রথযাত্রা ও অন্যান্য গল্প/নিষ্কণ্টক

নিষ্কণ্টক

—১—

 খরস্রোতা প্রবাহিণীর তীরে মনোহর উদ্যান, উদ্যানের মধ্যে মীরমঞ্জিল নামক প্রাসাদ। বাগানে চামেলী, জুঁই, মল্লিকা, গন্ধরাজ, চাঁপা, নাগকেশর ফুলের গাছ, পুষ্করিণীতে জল তক্ তক্ করিতেছে, তাহার পাশ দিয়া বড় বড় ঝাউ গাছের সারি। এক দিকে ফলের গাছ,—আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল।

 বাড়ীর বাহিরে সিংহদরজার মত ফটক, সেখান হইতে দুই দিক দিয়া বাড়ীর সদর দরজার পথ আসিয়াছে, দরজার সম্মুখে গাড়ীবারান্দা। বাগানবাড়ী, দোতালা, সব-সুদ্ধ দশ-বারটা বড় বড় ঘর আছে। একটু দূরে মোটর ও গাড়ী রাখিবার ঘর, চাকর-বাকরদিগের থাকিবার ঘর।

 বাড়ীতে লোকজন অধিক ছিল না। নসীর খাঁ নামক একজন ধনী মুসলমান যুবক সে গৃহে বাস করিতেন। দুইজন ভৃত্য, একজন বাবর্চি ও একজন মোটরচালক ছিল। বাড়ীর নীচে নদীর ধারে একটা নৌকার ঘর ছিল। তাহাতে তালা-বন্ধ-করা একটি ছোট বোট, বোটের জন্য একজন মাঝি। নসীর খাঁ কখন মোটরবোটে, কখন মোটরে বেড়াইতে যাইতেন, কখন সঙ্গে লোক থাকিত, কখন একা যাইতেন।

 অল্পদিন হইল এ বাড়ীতে তিনি আসিয়াছেন। কেহ তাঁহার সহিত দেখা করিতে আসিত না, তিনিও কাহারও সহিত আলাপ করিতেন না। খুব কাছাকাছি না হইলেও অল্প দূরে আরও বাড়ী ছিল, পথে যাইতে সময় সময় নৃত্যগীতের শব্দ শোনা যাইত, কিন্তু মীরমঞ্জিল স্তব্ধ, মনুষ্যকণ্ঠও শুনিতে পাওয়া যাইত না। সে-পথে গাড়ী ঘোড়া কি মোটর অধিক চলিত না, সুতরাং নসীর খাঁর মোটরও প্রায় নিঃশব্দে আসা-যাওয়া করিত, হর্ণের শব্দ বড়-একটা শোনা যাইত না। তিনি কখন্ বাড়ী থাকিতেন, কখন্ বাহিরে যাইতেন তাহার কোনো স্থিরতা ছিল না। ভৃত্যেরা কলের মত কাজ করিত, বাহিরে কোথাও বেড়াইতে যাওয়া বা অন্য বাড়ীর লোকজনের সঙ্গে গল্পগুজব করা তাহাদের ছিল না। দুই-একবার অপর লোকেরা তাহাদের সহিত আলাপ করিবার চেষ্টা করিয়াছিল, কিন্তু তাহারা অল্পভাষী দেখিয়া সে চেষ্টা পরিত্যাগ করিল।

 নসীর খাঁকে দেখিলে তাঁহার এরূপ একা বাস করিবার কারণ কিছুই বুঝা যাইত না। নবীন যুবা পুরুষ, উন্নতকায়, দীর্ঘমূর্ত্তি, সুশ্রী সতেজ মুখ, অল্প শ্মশ্রু, আয়ত বক্ষ, ক্ষীণ কটি; বলিষ্ঠ বুদ্ধিমান্ আকৃতি। অর্থের অপ্রতুল মনে হয় না, মোটর গাড়ী আর মোটর-নৌকা ধনী না হইলে রাখিতে পারে না, আর এই বয়সে যৌবনের উত্তেজনা, কত রকম আমোদ-প্রমোদে চিত্ত আকৃষ্ট হয়। নসীর খাঁর পরিচ্ছদ, আহার ইত্যাদি ধনীর মত, কিন্তু কোনো রকম সখ তাঁহার দেখিতে পাওয়া যাইত না। ঘরে ঘরে বিনা তারের রেডিও, তাঁহার তাহা ছিল না। বাড়ীতে একটা গ্রামোফোন পর্য্যন্ত নাই। সখের মধ্যে মোটর স্থলপথে ও জলপথে। কোথায় বেড়াইতে যাইতেন তাহাও বড়-একটা কেহ জানিত না।

—২—

 একদিন বৈকাল বেলা নসীর খাঁ মোটরে করিয়া একটা বড় সহরে উপস্থিত হইলেন। সহর তাঁহার বাড়ী হইতে প্রায় ত্রিশ ক্রোশ। সহরের বড় রাস্তার উপর একট বড় বাড়ীর সম্মুখে মোটর দাঁড়াইল। মোটরচালককে তাঁহার জন্য অপেক্ষা করিতে বলিয়া নসীর খাঁ বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলেন।

 বসতবাড়ী নয়, একজন বড় মহাজনের কুঠি। দোতালায় উঠিয় নসীর খাঁ দেখিলেন, একটা বড় ঘরে মেঝের উপর তাকিয়া ঠেসান দিয়া একজন প্রৌঢ়বয়স্ক ব্যক্তি বসিয়া আছে, মাথায় পাগ্‌ড়ী, কপালে ফোঁটা। ইনি গদিওয়ালা মহাজন বংশীলাল আগরওয়ালা। সামনে একটা কাঠের বড় বাক্স, পাশে হিসাবের খাতাপত্র। নসীর খাঁকে দেখিয়া বলিলেন,—আসুন খাঁসাহেব, বসুন।

 নসীর খাঁ বলিলেন,—শেঠ-সাহেব, মিজাজ ভাল ত?

 বংশীলাল বলিলেন,—আপনার অনুগ্রহ।

 নসীর খাঁ জুতা খুলিয়া বসিলেন। মহাজন জিজ্ঞাসা করিলেন,—কি হুকুম?

 —একটা হুণ্ডি আছে।

 —কই, দেখি, বলিয়া বংশীলাল হাত বাড়াইলেন।

 শেরওয়ানীর পকেট হইতে নসীর খাঁ হুণ্ডি বাহির করিয়া দিলেন। বংশীলাল চক্ষে চসমা দিয়া হুণ্ডি ভাল করিয়া দেখিলেন। কহিলেন,—৫০০ টাকা। নোট, না রোক দিব?

 —ছোট নোট হইলেই চলিবে।

 বংশীলাল বাক্স খুলিয়া ১০০ টাকা করিয়া ১০ টাকার নোটের পাঁচখানি তাড়া বাহির করিয়া গণিয়া দিলেন। নসীর খাঁ শেরওয়ানীর নীচে মেরজাইয়ের পকেটে নোটের তাড়া পূরিলেন।

 বংশীলাল একবার এদিক ওদিক দেখিলেন, ঘরে বা সম্মুখে আর কোনো লোক ছিল না। গলা নীচু করিয়া কহিলেন,—আপনার নামে একখানা চিঠি আছে।

 বড় বাক্সের ভিতর আর একটি ছোট ইস্পাতের ক্যাস-বাক্স ছিল। বংশীলাল কোমরের ঘুনসী হইতে একটি ছোট চাবি লইয়া বাক্স খুলিলেন। তাহার ভিতর হইতে শিলমোহর করা একখানি চিঠি নসীর খাঁর হাতে দিলেন। চিঠি খুলিয়া পড়িয়া নসীর খাঁ কহিলেন,—ইনি কয়দিন আসিয়াছেন? আমাকে সাক্ষাৎ করিতে লিখিয়াছেন। কোন্ বাড়ীতে তাঁহার দেখা পাইব?

 —দুই দিন হইল আসিয়াছেন। আপনাকে প্রকাশ্যভাবে যাইতে নিষেধ করিয়াছেন। আমি আপনাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইব। আপনার মোটর আছে?

 —আছে।

 —মোটর এখানেই থাকুক। আমরা হাঁটিয়া যাইব।

 —বেশ, চলুন।

 বংশীলাল নসীর খাঁকে সঙ্গে করিয়া একটা ছোট ঘরে লইয়া গেলেন। সে-ঘরে কাপড়চোপড় থাকিত। নসীর খাঁকে বসাইয়া বংশীলাল বাহিরে আসিয়া ডাকিলেন,—মেহেতা জী!

 মেহেতা জী নিজের ঘর হইতে হিসাবপত্র রাখিয়া দিয়া উঠিয়া আসিলেন। বংশীলাল কহিলেন,—আমি একবার বাহিরে যাইতেছি। আপনি আমার বাক্স ও খাতাপত্র তুলিয়া রাখুন।

 —যে আজ্ঞা।

 নসীর খাঁ যে-ঘরে বসিয়াছিলেন বংশীলাল সেই ঘরে প্রবেশ করিয়া দরজা বন্ধ করিয়া দিলেন। কহিলেন,—আমাদিগকে অত্যন্ত সাবধানে যাইতে হইবে, বুঝিতেই পারিতেছেন?

 —হাঁ, বুঝিতে পারিতেছি।

 —আমরা যতই গোপনে যাই না কেন, আমাদের পিছনে লোক লাগিবেই।

 —তাহাও বুঝিতেছি, কিন্তু আপনি আমার সঙ্গে যাইতেছেন কেন? আপনারও বিপদ হইতে পারে।

 বংশীলাল অল্প হাসিলেন,—কহিলেন, আপনার ও আমার একই অবস্থা। আপনার আশঙ্কা অধিক, কেননা আমার লোকবল আছে, আপনি একা।

 এবার নসীর খাঁ হাসিলেন, কহিলেন,—একা যেটুকু পারি সাবধান থাকিব।

 বংশীলাল একটি ছোট দরজা খুলিয়া নসীর খাঁর সঙ্গে বাড়ীর পিছনের সিঁড়ি দিয়া নামিয়া গেলেন। সেখানে দরজা খুলিতেই একটা গলি। গলির মোড়ে দুইজন বলবান পুরুষ লাঠি হাতে দাঁড়াইয়া ছিল। বংশীলাল সঙ্কেত করিবামাত্রই তাহারা দুইজন তাঁহাদের সঙ্গে চলিল।

—৩—

 বংশীলাল বরাবর গলির ভিতর দিয়া চলিলেন, কোথাও বড় রাস্তা পড়িলে পাশ কাটাইয়া অন্য একটা গলির মধ্যে প্রবেশ করিলেন। কিছুদূর এইরূপে গিয়া তাঁহারা একটা রাস্তার উপর একটা বড় বাড়ীর সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। বাড়ীর সদর দরজা বন্ধ, সম্মুখের অপর দরজা জানালাও বন্ধ। বংশীলাল দরজায় করাঘাত করাতে ভিতর হইতে একজন দরজা অল্প খুলিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কে?

 —বংশীলাল আগরওয়ালা।

 ভিতর হইতে আর একজন বলিল,—দরজা খুলিয়া দাও।

 দরজা খুলিতে বংশীলাল ও নসীর খাঁ দেখিলেন, চারজন লোক সশস্ত্র হইয়া দাঁড়াইয়া আছে, একজনের হাতে ভরা পিস্তল আর এক জনের হাতে খোলা তলওয়ার। তাহাদের পাশে আর একজন নিরস্ত্র ব্যক্তি দাঁড়াইয়া আছে, সে এই দরজা খুলিতে বলিয়াছিল। বংশীলাল, নসীর খাঁ ও তাঁহাদের সঙ্গের দুইজন লোক ভিতরে প্রবেশ করিতেই একজন দরজা বন্ধ করিয়া দিল।

 নিরস্ত্র ব্যক্তি বংশীলাল ও নসীর খাঁকে বলিল,—আপনারা আমার সঙ্গে আসুন।

 দোতালার উপরে কয়েকটা ঘর পার হইয়া তাঁহারা একটা ঘরের দরজায় উপস্থিত হইলেন। সেখানেও একজন প্রহরী। তাঁহাদিগকে দেখিয়া সে পথ ছাড়িয়া দিল।

 ঘরের ভিতর একটা টেবিলের সম্মুখে দুইজন লোক বসিয়া। একজনের বয়স পঞ্চাশ হইবে আর একজন তরুণ বয়স্ক, কুড়ি বাইশ বৎসরের অধিক নয়। দুই জনকে দেখিলেই মনে হয় যে, ইঁহারা বিশেষ সম্ভ্রান্তবংশীয়। যাঁহার বয়স অধিক তাঁহার চুল কিছু পাকিয়াছে, ললাট প্রশস্ত, চক্ষু আয়ত ও অত্যন্ত উজ্জ্বল। বর্ণ গৌর, আকৃতি কিছু দীর্ঘ, শরীর কৃশ কিন্তু দুর্ব্বল নয়, মুখের ভাব গম্ভীর। যুবক অনেকটা তাঁহারই মত দেখিতে, অত্যন্ত সুপুরুষ, মুখের ভাব অতি নম্র।

 বংশীলাল ও নসীর খাঁকে দেখিয়া প্রৌঢ় ব্যক্তি আসন ত্যাগ করিলেন না, কিন্তু তাঁহারা দুইজন অত্যন্ত বিনীতভাবে অভিবাদন করিলেন। যুবক উঠিয়া সেলাম করিল।

 নসীর খাঁ ও বংশীলাল আদেশ মত উপবেশন করিলেন। প্রৌঢ় পুরুষ মৃদু হাসিয়া কহিলেন,—আমাদের বিপদে যে তোমরাও জড়িত হইতেছ ইহাতে আমার ক্ষোভ হইতেছে।

 বংশীলাল কহিলেন,—আমরা পুরুষানুক্রমে আপনাদের প্রজা, আমাদের যাহা কিছু আছে আপনাদের কৃপায়। আমাদের জান মাল আপনার আজ্ঞাধীন। এই রাজ্য আপনার, শত্রু আপনাকে বঞ্চিত করিয়াছে।

 পুরুষ নসীর খাঁকে কহিলেন,—তুমি আমার আত্মীয়, কিন্তু তাহা হইলেও এই অল্প বয়সে যে তুমি আমাদের জন্য বিপদগ্রস্ত হইতে চাও ইহাতে কিছু কুণ্ঠিত হইতে হয়।

 নসীর খাঁ হাতজোড় করিয়া কহিলেন,—হজরত, আপনি নাজীর শাহের পৌত্ত্র শাহ সুলেমান। আপনার সহিত আত্মীয়তা আছে বলিয়া আমি গৌরব করিতে পারি, কিন্তু আমিও প্রজা এবং কিঙ্কর, আপনার কার্য্যে প্রাণের আশঙ্কা অতি তুচ্ছ মনে করি।

 শাহ সুলেমান কহিলেন,—বড় ভাগ্যবান না হইলে তোমাদের মত বন্ধু মিলে না। দেখ আমি নিজে সব ছাড়িয়া দিয়া ফকীর হইতে পারি, কিন্তু এই বালক আমার ভ্রাতুষ্পুত্ত্র, আমার অবর্ত্তমানে সিংহাসন ইহার, ইহাকে বঞ্চিত করিতে আমার ইচ্ছা হয় না। সিকন্দর শাহ, তুমি কি বল?

 যুবক সিকন্দর শাহ মস্তক অবনত করিয়া বলিল,—আপনার আদেশ ছাড়া আমার কোনো স্বতন্ত্র অভিপ্রায় নাই। আমার বলিবার কিছুই নাই।

 শাহ সুলেমান উঠিয়া বংশীলাল ও নসীর খাঁকে বলিলেন,—তোমরা একবার আমার সঙ্গে আইস।

 পাশের ঘরে গিয়া শাহ সুলেমান তাঁহাদিগকে দেখাইলেন ঘরে বাক্স, সিন্দুক, সমস্ত খোলা পড়িয়া আছে, জিনিষপত্র চারিদিকে ছড়ান। আর এক ঘরেও সেইরূপ।

 শাহ সুলেমান বলিলেন,—আমরা এখানে দুই দিন হইল আসিয়াছি, কিন্তু ইহারই মধ্যে কাল রাত্রে কখন কে আমাদের ঘরে প্রবেশ করিয়া সমস্ত বাক্স-পেটরা ভাঙিয়া তচনচ করিয়াছে, অথচ কিছু চুরি হয় নাই। সাধারণ চোরের কাজ নয় বুঝিতেই পারিতেছ। যাহা খুঁজিতে আসিয়াছিল তাহা পায় নাই। বাড়ীতে লোকজন, পাহারা, কিন্তু কখন ঘরে লোক আসিয়াছিল কেহ জানিতে পারে নাই।

 বংশীলাল বলিলেন,—আপনার লোক কি সব বিশ্বাসী?

 —আমার লোকেরা পুরুষানুক্রমে আমাদের বংশে কাজ করিয়া আসিতেছে। ইহাদের মধ্যে কেহ অবিশ্বাসী হইলে কত কাল পূর্ব্বে চুরি হইয়া যাইত। কি চুরি করিতে আসিয়াছিল তোমরা জান ত?

 বংশীলাল বলিলেন,—কিছু কাগজপত্র আছে জানি।

 নসীর খাঁ বলিলেন,—একটা প্রাচীন শিলমোহরও আছে।

 শাহ সুলেমান বলিলেন,—আছে তিনটি জিনিষ। সেই তিনটি জিনিষ না থাকিলে কেহ এ রাজ্য নিশ্চিন্ত হইয়া ভোগ করিতে পারিত না। যাহারা আমাদিগকে বলপূর্ব্বক শঠতা করিয়া তাড়াইয়া দিয়াছে, সেই তিনটি সামগ্রী না পাইলে তাহারা শীঘ্রই রাজ্যচ্যুত হইবে। এ সকল রাজ্য শাহান শাহ মোবারক শাহের অধীন, তোমরা সকলেই জান। বৎসরে একবার করিয়া আমাদিগকে তাঁহার রাজধানীতে যাইতে হয়, সেই সময় সেই সকল নিদর্শন দেখাইতে হয়, না দেখাইতে পারিলে রাজ্য বাজেয়াপ্ত হয়, শাহান শাহ আর কাহাকেও দিয়া দেন। তাঁহার সৈন্যবল এত অধিক যে, তাঁহার সহিত বিরোধ করিতে কাহারও সাহস হয় না। আমাদের শত্রু দশ মাস হইল রাজ্য অপহরণ করিয়াছে; আর দুই মাস পরে তাহাকে রাজধানী যাইতেই হইবে। সেইজন্য সেই তিনটি জিনিষের খোঁজ করিতেছে।

 বংশীলাল বলিলেন,—আপনাদের কোনো আশঙ্কা নাই।

 —এখন নয়। আমাদিগকে এখন হত্যা করিলে কোনো ফল নাই। কেননা, তাহা হইলে সে-সকল সামগ্রী একেবারেই না পাওয়া যাইতে পারে, আমরা অপর কাহাকেও দিয়া দিতে পারি। কিন্তু সে-সকল জিনিষ পাইলেই আমাদিগকে হত্যা করিবে।

 নসীর খাঁ কিছু বেগের সহিত কহিলেন,—আমরা আপনাকে রক্ষা করিবার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত।

 সুলেমান শাহ বলিলেন,—তোমরা আমার পরম মিত্র জানি, কিন্তু গুপ্তশত্রু হইতে কতক্ষণ রক্ষা করিবে? এই দেখ এত লোক থাকিতে এই বাড়ীতে লোক আসিয়াছিল। সিকন্দর ও আমি পিস্তল লইয়া শয়ন করি, রুদ্ধ দ্বারের বাহিরে দুজন সশস্ত্র প্রহরী থাকে, কিন্তু কোথায় কখন আমাদের প্রাণের আশঙ্কা, তাহা কেমন করিয়া জানা যাইবে? তবে আমার বিশ্বাস, এখন আমাদের প্রাণের আশঙ্কা নাই।

 বংশীলাল জিজ্ঞাসা করিলেন,—সে কয়েকটা সামগ্রী সাবধানে রাখিবার কি ব্যবস্থা করিয়াছেন?

 অল্প হাসিয়া সুলেমান শাহ বলিলেন,—সেই পরামর্শ করিবার জন্যই তোমাদিগকে ডাকাইয়াছি। সে জিনিষগুলা এখন পর্য্যন্ত আমার কাছেই আছে, কিন্তু কিছুদিন আর কোথাও রাখিতে পারিলে ভাল হয়। তোমরা একটু অপেক্ষা কর।

 সুলেমান শাহ চলিয়া গেলেন। যখন ফিরিয়া আসিলেন তাঁহার হাতে তিনটি সামগ্রী, দুইটি ছাগচর্ম্মের টুকরা, তাহাতে গাঢ় মসীতে লেখা, আর একটি লোহার নাম খোদাই করা মোহর। তিনটিই অত্যন্ত প্রাচীন, কিন্তু দেখিতে এত সামান্য যে, পথে পড়িয়া থাকিলেও কেহ চুরি করে না। অথচ এই তিনটি সামগ্রী একটা রাজ্যলাভের উপায়, ইহাদের অন্বেষণে কত লোক দিবারাত্র ফিরিতেছে।

 —আমার ইচ্ছা এই তিনটি সামগ্রী আর একত্রে না রাখা হয়, তাহা হইলে সবগুলি একসঙ্গে অপহৃত হইবে না।

 বংশীলালকে সম্বোধন করিয়া সুলেমান শাহ এই কথা বলিলেন।

 বংশীলাল কহিলেন,—হুজুর যেমন আদেশ করিবেন সেইরূপ হইবে। আমাকে যাহা রাখিতে বলিবেন, রাখিব।

 নসীর খাঁ কহিলেন,—আমিও রাখিতে সম্মত আছি।

 সুলেমান শাহ কহিলেন,—যাহারা এই কয়টি জিনিষ চুরি করিয়া কিংবা বলপূর্ব্বক গ্রহণ করিবার চেষ্টা করিতেছে তাহারা জানে, এগুলি আমার কাছে আছে। আমার নিকট হইতে অপহরণ করিবার অনেকবার চেষ্টা করিয়াছে। কিন্তু তোমাদিগকে যে সন্দেহ করিবে না, এমন মনে করিও না। আমাদের কাছে কে আসে যায় সে সন্ধান তাহারা রাখে। তোমরা আমার বিশ্বস্ত বন্ধু, তাহাও তাহারা জানে। যদি তাহাদের সংশয় হয় যে, এই সকল জিনিষ তোমাদের কাছে আছে, তাহা হইলে তোমাদের বাড়ী ত খুঁজিবেই, তোমাদের অন্য আশঙ্কাও আছে।

 নসীর খাঁ বলিলেন,—আপনি সে বিষয়ে কোনো চিন্তা করিবেন না, আমরা যথাসাধ্য আত্মরক্ষা করিব।

 সুলেমান শাহ এক খণ্ড চর্ম্ম ও মোহর আলাদা করিয়া কহিলেন,—এই দুইটি অধিক প্রাচীন ও এ দুটি না দেখাইতে পারিলে মোবারক শাহ কাহাকেও রাজা বলিয়া স্বীকার করিবেন না। তোমরা কে কোনটি রাখিবে?

 বংশীলাল বলিলেন,—প্রাচীন সনদ আমাকে দিন্।

 নসীর খাঁ বলিলেন,—তাহা হইলে মোহর আমি রাখিব।

 সুলেমান শাহ কহিলেন,—আমি আরও একটা কথা ভাবিয়াছি। সিকন্দর শাহ কিছুদিন আমার কাছে না থাকিয়া আর কোথাও থাকিলে হয়। তাহাতে আশঙ্কা থাকিলেও লাভ আছে।

 নসীর খাঁ যুক্তকরে কহিলেন—যুবরাজ যদি আমার গৃহে পদার্পণ করেন তাহা হইলে আমি চরিতার্থ হইব।

 সুলেমান শাহ জিজ্ঞাসা করিলেন,—সিকন্দর, তুমি কি বল?

 —আপনার আদেশ হইলেই নসীর খাঁর সঙ্গে যাইব।

 —আচ্ছা, তুমি নিজের বেশ পরিবর্ত্তন করিয়া সাধারণ লোকের পরিচ্ছদ পরিধান কর।

 শিকন্দর শাহ বেশ বদ্‌লাইতে গেলেন। সুলেমান শাহ কহিলেন,—তোমরা হাজার সাবধানে এখানে আসিলেও তোমাদের পিছনে লোক আছে। বংশীলাল তোমার সঙ্গে লোক আছে?

 —দু’জন লোক হাতিয়ার সমেত আছে।

 —তোমার নিজের কাছে কোনো অস্ত্র আছে?

 বংশীলাল বক্ষের ভিতর হইতে একটি ছোট পিস্তল বাহির করিয়া দেখাইলেন।

 সুলেমান শাহ নসীর খাঁকে জিজ্ঞাসা করিলেন,—তোমার কাছে কি আছে?

 নসীর খাঁর কাছে দুইটি উৎকৃষ্ট পিস্তল ও কটিতে তীক্ষ্ণধার ছুরি ছিল।

 সুলেমান শাহ আবার জিজ্ঞাসা করিলেন,—তুমি মোটরে আসিয়াছ?

 —আজ্ঞা হাঁ।

 —ফিরিবার সময় তুমি নিজে মোটর চালাইবে, আগে-পিছনে দৃষ্টি রাখিবে।

 সিকন্দর শাহ সাধারণ নগরবাসীর ন্যায় পোষাক পরিয়া ফিরিয়া আসিলেন। সুলেমান শাহের প্রশ্নের উত্তরে পিস্তল বাহির করিয়া দেখাইলেন। সুলেমান শাহ নিজের কটি হইতে ছুরি বাহির করিয়া তাঁহাকে দিলেন, বলিলেন,—এটাও রাখ।

 বংশীলাল সনদ কটির বস্ত্রে বাঁধিয়া লইলেন, নসীর খাঁ মোহর রুমালে বাঁধিয়া মীরজাইয়ের ভিতর লইলেন।

 বাড়ীর বাহিরে আসিয়া বংশীলাল ও নসীর খাঁ লক্ষ্য করিলেন, একজন লোক কিছু দূরে দাড়াইয়া তাঁহাদিগকে দেখিতেছে। তাঁহাদের তিনজনকে দেখিয়া সে একটা গলির ভিতর চলিয়া গেল।

—৪—

 বংশীলালের কুঠীতে পঁহুছিতে সন্ধ্যা হইল। বংশীলাল নসীর খাঁকে বলিলেন,—আপনারা আর একটু অপেক্ষা করিবেন কি? তাহা হইলে অন্ধকার হইয়া আসিবে।

 সিকন্দর শাহ ও নসীর খাঁ একটু বসিলেন। ঘোর ঘোর হইলে নসীর খাঁ ও সিকন্দর শাহ বাড়ীর বাহিরে আসিয়া মোটরে উঠিলেন। মোটর-চালককে নসীর খাঁ বলিলেন,—মোটর আমি চালাইব, তুমি গাড়ীর ভিতর ব’স। তুমি পিছন দিকে মুখ ফিরাইয়া বসিবে, আমাদের পিছনে কোনো মোটর কি মোটর-বাইক আসিতেছে দেখিতে পাইলে আমাকে বলিবে। সামনের দিকে আমি নজর রাখিব।

 সম্মুখ দিকে সিকন্দর শাহ নসীর খাঁর পাশে বসিলেন। নসীর খাঁ বলিলেন,—আপনি পিস্তল বাহির করিয়া হাতে রাখুন। প্রয়োজন হইলে ব্যবহার করিতে বিলম্ব করিবেন না।

 একটা পিস্তল নসীর খাঁ নিজের পাশে রাখিলেন, আর একটা মোটর-চালকের হাতে দিলেন, বলিলেন,—পিছন হইতে যদি কেহ আমাদের আক্রমণ করে তখনি গুলি করিবে।

 সহর হইতে বাহির হইয়া নসীর খাঁ বেগে মোটর চালাইলেন। মোটর-চালক পিস্তল হাতে করিয়া পিছন দিকে মুখ ফিরাইয়া দেখিতে লাগিল। সিকন্দর শাহ পথের দুই পাশে লক্ষ্য রাখিলেন। নসীর খাঁর দৃষ্টি সম্মুখ দিকে, কিন্তু পাশের দিকেও তাঁহার নজর ছিল।

 কিছুদূর গিয়া মোটর-চালক বলিল,—পিছন হইতে একখানা বড় মোটর বড় জোরে আসিতেছে।

 নসীর খাঁ পশ্চাতে ফিরিয়া চাহিলেন। দেখিলেন, মোটরে দুই জন আছে, তাঁহার মোটরের অপেক্ষা এ মোটর বড় এবং গতির বেগও অধিক। আর কিছুদূর যাইতেই সে মোটর তাঁহাদের কাছে আসিয়া পড়িবে। সম্মুখে চাহিয়া দেখিলেন, একটু আগেই রাস্তা বাঁ-দিকে বেঁকিয়া গিয়াছে। সেখানে জঙ্গলের মত, পথের ধারে কয়েকটা বড় বড় অশ্বত্থ ও বটগাছ। নসীর খাঁ হঠাৎ মোটরের পিছন হইতে ধোঁয়া বাহির করিতে আরম্ভ করিলেন। পথ ধোঁয়ায় অন্ধকার হইয়া গেল, পিছন হইতে আর কিছু দেখা যায় না। সেই অবসরে নসীর খাঁ রাস্তার মোড় ফিরাইয়া মোটর একপাশে দাঁড় করাইলেন। তাঁহার ইঙ্গিত-মত মোটর-চালক পিস্তল হাতে নামিল। সিকন্দর শাহ নসীর শাহের সঙ্গে নামিলেন। তিনজনে একটা বড় বটগাছের আড়ালে দাঁড়াইলেন। তখনও পিছনের মোটর আসিয়া পৌঁছায় নাই, বাতাসে ধোঁয়া অল্পে অল্পে উড়িয়া যাইতেছে।

 বড় মোটর মোড় ফিরিতেই আরোহীরা দেখিল, অন্য মোটর পথের পাশে দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। তখনি ব্রেক বাঁধিয়া আরোহী দুইজন লাফাইয়া পড়িল, দুইজনেরই হাতে পিস্তল। তাহারা নসীর খাঁর মোটরের দিকে অগ্রসর হইল।

 তাহাদের পশ্চাৎ হইতে কে স্পষ্ট, কঠোর স্বরে কহিল,—তোমরা যেমন আছ তেমনি দাঁড়াইয়া থাক। পিছনে মুখ ফিরাইও না। হাতের পিস্তল মাটিতে ফেলিয়া দাও।

 সে দুই ব্যক্তির মধ্যে একজন অল্প ঘাড় বাঁকাইয়া পিছনে দেখিবার চেষ্টা করিল। তৎক্ষণাৎ—দুম্! তাহার কানের পাশ দিয়া শোঁ করিয়া গুলি বাহির হইয়া গেল।

 নসীর খঁ সেইরূপ কঠিন কণ্ঠে কহিলেন,—এবার মুখ ফিরাইলে গুলি তোমার মাথায় লাগিবে। তোমাদের পিছনে তিনটি পিস্তল। তোমরা পিস্তল ফেলিয়া দাও, নহিলে হাতে গুলি করিব।

 পিস্তল দুইটা পথের মাঝখানে সশব্দে পড়িয়া গেল। নসীর খাঁ ও সিকন্দর শাহ সেই দুই ব্যক্তির সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন, তাঁহাদের পিস্তলের লক্ষ্য তাহাদের বক্ষঃস্থল। নসীর খাঁ মোটর-চালককে কহিলেন,—ইহাদের কাছে কি আছে দেখ।

 নসীর খাঁ তাহাদের কাপড়চোপড় দেখিয়া দুইখানা ছুরি পাইল, একজনের পকেটে একখানা কাগজ ছিল, সেখানা নসীর খাঁ লইলেন। তাহার পর আদেশ করিলেন,—ইহাদিগকে বাঁধ।

 তাহাদের মাথার পাগ্‌ড়ী খুলিয়া মোটর চালক তাহাদিগকে বাঁধিল। নসীর খাঁ বলিলেন,—ইহাদের মোটরের চাকা ফাটাইয়া দাও।

 মোটর চালক পিস্তলের গুলি দিয়া সব টায়ারগুলা ফাটাইয়া ফেলিল। বোমা ফাটার মত শব্দ হইল।

 নসীর খাঁর আদেশে মোটর চালক সেই দুই ব্যক্তিকে তাহাদের নিজের মোটরে বাঁধিল।

 নসীর খাঁ সেই দুই ব্যক্তিকে বলিলেন,—আবার তোমাদের দেখিলে চিনিতে পারিব, কিন্তু আমাদের সঙ্গে আর দেখা না হওয়াই তোমাদের মঙ্গল। এবার তোমরা রক্ষা পাইলে, দ্বিতীয়বার পাইবে না।

—৫—

 বাড়ীতে ফিরিয়া নসীর খাঁ মোটর-চালককে বলিলেন,—রাত্রেও সাবধান থাকিতে হইবে।

 মোটর-চালক এ পর্য্যন্ত, একটা কথাও বলে নাই, নসীর খাঁর আদেশ নীরবে পালন করিয়াছিল। এখন বলিল,—সেই দুইটা লোক আবার আসিতে পারে?

 —তাহারাই হউক কিংবা অন্য লোক। ইহারা চোর নয়, আমাদের দুশমন।

 —বাড়ীর অন্য লোককে বলিব?

 —সকলকে বলিবে। সকলের কাছে যেন অস্ত্র থাকে।

 সিকন্দর শাহ বাগান দেখিয়া, বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়া কহিলেন,—আপনার বাড়ী বেশ সুন্দর।

 নসীর খাঁ কহিলেন,—এখানে আপনার কোনো কষ্ট হইবে না। আমাকে আপনার ভৃত্য বিবেচনা করিবেন।

 সিকন্দর শাহ লজ্জিত হইয়া কহিলেন,—অমন কথা বলিবেন না, আপনি আমাদের পরম বন্ধু, আমাদের জন্য বিপদ স্বীকার করিয়াছেন।

 আহারাদির পর নসীর খাঁ সিকন্দর শাহকে জিজ্ঞাসা করিলেন,—আপনার কুকুরের সখ আছে?

 —খুব আছে, কিন্তু সঙ্গে আনিতে পারি নাই। আমাদিগকে গোপনে তাড়াতাড়ি চলিয়া আসিতে হইয়াছিল।

 —আসুন, আমার কুকুর দেখিবেন।

 বাড়ীতে, বাড়ীর বাহিরে বৈদুত্যিক আলো জ্বলিতেছিল। যেখানে মোটর রাখা ছিল তাহার পাশের ঘর খুলিয়া নসীর খাঁ আলো জ্বালিলেন। সিকন্দর শাহ দেখিলেন, বাঘের মত চারিটা কুকুর লোহার শিকলে বাঁধা রহিয়াছে। বলিলেন,—এ ত তাজী কুকুরের অপেক্ষাও বড়। কোথায় পাইলেন?

 —এগুলি বিদেশী কুকুর। আর এক দেশে গিয়া দুই জোড়া পাইয়াছিলাম।

 —ইহাদের নাম কি রাখিয়াছেন?

 —এইটি রুস্তম, সকলের অপেক্ষা বলবান, ইহার পাশে ইহার জোড়া বানু। আর ও-পাশে খুসরু ও হনিফা।

 নসীর খাঁকে দেখিয়া কুকুরগুলা ল্যাজ নাড়িতেছিল, সিকন্দর শাহকে দেখিতেছিল। তিনি রুস্তম বলিয়া ডাকিয়া রুস্তমের মাথায় হাত দিলেন। কি করেন? সাবধান! বলিয়া নসীর খাঁ তাড়াতাড়ি সিকন্দর শাহের হাত ধরিতে গেলেন, কিন্তু সিকন্দর শাহ হাসিতে লাগিলেন। রুস্তম তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া তাঁহার পায়ের কাছে লুটাইয়া পড়িল।

 নসীর খাঁ বলিলেন,—ইহারা অপরিচিত কোনো লোককে কাছে আসিতে দেয় না। কুকুর বশ করিবার আপনার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে।

 সিকন্দর শাহ বলিলেন,—আমি কুকুর ভালবাসি। ইহারা থাকিতে আপনার পাহারার প্রয়োজন কি?

 —সকল রাত্রে ইহাদিগকে খুলি না, কিন্তু এখন ইহাদের দরকার। দশজন অস্ত্রধারী সিপাহী অপেক্ষা রাত্রিকালে ইহাদের উপর ভরসা অধিক। ইহারা বড় একটা ডাকে না, যাহাকে ধরে তাহাকে প্রাণেও মারে না, মানুষ ধরিয়া তাহার পর সাড়া দেয়।

 নসীর খাঁ কুকুর চারিটা খুলিয়া দিলেন। তাহারা নিঃশব্দে তাঁহাদের পিছনে পিছনে চলিল। নসীর খাঁ ও সিকন্দর শাহ বাড়ীর চারিদিকে ঘুরিলেন, লোকজনকে সতর্ক থাকিতে বলিলেন। বাড়ীতে প্রবেশ করিবার সময় রুস্তমকে ভিতরে ডাকিয়া দরজা বন্ধ করিলেন, বলিলেন,—রুস্তম, তুমি আজ আমাদিগকে পাহারা দিবে।

 রুস্তম একবার ল্যাজ নাড়িয়া নসীর খাঁর শয়ন কক্ষের দ্বারদেশে গিয়া বসিল।

 সেই ঘরে সিকন্দর শাহেরও শয্যা পাতা হইয়াছিল। ঘরে প্রবেশ করিয়া নসীর খাঁ কহিলেন,—আমরা এখানে শয়ন করিব না, সাধ্যমত আমাদিগকে সাবধানে থাকিতে হইবে।

 দুইটি শয্যায় বালিশ ও বিছানা নসীর খাঁ এরূপভাবে সাজাইলেন যেন দুইটি লোক শুইয়া আছে। সেই ঘরের ভিতর দিয়া আর একটি ঘরে প্রবেশ করিয়া নসীর খাঁ সিকন্দর শাহকে আর দুইটি শয্যা দেখাইলেন। বলিলেন, আমরা এইখানে শয়ন করিব। আপনি নিশ্চিন্ত হইয়া নিদ্রিত হউন, আমি জাগিয়া থাকিব।

 সিকন্দর শাহ বলিলেন,—সে কেমন কথা! আমার জন্য আপনার আশঙ্কা, আর আমি নিশ্চিন্ত হইয়া ঘুমাইব? নূতন স্থানে সহজেই আমার ঘুমের একটু ব্যাঘাত হইয়া থাকে, অতএব প্রথম রাত্রে কিছুতেই আমার নিদ্রা হইবে না। আপনি এখন নিদ্রিত হউন, আমার নিদ্রা আসিলে আপনাকে উঠাইয়া দিব।

 —সেই ভাল কথা, বলিয়া নসীর খাঁ পাশ ফিরিয়া শয়ন করিলেন।

 অর্দ্ধ রাত্রি পর্য্যন্ত কোনো রকম সাড়াশব্দ শুনিতে পাওয়া গেল না। রাত্রি প্রায় দুইটার সময় একবার বাড়ীর বাহিরে কুকুরের ডাক শোনা গেল। ঘরের ভিতর রুস্তম একবার ডাকিয়া বাহিরে যাইবার চেষ্টা করিতে লাগিল। সিকন্দর শাহ তৎক্ষণাৎ উঠিলেন। নসীর খাঁ পিস্তল-হাতে উঠিয়া আসিলেন, সিকন্দর শাহকে জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনার পিস্তল?

 সিকন্দর শাহ নিজের হাতের পিস্তল দেখাইলেন।

 নসীর খাঁ কহিলেন,—কুকুর অকারণে ডাকিবে না, নিশ্চিত কোনো লোক দেখিয়া থাকিবে।

 নসীর খাঁ ও সিকন্দর শাহ দরজা খুলিয়া বাহিরে আসিলেন। রুস্তম বেগে বাগানের একদিকে দৌড়িয়া গেল।

 নসীর খাঁ বলিলেন, চলুন, আমরাও উহার পিছনে যাই।

 মোটর চালক ও অপর ভৃত্যেরা উঠিয়া লণ্ঠন হাতে করিয়া তাঁহাদের দিকে আসিতেছিল।

 যেদিকে রুস্তম দৌড়িয়া গিয়াছিল সেইদিকে সকলে গিয়া দেখিলেন, যেখানে বাগান বড় অন্ধকার সেইখানে একটা বকুল গাছের তলায় একটা লোক পড়িয়া আছে। খুসরু নামক কুকুর তাহার বুকে দুই থাবা দিয়া চাপিয়া বসিয়া আছে, আর দুইটা কুকুর তাহাকে ঘিরিয়া দাঁড়াইয়া আছে।

 যে লোকটা মাটিতে পড়িয়াছিল সে মানুষ দেখিয়া আর্ত্তস্বরে চীৎকার করিয়া উঠিল,—আমাকে রক্ষা কর। কুকুরে আমাকে মারিয়া ফেলিবে।

 নসীর খাঁ চাকরদের নিকট হইতে একটা লণ্ঠন লইয়া চারিদিকে দেখিতে লাগিলেন। নিকটেই একটা পিস্তল পড়িয়াছিল, সেটা তুলিয়া লইলেন।

 তিনি খুসরু বলিয়া ডাকিতেই খুসরু সে লোকটাকে ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। সে ব্যক্তির শরীর অক্ষত, কেবল ভয়ে সে ঠক্‌ ঠক্‌ করিয়া কাঁপিতেছিল।

 নসীর খাঁর আদেশ-মত ভৃত্যেরা সে লোকটাকে টানিয়া তুলিয়া তাহার বস্ত্রের মধ্যে এক টুকরা কাগজ খুঁজিয়া পাইল।

 ইহার পূর্ব্বে নসীর খাঁ মোটরের লোকদের কাছে এক খণ্ড কাগজ পাইয়াছিলেন। সেখানা তাঁহার পকেটে ছিল। সেখানা বাহির করিয়া দ্বিতীয় কাগজের সহিত মিলাইয়া দেখিলেন, দুখানিই এক রকম, তাহাতে শুধু লেখা আছে, এই কাগজ আর মাল আনিলে প্রতিশ্রুত পুরস্কার পাইবে।

 নসীর খাঁ কাগজে লেখা সিকন্দর শাহকে দেখাইলেন। সিকন্দর শাহ পড়িয়া বলিলেন,—ইহা জানা কথা।

 নসীর খাঁ চাকরদের বলিলেন,—এই লোকটাকে আমার বসিবার ঘরে লইয়া আইস।

 নসীর খাঁ ও সিকন্দর শাহ রুস্তমকে সঙ্গে করিয়া বৈঠকখানা ঘরে আসিলেন। যে লোকটা ধরা পড়িয়াছিল তাহাকে লইয়া আসিলে পর নসীর খাঁ ভৃত্যদিগকে কহিলেন,—তোমরা যাও, ইহাকে আমি বন্ধ করিয়া রাখিব।

—৬—

 ভৃত্যেরা বাহির হইয়া গেলে পর নসীর খাঁ দরজা বন্ধ করিলেন। ঘরের সব কয়টা আলো জ্বলিতেছিল। নসীর খাঁ ও সিকন্দর শাহ পাশাপাশি বসিলেন, রুস্তম নসীর খাঁর পায়ের কাছে বসিল। হাতের পিস্তল দুইটা নসীর খাঁ নিজের পাশে রাখিলেন।

 যে লোকটা ধৃত হইয়াছিল সে তাঁহাদের সম্মুখে দাঁড়াইয়া ছিল। এ পর্য্যন্ত তাহার কোন শাস্তি হয নাই দেখিয়া তাহার সাহস ফিরিয়া আসিতেছিল।

 নসীর খাঁ জিজ্ঞাসা করিলেন,—তুমি কে?

 —আমি চোর, দেখিতেই পাইতেছেন!

 —চোরের কাছে কি পিস্তল থাকে?

 —আত্মরক্ষার জন্য কেহ ছুরি রাখে, কেহ পিস্তল রাখে।

 —পিস্তল থাকিতে আত্মরক্ষা করিতে পারিলে না কেন, এত সহজে ধরা পড়িলে কেন?

 চোরের মুখ শুকাইল। কহিল,—বিপদ জানিলে আত্মরক্ষা করিতে পারা যায়। আমি কুকুর দেখি নাই, কুকুরের ডাকও শুনি নাই, হঠাৎ আমার ঘাড়ে ও পিঠে যেন একটা প্রকাণ্ড পাথর পড়িল, পিস্তল কোথায় পড়িয়া গেল, আমি পড়িয়া গিয়া উঠিবার চেষ্টা করিতেছি, এমন সময় বাঘের মত একটা কুকুর আমাকে চাপিয়া ধরিল।

 নসীর খাঁ অল্প হাসিলেন, সে হাসি দেখিয়া চোরের ভয় হইল। নসীর খাঁ বলিলেন,—আমি একবার ইসারা করিলেই কুকুরে তোমার টুঁটি ছিঁড়িয়া খাইত, জান?

 চোর বারকতক ঢোক গিলিয়া বলিল,—হুজুর, তা ত জানি।

 —এ বাড়ীতে ত চুরি করিবার কিছুই নাই, টাকাকড়ি আমি বাড়ীতে রাখি না, এখানে চুরি করিতে কেন আসিয়াছিলে?

 —কিছু আছে কি না কেমন করিয়া জানিব?

 —তুমি কি চুরি করিতে আসিয়াছিলে, কে তোমাকে পাঠাইয়াছিল, আর এ কাগজে কাহার লেখা, সত্য করিয়া বল।

 —আমার আর কিছু বলিবার নাই, আমি আর কিছু বলিব না।

 —বটে? কুকুর দিয়া খাওয়াইলে বলিবে! রুস্তম!

 রুস্তম উঠিয়া দাঁড়াইয়া চোরের দিকে চাহিয়া লাফাইবার উপক্রম করিল।

 চোর ভয়ে অস্থির হইয়া বলিল,—হুজুর, হুজুর, আমি সকল কথা বলিতেছি, কুকুর লেলাইয়া দিবেন না।

 নসীর খাঁ হাত নাড়িতেই রুস্তম আবার বসিল। নসীর খাঁ চোরকে বলিলেন,—আমার কথার উত্তর দাও।

 —আমি মোহর আর কাগজ চুরি করিতে আসিয়াছিলাম। এ কাগজে কাহার লেখা, আমি জানি না। যে আমাকে এখানে আসিতে বলিয়াছিল তাহাকে আমি চিনি না। আমাকে পঞ্চাশ টাকা দিয়া বলিয়াছিল জিনিষ আনিতে পারিলে আরও পাঁচশো টাকা পাইবে।

 —যে তোমাকে এখানে পাঠাইয়াছিল সে কোথায় থাকে?

 চোর সহরে একটা বাড়ীর ঠিকানা দিল, বলিল, সে ব্যক্তি সে বাড়ীতে থাকে কি না বলিতে পারি না।

 —আচ্ছা, আজ রাত্রে তুমি বন্ধ থাক, কাল সকালবেলা একটা ব্যবস্থা করিব।

 নসীর খাঁ চোরকে একটা ছোট কুঠুরীতে বদ্ধ করিলেন। একটি দরজা, ভিতরে জানালা ছিল না। বাহির হইতে তালা বদ্ধ করিয়া রুস্তমকে দরজার সম্মুখে বসাইয়া রাখিলেন।

 দ্বিতীয়বার শয়ন করিবার সময় নসীর খাঁ সিকন্দর শাহকে কহিলেন,—আমার মনে হয় এ ব্যক্তি সত্য বলিতেছে। যাহারা ইহার পিছনে আছে তাহারা ইহার নিকট আত্ম-পরিচয় দিবে না।

 সিকন্দর শাহ বলিলেন,—আমারও তাহাই মনে হয়।

—৭—

 প্রাতে চোরকে সঙ্গে করিয়া নসীর খাঁ ও সিকন্দর শাহ বংশীলালের কুঠীতে উপস্থিত হইলেন। চোরকে দেখিয়াই বংশীলাল চিনিলেন, কহিলেন,—কি, রামঅবতার! কাল রাত্রে কি তোমার খাঁ সাহেবের বাড়ী নিমন্ত্রণ ছিল?

 রামঅবতার মুখ বিকৃত করিয়া কহিল,—আপনি কি আমার জাত মারিতে চান?

 নসীর খাঁ বলিলেন,—রামঅবতার আমাদের অতিথি।

 রাত্রের ঘটনা বলিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন,—ইহাকে আপনি চেনেন?

 —বিলক্ষণ চিনি! বড় বাহাদুর লোক, কিছু টাকা পাইলেই সব করিতে প্রস্তুত। রামঅবতার, কাল রাত্রে তোমার জুড়িদার কে ছিল?

 —আমি একা ছিলাম, আমার সঙ্গে আর কেহ ছিল না।

 —একজন এখানে আসিয়াছিল, কিন্তু বড় তাড়াতাড়ি চলিয়া গেল।

 বংশীলাল সকলকে সঙ্গে করিয়া বাড়ীর পিছন দিকে লইয়া গেলেন। সেখানে একটা সরু সিঁড়ির পৈঠার স্থানে স্থানে রক্তচিহ্ন। বংশীলাল বলিলেন,—রাম অবতার, এই তোমার জুড়িদারের চিহ্ন। অন্ধকারে কোথায় চোট লাগিয়াছিল, আমাদিগকে না দেখাইয়াই চলিয়া গিয়াছে।

 নসীর খাঁ হাসিয়া বলিলেন,—রাম অবতারের গলাটাও বড় রক্ষা পাইয়াছিল, নহিলে আর কথা কহিবার শক্তি থাকিত না।

 বংশীলাল বলিলেন,—এখানে যে আসিয়াছিল তাহার পায়ে আমি গুলি করিয়াছিলাম। মাস কয়েক তাহাকে বিছানায় পড়িয়া থাকিতে হইবে।

 নসীর খাঁ বলিলেন,—রাম অবতার আমার বাড়ীতে খাইবে না, তাহার আতিথ্য সেবা কেমন করিয়া হইবে?

 —তাহার আর ভাবনা কি? এখানে কে আছে?

 একজন বলবান দরওয়ান আসিল। বংশীলাল কহিলেন,—রামঅবতার কাল রাত্রে খাঁ সাহেবের বাড়ীতে চুরি করিতে গিয়াছিল। ইহাকে খাইতে দাও, কিন্তু আমি হুকুম না দিলে ইহাকে ছাড়িবে না।

 —বহুত খুব, শেঠজী, বলিয়া দরওয়ান রামঅবতারকে ধরিয়া লইয়া গেল।

 তাহার পর সকলে গিয়া সুলেমান শাহের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। তিনি বংশীলাল ও নসীর খাঁকে ধন্যবাদ দিয়া সিকন্দর শাহকে জিজ্ঞাসা করিলেন,—তুমি কি নসীর খাঁর বাড়ীতেই থাকিবে?

 সিকন্দর শাহ কহিলেন,—আমি বেশ আছি। খাঁ সাহেবের যে কুকুর আছে তাহাতে চোর-ডাকাতের কোনো ভয় নাই!

 সুলেমান শাহ কুকুরের কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। নসীর খাঁ বলিলেন,—জাঁহাপনা, যদি একদিন আমার গৃহে পদার্পণ করেন, তাহা হইলে আপনাকে কুকুর দেখাই।

 সুলেমান শাহ বলিলেন,—আমি নিশ্চিত একদিন যাইব। আমার এখানে আর কোনো উপদ্রব হয় নাই, উহাদের বিশ্বাস হইয়া থাকিবে, জিনিষগুলা আমার কাছে নাই।

—৮—

 নসীর খাঁ ও সিকন্দর শাহ মীরমন্‌জালে ফিরিয়া আসিলেন। তাঁহারা বেড়াইতে বেড়াইতে নদীর ধারে উপস্থিত হইলেন। সেখানে নৌকার ঘর দেখিয়া সিকন্দর শাহ জিজ্ঞাসা করিলেন, ইহার ভিতর নৌকা আছে?

 নসীর খাঁ বলিলেন,—একটা ছোট মোটর-বোট আছে। আমি কখনও কখনও নদীতে বেড়াইতে যাই।

 নৌকার ঘরের সম্মুখে আসিয়া লোহার গরাদের ভিতর দিয়া সিকন্দর সাহ মোটর বোট দেখিতে পাইলেন। কহিলেন,—আপনার অনুমতি হইলে আমি নদীতে একবার ভ্রমণ করিয়া আসি।

 নসীর খাঁ কহিলেন,—আসুন, আমি আপনাকে লইয়া যাইতেছি।

 তালা খুলিয়া নসীর খাঁ ও সিকন্দর শাহ বোটে উঠিলেন। নদীতে যাইবার আর একটা দরজা ছিল, নসীর খাঁ সেটা খুলিয়া বোট বাহিরে আনিলেন। স্রোতে পড়িয়া বোট ভাসিয়া চলিল।

 নসীর খাঁ বলিলেন,—বোট আপনি চালাইবেন?

 সিকন্দর শাহ এঞ্জিন চালাইয়া বোটের হাল ধরিলেন। নসীর খা তাঁহার সম্মুখে বসিলেন। নৌকায় গদি পাতা, মাঝখানে একটি ছোট কামরা, তাহার ভিতর দুইজন লোক আরামে বসিতে ও শুইতে পারে।

 নদীর স্রোত একটানা, জলের প্রবাহ তীব্র। প্রশস্ত গভীর নদী, পর পারে চাষের জমি, কাছাকাছি নৌকা ও লোকজন নাই। সিকন্দর শাহ বোটের মুখ ফিরাইয়া উজানে চলিলেন। বোট জল কাটিয়া আশে পাশে ঢেউ ও ফেনা তুলিয়া তীরের মত চলিল।

 মাঝে মাঝে কোথাও নদীর ধারে বাড়ী, বাড়ীর লোকেরা বোটের শব্দ শুনিয়া চাহিয়া দেখিতেছে। এ ধারে চাষবাস নাই, যেখানে বাড়ী নাই সেখানে হয় উপবন, না হয় জঙ্গল।

 সিকন্দর শাহ একহাতে হাল ধরিয়া আর এক হাত মাঝে মাঝে জলে ডুবাইতেছিলেন। জলপথে তাঁহার আলস্যের আবেশ হইতেছিল। নসীর খাঁ গদি ঠেসান দিয়া পা ছড়াইয়া ওপারে চাষীদের চাষ করা দেখিতেছিলেন।

 সিকন্দর শাহ বলিলেন,—কাছাকাছি দেখিবার মতন কিছু আছে?

 —কিছু দূরে লালবিবির কবর আছে। চলুন দেখিতে যাওয়া যাক্।

 আর কোনো কথা হইল না, বোট সশব্দে জল তোলপাড় করিয়া চলিতে লাগিল।

 কিছুক্ষণ পরে নসীর খাঁ কহিলেন,—এই বার কিনারায় লাগান।

 সিকন্দর শাহ বোটের বেগ সংযত করিয়া নিকটেই প্রাচীন ঘাট দেখিতে পাইয়া তাহার পাশে বোট লাগাইলেন। নসীর খাঁ কল বন্ধ করিয়া তাহাতে চাবি দিলেন।

 ঘাটের কাছে একটা লোক দাঁড়াইয়াছিল, সে বলিল, চলুন হুজুর, ভাল করিয়া আপনাদিগকে মকবরা দেখাইয়া আনি।

 নসীর খাঁ কহিলেন,—আমাদের সঙ্গে তোমাকে যাইতে হইবে না, তুমি আমাদের নৌকা আগ্‌লাও, ফিরিয়া আসিয়া বখসিস দিব।

 —বহুত আচ্ছা, জনাব, বলিয়া সে ব্যক্তি নৌকার পাশে দাঁড়াইয়া রহিল।

 নদীর ধারের নিকটেই কবর। দেখিতে বড় নয়, কিন্তু শ্বেত মর্ম্মরের উপর কারুকার্য্য বড় সুন্দর। সিকন্দর শাহ ও নসীর খাঁ চারিদিকে ঘুরিয়া উত্তমরূপে দেখিলেন। ফিরিবার সময় নসীর খাঁ যে ব্যক্তি তাঁহাদের বোটের কাছে দাঁড়াইয়াছিল তাহাকে কিছু পুরস্কার দিলেন।

 সিকন্দর শাহ পূর্ব্বের ন্যায় হাল ধরিলেন, নসীর খাঁ পরপারের দিকে দেখিতে লাগিলেন।

 ফিরিতে অধিক বিলম্ব হইল না। একে স্রোতের টান, তাহার উপর মোটরের বেগ; বোট নক্ষত্রগতিতে চলিল। বাড়ীর কাছে আসিয়া সিকন্দর শাহ দেখিলেন, আর একটা বাড়ীর দোতলায় খোলা জানালায় একটি সুন্দরী যুবতী দাঁড়াইয়া তাঁহাদের বোট দেখিতেছে। সহসা চারিচক্ষে মিলন, রমণী সিকন্দর শাহকে দেখিয়া মৃদুমন্দ হাসিল।

 নসীর খাঁ রমণীকে দেখিতে পান নাই, তিনি সেদিকে পৃষ্ঠ করিয়া বসিয়াছিলেন। সিকন্দর শাহ নৌকার বেগ সংযত করিলেন দেখিয়া, নসীর খাঁ উঠিয়া বসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কি হইয়াছে?

 সিকন্দর শাহ কহিলেন, কিছুই না। বাড়ীও আর বেশী দূর নয় সেইজন্য নৌকার বেগ মন্দীভূত করিয়াছি।

 মুক্ত গবাক্ষপথে রমণীকে দেখিয়া সিকন্দর শাহ নৌকার গতি সংযত করিয়াচিলেন সে-কথা প্রকাশ করিলেন না। নসীর খাঁকে উঠিতে দেখিয়াই যুবতী গবাক্ষ হইতে সরিয়া গিয়াছিল। সিকন্দর শাহ বুঝিলেন, রমণী কেবল তাঁহাকেই দেখা দিয়াছিল। নৌকা হইতে দুই জনে যখন নামিলেন তখন সিকন্দর শাহ কিছু অন্যমনস্ক।

—৯—

 মধ্যাহ্ন-ভোজনের পর সিকন্দর শাহ বলিলেন, আমি একটু বাগানে ঘুরিয়া রেড়াই।

 নসীর খাঁ বলিলেন,—অধিক দূরে যাইবেন না। পকেটে পিস্তল আছে ত? আর আমার বিশেষ অনুরোধ যে, আপনি একা কোথাও যাইবেন না, রুস্তমকে সঙ্গে রাখিবেন।

 দিনের বেলা সব কুকুর বাঁধা থাকিত। সিকন্দর শাহ আদেশ করাতে মোটর চালক রুস্তমকে খুলিয়া দিল। সিকন্দর শাহ ডাকিতেই তাঁহার কাছে ছুটিয়া আসিল।

 সিকন্দর শাহ বেড়াইতে বেড়াইতে নদীর ধারে গেলেন। সিকন্দর শাহ সচ্চরিত্র যুবক, মহৎ বংশের সন্তান, বিনয়ী, লজ্জাশীল। তাহা হইলেও যৌবনের স্বভাবিক চঞ্চলতা কিরূপে অতিক্রম করিবেন? রমণী রূপসী, যুবতী, সিকন্দর শাহকে দেখিয়া মুচকিয়া হাসিয়াছিল, কিন্তু পাছে নসীর খাঁ তাহাকে দেখিতে পান এই আশঙ্কায় সরিয়া গিয়াছিল। সিকন্দর শাহও তাহাকে ভাল করিয়া দেখেন নাই, একবার চকিতের মত দেখা। এখন তাঁহার মনে কিছু কৌতূহল, কিছু চক্ষের অতৃপ্তির লালসা। আর একবার কি তাহাকে দেখিতে পাইবেন?

 সিকন্দর শাহ কাহাকেও কোনো কথা জিজ্ঞাসা করেন নাই। রমণী কে, তাহা নসীর খাঁ না জানিতে পারেন, কিন্তু বাড়ী কাহার, কে সেখানে বাস করে তাহা নিঃসন্দেহ জানিতেন। সিকন্দর শাহ তাঁহাকে কিংবা বাড়ীর অপর কোনো লোককে কোনো কথাই জিজ্ঞাসা করেন নাই। যথার্থ পক্ষে গোপন করিবার কিছুই ছিল না অথচ সিকন্দর শাহের বিবেচনায় তৃতীয় ব্যক্তিকেও কোনো কথা বলা যায় না।

 নদীর ধার দিয়া সিকন্দর শাহ যে বাড়ীতে রমণীকে দেখিয়াছিলেন সেইদিকে গমন করিলেন। রুস্তম কুকুর তাঁহার সঙ্গে ছিল। সেই বাড়ীর নিকট উপনীত হইয়া কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না। নীচেকার দরজা জানালা বন্ধ, দেখিয়া মনে হয় সে বাড়ীতে কাহারও বাস নাই। সিকন্দর শাহ ভাবিতেছিলেন যদি কোনো লোকের সঙ্গে দেখা হয় তাহা হইলে জিজ্ঞাসা করিলে তিনি কি বলিবেন? কিন্তু কোথাও জনমনুষ্য দেখিতে পাইলেন না। যে গবাক্ষের সম্মুখে রমণী দাঁড়াইয়া ছিল সিকন্দর শাহ সেদিকে চাহিয়া দেখিলেন, জানালা বন্ধ। সেটা বাড়ীর পশ্চাৎ ভাগ, বাড়ীতে প্রবেশ করিবার দরজা অন্যদিকে। কিয়ৎকাল অপেক্ষা করিয়া কিছু নিরাশ হইয়া সিকন্দর শাহ ফিরিবার উপক্রম করিতেছেন এমন সময় সেই গবাক্ষ ধীরে ধীরে উন্মুক্ত হইল। গবাক্ষপথে অঙ্কিত চিত্রের ন্যায় দাঁড়াইয়া সেই রমণীমূর্ত্তি!

 সিকন্দর শাহ নির্ণিমেষনয়নে সেই রূপের প্রতিমূর্ত্তি দেখিতে লাগিলেন। আলুলায়িতকুন্তলা, কুঞ্চিত দীর্ঘ কেশ পৃষ্ঠে বক্ষে পড়িয়াছে, অনিন্দিত আনন বেষ্টন করিয়াছে। আয়ত চক্ষের অলস দৃষ্টি সিকন্দর সাহের মুখের দিকে। আবার চক্ষে চক্ষে মিলিল, আবার সুন্দরী বিকচ কমলের ন্যায় স্মেরমুখী, ঈষন্মুক্ত ওষ্ঠাধরের মধ্যে মুক্তাপঙ্‌ক্তির ঈষৎ বিকাশ। দৃষ্টির তরলতায় অপূর্ব্ব মোহিনী।

 বেশ কিছু শিথিল, মস্তকের ওড়না সরিয়া গিয়াছে, কণ্ঠ অনাবৃত। গবাক্ষ হইতে অল্প মুখ বাড়াইয়া রমণী দক্ষিণ হস্ত জানালার উপর রাখিল। কোমল চম্পক অঙ্গুলি, অর্দ্ধেক বাহু, দেখা যাইতেছে। মসৃণ, ললাম, বলয়িত বাহু সর্ব্বাঙ্গে স্তরে স্তরে লাবণ্য পুঞ্জীকৃত, রূপের পূর্ণতায় অলক্ষ্যে তরঙ্গায়িত হইতেছে। সিকন্দর শাহের চক্ষু নমিত হইল।

 আবার তিনি উর্দ্ধমুখ হইয়া রমণীকে চাহিয়া দেখিলেন। মুখের হাসি আর একটু ফুটিয়াছে, চক্ষের আকর্ষণী আর একটু প্রবল। ধীরে ধীরে রমণী বক্ষের বস্ত্রের ভিতর হইতে একখণ্ড কাগজ বাহির করিয়া অঙ্গুলি হইতে একটি অঙ্গুরী বাহির করিয়া সেই কাগজে জড়াইয়া সিকন্দর শাহের পায়ের কাছে ফেলিয়া দিল।

 সিকন্দর সাহ তুলিয়া লইয়া পড়িলেন—আজ সন্ধ্যার পর শিরীষ গাছের তলায়।

 সিকন্দর শাহ উপরে চাহিলেন। রমণী অঙ্গুলি দিয়া বৃক্ষ নির্দ্দেশ করিয়া দিল। বাগানের একপাশে একটা বড় শিরীষ গাছ, তাহাতে ফুল ভরিয়া আছে, তাহার আশেপাশে ছোট ছোট গাছপালায় অন্ধকার।

 আংটী, সোনার সিল আংটী, কোনো অক্ষর বা নাম নাই। সিকন্দর শাহ আংটী তুলিয়া ধরিলেন। রমণী হাত দিয়া সঙ্কেত করিল, এখন থাকুক।

 রমণী মস্তক অবনত করিয়া বিদায় জ্ঞাপন করিল। তাহার পর ধীরে ধীরে, অঙ্গুলিসঙ্কেতে সিকন্দর শাহকে আকুলিত করিয়া, অর্দ্ধনিমীলিত চক্ষের আমন্ত্রণে তাঁহাকে জর্জ্জরিত করিয়া, ধীরে ধীরে গবাক্ষ রুদ্ধ করিল।

 সিকন্দর শাহ গৃহের অভিমুখে ফিরিলেন, এক হস্তে অভিসারিকার নিমন্ত্রণ, অপর হস্তে অঙ্গুরীয় নিদর্শন!

—১০—

 সেইদিন বৈকালে দুইখানা মোটর করিয়া সুলেমান শাহ ও বংশীলাল নসীর খাঁর বাড়ীতে আসিলেন। তাঁহাদের সঙ্গে ছয়জন লোক, সকলেই সশস্ত্র হইয়া আসিয়াছেন।

 নসীর খাঁ সসম্ভ্রমে সুলেমান শাহকে অভিবাদন করিয়া কহিলেন, আপনি কৃপা করিয়া আমার গৃহে আগমন করিয়াছেন আমার পরম সৌভাগ্য।

 সুলেমান শাহ নসীর খাঁর পৃষ্ঠে হস্ত দিয়া কহিলেন,—আমি আমার কথা-মত আসিয়াছি। তোমার কুকুর দেখাও।

 সুলেমান শাহ সিকন্দর শাহের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া কহিলেন, তোমাকে বেশ ভাল দেখিতেছি। আজ আমার সঙ্গে ফিরিয়া যাইবে কি?

 সিকন্দর শাহের চক্ষু উজ্জ্বল, মুখ উৎফুল্ল। ফিরিয়া যাইবার কথা শুনিতেই তাঁহার মুখ ম্লান হইয়া গেল। অত্যন্ত আগ্রহের সহিত কহিলেন,—যদি কোনো বিশেষ প্রয়োজন না থাকে তাহা হইলে আরও দিন-কয়েক এখানে থাকিবার অনুমতি প্রার্থনা করি।

 নসীর খাঁ হাসিয়া বলিলেন,—উনি নৌকায় ভ্রমণ করিতে ভালবাসেন, আজই একবার গিয়াছিলেন।

 সুলেমান শাহ কিছু উদ্বেগের সহিত জিজ্ঞাসা করিলেন,—কোনো আশঙ্কা নাই? জলে শত্রু-ভয় নাই?

 —কিছুমাত্র না। আমার মোটর-বোট, কাছাকাছির মধ্যে আর কাহারও, ওরকম নৌকা নাই। কোনো নৌকা আমার বোটকে ধরিতে পারে না।

 সিকন্দর শাহ সুযোগ পাইয়া বলিলেন—নদীতে বেড়াইলে শরীর ভাল থাকে, আমি প্রতিদিন বোটে বেড়াইব।

 সুলেমান শাহ হাসিয়া উঠিলেন, বলিলেন,—তোমার কোনো চিন্তা নাই, আমি তোমাকে বলপূর্ব্বক লইয়া যাইব না, তোমার যতদিন ইচ্ছা এখানে থাক।

 সিকন্দর শাহের মুখ আবার আনন্দে সমুজ্জ্বল হইয়া উঠিল, যুক্তকরে পিতৃব্যকে কৃতজ্ঞতা জানাইলেন।

 নসীর খাঁ কহিলেন, আমার একটি নিবেদন আছে, অনুমতি হইলে জানাইতে পারি।

 সুলেমান শাহ কহিলেন,—স্বচ্ছন্দে বল, সঙ্কোচ কিসের?

 —যদি কপা করিয়া রাত্রে এখানে আহার করেন—

 —এই কথা! তোমার গৃহে আহার করিব ইহা ত অনন্দের কথা।

 নসীর খাঁ বংশীলালের দিকে ফিরিলেন, কহিলেন,—শেঠ-সাহেব, আপনাকে কি বলিব?

 বংশীলাল কহিলেন,—আপনার কুণ্ঠিত হইবার কোনো কারণ নাই, আমি আহার করিয়া আসিয়াছি। আমাদের রাত্রিকালে আহার করা নিষিদ্ধ।

 নসীর খাঁ সুলেমান শাহকে বলিলেন,—কুকুরগুলা এইখানে আনিতে বলিব?

 —না, না, চল, আমরা গিয়া দেখিব।

 সকলে বাড়ীর বাহিরে আসিলেন। নসীর খাঁর আদেশক্রমে কুকুর চারিটাকে খুলিয়া দিল। রুস্তম একেবারে সিকন্দর শাহের নিকট লাফাইয়া আসিল, আর কয়েকটা কুকুর অপর লোক দেখিয়া একবার থমকিয়া দাঁড়াইল, আবার নসীর খাঁর ইঙ্গিতে ধীরে ধীরে তাঁহার নিকট আসিল।

 সুলেমান শাহ কুকুরগুলিকে উত্তমরূপে দেখিয়া বলিলেন,—এই জাতের কুকুর এদেশে বড় একটা দেখিতে পাওয়া যায় না। অনেক দিন পূর্ব্বে আমি দেখিয়াছিলাম। এমন বলবান কুকুর কখন দেখি নাই। তোমার এই চারিটা কুকুর দশজন প্রহরীর সমান। ইহাদের আর একটা বড় গুণ, বড়-একটা ডাকে না, চোর কিংবা অপর লোক দেখিলে নিঃশব্দে আক্রমণ করে, কিন্তু যাহাকে ধরে তাহার রক্ষা নাই।

 নসীর খাঁ কহিলেন,—আমি ইহাদিগকে শিখাইয়াছি সহজে কাহাকেও প্রাণে মারে না, ফেলিয়া দিয়া চাপিয়া ধরে। সে-রাত্রেও তাহাই করিয়াছিল, তবে যদি কোনো ব্যক্তি আমাকে কিংবা এ বাড়ীর কাহাকেও আক্রমণ করে তাহাকে দেখিতে পাইলে মারিয়া ফেলিতে পারে।

 সুলেমান শাহ বাগানে, নদীর ধারে ভ্রমণ করিতে লাগিলেন, আর সকলে তাঁহার পশ্চাতে। একবার মোটর-বোট দেখিলেন, নসীর খাঁ জিজ্ঞাসা করায় বলিলেন,—নৌকায় আর একদিন বেড়াইতে যাইবেন, আজ নয়।

 কথা কহিতে কহিতে সুলেমান শাহ, সিকন্দর শাহ, বংশীলাল ও নসীর খাঁ কিছু অগ্রসর হইয়া গেলেন, আর সকলে পিছনে পড়িল। সুলেমান শাহ বলিলেন,—আর অধিক সময় নাই, শত্রু প্রাণপণে ঐ জিনিষগুলির সন্ধান করিতেছে, যদি না পায় তাহা হইলে হয়ত ক্রোধান্ধ হইয়া আমাদিগকে হত্যা করিবার চেষ্টা করিবে। আমি তোমাদিগকে বলিয়াছি, আমার বিশ্বাস, যতদিন তাহারা ঐ তিনটি সামগ্রী না পায় ততদিন আমাদের প্রাণের আশঙ্কা নাই; কিন্তু যদি নির্দ্দিষ্ট সময় অতীত হইয়া যায় আর তাহাদের অনুসন্ধান নিষ্ফল হয়, তাহা হইলে রাজ্য ত তাহাদের হইবেই না, কিন্তু আমাদিগকে হত্যা করিলে তাহাদের ক্রোধের উপশম হইবে।

 নসীর খাঁ বলিলেন,—এই তিনটি প্রমাণ লইয়া আপনিই কেন মোবারক শাহের নিকট যান না?

 —তাহা হইলে পথে আমাদিগকে নিঃসন্দেহ মারিয়া ফেলিবে। যদি কোনোরূপে আমরা মোবারক শাহের নিকট যাইতে পারি, তাহা হইলেই বা কি হইবে? যদি তাঁহার নিকট সৈন্যবল প্রার্থনা করি, তিনি হাসিয়া উড়াইয়া দিবেন, বলিবেন, তোমার রাজ্য তুমি রক্ষা করিতে পার না? এই কয়দিন বল প্রকাশের কোনো চেষ্টা হয় নাই বটে, কিন্তু আমরা একদণ্ডও নিশ্চিন্ত হইয়া থাকিতে পারি না। প্রতিদিন তাহারা নূতন নূতন উপায় উদ্ভাবন করিতেছে। আপাততঃ সকল চেষ্টা গোপনে হইতেছে, প্রকাশ্যরূপে বল প্রকাশ করিবে না। কতক লোক আমাদের বিপক্ষে হইলেও অনেক আমাদের স্বপক্ষে, সুতরাং অনেক লোকবল লইয়া এখন আমাদিগকে আক্রমণ করিবে না। অনেকবার অন্বেষণ করিয়া কিছু পায় নাই। তোমাদের দুইজনের বাড়ীতে খুঁজিবার চেষ্টা করিয়া ঠকিয়াছে। এখন কি করিবে?

 বংশীলাল বলিলেন,—তাহাই যদি না জানা যাইবে তাহা হইলে এত আশঙ্কা থাকিবে কেন? বিপদ যদি পূর্ব্বে জানিতে পারা যায় তাহা হইলে উদ্ধার হইবার উপায় করা যায়, কিন্তু আমরা ত কিছু জানিতে পারিতেছি না সুতরাং সর্ব্বদা সাবধান থাকা ছাড়া আমরা কি করিতে পারি?

 নসীর খাঁ বলিলেন,—আমাদের পক্ষ হইতে কয়েকজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি চেষ্টা করিতেছেন যাহাতে শত্রুপক্ষের প্রধান লোকেরা আমাদের পক্ষ অবলম্বন করে। তাঁহাদের চেষ্টা সফল হইলে আর বিশেষ আশঙ্কা থাকিবে না। তবে এই সময় আমাদিগকে অত্যন্ত সতর্ক থাকিতে হইবে, কারণ দিন-কয়েকের মধ্যে একটা কিছু ঘটিবার সম্ভাবনা।

 এইরূপ কথা কহিতে কহিতে তাঁহারা বাড়ীতে ফিরিয়া আসিলেন। তখন ঘোর-ঘোর হইয়া আসিয়াছে। নসীর খাঁ সুলেমান শাহকে বসিবার ঘরে লইয়া গেলেন। সঙ্গে যাহারা আসিয়াছিল তাহারা আর একটা ঘরে বসিল। সিকন্দর শাহ কিছুক্ষণ তাহাদের সহিত কথাবার্ত্তা কহিলেন,—তাহার পর এ-ঘর ও-ঘর করিয়া ঘুরিতে লাগিলেন। অবশেষে অপরের অলক্ষ্যে পা টিপিয়া টিপিয়া নিঃশব্দে নীচে নামিয়া বাড়ীর বাহির হইয়া গেলেন।

—১১—

 কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী রাত্রি, সন্ধ্যার পরেই গাঢ় অন্ধকার করিয়া আসিল। বাড়ীর বাহিরে আসিয়াই সিকন্দর শাহ দ্রুতপদে নদীতীরে উপনীত হইলেন। নদীর ধার দিয়া সঙ্কেতস্থানে গমন করিলেন।

 পশ্চাতে ফিরিয়া দেখিলেন, রুস্তম তাঁহার পিছনে আসিতেছে। সিকন্দর শাহ গোপনে একা যাইতেছিলেন, সঙ্গে কুকুর লইয়া যাইবার তাঁহার ইচ্ছা ছিল না। রুস্তমকে তিনি হাত নাড়িয়া ফিরিয়া যাইতে আদেশ করিলেন, মুখে কিছু বলিতে সাহস করিলেন না পাছে তাঁহার কণ্ঠস্বর আর কেহ শুনিতে পায়। রুস্তম দাঁড়াইল, ফিরিয়া গেল না। সিকন্দর শাহ মাটির ঢেলা তুলিয়া তাহার প্রতি নিক্ষেপ করিলেন। রুস্তম কিছু পিছাইয়া গেল কিন্তু সিকন্দর শাহ আবার যেমন অগ্রসর হইলেন অমনি গাছের আড়ালে আড়ালে তাঁহার পশ্চাতে চলিল, সিকন্দর শাহ তাহাকে দেখিতে পাইলেন না।

 শিরীষ গাছের তলায় গিয়া দেখিলেন, কেহ কোথাও নাই। কয়েক মুহূর্ত পরেই শুষ্কপত্রের ক্ষীণ মর্ম্মর শব্দ হইল, লঘু পদক্ষেপে তরুণী ছায়াময়ী মূর্ত্তির মত সিকন্দর শাহের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। অন্ধকারে তাহার মুখ ও অবয়ব অস্পষ্ট দেখা যাইতেছে। দ্রুত আগমনের জন্য বা অন্য কারণে নিঃশ্বাস কিছু বেগে বহিতেছে, ওষ্ঠাধর কিছু মুক্ত, বক্ষে কিছু চঞ্চলতা। মস্তকের ওড়না স্রস্ত হইয়া কটিদেশে পড়িয়াছিল, তুলিয়া মাথায় দিবার সময় রমণীর হাত সিকন্দর শাহের হাতে ঠেকিল। সিকন্দর শাহ তাহার হস্ত ধারণ করিলেন। তাঁহার হাতের ভিতর রমণীর ক্ষুদ্র কোমল করপল্লব ঈষৎ কাঁপিতেছিল, অঙ্গুলিতে অঙ্গুলির ঈষৎ চাপ পড়িতেছিল। রমণী অতি মৃদুস্বরে, তরুপল্লবে মর্ম্মরিত বসন্ত বাতাসের ন্যায় কহিল, আমি এমন করিয়া তোমার সঙ্গে দেখা করিতেছি, না জানি তুমি কি মনে করিবে!

 সিকন্দর শাহ কহিলেন,—আমি মনে করিতেছি আমার তুল্য কেহ ভাগ্যবান নাই। তোমার মত সুন্দরী আমি কখন দেখি নাই, কখন কোনো রমণীর অঙ্গস্পর্শ করি নাই।

 যুবতী হাসিল। হাসির চাপা শব্দ সিকন্দর শাহের শ্রবণে জলতরঙ্গ বাজনার মত মধুর শুনাইল। রমণী কহিল, তাহা হইলে তোমাকে অত্যন্ত কঠোর শাসনে থাকিতে হয়?

 —কই না। আমি অত্যন্ত স্নেহে প্রতিপালিত হইয়াছি। শাসন বংশ-প্রথার। তরুণ বয়সের চাঞ্চল্য আমাকে সংযম করিতে হয়।

 যুবতী আবার হাসিয়া সিকন্দর শাহের স্কন্ধে হস্তার্পণ করিল, বলিল,—আর এখন?

 —এখন আমি তোমার রূপে মুগ্ধ হইয়াছি, একমাত্র তোমার শাসন মানি।

 —আমি কে, তাহা ত তুমি জান না, অপরিচিতার সহিত গোপনে সাক্ষাৎ করিয়াছ।

 —তোমার রূপই তোমার পরিচয়। অপর পরিচয় দেওয়া-না-দেওয়া তোমার ইচ্ছা।

 —তোমার পরিচয় জিজ্ঞাসা করিব? না, বিনা পরিচয়ে আমাদের সম্ভাষণ হইবে?

 —তাহাও তোমার ইচ্ছা। আমাকে যাহা জিজ্ঞাসা করিবে আমি উত্তর দিতে প্রস্তুত।

 —যুবরাজ সিকন্দর শাহকে কে না জানে? বলিয়া রমণী সিকন্দর শাহের কণ্ঠলগ্ন হইল।

 যুবতীর পশ্চাতে শুষ্কপত্রে পদশব্দ হইল। সিকন্দর শাহ তাহার স্কন্ধের পার্শ্ব দিয়া দেখিলেন, একব্যক্তি দ্রুতপদক্ষেপে তাঁহাদের অভিমুখে আসিতেছে, নক্ষত্রালোকে তাহার হাতের ছুরি একবার ঝলসিত হইল।

 রমণীও মুখ ফিরাইয়া দেখিতে পাইল, ভীত উৎকণ্ঠিত হইয়া কহিল,—ইঁহাকে আঘাত করিতে পাইবে না, আঘাত করিবার কোনো কথা হয় নাই।

 সে-ব্যক্তি দন্তে দন্ত নিষ্পেষিত করিয়া অনুচ্চ কঠোরস্বরে কহিল,—তুমি উহাকে ছাড়িয়া দাও। তোমার কর্ম্ম তুমি করিয়াছ, আমার প্রতি যেমন আদেশ হইয়াছে আমি পালন করিব।

 সিকন্দর শাহ রমণীর বাহুবন্ধন হইতে আপনাকে মুক্ত করিবার চেষ্টা করিলেন, কিন্তু পাছে রমণীর অঙ্গে আঘাত লাগে এই ভয়ে অধিক বল প্রকাশ করিতে পারিলেন না। রমণীও তাঁহাকে রক্ষা করিবার জন্য তাঁহাকে জড়াইয়া ধরিল। বলিল,—মারিতে হয় আমাকে মার, ইঁহাকে স্পর্শ করিতে পাইবে না।

 সে ব্যক্তি কহিল,—তোমার শাস্তি পরে হইবে। এই বলিয়া ছুরি তুলিয়া অগ্রসর হইল।

 সহসা তাহার পশ্চাৎ হইতে নিঃশব্দে ব্যাঘ্রের ন্যায় একটা জন্তু এক লম্ফে তাহাকে আক্রমণ করিল। সে ভয়ে আর্ত্তনাদ করিয়া পড়িয়া গেল, হাতের ছুরি তাহার মুষ্টিমুক্ত হইয়া দূরে পড়িল। সে একবার চীৎকার করিয়াই স্তব্ধ হইল।

 রুস্তম সিকন্দর শাহের অলক্ষ্যে তাঁহার পিছনে আসিয়া একটা ঝোপের আড়ালে দাঁড়াইয়াছিল। রমণীকে আসিতে দেখিয়া কিছু করে নাই। ছোরা-হস্তে আক্রমণকারীকে দেখিয়া তাহার পশ্চাতে আসিয়াছিল। সে ব্যক্তি সিকন্দর শাহকে আক্রমণ করিবার উপক্রম করিতেই তাহাকে ভূতলে নিক্ষেপ করিয়া, তাহার গলা চাপিয়া ধরিল। এবার তাহাকে শুধু ফেলিয়া দিয়া রুস্তম ক্ষান্ত হইল না। বিড়ালে যেমন ইঁদুর ধরে সেইরূপ সে ব্যক্তির টুঁটি ধরিয়া, কয়েকবার ঝাঁকানি দিয়া তাহাকে হত্যা করিল।

 রমণী ভীতম্বরে চীৎকার করিয়া মূর্চ্ছিত হইল। সিকন্দর দেখিলেন, অন্ধকারে আরও কয়েকজন লোক দৌড়িয়া আসিতেছে। তিনি ধীরে ধীরে রমণীকে ঘাসের উপর শয়ন করাইয়া শিরীষ গাছের আড়ালে লুকাইলেন। রুস্তম মৃত ব্যক্তিকে ছাড়িয়া দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। আরও লোক আসিতেছে দেখিয়া একবার ডাকিল। অতি গভীর শব্দ। তাহার ডাক শুনিয়া যাহারা আসিতেছিল তাহারা একবার থমকিয়া দাঁড়াইল।

 সিকন্দর শাহ পকেটে হাত দিয়া দেখিলেন পকেটে পিস্তল রহিয়াছে। তিনি ইচ্ছা করিয়া আনেন নাই, সর্ব্বদাই তাঁহার পকেটে থাকিত, বাহির করিয়া রাখিয়া আসিতে ভুলিয়া গিয়াছিলেন। তিনি মৃদুস্বরে রুস্তম বলিয়া ডাকিতেই কুকুর তাঁহার পাশে আসিয়া দাঁড়াইল।

 পাঁচ ছয়জন লোক ছুটিয়া আসিয়া প্রথমে মৃত ব্যক্তিকে দেখিতে পাইল। শব নাড়াচাড়া করিতে একজনের হাতে রক্ত লাগিল, সে বলিয়া উঠিল, ইহার গলা কাটিয়া দিয়াছে!

 তাহাদের পিছনে কিছু দূরে আর একজন স্থিরভাবে দাঁড়াইয়াছিল, ছুটাছুটি করিতেছিল না। সে বলিল,—আমার হুকুম তোমাদের মনে নাই? সিকন্দর শাহ এখানেই কোথাও আছে, তাহাকে জীবিত হউক, মৃত হউক, আমার নিকটে লইয়া আইস।

 মৃত ব্যক্তি ও মূর্চ্ছিতা রমণীকে ছাড়িয়া অপর লোকেরা সিকন্দর শাহকে খুঁজিতে লাগিল। একজন গাছের পিছনে গিয়া বলিল,—এই যে, এখানে লুকাইয়া আছে!

 অমনি পিস্তলের শব্দ হইল। যে কথা কহিয়াছিল সে ঘুরিয়া পড়িয়া গেল। তাহার পশ্চাতে আর একজন, রুস্তম এক লাফে তাহার টুঁটি ধরিয়া তাহাকে মাটিতে পাড়িয়া ফেলিল।

—১২—

 সুলেমান শাহ, বংশীলাল ও নসীর খাঁ একটা ঘরে বসিয়া কথোপকথন করিতেছিলেন। সুলেমান শাহ বলিলেন,—শত্রু এখন কি করিবে তাহা না জানিতে পারিলেও আমরা নিশ্চিন্ত হইয়া থাকিতে পারি না। তাহারা যে-কয়টা সামগ্রীর সন্ধান করিতেছে তাহা না পাইলে কি করিবে?

 নসীর খাঁ কহিলেন,—হুসেন শাহ আপনার রাজ্য অপহরণ করিয়াও নিশ্চিন্ত হইতে পারিতেছে না। মোবারক শাহকে সে তিনটি জিনিষ দেখাইতে না পারিলে তিনি তাহাকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করিবেন না, হয়ত বিদ্রোহী বলিয়া তাহাকে ধৃত করিবেন। সময়ও আর অধিক নাই। হুসেন শাহ গোপনে আপনাদিগকে গ্রেপ্তার করিয়া উৎপীড়ন করিতে পারে। আপাততঃ হত্যা করিবার চেষ্টা করিবে না।

 সুলেমান শাহ বলিলেন,—আমারও তাহাই মনে হইতেছে।

 বংশীলাল বলিলেন,—এই অনুমান সঙ্গত বিবেচনা হয়। সেইজন্য আমি আরও কয়েকজন বলবান লোককে নিযুক্ত করিয়াছি। শত্রু সহসা আপনাদিগকে আক্রমণ করিতে পারিবে না।

 এমন সময় ভৃত্য আসিয়া নিবেদন করিল,—আহার প্রস্তুত।

 সুলেমান শাহ জিজ্ঞাসা করিলেন,—সিকন্দর কোথায়?

 নসীর খঁ উত্তর করিলেন,—বোধ হয় পাশের ঘরে বসিয়া গল্প করিতেছেন। আমি তাঁহাকে ডাকিয়া আনিতেছি।

 নসীর খাঁ উঠিয়া গিয়া দেখিলেন, পাশের ঘরে ছয়জন লোক বসিয়া আছে। তাঁহাকে দেখিয়া তাহারা উঠিয়া দাঁড়াইল। নসীর খাঁ জিজ্ঞাসা করিলেন,—সিকন্দর শাহ কোথায়?

 তাহাদের মধ্যে একজন বলিল,—তিনি একবার এঘরে আসিয়াছিলেন, কিন্তু এখানে ত বসেন নাই। অনেকক্ষণ হইল চলিয়া গিয়াছেন।

 চারিদিকে খোঁজ পড়িল, নসীর খাঁ ও বংশীলাল কয়েকবার সিকন্দর শাহের নাম ধরিয়া ডাকিলেন,—কোনো উত্তর নাই। সুলেমান শাহ ত্রস্ত হইয়া বলিয়া উঠিলেন,—আমরা যে আশঙ্কা করিতেছিলাম, হয়ত তাহাই ঘটিয়াছে।

 নসীর খাঁ একটা টানা খুলিয়া কয়েকটা বিদ্যুতের পকেট-মশাল বাহির করিয়া সুলেমান শাহ, বংশীলাল ও অপর লোকের হাতে দিলেন, একটা নিজে লইলেন। সকলের কাছে অস্ত্র ছিল।

 বাড়ীর বাহিরে তাঁহারা আসিয়া দেখিলেন, মোটরচালক ও অপর ভৃত্যেরা জড় হইয়াছে। কুকুর তিনটাও সেই সঙ্গে আসিয়াছে।

 নসীর খাঁ জিজ্ঞাসা করিলেন,—সিকন্দর শাহকে তোমরা বাগানে বেড়াইতে কিংবা ফটকের বাহিরে যাইতে দেখিয়াছ?

 সিকন্দর শাহকে কেহই দেখে নাই।

 সকলে নদীতীরের অভিমুখে ধাবিত হইলেন। অকস্মাৎ পুরুষকণ্ঠের আর্ত্তনাদ ও তাহার পরেই নারী-কণ্ঠের চীৎকার শ্রুত হইল। মুহূর্ত্তকাল পরেই কুকুরের গম্ভীর ডাক। নসীর খাঁ বলিলেন—রুস্তম! আর তিনটা কুকুর রুস্তমের গলা শুনিয়া তীরের মত সেইদিকে ছুটিয়া গেল। নসীর খাঁ ও আর সকলে সেই দিকে ধাবমান হইলেন। সুলেমান শাহ তরুণ বয়স্ক না হইলেও যুবকের ন্যায় বেগে চলিলেন।

 চারিদিক প্রতিধ্বনিত করিয়া পিস্তলের আওয়াজ হইল। নসীর খাঁ আর সকলকে ছাড়াইয়া আগে ছুটিলেন, তাঁহার পরেই সুলেমান শাহ। আর সকলে ঠিক তাঁহাদের পশ্চাতে, কেবল বংশীলাল মোটা বলিয়া কিছু পিছাইয়া পড়িয়াছিলেন। নসীর খাঁ হাঁকিলেন,—যুবরাজ, আপনি কোথায়?

 শিরীষ গাছের তলা হইতে সিকন্দর শাহ উচ্চকণ্ঠে বলিলেন,—এই দিকে! এই দিকে!

 নসীর খাঁর বাম হস্তে মশাল ছিল, কল টিপিতেই আলোক জ্বলিয়া উঠিল। দক্ষিণ হস্তে পিস্তল। তাঁহার দেখাদেখি আর সকলে মশাল জ্বালিল। উজ্জ্বল আলোকে চারিদিক স্পষ্ট দেখা যাইতে লাগিল।

 নসীর খাঁ দেখিলেন, সিকন্দর শাহ পিস্তল হাতে দাঁড়াইয়া আছেন। তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন,—আপনার কোথাও আঘাত লাগে নাই ত?

 সিকন্দর শাহ কিছু লজ্জিতভাবে কহিলেন,—না, আমার কোথাও আঘাত লাগে নাই।

 নসীর খাঁ ও বংশীলাল মশাল ঘুরাইয়া দেখিলেন, তিনজন পুরুষ ও একটি স্ত্রীলোক মাটিতে পড়িয়া আছে, কুকুরগুলা সেইখানে দাঁড়াইয়া আছে, রুস্তম সিকন্দর শাহের পাশে। আর তিনজন লোক পলায়ন করিতেছে। কিছু দূরে একখানা প্রকাণ্ড মোটর, তাহার এঞ্জিনের শব্দ শুনিতে পাওয়া যাইতেছে। একবার মোটরে উঠিতে পারিলে এই তিন ব্যক্তিকে আর পাওয়া যাইবে না।

 সুলেমান শাহ কোনো কথা কহেন নাই, সিকন্দর শাহকেও কিছু বলেন নাই। যে তিন ব্যক্তি পলায়ন করিতেছিল মশালের আলোকে তাহাদিগকে লক্ষ্য করিয়া দেখিতেছিলেন। হঠাৎ তিনি সবেগে তাহাদের পশ্চাদ্ধাবিত হইলেন।

 নসীর খাঁ কহিলেন,—আপনি কেন যাইতেছেন, আমাদিগকে আদেশ করিলেই হইবে।

 সুলেমান শাহ থামিলেন না, নসীর খাঁও তাঁহার সঙ্গে দৌড়িলেন।

 তিনজনের মধ্যে একজন আগে যাইতেছিল, তাহার অঙ্গে বহুমূল্য পোষাক। সে যেমন মোটরে উঠিবে অমনি সুলেমান শাহ তাহাকে গুলি করিলেন। সে তৎক্ষণাৎ পড়িয়া গেল, অর্দ্ধেক শরীর গাড়ীর ভিতর, অর্দ্ধেক বাহিরে। আর দুইজন টানাটানি করিয়া তাহাকে মোটরে তুলিবার চেষ্টা করিতে লাগিল।

 সুলেমান শাহ আর পিস্তল ছুঁড়িলেন না। নসীর খাঁ দৌড়িয়া গিয়া একটা চাকা অক্ষ্য করিয়া দুই তিনটা গুলি চালাইলেন, ঘোর শব্দে মোটরের টায়ার ফাটিয়া গেল।

 পিছন হইতে আরও লোক ছুটিয়া আসিল। মোটরচালক ও আর দুইজন বন্দী হইল। যাহার গুলি লাগিয়াছিল তাহাকে নীচে নামাইয়া সকলে দেখিল, তাহার মৃত্যু হইয়াছে।

 সুলেমান শাহ মৃত ব্যক্তির মুখে মশালের আলোক ধরিয়া নসীর খাঁকে জিজ্ঞাসা করিলেন,—চিনিতে পার?

 নসীর খাঁ স্তম্ভিত হইয়া বলিলেন,—হুসেন শাহ!

—১৩—

 বাড়ীর ভিতর কাহাকেও খুঁজিয়া পাওয়া গেল না। যে তিনজন ধরা পড়িয়াছিল নসীর খাঁর আদেশমত তাহারা হুসেন শাহের মৃতদেহ বহন করিয়া শিরীষ গাছের তলায় লইয়া গেল। সেখানে তিন ব্যক্তির মধ্যে একজন মৃত আর দুইজন আহত। রমণী মূর্চ্ছাভঙ্গের পর উঠিয়া বসিয়াছে। সুলেমান শাহ কহিলেন,—লাশ নদীতে ফেলিয়া দাও, আর সব বন্দীকে নসীর খাঁর বাড়ীতে ল‍ইয়া চল।

 এ পর্য্যন্ত সিকন্দর শাহকে কেহ কোনো কথা বলে নাই, কেহ কিছু জিজ্ঞাসা করে নাই, তিনিও নীরব ছিলেন। নসীর খাঁর বাড়ীতে উপনীত হইয়া সুলেমান শাহ সিকন্দর শাহকে জিজ্ঞাসা করিজেন,—কি হইয়াছিল? তুমি কেমন করিয়া ওখানে গিয়াছিলে?

 সিকন্দর কিছু বলিবার পূর্ব্বেই রমণী কহিল,—জাঁহাপনা! যুবরাজের কোনো অপরাধ নাই, আমি একা অপরাধিনী। আমি উঁহাকে ভুলাইয়া লইয়া গিয়াছিলাম। শাস্তি আমাকে দিন্।

 সিকন্দর শাহ কহিলেন,—ইনি আমার প্রাণ রক্ষা করিয়াছেন। ইনি না থাকিলে আমি নিহত হইতাম।

 সুলেমান শাহ রমণীকে বলিলেন,—তুমি কে, সকল কথা খুলিয়া বল।

 রমণী কহিল,—আমার পিতা-মাতা হুসেন শাহের আশ্রিত, তাঁহার আজ্ঞা আমরা সকলেই পালন করি। আপনারা এখানে আসিবার পরেই হুসেন শাহ গোপনে এখানে আসেন। আমরা কয়েকজন সেই সঙ্গে আসি। যুবরাজ এখানে আসিয়াছেন জানিয়া আমরা পাশের বাড়ীতে আসিয়াছিলাম। হুসেন শাহের আদেশানুসারে আমি যুবরাজকে সঙ্কেত করিয়া ডাকিয়াছিলাম। হুসেন শাহ আমাকে শপথ করিয়া বলেন,—তিনি যুবরাজের কোনো অনিষ্ট করিবেন না, তাঁহাকে বন্দী করিলেই আপনি রাজ্য ছাড়িয়া দিবেন। যুবরাজের কোনোরূপ আশঙ্কা আছে জানিতে পারিলে আমি তাঁহাকে বিপন্ন করিতে স্বীকার করিতাম না। আমার আপরাধ আমি স্বীকার করিতেছি। আপনার যেমন অভিরুচি হয়, আমার শাস্তি বিধান করুন।

 সিকন্দর শাহ কহিলেন,—সকল কথা ইনি বলেন নাই। হুসেন শাহের লোক যখন ছোরা দিয়া আমাকে আক্রমণ করে, সে-সময় ইনি নিজের অঙ্গ দ্বারা আমাকে রক্ষা করেন। সে লোকটাকে রুস্তম মারিয়া ফেলে।

 নসীর খাঁ রুস্তমের মাথায় হাত দিয়া বলিলেন,—সাবাস রুস্তম!

 সুলেমান শাহ বন্দীদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন,—তোমাদের কি বলিবার আছে?

 —আমাদের প্রতি আদেশ ছিল যুবরাজকে বন্দী করিতে, হত্যা করিতে নয়। সেইজন্য বড় মোটর আনা হয়। কুকুর দেখিয়া হুসেন শাহ ক্রুদ্ধ হইয়া বলেন,—যুবরাজকে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় যেমন করিয়াই হউক ধরিতে হইবে।

 সুলেমান শাহ কহিলেন,—যে প্রকৃত অপরাধী আমি স্বহস্তে তাহার প্রাণদণ্ড করিয়া আমার সিংহাসন নিষ্কণ্টক করিয়াছি। বংশীলাল, ইহাদের কি দণ্ড হওয়া উচিত?

 —ইহাদের পক্ষে কারাদণ্ড যথেষ্ট।

 —তাহাই হইবে। আর এই রমণীর কি শাস্তি হইবে? ইহার কৌশলেই ত যুবরাজের বিপদ হয়।

 কেহ কোনো কথা কহিল না, কেবল সিকন্দর শাহ কিছু বেগের সহিত বলিলেন,—এই রমণী না থাকিলে আমাকে জীবিত দেখিতে পাইতেন না, সে-কথা আপনি শুনিয়াছেন।

 সুলেমান শাহ স্মিতমুখে কহিলেন,—অর্থাৎ তোমাকে বিপদে ফেলিয়া তাহার পর আরও কঠিন বিপদ হইতে তোমাকে রক্ষা করিয়াছে। তাহা হইলে ইহার লঘু দণ্ড হওয়া উচিত।

 এবার সিকন্দর শাহও নীরব, শুধু রমণী কথা কহিল, বলিল,—আমার অপরাধ গুরুতর, আমাকে গুরুদণ্ড দিতে আদেশ হউক।

 সুলেমান শাহ রমণীর মুখের দিকে চাহিয়া দেখিলেন, তাহার পর সিকন্দর শাহের অভিমুখে দৃষ্টি করিলেন। রমণীর মুখে ভয়ের চিহ্ন নাই, চক্ষের দৃষ্টি কঠিন, সিকন্দর শাহের মুখ ম্লান, হস্তের অঙ্গুলি কাঁপিতেছে।

 সুলেমান শাহ রমণীকে বলিলেন,—হুসেন শাহ নাই, আমার আশ্রয়ে তুমি থাকিলে তোমার বাপ-মার কোনো আপত্তি আছে?

 রমণী বাক্‌শূন্য হইল, বিস্ফারিত স্থির নয়নে সুলেমান শাহের দিকে চাহিয়া রহিল।

 সুলেমান শাহ হাসিয়া বলিলেন,—এখন তুমি শাহজাদীদের মহলে থাকিবে, তাহার পর প্রয়োজন হইলে তোমার নিজের মহল হইবে।

 সুলেমান শাহ সিকন্দর শাহের প্রতি কৌতুকপূর্ণ কটাক্ষপাত করিলেন। রমণী কাঁদিয়া সুলেমান শাহের পা জড়াইয়া ধরিল। সুলেমান শাহ তাড়াতাড়ি তাহার হাত ধরিয়া উঠাইলেন, কহিলেন,—আহারাদির পর তোমাকে মহলে পাঠাইয়া দিব। তুমি যুবরাজ সিকন্দর শাহের প্রাণ রক্ষা করিয়াছ, উনি মহলে তোমার বাস করিবার ব্যবস্থা করিয়া দিবেন।

 বন্দীদিগের প্রতি চাহিয়া কহিলেন,—ইহাদিগকে ছাড়িয়া দাও। যাহারা আহত হইয়াছে তাহাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করিয়া দাও। ইহাদের সহিত আমার কোনো বিবাদ নাই।

 সিকন্দর শাহ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিবার জন্য সুলেমান শাহের করচুম্বন করিলেন।

 রমণীকে আহারের নিমিত্ত আর একটা ঘরে লইয়া গেল। সিকন্দর শাহ দ্বারদেশ পর্য্যন্ত গমন করিলেন। গৃহে প্রবেশ করিবার সময় রমণী ফিরিয়া দেখিল সিকন্দর শাহ তাহার প্রদত্ত অঙ্গুরীয় অঙ্গুলিতে ধারণ করিলেন।