রথযাত্রা ও অন্যান্য গল্প/রথযাত্রা
রথযাত্রা
ও
অন্যান্য গল্প
রথযাত্রা
একটি ছোট ঘর। দেয়ালে কয়েকখানা অল্প দামের ছবি। একখানি ছবি ধ্রুবের, বনে বালক তপস্যা করিতেছে। আর একখানা নৃসিংহ মূর্ত্তির, স্তম্ভ ভেদ করিয়া নরসিংহ বাহির হইতেছেন, গদাহস্তে ভ্রূকুটি-কুটিল নয়ন, ভীমদর্শন হিরণ্যকশিপু, বদ্ধাঞ্জলি অবনতমস্তক বালক প্রহ্লাদ। অপর ছবিতে ভীষ্ম শরশয্যায় শয়ন করিয়া আছেন, অর্জ্জুন গাণ্ডীবে শরসংযোগ করিয়া পিতামহের পিপাসানিবৃত্তি করিবার জন্য পাতাল ভেদ করিবার উদ্যোগ করিতেছেন। অন্য ছবিতে রাম, লক্ষ্মণ ও সীতা বল্কল ধারণ করিয়া বনে যাইতেছেন, পুরবাসিগণ রোদন করিতেছে। একখানি জলচৌকির উপর কতক গুলি ঔষধের শিশি, তাহার পাশে বেদানা ও কমলা লেবু। কুলুঙ্গীতে একটি ঘড়ি টিক্ টিক করিতেছে। ঘরের মাঝখানে তক্তপোষে বিছানা পাতা, তাহার উপরে শয়ন করিয়া তের বৎসরের বালিকা অমৃতা। অমৃতা সুন্দরী, কিন্তু এখন শীর্ণ, রোগক্লিষ্ট মূর্ত্তি, মুখখানি ম্রিয়মাণ পদ্মের মত, চুল আলুথালু, কপালের উপর পড়িয়াছে, চক্ষু বসিয়া গেলেও উজ্জ্বল, হাতের শিরা দেখা যাইতেছে। শিয়রে বসিয়া অমৃতার দিদিমা, কপালে হাত বুলাইয়া দিতেছেন, চুল সরাইয়া মাথার পিছনে গুছাইয়া দিতেছেন। ঘরের মেঝেতে বসিয়া অমৃতার মা, তাঁহার পাশে তাঁহার ছোট জা।
অমৃতার পিতা আপিসের পোষাক পরিয়া ঘরে প্রবেশ করিলেন। তাঁহাকে দেখিয়া তাঁহার ভাদ্রবধু ঘোমটা টানিয়া দিলেন। অমৃতার দিদিমা শয্যা হইতে উঠিয়া পাশে দাঁড়াইলেন। যেখানে তিনি বসিয়াছিলেন, অমৃতার পিতা সেইখানে উপবেশন করিলেন। অমৃতা নিজের হাত তাঁহার হাতের উপর রাখিল। তিনি এক হাতে তাহার হাত ধরিয়া আর এক হাত তাহার মাথায় দিলেন।
অমৃতা। বাবা, তুমি বেরুচ্ছ?
বাবা। হাঁ মা। যদি পারি ত সকাল সকাল ফিরে আসব। তুমি এখন কেমন আছ?
অমৃতা। এখন ভাল আছি। তোমার সকাল সকাল আসবার কি দরকার? (ঘড়ির দিকে চাহিয়া) দশটা বাজে, তুমি যাও, নইলে তোমার দেরী হবে।
বাবা। এই যে যাই।
তিনি উঠিয়া চলিয়া গেলেন। ভাদ্রবধূ ঘোমটা খুলিলেন। দিদিমা আবার অমৃতার শিয়রে বসিলেন।
দিদিমা। অমী, এখন তোমার কোন কষ্ট নেই?
অমৃতা। না, দিদিমা। আগে আমার গাঁটে গাঁটে যেন এঁটে বেঁধেছিল, ব্যথায় যেন ফেটে যাচ্ছিল। এখন যেন বাঁধন একে একে খুলে দিচ্চে, আর কোন যন্ত্রণা নেই।
অমৃতার মা ও দিদিমা পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিলেন। অমৃতার মা’র চক্ষু জলে ভরিয়া আসিল, তিনি তাড়াতাড়ি উঠিয়া বাহিরে গেলেন।
দিদিমা। ছোটমেয়ে, তুমি, একবার অমীর কাছে বস্বে? আমি ঠাকুরঘরের শিকলটা দিয়ে আসি।
অমৃতার খুড়ীমা। হাঁ মা, আমি ত বসে’ রয়েচি।
দিদিমা উঠিয়া গেলেন। খুড়ীমা উঠিয়া আসিয়া অমৃতার মাথার কাছে বসিতে যাইতেছেন—
অমৃতা। তুমি ওখানে বসো না, খুড়ীমা, আমার কাছে এস, তোমাকে দেখি।
খুড়ীমা নিকটে আসিতেই অমৃতা তাঁহাকে জড়াইয়া ধরিল।
অমৃতা। (খুড়ীমার মুখের কাছে মুখ রাখিয়া) তোমার সঙ্গে আমার সব মনের কথা, কেমন?
খুড়ীমা। তুমি যে আমাকে বড় ভালবাস।
অমৃতা। অনেক দিন থেকে। সেই যে তুমি যখন ছোট্ট বউটি এসেছিলে তখন থেকে।
খুড়ীমা। সে কথা বুঝি তোমার মনে আছে? এত অসুখেও কি তোমার তামাসা আসে?
অমৃতা। কেন আসবে না? সবই তামাসা, সুখও তামাসা, অসুখও তামাসা।
অমৃতার মা বাটিতে দুধবার্লি লইয়া আসিলেন।
মা। অমী, এই দুধটুকু খাও। ওষুধ ত খানিক আগে খেয়েচ। ছোটবউ, দুটি বেদানা ছাড়িয়ে দাও ত।
খুড়ীমা একখানি রেকাবিতে বেদানা ছাড়াইয়া আনিলেন। অমৃতা দুধ খাইয়া বেদানা মুখে দিল। অমৃতার সমবয়সী দুটি মেয়ে, মঞ্জুলা ও শেফালিকা দরজার গোড়ায় আসিয়া দাঁড়াইল।
মা। তোমরা দাঁড়িয়ে রইলে কেন? এস, ঘরের ভিতর এস।
অমৃতা। মঞ্জুলা আর শেফালি, তোরা যে বড় এমন সময়? স্কুলে যেতে হবে না?
কন্যা দুইটি তক্তপোষের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল।
মঞ্জুলা। আজ যে রথের ছুটি।
অমৃতা। তাও ত বটে। আমার এই অসুখ হয়ে সব কথা ভুলে যাই। হাঁ মা, ছোটবেলায় দোরগোড়া থেকে আমি কেমন ভেঁপু কিনে আনতাম!
মা। এখন বুঝি আর ছোট নেই? মস্ত গিন্নী হয়েছিস, না?
অমৃতা। তা বলে’ এখন আর ভেঁপু বাজাবার বয়স আমার নেই। (পথে ভেঁপুর শব্দ) ঐ শোন।
মা। আজ রথের দিন, ছেলেমেয়েরা ত ভেঁপু বাজাবেই।
অমৃতা। মা, খুড়ীমাকে একটা ভেঁপু কিনে দাও না।
খুড়ীমা। শুনলে দিদি, মেয়ের কথা? আমার সঙ্গে কেবল তামাসা। এখনি বলছিল, আমি যখন বিয়ের ক’নে এ বাড়ীতে আসি, সে-কথা ওর মনে আছে।
মা। তোমাকে সমবয়সী মনে করে’ তোমাকে ক্ষেপায়।
খুড়ীমা। আমি ক্ষেপতে গেলাম কেন? ও যা বলে তাই আমার মিষ্টি লাগে।
শেফালিকা কোঁচড়ের ভিতর হইতে কতকগুলা কদম ফুল বাহির করিয়া অমৃতার হাতের কাছে রাখিল। দিদিমা ঘরে প্রবেশ করিলেন।
অমৃতা। বাঃ, কি সুন্দর কদম ফুল! (একটা হাতে তুলিয়া) কি চমৎকার গন্ধ! ফুলের শুঁয়ো দেখেচ? যেন আহ্লাদে শিউরে রয়েচে! তা, শেফালি, তুই যে বড় কদম ফুল এনেছিস্? তোর ত শিউলি ফুল আনতে হয়!
সকলের হাস্য।
দিদিমা। বিছানায় শুয়ে না থাকলে কে বলবে মেয়ের অসুখ করেছে? ওর মতন মজার কথা আমাদেরও মুখে আসে না।
খুড়ীমা। এইবার ভাল হয়ে উঠ্বে।
মা। বাছা সেরে উঠলে আমি পাঁচ টাকার পূজো দেব। অসুখ হতেই মানত রেখেচি।
অমৃতা। হাঁ, অসুখের গেরোগুলো খুলে যাচ্ছে। আর আমাকে বেঁধে রাখতে পারবে না। সকলে নীরব। মঞ্জুলা ও শেফালিকা খুড়ীমার মুখের দিকে চাহিতে লাগিল।
অমৃতা। আচ্ছা দিদিমা, সোজা রথ আর উল্টো রথ কেন বলে?
দিদিমা। জগন্নাথের চানযাত্রা কি না। যাবার সময় সোজা রথ, ফিরে আসবার সময় উল্টো রথ।
অমৃতা। রথের ঘোড়া কি হ’ল?
দিদিমা। সেকালে ঘোড়ায় টানত, এখন মানুষে টানে।
অমৃতা। সেকালে রথে চেপে যুদ্ধ করতে যেত। মেয়েদের কি রথে উঠতে নেই? তা হ’লে সুভদ্রা দুই ভাইয়ের মাঝখানে রথে ওঠেন কেন?
দিদিমা। ঠাকুরদের সঙ্গে মানুষের কথা! দেবতার রথে কি মানুষের উঠতে আছে?
অমৃতা। মানুষদেরও রথ ছিল। আমার রথে উঠতে ইচ্ছে করে। মঞ্জুলা আর শেফালি রথে উঠবি?
মঞ্জুলা আর শেফালির ফিক ফিক করিয়া হাসি।
শেফালিকা। রথে উঠে কি হবে? ঘড়র ঘড়র করে’ টেনে নিয়ে যায়, ছুটে যেতে পারে না। তার চেয়ে মটর গাড়ী ভাল, দেখতে দেখতে কত দূর চলে যায়।
অমৃতা। (কদম ফুল হাতে করিয়া নিজের মনে) কদমতলায় শ্যামের বাঁশী কেমন করে’ বাজত? যমুনার জল স্থির হয়ে থাকত, গাছে পাখী চুপ করে’ শুনত। বাঁশী শুনে কদম ফুলের গায় কাঁটা দিয়েছিল, তাই এ-সব শুঁয়ো বেরিয়েচে।
দিদিমা। অবাক্! যে-সব কথা তোর মনে আসে আমরা এত বুড়ো হয়েচি আমরা সে-সব ভাবতে পারিনে।
অমৃতা। (দিদিমার কথা শুনিতে না পাইয়া) ত্রিভঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে কেষ্টোঠাকুর বাঁশী বাজাতেন। ঠাকুর ত চিরকাল থাকেন তবে এখন কেন বাঁশী বাজে না? না, এখন আর কেউ তেমন কান পেতে শোনে না, তাই শোনা যায় না? আচ্ছা দিদিমা, আষাঢ় মাসে চানযাত্রা আর শ্রাবণ মাসে ত ঝুলনযাত্রা?
দিদিমা। হাঁ ভাই।
অমৃতা। রাধাকেষ্ট দোলায় ত একসঙ্গে দোলেন, কিন্তু রাধা কইত রথে ওঠেন না। সুভদ্রা যে কেষ্টঠাকুরের বোন বৃন্দাবনে কেউ ত সে-কথা জানত না। তা সেখানে রথই বা কোথা থেকে আসবে? রাখালের কি রথ থাকে?
মা। এই একরত্তি মেয়ে এত কথা জানে! ছেলেবেলা থেকে ঠাকুরদেবতাদের সব কথা পড়ে।
দিদিমা। তাই ও-সব কথা ওর মনে পড়চে।
অমৃতা। মঞ্জুলা, আমি যখন রথে উঠব তোরা তখন দেখিস্। হয় ত তোরা দেখতেই পাবি নে।
মঞ্জুলা। তুই কি সুভদ্রা হবি?
অমৃতা। তা কেন? আমার জন্য অন্য রথ আসবে। তোরা ভেঁপু বাজাবি আর আমার রথ গড়গড়িয়ে চলে’ যাবে।
শেফালিকা। তোর রথের কাছি ধরে’ আমরা টানব।
অমৃতা। আমার রথ ঘোড়াতে টানবে,—পক্ষীরাজ ঘোড়া।
মঞ্জুলা। তা হ’লে ত রথ উড়ে যাবে। এরোপ্লেনের মতন।
মা। তোরা মেয়ে-দুটো বড়্ বড়্ করচিস, তোদের খাওয়া হয়েচে?
মঞ্জুলা। না মাসীমা, আজ ছুটি কি না, তাই তেমন তাড়া নেই।
মা। অনেক বেলা হয়েচে, তোমরা খেতে যাও। বিকেল বেলা না হয় এস।
(মঞ্জুলা ও শেফালিকার প্রস্থান।)
মা। অমী, তুমি রোগা মেয়ে এখন একটু ঘুমোও। কেবল কথা কইলে কাহিল বোধ হবে।
অমৃতা। আচ্ছা মা।
অমৃতা পাশ ফিরিয়া দেয়ালের দিকে মুখ করিয়া চক্ষু বুজিল।
দিদিমা। তোমরা দুই জায়ে খেয়ে এস, আমি ততক্ষণ বসে আছি।
মা। আমরা দু-গরস মুখে দিয়ে এখনি আসচি। অমী একটু ঘুমোক।
দুই জা চলিয়া গেলেন। দিদিমা তক্তপোষের নীচে মেঝেতে বসিয়া রহিলেন। কিছু পরে অমৃতার খুড়ীমা ফিরিয়া আসিলেন।
খুড়ীমা। (দিদিমার কানে কানে) মা, এইবার তুমি যাও। দিদিরও হয়েছে, তিনি আসচেন।
দিদিমা নিঃশব্দে উঠিয়া গেলেন। অমৃতার মা পা টিপিয়া টিপিয়া ঠোঁটে আঙুল দিয়া, ঘরে প্রবেশ করিয়া ছোট জায়ের পাশে বসিলেন।
মা। (ছোট বউয়ের কানে কানে) বেশ ঘুমিয়ে আছে।
অমৃতা। (ধীরে ধীরে পাশ ফিরিয়া ফিক করিয়া হাসিয়া) হাঁ, মা, আমি ঘুমিয়ে আছি। তুমি যে আমাকে ঘুমুতে বলেছিলে।
মা। ঘুম বুঝি হয় নি, শুধু চোখ মট্কে ছিলি?
অমৃতা। না মা, ঘুম কি আর বললেই আসে? তন্দ্রা বুঝি এসেছিল, তন্দ্রার দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। জান ত মা, সে আর একটা দেশ আছে। সে এক মজার ওলট-পালটের দেশ, কোথায় যে কি হচ্চে তার কোন ঠিকঠিকানাই নেই! এই দেখ রাজকন্যার সাম্নে ময়ূর নাচচে, আবার কোথাও কিছু নেই পথের ধারে বসে’ ভিখারীর মেয়ে কাঁদচে। বাঘ সিঙ্গী যেন কুকুর-বেরালের মতন বেড়াচ্চে। কেবল যেন ভেল্কিবাজী, একটা চোখের সামনে আসে আর একটা মিলিয়ে যায়।
মা। তুমি বুঝি স্বপন দেখছিলে? রোগা হ’লে ও-রকম হয়।
অমৃতা। স্বপন! তা হবে। স্বপনটাই যেন সত্যি আর সব মিথ্যে। তোমদের ঘর-সংসারকে ত তোমরা স্বপন বল না, কিন্তু এ সব কি মিথ্যে নয়?
মা। অত সব বড় বড় কথা তুমি কোথায় শিখলে? ও-সব আমরাই বুঝতে পারি নে।
অমৃতা। মা গো, আমাদের সবাইয়ের চোখে যে ঠুলি বাঁধা। তিনি দয়া করে’ যদি খুলে দেন। তাঁর ত ছোট-বড় নেই, বয়সের কোন হিসেব নেই। ধ্রুব-প্রহ্লাদের কত বয়স হয়েছিল? বয়স যে কখন্ ফুরোয়—
দিদিমা আর তাঁর সঙ্গে আর একটি বৃদ্ধা রমণী আসিলেন। অমৃতার কথা বন্ধ হইল। অমৃতার মা ও খুড়ীমা উঠিয়া বৃদ্ধার পায়ে হাত দিয়া নমস্কার করিলেন।
মা। রাঙাদিদি, তুমি কবে এলে? কত তীথ্থি ঘুরে এলে!
রাঙাদিদি। আর মা, কপালে যা ছিল। দ্বারিকায় গিয়েছিলাম। সেখান থেকে পেরভাস। দ্বারিকায় গেলেই পেরভাসে যেতে হয়। পেরভাসে মিলন হয়েছিল কি না। কেষ্টো আর অর্জ্জুন যে নরনারায়ণ ছিলেন।
দিদিমা। (কপালে যুক্তকর স্পর্শ করিয়া) নরনারায়ণকে নমস্কার। তুমি কত দেখে এলে, তোমাকে দেখলেও পুণ্যি হয়।
রাঙাদিদি। ওসব বাড়াবাড়ি কথা। অমীর বড় অসুখ শুনে তাড়াতাড়ি দেখতে এলুম।
মা। বাছা আমার কুড়ি দিন ধরে’ ভুগছে, আজ একুশ দিন। আজ একটু হালুচালু হয়েছে।
রাঙাদিদি। অমীকে আমার মনে আছে ঠিক যেন মোমের পুতুলের মতনটি ছিল। এখন মেয়ে বিছানার সঙ্গে মিশে গিয়েচে, যেন পাতখানি।
অমৃতা। (অস্ফুট স্বরে গুন গুন করিয়া) মাটিকে দেহিয়া মট্টীমে মিল যানা—তাদেলমান! তাদেলমান!
রাঙাদিদি। অমী গুন গুন ক’রে কি গান করচে?
অমৃতা। ও কিছু নয়, ফকীরদের একটা কথা। হাঁ, রাঙাদিদি, দ্বারিকায় কেষ্টোঠাকুর রাজা ছিলেন, সেখানে তাঁর রথ দেখলে?
রাঙাদিদি। রথ?
মা। আজ রথ কি না, তাই কেবল রথের কথা কইচে। মঞ্জুলা আর শেফালি এসেছিল, তারা কতকগুলো কদম ফুল দিয়ে গিয়েচে। কদম ফুল দেখে অমী বৃন্দাবনের কত কথা বল্ছিল।
রাঙাদিদি। বৃন্দাবনে ক’টাই বা কদম গাছ! আমি ত খুঁজে খুঁজে দেখতেই পাইনে।
অমৃতা। নাইক সে বৃন্দাবন, নাইক সে মদনমোহন! রাঙাদিদি, দ্বারিকায় রথ দেখলে, না শুধু কলা বেচাই সার?
রাঙাদিদি। শোন কথার বাঁধুনি! এখন ত মেয়েরাও বক্তিমে করে, কিন্তু অমীর মুখের কাছে কেউ দাঁড়াতে পারবে না। না ভাই, রথ থাকলেও থাকতে পারে কিন্তু আমরা কই ত দেখি নি।
পথে কোলাহল। রথ টানিয়া লইয়া যাইতেছে। রথচক্রের ঘর্ঘর শব্দ। রাঙাদিদি ও দিদি-মা একবার বাহিরে গিয়া রথ দেখিয়া আবার ফিরিয়া আসিলেন। জনতা ও রথের শব্দ দূরে চলিয়া গেল।
অমৃতা। (নিজের মনে মৃদুস্বরে) ঠাকুর যখন বিশ্বম্ভর মূর্ত্তি ধরেন তখন আর রথ নড়ে না, হাজার লোক মিলেও রথ টানতে পারে না। আর জগন্নাথের রথ চাকার তলায় মানুষকে পিষে দিয়ে চলেচে, চাকার সুমুখে যে পড়ে তার আর রক্ষে নেই। সুয্যির রথ চলে আকাশ দিয়ে, রং বেরংগের ঘোড়া, ঘোড়ার পায়ের তলা দিয়ে আলোর ফিন্কি ওঠে, আগুনের ধুলো ওড়ে। আলোতে রথ ঢাকা পড়ে।
রাঙাদিদি। (অমৃতার মার মুখের দিকে চাহিয়া) বিব্ভুল বক্চে?
মা। বালাই, বিব্ভুল কেন বকতে যাবে? ওর কথা শুনলে অবাক্ হ’তে হয়। কত সব জ্ঞানের কথা বলে।
রাঙাদিদি। তাই ত, আমি ভেবেছিলাম শুধু বুঝি তামাসাই করে, তা আমি ত সম্পর্কে ওর ঠানদিদি হই। ঐটুকু মেয়ে, গলা টিপলে এখনো দুধ বেরোয়, এমন সব কথা শিখ্লে কোত্থেকে?
অমৃতা। কলিকাল, কলিকাল! জান না, রাঙাদিদি? কলিকালে সবই অনাছিষ্টি।
রাঙাদিদি। না, না, তা কেন? তোমার ও-সব কথা সত্যি যুগের মতন।
অমৃতা। দিদিমা, শুনলে ত, আমি সত্যিযুগের মেয়ে পথ ভুলে কলিকালে এসে পড়েছি।
দিদিমা। মা, মা, মা! এত কথাও তোর আসে!
অমৃতা। (স্মিতমুখে) ছুটোছুটি করবার এখন ত আর সাধ্যি নেই, মুখখানাই নাড়াচাড়া করি।
রাঙাদিদি। এখন তবে আসি। বউ-মা কাল বাপের বাড়ী গিয়েছে, উল্টো রথের পরে আসবে। সংসারের সব কাজ আমাকেই কর্তে হচ্চে। অমী শীগ্গির শীগ্গির সেরে উঠুক এই আশীর্ব্বাদ করচি।
মা। তোমাদের আশীর্ব্বাদে মেয়ে আমার যেন ভাল হয়ে ওঠে।
রাঙাদিদি। তা হবে বই কি! তুমি ভেব না মা, আজ ত অমীকে ভালই দেখাচ্চে। তাঁকে ডাক, তিনি ভাল করে’ দেবেন।
অমৃতা। তখন রথে উঠব।
রাঙাদিদি চলিয়া গেলেন। তাঁহার সঙ্গে কথা কহিতে কহিতে দিদিমাও ঘরের বাহিরে গেলেন। অমৃতা চক্ষু মুদ্রিত করিয়া চুপ করিয়া রহিল।
মা। দেখতে দেখতে বেলা গেল। একটু পরেই ডাক্তার আসবে। ছুটির দিন বলে’ ছেলেরা কে কোথায় বেরিয়ে গিয়েচে, এখনি এসে খাবারের জন্য পাগল করে তুলবে। যাই, ঝিকে বাজারে পাঠিয়ে দিয়ে আসি।
খুড়ীমা। আমি ত রয়েচি দিদি, তুমি কাজ সেরে এস।
মা উঠিয়া গেলেন।
অমৃতা। খুডীমা, একটু খাবার জল দাও ত।
খুড়ীমা। (তাড়াতাড়ি উঠিয়া) একটা কমলালেবু ছাড়িয়ে দেব?
অমৃতা। এখন নয়, শুধু একটু জল দাও। (জলপান করিয়া) খুড়ীমা, আমার বুকে একবার হাত দাও ত।
খুড়ীমা। (বুকে হাত দিয়া) এ কি, তোমার বুক অমন ধড়াস্ ধড়াস্ করচে কেন? নিঃশ্বাস ফেলতে কি কষ্ট হচ্চে? যাই, দিদিকে ডেকে নিয়ে আসি।
অমৃতা। (খুড়ীমার হাত চাপিয়া ধরিয়া) তোমার কাউকে ডাকতে হবে না। চুপ করে’ বসো আমার কাছে। বনের পাখীকে খাঁচার ভিতর পূরলে কি রকম ছট্ফট্ করে দেখেচ? খাঁচার শিকে পাখা-ঝাপটা মারে, কেবল এদিক-ওদিক ঘোরে। খাঁচা খুলে দিলে উড়ে যায়, আর ধড়ফড় করে না। আমার বুকের পাঁজরাগুলো লোহার গরাদে, তার ভিতর থেকে পাখী বেরুবার জন্য ও-রকম করচে।
খুড়ীমা। ও-সব কি কথা! অমন কথা বলতে নেই।
অমৃতা। শুধু তোমাকে বলচি। রথে উঠলেই আমার সব সেরে যাবে।
(মা ও দিদিমার প্রবেশ।)
খুড়ীমা। অমী অমন করচে কেন? অসুখ বাড়েনি ত?
মা। (অমৃতার কাছে আসিয়া) কি হয়েচে মা? অসুখ করচে? কোন কষ্ট হচ্ছে?
অমৃতা। একটু যেন কি রকম বোধ হচ্ছে। আমি কি ভাবচি জান? এই যে সোজা রথে যাব, উল্টো রথে আর আস্ব না।
মা। ও কি রকম কথা! রথের কথা বলতে নেই। এখুনি ডাক্তারবাবু আসবেন, তিনি ওষুধ দিলেই সেরে যাবে।
অমৃতা। আমার কষ্ট কিছু ত হয় নি। তা বেশ ত, ডাক্তার বাবু আসুন।
একজন বৃদ্ধ ব্যক্তির প্রবেশ। ইনি অমৃতার মাতার মামা। তাঁহার পিছনে মঞ্জুলা ও শেফালিকা!
বৃদ্ধ। আজ পথে বড় ভিড়, আমার আসতে একটু দেরী হয়ে গেল।
মা। মামা, তুমি ত কবিরাজ, একবার অমীকে দেখ ত। মেয়ে যেন কি রকম করচে।
অমৃতা। দাদাবাবু এয়েচ? মঞ্জুলা শেফালি তোরাও এসেচিস?
বৃদ্ধ অমৃতার নাড়ী দেখিলেন। এমন সময় অমৃতার পিতা আপিসের পোষাকে আসিলেন। অমৃতার মুখ দেখিয়া, ঘরে আর সকলের মুখ দেখিয়া তাঁহার মুখ শুকাইয়া গেল। বৃদ্ধ অনেকক্ষণ নাড়ী দেখিলেন। তিনি নাড়ী দেখিতেছেন এমন সময় ডাক্তারবাবুও আসিলেন।
বৃদ্ধ। (অমৃতার হাত ছাড়িয়া দিয়া) ডাক্তারবাবু, আপনি দেখুন।
ডাক্তারবাবু। আপনি কেমন দেখলেন?
বৃদ্ধ। বলচি। আপনি আগে দেখুন।
ডাক্তার অমৃতার হাত দেখিলেন।
অমৃতা। (একবার হাঁপাইয়া, অল্প হাসিয়া ক্ষীণ স্বরে) ডাক্তারবাবু, কেমন দেখচেন? দাদাবাবু, আমার জন্য রথ আসচে, জান?
বৃদ্ধ। ও কি বলচে?
দিদিমা। আজ রথ কি না, সারাদিন বলচে রথে উঠবে।
ডাক্তার ও বৃদ্ধ ঘরের বাহিরে আসিলেন। অমৃতার পিতা বজ্রাহতের ন্যায় স্তব্ধ হইয়া অমৃতার পাশে দাঁড়াইলেন। মাতা অশ্রুসিক্তনয়নে অমৃতার হাত নিজের হাতে তুলিয়া লইলেন। খুড়ীমা মাথায় ঘোমটা দিতে ভুলিয়া গিয়া অন্য পাশে দাঁড়াইলেন। দিদিমা কাছে দাঁড়াইয়া। মঞ্জুলা ও শেফালিকা অমৃতার পায়ের কাছে দাঁড়াইয়া তাহার মুখ দেখিতেছে।
ঘরের বাহিরে ডাক্তার ও বৃদ্ধ দাঁড়াইয়া মৃদুস্বরে কথা কহিতেছেন।
ডাক্তার। নাড়ী নেই!
বৃদ্ধ। তেমন বিশেষ শ্বাসেরও লক্ষণ নেই। খুব অল্পক্ষণ মেয়াদ। মকরধ্বজ আর মৃগনাভি দিয়ে দেখা যাক্।
ডাক্তার। তাই দেখুন।
দু’জনে আবার ঘরে আসিলেন। বৃদ্ধ খলে মকরধ্বজ ও মৃগনাভি মাড়িয়া অমৃতাকে সেবন করাইতে গেলেন। অমৃতা মাথা নাড়িয়া নিষেধ করিল।
অমৃতা। ও-সব আর কিছু না। দেখচ না সব বাঁধন খুলে গিয়েচে? শুধু রথ আসতে বাকি। দেখ—বাবা, এঁদের বেশী কাঁদতে দিও না, কান্নার সুর আমার সঙ্গে সঙ্গে যাবে।
মা। ও মা, আমায় কিছু বলবি নে?
অমৃতা। মা আসি। এর পর আবার সব—কথা হবে। খুড়ীমা, দিদিমা, দাদাবাবু, সরাই পায়ের ধূলো দাও। হাঁ মা, এত অন্ধকার কেন? ওই আলো—আলো—আলো! রথের চাকায় আলো! কে গা তুমি রথে বসে? ঠাকুর, তুমি? এই যে যাই!
অমৃতার একটি ছোট নিঃশ্বাস পড়িল, তাহার পর স্তব্ধ। চক্ষু স্থির, সর্ব্বাঙ্গ স্থির।
বাবা। হা ভগবান, তোমার মনে এই ছিল!
বৃদ্ধ। স্বর্গ থেকে রথ নেমে এসেছিল তাইত উঠে—
মা। অমৃতা! অমৃতা! মা! দেবী! দেবী!