রথযাত্রা ও অন্যান্য গল্প/নির্ব্বন্ধ
নির্ব্বন্ধ
—১—
লাহোরের কেল্লা ও মহারাজ রণজিৎ সিংহের সমাধির মধ্য দিয়া যে-পথ সহর হইতে বাহির হইয়া আসিয়াছে, তাহার এক পাশে একখানা পাল্কী। পাল্কীর দরজা বন্ধ। সন্ধ্যা হইয়া আসিয়াছে। পাল্কীবেহারারা মুসলমান, তাহারা পথের ধারে পাল্কী রাখিয়া নিকটস্থ বাদশাহী মসজিদে নমাজ পড়িতে গিয়াছে।
কেল্লার ভিতর হইতে একজন গোরা বাহির হইয়া আসিয়া ছোট রাবী নদীর তীরের অভিমুখে যাইতেছিল। মুখ ফিরাইয়া দেখিল, পথের ধারে একখানা পাল্কী, নিকটে লোকজন নাই। সে কৌতূহলাবিষ্ট হইয়া পাল্কীর নিকটে গেল। পাল্কীর দরজা অল্প খোলা ছিল, গোরাকে আসিতে দেখিয়া যে পাল্কীর ভিতর ছিল সে ভিতর হইতে দরজা টানিয়া বন্ধ করিয়া দিল।
ঠিক সেই সময় সহরের ভিতর হইতে এক ব্যক্তি বাহির হইয়া আসিতেছিল। নবীন যুবা, দেখিতে সুপুরুষ, মাথায় পাগড়ী, গায়ে পাঞ্জাবী জামা, পরিধানে লুঙ্গী, পায়ে পাঞ্জাবী জুতা। আকৃতি খুব দীর্ঘ নহে, কিন্তু সর্ব্বাঙ্গ সুগঠিত, বর্ণ গৌর। ধীরপদক্ষেপে আসিতেছিল, কিন্তু গোরাকে পাল্কীর নিকটে যাইতে দেখিয়া দ্রুতপদে সেই দিকে গেল।
পাল্কীর নিকটে উপস্থিত হইয়া গোরা দরজা খুলিবার চেষ্টা করিল। যে পাল্কীতে ছিল, সে ভিতর হইতে দরজা চাপিয়া ধরিয়াছিল। গোরা বলপূর্ব্বক দরজা টানিয়া খুলিয়া ফেলিল। পাল্কীর ভিতর বুরকা দিয়া মুখ ঢাকা মহিলা। দরজা খুলিতেই সে ভয়ে অস্ফুট চীৎকার করিয়া উঠিল।
এমন সময় সেই যুবক আসিয়া গোরাকে ঠেলা দিয়া সরাইয়া দিল। রাগিয়া বলিল,—উল্লু, হারামজাদা, স্ত্রীলোককে বেআবরু করিতেছিস্?
পাল্কীর দরজা বন্ধ হইয়া গেল। একবারে চাপিয়া নহে, মাঝে একটু ফাঁক রহিল।
গোরা দশাসই প্রকাণ্ড বলিষ্ঠ জোয়ান, তাহার তুলনায় পাঞ্জাবী যুবা দেখিতে কিছুই নহে। গোরা বিস্মিত হইয়া একবার যুবকের দিকে চাহিয়া দেখিল, তাহার পরেই ‘ব্লাডি সোয়াইন’ বলিয়া মারিল এক ঘুঁষি। ঘুঁষি মারিল যুবকের চোয়াল লক্ষ্য করিয়া। ঘুঁষিবিদ্যায় ইহার নাম নক্ আউট্ ব্লো, লাগিলে যুবক অজ্ঞান হইয়া মাটিতে পড়িয়া যাইত।
ঘুঁষিটা লাগিল খুব জোরে বাতাসে আর সেই সঙ্গে গোৱা চিৎপাত হইয়া পড়িয়া গেল। গোরা ঘুষি তুলিতেই মল্ল-বিদ্যাকুশলী যুবক চকিতের মধ্যে তাহার পিছনে গিয়া তাহাকে তুলিয়া আছাড় দিল।
পাল্কীর ভিতর হইতে অতি-মধুর হাস্যধ্বনি শ্রুত হইল। গোরা মাটি হইতে উঠিবার সময় সে হাসি শুনিতে পাইল, যুবক মৃদু হাসিয়া একবার পাল্কীর দিকে চাহিল। দরজার ফাঁক দিয়া কৌতুকপূর্ণ বড় বড় কালো চক্ষু দেখা যাইতেছিল।
ভূতলে নিক্ষিপ্ত হইয়া ত গোরার রাগ হইয়াই ছিল, তাহার উপর রমণীর হাসি শুনিয়া সে ক্রোধে উন্মত্ত হইয়া যুবককে আবার আক্রমণ করিল। যুবক সতর্ক ছিল, গোরার পাশ কাটাইয়া, পাশ হইতে তাহার বাহু পিঠের দিকে মুচড়াইয়া, তাহার পায়ের ভিতর পা দিয়া আবার সজোরে তাহাকে মাটিতে ফেলিয়া দিল। এবার গোরার হাতে ও পায়ে আঘাত লাগিয়াছিল, উঠিতে কিছু বিলম্ব হইল।
পাল্কী বেহারারা নমাজ পড়িয়া ফিরিয়া আসিতেছিল। পাল্কীর নিকটে গোরা ও পাঞ্জাবী যুবককে দেখিয়া তাহারা ছুটিয়া আসিল। গোরা যুবককে তৃতীয়বার আক্রমণ করিবার চেষ্টা করিল না, গায়ের ধূলা ঝাড়িতে ঝাড়িতে গালি দিতে দিতে চলিয়া গেল।
বেহারাদের সঙ্গে একজন বৃদ্ধ লোক ছিল, বোধ হয় পুরাতন ভৃত্য। সে যুবককে জিজ্ঞাসা করিল, কি হইয়াছিল?
যুবক হাস্যমুখে বলিল,—গোরা পাল্কীর দরজা খুলিতেছিল, আমি তাহাকে কিছু শিক্ষা দিয়াছি।
পাল্কীর দরজা বন্ধ হইয়া গিয়াছিল, ভিতর হইতে রমণী অতিমৃদুস্বরে বৃদ্ধকে ডাকিল, সে পাল্কীর পাশে গিয়া মাথা নীচু করিয়া বলিল,—কি বলিতেছেন?
পূর্ব্বের মত মৃদুস্বরে পাল্কীর ভিতর হইতে রমণী কয়েকটা কথা বলিল, শুনিয়া বৃদ্ধ উঠিয়া আসিয়া যুবককে কহিল,—আপনি বিবির আবরু রক্ষা করিয়াছেন, এজন্য তিনি কৃতজ্ঞতা জানাইতেছেন। আপনি কি পাহালওয়ান?
যুবা হাসিয়া উঠিল, বলিল, না, আমি পাহালওয়ান নই, রাঁঝা পাহালওয়ানের কাছে অল্প-স্বল্প কুস্তি শিখিয়াছি। আমার এরূপ বেশ দেখিয়া তুমি জিজ্ঞাসা করিতেছ? আমি আখড়া হইতে আসিতেছি।
—রাঁঝা খুব বড় পাহালওয়ান, তাহার শাগরেদ হইয়া আপনি যে গোরাকে শিক্ষা দিয়াছেন, ইহাতে বিচিত্র কি? আপনার পরিচয় জিজ্ঞাসা করিতে কোন দোষ আছে?
—কিছু না। আমি নবীউল্লা খাঁর পুত্ত্র।
বৃদ্ধ ঝুঁকিয়া সেলাম করিল, কহিল,—আপনি খাঁ সাহেবের শাহজাদা? আপনাদের বংশ কে না জানে? আপনাদের সমান পুরাতন ও সম্ভ্রান্ত খানদান কয়টা আছে?
যুবক জিজ্ঞাসা করিল,—কোথাকার সোয়ারি? তোমরা কোথায় যাইবে?
—আমরা বিদেশী, রাবীর ধারে বারাদরীর কাছে রংমহল ভাড়া করিয়া আছি।
—সে বাড়ী আমি দেখিয়াছি, সে ত অট্টালিকা।
পাল্কী হইতে আবার অস্পষ্ট মৃদুস্বরে বৃদ্ধের ডাক পড়িল। সে উঠিয়া গিয়া ফিরিয়া আসিয়া বলিল, যদি কোন সময় বেড়াইতে বেড়াইতে ওদিকে যান, তাহা হইলে একবার আমাদের বাড়ীতে পদার্পণ করিলে আমরা চরিতার্থ হইব।
যুবক বলিল,—‘সে ত বড় খুসীর কথা!
বেহারারা পাল্কী উঠাইল, বৃদ্ধ পাল্কীর আগে আগে চলিল, যুবক এক পাশে রহিল।
পাল্কীর দরজা অল্প খুলিল, মুখের অবগুণ্ঠন অপসারিত করিয়া রমণী যুবকের দিকে চাহিল।
কোমল সলজ্জ দৃষ্টি, ওষ্ঠাধরে অর্দ্ধস্ফুট পুষ্পের ন্যায় হাসি। যুবক মস্তক নত করিয়া অভিবাদন করিল, রমণীও গ্রীবা ঈষৎ হেলাইয়া দরজা নিঃশব্দে বন্ধ করিল।
পাল্কী চলিয়া গেল। যুবা পথে দাঁড়াইয়া রহিল।
—২—
রাঁঝা পাহালওয়ানের সমকক্ষ কোন কুস্তিগীর ছিল না। বড় বড় সব পাহালওয়ান তাহার সঙ্গে কুস্তি করিয়া হারিয়া গিয়াছিল। রাঁঝার বয়স ৪৫ বৎসর হইবে, দীর্ঘাকৃতি সুপুরুষ, পাহালওয়ানদের মত পেটমোটা স্থূলশরীর নহে, সুডৌল নধর গঠন, অঙ্গের কোন স্থান কঠিন কিংবা কর্কশ দেখাইত না। কাপড়-চোপড় পরিয়া থাকিলে সাধারণ লোকের মত দেখাইত, অদ্বিতীয় বলবান মল্ল বলিয়া কাহারও মনে হইত না। সকল বিষয়ে তাহার সংযম ছিল, অতিরিক্ত আহার বা অন্য কোন দোষ ছিল না। কথাবার্ত্তায়, লোকের সঙ্গে ব্যবহারে বিনয়ী, নম্র, শান্ত। এই গুণে দেশ-বিদেশে তাহার যশ প্রথিত হইয়াছিল। কাছকৌপীন আঁটিয়া যখন মল্লভূমিতে নামিত, সে সময় আর এক মূর্ত্তি ধারণ করিত। চক্ষুতে সমরোল্লাসের জ্যোতি, নাসারন্ধ্র বিস্ফারিত, মসৃণ গৌরবর্ণ দেহ, অর্গলতুল্য বাহুযুগলে মাংসপেশী তরঙ্গায়িত হইত—রণদর্পে সিংহবিক্রমে প্রতিদ্বন্দ্বী মল্লকে আক্রমণ করিত।
রাঁঝার শিসংখ্যা বিস্তর, তাহাদের মধ্যে নবীউল্লা খাঁর পুত্র দাউদ তাহার বিশেষ প্রিয়পাত্র। রাঁঝা তাহাকে বলিত,—তুমি আমীর-বংশের সন্তান, পাহালওয়ানী করিতে পাইবে না। তোমাকে আমি যে-রকম শিখাইয়াছি, তাহাতে বড় পাহালওয়ান হইতে পারিতে। আখড়ায় তোমার সমান আর কোন শাগরেদ নাই। তুমি হয় ত আর বেশী দিন এখানে আসিতে পারিবে না। কিন্তু ব্যায়ামের অভ্যাস ছাড়িও না, অল্প-স্বল্প কসরৎ সর্ব্বদা করিবে। ধনীদের মত অলস অথবা বিলাসী হইও না।
দাউদ বলিল,—আপনার দোয়া থাকিলে আমার জীবন বৃথা যাইবে না। পাহালওয়ানী করিতে না পারি, পাহালওয়ানদের সহায়তা করিতে পারিব, বিলাসিতায় আমার কিছুমাত্র অভিরুচি নাই। আপনি শুধু আমার কুস্তির ওস্তাদ নন, আপনার কাছে আমি চরিত্রশিক্ষা লাভ করিয়াছি।
—সেই আসল জিনিষ। গায়ের জোর বাঘ-সিংহেরও হয়। চরিত্রবলেই মানুষ মানুষ হয়।
দাউদ বাপের একমাত্র পুত্ত্র-সন্তান, কাজেই, বাড়ীতে সকলকার আদুরে। কুস্তি শিক্ষা ধনি-সন্তানের উপযোগী নহে, কিন্তু দাউদের আগ্রহ দেখিয়া কেহ তাহাকে নিষেধ করিত না। তাহার পিতা রাঁঝাকে জানিতেন, দাউদ যণ্ডা চোয়াড় যুবাদের সঙ্গে মিশিত না, তাহাও দেখিয়াছিলেন। দাউদ লেখাপড়াও ভাল করিত, হাফিজের দেওয়ান কণ্ঠস্থ, শাহনামা আগাগোড়া পড়িয়াছিল, নিজেও কখন কখন গজল লিখিত। তাহার নির্দ্দোষ স্বভাব বলিয়া তাহাকে শাসন করিবার কোন প্রয়োজন হইত না।
উক্ত ঘটনার পরদিবস দাউদ খাঁ যথাসময়ে রাঁঝার আখড়ায় উপস্থিত হইল। তাহাকে দেখিয়া রাঁঝা বলিল, তোমাকে কিছু বিমর্ষ দেখিতেছি, তোমার শরীর সুস্থ আছে ত?
দাউদ বলিল, আমি বেশ আছি, আমার কিছুই হয় নাই।
এই বলিয়া লেঙ্গট আঁটিয়া দাউদ আখড়ায় নামিল। প্রথমে অপর কয়েক জন শাগরেদের সঙ্গে কুস্তি করিয়া তাহাদিগকে হারাইল, তাহার পর রাঁঝা নিজে দাউদের সঙ্গে কুস্তি আরম্ভ করিল। দুই জনে প্রায় তুল্যবল, আখড়ার অপর লোকেরা তাহাদের বল ও কৌশল উত্তমরূপে লক্ষ্য করিতে লাগিল। কুস্তির পর গায়ের ধূলা উত্তমরূপে ঝাড়িয়া দুই জনে কাপড় পরিল। তখন রাঁঝা বলিল,—চল, দাউদ, তোমার সঙ্গে একটু বেড়াইয়া আসি।
দাউদ কিছু বিস্মিত হইল; কেননা, সচরাচর রাঁঝা আখড়া হইতে বাড়ী যাইত, কোথাও ভ্রমণ করিতে যাইত না। পথে কিছু দূর গিয়া রাঁঝা বলিল,—তোমার শরীর ভাল থাকিলেও তোমার মন ভাল নাই। তোমার মুখ দেখিয়া আমি বুঝিতে পারিয়াছি, কুস্তির সময়ও তোমাকে অন্যমনস্ক দেখিয়াছি। কি হইয়াছে?
রাঁঝার শিক্ষা ছিল যে, শিষ্য গুরুর নিকট কোন কথা গোপন করিবে না। শাগরেদ ওস্তাদকে সকল কথা বলিবে, প্রয়োজনমত তাঁহার পরামর্শ গ্রহণ করিবে। দাউদ সকল শিষ্যের অপেক্ষা রাঁঝার প্রিয়, রাঁঝাকে সে সমস্ত কথা বলিত। সে বুঝিয়াছিল, রাঁঝা কৌতূহল নিবারণ করিবার জন্য কোন কথা জিজ্ঞাসা করে না, সে যথার্থই দাউদের হিত কামনা করে ও তাহার পরামর্শ গ্রহণ করিলে লাভ আছে। দাউদ অকপটে ওস্তাদকে সকল কথা বলিল।
গোরার লাঞ্ছনার বিবরণ শুনিয়া রাঁঝা অট্টহাস্য করিয়া উঠিল, কহিল,—আমি দেখিতে পাইলাম না, ইহাতে আমার ক্ষোভ হইতেছে। ঘুষি আর কুস্তির লড়াই দেখিবার সামগ্রী। পাল্কীতে স্ত্রীলোকটি কে?
—আমি জানি না, চাকরের মুখে শুনিলাম, উহারা বিদেশী; অল্পদিন হইল এখানে আসিয়াছে।
—তুমি তাহাকে দেখিয়াছ?
—পাল্কীর দরজা একটু খোলা ছিল, তাহাতে আমি দেখিয়াছি।
—রমণী তোমার বীরত্ব দেখিয়া তোমাকে দেখিতেছিল? সুন্দরী?
—হাঁ, সুন্দরী।
—তুমি তাহাদের বাড়ী যাইবে?
—যাইব ত বলিয়াছি, এখন ভাবিতেছি কি করিব।
—তাহাতে ক্ষতি কি? ভদ্র-ঘরের কন্যা হইলে দোষ কি? তবে মজনু আর লয়লার কাহিনী মনে আছে ত?
দাউদ কিছু লজ্জিত হইল, কহিল,—সে নিজে বোধ হয় আমার সহিত সাক্ষাৎ করিবে না। আমার যাওয়া উচিত কি না, ঠিক করিতে পারিতেছি না।
রাঁঝা জিজ্ঞাসা করিল,—বাড়ীতে এ-কথা বলিয়াছ?
—না, আপনাকে ছাড়া আর কাহাকেও বলি নাই। আপনি জিজ্ঞাসা করিলেন, তাই বলিলাম।
—তুমি যুবা পুরুষ, এখন পর্য্যন্ত বিবাহ কর নাই। তোমার চরিত্র নির্ম্মল আমি জানি, ধনি সন্তানের ন্যায় তুমি বিলাসপরায়ণ নও। যদি এই রমণী অবিবাহিতা, ভদ্রবংশজাতা হয়, তাহা হইলে উহার সহিত পরিচয় হইলে দোষের কিছু নাই। তাহার পর কি হইবে, সে পরের কথা।
সেদিন এই পর্য্যন্ত কথা রহিল। রাঁঝাকে তাহার বাড়ীতে পৌঁছাইয়া দিয়া দাউদ গৃহে ফিরিয়া গেল।
ওস্তাদের কাছে দাউদ সকল কথা বলিয়াছিল কি? যেমন যেমন ঘটিয়াছিল, তাহা বলিয়াছিল বটে, কিন্তু মন খুলিয়া মনের কথা বলিতে পারিয়াছিল কি? সে নিজেই ঠিক বুঝিতে পারিয়াছিল না, তাহার কি হইয়াছে, তবে কেমন করিয়া বলিবে? ইতিপূর্ব্বে কখন তাহার এরূপ ত হয় নাই। যে সমাজে পর্দ্দা, অপরিচিত স্ত্রীপুরুষে সাক্ষাৎ হওয়া কঠিন, তাহাদের মধ্যে এরূপ ঘটনা বিরল। ঘটনাচক্রেই রমণী দাউদের চক্ষুতে পড়িয়াছিল। গোরা যদি পাল্কীর দরজা না খুলিত, তাহা হইলে দাউদ রমণীকে দেখিতেই পাইত না। এমন কি, যাইবার সময় সে মুখের আবরণ খুলিয়া দাউদকে না দেখিলে দাউদ তাহার মুখ দেখিতে পাইত না। রমণীর নয়নে কিছু কৌতূহল—কিছু কৃতজ্ঞতার চিহ্ন। দাউদ সে সকল লক্ষণ বিশেষ করিয়া লক্ষ্য করিতে পারে নাই। সেই যে চকিতের মত একবারমাত্র দেখা, স্বপ্নদৃষ্ট ছায়ামূর্ত্তির মত তাহার মনে পড়িতেছিল। রমণী সুন্দরী, নব-যুবতী, কিন্তু তাহার মুখ দাউদ ভাল করিয়া দেখিতে পায় নাই। মেঘের আড়াল হইতে বিদ্যুৎ যেমন একবার ক্ষণমাত্র দেখিতে পাওয়া যায়, সেইরূপ দেখিয়াছিল। সর্ব্বাঙ্গ আবৃত, শুধু সেই মুখখানি একবার তাহার দৃষ্টিপথে বিকশিত হইয়া উঠিয়াছিল, ভাল করিয়া দেখিতে না দেখিতেই আবার অপসৃত হইল। সেই ক্ষণিকের দেখা, আবছায়ার মত সেই মুখের প্রতিকৃতি তাহার স্মৃতিকে বিচলিত করিয়াছিল। রমণী একবার যে হাসিয়াছিল, তাহার সেই মধুর তরঙ্গিত কণ্ঠধ্বনি দাউদের প্রাণে মুরলীনিঃস্বনের ন্যায় ধ্বনিত হইতেছিল। মনে মনে সেই মুখের চিত্র কল্পনা করিতে কিছু মনে পড়ে, কিছু পড়ে না। একবার সে মুখের ছবি মানস-চক্ষুর সম্মুখে উজ্জ্বল হইয়া উঠে, আবার তখনই মিলাইয়া যায়। অতৃপ্তির আকুলতা কেমন করিয়া নিবারিত হইবে? শুধু আর একবার দেখা! একবার চক্ষু ভরিয়া দেখিতে পাইলেই চক্ষুর পিপাসা মিটিবে, হৃদয়ের অশান্তি দূর হইবে, লালসার শান্তি হইবে। মনের এই আকাঙ্ক্ষা যে আত্মপ্রতারণা, দাউদের সে বিবেকশক্তি ছিল না। মোহের আবেশে অজ্ঞাতে তাহার হৃদয়কে আচ্ছন্ন করিতেছিল।
পরদিবস সায়ংকালে দাউদ আখড়ায় গেল না। উত্তম বেশভূষা ধারণ করিয়া অশ্বারোহণে রাবী নদী পার হইয়া রংমহলে উপনীত হইল। নূতন বৃহৎ বাড়ী, চারিধারে বাগান, শীতকালে বড় বড় চন্দ্রমল্লিকা ফুটিয়া বাগান আলো করিয়া রহিয়াছে, দেশী বিদেশী নানা জাতীয় ফুল, টবে নর্যাস ফুল, বাড়ীর সম্মুখে ঘাসের উপর বাঁধান ফোয়ারা, গাছে হরিতাল ঘুঘু।
ফটক পার হইয়া বাড়ীর সম্মুখে উপস্থিত হইয়া দাউদ ঘোড়া হইতে নামিল। সঙ্গে সহিস আসে নাই। দাউদ একটা গাছে ঘোড়া বাধিবার উপক্রম করিতেছে, এমন সময় এক জন ভৃত্য আসিয়া ঘোড়ার লাগাম ধরিল, বলিল, আমি ঘোড়া ধরিতেছি, আপনি ভিতরে যান।
হাতের চাবুক ভূতাকে দিয়া দাউদ সিঁড়ি উঠিয়া গৃহে প্রবেশ করিল। পাল্কীর সঙ্গে যে লোককে দাউদ দেখিয়াছিল ও যাহার সহিত কিছু কথা হইয়াছিল, সেই ব্যক্তি তাড়াতাড়ি আসিয়া বলিল,—সাহেব, আসুন আসুন, আমরা ভাবিয়াছিলাম, আপনি কালই আসিবেন।
দাউদ কিছু সঙ্কোচের সহিত কহিল,—কাল আসিতে পারি নাই। তোমরা ত এখানে কিছু দিন থাকিবে?
—হাঁ, জনাব। এ বাড়ী এক বৎসরের জন্য ভাড়া করা হইয়াছে।
—এ জায়গাও খুব ভাল। নিকটেই দেখিবার মত জাহাঙ্গীর শাহের ও নূরজাহানের কবর আছে, নিরালা স্থান, এ দিকে লোকজনের অধিক ভীড় নাই।
—এ বাড়ী দেখিয়া শুনিয়া ভাড়া করা হইয়াছে। সাহদরা আমরা দেখিয়া আসিয়াছি।
পুরাতন ভৃত্য, দাউদকে লইয়া গিয়া আর একটা ঘরে বসাইল। ঘরে উত্তম ফরাস পাতা, তাহার উপর বড় বড় তাকিয়া। দিব্য সাজান ঘর, দেয়ালে কাচের ফ্রেমে আঁটা সোনার অক্ষরে লেখা চারিদিকে কোরাণের বয়েৎ টাঙ্গানো রহিয়াছে।
দাউদ বসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, বাড়ীর মালিক কোথায়?
ভৃত্য হাসিয়া কহিল,—জনাবালি, মালিক ত কেহ নাই, মল্কাকে আপনি সেদিন অপমান হইতে রক্ষা করিয়াছিলেন, সঙ্গে কর্ম্মচারী আছে, সেই বিষয়-আশয় দেখে, হিসাব-পত্র রাখে, তাহাকে ডাকিয়া দিতেছি।
ভৃত্য চলিয়া গেল। দাউদ কিছু নিরাশ হইল। হয় ত তাহার মনে আশা ছিল যে, সেই ক্ষণদৃষ্টা সুন্দরীকে আবার দেখিতে পাইবে, হয় ত সে নিজে আসিয়া তাহাকে সম্ভাষণ করিবে, কিংবা অন্তরাল হইতে তাহাকে নিরীক্ষণ করিবে। দাউদ এদিক্ ওদিক্ চাহিয়া দেখিতে লাগিল। সেই ঘরে প্রবেশ করিবার কয়েকটি দরজা ছিল, দরজায় পর্দ্দা দেওয়া, সেই দিকে তাহার দৃষ্টি পড়িল। একবার কি একটা পর্দ্দা ঈষৎ আন্দোলিত হইল, অলঙ্কারের মৃদু নিক্কণ শ্রুত হইল? না, শুধু দাউদের কল্পনা, উৎকর্ণ শ্রবণের ভ্রম? দাউদ পর্দ্দার দিকে চাহিয়া দেখিতেছে, এমন সময় কর্ম্মচারী প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করিল।
তাহার বয়স হইয়াছে, দাড়ী-গোঁফে পাক ধরিয়াছে, দোহারা শরীর, আকৃতি মধ্যবিধ, ঘরে প্রবেশ করিয়া লম্বা সেলাম করিয়া কহিল,—সলাম ওয়ালেকুম।
—ওয়ালেকুম সলাম।
—আপনার মেজাজ ভাল আছে?
—আপনাদের কৃপায় ভালই আছি।
—আপনার বীরত্বের কথা শুনিয়াছি। আপনার জন্য বিরি সাহেবের আবরু রক্ষা পাইয়াছিল।
—সে সময় আমি উপস্থিত ছিলাম। ইহা আমার সৌভাগ্য।
—আপনার বংশের উপযুক্ত কাজ হইয়াছে। এখানে আমরা খাঁ সাহেবের নাম অনেক শুনিয়াছি। আপনার নাম শুনিবার সৌভাগ্য এ পর্য্যন্ত হয় নাই।
—আমার নাম দাউদ। আপনাদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করিবার এই আমার প্রথম অবসর হইল।
—বিবি সাহেবের পূর্ব্ব-পুরুষেরা ইরানবাসী। বড় খানদান, ওমরাহ শ্রেণী, বংশ পাঠান। বিবি সাহেবের প্রপিতামহের সহিত ইরানের শাহের বিবাদ হয়। সেই কারণে তিনি পারস্য দেশ ছাড়িয়া হিন্দুস্থানে চলিয়া আসেন। ইঁহারা দক্ষিণ দেশে কোঙ্কনে বাস করেন। সঙ্গে অনেক অর্থ ও বিস্তর জহরাত আনিয়াছিলেন, তাহার কিছু বিক্রয় করিয়া অনেক জমী-জমা খরিদ করিয়া প্রভূত সম্পত্তিশালী হইয়াছেন। বিবি সাহেবের পিতামহ নবাব উপাধি প্রাপ্ত হন। তিনি সম্পত্তি আরও বাড়াইয়া যান। বিবি সাহেবের বাল্যকালে তাঁহার মাতার মৃত্যু হয়, দুই বৎসর হইল পিতারও মৃত্যু হইয়াছে। এখন ইনি সমস্ত সম্পত্তির অধিকারিণী। ইঁহার পিতৃব্য মক্কায় হজ্ করিতে গিয়া সেইখানেই স্বর্গলাভ করিয়াছেন। আমি ইঁহাদের পুরাতন কর্ম্মচারী, জমীদারী দেখাশুনার ভার আমার উপর।
দাউদ জিজ্ঞাসা করিল,—আপনাদের এখানে আসিবার কারণ কি?
—সে বড় আপশোষের কথা। বিবি সাহেবের চাচা সাহেবের একমাত্র পুত্র সন্তান। ইঁহার মাতা নাই। বয়সে বিবি সাহেবের অপেক্ষা তিন চার বৎসরের বড়, ইঁহারই সহিত বিবি সাহেবের বিবাহ স্থির ছিল, হঠাৎ ইনি উন্মাদ হইয়া যান। এখানে হাকিম নসিরুদ্দীন উন্মত্তের উত্তম চিকিৎসা করেন জানিতে পারিয়া নবাবজাদা ফিরোজ খাঁকে এখানে আনা হইয়াছে।
—তাহা হইলে বিবি সাহেব এ পর্য্যন্ত অবিবাহিতা? দাউদের মুখ দিয়া হঠাৎ এই প্রশ্ন বাহির হইল। এরূপ প্রশ্ন করা সঙ্গত অথবা অসঙ্গত, সে-কথা বিবেচনা করিবার অবকাশ রহিল না।
কর্ম্মচারী কহিল,—কাজেই। একে এই দুশ্চিন্তা, তাহার উপর বিবি সাহেবের মাথার উপর কেহ নাই। তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমতী। সমস্ত কাজকর্ম্ম নিজে দেখেন, দপ্তরে বসিয়া কাগজপত্র পড়েন, কিন্তু এখন সব ছাড়িয়া এই দুর্ভাবনা উপস্থিত হইয়াছে।
—বিবি সাহেব ত পর্দ্দানশীন, তিনি দপ্তরে কেমন করিয়া বসেন?
কর্ম্মচারী হাসিল, বলিল,—দক্ষিণদেশে পর্দ্দা নাই, ইঁহাদেরও গৃহে পর্দ্দার প্রথা উঠিয়া গিয়াছে। সেখানে ইজার, পেশবাজ, বুরকা কিছুই নাই। বিবি সাহেব সাড়ী পরিয়া খোলা মোটরে বেড়াইতে যান। এখানে আসিয়া লোকনিন্দার আশঙ্কায় বেশ পরিবর্ত্তন করিয়াছেন। পর্দ্দায় রহিয়াছেন। পাছে আপনি তাঁহাকে প্রগল্ভা বিবেচনা করেন, এই কারণে তিনি এখন পর্য্যন্ত আপনার সহিত সাক্ষাৎ করেন নাই; নহিলে তিনি নিজের মুখে আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাইতেন।
দাউদ বাক্শূন্য। তাহার হৃদয় তাহার পঞ্জরাস্থিতে আঘাত করিতে লাগিল। মুখ রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল। অনেক চেষ্টায় কিছু সামলাইয়া অস্পষ্ট স্বরে কহিল,—তিনি অকারণে আমাকে অপরাধী করিয়াছেন। আমার সহিত সাক্ষাৎ করিলে তাঁহার কৃপা এবং আমার পরম সৌভাগ্য।
এবার পর্দ্দার আড়ালে অলঙ্কার-শিঞ্জিতের শব্দ স্পষ্ট শুনা গেল। অল্পবয়স্কা দাসী রূপার পাত্রে ফল, মিষ্টান্ন, শরবত, পানের ডিবা আনিয়া দাউদের সম্মুখে রাখিল। কহিল,—বিবি সাহেব আপনার জন্য এই সামান্য নাস্তা পাঠাইয়াছেন। তিনি আসিতেছেন।
—8—
কর্ম্মচারী দাউদকে সেলাম করিয়া উঠিয়া গেল। দাউদ সতৃষ্ণনয়নে যে দরজা দিয়া দাসী ঘরে প্রবেশ করিয়ছল, সেই দিকে চাহিয়া দেখিতে লাগিল। দাসী হাস্যমুখে বলিল,—আপনি কিছু খাইতেছেন না?
—এই যে খাইতেছি, বলিয়া দাউদ একটা আঙ্গুর তুলিয়া মুখে দিল।
এই সময় পর্দ্দা সরাইয়া রমণী ঘরে প্রবেশ করিল। দাউদ শশব্যস্তে উঠিয়া, মস্তক অবনত করিয়া অত্যন্ত সম্মানের সহিত তাহাকে অভিবাদন করিল। রমণী হাত তুলিয়া কহিল,—তসলীম। আপনি উঠিলেন কেন? বসুন।
দাউদ বসিল। উঠিবার সময় একবার রমণীর মুখের দিকে চাহিয়া দেখিয়াছিল, কিন্তু তাহার পর চক্ষু নত করিয়া রহিল।
দাসী বাহির হইয়া যায় দেখিয়া রমণী কহিল,—তুই এইখানে থাক্। দাউদকে কহিল,—আপনি কিছু খান, তার পর কথা হইবে।
দাউদ কিছু ফল, মিঠাই ও শরবত খাইয়া, হাত ধুইয়া, হাত মুছিল।
রমণী কহিল,—পাণ নিলেন না?
দাউদ একটা ছোট এলাচ তুলিয়া মুখে দিল, বলিল,—আমি পাণ খাই না।
—পাহালওয়ানরা কি পান খায় না?
আর একবার নিমেষের জন্য নয়নে নয়নে মিলিল, দাউদ লজ্জিত ভাবে কহিল,—আমি পাহালওয়ানের শাগরেদ মাত্র, পাহালওয়ানের সম্মুখে কিছুই নই।
—গোরারও মনে কি তাহাই হইয়াছিল?
বীণাবিনিন্দিত কলকণ্ঠে রমণী হাসিয়া উঠিল। পাল্কীর ভিতর হইতে সেই হাসি দাউদের স্মরণ হইল। দুই জনে পরস্পরের মুখের দিকে চাহিয়া সরল প্রকৃতি বালক-বালিকার মত হাসিতে লাগিল।
রমণী কহিল,—গোরা যখন পড়িয়া যায়, সেই সময়কার তাহার মুখের ভাব আমার কেবলই মনে পড়ে। মানুষ আকাশ হইতে পড়িলেও এত আশ্চর্য্যান্বিত হয় না। আপনাকে দেখিয়া সে ভাবিয়াছিল, এক ঘুষিতে আপনাকে গুঁড়া করিয়া দিবে।
—প্যাঁচের কাছে শুধু গায়ের জোর টেকে না।
—এ পর্য্যন্ত আপনার পরিচয় পাইবার সৌভাগ্য আমার হয় নাই। আমার নাম হানিফা।
—আমার নাম দাউদ, পাহালওয়ানি আমার পেশা নয়।
—আপনার বংশ-পরিচয় জানি। এরূপভাবে আপনার সহিত কথা কহিতেছি, আপনি নিশ্চিত আমাকে মুখরা মনে করিতেছেন।
দাউদ লজ্জায় অধোবদন হইল, কহিল,—আপনি এমন কথা কেন বলিতেছেন? পর্দ্দার প্রথা ত সকল দেশে নাই।
—যে দেশে আমরা থাকি, সেখানে মোটেই নাই। কাজকর্ম্ম উপলক্ষে আমাকে সকলের সঙ্গে কথা কহিতে হয়। স্ত্রীলোক হইলেই কি লুকাইয়া থাকিতে হইবে?
দাসী খাবারের পাত্র তুলিয়া লইয়া গেল। হনিফা কহিল,—এখনই ফিরিয়া আসিবি।
তৃতীয় ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে দুই জনের মুখ বন্ধ হইয়া গেল। লজ্জা আসিয়া দুই জনের মুখ আঁটিয়া দিল। হনিফার চক্ষু অবনত, অঙ্গুলিতে বস্ত্রাঞ্চল জড়াইতেছিল। সেই অবসরে দাউদ তাহার মুখের দিকে চাহিয়া তাহার রূপরাশি দেখিল, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কোমল সৌন্দর্য্য লক্ষ্য করিল। আবার যখন হনিফার চক্ষু উঠিল, তখন দাউদের দৃষ্টি আর এক দিকে, হনিফা তাহার মুখের অনিন্দ্য শ্রী, তাহার বক্ষের বিশালতা দেখিল। এইরূপে কয়েকবার চক্ষুর লুকাচুরী খেলা হইল, তাহার পর চুম্বকের আকর্ষণে যেমন লৌহ টানে, সেইরূপ চক্ষুর প্রতি চক্ষু আকৃষ্ট হইল, মিলিল, স্থির হইল। চোখে চোখে কি যে কথা হইল, তাহা তাহারাই জানে, কিন্তু মুখে যে-কথা বলিতে দিন ফুরাইয়া যায়, পলকের মধ্যে তাহা হইয়া গেল। হনিফার গণ্ডস্থল হইতে কান পর্য্যন্ত লাল হইয়া উঠিল, দাউদের মুখ পাণ্ডুবর্ণ হইয়া গেল। কয়েক মুহূর্ত্ত এইরূপে গেল, দুই জনের কেহই দৃষ্টি ফিরাইতে পারিল না, দুই জনের কাহারও মুখ ফুটিল না।
দাসী ফিরিয়া আসিল, উভয়ের দৃষ্টির টানা তার ছিঁড়িয়া গেল। দাউদ বলিল,—আপনার উজীর সাহেব, আপনার ভাইয়ের পীড়ার কথা বলিতেছিলেন।
—হ্যাঁ, সেই জন্যই আমরা এখানে আসিয়াছি। ফিরোজ ছেলেবেলা হইতেই কেমন-কেমন, এখন ত একেবারে মাথা খারাপ হইয়া গিয়াছে।
—হাকিম নসিরুদ্দীন দেখিয়াছেন?
—হাকিম সাহেব একবার আসিয়াছিলেন, আবার আসিবার কথা আছে। তিনি বলিয়াছেন, দুই চার বার না দেখিলে ঠিক বুঝিতে পারিবেন না, কিন্তু তাঁহার কথার আভাসে বোধ হয়, আরোগ্য হইবার আশা নাই। তাঁহার অনুমান, বাল্যকাল হইতেই মস্তিষ্কের দোষ ছিল, এখন রোগে দাঁড়াইয়াছে।
—কিছু ঔষধ দিয়াছেন?
—দিয়াছেন। আগে একেবারেই নিদ্রা হইত না, ওষুধ খাইয়া নিদ্রা হইতেছে। তবে হাকিম সাহেবের একটা কথায় আমরা কিছু ভয় পাইয়াছি।
—কি?
—তিনি বলিয়াছেন, রোগের লক্ষণে তাঁহার বিবেচনা হয়, দৌরাত্ম্য বাড়িবে; সেজন্য অত্যন্ত সাবধানে থাকিতে হইবে। দুই জন লোক আমরা সঙ্গে আনিয়াছি, তাহারাই ফিরোজকে সর্ব্বদা দেখে।
—দৌরাত্ম্যের লক্ষণ কিছু দেখা গিয়াছে?
—মাঝে মাঝে অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া মারিতে যায়, এক দিন লাঠি দিয়া একটা রক্ষকের মাথায় মারিতে গিয়াছিল, দুই জনে মিলিয়া অনেক কষ্টে লাঠি কাড়িয়া লয়। উন্মত্তের বল জানেন ত?
—তাহা হইলে ত বাড়ীর সকলকেই ভয়ে ভয়ে থাকিতে হয়?
—কতক কতক বটে, কিন্তু তাহার সঙ্গে সর্ব্বদাই লোক থাকে।
ঠিক এই সময় হঠাৎ একটা দরজা খুলিয়া গিয়া এক জন যুবক সেই ঘরে প্রবেশ করিল। যুবক দেখিতে সুপুরুষ হইলেও, কিন্তু তাহার কেশ-বেশ অসংযত, ঘূর্ণিত শূন্য দৃষ্টি, রক্ত চক্ষু, মুখের বিকৃত ভঙ্গী ও হস্ত-পদের আক্ষেপে তাহাকে বিকট-মূর্ত্তি দেখাইতেছে। দাউদ দেখিয়াই বুঝিল, এ ব্যক্তি আর কেহ নহে, উন্মাদগ্রস্ত ফিরোজ।
যুবক ঘরে প্রবেশ করিয়া, মাথা নাড়িয়া, হাত দোলাইয়া হনিফার দিকে চাহিয়া বার বার বলিতে লাগিল,—মস্তানা দিওয়ানা হুঁ ময় ইস্ক কা মারা হুঁ ময়! ময় মস্ত পরেশান গিরফতার হুঁ!
হনিফা তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাঁড়াইল, দাসীর দিকে ফিরিয়া ইসারায় জিজ্ঞাসা করিল,—রক্ষকরা কোথায়?
দাসী পর্দ্দা তুলিয়া, মুখ বাড়াইয়া ডাকিল,—আবদুল্লা! আলিজান!
যুবক অগ্রসর হইয়া হনিফার সম্মুখে আসিল। হনিফা ভীত হইয়া পিছাইয়া দাউদের নিকট গেল।
দাউদও উঠিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। ফিরোজ হাত বাড়াইয়া হনিফার বস্ত্র ধারণ করিতে উদ্যত হইয়াছে দেখিয়া সে হনিফা ও ফিরোজের মধ্যস্থলে আসিয়া দাঁড়াইল।
অকস্মাৎ পাগলের ভাবান্তর উপস্থিত হইল। দাউদকে দেখিয়া বিকট রবে চীৎকার করিয়া উঠিল,—দুশমন, মেরা দুশমন! তাহার পরেই লম্ফ দিয়া দাউদের গলা টিপিয়া ধরিল।
হনিফা ঘরের এক কোণে সরিয়া গিয়াছিল, দাসী রক্ষকদের নাম করিয়া চীৎকার করিতে লাগিল।
কুস্তির প্যাঁচ না জানিলে দাউদ বিপদে পড়িত। উন্মত্তের একে কাণ্ডজ্ঞান নাই, তাহার উপর উন্মত্ততায় অসীম বল। দাউদ একটা ঝটকা দিয়া নিজের গলা ছাড়াইয়া লইল, তাহার পর অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সহিত ফিরোজের স্কন্ধ ধারণ করিয়া ঘুরাইয়া পিছন হইতে তাহার দুই হাত মুচড়াইয়া ধরিল। ফিরোজ ঘাড় ফিরাইয়া দাউদকে কামড়াইবার চেষ্টা করিতে লাগিল, লাথি পিছন দিকে মারিতে লাগিল, কিন্তু হাত ছাড়াইতে পারিল না। দাউদ তাহার পিঠে হাঁটু দিয়া চাপিয়া তাহাকে বেকায়দায় ফেলিল।
রক্ষক দুই জন ছুটিয়া আসিল। তাহারা আসিয়াই ফিরোজকে দুই জনে দুই দিক্ হইতে ধরিল। দাউদ তাহাকে ছাড়িয়া দিল। ফিরোজ কেবল চীৎকার করিতেছিল,—দুশমনকো মারুঙ্গা, দুশমনকো মারুঙ্গা!
আর কোন আশঙ্কা নাই দেখিয়া হনিফা যেখানে বসিয়াছিল, সেইখানে আসিয়া রক্ষকদ্বয়কে বলিল,—তোমরা নিজের কাজে এমন গাফিল হইলে চলিবে না।
এক জন বলিল,—সাহেবা, নবাবজাদা নিজের ঘরে বসিয়াছিলেন, আমরা দরজার কাছে ছিলাম। ভিতর দিকার দরজা খুলিয়া কখন চলিয়া আসিয়াছেন, আমরা কিছু জানিতে পারি নাই।
—এখন হইতে তোমরা ঘরের ভিতর থাকিবে।
—যো হুকুম।
হনিফা বলিল,—ফিরোজ!
পাগলের আবার অন্য ভাব হইল, হাত দিয়া চক্ষুর সম্মুখ হইতে কি যেন সরাইয়া দিয়া কহিল,—কেন?
এখন বেশ শান্ত ভাব, বলপ্রকাশের কোন চেষ্টা নাই। হানিফা কহিল,—তুমি গিয়া শান্ত হইয়া থাক, তাহা হইলে তোমাকে মোটরে করিয়া বেড়াইতে পাঠাইয়া দিব।
—আচ্ছা, বলিয়া ফিরোজ রক্ষকদের সঙ্গে চলিয়া গেল। দরজার কাছে গিয়া, মুখ ফিরাইয়া দাউদকে দেখিয়া ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া বিড়বিড় করিয়া দুশমন বলিতে বলিতে চলিয়া গেল।
দাউদের পোষাক এক স্থানে ছিঁড়িয়া গিয়াছিল। হনিফা অপ্রতিভ হইয়া বলিল,—আপনাকে এখানে আসিতে বলিয়া ভাল করি নাই। আপনার কাপড় নষ্ট হইয়াছে, পাগল আপনাকে আঘাতও করিতে পারিত।
দাউদ বলিল,—ও-কথার উল্লেখ করিবেন না। আমাকে এখানে আসিতে নিষেধ করিলে আমার প্রতি অত্যন্ত কঠোর আদেশ করা হইবে।
হনিফা মৃদু মন্দ মধুর হাসি হাসিয়া দাউদের প্রতি কটাক্ষপাত করিল। দাউদের হৃদয়ে যেন অমৃত সিঞ্চিত হইল।
একটু পরে দাউদ উঠিল। হনিফা তাহার সঙ্গে দ্বারদেশ পর্যন্ত আসিল। কহিল,—আমার বিশ্বাস, আমাকে রক্ষা করিবার জন্যই আপনি আমাকে দেখা দেন।
দাউদ হনিফার মুখের দিকে চক্ষু তুলিল, দৃষ্টিতে প্রশ্ন।
হনিফা বলিল,—প্রথম দিন আপনি আমাকে অপমান হইতে রক্ষা করিয়াছিলেন, আজ আমাকে উন্মত্তের হস্ত হইতে রক্ষা করিয়াছেন। ফিরোজ যখন আমাকে ধরিতে আসিয়াছিল, সে সময় তাহার অবস্থা বন্য পশুর ন্যায়।
দাউদ কহিল,—সৌভাগ্য আমার একার, আমার জীবনে নূতন আলোক প্রবেশ করিয়াছে।
বিদায়ের সময় হনিফা হাত বাড়াইয়া দিল। দাউদ সেই কুসুমকোমল হাত নিজের হাতে লইল।
অল্পে অল্পে হাত উঠাইল, অল্পে অল্পে তাহার মাথা নত হইল, তাহার ওষ্ঠাধর হনিফার হস্তে স্পৃষ্ট হইল। হনিফার হাত কাঁপিল, দাউদের হাতের ভিতর রহিল।
যাইবার সময় দাউদ একবার মুখ ফিরাইল, আবার চারি চক্ষুর কোমল মিলন, চক্ষুর নিকট চক্ষুর বিদায়।
—৫—
সেই দিন হইতে দাউদের জীবন-স্রোত আর এক খাতে প্রবাহিত হইল। প্রেমের বন্যা আসিয়া তাহার হৃদয়কে ভাসাইয়া লইয়া গেল। শয়নে, স্বপনে, জাগরণে একই মূর্ত্তি তাহার মানস-দৃষ্টিতে সমুদিত হইত, একই নাম অনুক্ষণ তাহার হৃদয়তন্ত্রীতে ঝঙ্কারিত, ধ্বনিত হইত। হনিফা, হনিফা, হনিফা! হনিফার মুখ সর্ব্বদা তাহার নয়নসমক্ষে সমুজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের ন্যায় প্রতীয়মান হইত,—তাহার হৃদয়াকাশ আলোকিত করিত। হনিফার চক্ষুর জ্যোতিঃ তাহার মানস-পথে বিচ্ছুরিত হইত। সেই করকমলের স্পর্শ স্মরণ করিয়া তাহার হস্ত কম্পিত হইত। এই অভূতপূর্ব্ব, অচিন্তনীয় আকুলতা দাউদ কিছুতেই নিবারণ করিতে পারিত না, করিবার চেষ্টাও করিত না। সেই এক চিন্তাতেই তাহার অসীম আনন্দ, আবার সেই চিন্তাতেই অসহ্য যন্ত্রণা। আনন্দ স্মৃতিতে, যন্ত্রণা পুনরায় দর্শনের বিলম্বে। তাহার আত্মসংযম তিরোহিত হইয়া আসিতেছিল।
প্রতিদিন অপরাহ্ণ কালে দাউদ আখড়ায় যাইবার জন্য গৃহ হইতে বাহির হইত, কিন্তু সেখানে যাওয়া হইত না। অনির্দ্দিষ্ট ভাবে চলিতে চলিতে রাবীর অভিমুখে চলিয়া যাইত, আবার পথে থমকিয়া দাঁড়াইত। কিসের ছলে নিত্য হনিফার বাড়ী যাইবে? হানিফা অসন্তুষ্ট না হইলেও তাহার গৃহে অপর লোকজন আছে, তাহারা কি মনে করিবে, কি বলিবে? একবার ঘটনাক্রমে হনিফার যৎসামান্য উপকার করিয়াছিল বলিয়া কি দাউদ যখন-তখন তাহার গৃহে যাইতে পারে? আবার ভাবিত, হনিফা অপ্রসন্ন না হইলে আর কাহারও কথায় কি আসিয়া যায়? হানিফা স্পষ্টাক্ষরে দাউদকে আবার যাইতে বলে নাই সত্য, কিন্তু তাহার দৃষ্টিতে কি আহ্বান ছিল না? বিদায়ের সময় হনিফা মুখে কিছু না বলিলেও চক্ষুর ভাষায় দাউদকে আবার আসিতে বলিয়াছিল।
কয়েক দিন দাউদ রংমহলে গেল না। এদিক ওদিক ঘুরিয়া ঘুরিয়া ক্লান্ত হইয়া বাড়ী ফিরিয়া আসিত। তিন চার দিন পরে এক দিন মধ্যাহ্নের পর রাঁঝা দাউদকে দেখিতে আসিল। দাউদ অত্যন্ত সম্মানের সহিত তাহাকে নিজের ঘরে লইয়া গেল।
ঘরে বসিয়া রাঁঝা জিজ্ঞাসা করিল,—কয়েক দিন তুমি আখড়ায় যাও নাই কেন? তোমার শরীর কি অসুস্থ?
—না, আমার কোন অসুস্থ করে নাই, আলস্যের কারণ কয় দিন যাইতে পারি নাই।
—সে কোন কাজের কথা নয়। তোমাকে অন্যমনস্ক দেখিতেছি। তুমি কি সেই রমণীর গৃহে গিয়াছিলে?
—এক দিন গিয়াছিলাম।
—তাহার সহিত সাক্ষাৎ হইয়াছিল?
—হইয়াছিল। তাহারা দক্ষিণ দেশে বাস করে, সেখানে জেনানার পর্দ্দা নাই।
—বাড়ীতে আর কে আছে?
—লোক-জন, কর্ম্মচারী আছে, বাপ-মা নাই। সম্পত্তি তিনি নিজেই দেখেন। এক পাগল ভাই আছে, তাহারই চিকিৎসার জন্য উহারা এখানে আসিয়াছে।
—রমণীর প্রতি তোমার অনুরাগ জন্মিয়াছে?
দাউদ কোন উত্তর করিল না, মস্তক অবনত করিয়া মৌন হইয়া রহিল।
রাঁঝা বলিল,—ইহাতে দোষের কিছু দেখি না। সম্ভ্রান্ত বংশের মহিলা, অবস্থাপন্ন, তোমরা যদি পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হও, তাহা হইলে বিবাহে বাধা কি?
—পিতামাতার অনুমতি না হইলে কেমন করিয়া বিবাহ হইবে? রমণীর মনোভাবও আমি জানি না। তাহাকে দুইবার মাত্র দেখিয়াছি, বিবাহের প্রসঙ্গ কেমন করিয়া হইবে?
—তোমাদের দুই জনের মনের কথা পরস্পরের জানিতে কতক্ষণ? মনের মিল কুস্তির প্যাঁচের মতন, তড়ি-ঘড়ি বাঁধিয়া ফেলে। মনে মনে মনের ভাব তুমি কত দিন চাপিয়া রাখিবে? খোলাখুলি কথা কহিয়া ঠিক করিয়া ফেল। তোমার পিতামাতার আপত্তির কোন কারণ দেখি না। তুমি আজ সেখানে যাও, অবসর হয় কথা পাড়িবে; নহিলে আর কাহাকেও জিজ্ঞাসা করিয়া জানিবে, রমণীর আর কোথাও বিবাহের কথা হইয়াছে কি না।
রাঁঝা দাউদকে উৎসাহিত করিয়া চলিয়া গেল। দাউদ নিজেই প্রতিদিন যাইবার জন্য ব্যস্ত হইত, কেবল লজ্জার শাসনে আত্ম-নিবারণ করিত। ওস্তাদের পরামর্শ তাহার হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষার অনুরূপ, বৈকালে সে বাহির হইয়া পড়িল। আজ আর ঘোড়ায় চড়িল না, বাইসিকেল ছিল, তাহাতে করিয়াই চলিয়া গেল।
অল্প অল্প মেঘ করিয়াছে, অস্তমান সূর্য্য মাঝে মাঝে মেঘের ভিতর দিয়া দেখা যাইতেছে। লাল মেঘের ছায়া রাবীর জলে পড়িয়াছে, থাকিয়া থাকিয়া তাহার উপর সূর্য্যের আলোক চিক্মিক্ করিতেছে। রাবীর ধারে পঁহুছিয়া দাউদ দেখিল, সেই বিশালকায় গোরা দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। যদি সে আবার আক্রমণ করে, তাহা হইলে বাইসিকেলে থাকিলে দাউদের অসুবিধা, এই বিবেচনা করিয়া সে বাইসিকেল হইতে নামিল।
গোরা কট্মট্ করিয়া দাউদের দিকে চাহিয়া রহিল, মারামারি করিবার উপক্রম করিল না। দাউদ তাহার নিকটে গিয়া পকেট হইতে একখানা দশ টাকার নোট বাহির করিয়া তাহার হাতে দিল।
গোরা অবাক্ হইয়া গেল। নোটখানা উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিয়া ভাঙ্গা হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করিল,—এ কি হইবে?
দাউদ হাসিয়া কহিল,—ওখানা তোমার, বিয়ার পান করিও।
গোরার বিস্ময় তখনও অপনীত হয় নাই। নোটখানা আস্তে আস্তে পকেটে পূরিল। দাউদ আবার বাইসিকেলে উঠিল। তখন গোরা মনের আনন্দে গান ধরিল,—হী ইজ এ জলি গুড ফেলো!
—৬—
রংমহলে উপনীত হইয়া দাউদ সিঁড়ির পাশে বাইসিকেল রাখিয়া বারান্দায় উঠিল। দেখিল, পাশের একটা ঘরের জানালার পাখি খুলিয়া ফিরোজ তাহাকে দেখিতেছে। ফিরোজের ঘূর্ণিত লোহিত চক্ষু, মুখে পৈশাচিক ক্রোধের চিহ্ন। দাউদকে দেখিয়া বদ্ধমুষ্টি তুলিয়া তাহাকে শাসাইল। দাউদ কিছু না বলিয়া অন্য দিকে মুখ ফিরাইল।
সেই পুরাতন ভৃত্য আসিয়া পূর্ব্বে দাউদকে যে-ঘরে বসাইয়াছিল, সেই ঘরে লইয়া গেল। বলিল,—আপনি বসুন, আমি খবর দিতেছি।
ভৃত্য চলিয়া যাইবার একটু পরেই দাসী আসিল। সে সেলাম করিয়া বলিল,—বিবি সাহেব গোসল-খানায় আছেন, এখনি আসিতেছেন। আপনি অপরাধ লইবেন না।
দাউদ বলিল,—আমি না হয় একটু অপেক্ষা করিলাম, তাহাতে কি হইয়াছে?
দাসী দাঁড়াইয়া রহিল। দাউদের মুখের দিকে চাহিয়া বলিল,—খাঁ সাহেব, আপনি এত দিন আসেন নাই কেন? আমরা কত কি ভাবিতেছিলাম। বিবি সাহেব মনে করিতেছিলেন, হয় ত সেদিন নবাবজাদার কাণ্ড দেখিয়া আপনি কিছু বিরক্ত হইয়াছেন, সেই কারণে আর আসেন নাই।
—পাগলের কাণ্ড দেখিয়া কে আবার কি মনে করে? আমি এমনি আসি নাই। আমার কি ঘন ঘন আসা উচিত? লোকে কি মনে করিবে?
—কে আবার কি মনে করিবে? আপনি আসিলে সকলেই খুসী হয়। সেখানে বিবি সাহেবের অনেক কাজ, তবু সকলের সঙ্গে দেখা করিতেন। এখানে কাজ-কর্ম্ম কিছু নাই, বিবি সাহেব রোজ বেড়াইতেও যান না, আপনাকে তিনি যথেষ্ট খাতির করেন; আপনি আসিবেন, তাহাতে আবার কথা কি?
—আমাদের এখানে পর্দ্দা আছে কি না, তাই আমার মনে একটু খটকা লাগে।
দাসী খুঁতিতে আঙ্গুল দিয়া মাথা নাড়িয়া একবার হাসিল; বলিল,—আপনার এখানে আসিতে কি লজ্জা বোধ হয়?
দাউদ ও হাসিল, কহিল,—লজ্জা কেন হইবে? তবে আমি ত অপরিচিত লোক বলিলেই হয়, বার বার আসিলে তোমরাই বিরক্ত হইতে পার।
—শেষে আমরাই অপরাধী হইলাম! আপনার এখানে আসিতে ইচ্ছা করে না?
—আমার রোজ আসিতে ইচ্ছা করে, কিন্তু যাহা ইচ্ছা করে, তাহাই কি করা উচিত?
—অন্যায় হইলে করা উচিত নয়, কিন্তু এখানে আসা কি আপনার অন্যায় মনে হয়?
—আমার কেন, অপর লোকের কথা ভাবিতেছি।
—অপর লোকের জন্য কিসের ভাবনা? আপনার দিল ও বিবি সাহেবের দিল রাজি হইলেই হইল।
দাউদের মুখ লাল হইয়া উঠিল, বলিল,—এমন কথা শুনিলে বিবি সাহেব রাগ করিতে পারেন।
দাসী বলিল,—আমি কি না জানিয়া বলিতেছি? আচ্ছা, খাঁ সাহেব, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, রাগ করিবেন না। আপনার কি শাদি হইয়াছে?
—না, ও-কথা আমি কখন ভাবি না।
—আপনি এমন নওজোয়ান, এমন সুপুরুষ, আপনার বাড়ীতে ও-কথা উঠে না?
—উঠিলেও আমি কানে তুলি না। ও-কথা ছাড়িয়া দাও।
দাসী দাউদের নিকটে আসিয়া চুপি চুপি বলিল,—বিবি সাহেবকে আপনার শাদি করিতে ইচ্ছা করে? যেমন খুবসুরত—তেমনি গুণবতী।
দাউদ বলিল,—অমন কথা বলিতেছ কেন? নিজের দেশ ছাড়া অন্য দেশে কেন তাঁহার বিবাহ হইবে?
—নিজের দেশের একমাত্র পাত্র ত নবাবজাদা ফিরোজ। তিনি ত পাগল হইয়াছেন, তাঁহার কথা ছাড়িয়া দিন্। বিবি সাহেব মুখে কিছু না বলিলেও তাঁহার মন আমি বুঝিতে পারিয়াছি। তিনি প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় আপনার পথ দেখেন। এখন আমি যাই, বিবি সাহেবের কাপড় বাহির করিয়া দিতে হইবে।
দাসী চলিয়া গেলে দাউদের চিত্ত অত্যন্ত চঞ্চল হইয়া উঠিল; দাসী কি তাহার সঙ্গে কৌতুক করিতেছিল, না সত্য কথা বলিতেছিল? নিজের মনোভাব দিয়া দাউদ হনিফার মনের ভাব কেমন করিয়া বুঝিবে? সেদিন হনিফার দৃষ্টিতে কি দেখা দিয়াছিল? অনুরাগের জ্যোতি—না, শুধু কৃতজ্ঞতার ছায়া?
হনিফা ঘরে প্রবেশ করিতেই দাউদ উঠিয়া দাঁড়াইল। হনিফা বলিল,—এত দিন আপনি আসেন নাই কেন? সেদিন ফিরোজের উৎপাতে আপনি বিরক্ত হন নাই ত?
দাসী হনিফার পিছনে আসিয়া দরজার কাছে দাঁড়াইয়াছিল।
দাউদ বলিল,—বিলক্ষণ! এমন কথা মনে করিবেন না। এখানে আসিবার আমার সম্পূর্ণ ইচ্ছা, তবে সর্ব্বদা কি আমার আসা উচিত?
—কেন, তাহাতে কি দোষ আছে?
হনিফা দাউদের নিকটে আসিয়া হাসিয়া বলিল,—আমার রক্ষার ভার আপনার উপর, সে-কথা কি ভুলিয়া গিয়াছেন? এই কয় দিনের মধ্যে যদি আমার আর কোন বিপদ হইত?
হনিফা আসিয়া দাউদের সম্মুখে বসিল। তাহার কথা শুনিতে বিদ্রূপের মত, কিন্তু সেই সঙ্গে ব্যগ্রতার ভাবও মিশ্রিত ছিল। তাহার কথা শুনিয়া ও তাহাকে বসিতে দেখিয়া দাসী নিঃশব্দে দরজা ভেজাইয়া দিয়া চলিয়া গেল।
দাসী চলিয়া গেল—দাউদ দেখিতে পাইল। হনিফার মুখের দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া মৃদুস্বরে কহিল,—তোমাকে চিরকাল রক্ষা করিবার অধিকার কি আমাকে অর্পণ করিবে?এমন কথার অর্থ কি হইতে পারে? দাউদ হনিফাকে আপনি না বলিয়া তুমি বলিল কেন? হনিফাও ফিরিয়া দেখিল দাসী নাই, দরজা ভেজান রহিয়াছে। হনিফার চক্ষু কোমল হইয়া আসিল, কম্পিত স্বরে কহিল,—তোমাকে অদেয় আমার কিছুই নাই।
দাউদ হনিফার হস্তধারণ করিল, কহিল,—আমি তোমাকেই প্রার্থনা করি। আমাকে বিবাহ করিবে?
—তোমাকে দেখিয়াই আমি আত্মসমর্পণ করিয়াছি। কিন্তু আমি বিদেশিনী, এখানে সকলের কাছে অপরিচিতা। তোমার পিতামাতা অসন্তুষ্ট হইতে পারেন, আমাদের বিবাহে সম্মত হইবেন কি না বলিতে পারি না। আমার কথা স্বতন্ত্র। আমাকে নিষেধ করিবার কেহ নাই।
—আমার পিতামাতাও কোন আপত্তি করিবেন না। তাঁহারা আমার চরিত্র জানেন। তোমাকে দেখিবার পূর্ব্বে আমি কখন নারীর প্রেম জানিতাম না। এখন তুমি আমার শুধু চোখে নহে—আমার হৃদয়ে রহিয়াছ, তোমার দর্শন-লালসা আমাকে আকুল করিয়াছে।
—আমি প্রতিদিন তোমার পথ চাহিয়া থাকি। তোমাকে কয় বারই বা দেখিয়াছি, তবু মনে হয়, তুমি চির-পরিচিত, চির-প্রিয়। এত দিন আমার প্রাণ যেন নিদ্রিত ছিল, তোমাকে দেখিয়া জাগিয়া উঠিয়াছে। যেদিকেই দেখি, তোমাকে দেখিতে পাই; তুমি যেন আমাকে ডাকিতেছ, সকল প্রকার আশঙ্কা হইতে আমাকে রক্ষা করিতেছ।
দাউদ হনিফাকে আলিঙ্গন করিয়া তাহাকে চুম্বন করিল। হনিফার মস্তক দাউদের স্কন্ধে ন্যস্ত হইল।
এমন কতক্ষণ গেল। বসন্ত বাতাসের মর্ম্মরের ন্যায় দুই জনে মৃদু মৃদু কথা কহিতে লাগিল, প্রেমের পুরাতন বারতা, বার বার প্রিয় সম্বোধন, আবার নীরবে নয়নে নয়নে কথা। কতক্ষণ পরে হানিফা দাউদের বাহুবন্ধনমুক্ত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, কহিল,—অন্ধকার হইয়া আসিল, এতক্ষণ আমরা একা রহিয়াছি।
হানিফা কল টিপিয়া বিদ্যুতের আলোক জ্বালিয়া দিল। দাউদ কহিল,—তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিত থাকিবার কিছু আবশ্যক আছে?
হনিফা কহিল,—আছে বৈ কি! আমি কি নির্ল্লজ্জের ন্যায় অন্ধকারে পরপুরুষের সহিত বসিয়া গল্প করিব?
—পরই ত আপন হয়।
—সে পরের কথা, বলিয়া দরজা খুলিয়া হনিফা দাসীকে ডাকিল।
দাউদ বলিল,—আমি এখন যাই।
হনিফা দাউদের হাত ধরিল, জিজ্ঞাসা করিল,—আবার কবে আসিবে?
—যত শীঘ্র পারি।
—কত শীঘ্র?
—কাল।
দাসী আসিয়া দেখে, দুইজনে হাত ধরাধরি করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। দাউদ হনিফার হাত ছাড়িয়া দাসীর সঙ্গে বাহিরে আসিল। তাহাকে বলিল,—একটা নূতন খবর হয়ত তোমার মনের মত হইবে। তোমার বিবি সাহেবকে আমি বিবাহ করিব।
দাসী মস্ত লম্বা সেলাম করিয়া কহিল,—শাদি মোবারক! এ বড় খুশ খবর!
—৭—
বাড়ীর বাহিরে আসিয়া দাউদ দেখিল, অন্ধকার হইয়াছে। সে বাইসিকেলের আলো জ্বালিয়া তাহাতে উঠিয়া ধীরে ধীরে ফটকের দিকে চলিল। পথে এক স্থানে বড় বড় গাছের তলায় অত্যন্ত অন্ধকার। দাউদ এক পাশ দিয়া আস্তে আস্তে বাইসিকেল চালাইতেছিল।
হঠাৎ পশ্চাতে বিকট চীৎকার শুনিয়া দাউদ বাইসিকেল হইতে লাফাইয়া পড়িল। সে বুঝিতে পারিল, ফিরোজ কোন রূপে প্রহরী দুই জনকে এড়াইয়া তাহার পিছনে আসিয়াছে। চীৎকার করিয়াই ফিরোজ দাউদকে আক্রমণ করিল। তাহার হাতে ছিল একটা ছুরি। যেমন ছুরি তুলিয়া সে দাউদের বক্ষে আঘাত করিবে, অমনি গাছের শিকড়ে পা লাগিয়া পড়িয়া গেল। পড়িবার সময় ছুরি দাউদের ঊরুস্থলে বিদ্ধ হইল। দাউদ ফিরোজের হাত হইতে ছুরি কাড়িয়া লইয়া দূরে নিক্ষেপ করিল। ক্ষতস্থান হইতে বেগে রক্ত ছুটিল।
রক্ষক দুই জন ফিরোজকে খুঁজিতেছিল, চীৎকার শুনিয়াই ছুটিয়া আসিল। দাউদ রুমাল বাহির করিয়া ক্ষতস্থানে বাঁধিতেছিল, রক্ষকদিগকে দেখিয়া বলিল,—আমার পায়ে ছুরি মারিয়াছে, তোমরা ইহাকে সাম্লাও।
রক্ষকেরা তখনি ফিরোজকে বাঁধিয়া ফেলিল। আহত হইয়া দাউদ মাটীতে বসিয়া পড়িয়াছিল, রক্তস্রাবে তাহার শরীর অবসন্ন হইয়া আসিতেছিল। উঠিবার চেষ্টা করিতে গিয়া মূর্চ্ছিত হইয়া পড়িল।
আবার যখন তাহার চৈতন্য হইল, তখন দেখে, ঘরের ভিতর পালঙ্কে সে শয়ন করিয়া আছে, ক্ষতস্থান আঁটিয়া বাঁধা, শয্যার পাশে হনিফা, দাসী ও কর্ম্মচারী। হানিফা ও দাসীর নয়নে অশ্রু বহিতেছে।
দাউদের মুখ কিছু ম্লান হইয়া গিয়াছে, কিন্তু ক্লেশের আর কোন চিহ্ন নাই। হাসিয়া কহিল,—তোমরা কাঁদিতেছ কেন? কি হইয়াছে?
হানিফা অশ্রু সম্বরণ করিয়া চক্ষু মুছিয়া কহিল,—আমার বাড়ীতে আসিয়া তোমার এইরূপ হইল! তোমার পিতা আসিলে তাঁহাকে আমরা কি বলিব?
—আমার পিতার আসিবার কি প্রয়োজন?
কর্ম্মচারী বলিল,—অপনার গুরুতর আঘাত লাগিয়াছে, এ সংবাদ কি তাঁহার নিকট গোপন করা যায়? তাঁহাকে ও ডাক্তারকে আনিবার জন্য মোটর পাঠান হইয়াছে, তাঁহারা এখনি আসিবেন।
দাউদ বলিল,—সামান্য আঘাত লাগিয়াছে, সেজন্য আপনারা এত চিন্তিত হইয়াছেন কেন? আমাকে বাড়ী পাঠাইয়া দিলেই হইত, যাহা বলিবার আমি নিজেই বলিতাম।
—আপনাকে কি অচৈতন্য অবস্থায় পাঠাইয়া দেওয়া যায়?
—আমার মাথা ঘুরিয়া গিয়া থাকিবে। রক্ত ছুটিলে ওরূপ হয়, কিন্তু ও কিছুই নয়। অমন চোট কত লাগিয়া থাকে।
কর্ম্মচারী বলিল,—ডাক্তারের আসিবার সময় হইল, আমি তাঁহাদিগকে লইয়। আসি।
কর্ম্মচারী বাহিরে গেল। হনিফা দাউদের পাশে খাটে বসিল। তাহার চক্ষুতে কেবল অশ্রু পূরিয়া আসিতেছিল। বলিল,—এমন জানিলে তোমাকে কখন এখানে আসিতে বলিতাম না। তোমার পিতা শুনিয়াই বা কি বলিবেন? তিনি আমাদিগকে তোমার শত্রু মনে করিবেন। তুমি সারিয়া উঠিয়া গৃহে যাও, তাহা হইলেই আমি নিশ্চিন্ত হই। বিবাহের কথা স্বপ্নতুল্য হইল।
দাউদ হনিফার হাত ধরিল। হাসিয়া বলিল, স্বপ্ন সত্য হইবে। তুমি দেখিও হয় কি না।
বাহিরে মোটরের শব্দ হইল। দাউদ বলিল, তোমরা পর্দ্দার আড়ালে দাঁড়াও, তাহা হইলেই সব দেখিতে শুনিতে পাইবে।
হনিফা ও দাসী ভিতরকার দরজার পর্দ্দার পিছনে গিয়া দাঁড়াইল।
কর্ম্মচারীর পশ্চাতে নবীউল্লা খাঁ ও ডাক্তার ঘরে প্রবেশ করিলেন। নবীউল্লার বয়স হইয়াছে, কিন্তু অধিক বৃদ্ধ হন নাই। গম্ভীর মূর্ত্তি, শান্ত পুরুষ, এখন উদ্বেগে আননে চিন্তার চিহ্ন। গৃহে প্রবেশ করিয়া কহিলেন,—অন্য কোন কথা হইবার পূর্ব্বে ডাক্তার সাহেব দেখুন।
ডাক্তারের সঙ্গে আর এক জন লোক আসিয়াছিল, সেও ব্যাগ হাতে করিয়া পিছনে পিছনে আসিল।
গরম জল, গামলা, বাসন পূর্ব্ব হইতেই প্রস্তুত ছিল। ব্যাগ হইতে একটা স্পিরিটের আলো বাহির করিয়া, একটা বাটিতে কয়েকটা অস্ত্র ডাক্তারের লোক তপ্ত জলে ফুটাইতে আরম্ভ করিল।
বন্ধন খুলিয়া ডাক্তার ক্ষতস্থান দেখিলেন। তখনও অল্প অল্প রক্ত পড়িতেছে, বন্ধন খুলিয়া দেওয়াতে আবার বেগে রক্ত ছুটিল। কাটার মুখ চাপিয়া ধরিয়া ঔষধ দিয়া ডাক্তার রক্তস্রাব বন্ধ করিলেন। তাহার পর পরীক্ষা করিয়া কহিলেন,—শির কাটিয়া যায় নাই, হাড়েও লাগে নাই। ভাল করিয়া ধুইয়া ক্ষতস্থান সেলাই করিয়া কাটার মুখ বন্ধ করিতে হইবে। কিছু বেশী লাগিবে, ঔষধ দিয়া রোগীকে অজ্ঞান করিলে যন্ত্রণা টের পাইবে না।
দাউদ বলিল,—আমাকে অজ্ঞান করিবার কোন প্রয়োজন নাই। আপনার যাহা করিবার হয় করুন।
—তুমি যাতনা সহ্য করিতে পারিবে?
—পারি কিনা, আপনি দেখিলেই বুঝিতে পারিবেন।
দাউদের পিতা কহিলেন,—ও যেমন বলিতেছে, আপনি সেইরূপ করুন, কোন চিন্তা করিবেন না।
ডাক্তার ক্ষতস্থান উত্তমরূপে পরিষ্কার করিয়া, তাহার ভিতরে রবারের সরু নল দিয়া, ক্ষতমুখ সেলাই করিয়া, আঁটিয়া ব্যাণ্ডেজ করিয়া দিলেন। দাউদ দুই একবার অল্প মুখ বিকৃত করিল, কিন্তু মুখে যন্ত্রণার কোন শব্দ করিল না। ডাক্তার তাহার হাতের মাংসপেশী টিপিয়া কহিলেন,—তুমি খুব বাহাদুর! তুমি কি পাহালওয়ান না কি?
নবীউল্লা খাঁ কহিলেন,—রাঁঝার আখাড়ায় কুস্তি শেখে।
—আমিও তাই ভাবিতেছিলাম যে, আঘাত সহ্য করা অভ্যাস না থাকিলে এমন নিশ্চিন্তভাবে অস্ত্র করাইতে পারে না। আর কোন ভাবনা নাই। পরশু ব্যাণ্ডেজ খুলিয়া বদলাইয়া দিব। দিন দশেকের মধ্য্যে সারিয়া যাইবে।
নবীউল্লা খাঁ বলিলেন,—এখন তবে আমি উহাকে বাড়ী লইয়া যাই?
ডাক্তার বলিলেন,—ইহাকে এখন কোনমতে নাড়াচাড়া করিতে পারা যায় না, তাহা হইলে আবার রক্ত ছুটিবার ও অন্য আশঙ্কা আছে। পাঁচ ছয় দিন বিছানা হইতে কোনমতে উঠিতে দেওয়া হইবে না।
—তাহা হইলে আমাকেও এখানে থাকিতে হইবে।
—আপনার থাকিবার কোন আবশ্যক নাই, আপনি দুই বেলা আসিয়া দেখিয়া যাইবেন।
—তাহাই হইবে।
ডাক্তারের সঙ্গে ঘরের বাহিরে গিয়া নবীউল্লা তাঁহার হাতে টাকা দিতে গেলেন, ডাক্তার কোনমতে টাকা লইলেন না। তাহার কারণ, যে-ব্যক্তি ডাক্তারকে ডাকিতে গিয়াছিল, সে বলিয়া দিয়াছিল, তাঁহার প্রাপ্য হনিফা বিবি চুকাইয়া দিবেন, তিনি যেন দাউদের পিতার নিকট কোনমতে টাকা গ্রহণ না করেন।
নবীউল্লা বলিলেন,—এখন যদি না লয়েন, তাহা হইলে পরে আমাকে বিল পাঠাইবেন।
—সে পরে দেখা যাইবে।
ডাক্তার ফিরোজকে দেখিতে গেলেন। নবীউল্লা ফিরিয়া আসিয়া পুত্রের কাছে বসিলেন। বলিলেন,—কর্ম্মচারীর মুখে আমি সকল কথা শুনিয়াছি। তুমি যে এখানে আসা-যাওয়া কর, আমরা ত তাহার কিছু জানিতাম না।
—এখানে ত আমি বেশী বার আসি নাই। পরে আপনাকে সকল কথা জানাইতাম।
—এখানে আসিবার কথা কাহাকেও বলিয়াছ?
—আজ্ঞা হাঁ, রাঁঝাকে বলিয়াছি?
—তাহার সঙ্গে তোমার সকল কথা হয় বটে। সে লোক ভাল।
আমার ওস্তাদ। অমন সৎ লোক বড় দেখিতে পাওয়া যায় না।
—যে তোমাকে ছুরি মারিয়াছিল, সে উন্মাদ পাগল। দেখিলাম, তাহাকে বাঁধিয়া রাখিয়াছে।
—অল্প দিন হইল উৎপাত করিতে আরম্ভ করিয়াছে। আমাকে দেখিয়াই বিনা কারণে ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিয়াছিল। প্রহরীরা সতর্ক থাকিলেও কোথা হইতে একটা ছুরি আনিয়া আমাকে আক্রমণ করিয়াছিল।
—পাগলের কারণ-অকারণ বুঝিতে পারা যায় না। যে রমণী এই গৃহের কর্ত্রী, তাঁহার সহিত তাহার বিবাহের কথা ছিল, না?
—এরূপও শুনিয়াছি। কিন্তু উন্মাদ সারিবার আশা নাই। হাকিম নসিরুদ্দীন বিশেষ আশা দেন নাই।
নবীউল্লা দাড়ীতে হাত বুলাইতে বুলাইতে দাউদের মুখ নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। গলা নীচু করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন,—তুমি রমণীকে দেখিয়াছ?
—দেখিয়াছি। তাঁহারা দাক্ষিণাত্যে থাকেন, সেদিকে পর্দ্দা নাই।
দাড়ীর ভিতর অঙ্গুলি চলিতেছিল। নবীউল্লার দৃষ্টি দাউদের মুখের দিকে, আপনার মনে যেন বলিতে লাগিলেন,—সুন্দরী, না? ইরানের সম্ভ্রান্ত বংশ, সম্পত্তিশালিনী, বুদ্ধিমতী। বয়স কত হইবে?
দাউদ একটু ভাবিয়া বলিল,—ঠিক বলিতে পারি না। কুড়ি বৎসর হইতে পারে।
নবীউল্লা ও-কথা ছাড়িয়া দিলেন। বলিলেন,—এখানে থাকিতে তোমার কোন কষ্ট হইবে না ত?
—কিসের কষ্ট? আমার উঠিতে নিষেধ, যেখানেই থাকি—পড়িয়া থাকিতে হইবে।
—আমি রাত্রে তোমার কাছে থাকিব?
—আপনার যেমন ইচ্ছা, কিন্তু ডাক্তার বলিয়াছেন, আপনার থাকিবার কোন প্রয়োজন নাই।
—তবে আমি যাই। তোমার চাকরকে এখনি পাঠাইয়া দিতেছি। কাল ভোরে আসিব। তোমার মাও আসিবেন। তিনি কত কি ভাবিতেছেন। তাঁর আসা দরকার।
দাউদের অঙ্গে হাত বুলাইয়া নবীউল্লা খাঁ চলিয়া গেলেন।
—৮—
যেমন নবীউল্লা বাহির হইয়া গেলেন, অমনি হনিফা ও দাসী দাউদের ঘরে প্রবেশ করিল। হনিফা আঙ্গুল তুলিয়া বলিল,—তুমি বেশী কথা কহিও না, ডাক্তর কথা কহিতে বারণ করিয়াছে। তুমি ত সকলের সঙ্গে কেবলি কথা কহিতেছ।
—বাপের সঙ্গে কথা কহিব না? কাল আমার মা আসিবেন, জান ত?
—জানি। জানিবার জন্যই ত পর্দ্দার আড়ালে দাঁড়াইয়া ছিলাম। তোমার বাবা আমার বয়স জানিতে চাহিলেন কেন?
—আমিও সেই কথা ভাবিতেছি। হয় ত তোমার বিবাহের সম্বন্ধ করিবেন।
—সম্বন্ধ ত ঠিক হইয়াছে।
—তাহা তিনি জানেন না, তবে তাঁহার মনে কিছু সন্দেহ হইয়া থাকিতে পারে। কাল মা আসিয়া আমাকে দেখিবেন, তোমাকেও দেখিবেন ত? তুমি এদেশী কাপড় পরিয়া থাকিও।
—যো হুকুম। পেশগীর, বুরকা সব তৈরী আছে।
ডাক্তার দাউদের জন্য যে পথ্য ব্যবস্থা করিয়া গিয়াছিলেন, তাহাকে তাহাই দেওয়া হইল। মুরগীর শুরুয়া, পাতলা শুকনা রুটি আর ফিরণী। আহার শেষ হইতে দাউদের ভৃত্য আসিয়া উপস্থিত হইল। হনিফা তাহার সম্মুখে বাহির হইল না।
ভৃত্য আসিয়া বলিল,—মিঞা সাহেব, বড়ি বিবি আপনাকে দেখিবার জন্য বড় ব্যস্ত হইয়াছেন। তিনি এখনি আসিতে চাহিতেছিলেন, বড়া মিঞা তাঁহাকে অনেক করিয়া বুঝাইয়া, আপনার তেমন কিছু লাগে নাই বলিয়া, থামাইয়া রাখিয়াছেন। বিবি সাহেব ভোরে আসিবেন।
—বেশ কথা। আমার সামান্য লাগিয়াছে, চিন্তার কোন কারণ নাই।
—রাত্রে আমি হুজুরের কাছে থাকি?
—কোন আবশ্যক নাই। রাত্রে প্রয়োজন হইলে তোমাকে ডাকিব।
ভৃত্য বাহিরে অপর চাকরদের কাছে গেল। হানিফা আবার আসিয়া বলিল,—প্রয়োজন হইলে আমাদেরও ডাকিবে।
—আচ্ছা।
হনিফা ও দাসী চলিয়া গেল। পরদিন প্রত্যূষে নবীউল্লা ও দাউদের মাতা আসিলেন। আঘাতের তাড়সে ও রক্তস্রাবে দাউদের ঈষৎ জ্বরভাব হইয়াছিল। মাতা তাহার মাথায় হাত দিয়া বলিলেন,—বেটা, তোমার জ্বর হইয়াছে!
—ও কিছুই নয়, এখনি ছাড়িয়া যাইবে। তোমরা এত ভাবিতেছ কেন? আমার এমন কিছুই হয় নাই, দু’চার দিনে সারিয়া যাইবে।
—তুমি এখানে আসিয়াছিলে কেন? ছেলে দিব্য সুস্থ শরীর, হাসিয়া খেলিয়া বেড়াইতেছে, কোথা হইতে একটা পাগল তাহাকে ছুরি মারিয়া বসিল।
—নবীউল্লা বলিলেন, ও-কথায় কাজ নাই। ইহাতে কাহারও অপরাধ নাই।
—তা ত বুঝিলাম, কিন্তু আমার ছেলে এখানে কত দিন বিছানায় পড়িয়া থাকিবে? বাড়ীতে লইয়া গেলে আমি সর্ব্বদা উহার কাছে থাকিতে পারি।
—দু’চার দিনের মধ্যেই বাড়ী যাইবে। চিন্তার কোন কারণ নাই।
তাঁহারা কথা কহিতেছেন, এমন সময় দাসী আসিয়া সেলাম করিয়া, দাউদের মাতাকে কহিল,—বেগম সাহেবা, একবার অন্দর-মহলে যাইবেন না?
—যাইব বই কি, তোমার বিবি সাহেবের অনেক প্রশংসা শুনিয়াছি।
দাউদের মাতা দাসীর সঙ্গে ভিতরে গেলেন। পিতা-পুত্রে কথোপকথন হইতে লাগিল।
অনেকক্ষণ পরে দাউদের মাতা ফিরিয়া আসিলেন। হর্ষোৎফুল্ল আনন, চক্ষু আনন্দে উজ্জ্বল। স্বামীকে কহিলেন,—তুমি এখন বাড়ী যাও, আমি এবেলা এখানেই থাকিব, সন্ধ্যার সময় বাড়ী যাইব।
নবীউল্লা বলিলেন,—আহারাদির কি হইবে?
—ইহারা এখানে খাইতে না দেয়, উপবাসী থাকিব।
পর্দ্দার পিছনে চাপা হাসির অল্প শব্দ শুনা গেল। নবীউল্লা কিছু লজ্জিত হইয়া প্রস্থান করিলেন।
দাউদের মা বলিলেন, আমি এতক্ষণ হনিফার সঙ্গে গল্প করিতেছিলাম। খুব লজ্জাশীলা আর নরম প্রকৃতির মেয়ে। আর সুন্দরী ত বটেই, পরমা সুন্দরী। তোমার সঙ্গে কথা কহিল কেমন করিয়া?
—ওদের দেশে পর্দ্দা নাই জান ত? তবে সে গোরাটা না আসিলে আমার সঙ্গে আলাপ হইত না।
দাউদের মা হাসিতে লাগিলেন; বলিলেন,—তুই ত কিছু বলিস্ নাই, হনিফার কাছে সব শুনিলাম। ছেলে আমার রুস্তম। আরও শুনিলাম, ফিরোজকে ডাক্তার পাগলা গারদে পাঠাইয়া দিয়াছে। যাহাকে দেখে, তাহাকেই বলে খুন করিবে; তাহাকে এখানে সাম্লান অসম্ভব। রোগ কিছুতেই সারিবে না।
—বড় আপশোষের কথা।
দাউদের মা চুপ করিয়া রহিলেন। তাহার পর ছেলের মুখের কাছে মুখ লইয়া গিয়া কহিলেন,—তুমি এখানে হনিফাকে দেখিতে আসিতে, না?
দাউদ কোন উত্তর দিল না, মা’র হাত চাপিয়া ধরিল। মা মুচকাইয়া হাসিয়া বলিলেন,—হনিফাকে বিবাহ করিবে?
দাউদের চক্ষু অত্যন্ত কোমল হইয়া মা’র মুখের উপর পড়িল। কহিল, সেই কথা আমি তোমাকে বলিব ভাবিতেছিলাম। আমি আর কাহাকেও বিবাহ করিব না।
—বড় কঠিন পণ। তুমি গুণ্ডা পাহালওয়ান, হনিফা তোমাকে বিবাহ করিবে কেন?
—না করে ত আর কি করিব?
—নিজেদের মধ্যে কথা ঠিক করিয়া এখন আবার বোকা সাজিতেছ। এ ত ফিরিঙ্গীর বিবাহ।
দাউদের মা উঠিয়া ফস্ করিয়া পর্দ্দা টানিয়া দিলেন। দাসী মুখে কাপড় দিয়া হাসিতেছে, হনিফা পলায়ন করিয়াছে।
দাসী দাউদের মা’র হাত ধরিয়া মিনতি করিতে লাগিল,—বেগম সাহেবা, শাদি করিয়া দাও—শাদি করিয়া দাও! মিঞা সাহেব আর বিবি সাহেব দিবা-রাত্র পরস্পরের দর্শন-কামনা করে। তুমি এমন পুত্রবধূ পাইবে না, বিবি সাহেবও এমন শোহর পাইবে না।
—আর তুই দু’-তরফ হইতে সোনার জেওয়র আর জরির পেশোয়াজ পাইবি, কেমন?
—তা ত পাইবই, আর আপনাদের দৌলতে আমার ভাবনা কিসের?
—আচ্ছা, তুই এইবার গোসলখানায় গরম জল দিতে বল, আমার স্নানের সময় হইয়াছে।
—আমি গিয়া এখনি সব ঠিক করিয়া রাখিতেছি, বলিয়া দাসী চলিয়া গেল।
দাউদের মা পুত্ত্রের কাছে আসিয়া বলিলেন, তুমি সারিয়া উঠিলেই তোমার বিবাহ দিব। ডাক্তার অনুমতি দিলেই তোমাকে বাড়ী লইয়া যাইব, তাহার পর যত শীঘ্র হয় বিবাহ হইবে। কেমন, এখন তোমার মনের মত কথা হইয়াছে ত?
দাউদ মাতার হস্ত লইয়া নিজের মাথার উপর রাখিল, বলিল,—তোমার দোয়া হইলেই আমার সুখ হইল।
দাউদের মা যখন স্নানাগারে গমন করিলেন, সেই অবকাশে হনিফা দাউদের নিকটে আসিন। সঙ্গে দাসী ছিল না। দাউদ হনিফার হাত ধরিয়া তাহাকে পাশে বসাইল, বলিল,—মা কি বলিয়াছেন, শুনিয়াছ?
—শুনিয়াছি, বলিয়া হনিফা দাউদের বক্ষে মুখ লুকাইল।
কিছু পরে দাউদ হানিফার মুখ তুলিয়া ধরিল। হনিফার চক্ষু আনন্দ-সলিলে ভাসিতেছে।
কেহ কোন কথা কহিল না।