রথযাত্রা ও অন্যান্য গল্প/পণ্ডিতের পরাজয়
পণ্ডিতের পরাজয়
(থিউয়েন স্যাংয়ের ভ্রমণ-বৃত্তান্ত অবলম্বনে)
পুরাকালে দাক্ষিণাত্যে কর্ণসুবর্ণ নামে সমৃদ্ধ রাজ্য ছিল। রাজধানীরও ঐ নাম। নগরে অনেক ধনীর বাস, অনেকে বাণিজ্যে প্রচুর অর্থ সঞ্চয় করিয়াছিলেন। মলয় পর্ব্বত হইতে চন্দন, খনি হইতে সুবর্ণ ও হীরক পাওয়া যাইত। নানা জাতীয় উত্তম বস্ত্র প্রস্তুত হইত। এইরূপে বিবিধ উপায়ে নগরবাসিগণ ঐশ্বর্য্যশালী হইয়া উঠিয়াছিল।
পূর্ব্বে কর্ণসুবর্ণ নগরে অনেক পণ্ডিত বাস করিতেন। বিচার সভায় সর্ব্বদা দেশবিদেশ হইতে পণ্ডিতেরা আসিয়া বিচার করিতেন; ন্যায়, দর্শন, অলঙ্কার প্রভৃতি শাস্ত্রের বাক্যে, যুক্তি ও পাণ্ডিত্যের সংঘর্ষে বিচার-সভা মুখরিত হইয়া উঠিত। কোন পণ্ডিতের জয় হইলে জয়! জয়! শব্দে সভা ধ্বনিত হইত ও তাহার পর জয়শীল পণ্ডিতকে হস্তিপৃষ্ঠে আরোহণ করাইয়া নগর পরিভ্রমণ করান হইত; জয়ধ্বনিতে রাজধানী পরিপূর্ণ হইয়া যাইত। অবশেষে রাজা তাঁহাকে বহুবিধ বহুমূল্য উপঢৌকন দিতেন।
কয়েক বৎসর হইতে সেরূপ আর দেখিতে পাওয়া যায় না। নগরের পণ্ডিতেরা অনেকে কাশীবাসী হইয়াছেন, কেহ কেহ বৌদ্ধধর্ম্ম অবলম্বন করিয়া ভিক্ষু হইয়া ভিন্ন ভিন্ন বিহারে বাস করিতেছেন। দেশান্তর হইতে পণ্ডিতেরাও আর বড়-একটা আসেন না। বিস্তীর্ণ বিচারসভা শূন্য পড়িয়া আছে, বৃহৎ প্রবেশদ্বারে ঢাকে কেহ আঘাত করে না, শাস্ত্র-বিচারের সংবাদ নগরে আর ঘোষিত হয় না।
এমন সময় সংবাদ আসিল, একজন অদ্বিতীয় পণ্ডিত নগরের অভিমুখে আসিতেছেন, বিচার করিবেন। নগরবাসীরা উদ্গ্রীব হইয়া পণ্ডিতের আগমনের প্রতীক্ষা করিতে লাগিল। সর্ব্বত্র রাষ্ট্র হইয়া গেল, এমন পণ্ডিত কোথাও দেখিতে পাওয়া যায় না, পাণ্ডিত্যে যেমন অদ্বিতীয়, বিচারে তেমনি সুক্ষ্ম-যুক্তি। ইঁহার সমকক্ষ পণ্ডিত কোথায় পাওয়া যাইবে? সর্ব্বত্র এই জল্পনা হইতে লাগিল। রাজসভায় বড় পণ্ডিত কেহ ছিলেন না। রাজ-পণ্ডিত বৃদ্ধ, পুরুষানুক্রমে এই পদে অধিষ্ঠিত, পাণ্ডিত্যের কোন অভিমান ছিল না।
পণ্ডিত যখন নগরে প্রবেশ করিলেন, তখন সকলে একবাক্যে স্বীকার করিল যে, এমন পণ্ডিত কেহ কখন দেখে নাই। ঐন্দ্রজালিকের বিচিত্র বিদ্যা দেখিবার জন্য যেমন জনতা হয়, পণ্ডিতকে দেখিবার জন্য সেইরূপ লোক-সমাগম হইল। এমন পণ্ডিত কে কোথায় দেখিয়াছে? পণ্ডিতের সমুন্নত বিশাল দেহ, যেমন দীর্ঘ সেইরূপ স্থূল, বর্ণ শ্যাম, বৃহৎ মুখমণ্ডল শ্মশ্রুকেশে শোভিত, চক্ষের দৃষ্টি দাম্ভিকতাপূর্ণ। পণ্ডিতের হস্তে দীর্ঘ কাষ্ঠদণ্ড, প্রকাণ্ড উদর তাম্রনির্ম্মিত বর্ম্মে আবৃত, মস্তকের উপর উষ্ণীষ, তাহার উপর তাম্রাধারে মশাল জ্বলিতেছে! পণ্ডিত ধীর, গম্ভীর, দীর্ঘপদক্ষেপে শনৈঃ শনৈঃ বিচার-সভার দ্বারদেশে উপনীত হইয়া, ঢাকের কাঠি তুলিয়া তিন বার আঘাত করিলেন। নগরবাসীর শ্রবণে সে শব্দ বজ্রনির্ঘোষের ন্যায় শ্রুত হইল। অতঃপর পণ্ডিত সেইরূপ গজেন্দ্র-গমনে পান্থনিবাসে প্রবেশ করিলেন।
রাজার নিকট সংবাদ গেল, দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত বিচার করিবার নিমিত্ত নগরে আগমন করিয়াছেন। বিচার-সভার দ্বারে ডঙ্কা বাজাইয়া তিনি অপর পণ্ডিতবর্গকে বিচারক্ষেত্রে আহ্বান করিয়াছেন। রাজা ব্যস্ত হইয়া রাজপণ্ডিতকে ডাকাইলেন; কহিলেন,—এই যে দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত আসিয়াছেন, ইঁহার সহিত কে শাস্ত্রবিচার করিবে?
রাজপণ্ডিত কহিলেন,—মহারাজ, নগরে ত বড় শাস্ত্রীয় পণ্ডিত কেহ নাই, বিচারের ত কোন সম্ভাবনা দেখি না।
রাজা কহিলেন,—কি লজ্জার কথা! নগরে বড় বড় শ্রেষ্ঠীর অভাব নাই, কিন্তু একজনও ভাল পণ্ডিত খুঁজিয়া পাওয়া যায় না! এই একজন পণ্ডিত আসিয়াছেন, ইঁহার প্রতিদ্বন্দ্বী কেহ নাই! দেশের পক্ষে, নগরের পক্ষে কি কলঙ্ক! আমারও মাথা হেঁট হইবে।
রাজা চারিদিকে দূত পাঠাইলেন, চরেরা সর্ব্বত্র খুঁজিতে লাগিল, কোথাও উত্তম শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত পাওয়া যায় কি না। অবশেষে একজন আসিয়া রাজাকে নিবেদন করিল,—মহারাজ, অনেক দূরে অরণ্যের মধ্যে একজন শ্রমণ আছেন, বয়স অধিক নয়, কিন্তু শুনিলাম, তিনি বহুশাস্ত্রদর্শী পণ্ডিত! তিনি লোকালয়ে আসিতে স্বীকার করেন না।
রাজা কহিলেন,—আমি স্বয়ং যাইব। তাঁহাকে আনিতেই হইবে, নহিলে আমার মুখ দেখান ভার হইবে।
রাজা লোকজন সঙ্গে লইয়া অরণ্যে শ্রমণের নিকটে উপস্থিত হইলেন। তাঁহাকে প্রণাম করিয়া যুক্ত করে নিবেদন করিলেন,—আপনাকে কৃপা করিয়া আমার সঙ্গে যাইতে হইবে, নচেৎ লোকলজ্জা নিবারণের উপায় নাই।
শ্রমণ কহিলেন,—মহারাজ, বনবাসী হইলেও আমি আপনার রাজ্যে বাস করি, সুতরাং আপনার আজ্ঞা লঙ্ঘন করিতে পারি না। কিন্তু আমি তরুণবয়স্ক শিক্ষার্থী, প্রথিতনামা পণ্ডিতের সমকক্ষ নহি।
রাজা কহিলেন,—সে বিচারভার আমার উপর রহিল। যথার্থ পাণ্ডিত্যের প্রধান লক্ষণ বিনয়, আপনাতে তাহা বর্ত্তমান।
শ্রমণ কহিলেন,—মহারাজ! আপনার নিকট একটি প্রার্থনা আছে।
—আপনি বলিবার পূর্ব্বেই তাহা পূর্ণ হইল।
—যদি ভগবান্ বুদ্ধদেবের কৃপায় বিচারে আমি পরাজিত না হই, তাহা হইলে কর্ণসুবর্ণ নগরের বাহিরে ভিক্ষু-শ্রমণের বাসের উপযোগী একটি সঙ্ঘারাম নির্ম্মাণ করিয়া দিবেন।
—আমি সানন্দে স্বীকৃত হইলাম। ধর্ম্মযাজকদিগের বাসস্থান নির্ম্মাণ করাইয়া স্বয়ং কৃতার্থ হইব।
শ্রমণ দ্বিরুক্তি না করিয়া মহারাজার সঙ্গে নগরে আগমন করিলেন।
ওদিকে দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত প্রতিদিন একবার করিয়া বিচারসভার সম্মুখে ডঙ্কা মারিয়া যান। আর বলেন, এ দেশের এত নাম, কিন্তু এমন একজন পণ্ডিত নাই যে, আমার সঙ্গে বিচার করিতে সাহস করে। সপ্তম দিবসে যখন ঢাকে ঘা মারিলেন, সেই সময় রাজপণ্ডিত সেখানে দাঁড়াইয়াছিলেন। কহিলেন,—প্রাতঃপ্রণাম!
পণ্ডিত তাঁহার প্রতি অবহেলাসুচক দৃষ্টিপাত করিয়া কহিলেন,—প্রণাম। আপনি কে?
—আমি রাজসভায় পণ্ডিতের পদে নিযুক্ত। পদ আছে বটে, কিন্তু পাণ্ডিত্য কিছুমাত্র নাই।
—তাহা ত দেখিতেই পাইতেছি। সপ্তাহকাল প্রতিদিন আমি এখানে পণ্ডিতদিগকে শাস্ত্রবিচারে আহ্বান করিতেছি, আজ পর্য্যন্ত কাহারো দেখা নাই।
—এ অনুযোগ আপনি করিতে পারেন। এখন আপনি নিশ্চিন্ত হইতে পারেন, কাল সূর্য্যোদয়ের পর এই বিচারসভায় শাস্ত্রার্থ বিচার হইবে। আপনাকে সংবাদ দিতে আসিয়াছি।
পণ্ডিত বিদ্রূপ করিয়া কহিলেন,—কে বিচার করিবে? আপনি?
—মহাভারত! আমি ত বলিয়াছি যে, আমার ঘটে কিছু নাই। সাপ নামে মাত্র— ঢোঁড়া, ফণাও নাই, বিষও নাই।
—বটে, বটে! পণ্ডিতকে আপনি সর্পজাতি বিবেচনা করেন?
—উপমা ভাল হইল না? না হইবারই কথা। এখন প্রণাম করিয়া আমি বিদায় হই, সভার আয়োজন ও নগরে ঘোষণা করিতে হইবে।
—যিনি বিচার করিবেন,—তিনি কে?
—সভায় তাঁহার পরিচয় পাইবেন, আমি তাঁহাকে দেখি নাই।
রাজপণ্ডিত চলিয়া গেলেন। পণ্ডিতও অটল গাম্ভীর্য্যের সহিত, ধীরপদবিক্ষেপে নিজস্থানে গমন করিলেন।
সমস্ত দিন বিচার-সভা সজ্জিত ও সংস্কৃত হইল। রাজা ও তাঁহার পরিবারবর্গের নিমিত্ত উচ্চ মঞ্চে স্বতন্ত্র আসন নির্দ্দিষ্ট হইল। পণ্ডিতদিগের জন্য সভার মধ্যস্থলে বেদী নির্ম্মিত হইল, যাহাতে সভাস্থ সকলে সমস্ত দেখিতে ও শুনিতে পায়। দ্বার ও তোরণ পত্রপুষ্পে সুশোভিত হইল। বন্দিগণ নগরের সর্ব্বত্র বিচারের স্থান ও নির্দ্ধারিত সময় ঘোষণা করিতে লাগিল। সংবাদ পাইয়া কৌতুকপ্রিয় নাগরিকগণ রহস্য করিতে লাগিল।
একজন বলিল,—এমন পণ্ডিত কেহ কখন দেখিয়াছে? মানুষ ত নয়, যেন একটা দৈত্য!
—মাথায় কি উটি?
—দেউটি। সাপের মাথায় মাণিক থাকে না? অশ্বত্থামার মাথায় মাণিক ছিল, ইঁহার মাথায় মশাল।
—পণ্ডিতের বুদ্ধি হারাইয়াছে, তাহাই খুঁজিয়া বেড়ায়।
—বিচারের গোলকধাঁধায় পড়িলে পথ খুঁজিয়া বাহির করিবে।
—আর পেটে কি বাঁধা?
—ওটা পাঁচিল গাঁথা। লম্বোদর যদি বাড়িতে বাড়িতে ভূমিতে লুটাইয়া পড়ে? দুর্গের যেমন প্রাচীর, উহাও তেমনি উদরের প্রাচীর।
পর দিবস প্রত্যূষ হইতেই নগরবাসীরা সভায় ছুটিল। রাজবাটীর কর্ম্মচারীরা সকলকে বসাইয়া দিল। সভার ভিতর যখন আর স্থান রহিল না লোকেরা দ্বারদেশে দাঁড়াইয়া রহিল। স্ত্রীলোকেরা এমন স্থানে কখন আসে না, আজ তাহারা পণ্ডিতকে দেখিবার জন্য সারি দিয়া দাঁড়াইয়াছে।
রথে অশ্বারোহণে রাজবংশীয়েরা ও শ্রেষ্ঠিগণ আসিতে লাগিলেন। সভাদ্বারে তূর্য্যধ্বনি হইল—রাজা আসিতেছেন। কৌতূহল সম্বরণ করিতে না পারিয়া তাঁহার সহিত রাণীও আসিয়াছেন। সভা পরিপূর্ণ, সকলের দৃষ্টি দ্বারদেশে, সকলে পণ্ডিতদ্বয়ের আগমন অপেক্ষা করিতেছে।
পথে যাহারা দাঁড়াইয়াছিল তাহারা দেখিল, মহাকায় মাতঙ্গের মত রাজপথের মধ্যস্থল দিয়া পণ্ডিত আসিতেছেন। হন্তে দণ্ডকাষ্ঠ, মস্তকে মশাল, উদরে বর্ম্ম। সাটোপ পদক্ষেপ, চারিদিকে গর্ব্বিত দৃষ্টি। থাকিয়া থাকিয়া গম্ভীর কণ্ঠে বলিতেছেন, সোঽহং! তত্ত্বমসি! সভাদ্বারে উপনীত হইলে আবার তূর্য্যধ্বনি হইল। রাজপণ্ডিত, রাজকর্ম্মচারিগণ সসম্ভ্রমে পণ্ডিতকে প্রত্যুদ্গমন পূর্ব্বক তাঁহাকে নির্দ্দিষ্ট স্থানে উপবেশন করাইলেন।
সকলের শেষে শ্রমণ আসিলেন। মধ্যাকৃতি, শীর্ণ দেহ, উজ্জ্বল কান্তি, মুণ্ডিত কেশ, মুণ্ডিতমুখ, অঙ্গে ভিক্ষুর পীত কাষায় বসন। পথের এক পার্শ্ব দিয়া অবনত মস্তকে, কোনদিকে দৃষ্টিপাত না করিয়া অতিশয় সঙ্কোচের সহিত আগমন করিতেছিলেন। মাঝে মাঝে মৃদুস্বরে কহিতেছিলেন, বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি, ধর্ম্মং শরণং গচ্ছামি, সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি! দ্বারের সম্মুখে তাঁহাকে দেখিয়া তৃতীয় বার তূর্য্যনাদ হইল। তাঁহাকেও সসম্মানে বেদীর উপর যথাস্থানে লইয়া যাওয়া হইল।
রাজা আসন ত্যাগ করিয়া উঠিলেন। কহিলেন,—পণ্ডিতেরা উপস্থিত, সভাও পরিপূর্ণ, এইবার বিচার আরম্ভ হউক।
রাজপণ্ডিত প্রতিদ্বন্দ্বী পণ্ডিত দুইজনের সম্মুখে গিয়া কহিলেন,—সভাস্থ লোকদিগের অবগতির জন্য আপনাদের পরিচয় আমাকে দিতে হইবে।
পণ্ডিত কহিলেন,—আমি নিজেই দিতেছি। এই বলিয়া উন্নত মস্তক আরও উন্নত করিয়া, সভাস্থল ধ্বনিত করিয়া কহিলেন, আমার নাম দীপঙ্কর পণ্ডিত। এরূপ নাম কেন? আমি মস্তকে দীপ ধারণ করি বলিয়া। কেন মস্তকে দীপ ধারণ করি? এই জগতে লোক অজ্ঞানান্ধকারে পথহারা হইয়া ঘুরিতেছে,—তাহাদের প্রতি অহেতুকী কৃপাপরবশ হইয়া, তাহাদিগকে পথ প্রদর্শন করিবার জন্য মস্তকে আলোক ধারণ করিয়াছি। উদরে কেন বর্ম্মধারণ করিয়াছি? আমার পেটে এত বিদ্যা, এত জ্ঞান যে, পাছে পেট ফাটিয়া যায় এই আশঙ্কায় আমি কঠিন তাম্রফলক দ্বারা সর্ব্বদা পেট বাঁধিয়া রাখি। আমি সর্ব্বশাস্ত্রজ্ঞ, অনেক দেশে অনেক পণ্ডিতকে বিচারে পরাজিত করিয়াছি। এ দেশে যে আমার যশ প্রথিত হয় নাই তাহার কারণ এ দেশে পণ্ডিতের অভাব। এক সপ্তাহ আমি নিত্য ডঙ্কা দিয়া বিচার আহ্বান করিতেছি, এতদিন কোন সংবাদ পাই নাই। এখন এই সভাস্থলে আমার সহিত শাস্ত্রবিচার করিবার উপযুক্ত পণ্ডিত কাহাকেও দেখিতে পাইতেছি না।
পণ্ডিত ক্ষান্ত হইলেন। শ্রমণ রাজপণ্ডিতকে কহিলেন,—আমার পরিচয় দিবার কিছুই নাই, আমি সামান্য বিদ্যার্থী মাত্র। কিন্তু ভগবান বুদ্ধদেবের কৃপায় আমি বিচার করিতে প্রস্তুত।
এই কয়েকটি কথা রাজপণ্ডিত সকলকে শুনাইয়া বলিলেন। সভাস্থ সকলে শ্রমণের বিনয়ে প্রীত হইলেন।
বিচার আরম্ভ হইল। পণ্ডিত দীপঙ্কর শাস্ত্রোক্ত নানা মতের উল্লেখ করিলেন। জীব ও ব্রহ্ম স্বতন্ত্র অথবা অভিন্ন, মায়া কাহাকে বলে, বীজ হইতে বৃক্ষ অথবা বৃক্ষ হইতে বীজ, বহ্নি হইতে ধূম অথবা ধূম হইতে বহ্নি, ভ্রান্তির স্বরূপ কি, রজ্জুতে অহিভ্রম, হস্তামলক, স্থূল সুক্ষ্ম, ঈশ্বর সিদ্ধ অথবা অসিদ্ধ, অনুলোম ও বিলোম, সাকার ও নিরাকার, কুণ্ডলিনী ও পিঙ্গলা, ধারণা ধ্যান, বদ্ধ ও মুক্ত, স্বর্গ নরক ও সপ্তলোক এই নানা মতের অবতারণা করিলেন। শ্লোক ও শব্দের সংখ্যা ত্রিশ সহস্র।
পণ্ডিতের কথায় সভাশুদ্ধ লোক বিস্ময়ে অভিভূত হইল, কিন্তু তিনি যে কি প্রতিপাদন করিতেছেন তাহা কেহই বুঝিতে পারিল না। শ্রমণ মধুর, মুক্ত কণ্ঠে, স্বল্প কথায় যুক্তিপূর্ণ বাক্যবিন্যাসে পণ্ডিতের শব্দজাল ছেদন করিলেন। কহিলেন, সত্য এক, মত বহু। নানা গুরুর নানা মত, সেই নিবিড় অরণ্যে প্রবেশ করিলে মানব পথ কোথায় খুঁজিয়া পাইবে? সত্যের অনুসন্ধিৎসাই শাস্ত্রের মূল। এমন কোন শাস্ত্র নাই যাহার ভিন্ন ভিন্ন অর্থ হয় না। উপনিষদের কেহ দ্বৈত মতে, কেহ অদ্বৈত মতে ব্যাখ্যা করেন। সত্য গূঢ়নিহিত, বিচারে অথবা শাস্ত্রার্থে পাওয়া যায় না। পণ্ডিত দীপঙ্কর যে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত তাহা তাঁহার আচরণেই বুঝিতে পারা যাইতেছে। চন্দ্র-সূর্য্যের আলোকে যে তিমির বিনষ্ট হয় না তাহা কি তাঁহার মস্তকস্থিত দীপে দূরীভূত হইবে? অজ্ঞানের অন্ধকার বাহিরে, না মানবের হৃদয়ে? জ্ঞানের আলোক অন্তরে উৎপাদিত হইয়া বাহিরে সর্ব্বত্র আলোক বিকীর্ণ করে। মহানির্ব্বাণের পূর্ব্বে ভগবান বুদ্ধ আনন্দকে কহিয়াছিলেন,—তোমরা স্বয়ং নিজের আলোক হইবে। বিদ্যার প্রাচুর্য্যে পাছে উদর বিদীর্ণ হয় বলিয়া পণ্ডিত বর্ম্ম ধারণ করিয়াছেন। এরূপ হাস্যকর কথা কেহ কোথাও শুনিয়াছে? নৃসিংহ অবতারে বিষ্ণু হিরণ্যকশিপুর বক্ষ ও উদর বিদীর্ণ করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু বিদ্যার ভারে এরূপ দুর্ঘটনা কোন কালে হয় নাই। বিস্তার স্থান উদরে, না মেধায়, মস্তকে না অন্নকোষে? তবে পণ্ডিতের পক্ষে ইহা সম্ভবপর হইতে পারে। ইঁহার পেটে বিদ্যা অনেক থাকিতে পারে, কিন্তু ইনি তাহা জীর্ণ করিতে পারেন নাই, ইহা প্রত্যক্ষ লক্ষিত হইতেছে।
সাধু সাধু রবে সভাস্থল ধ্বনিত হইল, চারিদিকে হাস্যের তরঙ্গ উঠিল। লজ্জিত, ক্রুদ্ধ হইয়া পণ্ডিত দীপঙ্কর চারিদিক চাহিয়া দেখিতে লাগিলেন।
কোলাহল থামিলে পর পণ্ডিত প্রশ্নের আবর্ত্তচক্রে শ্রমণকে নিমগ্ন করিবার প্রয়াস করিলেন। কহিলেন,—বিচারস্থলে পণ্ডিতদের নাম প্রকাশ করিতে হয়। আপনার—তোমার নাম কি?
—লোকে আমাকে দেব বলে।
—দেব কে?
—আমি।
—আমি? এই আমি কে?
—অজ্ঞানী।
—এই যে অজ্ঞানী বলিলেন, এ ব্যক্তি কে।
—তুমি।
—তুমি বলিতে কাহাকে বুঝাইবে? তুমি কে?
—দেব।
—দেব কাহাকে বলিতেছ?
—আমাকে।
নিজের ঘূর্ণাবর্ত্তে পণ্ডিতকে মজ্জমান দেখিয়া সভাসুদ্ধ লোক হাসিয়া অস্থির হইল। পণ্ডিত পরাস্ত হইলেন। রাজা স্বয়ং উঠিয়া শ্রমণ দেবধরের গায় জয়মাল্য পরাইয়া দিলেন। বাহিরে রাজবাদ্য বাজিয়া উঠিল। শ্রণের ললাটে রাণী বিজয়তিলক দিলেন। রাজা নিজের রথে শ্রমণকে আরোহণ করাইয়া রাজবাটীতে লইয়া গেলেন।
সভার বাহিরে আসিয়া পণ্ডিত দীপঙ্কর মস্তকের পাত্রাধার ও মশাল এবং অঙ্গের বর্ম্ম দূরে নিক্ষেপ করিলেন। তিনি নগর হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া কোথায় গেলেন, কেহ জানিতে পারিল না। লোকালয়ে আর ফিরিলেন না।
অঙ্গীকার পূর্ণ করিয়া রাজা নগরের বাহিরে উদ্যান, তড়াগশোভিত বৃহৎ মনোরম সঙ্ঘারাম নির্ম্মাণ করিয়া দিলেন। সঙ্ঘারামের নামকরণ হইল রক্তবীথি। সেখানে এক সহস্র ভিক্ষু ও শ্রমণ বাস করিতেন।