রথযাত্রা ও অন্যান্য গল্প/রাজরোষ

রাজরোষ

—১—

 অপরাহ্ণকালে প্রয়াগ-সঙ্গমে বালুকাতটে বসিয়া প্রশান্ত-ললাট নির্গ্রন্থ নাথপুত্ত্র[] শিষ্যদিগকে শিক্ষা দিতেছিলেন। তাঁহার সম্মুখে ও দুই পার্শ্বে পঞ্চাশ জন শিষ্য নীরবে বসিয়া, অবহিত চিত্তে তাঁহার উপদেশ শ্রবণ করিতেছিলেন। কয়েক জন গৃহস্থও উপস্থিত ছিলেন।

 গুরু কহিতেছিলেন,—‘গ্রন্থি ইহ-সংসারে বন্ধন। অনেক প্রকার জটিল গ্রন্থিতে মানুষের স্বভাব আবদ্ধ, চিত্ত স্বচ্ছন্দে বিচরণ করিতে পারে না। এই সকল গ্রন্থি মোচন করিতে হইলে আয়াস ও সাধনার প্রয়োজন, কিন্তু তাহা ব্যতিরেকে মুক্তির উপায় নাই। যাহার চরণে শৃঙ্খল বদ্ধ, সে অনায়াসে পথ পর্য্যটন করিতে পারে না। এই ভার বহন করিয়া জীবনের দীর্ঘ পথ কেমন করিয়া অতিবাহিত করিবে? সংযম অভ্যাস কর—বাক্যে সংযম, চিত্তে সংযম, আহার-বিহারে সংযম। বাক্য শাণিত অস্ত্রের ন্যায়, সংযম না করিলে অপরের মর্ম্মে আঘাত করে। চিত্ত চঞ্চল অশ্বের ন্যায়, বল্গা সংযত না করিলে অপথে-কুপথে ধাবিত হইবে। আহারের জন্য ধরণী নানা সামগ্রী দান করে, অপর ভক্ষ্যের কি প্রয়োজন? মানুষ কি ব্যাঘ্র যে মাংস ভোজন করিবে? আর বিহার? সাধু-সঙ্গই বিহার।’

 একজন গৃহস্থ প্রশ্ন করিল,—‘প্রভু, যাহারা সংসারে লিপ্ত, গৃহস্থ আশ্রমে রহিয়াছে, তাহাদের প্রতি কি আদেশ?’

 —‘গৃহাশ্রমে ত সকলেই রহিয়াছে, কয়জন গৃহ পরিত্যাগ করিতে পারে? গৃহস্থের পক্ষেও যথাসাধ্য সংযম ব্যবস্থা। সংযম ত্যাগ করিলেই সমূহ বিপদ। এই যে সংসার, ইহা পর্ব্বতের পার্শ্বের ন্যায়,—অত্যন্ত পিচ্ছিল, গমনাগমনের পক্ষে বড় কঠিন। অসাবধান হইলেই পতন ও বিনাশ। কোন জীবের হিংসা করিবে না, পিপীলিকাকেও পদদলিত করিবে না।’

 যমুনার কালো জলে অস্তমান সূর্য্যের রশ্মি জ্বলিতেছিল, সিতাসিত সঙ্গমে গঙ্গার শুভ্র, তীব্র স্রোত ও যমুনার অলস, মন্থর, কৃষ্ণ প্রবাহ লক্ষিত হইতেছিল। পূর্ব্বদিকের বাতাস, তাহা জলে ঠেকিয়া ছোট ছোট তরঙ্গ রচনা করিতেছে, যমুনার পারে হরিদ্-বর্ণ ক্ষেত্র। কিছু দূরে ঘাটে কয়েকটি নৌকা বাঁধা, নাবিকেরা নৌকায় কিংবা তীরে বসিয়া গল্প করিতেছে, গ্রামের বালক বালিকা বালুকায় খেলা করিতেছে।

 দুই তিনখানি সজ্জিত রথ বেগে চালিত হইয়া যমুনাতীরে উপনীত হইল। ছয় জন উত্তম-বেশ-পরিহিত যুবক রথ হইতে অবতরণ করিয়া শিষ্যপরিবৃত গুরুর অভিমুখে হাস্য-কৌতুক করিতে করিতে আগমন করিলেন। সকলের অগ্রে যে-যুবক আসিতেছিলেন তাঁহার বেশ-ভূষার পারিপাট্য কিছু অধিক। উপবিষ্ট শ্রোতার মধ্যে একজন তাঁহাকে চিনিতে পারিয়া কহিল, ‘রাজা বিরূপাক্ষ!’ সে-নাম শুনিয়া সকলেই কিছু শঙ্কিত হইল। একা নাথপুত্ত্র বিচলিত হইলেন না, নবাগত যুবকদিগের প্রতি দৃষ্টিপাত না করিয়া যেমন মধুর গম্ভীরস্বরে উপদেশ দিতেছিলেন, সেইরূপ দিতে লাগিলেন।

 রাজা বিরূপাক্ষের বয়স চব্বিশ বৎসর। দেখিতে সুপুরুষ, কিন্তু বিলাসিতার আতিশয্যে চক্ষু কোটরগত, রক্তবর্ণ, মুখমণ্ডল শ্রীবিহীন। সাঙ্গোপাঙ্গও তদ্রূপ। বিরূপাক্ষ দুশ্চরিত্র, নিষ্ঠাশূন্য, নিষ্ঠুর, প্রজাপীড়ক, অত্যাচারী। নিকটে আসিয়া সঙ্গের এক ব্যক্তিকে ব্যঙ্গচ্ছলে জিজ্ঞাসা করিলেন,—‘ইহারা কে? এখানে কি করিতেছে?’

 হয় ত সেই ব্যক্তি বিদূষক। মুখ গম্ভীর করিয়া কহিল,—পিতৃশ্রাদ্ধ করিতেছে। মধ্যস্থলে পুরোহিত বসিয়া মন্ত্রোচ্চারণ করিতেছে।’

 আর একজন কহিল,—‘না হে, ইহারা নটের দল। আজ রাত্রে প্রেতপঞ্চাশিকা নাটক অভিনয় হইবে, তাহাই আবৃত্তি করিতেছে। এই শ্মশানভূমি তাহার উপযুক্ত স্থান।’

 নাথপুত্ত্র মৌনাবলম্বন করিয়া অবনত মস্তকে বসিয়াছিলেন। রাজা তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন,—‘কে তুমি? ব্রাহ্মণ?’

 গুরু মাথা তুলিয়া ধীর স্বরে কহিলেন,—‘আমি তোমার দাস।’

 রাজা পারিষদদিগকে কহিলেন,—‘এই দেখ, এক রকম। কতকগুলা অনার্য্য এখানে বসিয়া কি পরামর্শ করিতেছে। আর এক দল হইয়াছে, দেখিয়াছ? মুণ্ডিত শির, মুণ্ডিত তুণ্ড, পীতবস্ত্র ধারণ করিয়া ভিক্ষাপাত্র-হস্তে ঘুরিয়া বেড়ায়।’

 রাজার সঙ্গিগণ হাসিতে লাগিল। একজন কহিল,—‘জানি বই কি! তাহাদের গুরু শাক্যবংশীয় রাজপুত্র, উন্মাদ, বীভৎস আচার চণ্ডালের গৃহ হইতে অন্ন ভিক্ষা করে।’

 যুবকেরা অট্টহাস্য করিয়া উঠিল। একজন হাসিতে হাসিতে কহিল,—‘রাজসুখের অপেক্ষা ভিক্ষাভোগ উত্তম, ইহাতে আর সন্দেহ কি! কিন্তু এই যে লোকগুলা, ইহারা কে? রাজদ্রোহী নয় ত?’

 আবার হাস্যের তরঙ্গ উঠিল। বিদ্রূপ-বাক্য শুনিয়া নাথপুত্ত্র আসন ত্যাগ করিয়া উঠিলেন। শ্রোতাদের মধ্যে এক যুবক ধৈর্য্যচ্যুত হইয়া বলিয়া উঠিলেন,—‘সাধু সন্নাসীকে বিদ্রূপ অপমান করা রাজার উচিত কর্ম্ম বটে!’

 যুবা তেজস্বী, বলবান, অথচ সৌম্যমূর্ত্তি। সে স্বয়ং ক্ষত্রিয়, দুর সম্বন্ধে রাজার জ্ঞাতি, তাহাকে দেখিয়া রাজা চিনিলেন। ক্রোধে চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া কহিলেন,—‘উদয়ন, তুমি এখানে? যেমন দলে মিশিয়াছ সেইরূপ তোমার প্রকৃতি হইয়াছে। কাহার সহিত কথা কহিতেছ, তোমার স্মরণ নাই? তোমার মুখে এরূপ কথা?’

 উদয়ন কহিলেন,—‘সকলের মুখে এইরূপ কথা। গুপ্তচরেরা সে-সংবাদ দেয় না?’

 রাজার সঙ্গিগণ তর্জ্জন-গর্জ্জন করিয়া উদয়নের অভিমুখে অগ্রসর হইল। নাথপুত্রের শিষ্যগণ তৎক্ষণাৎ উদয়নকে বেষ্টন করিয়া দাঁড়াইল। এরূপ স্থলে বল প্রকাশ যুক্তিযুক্ত নহে বিবেচনা করিয়া রাজার মোসাহেবেরা ক্ষান্ত হইল।

 নাথপুত্ত্র হস্ত উত্তোলন করিয়া কহিলেন,—‘মঙ্গল হউক!’

 এই বলিয়া তিনি সে-স্থান পরিত্যাগ করিলেন। শিষ্য ও শ্রোতাগণ তাঁহার সঙ্গে গেল। রাজা চীৎকার করিয়া কহিলেন,—‘উদয়ন, আজিকার অপমান আমার স্মরণ থাকিবে।’

 উদয়ন কোন উত্তর দিলেন না।

—২—

 রাজবাটী পরিত্যাগ করিয়া রাজা বিরূপাক্ষ কিছু দূরে বিস্তৃত উদ্যানের মধ্যে প্রমোদ ভবনে বাস করিতেন। রাজমাতা বর্ত্তমান, রাজবংশের কয়েকজন বৃদ্ধও জীবিত, রাজ-বাটীতে বিরূপাক্ষ যথেচ্ছাচার করিতে পারিতেন না। উদ্যানে তাঁহাকে নিষেধ করিবার বা বুঝাইবার কেহ ছিল না। প্রমোদ-ভবনে কি হইত, রাজ-বাটীতে সংবাদ আসিত, কিন্তু রাজা বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়াছেন, রাজ্যভার তাঁহার হস্তে, কে তাঁহাকে নিষেধ করিবে? রাজা কখন কখন রাজরাটীতে গিয়া মাতাকে প্রণাম করিয়া আসিতেন, অধিক কথাবার্ত্তা হইত না। রাজমাতা মনে করিতেন বিবাহ হইলে এরূপ উচ্ছৃঙ্খল থাকিবে না, এই ভাবিয়া তিনি পুত্ত্রের বিবাহ দিবার চেষ্টা করিতেছিলেন। পুত্ত্র অসৎসঙ্গে প্রমোদে মত্ত, বিবাহের জন্য কোনরূপ আগ্রহ ছিল না।

 উদয়নের কথায় রাজা ক্রোধে জ্ঞানশূন্য হইয়াছিলেন। বাগানে ফিরিবার পথে আর কোন কথা হইল না। ‘দেখিয়াছ, কতকগুলা ভিখারীর সম্মুখে আমাকে অপমান করিল! উহারা দেশে দেশে ঘুরিয়া বেড়ায়, সর্ব্বত্র এই কথা রাষ্ট্র করিবে।’

 প্রজ্বলিত অগ্নিতে ইন্ধন জোগাইবার লোক অনেক আছে, রাজার বয়স্যদিগের ত কথাই নাই। কেহ বলিল,—‘উদয়নকে বন্দী করা হউক,’ কেহ বলিল,—‘তাহাকে শূলে দেওয়া হউক।’ সঙ্গীদিগের মধ্যে একজনের একটু বিবেচনা ছিল। সে বলিল,—‘যদি উদয়নকে এখন শাস্তি দেওয়া হয় তাহা হইলে প্রজারা জানিতে পারিবে যে, একজন প্রধান সন্ন্যাসীকে বিদ্রূপ করা হইতেছে দেখিয়া সে আপত্তি করিয়াছিল। প্রজাদের মনের ভাব জান ত, সাধু-সন্ন্যাসীকে অপমান করিলে তাহারা ক্রোধে উন্মত্ত হইয়া উঠে। কিছু একটা কৌশল করিয়া উদয়নকে শিক্ষা দিতে হইবে।’

 একজন ব্যঙ্গ করিয়া কহিল,—‘মন্ত্রী মহাশয় ত উপস্থিত রহিয়াছেন, তবে আর ভাবনা কি! মহাশয়, পরামর্শ দিন্।’

 রাজ্য রাগিয়া কহিলেন,—‘পরামর্শের কি প্রয়োজন? আমার আজ্ঞা যথেষ্ট। কোন প্রজা আপত্তি করিলে তাহাকেও চণ্ডালের হস্তে সমর্পণ করিব।’

 এমন সময় প্রতিহারী আসিয়া অভিবাদন করিল, ‘জয় মহারাজ!’

 রাজা ভ্রূভঙ্গে জিজ্ঞাসা করিলেন,—‘কি?’

 —‘মহারাজ, রাজমাতা মহারাণী আপনাকে স্মরণ করিয়াছেন।’

 —‘এমন সময়? এখন আমি যাইতে পারিব না।’

 —‘মহারাজ, বিশেষ কোন প্রয়োজন হইবে। পুরোহিত অপেক্ষা করিতেছেন।’

 —‘পুরোহিত? আর কোন লোক ছিল না? উত্তম, ডাক তাহাকে।’

 পুরোহিত আসিলেন, উন্নত, শীর্ণ দেহ, উজ্জ্বল আয়ত চক্ষু, বার্দ্ধক্যের স্থবিরতা এখনও দেখা দেয় নাই। রাজা ও তাঁহার সঙ্গিগণ উঠিয়া দাঁড়াইলেন। রাজা প্রণাম করিলেন।

 পুরোহিত আশীর্ব্বাদ করিলেন, বসিলেন না। কহিলেন,—‘মগধরাজের প্রধান দূত সশস্ত্র অনুচর-বর্গ লইয়া রাজপ্রাসাদে উপনীত হইয়াছেন। অবিলম্বে মহারাজের দর্শন কামনা করেন।’

 আকাশে বাজপক্ষীর কণ্ঠ শুনিলে ও তাহার প্রসারিত পক্ষ দেখিলে পারাবতকুল যেমন চঞ্চল, ত্রস্ত্র ও শঙ্কিত হয়, রাজা ও তাঁহার সখাগণ সেইরূপ বিচলিত হইলেন। মহা প্রতাপান্বিত মগধরাজের এখানে কি প্রয়োজন?

 শুষ্ক মুখে বিরূপাক্ষ কহিলেন,—‘মগধরাজ কেন দূত পাঠাইয়াছেন?’

 —‘যাইলেই জানিতে পারিবেন। কোন অমঙ্গলের আশঙ্কা নাই, তবে কালবিলম্ব করিবেন না। রাজবাটীতে আপনাকে দেখিতে না পাইয়া দূত কিছু বিস্মিত হইয়াছেন।’

 রাজা বিলম্ব করিলেন না, বেশ পরিবর্ত্তন করিয়া তখনই পুরোহিতের সঙ্গে গমন করিলেন।

 তাঁহার বয়স্যগণ কোন কথা না কহিয়া আপন আপন গৃহে গমন করিলেন।

 রাজবাটীতে সুসজ্জিত প্রকোষ্ঠে বসিয়া মগধ-রাজদূত রাজা বিরূপাক্ষের অপেক্ষা করিতেছিলেন। রাজাকে দেখিয়া দাঁড়াইয়া উঠিয়া তাঁহাকে অভিবাদন করিলেন। পুরোহিত এক পার্শ্বে দাঁড়াইয়া রহিলেন। সম্ভাষণাদির পর রাজা বিরূপাক্ষ কহিলেন,—‘আমার পরম সৌভাগ্য যে, মগধরাজ আমাকে স্মরণ করিয়াছেন। তাঁহার আদেশ শুনিতে পাই?’

 দূত মধ্যবয়স্ক, তীক্ষ্ণদৃষ্টি পুরুষ। কহিলেন,—‘রাজাধিরাজ আপনার সহিত পারিবারিক সম্বন্ধ কামনা করেন। তাঁহার কন্যা নাই, কিন্তু তাঁহার ভ্রাতুষ্পুত্রী পরমা সুন্দরী। মহারাজের ইচ্ছা, আপনি সেই কন্যার পাণিগ্রহণ করেন।’

 বিরূপাক্ষ পুরোহিতের দিকে চাহিয়া দেখিলেন, তিনি চক্ষু নত করিয়া দণ্ডায়মান রহিয়াছেন, মুখ তুলিলেন না। চিন্তা করিয়া বিরূপাক্ষ কহিলেন,—‘মাতা-ঠাকুরাণী রহিয়াছেন, এ প্রস্তাব তাঁহাকে জানাইব। তাঁহাকে লঙ্ঘন করিয়া আমি কিরূপে উত্তর দিব?’

 দূত কহিলেন,—‘সাধু, আপনি মাতৃবৎসল পুত্ত্রের উপযুক্ত উত্তর দিয়াছেন। রাজমাতার আপত্তির কোন কারণ দেখি না। পুরোহিত মহাশয় কি বলেন?’

 রাজা এবং দূত উভয়ে পুরোহিতের অভিমুখে দৃষ্টিপাত করিলেন। স্মিতমুখে পুরোহিত কহিলেন,—‘এমন কুটুম্বিতা কাহার বাঞ্ছনীয় না হইবে? মগধরাজের প্রস্তাবে রাজ-মাতা পরম সম্মানিত ও অনুগৃহীত হইয়াছেন।’

 বিরূপাক্ষ বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন,—‘তিনি অবগত আছেন?’

 দূত কহিলেন,—‘তাঁহার অবগতির জন্য প্রথমেই নিবেদন করা হইয়াছে।’

 —‘তিনি যেরূপ আদেশ করিবেন, তাহাই হইবে।’

 দূত এবং তাঁহার অনুচরগেণের রাত্রিবাসের ব্যবস্থা করিয়া দিয়া রাজা বিরূপাক্ষ পুরোহিতকে একান্তে কহিলেন,—‘ইহা আপনারই কাজ। মাতার সহিত পরামর্শ করিয়া আপনি এই সম্বন্ধ ঘটাইয়াছেন।’

 —‘ইহা ত কোন গর্হিত কর্ম্ম নয়। বাল্যকাল হইতে তোমাকে দেখিয়াছি, তোমাকে সুখী দেখিলে আমাদের আনন্দ। চক্রবর্ত্তী মহারাজার জামাতা হইবে ইহা অপেক্ষা সৌভাগ্যের বিষয় কি হইতে পারে?’

 —‘আমাকে না জিজ্ঞাসা করিয়াই আমাকে জড়াইবার চেষ্টা করিয়াছেন। বিবাহে আমার সম্মতি নাই।’

 —‘সঙ্গদোষে। বিবাহ হইলে সুবুদ্ধি হইবে।’

 রাজা রাগিয়া কহিলেন,—‘আপনার বড় স্পর্দ্ধা! যাহা মুখে আসিতেছে তাহাই বলিতেছেন!’

 —‘ব্রাহ্মণের মুখ কাহারও ভয়ে বন্ধ হয় না। সত্য কাহাকে ভয় করিবে?’

 রাজা উদ্যানে চলিয়া গেলেন। রাজমাতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিলেন না।

—৩—

 সন্ন্যাসীদের সহিত কিছু দূর গমন করিয়া উদয়ন নগরে প্রবেশ করিলেন। নিজের গৃহে না গিয়া রাজবাটীর নিকটে আর-একটি প্রাসাদে প্রবেশ করিলেন। ইহাতেও রাজবংশীয়েরা বাস করেন। এ-বাটীতে উদয়নের সর্ব্বদা যাতায়াত ছিল। বাহির বাটীতে কাহাকেও না দেখিতে পাইয়া উদয়ন অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলেন।

 গৃহকর্ত্রী মহাশ্বেতা প্রকোষ্ঠদ্বারে বসিয়াছিলেন। উদয়নকে স্বাগত জিজ্ঞাসা করিয়া বসিতে বলিলেন। কহিলেন,—‘তুমি যে কর্ম্ম শিখিতেছিলে তাহার কি হইল?’

 —‘শিক্ষা প্রায় শেষ হইয়াছে, এইবার কর্ম্ম আরম্ভ করিব।’

 —‘পূর্ব্বে সকলে রাজকর্ম্মের চেষ্টা করিত। এখন রাজার নিকটে কর্ম্ম প্রার্থনা করিতে কে যাইবে?’

 ‘কেমন রাজা জানেন ত?’

 —‘সে-কথায় কাজ নাই! হতভাগ্য রাজ্য, হতভাগ্য প্রজা!’

 তাঁহাদের কথোপকথন হইতেছে এমন সময় একজন যুবতী রমণী আসিয়া মহাশ্বেতার পাশে দাঁড়াইলেন। রমণী সুন্দরী, মহাশ্বেতার ভগিনীর কন্যা, পিতৃমাতৃবিয়োগ হওয়াতে মাসীর কাছে থাকেন। মহাশ্বেতা কহিলেন,—‘তোমরা কথা কও, আমি গৃহদেবতার কর্ম্ম সারিয়া আসি।’ এই বলিয়া তিনি উঠিয়া গেলেন।

 উদয়ন কহিলেন,—‘সুজাতা!’

 সুজাতা কহিলেন,—‘কি?’

 দুই জনে পরস্পরের প্রতি চাহিয়া দেখিতেছিলেন। উভয়েরই কিছু সঙ্কোচ, কিছু বাধার ভাব। দুই জনেই চক্ষু নত করিলেন।

 উদয়ন কহিলেন,—‘একটা কথা তোমাকে বলিতেছি, তোমার মাসী কিংবা অপর কেহ যেন জানিতে না পারেন। তাঁহাকে আমি কিছু বলি নাই।’

 সুজাতার কপোল ঈষৎ রক্তবর্ণ হইল, আবার সে-আভা মিলাইয়া গেল। কিছু উদ্বেগের সহিত জিজ্ঞাসা করিলেন,—‘কি কথা?’

 —‘রাজা আমার উপর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়াছেন।’

 সুজাতার মুখ মলিন হইয়া গেল, চক্ষে ভীতি-সঞ্চার হইল, হস্তের অঙ্গুলি কাঁপিল। কহিলেন,—‘রাজরোষ? কি অপরাধ?’

 —‘সব কথা তোমাকে বলিব বলিয়াই আসিয়াছি। আর কাহাকেও বলি নাই, বলিবও না।’

 উদয়নের সাগ্রহ দৃষ্টিতে সুজাতার চক্ষু আবার নত হইল, মুখ আবার আরক্তিম হইল।

 উদয়ন কহিলেন,—‘আজ বৈকালে প্রয়াগ-সঙ্গমে নির্গ্রন্থ নাথপুত্ত্র উপদেশ দিতেছিলেন, শ্রোতাদের মধ্যে আমিও ছিলাম।’

 —‘তিনি ত মহাপুরুষ, সকলেই জানে।’

 —‘সকলে ভক্তিপূর্ব্বক তাঁহার কথা শুনিতেছিল, এমন সময় রাজা তাঁহার কয়েক জন অসদাচারী বন্ধু লইয়া উপস্থিত।

 —‘রাজার আচরণে ত প্রজারা সকলেই ভয় পাইয়াছে।’

 —‘তাঁহারা আসিয়াই সাধুকে বিদ্রূপ ও অপমান করিতে লাগিলেন। গৌতম বুদ্ধদেবেরও নিন্দা আরম্ভ হইল। আমার অসহ্য বোধ হওয়াতে একটা কথা বলিলাম।’

 —‘কি বলিলে?’

 —‘আমি বলিলাম, সাধু-সন্ন্যাসীকে বিদ্রূপ করা রাজার পক্ষে অনুচিত। প্রজারা তাঁহার ব্যবহারে অসন্তুষ্ট, সে-কথাও বলিয়াছিলাম।’

 সুজাতা সভয়ে কহিলেন,—‘রাজার প্রকৃতি ত জান? তিনি ত কখন ক্ষমা করিবেন না। তাঁহার অসাধ্য কোন কর্ম্ম নাই। তোমাকে কিরূপ লাঞ্ছনা করিবেন, কে বলিতে পারে?’

 ‘তাই ত ভাবিতেছি। এখন উপায়?’

 —‘কিছু দিন আর কোথাও গিয়া বাস করিলে হয় না? রাজার বিবাহের কথা হইতেছে, বিবাহ হইলে শান্তপ্রকৃতি হইতে পারেন।’

 —‘কোথায় বিবাহের কথা হইতেছে?’

 —‘সন্ধ্যা হইবার পূর্ব্বে মগধরাজের দূত রাজপথ দিয়া রাজবাটীতে গিয়াছেন। মাসী বলিতেছিলেন, মগধরাজ তাঁহার ভ্রাতুষ্পুত্ত্রীর সহিত রাজার বিবাহের প্রস্তাব করিয়াছেন।’

 —‘রাজমাতার মুখে শুনিয়া থাকিবেন?’

 —‘সেইরূপ অনুমান হয়।’

 —‘তুমি যে স্থানান্তরে যাইতে বলিতেছ, কোথায় যাইব? যে-কর্ম্ম শিখিয়াছি দুই চারি দিনে আরম্ভ করিবার কথা। এখন যদি কোথাও চলিয়া যাই, যাঁহার সহিত কর্ম্ম করা স্থির হইয়াছে তিনি কি বলিবেন?’

 —‘রাজা এখন ক্রুদ্ধ হইয়াছেন, কখন কি করিয়া বসেন, তাহার ত স্থিরতা নাই! তুমি কর্ম্ম আরম্ভ করিলে, এমন সময় সহসা যদি তোমায় কারাবন্দী করেন কিংবা আর কোন শাস্তি দেন তাহা হইলে তুমি কি করিবে? তখন ত কর্ম্ম বন্ধ হইয়াই যাইবে, তুমিও বিপদে পড়িবে।’

 —‘তুমি যেমন বলিতেছ সেইরূপ করিব। আমার বন্ধুকে বলিয়া কাল বারাণসী চলিয়া যাইব।’

 —‘আজ রাত্রে কোন আশঙ্কা নাই ত?’

 —‘রাত্রে গৃহে থাকিব না, আর কোথাও গিয়া শয়ন করিব।’

 —‘সেই কথা ভাল।’

 কিছুক্ষণ কথা স্থগিত হইল। আবার উদয়ন কহিলেন,—‘সুজাতা!’

 —‘উদয়ন!’

 —‘আমাদের নিজের একটা কথা আছে।’

 সুজাতা নখে নখ খুঁটিতে লাগিলেন, কোন কথা কহিলেন না।

 —‘তুমি ত আমার মনের কথা জান।’

 সুজাতা পূর্ব্বরূপ। উদয়ন তাঁহার হস্ত ধারণ করিলেন, কহিলেন,—‘আমাদের বিবাহে ত কোন বাধা নাই। তুমি স্বীকৃত হইলেই হয়।’

 মুষ্টিমধ্যে ধৃত ক্ষুদ্র পক্ষিণীর ন্যায় উদয়নের হস্তের মধ্যে সুজাতার হস্ত কম্পিত হইতেছিল। মৃদুস্বরে কহিলেন,—‘এ-কথা আমাকে কেন বলিতেছ? এখন ত স্বয়ম্বরের প্রথা নাই যে, প্রকাশ্য সভায় তোমার গলায় আমি বরমাল্য পরাইয়া দিব।’

 উদয়ন সুজাতার হস্ত মুক্ত করিলেন। মহাশ্বেতা ফিরিয়া আসিলেন। উদয়ন তাঁহাকে কহিলেন,—‘বৈকালে বাহির হইয়াছি, এখনও গৃহে ফিরি নাই। অনুমতি হয় ত এখন গৃহে যাই।’

 মহাশ্বেতা সম্মিত মুখে কহিলেন,—‘এ কি তোমার গৃহ নয়?’

 —‘আপনাদের স্নেহেই ত আমি প্রতিপালিত।’

 উদয়ন বিদায় গ্রহণ করিলেন।

—৪—

 পর দিবস প্রাতে দূত মগধে ফিরিয়া যাইবেন সংবাদ পাইয়া রাজা বিরূপাক্ষ রাজপ্রাসাদে আসিলেন। তাঁহাকে দেখিয়া দূত কহিলেন,—‘বিবাহে আপনার সম্মতি জানিয়া মগধরাজ আনন্দিত হইবেন। শুভ দিন স্থির হইলে যথোচিত সমাদরের সহিত আপনাকে রাজধানীতে লইয়া যাইবেন।’

 ক্রোধে বিরূপাক্ষের সর্ব্বাঙ্গ জ্বলিয়া যাইতেছিল। কিন্তু ওঝার সম্মুখে সর্প ফণা তুলিয়া কি করিবে? প্রকাশ্যে রাজা কহিলেন,—‘কিছু দিন পরে হইলে ক্ষতি কি? ব্যস্ত হইবার কি প্রয়োজন?’

 —‘সে কি কথা মহারাজ! শুভ কর্ম্মে কি বিলম্ব করিতে আছে? আপনি লজ্জার অনুরোধে এমন কথা বলিতেছেন।’

 স্থির অথচ সতর্ক পুরোহিত পাশে দাঁড়াইয়াছিলেন। কহিলেন,—‘মগধরাজ যেরূপ আদেশ করিবেন, তাহাই হইবে।’

 রাজা একবার পুরোহিতের দিকে আর একবার দূতের দিকে চাহিয়া বাক্‌শূন্য হইয়া রহিলেন। দূত অনুচরগণের সঙ্গে চলিয়া গেলেন। তখন রাজা মনোভাব গোপন করিবার চেষ্টা না করিয়া সক্রোধে পুরোহিতকে কহিলেন,—‘এ সমস্ত আপনাদের ষড়যন্ত্র।’

 পুরোহিত কহিলেন,—‘ষড়যন্ত্র ত অসৎ কর্ম্মের জন্য করে। সদ্বংশে বিবাহের ব্যবস্থা করা কি অসৎ কর্ম্ম?’

 —‘বিবাহ করা-না-করা, যে কোন সময় করা আমার ইচ্ছা। বিবাহ আমি করিব না।’

 —‘মহারাজের ইচ্ছা; প্রতিশ্রুত হইয়া প্রত্যাখ্যান করিলে মগধরাজ কারণ জানিতে চাহিবেন।’

 —‘আমাকে আপনি শাসাইতেছেন?’

 —‘আমি দরিদ্র ব্রাহ্মণ, আমার সাধ্য কি মহারাজ! কিন্তু মগধরাজ রাজান্নে প্রতিপালিত পুরোহিত নহেন, এ-কথা আপনি কেমন করিয়া বিস্মৃত হইবেন?’

 রাজা ক্রুদ্ধ হইয়া প্রাসাদ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া পদব্রজে নগরে চলিলেন। তিনি একা যাইতেছেন দেখিয়া দুইজন ভল্লধারী রাজসৈনিক তাঁহার অনুবর্ত্তী হইল।

 উদয়ন প্রভাত-কালে উঠিয়া নিজের গৃহে আসিয়াছেন, রাত্রে কোন বন্ধুর গৃহে শয়ন করিয়াছিলেন। এখন যে ব্যক্তির সহিত কর্ম্ম করিবার কথা, তাহার গৃহে গমন করিতেছিলেন। পথে রাজার সহিত দেখা! উদয়ন পথ ছাড়িয়া দিয়া বিনীতভাবে অভিবাদন করিলেন।

 যে ক্রোধানল রাজার হৃদয়ে এতক্ষণ ভস্মাচ্ছাদিত ছিল, উদয়নকে দেখিবামাত্রই তাহা হবিযুক্ত হুতাশনের ন্যায় প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। রাজা গর্জ্জন করিয়া সৈনিকদ্বয়কে কহিলেন,—‘এই ব্যক্তিকে বন্দী কর!’

 সৈনিক দুইজন এমন চমকিয়া উঠিল যে, তাহাদের ভল্ল হস্ত হইতে পড়িতে পড়িতে রহিল। সংযত হইয়া একজন কহিল,—‘কাহাকে, মহারাজ?’

 প্রশ্নের কারণ ছিল। পথ সঙ্কীর্ণ, লোকের গমনাগমন ত ছিলই, আবার রাজার সিংহনাদ শুনিয়া পথিক চমকিত হইয়া দাঁড়াইল। দু‍ই চারিজন উদয়নের পাশেই দাঁড়াইল।

 রাজা অঙ্গুলি দিয়া উদয়নকে নির্দ্দেশ করিয়া দিলেন।

 সৈনিকেরা তখনও বুঝিতে পারে না। পথ চলিতে যাহাকে তাহাকে বন্দী করা কি রকম বিচার! উদয়ন চোর-দস্যু নহেন, সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান, রাজার জ্ঞাতি, কোথাও কিছু নাই, পথের মধ্যে তাঁহাকে বন্দী! রাজার মস্তিষ্কের বিকার হয় নাই ত! হয়ত রাত্রে প্রমোদের অধিক বাড়াবাড়ি হইয়া থাকিবে!

 নাগরিকগণও বিস্মিত হইয়া দেখিতে লাগিল। রাজার চরিত্র সকলেই জানিত, প্রজার শ্রদ্ধা দিনদিন হ্রাস হইয়া আসিতেছিল।

 একজন সৈনিক সাহস করিয়া জিজ্ঞাসা করিল,—‘কি অপরাধে, মহারাজ?’

 রাজা চীৎকার করিয়া উঠিলেন,—‘তোমরা আদেশ পালন করিবে, প্রশ্ন করিবার কে?’

 সৈনিক স্তব্ধ হইল। একজন পথিক কহিল,—‘আমরা জিজ্ঞাসা করিতে পারি, কি অপরাধে এই ব্যক্তিকে বন্দী করিতেছেন?’

 —‘তাহা হইলে তুমিও বন্দী হইবে।’

 পশ্চাৎ হইতে এক ব্যক্তি কহিল,—‘এমন রাজা না হইলে এমন বিচার করে কে? নগরসুদ্ধ লোককে বন্দী করিলেই ত হয়!’

 রাজা কহিলেন,—‘এ ব্যক্তি রাজদ্রোহী।’

 সৈনিকেরা উদয়নকে ধরিতে উদ্যত হইল। মাঝে আর কয়েকজন লোক আসিয়া পড়িল। একজন উদয়নের কানে কানে বলিতেছিল,—‘পশ্চাতে মহামায়ার মন্দির দেখিতে পাইতেছ না? মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ কর, সেখানে বন্দী করিবার আদেশ নাই।’ সে ব্যক্তি উদয়নকে পশ্চাৎদিকে ঠেলিতে লাগিল। মন্দিরের বৃহৎ দ্বার, তাহার পর প্রশস্ত প্রাঙ্গণ। উদয়ন বেগে প্রাঙ্গণ পার হইয়া, মন্দিরে প্রবেশ করিয়া দেবীমূর্ত্তির সম্মুখে সাষ্টাঙ্গে পতিত হইলেন। কহিলেন,—‘আমি ভীত, আমি দেবীর শরণার্থী!’

 মন্দিরের প্রধান পুরোহিত পঞ্চপ্রদীপ হস্তে দাঁড়াইয়াছিলেন। দীর্ঘ, সৌম্যমূর্ত্তি, দীর্ঘকেশ, শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখশ্রী, কোমল গভীর স্বরে কহিলেন,—‘বৎস, আশ্বস্ত হও, অশরণকে শরণ দিবার জন্যই মা আছেন।’

 উদয়নকে কহিলেন,—‘রাজা মিত্রদলের সহিত সন্ন্যাসীকে অবমাননা করাতে আমি আপত্তি করিয়াছিলাম। এই অপরাধে তিনি আমাকে রাজদ্রোহী বলিয়া বন্দী করিতে আসিতেছেন।’

 —‘এখানে?’

 —‘সৈনিকদিগকে লইয়া রাজা মন্দির প্রাঙ্গণে প্রবেশ করিয়া থাকিবেন।’

 —‘এখানে রাজরাজেশ্বরীর রাজ্য, এখানে রাজা-প্রজা সকলেই সমান।’ পুরোহিতের চক্ষু জ্বলিয়া উঠিল। 'মন্দির-প্রাঙ্গণে সৈনিক! রাজদ্রোহী? রাজা স্বয়ং যখন নিজের শত্রু, অপর শত্রু হইতে কতক্ষণ?’ অপর পুরোহিতকে কহিলেন,—‘আমি বাহিরে যাইতেছি, দ্বার রুদ্ধ কর। আমি না আসিলে দেবীর দর্শন হইবে না।’

 পুরোহিত বাহিরে আসিলেন। ভিতর হইতে দ্বার রুদ্ধ হইয়া গেল। রুদ্ধ দ্বারের সম্মুখে দাড়াইয়া পুরোহিত দেখিলেন, প্রাঙ্গণে লোক ঠেলিয়া প্রবেশ করিতেছে, সর্ব্বাগ্রে রাজা, হস্তে মুক্ত অসি, তাঁহার পশ্চাতে সৈনিক, সঙ্গে সঙ্গে জনতা-স্রোত। মন্দিরের দ্বার রুদ্ধ দেখিয়া সকলে থম্‌কিয়া দাড়াইল, কেবল রাজা দ্রুতপদে মন্দিরের অভিমুখে অগ্রসর হইলেন। সৈনিকেরাও অগত্যা তাঁহার অনুগমন করিল। রাজা কিছু বলিবার পূর্ব্বেই পুরোহিত মুক্ত কণ্ঠে সকলকে শুনাইয়া কহিলেন,—‘মহারাজ, অসি হস্তে সশস্ত্র সৈনিক সঙ্গে আপনি এখানে প্রবেশ করিয়াছেন, ইহা কি দেবীর স্থান, না শত্রুর রণস্থল?’

 বিরূপাক্ষ উন্মত্ত বলিলেই হয়। অসংযত যৌবন, সকল প্রকার অত্যাচার, তাহার উপর মগধরাজের দূতের ভয়ে সমস্ত রাত্রি আত্মনির্য্যাতন। রুদ্ধচিত্ত মুক্ত হইয়া রাজা ক্ষিপ্তের ন্যায় হইয়া উঠিলেন, কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্য জ্ঞান তিরোহিত হইল। কহিলেন,—‘আমি দেবীর মন্দিরে আসি নাই, পলাতক অপরাধীকে বন্দী করিতে আসিয়াছি।’

 পুরোহিত পূর্ব্বের ন্যায় উচ্চ কণ্ঠে কহিলেন,—‘এখানে কেহ কাহাকেও বন্দী করিতে পারে না। এ স্থান অভয়ার, ভীত ব্যক্তিকে তিনি অভয় দেন, শরণাগতকে শরণ দেন।’

 রাজা একেবারে মন্দিরের সোপানের উপর উঠিয়া, হস্তের অসি না নামাইয়া, তীব্র-রুক্ষ স্বরে কহিলেন,—‘ব্রাহ্মণ, পথ ছাড়! ভিতরে প্রবেশ করিব, দ্বার রুদ্ধ থাকে ভাঙ্গিয়া ফেলিব!’

 জনতা শিহরিয়া উঠিল। পুরোহিত দুই বাহু উত্তোলন করিয়া, দুই হস্তে বক্ষের কাষায়-বস্ত্র ছিঁড়িয়া ফেলিয়া, রাজার তরবারির সম্মুখে প্রশস্ত বক্ষ পাতিয়া দিলেন। তূর্য্যধ্বনির ন্যায় কণ্ঠনিনাদে কহিলেন,—‘প্রথমে ব্রহ্মহত্যা কর, তাহা হইলে দেবীর দ্বার সহজে ভাঙ্গিতে পারিবে।’

 সমবেত জনসঙ্ঘ হাহাকার করিয়া উঠিল।—‘সর্ব্বনাশ হইল! সর্ব্বনাশ হইল’ বলিয়া চীৎকার করিয়া উঠিল; অনেকে দুই হস্ত দিয়া শ্রবণ রোধ করিল, অনেকে মন্দিরের অভিমুখে ধাবিত হইল।

 সৈনিক দুই জন ভল্লে ভল্ল যোজনা করিয়া, পুরোহিতের সম্মুখে রাজার পথ রোধ করিয়া দাঁড়াইল। রাজা দন্তে দন্তে নিষ্পেষিত করিয়া কহিলেন,—‘তোমরাও রাজদ্রোহী, শূলে যাইবে।’

 —‘রাজদণ্ড মস্তকে পাতিয়া লইব, দেবীর অভিশাপের ভাগী হইতে পারিব না। দেবীর অপমান হইলে নগর ধ্বংস হইবে।’

 রাজা বিরূপাক্ষের ওষ্ঠে ফেন এবং ওষ্ঠ-প্রান্তে শোণিতবিন্দু দেখা দিল।

 প্রজাদিগকে পুরোহিত কহিলেন,—‘তোমাদের কোন চিন্তা নাই, তোমরা গৃহে ফিরিয়া যাও। দেবীর মর্য্যাদা তিনি স্বয়ং অক্ষত রাখিবেন।’

 প্রজারা চলিয়া গেল। তখন পুরোহিত রাজাকে কহিলেন,— ‘মহারাজ, আপনিও গৃহে ফিরিয়া যান। অনুতপ্ত হৃদয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করিলে মহামায়া প্রসন্ন হইবেন।’

 রাজা কোন কথা না কহিয়া উদ্যানে ফিরিয়া গেলেন।

—৫—

 রাজা বিরূপাক্ষের মনে ভয়ের সঞ্চার হইয়াছিল। মন্দিরে বলপূর্ব্বক প্রবেশ করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন বলিয়া দেবীর অভিসম্পাতের ভয়, তাহার অপেক্ষাও ভয় প্রজাদের অসন্তোষ ও বিরক্তি লক্ষ্য করিয়া। উদয়নকে তিনি বিনা কারণে রাজদ্রোহী বলিয়াছিলেন, এখন যদি সত্য সত্যই প্রজারা বিদ্রোহী হয়? দেবীকে তুষ্ট করিবার জন্য তিনি উদ্যান হইতে নগ্ন পদে, কাষায় বস্ত্র পরিধান করিয়া মন্দিরে গিয়া মহা সমারোহে দেবীর অর্চ্চনা করিলেন, দেবীকে ও পুরোহিতকে প্রণাম করিয়া মন্দিরে বহু অর্থ প্রদান করিলেন। প্রজাদিগের মনোরঞ্জন করিবার আশায় নানাবিধ উৎসবের আয়োজন করিলেন, উৎসবে আহারের ও বস্ত্রাদি দানের মুক্ত হস্তে ব্যবস্থা করিলেন। অপর দিকে বিলাসের মাত্রা বাড়িল, রাজকর্ম্মে কিছুমাত্র মনোযোগ নাই।

 উদয়নকে নগর ত্যাগ করিতে হইল না। সকল কথা শুনিয়া মহামায়ার মন্দিরের পুরোহিত তাঁহাকে আশ্বাস দিলেন যে, তিনি নির্ভয়ে থাকুন, আশঙ্কার কোন কারণ নাই। রাজা মন্দিরে আগমন করিলে তাঁহাকে নিভৃতে কহিলেন,—উদয়নকে শাস্তি দিবার বাসনা পরিত্যাগ করুন। দোষ আপনার, নিরপরাধী সন্ন্যাসীদিগকে অকারণে অবমাননা করিয়াছিলেন। ইহাতে আপত্তি করায় উদয়নের কি অপরাধ? সেখানে অপর লোক উপস্থিত ছিল, উদয়নের প্রতি অবিচার করিলে তাহারা সকল কথা প্রকাশ করিবে, প্রজাগণ আরও রুষ্ট হইবে।’

 রাজা উদারভাবে কহিলেন,—‘আমি উদয়নকে ক্ষমা করিয়াছি।’

 পুরোহিত স্মিতমুখে কহিলেন,—‘সেই কথাই উত্তম।’

 উদয়ন নিজের কর্ম্মে নিযুক্ত হইলেন। গৃহে মাতা ছিলেন, আর কেহ না। মধ্যবিত্ত সঙ্গতিপন্ন গৃহস্থ, বিশেষ কোন অভাব ছিল না, উদয়নের অলস স্বভাব নহে বলিয়া তিনি কর্ম্ম করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন মাতা কহিলেন,—‘উদয়ন, এইবার বিবাহ কর, নিজের সংসার কর, আমিও পুত্রবধূর মুখ দেখি।’

 উদয়ন হাসিতে লাগিলেন, কহিলেন,—‘বিবাহ কোথায় স্থির করিলে?’

 —‘পাত্রীর জন্য অধিক দূরে অন্বেষণ করিতে হইবে না। মহাশ্বেতার বোন-ঝি সুজাতা মেয়েটি দেখিতে মন্দ নয়, কি বল?’

 মাতার হাস্যপূর্ণ চক্ষু দেখিয়া উদয়ন মস্তক অবনত করিলেন। কহিলেন,—‘তুমি যেখানে স্থির করিবে সেখানেই বিবাহ করিব।’

 ‘তোমার নিজের কোন মতামত নাই?’

 অপ্রতিভ হইয়া উদয়ন কহিলেন,—‘আমারও মত আছে।’

 মাতা আনন্দে হাসিতে হাসিতে কহিলেন,—‘তোমার মত জানিয়াই সম্বন্ধ করিয়াছি।’

 —‘আমার মত কেমন করিয়া জানিলে?’

 —‘আমার চক্ষু আছে, মহাশ্বেতারও চক্ষু আছে, জানিতে কতক্ষণ?’

 আনন্দে উদ্বেলিত হৃদয়ে উদয়ন জননীকে প্রণাম করিলেন।

 সেই রাত্রে উন্নয়ন স্বপ্ন দেখিলেন। দেখিলেন, চারিদিকে নিবিড় অরণ্য, কণ্টকময় মহাতরুতে পরিপূর্ণ, অরণ্যে অসংখ্য সর্প ও শ্বাপদকুল বিচরণ করিতেছে। লোলজিহ্ব, নরমাংস-লোলুপ, বিপুলদেহ রাক্ষসগণ বিশাল বাহু প্রসারিত করিয়া ইতস্ততঃ ধাবিত হইতেছে। কোথাও আর্ত্ত প্রাণীর চীৎকার, কোথাও কম্পিতকায় জীবের পলায়ন। শোণিতের ন্যায় লোহিত রাগে আকাশ আচ্ছন্ন, বায়ুতে রোদনের স্বর প্রবাহিত হইতেছে।

 সহসা সেই ভয়াবহ স্থানে অভয় বাণী শ্রুত হইল। আকাশ নির্ম্মল হইয়া উজ্জ্বল স্বর্ণবর্ণ ধারণ করিল, ত্রাসসঙ্কুল অরণ্য অদৃশ্য হইল। দেবী মহামায়া উদয়নের সম্মুখে আবির্ভূতা হইলেন। মন্দিরে উদয়ন যে-মুর্ত্তি দেখিয়াছিলেন সে-মূর্ত্তি নহে, কিন্তু দেবী সেই, সংশয়ের লেশমাত্র রহিল না। পাষাণময়ী মূর্ত্তির পরিবর্ত্তে জ্যোতির্ম্ময়ী, মঙ্গলময়ী, করুণাময়ী মূর্ত্তি! উদয়নের প্রতি কোমল, স্নেহপূর্ণ দৃষ্টিপাত করিয়া কহিলেন,—‘ভীত হইয়া তুমি আমার নিকটে শরণ প্রার্থনা করিয়াছিলে। দেখিতেছ না, এ স্থানে নিত্য ভয়! আমার সঙ্গে আইস, আমি তোমাকে চিরাভয় প্রদান করিব।’

 দেবী অন্তর্হিতা হইলেন। গলদ্‌ঘর্ম্ম হইয়া উদয়নের নিদ্রাভঙ্গ হইল। অবশিষ্ট রাত্রি তাঁহার আর নিদ্রা হইল না। স্বপ্নে যাহা দেখিয়াছিলেন জাগ্রত হইয়াও বারবার তাহাই দেখিতে লাগিলেন। স্বপ্নদৃষ্ট প্রত্যেক দৃশ্য মানস-চক্ষে স্পষ্ট প্রতিবিম্বিত হইল।

—৬—

 প্রভাতে উঠিয়া উদয়ন স্বপ্নবৃত্তান্ত কাহাকেও বলিলেন না। নিত্যকর্ম্ম যেমন করিতেন সেইরূপ করিলেন। একবার মনে করিলেন, মন্দিরে গিয়া পুরোহিতকে স্বপ্নকথা বলিবেন, কিন্তু সে কল্পনা ত্যাগ করিলেন। কত সময় কত স্বপ্ন দেখা যায়, সকল স্বপ্নেরই কি অর্থ আছে?

 বৈকালে কর্ম্মস্থান হইতে ফিরিবার সময় উদয়ন নগরের বাহিরে অল্পক্ষণ ভ্রমণ করিতেছিলেন। অকস্মাৎ মেঘ উঠিয়া আকাশ অন্ধকার করিয়া আসিল। তাহার পরেই প্রবল ঝঞ্ঝা, ধূলিতে চারিদিক ভরিয়া গেল। ঝড়ের বেগ প্রশমিত হইবার অপেক্ষায় উদয়ন পথের পাশে বৃক্ষের তলায় দাঁড়াইল।

 ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকিল, তাহার পর মেঘগর্জ্জন। উদয়ন দেখিলেন, দূর হইতে একটা অশ্ব ভয়ে উচ্ছৃঙ্খল হইয়া ছুটিয়া আসিতেছে, অশ্বারোহী কোনমতে অশ্বকে সংযত করিতে পারিতেছে না। উদয়ন চিনিলেন, রাজা বিরূপাক্ষ, ভয়ে চক্ষু বিস্ফারিত, অশ্বপৃষ্ঠে স্থির হইতে পারিতেছেন না। উদয়ন মুহূর্ত্ত-কাল বিলম্ব না করিয়া, লম্ফ দিয়া অশ্বের বল্গা ধারণ করিলেন। অশ্ব লাফাইয়া উঠিয়া, কিছু দূর গিয়া স্থির হইল। রাজা বিরূপাক্ষ তৎক্ষণাৎ অশ্ব হইতে অবতরণ করিলেন। দেখিলেন, উদয়ন অশ্বের পদতলে পতিত হইয়াছে।

 দেখিতে দেখিতে অপর অশ্বারোহিগণ আসিয়া উপস্থিত হইল। উদয়নের উঠিবার ক্ষমতা নাই। রাজার আদেশে সত্ত্বর শিবিকা আনীত হইল। রাজা কহিলেন,—‘রাজপ্রাসাদে লইয়া চল।’

 উদয়ন ক্ষীণ স্বরে কহিলেন,—‘না, আমার নিজের গৃহে।’

 বাহকেরা উদয়নকে তাঁহার গৃহে লইয়া গেল। রাজা ও তাঁহার সঙ্গিগণ নীরবে শিবিকার সঙ্গে গমন করিলেন। গৃহে উপনীত হইয়া রাজা ও তাঁহার বন্ধুগণ উদয়নকে সাবধানে তুলিয়া গৃহের ভিতরে শয্যায় শয়ন করাইলেন। উদয়নের মাতা অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন,— ‘কি হইয়াছে?’

 রাজা সংক্ষেপে ঘটনা বিবৃত করিয়া কহিলেন, ‘আমাকে রক্ষা করিতে গিয়া উদয়ন আহত হইয়াছেন।’

 উদয়নের মাতা কহিলেন,—‘নিজের প্রাণ দিয়াও রাজাকে রক্ষা করা প্রজার কর্ত্তব্য।’

 উদয়নের প্রতি কিরূপ ব্যবহার করিয়াছিলেন স্মরণ করিয়া রাজা অধোবদন হইলেন।

 রাজবৈদ্য দেখিতে আসিলেন। উদয়নকে দেখিয়া, নাড়ী পরীক্ষা করিয়া বাহিরে আসিলেন। রাজাকে কহিলেন,—‘শরীরের ভিতর কোথাও গুরুতর আঘাত লাগিয়া থাকিবে। শ্বাসের লক্ষণ দেখিতেছি। রক্ষা পাইবার কোনও আশা নাই।’

 বৈদ্য চলিয়া গেলেন। পর দিবস প্রাতঃকালে আবার আসিবেন বলিয়া রাজাও বিদায় লইলেন।

 ঝটিকার পর আকাশ নির্ম্মল হইয়াছে। সূর্য্য অন্তপ্রায়। মৃদুমন্দ শীতল বায়ু বহিতেছে, তরুশাখায় পক্ষিগণ সন্ধ্যার বন্দনা করিতেছে। বাহিরে দিবাবসানে প্রকৃতির প্রশান্ত মূর্ত্তি, ভিতরে নিঃশব্দে মৃত্যুর আগমন!

 সংবাদ পাইয়া মহাশ্বেতা ও সুজাতাও আসিয়াছিলেন। মহাশ্বেতা উদয়নের মাতার সহিত উদয়নের শয্যাপার্শ্বে দাঁড়াইলেন, সুজাতা গৃহের মধ্যে প্রবেশ করিলেন না।

 উদয়নের মাতা শোক সম্বরণ করিবার চেষ্টা করিতেছিলেন, নীরবে অশ্রু মোচন করিতেছিলেন। মহাশ্বেতা অঞ্চলে চক্ষু মুছিতেছিলেন।

 নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে উদয়নের ক্লেশ হইতেছিল। মৃদুস্বরে কহিলেন,—‘মা, মহামায়া আমাকে ডাকিয়াছেন।’

 মহাশ্বেতা কহিলেন,—‘অমন কথা বলিতে নাই। মহামায়ার আশীর্ব্বাদে তুমি আবার সারিয়া উঠিবে।’

 উদয়নের মুখে অতি ক্ষীণ, অতি মধুর, অতি নির্ম্মল হাসি দেখা দিল। কহিলেন,—‘কাল রাত্রে দেবী স্বপ্নে আমাকে দেখা দিয়াছিলেন। একবার রাজার ক্রোধ হইতে রক্ষা পাইবার জন্য দেবীর মন্দিরে শরণ লইয়াছিলাম। স্বপ্নে দেবী চিরাভয় দিবার নিমিত্ত আমাকে দেবলোকে যাইতে আদেশ করিয়াছেন। আর অধিক বিলম্ব নাই, তোমরা দুই জননী আমাকে আশীর্ব্বাদ কর যেন মহামায়ার চরণে আমি মুক্তি লাভ করি।’

 উদয়নের মাতা ও মহাশ্বেতা কি বলিবেন? নীরবে অশ্রু বিসর্জ্জন করিতে লাগিলেন।

 কয়েক মুহূর্ত্তের পর উদয়ন কহিলেন,—‘একবার সুজাতা—’

 উদয়নের মাতা ও মহাশ্বেতা গৃহের বাহিরে গমন করিলেন। সুজাতা গৃহে প্রবেশ করিয়া শয্যাপার্শ্বে দাঁড়াইলেন। উদয়ন কহিলেন, ‘ব’স।’

 সুজাতা উদয়নের পাশে বসিলেন। চক্ষের জলে দেখিতে পাইতেছিলেন না। উদয়ন তাঁহার হস্তের উপর হস্ত রক্ষা করিলেন। সুজাতা দুই হস্তে তাঁহার হস্ত ধারণ কারলেন।

 উদয়নের কণ্ঠস্বর আরও ক্ষীণ হইয়া আসিতেছিল। কহিলেন, ‘সুজাতা, মহামায়ার আদেশ, তাঁহার কাছে আমাকে যাইতে হইবে।’

 সুজাতা মস্তক নত করিলেন, কথা কহিতে পারিলেন না। তাঁহার অশ্রু উদয়নের বক্ষে পতিত হইল।

 উদয়ন কহিলেন,—‘আর আমাদের দেখা হইবে না—ইহলোকে।’

 অশ্রুজড়িত স্বরে সুজাতা কহিলেন,—‘লোকান্তরে!’

 উদয়নের চক্ষে আলোক নির্ব্বাপিত হইয়া আসিতেছিল। কহিলেন,—‘বিদায়!’

 সুজাতার মুখ আরও নমিত হইয়া ওষ্ঠাধর উদয়নের ললাটে স্পৃষ্ট হইল।

 মরণোন্মুখ, মর্ম্মরিত বায়ুর ন্যায় উদয়নের শেষ নিশ্বাসের সহিত কথা আসিল,—‘ছায়ায়! ছায়ায়!’

 দেবীর করুণা ও মানবীর প্রেম মমতার ছায়ায় ছায়ায় উদয়ন আনন্দলোকে গমন করিলেন।


  1. নির্গ্রন্থ নাথপুত্ত্র প্রসিদ্ধ জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীর।