রথযাত্রা ও অন্যান্য গল্প/পদ্ম পিসীমা
পদ্ম পিসীমা
—১—
কুমুদিনী বল্লেন,—আজ পিসীমা আস্বেন।
কুমুদিনী বিশ্বনাথ রায়ের স্ত্রী। বিশ্বনাথ একটা আফিসের বড়বাবু। কুমুদিনীর বয়স বছর পঁয়ত্রিশ হবে, রং গড়ন মাঝামাঝি, মুখখানি হাসি-হাসি, শরীর গোলগাল, ধরণ-ধারণ বেশ গিন্নীবাল্লীর মতন। তাঁর কাছে পাড়ার রাম মিত্রের স্ত্রী বসেছিলেন। বয়স কুমুদিনীর চেয়ে কিছু কম। নাম হেমলতা।
হেমলতা বল্লেন,—কে? পদ্ম পিসী?
—আমাদের আর ত কোন পিসী নেই। উনি ছয় মাসে বছরে একবার করে’ আসেন।
পদ্ম পিসীর কথা হ’তে লাগ্ল। তিনি রাণাঘাটের কাছে একটি গ্রামে থাকেন। বিধবা, ছেলেপুলে নেই, স্বামী কিছু টাকাকড়ি রেখে গিয়েছেন, তাইতে তাঁর চলে, কারুর কাছে হাত পাত্তে হয় না, বরং পূজার সময় ভাইঝিকে, তাঁর ছেলেমেয়েকে কাপড়-চোপড় কিনে দেন। রয়স তেমন বেশী নয়, এখনো পঞ্চাশ পার হয় নি। খুব যে বেশী সেকেলে, তাও নয়, পড়াশুনা বেশ আছে, বেশ আমোদে আহ্লাদে আর কথার ভারি চটক।!
হেমলতা বল্লেন,—পিসীমা মানুষ বেশ, কিন্তু কার সাধ্য তাঁর মুখের কাছে দাঁড়ায়!
—কিন্তু মনে কিছু নেই, একেবারে গঙ্গাজল। শুন্তে পাই, ছেলেবেলা থেকে নাকি ওঁর খুব মুখের ধার। এদিকে দয়ামায়া কেমন, তা ত তুমি দেখেছ?
—সে-কথা আর বল্তে। অমন আর একটি মানুষ মেলা ভার। এখন উঠি ভাই, তিনি এলে আবার আসব।
হেমলতা বাড়ী গেলেন। পিসীমা বিকেলবেলা এলেন। তাঁর জন্য বাড়ীর গাড়ী পাঠান হয়েছিল, বাড়ীর এক ছেলে তাঁকে আন্তে গিয়েছিল। তিনি বাড়ীতে ঢুক্তেই চার দিক্ দিয়ে তাঁকে নমস্কার কর্বার ধূম প’ড়ে গেল। কুমুদিনী দরজাগোড়ায় দাঁড়িয়েছিলেন, পিসীমা আস্তেই পায়ে হাত দিয়ে নমস্কার করলেন। পিসীমা তাঁর খুঁতি ধ’রে নিজের হ’তে চুমো খেলেন। বল্লেন,—কুমি, ভাল আছিস্ ত? কত দিন তোদের দেখি নি।
পিসীমা বারান্দায় উঠ্তে তাঁকে প্রণাম করবার জন্য কাড়া-কাড়ি প’ড়ে গেল। কুমুদিনীর দুই ছেলে, দুই মেয়ে, বড় মেয়ের বয়স উনিশ বছর, শ্বশুরবাড়ী থেকে সম্প্রতি এসেছে। তার পর ছেলে সতের বছরের, কলেজে পড়ে। তার পর আর একটি চোদ্দ বছরের ছেলে, ছোট মেয়েটি এগার বছরের। আবার গুটিকতক ভাসুরপো-ভাসুরঝিও আছে। মা ষষ্ঠীর কল্যাণে বাড়ীতে ছেলেমেয়ের অভাব নেই। তারা যদি ছাড়্লে,—তার পর ঝি-চাকরের পালা। চাঁপা পুরানো ঝি, মাটীতে ঢিপ্ ক’রে মাথা ঠেকিয়ে বল্লে,—পিসীমা, গড় করি।
ঘরে ঢুক্তে না ঢুক্তেই ছেলেমেয়েরা আবার ছ্যাঁকাবাকা ক’রে ধর্লে, দিদিমা, আমাদের জন্য কি এনেছ?
কুমুদিনী বললেন,—আঃ, তোরা এমন ব্যস্ত করিস্ কেন? এই ত সবে বাড়ীতে পা দিয়েছেন, রেলের কাপড় ছাড়ুন, মুখে হাতে একটু জল দিন্, তার পর না হয় আসিস্।
পিসীমা বললেন,—না রে না, তোরা থাক্। কিন্তু পাড়াগাঁয়ে কি আর এমন জিনিষ পাওয়া যায় যে, আমি তোদের জন্য নিয়ে আস্ব? তা শুধু হাতে ত আসতে নেই, যা পেয়েছি, নিয়ে এসেছি।
পিসীমার সঙ্গে ছিল একটি প্যাঁটরা আর একটা পুঁটুলী। সেই দুটো খুলে সকলের হাতে খাবার দিলেন, ছোটদের পুতুল, আর গোটাকতক ঝুনা নারিকেল কুমুদিনীর হাতে দিলেন। পুঁটুলীর ভিতর গোটাকতক্ চাল্তা ছিল, তা-ও বেরুল। জিনিষ ত ভারি, কিন্তু তাই পেয়ে বাড়ীশুদ্ধ লোকের আহ্লাদ দেখে কে!
সন্ধ্যার সময় বিশ্বনাথ আফিস থেকে এসে পিসীমাকে প্রণাম কর্লেন। পিসীমা বল্লেন,—বাবা, ভাল আছ ত?
—হ্যাঁ পিসীমা, আপনার আশীর্ব্বাদে সব ভাল।
রাত্রি হ’তেই ছেলেমেয়ের দল পিসীমাকে ঘিরে বস্ল। কুমুদিনী হেসে বল্লেন,—ছেলেরা সব পিসীমাকে পেয়ে বসেছে।
পিসীমা বলিলেন,—ওরা ত রোজ রোজ আর আমাকে পায় না, কত দিন পরে এসেছি, একটু গল্পগুজব কর্বে না?
কুমুদিনী সংসারের কাজে গেলেন। পিসীমার কাছে বসে ছেলেমেয়েরা তাঁর দেশের খবর জিজ্ঞাসা কর্তে লাগ্ল। অধিকাংশই শোনা কথা; কেননা, দু’চারজন বড় ছেলে মেয়ে ছাড়া তারা কেউ কখনো পিসীমাদের দেশে যায় নি। তবু জিজ্ঞাসা করা ফুরোয় না। গ্রামে রাসের মেলা কেমন হয়েছিল, পিসীমার বাগানে এ-বছর আম হয়েছিল কি না, চৌধুরীদের পুকুরে মাছ কি রকম, পরাণ ঘোষের নতুন বাড়ী কতদূর হ’ল, এই রকম কত কথা। তার পর সকলে পিসীমাকে নিজেদের খবর শোনাতে আরম্ভ করলে। মেয়েদের কার কার নতুন বন্ধু হয়েছে, সে-কথা হ’ল; ইস্কুলে যে-সব মেয়েরা পড়ে, তাদের মধ্যে কার কার বিয়ে হয়ে গিয়েছে, কে নতুন মাষ্টার এসেছে, এবার স্বদেশী মেলা কেমন হয়েছিল, এই সব কত কি পরিচয় দেওয়া হ’ল।
কুমুদিনীর বড় ছেলে ব্রজনাথ—ডাকনাম ভোঁদা—কলেজে পড়ে কি না, তাই তিনি একটু চালাক। মাঝখান থেকে জিজ্ঞাসা ক’রে বস্ল, হ্যাঁ দিদিমা, তোমার নাম পদ্ম হ’ল কেন? তুমি বুঝি দেখ্তে পদ্ম-ফুলের মত ছিলে?
ছেলেবেলায় পিসীমা দেখতে কেমন ছিলেন, তা ত আমরা জানি না, তবে সুন্দরী যে ছিলেন, তা বুঝিতে পারা যায়। এখনো চুল তেমন পাকে নি, এখনো মুখখানি ঢলঢলে, চোখ ভাসা-ভাসা, এখনো হাসলে গালে টোল খায়। পিসীমা বল্লেন,—বাপ-মা ত আমায় জিজ্ঞাসা ক’রে আমার নাম রাখে নি! আমি আর যাই হয়—আফিংখোর কমলাকান্তের পদী পিসী ত নই! আর তোর নাম ভোঁদা হ’ল কেন?
ঘরশুদ্ধ ছেলেমেয়ে খিল খিল ক’রে হেসে উঠল। ব্রজনাথ অপ্রস্তুত হয়ে বল্লে, ও ত আমার ভাল নাম নয়।
—রেখে দে তোর ভাল নাম! কাচের আলমারীতে তোর কি নাম তোলা আছে—তার কে খোঁজ রাখে রে! দেশসুদ্ধ লোক তোকে কি ব’লে ডাকে? আ মরি, নামের কি ছব্বা! ভোঁদা, ভোঁদা! গোঁড়া নেবুর মত টক জোঁদা! আর আমার নাম? কথায় বলে, আহা পদ্ম-ফুলের মত দেখতে!
সব ছেলেমেয়ে হাততালি দিয়ে হেসে উঠল। ব্রজনাথের বড় বোন্ উমা বল্লে, কেমন, দিদিমার সঙ্গে আবার লাগবি? কলেজে দু’খানা ইংরিজি বই পড়লেই হয় না। দিদিমার কথায় কেউ এঁটে ওঠে না, তুই ওঁর সঙ্গে পারবি?
আর এক মেয়ে বললে,—একটা নতুন ছড়া শিখলাম—
ভোঁদা, ভোদা, ভোঁদা,
গোঁড়া নেবুর মত টক জোঁদা।
ভোঁদা ত পালাবার পথ পায় না। সে রাত্রের পালা সায় হ’ল।
—২—
তার পরদিন দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়ার পর পিসীমা কুমুদিনীকে জিজ্ঞাসা কর্লেন,— হ্যাঁ রে, হিমুরা সব ভাল আছে ত?
হিমু হলেন হেমলতা। কুমুদিনী বল্লেন,—হ্যাঁ পিসীমা, তারা সব ভাল আছে। হিমু কাল এসেছিল, তোমার আসবার কথা সে জানে।
এই কথা হচ্ছে, এমন সময় হেমলতা এসে উপস্থিত। পিসীমাকে নমস্কার করতেই তিনি বল্লেন,—এই যে হিমু, এইমাত্র তোমার কথা জিজ্ঞাসা করছিলাম। তুমি চিরজীবী হয়ে থাক্বে।
—পিসীমা, মেয়েমানুষের পক্ষে এমন কথা কি আশীর্ব্বাদ? বরং আশীর্ব্বাদ কর, যেন এঁকে আর ছেলেদের রেখে যেতে পারি।
—তা মা, সত্যি কথা। সাজান সংসার রেখে যাওয়া মেয়েমানুষের বড় ভাগ্যির কথা। তুমি ভাগ্যবতী, পাকা চুলে সিঁদূর পর্বে।
—পিসীমা, খবরের কাগজে বেরিয়েছিল, তোমাদের দেশের কাছে কোথায় না—কি দেবীর মূর্ত্তি পাওয়া গিয়েছে। বড় জাগ্রত দেবতা। সত্যি কি?
—সত্যি বই কি! সব কথা বুঝি তোমরা শোন নি? গ্রামে একঘর বামুন আছে, তার স্বপন হ’ল যে, দেবী তার ঘরে আসবেন। স্বপনে দেখে অন্নপূর্ণার রূপ, রূপে ঘর আলো ক’রে মা তার শিয়রে দাঁড়িয়া বলছেন, দেখ্ তুই বড় দুঃখী, আমি এলে তোর দুঃখ ঘুচে যাবে। পঞ্চাননতলা দিয়ে যে পথ গাঁয়ের বাইরে গিয়েছে, সেই পথে অশ্বত্থ গাছের উত্তর ধারে আমি আছি। আমাকে তুলে নিয়ে এসে ঘরে রাখ্, তার পর আলাদা মন্দিরে রাখ্বি। স্বপন পেয়ে বামুন সেই গাছতলায় খুঁড়ে দেখে, সত্যি সত্যিই ঠাকুর রয়েচেন! তুলে নিয়ে এসে ঘরে রাখ্লে, আর দেখতে দেখতে চারিদিকে কথা রাষ্ট্র হয়ে গেল। আশপাশের গ্রাম থেকে, দূরের গ্রাম থেকে কত লোক মানত্ ক’রে আস্তে লাগ্ল, কত লোক হত্যা দিতে আসতে আরম্ভ করলে। ভারি জাগ্রত দেবতা। কত লোকের রোগ-বালাই সেরে গিয়েছে, কত লোক ঠাকুরকে সোনার গহনা গড়িয়ে দিয়েছে। বামুনের বড় কষ্ট ছিল, এখন বেশ সচ্ছল সংসার। ঠাকুরের মন্দির হয়েছে, বামুন প্রায় মন্দিরেই থাকে, মা’র আরতি করে, ভোগ দেয়, এমন ভক্তি দেখি নি। সাধে কি মানুষে ঠাকুর-দেবতায় বিশ্বাস করে?
কুমুদিনী আর হেমলতা ব’লে উঠলেন,— পিসীমা, এক দিন আমরা দর্শন কর্তে যাব।
—যাবে বই কি। এত লোক যাচ্ছে, তোমরা যাবে না কেন? আমি সঙ্গে ক’রে নিয়ে যাব।
—তা ত যাবেই, তোমাকে কি আমরা ছেড়ে যাব?
অন্য কথাবার্ত্তা হ’তে লাগল। পিসীমা বললেন,—আগে আগে সহরে আর পাড়াগাঁয়ের লোক একটু আলাদা আলাদা রকম হ’ত। সহরে খরচপত্র বেশী, সকলে নিজের নিজের ধন্ধা নিয়ে থাকে, কেউ কারুর খোঁজ রাখে না। পাশের বাড়ীতে কে থাকে, হয়ত তার নামই জানে না। পাড়াগাঁয়ে তবু ঢের ভাল, পাড়াপড়শীর খোঁজখবর রাখে, বিপদ-আপদে বুক দিয়ে পড়ে। কিন্তু সেটাও ক’মে যাচ্ছে। এখন দেশে ব’সেও কেবল সহরের কথা। পাড়াগাঁয়ের ছেলেরা সহরে পড়তে আসে, বাবুরা চাকরী কর্তে আসে। মনে করলেই এখানে আসা যায়, রেলের পথ, নৌকাতে আর ক’জন যাওয়াআসা করে? যা এখানে হবে, পাড়াগাঁয়েও তাই, সব যেন এক হয়ে গিয়েছে।
হেমলতা বল্লেন,—তুমি ত পিসীমা অনেক দেখেছ শুনেছ, আমরা ত কিছুই দেখি নি, তবু মনে হয়, সব যেন কি রকম হয়ে যাচ্ছে।
কথার মাঝখানে চাঁপা ঝি এসে খবর দিলে, পিসীমা, তালতলার দাদাবাবু এসেছে।
দাদাবাবু পিসীমার ভাসুরপো বিপিন, বছর কুড়ি বয়স, বি-এ পাশ করেছে। পিসীমা বল্লেন,—ডেকে নিয়ে আয় না!
হেমলতা বল্লেন,—আমি উঠে ঘরের ভিতর যাই। আমি ত কখনো ওঁর সুমুখে বেরুই নি।
পিসীমা বল্লেন,—তার আর কি হয়েছে? তোমার ছেলের বয়সী, ওর কাছে আবার লজ্জা কি?
হেমলতা ব’সে রইলেন। বিপিন এসে আগে পিসীমাকে প্রণাম কর্লে, তার পর কুমুদিনী আর হেমলতাকে। বাড়ীর কে কেমন আছে, জিজ্ঞাসা ক’রে পিসীমা বললেন,—হ্যাঁ রে, আজকাল তোদের কি যে সব কাণ্ডকারখানা হচ্চে, কিছুই বুঝতে পারি নে।
—কেই-বা বুঝতে পারে? এই দু’মাস রাজবাড়ী নেমন্তন্ন ছিল, সেখানে কাটিয়ে এলাম। ঠিক রাজভোগ নয়, মোটা চাল আর কলায়ের ডাল, তবু ত ঘরের ভাত বেঁচে গেল! আগে লোকে বল্ত হরিণবাড়ী, এখন বলে রাজবাড়ী।
—শুনলে ছেলের কথা! জেলে যাওয়া কি বড় পৌরুষের কথা?
—বড় লজ্জার কথা, যদি দুষ্কর্ম্ম ক’রে জেলে যেতে হয়। আমরা এই যে হাজার হাজার লোক, আমরা কি চুরি-ডাকাতি করেছি, না খুন-খারাপি করেছি? কোনখানে যদি সভা হয়, আর কেউ যদি সভায় যায় ত তার জেল হবে! ভাল কথা! রাজার মর্জ্জি! এইবার যদি পথে হাঁটতে কেউ হাঁচে কিংবা কাসে ত তার বেত-পেটা হবে!
—এ আবার কোন্দেশী আইন? যা তা আইন কর্লেই হ’ল?
—তা না হ’লে সরকারী ব্যবস্থার বাহাদুরী কি? এ-রকম জেলে যেতে আর অপমান কি? যারা বেরিয়ে আসে, তাদের গলায় ফুলের মালা দিয়ে নিয়ে যায়। এই দেখ না—কত বড় বড় লোক জেলে গেল।
—তা হ’লে তুইও বড়লোক হ’লি?
—না-ই বা হলাম! বড় লোকের সঙ্গে ত জেলে ছিলাম।
পিসীমা চুপ ক’রে একটু ভাবলেন, তার পর বল্লেন,—দেশের অদৃষ্টে কি যে আছে, ভেবে পাই নে।
বিপিন বল্লে,—যাই থাক্, লোকের একটু চৈতন্য হয়েছে। একটু ঘা না খেলে কি মানুষের মনে লাগে? এখন তবু লোকে বুঝতে পার্ছে যে, অনেক কষ্ট স্বীকার না কর্লে দেশের মঙ্গল হবে না।
—তাও ত বটে। জননী জন্মভূমি বলেছে ত। তা যাঁকে মা বল্ছে, তাঁর জন্য অনেক দুঃখ সহ্য কর্তে হয়।
কুমুদিনী বিপিনের জন্য রেকাবি ক’রে জলখাবার এনে তার হাতে দিলেন।
পিসীমা বললনে,—হ্যাঁ রে বিপিন, তুই ত তিনটে পাশ করেছিস্, এখন কি করবি?
—কি আর কর্ব? এখনো ত কর্ম্মভোগ ফুরোয় নি, এখন এম এ পড়ব।
—ও আবার কোন্দেশী কথা! লেখাপড়া শেখা কি কর্ম্মভোগ?
—তা কেন? তবে পাশ করা ত আর লেখাপড়া নয়!
—তোর সবই অনাছিষ্টির কথা! আবার লেখাপড়া কাকে বলে?
—একজামিন পাশ করা কেবল কতকগুলো বই গেলা। হজমও হয় না, বিদ্যাও হয় না। বিদ্যা শিখতে হ’লে তার পর শিখতে হয়।
—কেন, পাশ ক’রে ছেলেরা ত রোজগেরে হ’ত।
—সে-কাল আর নেই। এখন পাশ কর—তার পর ভেরেণ্ডা ভাজ!
—সে-কথাও ত সত্যি। কত পাশ করা ছেলে সব ঘুরে ঘুরে বেড়ায়, কোথাও কিছু পায় না।
কোত্থেকে পাবে? উকীল ডাক্তার কেরাণী কত জন হবে? আমরা শুধু মার্কা-মারা মাল, তা বাজারে এ মাল চলে না। যেখানেই যাই, পাবার মধ্যে অর্দ্ধচন্দ্র! মাড়োয়ারীরা স্কুলেও যায় না, পাশও করে না, এদিকে অর্দ্ধেক কলকেতা সহর দখল ক’রে নিয়েছে। যে টাকাটা আমরা কলেজের পাদপদ্মে ঢালি, সেই টাকা দিয়ে মুদির দোকান করলে তবু পেট চল্ত।
পিসীমা বল্লেন,—তাই ত, এ সব ত ভাববারই কথা। তোরা সব এই বয়সে এত রকম ভাবছিস্, আগে কারুর কোন ভাবনা ছিল না, দু’-বেলা দু’-মুঠো ভাত পেলেই নিশ্চিন্তি।
—সে-কাল গেছে, আর ফিরবে না।
চাঁপা এসে হেমলতাকে বল্লে,—বউ-দিদি তোমার গাড়ী এয়েছে; সইস বল্ছে, ঘোড়া দাঁড়াচ্ছে নি।
পিসীমা হেসে বললেন,—দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘোড়ার পা ব্যথা হয়ে থাকে ত একটু বসতে বল্ না!।
হাসির রোল উঠ্ল। হেমলতা চ’লে গেলেন। আর একটু পরে বিপিনও উঠে গেল।
—৩—
পৌষ মাস। পৌষ মাসে কলিকাতায় দুটি তীর্থস্থানে খুব ভীড় হয়, এক ভবানীপুর কালীঘাটে কালীর মন্দিরে, আর এক খিদিরপুর ঘোড়দৌড়ের মাঠে। ট্রাম, মোটর, বাস্, খিদিরপুরের দিকে বেশী; কেননা, রেস-খেলায় সকল জাতের সমন্বয়, হিন্দু-মুসলমান-খৃষ্টানের কোন ভেদ নেই, কালা-গোরার বিচার নেই। ট্রামে গুজরাটী, মাড়ওয়াড়ী, পঞ্জাবী, হিন্দু, মুসলমান সকলেই আছে, সকলের কাছে টিপ্ আছে, ট্রামে ব’সে ব’সেই বাজী রাখ্ছে। এক জন হয় ত হাত বাড়িয়ে বল্লে কেৎনা খাওগে? আর এক জন তার হাতে তালি দিয়ে বল্লে, দশ রুপইয়া। অমনি বাজী হয়ে গেল। এরা এক রকম যাত্রী, আর কালীঘাটের যাত্রী অনেকেই গরীব, অনেকে হেঁটে চলেছে, বড় জোর না হয় ট্রামে ক’রে।
কলিকাতায় আস্বার দু’-চার দিন পরে পিসীমা কুমুদিনীকে বল্লেন,—একদিন পোষ কালী দর্শন করতে যেতে হবে।
—যে-দিন ইচ্ছে গেলেই হ’ল, পিসীমা। বাড়ীর গাড়ী রয়েছে, যে-দিন বল্বে, তোমার জন্য গাড়ী থাক্বে। অমাবস্যার দিন যাবে?
—না বাছা, অত ভিড়ের দিন গিয়ে কাজ নেই। চ না, এরি মধ্যে এক দিন দর্শন ক’রে আসি!
—কবে যাবে, বল?
—গাড়ীর যদি সুবিধা হয় ত কাল গেলেই হয়।
গাড়ীর আবার সুবিধা-অসুবিধা কি? তোমার জন্য গাড়ী চাই—তার আবার কথা!
বিশ্বনাথ খেতে বসেছেন, পিসীমা পাখা-হাতে মাছি তাড়াচ্ছেন। কুমুদিনী বল্লেন,—কাল পিসীমা কালীঘাটে যাবেন, গাড়ী চাই। পিসীমা বল্ছিলেন,—গাড়ীর সুবিধা হবে কি?
হেসে বিশ্বনাথ বল্লেন,—গাড়ীর কথা আমি ব’লে দিচ্ছি। আমি ট্রামে কি ঠিকা গাড়ী করে আফিস যাব। পিসীমার সঙ্গে তুমি যেও, আর ছেলে-মেয়েদের যাকে ইচ্ছে হয়, নিয়ে যেও!
রাত পোহাতেই কালীঘাটে যাবার ধূম প’ড়ে গেল। ছেলেমেয়েরা—যাদের স্কুল-কলেজ নেই তারা পিসীমাকে চেপে ধর্লে,তারাও যাবে। পিসীমা কুমুদিনীকে বললেন,—ওদেরই বা মনে দুঃখ থাকে কেন? আর একখানা গাড়ী ডাক্তে বল।
দু’খানা গাড়ী ক’রে সকলে কালীঘাটে গেলেন। চাঁপা ঝি পিসীমার গাড়ীর পিছনে বসেছিল।
বিশ্বনাথ যাদের যজমান—সেই হালদারদের বাড়ীতে নেমে পিসীমা কুমুদিনীকে সঙ্গে ক’রে ধূলোপায়ে কালীদর্শন করতে গেলেন। ছেলেরা গরম গরম বেগুনী কিন্তে ছুট্ল।
পিসীমা বললেন,—এ যে পথ-ঘাট অনেক বদলে গিয়েছে! মন্দিরের আশে-পাশে ভেঙ্গে চুরে বড় রাস্তা হয়েছে।
কুমুদিনী বললেন,—মিউনিসিপালিটি থেকে সব পরিষ্কার ক’রে দিয়েছে, চারদিকে তেমন আর ঘিঞ্জি নেই।
পিসীমা মন্দিরের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখ্ছিলেন। মন্দিরের দেয়ালে বড় বড় অক্ষরে নানা রকম বিজ্ঞাপন লেখা। পিসীমা বললেন,—এ আবার কি? কালীর মন্দির কি বড় রাস্তা, না কারুর কেনা বাড়ী? মন্দিরের চারিদিকের দেয়ালে সব দোকানওয়ালাদের বিজ্ঞাপন! এর নাম কি ঠাকুর-দেবতাকে ভক্তি? মন্দিরের ভিতর এত টাকা পড়ছে, হালদাররা বড়মানুষ হয়ে গেল, চারদিকে বড় বড় ইমারত, এতে কি হয় না? আবার ঠাকুরের মন্দিরের দেয়াল-ভাড়া টাকা তুলছে! আমরা হিঁদু, হিঁদুয়ানীর এত ডব্ডবা দেখাই, আর এমনতর দেখে কারুর মুখে একটি কথা নেই? মুসলমানদের মসজীদে কি খৃষ্টানদের গির্জের দেওয়ালে কেউ এমন ক’রে লিখুক্ দেখি, কেমন তার মাথা থাকে! ওরা আমাদের চেয়ে ঢের ভাল!
কুমুদিনী ত অবাক্। বললেন,—সত্যিই ত পিসীমা, এত লোকের কারুর নজরে ঠেকে না! তুমি ত ঠিক কথাই বলেছ! চারদিকে ত এত হই-চই, এটা কারুর চোখে পড়ল না!
চাঁপা পিছন থেকে বললে,—বলবে নি, পিসীমা বল্বে নি ত কে বলবে? সউরে লোক ত চোখ থাকতে কাণা, পিসীমা এসেই দেখেছে! ও মা, কোথা যাব! কালীঠাকরুণের মন্দিরের দেওয়াল কি ভাড়া দিতে আছে?
কালীঘাট থেকে ফির্তে বেলা প্রায় তিনটে হ’ল। চৌরঙ্গীতে এসে এক যায়গায় খানিকক্ষণ গাড়ী দাঁড় করাতে হ’ল, সামনে পাশে অনেক গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে, রেসের জন্য ভিড়। পিসীমা দেখলেন, তাঁদের গাড়ীর একটু দূরে একখানা বড় মোটর দাঁড়িয়ে রয়েছে, মোটর খোলা, ভিতরে একজন স্ত্রীলোক ব’সে। বয়স অল্প, বেশ সুন্দরী, কাপড়-চোপড় খুব দামী, চোখে নাকটেপা চসমা, মাথার চুল বব করা। পিসীমা ঠাহর ক’রে দেখে বললেন,—ওকে যে চেনা-চেনা মনে হচ্ছে! কুমু, তুই চিনিস্ ওকে?
কুমুদিনী বললেন,—চিনি বই কি পিসীমা! ও যে ইন্দুবালা, এখন মিসেস্ মজুমদার, ওরা চৌরঙ্গীতে বাড়ী ভাড়া ক’রে থাকে।
—তবে বুঝি আমার চোখের দোষ হয়েছে! ইন্দু ত ভাজনঘাটের মেয়ে, আইবুড়ো বেলা কতবার দেখেছি, কতবার আমাদের বাড়ী আস্ত, ওর মা’র সঙ্গে কত নক্স খেলেছি। তবে ওকে দেখেই চিন্তে পারলুম না কেন, বল ত?
কুমুদিনী একটু আম্তা আম্তা ক’রে বললেন,—পিসীমা, চুল কেটে ফেললে হয় ত মানুষের মুখ একটু বদলে যায়!
—এইবার বুঝতে পেরেছি! তাই ভাবছিলুম, চিনি-চিনি কর্ছি—অথচ চিনতে পার্ছি নে কেন? চুল কেটে ফেললে মুখ আর এক রকম হয়ে যায় কি না! আর ওর এক মাথা কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, চুলের মধ্যে মুখখানি যেন ছবিখানি আঁটা। আহা, ইন্দুর বুঝি বড় অসুখ করেছিল, অনেক দিন জ্বর হয়েছিল, তাই বুঝি ডাক্তারে চুল কেটে দিয়েছে? ডেকে জিজ্ঞাসা করব?
কুমুদিনী তাড়াতাড়ি বললেন,—না পিসীমা, রাস্তার মাঝখানে কাজ নেই; ওরা ত আমাদের মত নয়, কি জানি কি মনে করবে।
কুমুদিনীর মনে হচ্ছিল, তাঁর আর পিসীমার কপালে মস্ত ফোঁটা, সদ্য কালীঘাটের ফেরত; মিসেস্ মজুমদার রেসে যাবার জন্য ব্যস্ত, হাতের ছাতা ঘোরাচ্ছেন, আর মুখ তুলে দেখ্ছেন, কতক্ষণে পাহারাওয়ালা আর সার্জ্জন হাত নামায়। এমন সময় তাঁকে সম্ভাষণ না করাই ভাল। আর চুলের কথা? সেটা পিসীমাকে বুঝিয়ে দেওয়া উচিত।
তাই কুমুদিনী আবার বল্লেন,—পিসীমা, মিসেস মজুমদারের কোন অসুখ করেনি। চুল আপনি কেটেছে।
—বলিস্ কি রে! সধবা মেয়েমানুষ, অমন সুন্দর চুল, পাগল ত আর হয় নি যে, সাধ ক’রে চুল কেটে ফেল্বে!
—হ্যাঁ পিসীমা, মেমেরা এখন ঐ রকম চুল রাখে, তাই দেখাদেখি আমাদেরও কেউ কেউ—
—এইবারে বুঝেছি। ফ্যাসান, হাল ফ্যাসান! একখানা ছবিতে দেখেছিলুম বটে, তা আমার মনে হ’ল, মেমসাহেবের একজ্বরী হয়ে থাক্বে, তাই চুল কেটে দিয়েছে। আমরা হলাম পাড়াগেঁয়ে মুখ্খু মানুষ, আমরা অতশত কি জানি! আর দ্যাখ্; ছবিতে দেখলুম, মেমের ঘাগরার নীচেও খানিকটা কাটা, আধখানা পা বেরিয়ে আছে। সেটাও কি ফ্যাসান?
—হ্যাঁ পিসীমা।
—তা হ’লে আমাদের মেয়েদের মেম সাজতে হ’লে ত ঠ্যাঙে ওঠা কাপড় পরতে হবে! উপরেও ফ্যাসান, নীচেও ফ্যাসান!
সার্জ্জনের হাত নেমেছে, মিসেস্ মজুমদারের মোটর বেরিয়ে গিয়েছে, কুমুদিনীদের গাড়ী আবার চলেছে। কুমুদিনী ত হেসে অস্থির, বল্লেন,—ও পিসীমা, তোমার সঙ্গে কেউ কখনো পারবে না। কালীঘাটের পাণ্ডা, সাহেব, মেম, উকীল, জজ সব হেরে যাবে।
পিসীমা অন্য কথা পাড়লেন।
—8—
সন্ধ্যার সময় পিসীমার দরবার বস্ল। ছেলে বড় সকলেই হাজির, সকলের ডাক পড়েছে। বিশ্বনাথ এসে এক পাশে বস্লেন। পিসীমা বল্লেন,—দেখ বাবা, আমরা পাড়াগাঁয়ে থাকি, একে মুখ্খু-সুখ্খু মানুষ, তার পর সহরের কিছু জানিনে, চোখে কিছু নতুন ঠেক্লে জিজ্ঞাসা করতে হয়। তোমরা লেখাপড়া শিখেছ, কত দেখেছ শুনেছ, আমরা যেটা বুঝতে পারি নে, সেটা বুঝিয়ে দিতে পার্বে। আজ এই কালীঘাটে গিয়ে একটা দেখলুম, কুমুদিনীকে বলেছি।
বিশ্বনাথ বল্লেন,—কি দেখলেন, পিসীমা?
মন্দিরের বাইরে দেয়ালে দেয়ালে কি সব বিজ্ঞাপন লেখা রয়েছে, দোকানদারদের জিনিষ-পত্তরের। আচ্ছা, একটা কথা আমি জিজ্ঞাসা করি, এই কলকেতা সহরে মোছোলমানদের কত মসজীদ আছে, সাহেবদের গির্জ্জে আছে, ইহুদীদের গির্জ্জে আছে, জৈনদের মন্দির আছে, ব্রাহ্মসমাজের মন্দির আছে, আর্য্য-সমাজের মন্দির আছে, শীখদের গুরুদোয়ারা আছে। কোনও জাতের দেবতার মন্দিরে এ-রকম দোকানীপসারীর বিজ্ঞাপন লিখতে দেয়? কালীঘাট পীঠস্থান, দেশদেশান্তর থেকে কত লক্ষ লক্ষ যাত্রী আসে, মায়ের মন্দিরে কি এ-রকম বিজ্ঞাপন লিখতে আছে? একবার আমি কাশীতে ছিলাম, দেখি, রেলে করে অনেক খোট্টা, কলকেতায় আস্ছে। তারা সব যাত্রী, গাড়ীতে ওঠবার সময় সব চেঁচিয়ে উঠল, কালী কলকত্তেওয়ালী! কালী মাঈকি জয়! সেতুবন্ধ রামেশ্বর থেকে আর সেই পঞ্জাব পর্য্যন্ত, কোথা থেকে লোক কালী দর্শন কর্তে না আসে! তা মন্দিরে এ-রকম করা কি ভাল?
—না, পিসীমা, ভাল আর কিসে?
—আর কোন জাত তাদের দেবতার জায়গায় এরকম কর্তে দেয়?
— কার সাধ্য এ-রকম করে।
—তবেই হ’ল যে আমরা আমাদের দেবতার সম্মান কর্তে জানি নে। তাই তোমায় জিজ্ঞাসা করছি।
—আমি আর কি বল্ব, পিসীমা, বলবার ত কিছু নেই! আপনার চোখে পড়েছে, এত লোক দেখেও দেখে না।
আর একটা দেখলাম। আমরা সেকেলে মানুষ, ঠাকুর-দেবতা দর্শন কর্তে যাই, আর আজকালের মেয়েরা কেউ কেউ রেস খেল্তে যায়। তা যাক্, বার যেমন অভিরুচি। চিরকাল ত আর এক রকম যায় না। কিন্তু এই যে সব নতুন হচ্ছে, এ ত আর আপনা-আপনি হচ্ছে না, পরের দেখে। সাহেবরা হ’ল রাজার জাত, ওরা যা কর্বে, তাই আমাদেরও কর্তে হবে! ওরা অখাদ্য খায়, আমাদেরও তাই খেতে হবে। ওরা কাটা পোষাক পরে, আমাদের পুরুষদেরও তাই পর্তে হবে! ওরা ধুচুনী মাথায় দেয়, আমাদেরও তা না হ’লে চল্বে না। মেমেরা চুল কেটে যাত্রাওয়ালা ছোকরাদের মত বেড়ায়, আমাদের মেয়েরাও চুল কেটে ফেলবে, যেন কতকেলে রোগী। আগে পৈরাগে গিয়ে মাথার চুল দিত, এখন ফ্যাসানের পায়ের তলায় চুল দেয়। সব দেখাদেখি ত?
—তা নয় ত আর কি?
—আর ওদিকে দেখ, সাহেব মেমেরা এ-দেশে এসে ত্রিশ চল্লিশ বছর ক’রে বাস ক’রে মাছের ঝোল ভাত খেতে শেখে না, কোঁচা ক’রে ধুতিও পরে না। আর ওদের মেয়েরাও কপালে উল্কি প’রে নাকে নোলক দোলায় না। ওদের বাপ-পিতামহ চৌদ্দ পুরুষ যেমন কর্ত—তেমনি করে। ফ্যাসান বদলায়—সেও ওদের নিজের দেশের। না হয় মান্লুম যে, সাহেবদের সব ভাল, ওদের মত থাকায় আমাদের লাভ আছে। কিন্তু বাঙ্গালী সাহেব সাজলে ত আর সাহেব হবে না। পোষাক পর্তে, খানা খেতে সকলেই পারে। শুধু কি তাইতে সাহেবরা এত বড় জাত হয়েছে? কাটা কোটের সঙ্গে সাহেবদের বুকের পাটা তোমরা পেয়েছ? এই ত দেখলে, লড়াইয়ের সময় কেমন লক্ষ লক্ষ ইংরাজ দেশের জন্য অম্লানমুখে প্রাণ দিলে। স্কুল-কলেজ সব বন্ধ হয়ে গেল, ছেলেরা সব যুদ্ধে ছুটেছে। মেয়েরা কোমর বেঁধে লেগে গেল,—কতক যুদ্ধে সেবা কর্তে, কতক মোটর-ট্রাম চালাতে, কতক মুটেগিরি কর্তে। সে কি এক জহর-ব্রত!! যেই যুদ্ধের আগুন জ্ব’লে উঠল, অমনি হুড়োহুড়ি ঠেলাঠেলি প’ড়ে গেল, কে আগে সে আগুনে ঝাঁপ দেবে! খাবার জিনিষ অর্দ্ধেক নেই, সহরে আকাশ থেকে বোমা পড়ছে, ওদিকে কাতারে কাতারে সব যুদ্ধে চলেছে। এমন জাতের পোষাক নিয়ে কি হবে—যদি সেই সঙ্গে তাদের প্রাণ না পাওয়া যায়?
—কেন, পিসীমা, বাঙ্গালীর ছেলেরাও ত যুদ্ধে গিয়েছিল।
—তোমার মুখে ফুল চন্দন পড়ুক্! এবার রাজার জন্য গেল, কোন দিন হয় ত দেশের জন্য যাবে। এ ত কারুর কাছে শিখতে হয় না, কারুর নকল কর্তে হয় না। বাঙ্গালী ভয় পায়—এ কলঙ্ক দেশের কর্ত্তারাই রটিয়েছেন। সেকালে যখন বাড়ীতে ডাকাত পড়ত, তখন কি পুলিস পল্টন এসে রক্ষা কর্ত? বাড়ীর পুরুষরা ডাকাতের মোয়াড়া নিত, বউ-ঝি সড়কি চালাত, ছাদ থেকে ইট ছুড়ত, কখন কখন খাঁড়া হাতে কালীর মত রণরঙ্গিণী হয়ে বেরুত। তখন কি কেউ সাহেবিয়ানা না মেমসাহেবিয়ানা জান্ত? তাঁতের মোটা কাপড় আর ভাল-ভাত খেয়ে কি দেশের কাজ করা যায় না, না চোর-ডাকাত শত্রুর সঙ্গে পেরে ওঠা যায় না? সেবার সেই ত্রিবেণীর কাছে বান ডেকে আমাদের নৌকা যায় যায়, আমাদের সামনে একটা ডিঙ্গী উল্টে গেল, শিবু মাঝি একা জলে প’ড়ে সকলকে তুল্লে। সে-ও ত ভীরু, কাপুরুষ বাঙ্গালী!
দরজা-গোড়া থেকে চাঁপা ঝি বল্লে,—ওগো, আমিও ছিনু।
উমা ধমক দিয়ে বল্লে,—থাম্ তুই!
চাঁপা থেমে গেল।
পিসীমা বিশ্বনাথকে জিজ্ঞাসা কর্লেন,—আচ্ছা, এখন যারা সাহেবের মত থাকে, তাদের মত কাপড় চোপড় পরে, খাওয়াদাওয়া করে, কেন করে?
বিশ্বনাথ বল্লেন,—ওরা রাজার জাত ব’লে একটা কারণ হ’তে পারে, তার পর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, ঘর-দোর বেশ সাজানো, সাহেবের মত থাক্লে লোকে খাতির করে, এই রকম নানা কারণ হ’তে পারে।
—সাহেবরা এদেশের লোকদের কি-রকম তাচ্ছীল্য করে, সেটাও কি একটা কারণ?
—সেটা যদি মনে করে, তা হ’লে সাহেব-সাজা মুস্কিল হয়।
—হ্যাঁ দ্যাখ্ কুমু, তোকে যদি ঝি-চাকর মেমসাহেব বলে, তা হ’লে তোর কি খুব আহ্লাদ হয় না?
—রক্ষে কর, পিসীমা, আমাকে আর অমন আশীর্ব্বাদ কর্তে হবে না।
এক চোট খুব হাসি হ’ল। এতক্ষণ ঘরশুদ্ধ স্তব্ধ হয়ে ছিল।
পিসীমা আবার বিশ্বনাথকে বল্লেন,—আর একটা কথা ভেবে দেখেছ? আজ যেন ইংরেজ রাজা, কিন্তু ওরা ত চিরকাল এদেশের রাজা ছিল না, চিরকাল থাকবেও না। সাহেবী ধরণ-ধারণ কত দিন হয়েছে বল দেখি? তার আগে কি রকম ছিল? মাথায় শামলা আর বুককাটা চাপকানেরও ত অনেক ছবি দেখেছি। ধর, কিছু দিন পরে এখানে চীন রাজ্য হ’ল, ইংরাজদের ত ঘরবাড়ী এখানে কিছু নেই, তল্পিতাল্পা বেঁধে তারা নিজের মুলুকে চ’লে গেল। তখন কি হবে? তখন কসাইটোলা গলির চীনে মুচিগুলো যে রাজার কুটুম হবে! কলেজে তাদের ভাষা পড়াবে, তাদের ভাষায় খবরের কাগজ ছাপা হবে, কলম ছেড়ে সব তুলি ধরবে। তখন আর সাহেব সাজবে কে? তখন সব চীনে কোট আর চীনে পায়জামা পরবে, ছুরী-কাঁটা ছেড়ে দুটো কাঠি ধর্বে, সৌখীন বাঙ্গালীর মেয়ে চীনে খোঁপা বেঁধে চীনেদের মেয়ের মত সাজবে! আর চীনেদের রান্না অমৃত লাগবে।
—ও পিসীমা, ওদের রান্নার কথাটা আর ব’লো না!
ছেলেরা সব ঘরে গড়াগড়ি দিয়ে হাস্তে লাগ্ল।
পিসীমার কথা বন্ধ হ’ল। উমা বড় মেয়ে, বাপের আদুরে, শ্বশুরঘর করে, একটু মুচকে হেসে বল্লে,—দিদিমা বাবার কাছ থেকে সব কথা জেনে নিয়েছেন, আর কিছু বাকী নেই!
বিশ্বনাথ বল্লেন,—ওঁর মুখেই আমরা কত কথা শিখি, ওঁকে আবার কে কি শেখাবে?
বিশ্বনাথ উঠে গেলেন। তখন চারদিকে কথার ফোয়ারা ছুট্ল। ব্রজনাথ বল্লে,—লেকচার শুন্তে হয় ত দিদিমার! আর সব লেক্চারে কি সব আজে-বাজে বকে!
পিসীমা বল্লেন,—নে, তুই আর জ্বালাস্ নে!
অন্য ছেলেরা বল্লে,—দিদিমা, তুমি আর দেশে যেও না, এইখানে থাক।
—এখন দেশে যাব না। পৌষ মাসের শেষে পৈরাগে যাব। মাঘ-মাসটা সেইখানে থাক্ব।
উমা বল্লে,—মাঘে প্রয়াগে কল্পবাসে—
ব্রজনাথ বল্লে,—মাঘে প্রয়াগে থরহরি কম্প লাগে।
পিসীমা বল্লেন,—দুই কথাই ঠিক, দু’টি ভাই-বোন যেন মাণিকজোড়!