রথযাত্রা ও অন্যান্য গল্প/যে দেশে পাখী নেই
যে দেশে পাখী নেই
রাজপুত্ত্র, মন্ত্রিপুত্ত্র, আর সদাগরপুত্ত্র দেশভ্রমণে বেরিয়েচেন। তিন জনেরই পোষাক এক রকম, খুব জাঁকালও নয়, খুব খেলোও নয়। তিন জনের বয়স প্রায় সমান, তবে তিন জনে দেখতে তিন রকম। রাজপুত্ত্র দেখতে রাজপুত্ত্রের মত, বেশ দোহারা শরীর। মন্ত্রিপুত্ত্র রোগা, মুখ বেশ টিকল। সদাগরপুত্ত্র দেখতে সব চেয়ে ভাল, আর সদাই হাস্যমুখ। রাজপুত্ত্রের সঙ্গে একটা মস্ত কুকুর, মন্ত্রিপুত্ত্রের কিছু নেই, সদাগরপুত্ত্রের হাতে পিতলের খাঁচায় লাল মখমলের ঢাকা দেওয়া টিয়ে পাখী। পাখীর জন্য একটা সোনার দাঁড়ও আছে। পড়া পাখী, পথে যেতে যেতে অনেক নতুন কথা শিখেছে।
তিন বন্ধু কত দেশ দেখলেন, কত নদী পার হ’লেন, কত দেশের কত কথা শুনলেন, কত বার কত বিপদ থেকে রক্ষা পেলেন। এই রকম যেতে যেতে এক নতুন দেশে উপস্থিত হ’লেন। সহরের চারদিকে বড় বড় বাগান, তাতে কত রকম ফুল-ফলের গাছ। তিন বন্ধুতে একটা বাগানের ভিতর গিয়ে একটা বড় গাছ তলায় বসলেন। সূর্য্য তখন অস্ত যায় যায়। বড় বড় গাছের ছায়া লম্বা হয়ে বন্ধুদের অনেক পিছনে পড়েছে। পুকুরের এক কোণে সূর্য্যের আলো ঝিকমিক করচে।
মন্ত্রিপুত্ত্র বল্লেন,—তোমরা দু’জনে এখানে ব’স, আমি সহরের একটু দেখে এখনি ফিরে আসছি।
রাজপুত্ত্র বল্লেন,—তুমি একা যাবে কেন? চল, তিন জনে একসঙ্গে যাওয়া যাক।
মন্ত্রিপুত্ত্র বল্লেন,—মাঝে মাঝে একটু সাবধান হওয়া ভাল। তোমরা কিছু ভেব না, আমি এই ফিরে এলাম ব’লে।
ঘোড়া ত রইল গাছে বাঁধা। মন্ত্রিপুত্ত্র হেঁটে সহরে প্রবেশ করলেন। সহরে রাস্তায় লোকজন চুপচাপ চলেচে, বড়-একটা কথাবার্ত্তা কইচে না। মন্ত্রিপুত্ত্র ভাবলেন, তাই ত, এমন সময় এমন ক’রে সব চুপ ক’রে আছে কেন? রাজার কিছু হয় নি ত?
সাম্নে এক জন বুড়ো মানুষকে দেখে মন্ত্রিপুত্ত্র জিজ্ঞাসা করলেন,মশায়, আমি বিদেশী, কাছাকাছি কোথাও ভাল পান্থনিবাস নেই?
বৃদ্ধ মন্ত্রিপুত্ত্রের পা থেকে মাথা পর্য্যন্ত ভাল ক’রে দেখলেন, তার পর রাস্তার সামনের দিকে আর পিছনদিকে চেয়ে দেখে বল্লেন, মোড়ের মাথায় ঐ লাল বাড়ী—সরাই।
ব’লেই তিনি চ’লে গেলেন, আর পিছন ফিরে চাইলেন না।
সরাইয়ের সুমুখে গিয়ে মন্ত্রিপুত্র দেখলেন, মস্ত বড় দরজা। আর তার ভিতর বড় উঠান। উঠানের এক দিকে ঘোড়া বাঁধবার আস্তাবল, আর এক দিকে বাঁধান কুয়া। ভিতরে ঢুকবার দরজার কাছে একজন আধাবয়সী স্ত্রীলোক দাঁড়িয়ে আছে, সরাই তার। মন্ত্রিপুত্ত্র তাকে জিজ্ঞাসা করলেন,—আমি বিদেশী, এখানে থাকবার জায়গা আছে?
প্রৌঢ়া হেসে বল্লে,—আছে বই কি, এ অতিথিশালা, বিদেশীদের থাকবার জায়গা।
—আমরা তিন বন্ধু, তিন জনের থাকবার স্থান চাই।
—আর দু’জন কোথায়?
—তারা সহরের বাইরে আছে। থাকবার জায়গা হ’লে তাদের নিয়ে আস্ব।
—ঘর দেখ, দেখে পসন্দ হয় ত তাদের নিয়ে এস।
মন্ত্রিপুত্ত্র রমণীর সঙ্গে গিয়ে ঘর দেখলেন। ছোট বড় ঘর কয়েকটা দেখে বল্লেন,—আমাদের একটা বড় ঘর হ’লেই হবে, তিন জনে এক ঘরেই থাকব।
প্রৌঢ়া একটা বড় ভাল ঘর দেখিয়ে বললে,—এ ঘরের ভাড়া রোজ দু’টাকা। খাওয়ার খরচ আলাদা, কেউ এখানে খায়, কেউ বাজারে খায়।
মন্ত্রিপুত্ত্র তার হাতে দশটি টাকা দিয়ে বল্লেন,—পাঁচ দিনের ভাড়া নাও | আমাদের খাবার ভাল ক’রে দিও, তার জন্য আলাদা টাকা দেব’। একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, সহরের লোক সব এমন চুপচাপ ক’রে আছে কেন, কোন গোলমাল নেই!
—তা বুঝি শোন নি? তুমি বিদেশী, সবে এখানে এসেছ, কেমন ক’রেই বা জানবে? কাল পাঁচজন বিদেশী যুবকের মাথা কাটা যাবে, তাই সহরের লোক দুঃখিত হয়ে আছে।
—কেন, তাদের কি অপরাধ?
—তারা বলেছিল, রাজকন্যাকে তারা হাসাবে, তা হাসাতে পারেনি ব’লে তাদের প্রাণদণ্ড হবে।
— এ কি রকম কথা?
—আমাদের রাজকন্যা অনেক দিন থেকে হাসেন না। রাজা বল্লেন,—রাজকন্যাকে যে হাসাতে পারবে, তাকে অনেক পুরস্কার দেবেন। তা কেউ পারলে না। তার পর রাজা বল্লেন, যে রাজকন্যাকে হাসাতে পারবে, তাকে রাজকন্যার সঙ্গে বিয়ে দেবেন আর অর্দ্ধেক রাজত্ব দেবেন। তাতেও কেউ রাজকন্যাকে হাসাতে পারলে না। তার পর রাজা রেগে পণ করলেন যে, যদি কেউ রাজকন্যাকে হাসাতে পারে ত ভাল, সে যা চাইবে তাই দেবেন, আর যদি না পারে তা হ’লে তার গর্দ্দান যাবে। আহা, বিদেশে এসে পাঁচ জনের প্রাণ যাবে!
—২—
এই কথা শুনে মন্ত্রিপুত্ত্র সহরের বাইরে বাগানে গিয়ে দুই বন্ধুকে বললেন। তিন বন্ধু এই কথা বলাবলি করতে করতে সরাইয়ে এসে উঠলেন। তাঁদের ঘরের দরজার সাম্নে সরাইওয়ালীর কিশোরী সুন্দরী কন্যা দাঁড়িয়েছিল। রাজপুত্ত্রের কুকুর তাকে দেখে ল্যাজ নেড়ে তার কাছে গেল। রাজপুত্র হেসে বল্লেন,—আমার কুকুর মানুষ ঠিক চেনে। তোমাকে যখন বন্ধু ঠাউরেছে, তখন নিশ্চয় তোমাকে দিয়ে আমাদের কোন উপকার হবে। তোমার নাম কি?
কিশোরী কুকুরের মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বল্লে,—আমার নাম আবিদা। উপকারের মধ্যে আমি তোমাদের রেঁধে খাওয়াব।
রাজপুত্ত্র বল্লেন,—এর চেয়ে উপকার আর কি হ’তে পারে?
সদাগরপুত্ত্রের হাতে ঢাকা খাঁচা দেখে আবিদা জিজ্ঞাসা করলে,—তোমার হাতে কি?
—ও একটা পাখী।
অমনি আবিদার মুখ শুকিয়ে গেল। সে বললে,—কি সর্ব্বনাশ! রাজার লোক জানতে পারলে আর রক্ষে থাকবে না! এখানে দাঁড়িয়ে কাজ নেই, কেউ দেখতে পাবে; ঘরের ভিতর এস।
সকলে ঘরের ভিতর গেলে আবিদা দরজা ভেজিয়ে দিলে। সদাগরপুত্ত্র বল্লেন,—এ ত নতুন রকম দেশ দেখছি। রাজকন্যাকে হাসাতে না পারলে মাথা কাটা যায়, আর খাঁচায় পাখী রাখলে সর্ব্বনাশ হয়! ব্যাপারখানা কি?
এমন সময় আবিদার মা এল। দরজা খুলে বল্লে, কি হয়েছে?
আবিদা বল্লে—মা, এঁদের সঙ্গে একটা পাখী!
—সর্ব্বরক্ষের মাথায় পা! এ দেশে কি পাখী আন্তে আছে!
রাজপুত্ত্র বল্লেন,—কথাটাই কি শুনি!
আবিদা বল্লে,—এখানে কারুর পাখী রাখবার হুকুম নেই। সহরের বাইরে কোথাও পাখী দেখেছিলে?
—তাই ত, বাগানে ত একটাও পাখী দেখিনি।
আবিদার মা বল্লে,—এখানে রাজসভায় দু’জন সর্ব্বজ্ঞ আছেন, তাঁদের মতেই সব হয়। তাঁরা বলেন,—পাখীর কি দরকার? হয় বধ, না হয় বন্ধন, এই দুইয়ের জন্য পাখীর সৃষ্টি। পাখীর ডাক বড় অশুড়, শেষ রাত্রিতে পাখীর ডাকের জ্বালায় কেউ ঘুমোতে পায় না এমন কি, কারুর সর্ব্বনাশ কামনা করলে তাকে বলে, তোর ভিটেয় ঘুঘু চরবে! সহরের ত্রিসীমায় পাখী নেই। ব্যাধরা সব রকম পাখী ধ’রে এনে সর্ব্বজ্ঞদের সাম্নে মেরে ফেলে। বন্ধ ক’রে রাখলে খাওয়াবার খরচ, আবার খাঁচার ভিতরও পাখী ডাকে। তোমরা খাঁচায় ক’রে পাখী এনেছ শুনতে পেলে আমাদের সুদ্ধ ধ’রে নিয়ে যাবে।
সদাগরপুত্ত্র বল্লেন,—আমরা দু’দিন পরে চ’লে যাব। আমাদের একটা পাখী আছে, তোমরা না বল্লে কেউ টের পাবে না। খাঁচা ঢাকা থাক্লে পাখী ডাকে না। তোমাদের ভয়ের কোন কারণ নেই।
আবিদার মা বল্লে,—শুধু পাখী নয়, তোমাদের সঙ্গে আবার একটা কুকুর। রাত্রিতে ঘেউ ঘেউ ক’রে ডাকবে। আর কেউ ঘুমুতে পারবে না। সকলে জিজ্ঞাসা করবে, কার কুকুর, তখন হৈ-হৈ হবে আর সব কথা বেরিয়ে পড়বে।
আবিদা বল্লে,—না, না, বেশ শান্ত কুকুর, এখানে এসে অবধি ডাকে নি।
রাজপুত্ত্র বল্লেন,—কুকুরের জন্য তোমরা ভেব না। রাত্রিতে আমাদের ঘরে থাকবে, একবারও ডাকবে না।
রান্নাবান্না হ’লে পর তিন বন্ধু নিজের ঘরে খেলেন। আবিদা তাঁদের খাবার নিয়ে এল। তাঁদের মুখে রান্নার সুখ্যাতি শুনে তার আহ্লাদ কত! তাঁদের খাওয়া হ’লে আবিদা বল্লে,—তোমাদের পাখীটি একবার দেখাবে না? কত দিন যে পাখী দেখিনি! রাত্তিরে ডাকে না ত?
সদাগরপুত্ত্র হেসে বল্লেন, একি পেঁচা, যে রাত্রে ডাকবে? এ পাখী রাত্তিরে ডাকে না।
খাঁচার ঢাকা খুলে সদাগরপুত্ত্র পাখী বের কল্লেন। বেশ বড় চন্দনা পাখী, মাথা টুকটুকে লাল, দুই দিকে ডানার পাশে লাল, ল্যাজ খুব লম্বা। তাকে হাতে বসিয়ে সদাগরপুত্ত্র মুখের কাছে তুলে ধরলেন। রাত্তিরে পাখী ভাল দেখতে পায় না, তবু সদাগরপুত্ত্রের গালে মাথা বুলোতে লাগল।
আবিদা দুই হাত একত্র ক’রে নিশ্বাস টেনে বল্লে, ও মা, কি সুন্দর পাখী! কেমন পোষ মেনেছে! আমি যদি ওর গায়ে হাত দি, তা হ’লে কি কাম্ড়াবে?
—দুষ্ট লোক না হ’লে কামড়ায় না। তুমি ওর গায়ে হাত দিয়ে দেখ!
এই ব’লে সদাগরপুত্ত্র পাখী সুদ্ধ হাত আবিদার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। আবিদা ভয়ে ভয়ে একটি আঙুলের আগা দিয়ে পাখীর মাথায় বুলিয়ে দিতে লাগল, পাখী মাথা কাৎ ক’রে চোখ বুজে রইল।
সদাগরপুত্ত্র বল্লেন,—কিছু ভয় নেই, এই নাও তোমার হাতে বসিয়ে দিচ্ছি।
আবিদার আঙ্গুলে ব’সে তার হাতে চকচকে চুড়ী দেখে পাখী একবার ঠোঁট দিয়ে আস্তে আস্তে ঠুকরে দেখলে। ক্রমে ভয় ভেঙে গেলে আবিদা পাখীকে মুখের কাছে তুলে ধরলে, সেও আবিদার গালে মাথা দিয়ে আরাম পেয়ে চুপ ক’রে রইল।
আবিদা বল্লে,—কি চমৎকার পাখী! আমার যদি এমন একটি পাখী থাকত!
সদাগরপুত্ত্র বল্লেন,—এইটেই তুমি নাও না কেন? তোমাকে এই পাখী দিয়ে যাব। একে
—বাপ রে, এদেশে কি পাখী রাখবার যো আছে! নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলবে আর হয় ত আমাদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবে।
আবিদা চ’লে গেলে ঘরের দরজা বন্ধ ক’রে তিন বন্ধু অনেকক্ষণ কি পরামর্শ করলেন। তাঁদের শুতে অনেক রাত হ’ল।
—৩—
সকালবেলা মুখ-হাত ধুয়ে তিন বন্ধু কুকুর সঙ্গে ক’রে নগরে যাবেন। পাখী ঘরের ভিতর বন্ধ রইল। ঘরে তালা বন্ধ ক’রে মন্ত্রিপুত্র চাবি নিজের কাছে রাখলেন।
বাইরে যেতে সিঁড়ির কাছে দেখা হ’ল আবিদার মার সঙ্গে। সে জিজ্ঞাসা করলে,—তোমরা কোথায় যাচ্ছ?
রাজপুত্ত্র বল্লেন,— রাজসভায়।
—সেখানে কেন?
—রাজকন্যাকে কেউ হাসাতে পারেনি, দেখি আমরা পারি কি না।
আবিদা ও আবিদা! ব’লে তার মা চেঁচিয়ে উঠল।
আবিদা ছুটে এসে বল্লে,—কি হয়েছে মা?
—শুনেছিস কথা, এরা রাজকন্যাকে হাসাবার জন্য যেতে চাইছে! বিদেশে এসে বেঘোরে প্রাণ হারাবে।
আবিদার দুই চক্ষু জলে পূরে এল। সে কেঁদে বল্লে,—না, না, তা কিছুতেই হবে না। তোমরা আর যেখানেই যাও, রাজসভাতে কিছুতে যেতে পাবে না। বিদেশে তোমরা বেড়াতে এসেছ, না মিছিমিছি প্রাণ দিতে এসেছ?
রাজপুত্ত্র বল্লেন,—আমরা বুঝেসুঝে এ-কাজ করছি, তোমরা ভয় পাচ্ছ কেন? যে কাজ কেউ পারে না, আমরা তা পারি। রাজকন্যাকে কেউ যদি হাসাতে পারে ত আমরা পারব।
আবিদা তাদের কিছুতেই যেতে দেবে না। বল্লে,—তোমরা এখানে মোটে এক দিন এসেছ, তবু আমাদের মনে হচ্ছে, যেন কত দিন থেকে তোমাদের জানি। এই ত পাঁচ জনের আজ মাথা কাটা যাবে। তোমাদের এই অল্প বয়স, রাজকন্যাকে তোমরা কখন চোখে দেখনি, সে তোমাদের কোথাকার কে, যে তার জন্যে তোমরা প্রাণ দেবে?
মন্ত্রিপুত্ত্র বল্লেন,—তোমরা মায়ে-ঝিয়ে যে আমাদের কুশল কামনা কর, সেটা আমাদের সৌভাগ্য মনে করি। কিন্তু আমরা গোঁয়ারের মত কিছু করচি নে। রাজকন্যাকে আমরা দেখি নি আর আমাদের কোন লোভও নেই। আমরা শুধু দেখাতে চাই যে, রাজকন্যাকে হাসান কিছুই শক্ত কাজ নয়। আর এই যে পাঁচ জনের মাথা কাটা যাবে, এদেরও আমরা রক্ষা কর্ব। আমরা ঠিক জানি, এ-কাজ পার্ব।
আবিদা ও তার মা কিছুতেই তাদের থামাতে পার্লে না। শেষে আবিদা বল্লে, তোমরা কি তিনজনে মিলে রাজকন্যাকে হাসাবার চেষ্টা করবে?
সদাগরপুত্ত্র বললেন,—না, আমি একা, এঁরা দুজন কিছু করবেন না।
আবিদার চোখের জল আরও উথলে উঠ্ল। বল্লে,—কেন, তুমি কেন?
—হাসাবার কৌশল আমি জানি ব’লে। বল ত তোমাকে এখনি হাসাতে পারি।
রাগ দুঃখ ক’রে আবিদা চ’লে গেল।
তিন বন্ধু তখন হাসতে হাসতে রাজপথে বেরিয়ে পড়লেন। রাস্তা সোজা রাজবাড়ী চ’লে গিয়েছে। সিংদরজায় খাপখোলা তলওয়ার হাতে প্রহরী দাঁড়িয়ে রয়েছে। দরজার পাশে প্রকাণ্ড ডঙ্কা, তার পাশে দেওয়ালে, ডঙ্কার কাঠি ঝোলান। সদাগরপুত্ত্র প্রহরীকে কিছু অবজ্ঞার সুরে জিজ্ঞাসা করলেন,—এ ট্যামটেমিটা কিসের জন্য?
সেপাই মশায় ভারি গরম! কোথাকার উজবুগ আনাড়ী মূর্খলোক, জয়ঢাককে বলে কিনা, ট্যামটেমি! দুই চক্ষু লাল ক’রে বললে,—তোমরা কোন্ দেশের লোক হে, রাজডঙ্কা চেন না? যারা রাজকন্যাকে হাসাতে চায় তারা এই ঢাকে কাঠি দেয়। তোমার মত পাঁচ জন এই ঢাক বাজিয়ে আজ চাঁড়ালের হাতে যাবে। পাঁচটা কাঁচা মাথা আজ কাটা যাবে।
—বটে? ব’লে সদাগরপুত্ত্র কাঠি পেড়ে ডঙ্কায় সজোরে তিন ঘা বসিয়ে দিলেন। সে-শব্দে রাজবাড়ী, হাট-বাজার কেঁপে উঠল।
প্রহরী বল্লে,—ডঙ্কায় এক ঘা দেবার কথা, তুমি যে বড় তিনবার বাজালে? তোমার কি তিনটে মাথা আছে?
—না হয় আমার মাথা তিনবার ক’রে কাটবে।
রাজসভা থেকে আর চার পাঁচ জন প্রহরী ছুটে এল। বল্লে,—ডঙ্কা এতবার বাজায় কে?
দরজার প্রহরী সদাগরপুত্ত্রকে দেখিয়ে দিয়ে বল্লে,—এই কোথাকার একটা পাড়াগেঁয়ে লোক আমাকে কোন কথা না বলেই তিনবার ডঙ্কা বাজিয়েছে।
সদাগরপুত্ত্র নেহাত ভাল মানুষের মত বল্লে,—আমরা তিন বন্ধু কি না, তাই তিন ঘা!
—চল রাজার হুজুরে।
—সেই জন্যেই ত আমরা এসেছি।
—তোমাদের সঙ্গে আবার একটা কুকুর দেখছি। রাজসভায় কুকুর নিয়ে যাবার হুকুম নেই।
—আমরা যেখানে যাই, আমাদের কুকুরও যেখানে যায়। একটা কুকুর সশরীরে স্বর্গে গিয়েছিল, জান? আমাদের কুকুর রাজদরবারে যাবে, তাতে আর আশ্চর্য্য কি?
— কী, আমাদের সঙ্গে তামাসা?
—অত সাহস আমাদের হয়নি। কিন্তু কুকুর সঙ্গে না থাকলে আমরা রাজকন্যাকে হাসাতে পার্ব না। এ ত আর যে সে কুকুর নয়।
একজন প্রহরী জিজ্ঞাসা করতে ভিতরে গেল, ফিরে এসে বললে,—সবসুদ্ধ যাবার হুকুম।
সামনে পিছনে প্রহরী, মাঝখানে তিনবন্ধু, তাঁদের পাশে কুকুর। রাজসভায় সিংহাসনে রাজা ব’সে আছেন, চারদিকে অমাত্য, সভাসদ, সিংহাসনের সাম্নে ব’সে দুই সর্ব্বজ্ঞ। এক জনের হাড়-পাঁজরা গোণা যায়, আর একজন ভরা তেলের কূপোর মত, একজন কাণা, এক চক্ষু নেই, আর একজন টেরা। দু’জনেই কিন্তু বেজায় গম্ভীর।
তিন বন্ধু রাজাকে অভিবাদন ক’রে সভায় বসলেন। কুকুর তাদের পাশে বস্ল। রাজা জিজ্ঞাসা কর্লেন,—তোমরা কে, এখানে কি জন্য আসা?
রাজপুত্ত্র বল্লেন,—আমরা বিদেশী। কেন এসেছি, তা ডঙ্কা বাজিয়ে জানিয়েছি।
—যে কাজ কর্তে চাও, তার পণ জান?
—জানি। আমাদের পণ প্রাণ, রাজার পক্ষে কি?
—অর্দ্ধেক রাজত্ব আর আমার কন্যা দিতে স্বীকৃত আছি।
—আর এক কথা আছে। আমরা শুন্লাম, পণে পরাজিত হয়েছে ব’লে আজ পাঁচ জনের প্রাণদণ্ড হবে। এ আদেশ তিন দিন স্থগিত রাখতে হবে।
প্রথম সর্ব্বজ্ঞ হাত নেড়ে বল্লেন,—তোমরা মনে কর, তোমাদের শুধু ধড় আছে, মাথাটা নেই।
রাজা বল্লেন,—তোমরা নিজের কথা বল, যাদের প্রাণদণ্ডের আদেশ হয়েছে, তাদের কথা কেন?
রাজপুত্ত্র বল্লেন, প্রথম কারণ, এ সময়ে রক্তপাত করলে রাজকন্যার অকল্যাণ হবে, দ্বিতীয় কারণ, রাজকন্যার জন্য আমরা গোপনে যে মন্ত্র সাধন করব, তার বিঘ্ন হবে, তৃতীয় কারণ, আপনার প্রধান উদ্দেশ্য আপনার কন্যার নীরোগতা লাভ, নিরপরাধের প্রাণহত্যা নয়, রাজকন্যাকে যদি আমরা না হাসাতে পারি, তা হ’লে আমাদের সঙ্গে ঐ পাঁচজনের প্রাণদণ্ড হবে। সভাস্থ লোকেরা বল্তে লাগল,—একথা যুক্তিযুক্ত।
রাজা বল্লেন,—তোমরা ক’দিন সময় চাও?
—তিন দিন। তিন দিনের দিন সূর্য্যোদয়ের এক প্রহর পরে আমরা নগরবাসী সকলের সমক্ষে রাজকন্যাকে হাসাব। না পারি, সেই দিনই আমাদের প্রাণদণ্ড হবে।
রাজা বল্লেন,—তাই হবে।
—আর এক নিবেদন। আমাদের তিন জনের মধ্যে যিনি রাজকন্যাকে হাসাবেন, তিনি পরীক্ষার পূর্ব্বে এখন একবার রাজকন্যাকে দেখতে চান।
—কে তিনি?
রাজপুত্ত্র সদাগরপুত্ত্রকে দেখিয়ে দিলেন। রাজা তাঁকে জিজ্ঞাসা কর্লেন,—এইখানে দেখতে চান?
সদাগরপুত্ত্র বল্লেন,—না মহারাজ, এত লোকের সাক্ষাতে নয়, শুধু আপনার কিম্বা আর কারও সাক্ষাতে।
রাজা আদেশ কর্লেন, প্রতিহারী, এঁকে রাজকন্যার মহলে নিয়ে যাও। সখীর সাক্ষাতে কিংবা ধাত্রীর সাক্ষাতে ইনি একবার রাজকন্যাকে দেখ্তে চান।
প্রতিহারী সদাগরপুত্রকে সঙ্গে ক’রে রাজকন্যার মহলে নিয়ে গেল। সেখানে সকলেই বিমর্ষ, সকলেই মুখ চূণ ক’রে আছে। বুড়ী ধাত্রী বসেছিল, তার কাছে রাজকন্যার দুইজন সখী। প্রতিহারী বল্লে, —মহারাজের আদেশ, এঁকে রাজকন্যার কাছে নিয়ে যাও। ইনি রাজকন্যাকে একবার দেখ্তে চান।
একজন সখী জিজ্ঞাসা কর্লে,—কেন?
—ইনি রাজকন্যাকে হাসাবেন।
সখী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে সদাগরপুত্ত্রকে বল্লে,—কেন এই বয়সে তুমি নিজের প্রাণ বিসর্জ্জন দিতে এসেছ?
সদাগরপুত্ত্র বল্লেন,—রাজকন্যার মুখের হাসির জন্য তুমি কি প্রাণ দিকে পার না?
—এখনি। রাজকন্যা আমার সখী, তাঁকে আমি প্রাণের চেয়ে ভালবাসি। তুমি বিদেশী, বাপ-মা’র আদরের ছেলে, হয়ত বিয়ে করেছ, তুমি কেন প্রাণ দিতে গেলে?
—আমি বিয়ে করিনি, পরের জন্য প্রাণ দিলে জীবন সার্থক হয়, আর তোমাকে সত্যি বল্ছি, তোমার সখীর মুখে হাসি তোমরা দেখতে পাবে। আমার দৈব ক্ষমতা আছে, যারা রাজকন্যাকে হাসাতে পারেনি, তাদের তা নেই। এখন আমাকে রাজকন্যার কাছে নিয়ে চল।
সদাগরপুত্ত্র রাজকন্যার সখীর সঙ্গে গিয়ে দেখ্লেন, একটি ঘরের ভিতর মহামূল্য আসনে রাজকন্যা ব’সে রয়েছেন। শৈবালাচ্ছন্ন কমলিনীর ন্যায় তাঁর রূপ ম্লান, মুখে বিষাদের ছায়া, চক্ষুর জ্যোতি নিভে গেছে। সখীর সঙ্গে সদাগরপুত্ত্রকে প্রবেশ করতে দেখে একটি কথাও কইলেন না, অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন।
সদাগরপুত্ত্র সখীকে বল্লেন,—তুমি দরজার কাছে দাঁড়াও, আর কেউ যেন এ ঘরে না আসে। রাজকন্যাকে কিছুক্ষণ দেখলে আমি বুঝতে পার্ব, ওঁর কি হয়েছে। আমরা তিন বন্ধু যে প্রাণপণ করেছি, সেজন্য কিছু বল্ছিনে, তবে তোমার সখী যদি ভাল হয়ে ওঠেন, তা হ’লে তোমাদেরও আহ্লাদ হবে।
রাজকন্যার সখী দরজাগোড়ায় গিয়ে দরজার বাইরে মুখ বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সদাগরপুত্ত্র রাজকন্যার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বল্লেন,—রাজকন্যে, আমার দিকে তাকাও।
রাজকন্যা মুখ তুলে চাইলেন। সদাগরপুত্ত্র স্থিরদৃষ্টিতে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে বার কয়েক অঙ্গুলি চালনা কর্লেন। রাজকন্যার দৃষ্টি স্থির হ’ল। সদাগরপুত্ত্র মৃদুকণ্ঠে বল্লেন,—রাজকন্যে!
রাজকন্যা ঠিক সেই রকম কণ্ঠে বল্লেন,—কি?
—তুমি আমার কথা শুন্বে?
—শুন্ব।
—উঠে দাঁড়াও।
রাজকন্যা উঠে দাঁড়ালেন।
—তুমি হাসতে পার?
—তুমি বল্লে পারি।
—তবে হাস। জোরে নয়, কোন শব্দ হবে না, মুচ্কে একটু হাস।
মেঘের আড়াল থেকে একটু ফাঁক পেলে চন্দ্র যেমন হেসে উঁকি মারে, সেই রকম রাজকন্যার ঠোঁটের কোণে একটুখানি হাসি উঁকি মেরে গেল। সদাগরপুত্ত্র রাজকন্যার সখীকে ডাক্লেন। সে এসে দেখলে, রাজকন্যার মুখে হাসি নাই বটে, কিন্তু একটা উজ্জল প্রফুল্ল আভা রয়েছে। সে এসেই রাজকন্যার গলা জড়িয়ে বল্লে,—এমনতর ত অনেকদিন দেখিনি, তবে বুঝি সখী আমাদের আবার ভাল হয়ে উঠবেন!
সদাগরপুত্ত্র আবার দুই চারবার রাজকন্যার মুখের সম্মুখে অঙ্গুলি চালনা কর্লেন। রাজকন্যার আগে যেমন বিষণ্ণ মুখ ছিল, সেই রকম হয়ে গেল। সদাগরপুত্ত্র বললেন,—এখন কাউকে কিছু ব’লো না, কিন্তু আমি তোমাকে বল্ছি, রাজকন্যা সেরে উঠবেন।
রাজসভায় ফিরে এসে সদাগরপুত্ত্র দুই বন্ধুর সঙ্গে উঠে গেলেন। তাঁদের সঙ্গে চারজন প্রহরী গেল। সরাইয়ের দরজায় পাহারা বস্ল।
—8—
আজ পরীক্ষার দিন। রাজসভায় লোকে লোকারণ্য। তিন বন্ধুর পক্ষ থেকে রাজপুত্ত্র রাজাকে বলেছিলেন,—পরীক্ষা সকলের সাম্নে হবে, প্রহরীরা যেন কাউকে নিষেধ না করে। যে পাঁচ জন বিদেশীর প্রাণদণ্ড হয়েছিল, তারাও রাজপুত্ত্রের অনুরোধে রাজসভায় আসবার অনুমতি পেলে। আবিদা ও তার মাও এল। রাজা যেমন সিংহাসনে বস্তেন, সেই রকম বসলেন, সর্ব্বজ্ঞ দুজনে যেখানে বস্তেন, সেইখানে ব’সে বল্তে লাগলেন,—আজ এদেরও মাথা কাটা যাবে। সিংহাসনের সাম্নে কিছু দূরে একটা উঁচু জায়গায় রাজকন্যার আসন, যাতে তাঁকে সকলে দেখতে পায়। তাঁর দুই পাশে দু’জন সখী। সদাগরপুত্ত্র একটা মস্ত ঝলঝলে চোগার মত গায়ে দিয়ে তাঁর সাম্নে বসেছেন, কুকুর তাঁর পিছনে ব’সে। রাজপুত্ত্র ও মন্ত্রিপুত্ত্র আরও পিছনে একটু দূরে বসেছেন। চারদিকে নগরের নরনারী স্থির হয়ে ব’সে দেখছে,—কারুর মুখে একটি কথা নেই।
সদাগরপুত্ত্র বড় গলা ক’রে সকলকে শুনিয়ে রাজাকে বল্লেন,—রাজকন্যাকে ভাল কর্তে পারা-না-পারা আমার দায়, আমার দুই বন্ধুর এতে কোন সংস্রব নেই।
রাজপুত্ত্র ও মন্ত্রিপুত্ত্র বললেন,—তা কেন? আমাদের সকলের সমান দায়।
সর্ব্বজ্ঞ দু’জন মাথা নেড়ে বল্লেন,—অবিশ্যি, অবিশ্যি! তিন জনেরই মাথা কাটা যাবে।
রাজা বললেন,—যে রাজকন্যাকে হাসাতে স্বীকার করেছে, পুরস্কার কিম্বা দণ্ড শুধু তার প্রাপ্য, তার সঙ্গে অপর লোক থাক্লে তাদের লাভ কিম্বা শাস্তি হ’তে পারে না।
সর্ব্বজ্ঞরা বল্লেন,—সে কি রকম কথা? এক যাত্রায় পৃথক্ ফল?
সদাগরপুত্ত্র আবার সকলকে শুনিয়ে বল্লেন, রোগ কি জানতে পারলে ব্যবস্থা করা সহজ হয়। রাজকন্যার কি হয়েছে কেউ জানে?
প্রথম সর্ব্বজ্ঞ বল্লেন,—অপদেবতার কাণ্ড! তা আমি বেশ জানি। দ্বিতীয় বল্লেন,—আসল রোগ তাই। অপদেবতার সঙ্গে কে পার্বে!
সদাগরপুত্ত্র বল্লেন,—কেন, আপনারা অত মন্ত্রতন্ত্র জানেন, অপদেবতার শান্তি করতে পারেন না?
সর্ব্বজ্ঞরা কানে হাত দিয়ে বল্লেন,—শুনলে ধৃষ্টের কথা! অপদেবতার সঙ্গে তুল্যবল হ’তে চায়! তা মরণের আগেই পিপীলিকার পাখা ওঠে বটে!
সদাগরপুত্ত্র রাজাকে বল্লেন,—রাজকন্যার কি হয়েছে, তিনি এখনি নিজের মুখে বলবেন। তার পর আমি রোগের প্রতিবিধান কর্ব। রাজকন্যার মুখে আজ সকলে হাসি দেখিতে পাবেন।
রাজা বল্লেন,—রাজকন্যা ত কারুর সঙ্গে কথাই ক’ন না।
সর্ব্বজ্ঞরা বল্লেন,—ও দাম্ভিকটার কথা শোনেন কেন? ওর সব বিদ্যা এখনি জানা যাবে।
সদাগরপুত্ত্র রাজকন্যার চক্ষুর দিকে চেয়ে অঙ্গুলি চালনা করতে লাগলেন। সর্ব্বজ্ঞরা চেঁচিয়ে উঠলেন,—ওকি ও! অঙ্গুলি বা হস্ত চালনা কি রকম?
সদাগরপুত্ত্র রাজাকে বল্লেন,—এ সময় যদি কেউ গোল করে কিম্বা আমাকে বাধা দেয়, তা হ’লে আমার চেষ্টা বৃথা হবে।
রাজা চোখ পাকিয়ে সর্ব্বজ্ঞদের বল্লেন,—চুপ ক’রে থাক!
রাজকন্যার দৃষ্টি স্থির হয়েছে দেখে সদাগরপুত্ত্র বল্লেন,—রাজকন্যে, আমি যা জিজ্ঞাসা কর্ব, তার উত্তর দিতে পার্বে?
—পারব।
—তোমার কি অপদেবতার দৃষ্টি লেগেছে?
—না।
—তবে তুমি কথা কও না কেন, হাস না কেন?
—যে দেশে পাখী ডাকে না, সেখানে সব নিরানন্দ, কিসে আমার হাসি আসবে?
—এ-দেশ থেকে কারা পাখী বিদায় ক’রে দিয়েছে?
—ওই সর্ব্বজ্ঞ দু-জন। ওরা বলে, বধ আর বন্ধন ছাড়া পাখীর আর কোন দরকার নাই।
—পাখী দেখলে তোমার আনন্দ হয়?
—কার না হয়?
—তুমি একটা পাখী পেলে কি কর?
—পুষি আর তাকে পড়াতে শেখাই।
সদাগরপুত্ত্র রাজাকে জিজ্ঞাসা কর্লেন, রাজবাড়ীতে পাখী নেই? রাজার মুখ শুকিয়ে গেল, বল্লেন,—কই, এখানে ত কোথাও পাখী নেই।
—আমি যদি একটি পাখী আন্তে পারি?
—তা হ’লে হয় ত রাজকন্যা খুসী হবেন।
হঠাৎ কোথা থেকে কে বল্লে,—সর্ব্বজ্ঞ বিট্লে!
সর্ব্বজ্ঞ দু’জন চ’টে উঠে বল্লেন,—শুনেছেন, মহারাজ, আমাদের গাল দিচ্ছে।
রাজা বল্লেন,—কে দিচ্ছে, দেখিয়ে দাও।
—এইখানে কোথাও হরবোলা আছে।
আবার কে বল্লে,—চুপ বিট্লে!
চারিদিকে সকাল চেয়ে দেখে, কে যে কথা কইচে, কিছুই বুঝতে পারা যায় না। তখন সদাগরপুত্ত্র কাপড়ের ভিতর থেকে সোনার দাঁড়ে বসান পাখী বের করলেন। রাজকন্যা হাত বাড়িয়ে বল্লেন,—দেখি, দেখি! আমার হাতে দাও!
পাখী বল্লে,—রাজকন্যে, হাস দেখি!
সদাগরপুত্ত্র বল্লেন,—রাজকন্যে, তুমি হাসলে এই পাখী পাবে।
গোলাপফুল যেমন ফোটে, সেই রকম রাজকন্যার রাঙা ঠোটে হাসি ফুট্ল। তার পর তিনি খিল খিল ক’রে হেসে উঠলেন। তাঁর মুখে আনন্দের আলো ফুটে উঠ্ল, তাঁর সর্ব্বাঙ্গ থেকে আনন্দের জ্যোতি বিচ্ছুরিত হ’ল। রাজার কানে, রাজার প্রাণে, যেন অমৃতবৃষ্টি হ’ল, সখী দুইজনের চক্ষুতে আনন্দাশ্রু প্রবাহিত হ’ল, সভাশুদ্ধ লোকের মন উৎফুল্ল হয়ে উঠল, কেবল সর্ব্বজ্ঞ দুই জনের মুখ কালিমায় ঢেকে গেল।
সদাগরপুত্ত্র দাঁড়সুদ্ধ পাখী রাজকন্যার হাতে দিলেন। পাথী অনর্গল কথা কইতে লাগল।
সদাগরপুত্ত্র বল্লেন,—রাজকন্যে, এখন এদেশে কি করা উচিত?
—পাখীর বধ-বন্ধন নিবারণ হবে। মুক্ত পাখী সর্ব্বত্র উড়ে গান গেয়ে বেড়াবে, নিরানন্দ রাজ্য আনন্দপূর্ণ হবে!
—আর কি?
—সর্ব্বজ্ঞ দু’জনের মাথা মুড়িয়ে একজনের গলায় একটা মরা কাক, আর একজনের গলায় একটা মরা বাদুড় ঝুলিয়ে রাজ্য থেকে নির্ব্বাসিত ক’রে দেবে।
রাজা সিংহাসন থেকে নেমে এসে রাজকন্যার হাত ধ’রে তুললেন। সদাগরপুত্ত্রকে বল্লেন,—এই কন্যা আর অর্দ্ধেক রাজ্য তোমার।
—না মহারাজ, রাজকন্যা আর অর্দ্ধেক রাজ্য রাজপুত্ত্রের প্রাপ্য।
—রাজপুত্ত্র কোথায়? তুমি কি রাজপুত্ত্র?
—রাজপুত্ত্র আপনার সম্মুখে।
রাজপুত্ত্র উঠে এলেন। কুকুর এসে রাজকন্যার কাছে ল্যাজ নাড়তে লাগল।
রাজকন্যা বল্লেন,—আমি এই কুকুরটাও নেব।
সদাগরপুত্ত্র বললেন,—এ কুকুর, আর যার কুকুর দু-ই তোমার।
রাজপুত্ত্রের দিকে চেয়ে রাজকন্যা মাথা হেঁট করলেন।
ক’দিন পরেই রাজবাড়ীতে বিয়ের বাদ্য বেজে উঠল। সর্ব্বজ্ঞ দু’জনের মাথা মুড়িয়ে গলায় মরা কাক আর বাদুড় ঝুলিয়ে কুলো পিটিয়ে রাজ্য থেকে বের ক’রে দেওয়া হ’ল।