রথযাত্রা ও অন্যান্য গল্প/না জলে, না স্থলে
না জলে, না স্থলে
পেন্সন আর পিঞ্জরাপোল দুইটা জিনিষ একই, তফাৎ এই যে, একটা দ্বিপদের জন্য, অপরটা চতুষ্পদের জন্য। বৃদ্ধ বয়সে সকল জানোয়ারের পিঞ্জরাপোলে স্থান হয় না, বুড়া হ’লে সব মানুষের ভাগ্যে পেন্সন জোটে না। সে হিসাবে যদি ধর তা হ’লে আমি ভাগ্যবান, কেন-না আমি যে জলজীয়ন্ত বেঁচে আছি, মাসে মাসে তার একখানা সার্টিফিকেট যোগাড় করে’ পেন্সনের টাকা নিয়ে আসি। কিন্তু তার থেকে যখন ইন্কাম ট্যাক্স কেটে নিত, তখন আমার মনে হ’ত আমার উপর এটা ভারি জুলুম হচ্চে।
গবর্মেণ্টের উপর আমার রাগের এইটে প্রধান কারণ কিন্তু পিঞ্জরাপোলে ঢুকে শিং দিয়ে গুঁতোবার চেষ্টা করা কিংবা জোয়ান জানোয়ারের মতো তিড়িংমিড়িং করে’ লাফানো যেমন ভুল, পেন্সনভোগীর পক্ষে তেড়েমেড়ে রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দিতে যাওয়া সেই রকম ভুল। বয়স হ’লে হাতপায়ের গাঁটে গাঁটে যেমন বাত ধরে, মনের গাঁটগুলোও সেই রকম বেতো হয়ে পড়ে।
সে কথাট। মনে রাখা উচিত ছিল আমার।
পেন্সন পাবার পূর্ব্বে রায় বাহাদুর খেতাব পেয়েছিলুম। কয়েকজন বন্ধু আমাকে বুঝিয়ে দিলেন রায় বাহাদুর আর রাজা বাহাদুর সমান, কেন-না রায় মানে রাজা। নতুন উপাধি একখানা তক্তায় লিখিয়ে বাড়ীর দরজা-গোড়ায় ঝুলিয়ে দিলুম। বাড়ীতে ঢুক্তে, বাড়ী থেকে বেরুতে সে লেখা আমার চোখে পড়্ত—রায় ভোলানাথ মিত্র বাহাদুর। বাড়ীর সুমুখ দিয়ে যে যেত তার নজরে সেটা ঠেক্ত। আমার জানা একটি লোক রায় বাহাদুর হয়েছিল, তাকে নাম ধরে’ ডাক্বার জো ছিল না, কেউ রায় বাহাদুর না বল্লে চটে লাল হ’ত। আমার ততটা না হোক্ রায় বাহাদুর বললে যে শুন্তে ভাল লাগ্ত সে কথা কেমন করে’ অস্বীকার কর্ব?
কোন্ সময় যে লম্বা নামওয়ালা একটা আন্দোলনের বন্যা দেশে এসে পড়্ল তা বুঝতেই পারা গেল না। অভিধানে ননকোঅপারেশনের জোড়াতাড়া দিয়ে একটা মানে পাওয়া যায়, কিন্তু কে কার সঙ্গে যে ননকোঅপারেট করে, সে একটা কঠিন হেঁয়ালী হয়ে উঠ্ল। গবর্মেণ্টের সঙ্গে যোগ দিতে না হ’লে সরকারী চাকরী এক ধার থেকে ছাড়তে হয়, হয়ত পেন্সন নিয়েও টানাটানি পড়ে। প্রজারা বলে, জমিদারের খাজনা দেবে না, তারপর হয়ত ধোপা-নাপিতও বন্ধ হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, একদিন যদি গৃহিণী ঝঙ্কার দিয়ে বলে’ বসেন তোমার সঙ্গে আর কোঅপারেট কর্ব না, কাল থেকে ভাঁড়ার তুমি বের করে’ দিও, তোমার সংসার তুমি দেখো—এই বলে চাবির গোছা আমার পায়ের কাছে ঝনাৎ করে’ ফেলে দিয়ে যদি ফর্কে চলে’ যান তখন আমি দাঁড়াই কোথায়?
কয়েকজন রায় বাহাদুর তাদের সনদ ফিরিয়ে দিলে, জনকতক কবে কোথায় কি মেডেল পেয়েছিল ফেরত পাঠিয়ে দিলে। আমার রায় বাহাদুরীর ঝোলানো তক্তাখানায় লোকে অন্য রকম নজর দিতে আরম্ভ কর্লে। আমার বস্বার ঘর ঠিক রাস্তার উপর, খড়খড়ীর পাখি খুলে লোকের চলাচল দেখ্তাম, আর তাদের কথা জানালা বন্ধ করে’ দিলেও কানে আস্ত। মাঝে মাঝে কথাগুলো শুন্তে তেমন মিষ্টি লাগত না, বিশেষ যখন ছেলে-ছোকরার দল সে-পথ দিয়ে যেত।
একজন হয়ত বল্লে ওরে, এই একটা রায় বাহাদুর!
—এরাই সব ধামা-ধরার দল!
—যেমন তোপটানা ঘোড়াগুলো ছাপ-মারা, তেমনি এদেরও পিঠে ছাপ!
—গরুর গলায় ঘণ্ট। দেয়, এ আবার নামের গলায় ঘণ্টা!
দিন-দুইচার এই রকম শুনে শুনে একদিন সন্ধ্যাবেলা তক্তাখানা খুলে ফেলে যে-ঘরে ভাঙ্গাচোরা জিনিষপত্র ছিল, সেইখানে এক কোণে রেখে দিলুম।
—২—
যুদ্ধস্থলে একদল সৈন্য নিজেদের পতাকা নামিয়ে যদি একটা সাদা নিশান তুলে ধরে, আর তাতে যেমন তাঁদের পরাজয় সূচিত হয়, আমারও সেই অবস্থা হ’ল। রায় বাহাদুরীর তক্তাখানা ছিল আমার সমর-পতাকা আর সাদা পাঁচিল হ’ল সাদা নিশান। ননকোঅপারেশনের হ’ল জয়, আর আমার হ’ল পরাজয়।
দূত পাঠাবার বেলা হ’ল উল্টা রকম। যারা হারে তারাই সন্ধি করবার জন্য দূত পাঠায়, কিন্তু এক্ষেত্রে ঠিক তার বিপরীত। আমি চুপচাপ ঘরে বসে’ আছি, অন্য পক্ষ থেকে আরম্ভ হ’ল দূতের আমদানী। তাই কি এক-আধজন? কেউ বা ভগ্নদূত, কেউ হয়ত রুদ্রদূত, আবার কারুর তর্জ্জন শুনে শেষ দিনের যমদূতকে আমার মনে পড়ত। সকলেই যে অচেনা তা নয়, কেননা, দলের নামটাই নতুন, মানুষগুলা তো আর নতুন নয়! গদাধর পাকড়াসী আমাদের পাড়ার, এককালে আমার বাড়ীতে তাস খেলার আড্ডায় জুট্ত। সে এখন নতুন দলের একজন পাণ্ডা। আমার নামের আর খেতাবের সাইনবোর্ডের অন্তর্ধান দেখে সে এসে হাজির। বল্লে, বেশ করেচ ভোলানাথ। এখন দেশের কাজে লাগো। তোমার রায় বাহাদুরীর সনদখানা ফেরত পাঠিয়েচ?
আমি বল্লাম, সে একখানা কাগজ বই ত নয়, সেখানা ফেরত দেওয়া কি নিতান্ত দরকার?
—দরকার বই কি, তা না হ’লে ওরা কি করে’ জান্বে তুমি আমাদের দলে এসেচ? গবর্মেণ্টকে জানাতে হবে যে, তুমি তাদের জন্য কেয়ার কর না।
—শেষে যদি আমার পেন্সন নিয়ে টানাটানি করে?
—সে সাধ্য তাদের নেই। আর গেলই বা তোমার পেন্সন? কত বড় বড় উকীল-ব্যারিষ্টার তাদের হাজার হাজার টাকার আয় ছেড়ে দিলে, আর তুমি এইটুকু ত্যাগ স্বীকার কর্তে পার্বে না?
—ও বিষয় আমি কিছু ভাবিনি।
—এতে ভাব্বার কি আছে? যেমন কথা তেমনি কাজ। তোমার ঐ তক্তা নামাবার বেলা ভেবেছিলে? আর দেখ, তোমার কাছে আমাদের আরও লোক আস্বে। তুমি বিলাতী ধুতি পরে’ আছ কি বলে’? বিলাতী কাপড় সব পুড়িয়ে ফেলা হচ্চে। তুমি আজই খাদি ধুতি আর জামা তৈরি কর। হয়ত কাল তোমার কাছে ডেপুটেশন আস্বে।
গদাধর স্বদেশী গানের সুর ভাঁজ্তে ভাঁজ্তে চলে গেল। আমি তাড়াতাড়ি বাজারে গিয়ে খাদি ধুতি আর খাদি পাঞ্জাবী কিনে আন্লাম। তার পরদিনই ডেপুটেশনের আবির্ভাব। দুএকজন ভারিক্কে লোক, বাকি সব নব্য পেট্রিয়ট। প্রথমে ত সকলে মিলে আমার অনেক সাধুবাদ কর্লে, তারপর যিনি ডেপুটেশনের মুখপাত, তিনি বল্লেন, এই শনিবারে আমাদের একটা মিটিং আছে, আপনাকে সভাপতি হ’তে হবে।
কি বিপদ! পঁচিশ ত্রিশ বছর ধরে’ আফিস আর ঘর করেচি, সভার আমি কি জানি? আমি বললাম, মশায়, আর কাউকে দেখুন। আমি কখনো সভায় যাইনি, আর প্রকাশ্য সভায় আমি একটা কথাও বল্তে পার্ব না।
—ও আপনার বিনয়ের কথা। সব কাজই নতুন আরম্ভ করতে হয়। আমাদের এই দল কি এতদিন ছিল? আপনাকে ত বেশী কিছু বল্তে হবে না, যা বলবার-কইবার আমরাই কর্ব।
—আমাকে কি বলতে হবে তাও ত জানি নে।
—সে আর কি এমন বড় কথা! হ্যাঁ হে নিতাই, তুমি প্রেসিডেণ্টের একটা স্পীচ লিখে ভোলানাথবাবুকে দিয়ে যেও ত। আপনি সেইটে মুখস্থ করে’ নিলেই হবে। এখন আমরা যাচ্চি, কর মশায়ের কাছে, আরও কয়েক জায়গায় যেতে হবে। শনিবার বিকেল বেলা ভলণ্টিয়াররা এসে আপনাকে নিয়ে যাবে।
ডেপুটেশন বিদায় হ’লে আমি মাথায় হাত দিয়ে ভাবতে বলাম। এককালে সেই স্কুল-কলেজের গাদা গাদা বহি মুখস্থ করতে হ’ত, আর এই বয়সে আবার বক্তৃতা মুখস্থ কর্তে হবে! তারপর বক্তৃতায় কি লিখে দেবে কে জানে। সেখানে সি-আই-ডি, রিপোর্টার একটি একটি কথা লিখে নেবে, আমি হয়ত প্রথমবার বক্তৃতা করেই সিডিশনের ঠেলায় পড়ি। আর তাই যদি পড়তে হয় ত পরের কথা তোতা পাখীর মত আউড়ে ধরা পড়ব কেন? সত্যি কি একটা স্পীচ আমি লিখতে পারিনে? চিরকাল ত লিখেই এসেচি, তখন না হয় রায় আর রিপোর্ট লিখতাম, এখন না হয় আর একটা কিছু লিখ্তে হবে। এতকাল গবর্মেণ্টের চাকরী করে’ এখন গবর্মেণ্টের বিরুদ্ধে লেখা আমার কেমন বাধো বাধো ঠেক্তে লাগ্ল। যাই হোক্ গোটাকতক কথা নোট করে’ রাখ্লাম, সংযত ভাষায়, সংযতভাবে লিখ্ব বলে’।
মাঠে বেড়িয়ে সন্ধ্যার পর ফিরে এসে দেখি, নিতাই বৈঠকখানায় বসে’ খবরের কাগজ পড়চে। আমি বল্লাম, কি নিতাইবাবু, স্পীচ লেখা হয়েচে না কি?
—মশায়, আমাদের কি লিখ্তে দেরী লাগে? স্পীচ যা লিখেচি তা শুনে সব তাক্ লেগে যাবে।
—কই, দেখি।
নিতাই পকেট থেকে এক তাড়া কাগজ বের কর্লে। আমি হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে বল্লাম, এ যে মস্ত বড় হয়েচে।
—প্রেসিডেণ্টের স্পীচ বড় হ’লে দোষ কি? সমস্ত কাগজে রিপোর্ট হয়ে যাবে, আপনি একদিনে ফেমাস্ হয়ে পড়বেন।
মনে মনে ভাব্লাম লর্ড বায়রণের মতো বুঝি!
স্পীচ পড়বার চেষ্টা কর্তে গিয়ে দেখি, এমন জড়ানো লেখা যে, দু-লাইন পড়তে গলদঘর্ম্ম হয়ে উঠতে হয়। বললাম, এ লেখা আমি ভাল পড়তে পার্চি নে।
ফস্ করে’ নিতাই আমার হাত থেকে কাগজগুলা টেনে নিলে। বললে, হ্যাঁ, আমার হাতের লেখা একটু টানা। আমি আপনাকে পড়ে’ শুনাচ্চি।
বলেই পড়তে আরম্ভ করে’ দিলে। মিনিট দুইয়ের মধ্যে তার হাত-পা চালা দেখে আমি একটু সরে’ বস্লাম। গলার চোটে বাড়ীর ছেলেরা ছুটে এল, দরজার সাম্নে পথে লোক জড় হ’ল। আমি বললাম, নিতাইবাবু, এ ত মিটিং নয়, তুমি আমাকেই পড়ে’ শোনাবে, রাস্তার লোককে এখন শোনাবার দরকার কি?
—আপনি কি বলেন মশায়, স্পীচ যেমন করে’ দেওয়া উচিত, সেই রকম করে’ না পড়লে ভাল শোনাবে কেন?
—তোমার মত অত জবর গলা ত আমার নেই, আর দশের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলাও আমার অভ্যাস নেই।
—আচ্ছা বেশ, আমি আস্তে পড়চি।
খানিক শুনেই আমি স্থির করেছিলাম যে, আস্তে কিংবা জোরে কোনো রকমেই নিতাইকে আর পড়তে দেওয়া হবে না। বল্লাম, আর তোমাকে কষ্ট কর্তে হবে না, এর পর আমি পড়ে’ নেব। একটা কথা তোমাকে জিগ্গেস করি, এই যে এতখানি পড়লে, এ সমস্তটা ডাহা সিডিশন নয় কি?
—তা হ'তে পারে।
—তুমি হ’লে কি এই রকম বক্তৃতা কর্তে?
—ও ত আমি আপনার জন্য লিখেচি। আমি নিজের কথা ভাবিনি।
—আমাকে ত ভাব্তে হয়।
—তা হ’লে আপনি ভয় পাচ্চেন?
—খুব সাহসী বলে’ আমার খ্যাতি নেই। কিন্তু সেই সঙ্গে কি আমাকে বোকাও সাজতে হবে? নিজের মনে যা আসে বলে’ যদি ধরা পড়ি ত পড়্ব, আর একজনের কথা আউড়ে বিপদ ডেকে আন্ব কেন?
—তা হ’লে আপনি আমার লেখা স্পীচ দেবেন না?
—তুমি রেখে যাও, আমি ভাল করে’ পড়ে’ ভেবে দেখ্ব।
নিতাই কাগজগুলা রেখে দিয়ে, রেগে দুম্ দুম করে’ সিঁড়ি নেমে চলে’ গেল।
—৩—
সভাতে গিয়ে দেখি লোকে লোকারণ্য। ভলণ্টিয়ারদের পিছনে আমি প্রবেশ কর্তেই চারদিকে হাততালি পড়ে’ গেল। কর্ত্তৃপক্ষ থেকে একজন আমাকে সভাপতি নির্ব্বাচন কর্বার প্রস্তাব কর্তেই আবার হাততালি। আমি উঠে গিয়ে সভাপতির আসন গ্রহণ করে’ বক্তৃতা আরম্ভ করে’ দিলুম। প্রথম প্রথম কথা ঠেকে ঠেকে যেতে লাগ্ল, তারপর কোনোমতে খানিক বল্লুম।
নিতাইয়ের লেখা স্পীচ থেকে একটা কথাও বলিনি। আমি নিজে যেমন পেরেছিলুম একটুখানি লিখে মুখস্থ করেছিলুম। বক্তৃতা শেষ করে’ যখন বসে’ পড়লুম, তখন অল্প-স্বল্প হাততালি পড়ল বটে, কিন্তু শ্রোতাদের যে খুব ভাল লেগেছে তা মনে হ’ল না। অপর বক্তারা বেশ তেজের সহিত অনেক কথা বল্লেন। সভা ভঙ্গ হবার পর দেখি, নিতাই মুখ ভার করে’ দাঁড়িয়ে আছে। দলপতিদের মধ্যে একজন আমাকে বল্লেন, প্রথমবারের হিসাবে আপনার বক্তৃতা মন্দ হয়নি। অভ্যাস নেই বলে’ আপনাকে একটু সাম্লে বল্তে হয়েচে, আর দিনকতক পরে খোলাখুলি সব কথা বল্তে পার্বেন।
পরের দিন খবরের কাগজে নানা রকম মন্তব্য প্রকাশ হ’ল। দেশী কাগজে লিখলে, আমি খুব সাবধানে বলেছি, তবে আমার মত লোকের কাছ থেকে এর বেশী আশা করা যায় না। ইংরেজদের কাগজে লিখলে, আমার মতন লোককে এমন দলে মিশতে দেখে তারা বিস্মিত হয়েচে। গবর্মেণ্টের কাজে আমার বেশ সুখ্যাতি ও সম্ভ্রম ছিল, আমার পক্ষে ইংরেজ-বিদ্বেষ অকৃতজ্ঞতার পরিচয়। আমার স্পীচের ভাষা সংযত হ’লেও অত্যন্ত নিন্দনীয়।
তার পর দিন গবর্ণরের প্রাইভেট সেক্রেটারীর কাছ থেকে এক চিঠি। তিনি লিখচেন—মাই ডিয়ার রায়-বাহাদুর, কাল সকাল বেলা সাড়ে দশটার সময় অনুগ্রহ করে’ আমার সঙ্গে দেখা কর্বে।
এ কথাটা কি সকলের জানা আছে যে, উপাধিপ্রাপ্ত দেশী লোকদের চিঠি লেখবার বেলা ইংরেজরা শুধু উপাধিটাই লেখেন—নাম লেখেন না? উপাধিতে নামটা চাপা পড়ে’ যায়, আর যাঁরা এ-রকম চিঠি পান তাঁরা আপ্যায়িত হন। রায়-বাহাদুর কি খাঁবাহাদুর হ’লে কি বাপ-মায়ের রাখা নামটা লোপ পেয়ে যায়? ইংরেজি উপাধির বেলা এ-রকম সম্বোধন কর্বার প্রথা নেই, নাইট্ হ’লে তাকে সর নাইট্ বলে’ কেউ চিঠি লেখে না। নাম বাদ দিয়ে শুধু উপাধি লেখা যে বিসদৃশ, সেটা এইবার আমার চোখে ঠেক্ল।
নির্দ্ধারিত সময়ের কিছু পূর্ব্বে গবর্মেণ্ট হাউসে হাজির হ’লেম। প্রাইভেট সেক্রেটারীর বাবু আমাকে দেখে কিছু তাচ্ছিল্যভাবে হেসে বল্লেন, কি রায়-বাহাদুর, আপনি না কি নতুন দলের চাঁই হয়েছেন?
আমি কিছু রুক্ষভাবে বল্লুম,—তাতে দোষ কি?
—জলে বাস করে’ কি কুমীরের সঙ্গে ঝগড়া পোষায়?
—জলটা কি কুমীরের?
এমন সময় লাল চাপকান-পরা চাপরাসী এসে বল্লে, সাহের সলাম দিয়া।
গেলুম সাহেবের কাছে। সাহেব বল্লেন, গুড মর্ণিং, রায়-বাহাদুর, বসো।
সাহেবের সামনে একটা চেয়ারে বস্লুম। সাহেবের টেবিলে খান-কতক খবরের কাগজ ছিল, একখানা কাগজের এক জায়গায় আঙুল দিয়ে, মুখ টিপে একটু হেসে সাহেব বল্লেন, এটা ত তোমার স্পীচ?
—হাঁ সাহেব।
—খুব খারাপ না হ’লেও এ তেমন লয়েল স্পীচ হয় নি। তুমি গবর্মেণ্টের কর্ম্মচারী ছিলে, গবর্মেণ্ট উপাধি দিয়ে তোমার সম্মান করেচেন, এখনও তুমি পেন্সন পাও। রাজবিদ্বেষীদের দলে তোমার যোগ দেওয়া উচিত নয়।
রায়-বাহাদুরীর সনদ আমার পকেটে ছিল, বের করে’ টেবিলে সাহেবের সাম্নে রাখলুম। বললুম, এই সনদ ফেরত দিচ্চি। চিরকাল ত গবর্মেণ্টের চাকরী করেচি, বুড়া বয়সে যেটুকু পারি দেশের কাজ কর্ব।
সাহেব খানিকক্ষণ আমার সনদের দিকে চেয়ে রইল। তারপর রেগে বল্লে,—গবর্মেণ্ট যেমন পুরস্কার দেয়, অপরাধীকে সেই রকম শাস্তিও দিয়ে থাকে।
—শাস্তির জন্য প্রস্তুত আছি, বলে’ আমি উঠে চলে’ এলুম।
গাড়ীতে উঠে মনে হ’ল, রাগের মাথায় কাজটা ভাল করিনি ভেবে-চিন্তে কাজ করাই আমার অভ্যাস, হঠাৎ এ-রকম মরিয়া হ’য়ে ওদের চটাবার কি দরকার? গলাবাজি করে’ যে সিডিশন প্রচার করে’ বেড়াব তার কোন সম্ভাবনা ছিল না, কেন-না আমার ধাত সে-রকম নয়। আর লীডার হবারও কিছুমাত্র আকাঙ্ক্ষা ছিল না। মাঝখান থেকে লাট সাহেবের বাড়ী গিয়ে সেক্রেটারীর সঙ্গে ঝগড়া করে’ কি ফল হ’ল?
এই রকম পাঁচ রকম ভাবনায় মনটা খারাপ হ’য়ে গেল। বাড়ীতে ফিরে বিকেল বেলা জলখাবার খাচ্চি, এমন সময় গৃহিণী বল্লেন, এ বয়সে তোমার আবার এ কি বুদ্ধি হ’ল?
—কি বুদ্ধি?
—এই হই হই করে’ কতকগুলো পাগলের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো?
—দেশের উন্নতি কর্বার চেষ্টা কি পাগলামি?
—তা নয় ত কি? ইংরেজের সঙ্গে কি তোমরা পার্বে? আর তুমি চিরকাল ইংরেজের চাকরী করে’ এসেচ, তুমি কোন্ মুখে তাদের বাদ সাধতে যাও?
—ইংরেজ ত আর ঘর থেকে আমাকে মাইনে দেয়নি, আমাদের দেশের টাকা আমাদের দেয়। আর দেশের সব টাকা তারা যে ঝেঁটিয়ে নিয়ে যাচ্চে।
এতদিন ত সে-কথা তোমার মনে পড়েনি। এরি মধ্যে তোমার ভীমরতি হয়েচে। কোন্ দিন তোমায় ধরে’ জেলে নিয়ে যাবে।
—তা যায় যাবে। দেশের কত বড় বড় লোককে নিয়ে গিয়েচে।
—তা হ’লে জেলে গিয়ে জাঁতা পিষে তুমিও এইবার বড়লোক হবে।
মুখ আমাকেই বন্ধ কর্তে হ’ল, কারণ গৃহিণীর মুখ বন্ধ হবার কোন সম্ভাবনা ছিল না। বাহিরের ঘরে বসে ভাবতে লাগলুম, পেট্রিয়ট হওয়া বড় দুরূহ ব্যাপার। এখন পর্য্যন্ত ত কিছুই করিনি, একটা স্পীচ, তাও ফুলঝুরির মতন, তাতে তুবড়ি হাউইয়ের মতো আতসবাজি মোটেই ছিল না। তাতেই সি-আই-ডির কালো কেতাবে আমার নাম উঠেচে, বাইরে বড় সাহেবের চোখ-রাঙ্গানি, ঘরে ভার্য্যার মুখ ঝাম্টানি। আমার মতো লোকের পক্ষে পরীক্ষা বড় কঠিন হ’য়ে উঠল।
দিন কয়েক পরে ম্যাজিষ্ট্রেটের হুকুম হ’ল তিন মাস প্রকাশ্য সভা কোথাও হবে না, যারা এ-রকম সভা কর্বে কিংবা সভায় উপস্থিত থাক্বে তাদের কারাদণ্ড হবে। অমনি আমার কাছে আর এক ডেপুটেশন এসে উপস্থিত, আদেশ অগ্রাহ্য করে’ সভা কর্তে হবে, তাতে জেলে যেতে হয় সেও ভাল।
এ-রকম বাহাদুরীতে কি লাভ আমি বুঝ্তে পার্লুম না। সভায় লোক জড় হ’য়ে বক্তৃতা আরম্ভ হ’তেই পুলিশ ধর্বে জেনেশুনে মিছিমিছি জেলে গিয়ে কি ফল? যাঁরা আমার কাছে এসেছিলেন তাঁরা আমাকে বোঝালেন, এ-রকম হুকুম অত্যাচার ছাড়া আর কিছু নয়, এরকম আদেশ পালন না করাই তার ঠিক প্রতিবাদ। আমার মনে হ’ল যেটুকু রয়-সয় সেইটুকু ভাল, সাধ করে’ ঘর ছেড়ে জেলে বাস করায় কোন লাভ নেই। আমি সভায় যেতে অস্বীকার কর্লুম।
ডেপুটেশনের মুখপাত বল্লেন, আমরা ভেবেছিলাম আপনার সাহস আছে, দেশের জন্য কিছু ত্যাগ স্বীকার কর্তে পার্বেন। সেটা আমাদের ভুল। চিরকালের অভ্যাস কোথায় যাবে? ইংরেজের সাম্নে দাঁড়ানো রায়-বাহাদুরদের কাজ নয়।
আমি বল্লাম, রায়-বাহাদুরীর সনদ আমি লাট সাহেবের প্রাইভেট সেক্রেটারীকে ফেরত দিয়েছি।
—তা যাই করুন, কাজের বেলা আপনার সাহসে কুলিয়ে উঠচে না।
ডেপুটেশন তো রেগেমেগে আমার বাড়ী থেকে বেরিয়ে গেল আর আমার লাভের মধ্যে হ’ল এই যে, কোন দিক বজায় রইল না। ধোপার কুকুরের অবস্থা হ’ল, না ঘরের, না ঘাটের। সাহেব মহলে মুখ দেখাবার পথ ঘুচিয়ে এসেছি, বাড়ীতে গৃহিণীর মুখ তোলোপানা, অবশেষে পেট্রিয়টের দল থেকেও নাম কাটা গেল।
তার পরদিন খবরের কাগজে আমার নামে এক চিঠি, কত রকম ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে’ চিঠিতে প্রমাণ করা হয়েচে যে, যেমন চিতাবাঘের গায়ের দাগ বদলানো যায় না, সেই রকম গবর্মেণ্টের চাকরীর ছাপ কখনো মেটে না।
পুরাকালের মতো আমার কথায় যদি ধরণী দ্বিধা হ’ত তাহ’লে আমি ভূগর্ভে প্রবেশ কর্তাম।
—৪—
মনটা খারাপ হ’য়ে যাওয়াতে দিন-কয়েকের জন্য আমি আর এক জায়গায় চলে গেলাম। সেখানে আমার এক-জন জানা লোক থাক্তো; সেখানকার এঞ্জিনিয়র, নাম হরপ্রসাদ। লোকটা কিছু সাহেবী রকম কিন্তু আমার সঙ্গে অনেক দিনের আলাপ বলে’ তার বাংলায় গিয়ে উঠ্লুম। আমাকে দেখে অন্য কথাবার্ত্তার পর জিজ্ঞাসা কর্লে, হ্যাঁ হে, ভোলানাথ, তোমার নামে খবরের কাগজে কত কি দেখ্ছিলুম, ব্যাপারখানা কি বল দেখি?
—ও-সব কিছু নয়, আমাকে নিয়ে নতুন দলে টানা-টানি করেছিল।
—হঠাৎ তুমি পেট্রিয়টা হ’তে গেলে কেন? তুমি সরকারী লোক, রায় বাহাদুর হয়েচ, তোমার আবার এ রোগ কেন?
—পৃথিবী-সুদ্ধ সকল জাত স্বাধীন, আমরাই কি চিরকাল পরাধীন হয়ে থাক্ব?
—কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ তোমার এ জ্ঞান টন্টনে হয়ে উঠল যে? এতকাল যে চাকরী কর্তে, কার অধীন ছিলে?
—তাই বলে’ কি দেশের অবস্থা ভাব্তে নেই?
—যারা ভাবে তারা ভাবুক, তোমার-আমার সে খোঁজে দরকার কি?
আমাদের কথাবার্ত্তা হচ্চে এমন সময় মিষ্টার চৌধুরী এলেন। ইনি ডেপুটী। হরপ্রসাদ পরিচয় করিয়ে দিলে। মিষ্টার চৌধুরী আমার হাতখানা ধরে’ খুব নাড়া দিয়ে বল্লেন, ও হো! আপনার নাম আমাদের খুব জানা আছে। আপনি ত একজন নতুন লীডার হয়েচেন।
—ও-সব বাজে কথা। লীডার হওয়া দূরে থাকুক, দলে ঢুক্তে না ঢুক্তেই আমাকে তাড়িয়ে দিয়েচে।
—ব্রেভো! এ একটা ভাল খবর বটে। যে দলে বরাবর ছিলেন, সেই দলই আপনার পক্ষে ভাল।
দু’একটা কথা আমি চেপে গেলাম। প্রাইভেট সেক্রেটারীর সঙ্গে দেখা, আর সনদ ফিরিয়ে দেবার কথা প্রকাশ কর্লাম না।
সন্ধ্যাবেলা হরপ্রসাদ আমাকে তাদের ক্লাবে নিয়ে গেল। সেখানে জেলার সব কর্ম্মচারী, উকীল, ডাক্তার জড় হয়। ব্রিজ খেলার খুব ধুম। আমাকে নিয়ে খানিক রঙ্গ হ’ল, কিন্তু সকলেই বুঝলে যে, আমার নামে যে-সব রব উঠেছিল, সে বাড়ানো কথা, সত্যিসত্যি আমি গবর্মেণ্টের বিরোধী নই।
দিন দুই পরে হরপ্রসাদ আমাকে বল্লে,—ওহে, আজকে মল্লিকদের ডিনারে নিমন্ত্রণ করেচি।
—বেশ, মল্লিক কে?
—সে একজন ব্যারিষ্টার, বেশ পয়সা আছে আর রোজগারও ভাল। সে মেম বিয়ে করেচে, তারা দু’জনেই আস্বে।
—ভাল কথা। মেম কি বিলাতে বিয়ে করেছিল?
—না, সে আগে এক সাহেবের ছেলেদের গবর্নেস ছিল, অল্পদিন হ’ল মল্লিক তাকে বিয়ে করেচে। তোমাকে আজ রাত্রে পোষাক পর্তে হবে।
—কেন, ধুতি কি অপরাধ কর্লে?
—মল্লিকের স্ত্রী হাজার হোক্ মেম ত বটে। তার সঙ্গে টেবিলে ধুতি পরে’ খেতে বসা ভাল দেখায় না।
আমার সর্ব্বাঙ্গ জ্বলে’ গেল। বল্লুম, বাপ পিতামহ চিরকাল ধুতি পরে’ এসেচে, আর এখন একজন মেম আস্বে বলে’ ধুতি অসভ্য বেশ হ’ল? এ যেন গবর্ণেস কিন্তু খোদ গবর্ণর যদি তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে আসেন, তা হ’লেও বাড়ীতে আমি ধুতি ছাড়া আর কিছু পর্ব না।
হরপ্রসাদ মুস্কিলে পড়ল। বল্লে, তুমি নিতান্ত ওল্ড ফ্যাশনের লোক। ধুতি না ছাড়লে তুমি তাদের সঙ্গে টেবিলে বসে’ কি করে’ খাবে?
—না হয় খাব না। আর তোমার গবর্নেসের সঙ্গে আলাপ কর্বারও আমার কোন দরকার নেই। আমি আর একটা ঘরে থাক্ব, সেইখানে আমার খাবার দিয়ে যেতে বলো। ইংরেজি খাবার চাই নে, বামুন যা রাঁধবে তাই দিতে বলো।
সে রাত্রে আমার আর খানা খাওয়া হ’ল না, মল্লিক-দম্পতীর দর্শনলাভও হ’ল না। তার পরদিন আমি বাড়ী ফিরে এলুম।
আমার অদৃষ্টে প্যাঁজ-পয়জার দু-ই হ’ল।