণ্ডিদে কীশ মুণ্ডিদে।[১]
কুরুক্ষেত্রে এক রাত্রি কাটিয়ে আমরা হিমাচলের অভিমুখে যাত্রা করলাম। পাহাড়ের পথে বেশী লোক চলে না, অনেক দূরে দূরে ছোট ছোট গ্রাম। বড় বড় দেবদারু-গাছ উর্দ্ধশির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের ফুলের রেণুতে পাহাড়ের সরু পথ ছেয়ে ফেলেছে। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড খড্।—নীচে চেয়ে দেখলে মাথা ঘুরে আসে। কোথাও বড় বড় ঝরণা, ঝর্ ঝর্ শব্দে খড্ বেয়ে নীচে চ’লে যাচ্ছ। চারিদিকে মৌন প্রকৃতি, বিশাল স্তব্ধতা সমস্ত আচ্ছন্ন ক’রে রয়েছে।
এক একবার আমি প্যারীর মাসীর দিকে চেয়ে দেখ্ছিলাম। তার মুখে কোনো কথা নেই, চক্ষুর উপর যেন একটা আবরণ নেমে তার বহির্দৃষ্টি রুদ্ধ হ’য়ে অন্তর্দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়েছে। কখন কখন উপরের দিকে চেয়ে দেখে, আবার যেন তার চোখের উপর একটা পর্দ্দা পড়ে। পাহাড়ের গম্ভীর সৌন্দর্য্যে আমার চিত্ত অভিভূত হয়েছিল। পুরাকালে মুনি-ঋষি-তপস্বীরা এই সব স্থানে কি কারণে সাধনা করতে আসতেন, তা ত সহজেই বুঝ্তে পারা যায়। কোথায় প’ড়ে থাকে সংসারের কলকোলাহল, সহস্র রকমের ক্ষুদ্রতা! এখানে বিরাটের ব্যাপ্তি, নভঃস্পর্শী উন্নত মস্তকের বিশালতা, ধ্যানমগ্নতার নিঃস্পন্দ স্থিরতা।
সন্ধ্যার সময় আমরা পথের পাশে একটি ভাঙ্গা কুঁড়ে ঘর দেখতে পেলাম। হয় ত কোনো সাধু কোনো কালে সেখানে বাস করত।
গ্রাম কাছাকাছি কোথাও আছে কি না, আমরা জানি নে, এ-দিকে অন্ধকার হ’য়ে এল। স্বামীজী বল্লেন, রাত্রে এ-পথে চলা যুক্তিযুক্ত নয়। পাহাড়ের পথ, পাশেই খড্, দেখে শুনে চলা উচিত। অন্য আশঙ্কাও থাক্তে পারে। আজ এইখানে রাত্রিবাস করা যাক্।
পাহাড়ে শীত বেশী জেনে মেলা থেকে আমরা খানকতক কম্বল কিনে নিয়েছিলাম। প্যারীর মাসীর সেই রকম অবস্থা দেখে পর্য্যন্ত স্বামীজী আমাকে ব’লে দিয়েছিলেন, রাত্রে কখনো অন্ধকারে শোওয়া হবে না, কি জানি, ও যদি কোথাও উঠে যায়। একটা টিনের আলোতে তেল পোরা, আর দেশালাইয়ের বাক্স আমার কাছে থাক্ত।
কুটীরের ভিতর কাঁধের কম্বল নামানো গেল। স্বামীজী বল্লেন, এইবার আগুন জ্বাল্তে হবে, বেশী রাত্রে ভালুক আস্তে পারে। আগুন জ্বালা থাকলে কিছুই আস্বে না।
আমি বল্লাম, এখানে কাঠ পাওয়া যাবে কোথায়?
প্যারীর মাসী বল্লে, বাঁশবনে ডোম-কাণা! চার ধারে গাছ, কাঠ নেই?
—ও যে কাঁচা কাঠ।
— তুমি বুঝি এই জান? দেবদারু-গাছের কাঁচা ডালে মশাল হয়, জান না? কতকগুলো ডাল ভেঙ্গে নিয়ে এস।
আলো জ্বালিয়ে রেখে আমি কাঠ আন্তে গেলাম। সরু মাঝারি ডাল ভেঙ্গে এক পাঁজা এনে দেখি, স্বামীজী আর প্যারীর মাসী পাহাড়ের আর গাছের গা থেকে মখমলের মত নরম নরম পুরু পুরু এক রকম শেওলা তুল্চেন। স্বামীজী বল্লেন, একে পাথর, তায় আবার কন্কনে ঠাণ্ডা। আমাদের যে গদি হবে, তা রাজাদেরও জোটে না।
পুরু ক’রে শেওলার বিছানা পেতে ঘরের দোর গোড়ায় আমরা আগুন জ্বাল্লাম। দেবদারু-কাঠের নির্য্যাস ঘৃতের মত জ্বলে। আগুন দাউ দাউ ক’রে জ্ব’লে উঠ্ল। বাকি ডালপালা ভিতরে রইল।
সঙ্গে কিছু খাবার ছিল, খেয়ে ঝরণার জল পান করা গেল। দিব্য নরম শয্যা, পাহাড়ে সারাদিন হাঁটার শ্রান্তি, বেশ শীত, কম্বল মুড়ি দিয়ে আমাদের ঘুমিয়ে পড়তে বিলম্ব হ’ল না।
—৭—
আবার সেই রকম! প্যারীর মাসীর কথার সাড়ায় আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। সে আপনার মনে কথা কইচে। বালানন্দ স্বামী ঘুমিয়েছিলেন, কিন্তু আমি যেই চোখ খুলেছি, অমনি তিনিও জেগে উঠ্লেন। আমরা দু’জনে চুপ ক’রে প্যারীর মাসীর কথা শুন্তে লাগ্লাম।
সে বল্ছিল, ঐ দেখেছ গাছতলায় কে ব’সে রয়েছে! নড়ন-চড়ন নেই, একেবারে স্থির। মুনি-ঋষি কেউ হবে, ব’সে চোখ বুজে ধ্যান করছেন। গা থেকে তেজ ফুটে বেরুচ্চে। কোথাও কিছু শব্দ নেই, চারিদিক একেবারে স্তব্ধ। জন-মনুষ্য নেই, গাছে একটা পাখী পর্য্যন্ত নেই। কেবল বন—বন—বন—গাছের ছায়ায় যেন দিনের বেলাও অন্ধকার ক’রে রয়েচে—
বনের ভিতর দিয়ে ও দুটো কি আস্চে? ভালুক না কি? আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে গুঁড়ি মেরে আস্চে। জন্তু নয় ত মানুষ, এইবার উঠে দাঁড়িয়েচে, সাবধানে উঁকি মেরে এ-দিকে ও-দিকে দেখ্চে! দু’পা এগোয়, আবার দাঁড়ায়, আর চোখগুলো যেন ভাঁটার মতন ঘুর্চে। ধীরে ধীরে, থেমে থেমে, একটুও শব্দ না ক’রে আস্চে—আস্চে—আস্চে—
মুনিকে দেখে থম্কে দাঁড়াল! একবার দু’জনে মুখ-চাওয়া-চাওয়ি ক’রে, যিনি ধ্যানে ব’সে আছেন, তাঁর পাশ কাটিয়ে আর এক দিকে গেল। তিনি যেমন ব’সেছিলেন, তেমনি ব’সে আছেন—চোখ বোজা, মাথা সোজা, অঙ্গের গৌরকান্তি থেকে জ্যোতি বেরুচ্চে—একেবারে স্থির, নিশ্বাস পড়চে কি না, বুঝ্তে পারা যায় না।
তিনি যেখানে ব’সে আছেন, তার পিছনে কিছু দূরে একটা গুহা। গুহার মুখের কাছে একটা বড় পাথরের আড়াল থেকে এক একবার উঁকি মারচে—ও কে?
মেয়েমানুষ! পরমা সুন্দরী, বয়স অল্প। ওর এত ভয় কিসের? ভয়ে চোখ যেন ঠিক্রে বেরিয়ে আস্চে, মুখ শুকিয়ে গিয়েচে, এক একবার হাঁপাচ্চে, গা ঠক-ঠক ক’রে কাঁপ্চে। গুহার ভিতর কোনো জন্তু জানোয়ার নেই ত? তা হ’লে ওখান থেকে পালিয়ে আস্চে না কেন?
আর ঐ দু’জন লোক অমন ক’রে যাচ্চে কেন? ওরাও কি ভয় পেয়েচে? কৈ, ওদের মুখে ত ভয়ের কোনো চিহ্ন নেই। কেবল সাবধান—সাবধান— সাবধান! ওদের পিছনে কি লোক লেগেচে? তা হ’লে এমন ক’রে ঘুরে ঘুরে বেড়াবে কেন? ওরা যেন চোরের মতন উট্কে পাট্কে কি খুঁজ্চে—
ঐ গো! ওরা মেয়েটিকে দেখতে পেয়েচে, পেয়েই একেবারে সেই দিকে ছুটেচে!
তারা ছুটে আস্চে দেখে মেয়েটি চেঁচিয়ে উঠ্ল। স্তব্ধতার বুকে যেন ছুরী বিঁধে গেল। গুহার ভিতর পাহাড়ের গায়-গায় চারিদিকে প্রতিধ্বনিত হ’তে লাগল। সে শব্দে যোগীর ধ্যান ভঙ্গ হ’য়ে গেল, তিনি চোখ মেলে উঠে দাঁড়ালেন। স্ত্রীলোকটি পাগলের মত ছুটে এসে যোগীর পা আঁকড়ে ধ’রে বল্চে, রক্ষা করুন—রক্ষা করুন!
তিনি আস্তে আস্তে পা ছাড়িয়ে নিয়ে, যুবতীর মাথায় হাত দিয়ে তা’কে অভয় দিলেন।
সে দু’জনও এসে উপস্থিত হ’ল। তারা একেবারে স্ত্রীলোকটিকে ধরতে যায়, যোগী হাত বাড়িয়ে তাদের নিষেধ করলেন। তারা রেগে মেগে তাঁকে ধাক্কা মেরে যেই ফেলে দিতে যাবে, আর অম্নি তাঁর মুখের দিকে চেয়ে তাদের আর পা এগোল না।
যোগী যেমন হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই রকম দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর চক্ষু সেই দুই জন লোকের মুখের দিকে। তারা তাঁর চোখের দিকে চেয়ে রইল, আর চোখ ফেরাতে পারল না।
দেখ, দেখ, যোগীর চক্ষু দেখ! চোখ থেকে যেন আগুনের হল্কা ছুট্চে। মহাদেবের ললাট-নেত্র না কি? এরা কি ভস্ম হ’য়ে যাবে? চোখের কি জ্যোতিঃ! কি দহন-জ্বালা! স্ফুলিঙ্গের পর স্ফুলিঙ্গ, অনল-স্রোতের পর স্রোত—
সে দু’জন লোক ঠিক পাথরের মূর্ত্তির মত দাঁড়িয়ে, মুখে একটি কথা নেই, একটি পা চল্বার শক্তি নেই—একেবারে আড়ষ্ট, নিঃস্পদ, চোখের পাতা পর্য্যন্ত পড়চে না।
যোগী একবার হাত দুলিয়ে আঙ্গুল দিয়ে নীচের দিকে দেখালেন। চক্ষুর দৃষ্টি সহজ হ’য়ে এল, বল্লেন, তোমরা চ’লে যাও, আর কখনো এখানে এস না
তখন তাদের হাত-পায়ে সাড় হ’ল, শুকনো মুখে কাঁপ্তে কাঁপ্তে, কুকুরের মত ল্যাজ গুটিয়ে চ’লে গেল।
এতক্ষণ মেয়েটি চুপ ক’রে এক পাশে দাঁড়িয়েছিল। যোগী তার দিকে কোমল দৃষ্টিতে চেয়ে কোমল স্বরে বল্লেন, মা, তুমি কোথায় যাবে?
যুবতী কেঁদে ফেল্লে। বললে, সংসারে আর আমি ফিরে যাব না। আপনি আমাকে রক্ষা করেছেন, আপনি আমাকে আশ্রয় দিন্।
যোগী বল্লেন, এখানে ত থাকার স্থান নেই। গুহার মধ্যে তুমি কেমন ক’রে বাস করবে? আমি তপস্বী, তুমি যুবতী রমণী, তুমি এখানে থাকলে আমার সাধনার বিঘ্ন হ’তে পারে।
—তপোবনে কি ঋষিকন্যারা থাক্তেন না? তাতে কি ঋষিদের তপস্যার কোনো বিঘ্ন হ’ত? আমি সংসার থেকে এসেচি, আমার চিত্ত মলিন, কিন্তু আপনার কৃপা হ’লে আমারও চিত্তশুদ্ধি হ’তে পারে।
তপস্বী একটু চুপ ক’রে রইলেন, তারপর বল্লেন, আমার সাধনা এখনো পূর্ণ হয়নি। আর কাউকে শিক্ষা দেবার সময় এখনো হয়নি। এখান থেকে কিছু দূরে জনকতক তপস্বিনী থাকেন, তুমি তাঁদের কাছে থাক্তে পার। এখন তাঁদের কাছে শিক্ষা কর, এর পর আবশ্যক হয়, আমার কাছেও শিখ্বে।
—আপনার যেমন আজ্ঞা।
এই দু’জন তপস্বিনী আস্ছেন। গেরুয়া-পরা, শীর্ণ মূর্ত্তি, বেশ লম্বা, শান্ত স্থির চাউনি। এসে দুই জনে তপস্বীকে প্রণাম করলেন। তিনি যুবতীকে দেখিয়ে বল্লেন, একে তোমরা নিয়ে গিয়ে নিজের কাছে রাখ।
তাঁরা যুবতীকে দেখে একটু আশ্চর্য্য হ’লেন, কিন্তু কোনো কথা কইলেন না। একজন এগিয়ে যুবতীর হাত ধরলেন, বল্লেন, চল বোন্, অশান্তি থেকে শান্তিতে চল।
আর কোনো কথা শোনা গেল না। প্যারীর মাসী পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
ঘরের দোর-গোড়ায় আগুন প্রায় নিভে গিয়েছিল, ঘরের পিছন দিকে কিসের শব্দ? ঘরের পিছন দিকে কিসে যেন আঁচ্ড়াচ্চে। বালানন্দ স্বামী উঠে ব’সে চুপি চুপি বল্লেন, ভালুক। এই ব’লে তিনি তাড়াতাড়ি উঠে কতকগুলা কাঠ আগুনের উপর দিলেন। আমিও উঠে দরজা-গোড়ায় এসে দাঁড়ালাম। কাঠ হু হু ক’রে জ্ব’লে উঠ্ল, চারিদিকে আলো হ’ল। সেই আলোয় আমরা দেখ্তে পেলাম, একটা ভালুক পালিয়ে গেল।
প্যারীর মাসীর ঘুম ভাঙ্গেনি।
সকালবেলা উঠে ঝরণার জলে মুখ-হাত ধুয়ে বালানন্দ স্বামী আর আমি একবার সাম্নের বনে গেলাম। প্যারীর মাসী নীচে ঝরণার কাছে নেমে গিয়েছিল। আমরা দেখ্লাম, পাহাড়ের গায়ে একটা বড় গুহা রয়েছে। বালানন্দ স্বামী আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে বল্লেন, ঐ দেখ। প্যারীর মাসী নিজে জানে না যে, সে জাতিস্মর। জাগ্রত অবস্থায় সে-ভাব হয় না, কিন্তু ঘুমুলে পর অতীত তা’র কাছে বর্ত্তমানের মতন দেখায়। আবার দেখেছ স্থানের গুণ? সব জায়গায়, কি সব রাত্রে এ-রকম তা’র হয় না।
প্যারীর মাসীর কোনো কথাই মনে ছিল না, আমরাও কিছু উচ্চবাচ্য করলাম না।
—৮—
হরিদ্বারে, মনে হয় বটে যে, ব্রহ্মলোক থেকে অলকানন্দা মর্ত্তলোকে অবতীর্ণা হয়েছেন। দিবানিশি জলপ্রপাতের ন্যায় শব্দ ঘোর ঘর-ঘর রবে উপলখণ্ডে জলমগ্ন প্রস্তরে আহত-প্রতিহত হ’য়ে দেরী ভাগীরথী মুক্তবেণী হ’য়ে চঞ্চল গতিতে তরঙ্গলীলায় সাগর-সঙ্গমে চলেচেন। এই স্রোতের মুখে ঐরাবত ভেসে যাবে, তা’তে আর বিচিত্র কি! অবিরাম বেগ, অজস্র প্রবাহ, দূর-সমুদ্রের নায় গভীর, দিক্পরিপূরিত ধ্বনি! ছল ছল, ঝর ঝর, তর তর রবে গৌরী-পর্ব্বতের তলদেশ দিয়ে জহ্নুকন্যা কোনো দিকে দৃকপাত না ক’রে অনন্তের উদ্দেশে যাত্রা করেচেন।
ব্রহ্মকুণ্ডে পাণ্ডারা যাত্রীদের ছাঁকা-বাঁকা ক’রে ধরেছে, ঠিক যেন মিঠাইয়ের উপরে মাছি ঘিরেচে। আমাদের কে পুছে? গৈরিক বস্ত্র ধারণ করলেই মার্কামারা দেউলে, না তার চোর-ডাকাতের ভয়, না তার উপর পাণ্ডার পীড়ন। গয়ালী, প্রয়াগওয়ালা পাণ্ডা তার দিকে ফিরেই চায় না।
হরিদ্বারে কেউ বড় একটা ত্রিরাত্রি বাস করে না। আমরা দু’দিন থেকেই চ’লে গেলাম।
চল্তা সাধুর চলা আর বন্ধ হয় না। হরিদ্বার থেকে হৃষীকেশ, সেখান থেকে লছমনঝোলা, গঙ্গোত্রী, গোমুখী। আরো আগে? আর আগে কি আছে? স্বামীজীর আর আগে যাবার ইচ্ছে নেই, প্যারীর মাসী চেপে ধরলে, আর খানিকটা যেতেই হবে।
আমরা দু’জনেই প্যারীর মাসীর একটা পরিবর্ত্তন লক্ষ্য করছিলাম। তার কথাবার্ত্তা ক্রমে ক’মে আস্ছিল। সর্ব্বদা যেন অন্যমনস্ক, সময়ে সময়ে আমরা কেউ কথা কইলে চম্কে উঠ্ত। মাঝে মাঝে চোখে সেই রকম আবরণ, বাইরে কোনো দিকে দৃষ্টি নেই। মনের ভাব টানা তারের মত, একবার আঙ্গুল ঠেক্লেই ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে। আঙ্গুল যে কার, সেটা আমরা বুঝ্তে পারছিলাম না। একটা আকুলতা, অন্তরের ব্যগ্রতা তাকে আচ্ছন্ন ক’রে ফেল্ছিল, কিন্তু কারণ আমাদের চোখে কিছু ঠেক্ছিল না। যে-ভাব রাত্রে আমরা দু’বার দেখেছিলাম, দিনের বেলাও যেন সেই রকম আরম্ভ হ’ল, কিন্তু আপনার মনে প্যারীর মাসী বেশী কথা কইত না। বরং আমাদের মনে হ’ত, যেন অনেক সময় সে কাণ পেতে কা’র কথা শুন্চে। এক একবার যেন ঘাড় নেড়ে কি কথায় সায় দিচ্চে।
প্যারীর মাসীর অসাক্ষাতে স্বামীজীকে আমি বল্লাম, এ-সব লক্ষণ কি আপনার ভাল মনে হচ্চে?
—না, ভাল আবার কোন্খানটা?
—যদি এমন স্থানে উন্মাদ হ’য়ে ওঠে কিংবা একটা কিছু কাণ্ড ক’রে বসে, তা হ’লে উপায়?
স্বামীজী মাথা নাড়লেন, বল্লেন, সে-সব ভয় কিছু নেই, কখনো কিছু উৎপাত করবে না। তবে হঠাৎ যদি কোথাও চ’লে যায়, সেই ভয়। হয় ত এই রকম কিছু দিন থেকে আপনি সেরে যাবে। হয় ত—
স্বামীজী কথাটা শেষ করলেন না, একদৃষ্টে আমার মুখ চাইলেন।
আমি বল্লাম, আপনি কি বল্তে যাচ্ছিলেন, বল্লেন না?
স্বামীজী বল্লেন, যা মনে হবে, সব কথাই কি বল্তে হবে? কখন একটা খেয়াল আসে, কখন কিছু কল্পনা।
—প্যারীর মাসীর এ-রকম জেদ কত দিন থাক্বে?
—এইবার যেখানে গিয়ে আড্ডা করা যাবে, সেইখান থেকে ফিরে আস্ব। আমার শরীর ভাল নেই বল্লে ও নিজেই ফিরে যেতে চাইবে।
পথে কিছু দূর গিয়ে আমরা দেখ্লাম, একটা সঙ্কীর্ণ পথ উত্তরদিকে চ’লে গিয়েচে। প্যারীর মাসী সেইখানে দাঁড়িয়ে বল্লে, এইবার এই পথ দিয়ে যেতে হবে।
স্বামীজী বল্লেন, এ পথ কোথায় গিয়েছে, আমরাও ত কিছু জানিনে।
—চল না, এই পথ দিয়ে গেলেই আমরা ঠিক যাব।
প্যারীর মাসী সেই পথে চল্ল। স্বামীজী আর কিছু না ব’লে তার পিছনে চল্লেন।
পথ সরু, পগদণ্ডী, দুর্গম। তার পাশেই অত্যন্ত গভীর, প্রশস্ত খড, নীচে চেয়ে দেখ্তে গেলে ভয় করে। অন্য দিন হ’লে প্যারীর মাসী ভয়ে ভয়ে আমাদের পিছনে আস্ত, আজ সে দ্রুত অভ্রান্ত পদক্ষেপে আগে আগে চল্ল, যেন পাহাড়ে ওঠা তার চিরকালের অভ্যাস। আমরা কোনোমতে যথাসাধ্য তার অনুবর্ত্তী হলাম। পাহাড়ের উচ্চতায় ও পথের কঠিনতায় হাঁপ্ লাগ্ছিল।
হিমালয়ের হিমানীমণ্ডিত শৃঙ্গরাজি কিছু দূরে হ’লেও খুব নিকটে মনে হচ্ছিল। অতি-প্রাচীন, শুভ্রশীর্ষ, বিরাটদেহ মৌনী ঋষির মত একের পর আর এক দাঁড়াইয়া আছে। কোনখানে উপত্যকার ন্যায়; সেখানে ঘনবিন্যস্ত ঘনশ্যাম বিশাল তরুরাজির সারি। চারিদিকে বিরাটের সমাবেশ, বিরাট্ গাম্ভীর্য্য, বিরাট্ স্তব্ধতা, বিরাট্ হিমগিরি। মধ্যাহ্নের পর আমরা দেখলাম, পথ পূর্ব্বমুখ হয়েছে। কিছু দূর গিয়ে দেখ্লাম, খডের ভিতর দিয়ে প্রবলবেগে স্রোতস্বতী প্রবাহিত হয়েচে, জল নির্ম্মল হ’লেও তা’তে গাঢ় শ্যাম আভা, পাহাড়ে ঠেকে শুভ্র ফেনা উঠ্ছে। প্যারীর মাসী একবার দাঁড়িয়ে নীচের দিকে চেয়ে বল্লে, কৃষ্ণগঙ্গা।
স্বামীজী বিস্মিত হ’য়ে তার মুখের দিকে চাইলেন, আবার জলের দিকে চেয়ে বল্লেন, কৃষ্ণগঙ্গাই বটে।
যেমন অপরাহ্ন হ’য়ে আসতে লাগল, সেই সঙ্গে খড দিয়ে মেঘ ঘনীভূত কুণ্ডলীকৃত হ’য়ে উপরে উঠ্তে লাগল। সে এক অপূর্ব্ব দৃশ্য! ঘুরে ঘুরে, পাকিয়ে পাকিয়ে, জড়িয়ে জড়িয়ে, অলস মন্থর গতিতে চলেচে। যেন বৃহৎ অজগরে দল এঁকে বেঁকে সংসর্পিত হ’য়ে পর্ব্বতারোহণ করছে। সারির পর সারি, স্তরের পর স্তর, মেঘের পর মেঘের দল—সব এক পথের যাত্রী। উপরে এসে গিরিশৃঙ্গের উপকণ্ঠে মালার মত জড়িয়ে যেতে আরম্ভ হ’ল। এ-সব বিনা-সূতায় গাঁথা হায়, আপনা-আপনি পর্ব্বতরাজের গলায় উঠ্চে। অথবা এই সব মহাসর্প কৈলাসপতি মহাদেবের অঙ্গ বেষ্টন করচে।
সন্ধ্যার প্রাক্কালে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হ’য়ে এল। আমরা কিছু চিন্তিত হলাম। যদি বৃষ্টি আসে, কোথায় দাঁড়াব? রাত্রিই বা কোথায় যাপন করব? বালানন্দ স্বামী বল্লেন, প্যারীর মাসী, আজ ত তুমি আমাদের পাণ্ডা। রাত্রের কি ব্যবস্থা করেছ? এ-পথে তোমার ঘর-দোর কোথাও আছে?
প্যারীর মাসী মুখ ফিরিয়ে বললে, তোমরা ভাব্চ কিসের জন্যে বাবাঠাকুর? আমি কি আর না জেনে শুনে তোমাদের নিয়ে যাচ্ছি। আর একটু এগিয়ে ঘর পাওয়া যাবে, তোমাদের রাতে কোনো কষ্ট হবে না।
ঠিক সন্ধ্যার সময় আমরা দেখ্তে পেলাম, পথের কিছু উপরে একখানি পাথরের ঘর। তার সাম্নে একটু জায়গা পরিষ্কার ক’রে সমভূমি করা, ঘরের সাম্নে বারান্দা, তা’তে তিনটি পাথরের থাম, বেশ শক্ত কাঠের দরজা, বাইরে থেকে শিকল দেওয়া। প্যারীর মাসী তড়-তড় ক’রে উঠে গিয়ে দরজার শিকল খুলে ঘরে ঢুক্ল। বালানন্দ স্বামী আর আমি বিস্মিত হ’য়ে পরস্পরের মুখের দিকে চেয়ে আস্তে আস্তে তার পশ্চাতে ঘরে প্রবেশ করলাম।
—৯—
ঘরের ভিতর গিয়ে দেখি, এক কোণে একরাশি কাটা কাঠ সাজানো রয়েছে, তার পাশে পাথরের উনান। একটা কুলুঙ্গিতে একটি পিতলের হাঁড়ি আর হাতা, তার পাশে কিছু চাল আর ডাল, একটা পাথরের বাটিতে খানিকটা ঘি, পাতার উপর সব রকম গুঁড়া মসলা, নুণ, একটা ঝুড়িতে আধ ঝুড়ি আলু। আর এক পাশে কতকগুলা শালপাতা।
আমি আশ্চর্য্য হ’য়ে বল্লাম, এ ঘরে নিশ্চয় কেউ থাকে।
কোথাও কিন্তু মানুষের কোনো চিহ্ন নাই। বালানন্দ স্বামী বল্লেন, কেউ থাক্ত, তা ত স্পষ্ট দেখা যাচ্চে, কিন্তু এখন যে কেউ আছে, তা মনে হয় না।
ঘরের আর এক কোণে গাদা–করা খড় রাখা ছিল, প্যারীর মাসী দেখিয়ে দিয়ে বল্লে, এই শোবার বিছানা। এখানে যে থাক্ত, সে এই সব জিনিষ রেখে কোথাও চ’লে গিয়েচে, ভেবেছিল, আর কেউ এখানে এলে তাদের কাজে লাগ্বে।
স্বামীজী বল্লেন, আমারও তাই মনে নিচ্চে। এ-রকম দুর্গম স্থানে কোথাও কোথাও এমন দেখ্তে পাওয়া যায়।
আমি বল্লাম, কে আমাদের এ-রকম আতিথ্যের ব্যবস্থা ক’রে রেখেচেন, তা ত আমরা জানিনে, উদ্দেশে আমরা তাঁর জয়-জয়কার করচি।
স্বামীজী হেসে বল্লেন, একশোবার। আর প্যারীর মাসীর পাণ্ডাগিরিরও জয়-জয়কার।
প্যারীর মাসী বল্লে, বাবাঠাকুর, এখন ত তামাসা কর্চ, আগে ভাব্ছিলে, কোথায় আমি তোমাদের নিয়ে যাচ্চি, রাত কাটাবার জায়গা পাওয়া যাবে না।
ঘরের পিছনেই একটি ছোট ঝরণা ছিল, খুব মিঠে জল। আমরা মুখ-হাত ধুয়ে খানিক এ-দিক ও-দিক ঘুরে দেখ্লাম। তখনও তেমন অন্ধকার হয় নি, কিন্তু চারিদিকে মেঘ ঘিরে রয়েচে, অল্প বাতাস, পাহাড়ের চূড়ার উপর অন্ধকার ঘনিয়ে আস্চে। আমরা সারাদিন চ’লে এসেছিলাম ব’লে তেমন শীত-বোধ হচ্ছিল না। প্যারীর মাসী হাত পা ধুয়ে এক মুঠা খড় দিয়ে ঘর পরিষ্কার করছিল।
ঘর থেকে খানিক দূরে একটা প্রকাণ্ড পাথরে ঠেসান দিয়ে স্বামীজী দাঁড়ালেন। বল্লেন, প্যারীর মাসীর ভাব-গতিক আজ তোমার কি-রকম মনে হচ্চে?
আমি উত্তর করলাম, আমি ত কিছুই বুঝ্তে পারচিনে। এমন জায়গায় এ-রকম ঘর থাক্তে পারে, এ-কথা সহজে বিশ্বাসই হয় না। প্যারীর মাসী কি রকম ক’রে জানলে যে, এখানে আশ্রয় আছে? আর আহারের সামগ্রী পাওয়া যাবে, তাই বা তার কেমন ক’রে মনে হ’ল?
— সে-কথা যে তার মনে হয়েছিল, তা বোধ হয় না, তবে কিছু একটা প্রেরণায় যে সে এ-পথে এসেচে, তার কোনো সন্দেহ নাই। এদিকে সচরাচর লোক চলে না, নিকটে যে কোথাও কোনো তীর্থস্থান আছে, তাও শুনিনি। অথচ এই স্থানে এমন কিছু আছে, যার স্মৃতি প্যারীর মাসীকে অজ্ঞাতে এখানে আকর্ষণ ক’রে এনেছে। কি তা, আমরা জানিনে, জাগ্রত অবস্থায় প্যারীর মাসীও জানে না। কিন্তু আকর্ষণ যে বলবৎ, তা ত দেখ্তেই পাচ্চ। পথ চল্তে চল্তে প্যারীর মাসী আর এক পথে চল্ল। আমাদের এ-দিকে আস্বার কোনো কথা ছিল না, ইচ্ছেও ছিল না। কে তাকে এ-পথে আস্তে বল্লে, কিসের জন্য এখানে আসা?
—আমরা তা ত কিছুই জানি নে।
— প্যারীর মাসীও জানে না। নিদ্রাবস্থায় তার আর এক চৈতন্য জাগরিত হ’য়ে জান্তে পারবে। এর আগে দু’বার যা দেখা গিয়েছিল, তা’তে ওর কোনো হাত ছিল না। আমাদের পথে যে-স্থান পড়ে, সেস্থানের পূর্ব্ব ঘটনা নিদ্রিতাবস্থায় কোনো অলৌকিক ব’লে ও প্রত্যক্ষ দেখ্তে পায়। ওর মধ্যে দুই সত্তা বিদ্যমান। যখন একটি জাগে, সে সময় অপরটি নিদ্রিত হয়। আজ যা দেখ্লে,সে-ভাব নূতন। সহজ জাগ্রত অবস্থাতেই দ্বিতীয় চৈতন্যের প্রভাব। ওর নিদ্রিতাবস্থায় যে ক্ষমতার বিকাশ আমরা দেখেছি, সেই ক্ষমতাই আজ জাগ্রত অবস্থায় ওকে এখানে নিয়ে এসেছে।
—আপনার মনে কোনো আশঙ্কা হচ্চে?
—চিন্তার কারণ বটে। আশঙ্কা আছে কি না, কেমন ক’রে জান্ব?
—ওকে নিয়ে ফিরে চলুন না কেন?
—কাল যাব। ছুতা করতে হবে, আমার শরীর ভাল নেই।
ফিরে এসে আমরা দেখি, প্যারীর মাসী ঝরণা থেকে চাল-ডাল ধুয়ে এনেচে। আমি আলো জ্বাল্লাম, প্যারীর মাসী উনানে আগুন দিলে।
রাত্রিতে বেশ তৃপ্তি ক’রে আমরা খিচুড়ী খেলাম।
উনানের আগুন না নিভিয়ে আরও দু’চার খানা মোটা মোটা কাঠ দেওয়া গেল। দেওয়ালে ফুকর দিয়ে ধোঁয়া বেরুবার পথ ছিল। ঘর বেশ গরম রইল, রাত্রিতে আলো যেমন জ্বালা থাকে, সেই রকম রইল। দরজায় লোহার শিকল ছিল, শিকল দিয়ে খড়ের উপর আমরা শুয়ে পড়লাম।
আগেকার মত গভীর রাত্রে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। প্যারীর মাসী চোখ চেয়ে রয়েছে, কিন্তু ঘরের ভিতর কিছু দেখ্তে পাচ্ছে না। দৃষ্টি স্থির, যেন দূরে কিছু দেখ্চে। কণ্ঠের স্বর আর এক রকম, যেন অনেক দূর থেকে কথা কইচে। বালানন্দ স্বামীও জেগেচেন। আমরা দু’জনে চুপ ক’রে প্যারীর মাসীর কথা শুন্তে লাগ্লাম।
সে বলছিল, ছায়া! ছায়া! ছায়া! কেবলি ছায়া! কেবলি ছায়ার আনাগোনা। এ কি ছায়ালোক না কি? কোথাও কোনো শব্দ নেই, নিঃশব্দে ছায়া সব ঘুরছে। সব যেন অস্পষ্ট, ছায়ার মত আলো। এত ছায়ার মধ্যে আমি কেন? আমিও কি ছায়া?—
সব যেন আব্ছায়া, আব্ছায়া! কারুর মুখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্চিনে। কারুর মুখে কথা নেই, কেউ কারুর সঙ্গে কোনো কথা কইচে না! আমিও যেমন! ছায়াতে কি কথা কইতে পারে? এখানে কি মানুষ নেই, শুধু ছায়া?
ঐ অনেক দূর থেকে যেন একটা সুড়ঙ্গ দিয়ে আলো আস্চে। অল্প গোলাপী আলো, তেমন পরিষ্কার নয়, তার পর আলো বাড়চে— বাড়চে—বাড়চে—
কৈ, আলোয় ত ছায়া মিলিয়ে গেল না! ছায়ার চারিদিকে আলো খেল্চে, আলোর মধ্যে ছায়ার মুখ! এমন সব মুখ ত কখন দেখিনি। পদ্ম-ফুলের মতন সব ফুটে রয়েচে। চোখের কি শান্ত, স্নিগ্ধ, কোমল দৃষ্টি!
ওকে ডাক্চে? ও মা, আমার নাম ধরে ডাক্চে! কমলা! আমার ও নাম ত কেউ জানে না, সবাই ভুলে গিয়েচে। এখানে আমাকে নাম ধ’রে কে ডাকে? কে গা, আমাকে ডাক্চে? এই যে আমি এসেচি। এ, কে এল? জ্যোতির জ্যোতি! সত্য সুন্দর মঙ্গল মূর্ত্তি!—
প্যারীর মাসী তাড়াতাড়ি উঠে ব’সে গলবস্ত্র হ’য়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলে। বালানন্দ স্বামী আমার মুখের দিকে চাইলেন। আমরা দু’জনেই বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছিলাম।
প্রণাম ক’রে প্যারীর মাসী বল্লে, ঠাকুর, আমাকে ডাক্চ? এই যে আমি এসেছি। ঐ ডাক শোন্বার জন্য আমি যে কত দিন ধ’রে কাণ পেতে আছি।
কোন্ দিকে যেতে হবে? ঐ যেখান দিয়ে আলো আস্চে? এই সব জ্যোতির্ম্ময় ছায়ার ভিতর দিয়ে? ছায়ার সাথে মিশে আমিও ছায়া হ’য়ে যাব?
প্যারীর মাসী আবার শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। স্বামীজী আমার দিকে চেয়ে অনেকক্ষণ কি ভাব্তে লাগ্লেন, তার পর পাশ ফিরে নিদ্রিত হ’লেন। আমার চক্ষে অনেকক্ষণ ঘুম এল না। কত কি ভাব্তে লাগ্লাম। শেষে ঘুমিয়ে পড়লাম।
শীতের জন্যই হোক, কিংবা রাত্রে ঘুম ভেঙ্গে গিয়ে অনেকক্ষণ ঘুম হয়নি ব’লেই হোক, আমাদের ঘুম ভাঙ্গতে একটু দেরী হ’ল। তাড়াতাড়ি উঠে দেখি, ঘরের ফুটো দিয়ে প্রভাত-সূর্য্যের আভা আস্চে।
বালানন্দ স্বামী উঠেই বল্লেন, প্যারীর মাসী কোথায় গেল?
প্যারীর মাসী ঘরে নেই দেখে আমি বল্লাম, হয় ত মুখ-হাত ধুতে গিয়েছে। আমাদের উঠ্তে দেরী হয়েচে
—তাই হবে, ব’লে স্বামীজী ভেজান দরজা খুলে ঘরের বাইরে এলেন। আমি তাঁর পিছনে।
বারান্দার এক দিকে একটা থামে বাঁ হাত জড়িয়ে ব’সে প্যারীর মাসী। তাকে কিছু না ব’লে আমরা বিস্ময়-বিস্ফারিত নেত্রে নিসর্গের অদৃষ্টপূর্ব্ব বিচিত্র শোভা দেখ্তে লাগ্লাম।
আকাশ নির্ম্মল, স্বচ্ছ, গভীর নীল। সূর্য্য সবেমাত্র উদয় হয়েচে, বৃহৎ লোহিত চক্র উপত্যকায় সংলগ্ন হ’য়ে রয়েচে। আকাশব্যাপী, শৃঙ্গকণ্ঠলম্বিত কৃষ্ণ অভ্ররাজি জ’মে শুভ্র তুষার হ’য়ে চারিদিক আচ্ছন্ন করেচে। গাছের মাথায়, পাহাড়ের গায়ে, পথে, সর্ব্বত্র শ্বেত আবরণ। তুষার-মণ্ডিত গিরিশৃঙ্গ ও তরুশীর্ষে সূর্য্য-কিরণ বিচ্ছুরিত হচ্চে।
প্যারীর মাসী স্তব্ধ হ’য়ে ব’সে আছে দেখে স্বামীজী ডাক্লেন, প্যারীর মাসী!
কোনো সাড়া নেই।
শশব্যস্তে আমরা গিয়ে দেখ্লাম, প্যারীর মাসী পূর্ব্বমুখী হ’য়ে ব’সে আছে। দেহ নিস্পন্দ, স্থির, কিছুক্ষণ পূর্ব্বে মৃত্যু হয়েছে। মুখে অপূর্ব্ব আনন্দ-জ্যোতি!
বালানন্দ স্বামী ঊর্দ্ধমুখ, উর্দ্ধবাহু হ’য়ে গভীর স্বরে বৈদিক ছন্দে আবৃত্তি করলেন —
তমসো মা জ্যোতির্গময় মৃত্যোমামৃতগময়।
- ↑ মুণ্ডিত শির, মুণ্ডিত মুখ, চিত্ত মুণ্ডিত না হইলে কি মুণ্ডিত হইল?—মৃচ্ছকটিক।