রবীন্দ্রনাথের বাল্যজীবনের সকলের চেয়ে বড় স্মৃতির বিষয়, বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে তাঁহার যে একটি নিকট আত্মীয়তার যোগ ছিল, তাহারই আনন্দ। তিনি বলেন, যখন তিনি নিতান্ত বালক, বাড়ির চাকরের হেপাজতে থাকিতেন, তখন জোড়াসাঁকোর বাড়ির দক্ষিণ দিকের জানালার নীচে একটি ঘাটবাঁধানো পুকুর ছিল, সেই পুকুরের পূর্বধারে প্রাচীরের গায়ে একটি প্রকাণ্ড চিনে বট এবং দক্ষিণপ্রান্তে একসারি নারিকেল গাছ ছিল। ভৃত্য তাঁহাকে ঘরে আবদ্ধ থাকিতে বলিয়া কাজে যাইত, সমস্তদিন সেই পুকুর দেখিয়া তাঁহার সময় কাটিত। সেই ডালপালাওয়ালা ঘন বট তাঁহার কাছে কী রহস্যময় ছিল! এক-একদিন নিস্তব্ধ দ্বিপ্রহরে সুদূরবিস্তৃত কলিকাতা শহরের নিস্তব্ধ বাড়িগুলার দিকে চাহিয়া তাহার ভিতরের নানা রহস্যের জল্পনায় সেই বালকের মন উন্মনা হইয়া উঠিত, মাঝে মাঝে চিলের সুতীব্র তীক্ষ্ণ স্বর, ফিরিওয়ালাদের বিচিত্র সুরের হাঁক বিশ্বের সঙ্গে নূতন পরিচয়ের আবেগে সমস্ত চেতনাকে স্পন্দিত তরঙ্গিত করিত।

 পরবর্তী কালে এই বাল্যজীবন স্মরণ করিয়া তিনি যে একটি পত্র লিখিয়াছিলেন তাহার কিয়দংশ উদ্ধৃত করিয়া দিই:

 ‘আমার নিজের খুব ছেলেবেলাকার কথা একটু একটু মনে পড়ে, কিন্তু সে এত অপরিস্ফুট যে ভালো ক’রে ধরতে পারি নে। কিন্তু বেশ মনে আছে, এক-একদিন সকালবেলায় অকারণে অকস্মাৎ খুব একটা জীবনানন্দ মনে জেগে উঠত। তখন পৃথিবীর চারিদিক রহস্যে আচ্ছন্ন ছিল।...গোলাবাড়িতে একটা বাঁখারি দিয়ে রোজ রোজ মাটি খুঁড়তুম, মনে করতেম কী একটা রহস্য আবিষ্কার হবে। ...

 পৃথিবীর সমস্ত রূপরসগন্ধ, সমস্ত নড়াচড়া আন্দোলন, বাড়িভিতরের বাগানের নারিকেল গাছ, পুকুরের ধারের বট, জলের উপরকার ছায়ালোক, রাস্তার শব্দ, চিলের ডাক, ভোরের বেলাকার বাগানের গন্ধ—সমস্ত জড়িয়ে একটা বৃহৎ অর্ধপরিচিত প্রাণী নানা মূর্তিতে আমাকে সঙ্গদান করত।’

 অতি অল্প বয়সেই তিনি বিদ্যালয়ে যান, কিন্তু হায়, পৃথিবীর অধিকাংশ কবির ন্যায় জননী বীণাপাণির পদ্মবনটির প্রতি শিশুকাল হইতেই তাঁহার লোভ ছিল, কিন্তু তাঁহার কমল-সরোবরের তীরে গুরুমশায়-অধিরাজিত যে বেত্রবনটা কণ্টকিত হইয়া আছে, সেটাকে তিনি অত্যন্ত বেশি ডরাইতেন। বিদ্যালয়-জীবনের স্মৃতি যে তাঁহার কাছে কিরূপ সুখকর তাহা ‘গিন্নি’ গল্পটি যাঁহারা পড়িয়াছেন তাঁহারাই বুঝিতে পারিবেন। নর্মাল বিদ্যালয়েরই এক পণ্ডিত একটি ছাত্রকে তাঁহার বাড়িতে আপন ভগ্নীদের সঙ্গে পুতুল খেলিতে দেখিয়া ক্লাসে তাহাকে ঐরূপ বিদ্রূপসম্ভাষণ করিয়াছিলেন। বালক রবীন্দ্রনাথ সমস্ত বৎসর তাঁহার ক্লাসে একটি কথারও উত্তর দিতেন না, তাঁহার অভদ্র আচরণ তাঁহাকে এমনি পীড়া দিয়াছিল। অথচ বাংলাভাষার পরীক্ষায় যখন তিনি প্রথম স্থান অধিকার করিলেন তখন উক্ত পণ্ডিত কোনোমতেই তাহা বিশ্বাস করিতে রাজি হইলেন না।

 যাহাই হোক বিদ্যালয়ের জীবন তাঁহার কাছে “দুঃসহ জীবন” ছিল। বিদ্যালয়ে তাঁহার পড়াশুনা যে বিশেষ কিছু অগ্রসর হইয়াছিল তাহা নহে। কিন্তু বিদ্যালয়ে পড়াশুনা না করিলেও বাল্যকাল হইতে বাংলা পড়িবার অভ্যাস থাকায় বিচিত্র বাংলা পুস্তক কবি শেষ করিয়া ফেলিয়াছিলেন, তখনকার দিনে এমন বাংলা বই নাম করা শক্ত যাহা তিনি পড়েন নাই। ইহাতে তাঁহার কল্পনার খোরাক নিঃসন্দেহ জুটিয়াছিল এবং ভাবপ্রকাশও অনেকটা পরিমাণে বাধাহীন হইয়া আসিয়াছিল।

 বাংলা বিদ্যালয় ত্যাগ করিয়া ইংরেজি বিদ্যালয়ে যখন পড়া চলিতেছে, তখন ইঁহার পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথকে তাঁহার সঙ্গে হিমালয়ে লইয়া যাইবার প্রস্তাব করিলেন। বালক রবীন্দ্রনাথের পক্ষে এ তখন কল্পনার অতীত। হিমালয় দেখিবেন! এতবড় সৌভাগ্য!

 যাত্রার পথে বোলপুরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বাহিরের জগতের সঙ্গে সেই প্রথম পরিচয়, তাহার পূর্বে গঙ্গার তীরে একটা বাগানবাড়িতে কিছুদিনের জন্য বড় আনন্দে যাপন করিয়াছিলেন মাত্র। কবির নিজের কাছে গল্প শুনিয়াছি যে, বোলপুর স্টেশন হইতে শান্তিনিকেতনে রাত্রিকালে পালকি করিয়া আসিবার সময়ে তিনি কিছুই চাহিয়া দেখেন নাই পাছে রাত্রে নুতন দৃশ্যের অস্পষ্ট আভাস চোখে পড়িয়া প্রাতঃকালের নবীন কৌতুহলপূর্ণ দৃষ্টির কিছুমাত্র রসভঙ্গ করে।

 বোলপুর হইতে বাহির হইয়া এলাহাবাদ কানপুর প্রভৃতি নানা স্থানে বিশ্রাম করিতে করিতে অমৃতসরে গিয়া উপস্থিত হইলেন। সেখান হইতে ডালহৌসি পাহাড়ে উঠিতে লাগিলেন। পাহাড়ের অধিত্যকা উপত্যকা-দেশে স্তরে স্তরে তখন চৈত্রের সোনার ফসল বিস্তীর্ণ— দুর্গম গিরিপথ, কলধ্বনিমুখরিত ঝরনা, কেলুবন — এ সমস্ত পার্বত্য ছবি দেখিতে দেখিতে তাঁহার চোখের আর শ্রান্তি রহিল না।

 পাহাড় হইতে ফিরিয়া আসিবার কিছু কাল পরে তাঁহার মাতৃবিয়োগ হয়। তখন তাঁহার বয়স বারো। তাহার পর হইতে তাঁহাকে, বিদ্যালয়ে পাঠানো আরো দুরূহ হইয়া পড়িল। এবং ক্রমশ তাঁহার গুরুজন এই বৃথা চেষ্টায় ক্ষান্ত হইলেন। পাহাড়ে থাকিতে পিতার নিকটে অল্প কিছু শিক্ষা লাভ করিয়াছিলেন, কিছু ইংরেজি, কিছু সংস্কৃত ব্যাকরণ ও ঋজুপাঠ, কিছু জ্যোতির্বিজ্ঞান। কিন্তু বাংলা পড়ায় তাঁহার বিরাম ছিল না। এই সময়ে তাঁহার কোনো অধ্যাপক তাঁহার অন্যান্য বিষয়ে পড়াশুনা সম্বন্ধে হতাশ হইয়া অবশেষে কালিদাসের কুমারসম্ভব ও শেক্সপীয়রের ম্যাকবেথ প্রভৃতি তাঁহাকে তর্জমা করিয়া শুনাইতেন। বাড়িতেও সাহিত্যচর্চার অভাব ছিল না। অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী মহাশয় ছিলেন ইংরেজি কাব্যসাহিত্যে ভরপুর।তাঁহার মুখে আবৃত্তি ও ব্যাখ্যা শুনিয়া রবীন্দ্রনাথের কল্পনাপ্রবণ চিত্ত বিস্তর খোরাক সংগ্রহ করিত।বিহারীলাল চক্রবর্তী মহাশয়ের সঙ্গেও ইঁহাদের বাড়ির বিশেষ একটি প্রীতির সম্বন্ধ ছিল। সুতরাং বালক-বয়স হইতে সাহিত্যচর্চার আবহাওয়ার মধ্যে তিনি মানুষ হইয়াছিলেন।

 যেমন সাহিত্যচর্চা তেমনি গীতচর্চা। বাল্যকাল হইতে ক্রমাগত গান শুনিয়া ও তৈরি করিয়া সুরের অনির্বচনীয়তার রাজ্যে তাঁহার মন ঘুরিয়া বেড়াইবার সুযোগ লাভ করিয়াছিল।

 কবি অল্পবয়স হইতেই অনেক রচনা করিয়াছেন, সে-সকলের উল্লেখ আমরা করিব না। তাঁহার ষোলো বৎসর বয়সের সময় তাঁহাদের বাড়ি হইতে ‘ভারতী’ কাগজখানি প্রথম বাহির হয়, তাহাতে কবির অনেক বাল্যরচনা প্রকাশিত হইয়াছিল।

 ‘ভারতী’ দ্বিতীয় বৎসরে পদার্পণ করিলে রবীন্দ্রনাথ সতেরো বৎসর বয়সে বিলাত যাত্রা করেন। তাহার পূর্বে আমেদাবাদে তাঁহার মধ্যমভ্রাতা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের সঙ্গে কিছুকাল বাস করেন। শাহীবাগের বাদশাহী আমলের প্রকাণ্ড এক প্রাসাদে ছিল তাঁহাদের বাসা— প্রাসাদের পাদমূলে সাবরমতী (সুবর্ণমতী) নদীর ক্ষীণ স্রোত প্রবাহিত— প্রকাণ্ড ছাদ, বিচিত্র কক্ষ এবং তাহাদের প্রবেশের বিচিত্র পথ- সবটা জড়াইয়া তারি রহস্যময় একটি স্থান। এই প্রাসাদের স্মৃতি অবলম্বনেই ভবিষ্যতে “ক্ষুধিত পাষাণ” গল্পটি রচিত হয়।

 এইখানে অবস্থানকালে কবির ইংরেজি শিক্ষা অনেকটা আপনাআপনি অগ্রসর হয়, ইংরেজি সাহিত্যের দুরূহ গ্রন্থসকল তিনি পাঠ করিতেন এবং তাহার ভাব অবলম্বনে বাংলায় রচনা প্রকাশ করিতেন।

 কুড়ি বৎসর বয়সে ‘ভগ্নহৃদয়’ প্রকাশিত হয়। তার পরে ‘সন্ধ্যাসংগীত’। তখন ইংলণ্ড হইতে তিনি ফিরিয়া আসিয়াছেন।

 ‘সন্ধ্যাসংগীত’ কতক কলিকাতায় লেখা এবং কতক চন্দননগরের বাগানবাড়িতে। গঙ্গাতীরের উপর ঘাটের সোপান বাহিয়া পাথরবাঁধানো একটি প্রশস্ত সুদীর্ঘ অলিন্দ পাওয়া যাইত, বাড়িটি তাহার সঙ্গেই সংলগ্ন। সেখানে একদিন বর্ষার দিনে “ভরা বাদর মাহ ভাদর” বিদ্যাপতির পদটিতে সুর বসাইয়া সমস্ত বর্ষা সেই সুরে আচ্ছন্ন করিয়া দিয়াছিলেন— সূর্যাস্তে অনেকদিন তাঁহার দাদা জ্যোতিরিন্দ্রবাবু এবং রবীন্দ্রনাথ নৌকা ভাসাইয়া দিয়া গানের পর গানে সূর্যাস্তের সোনার উৎসব সম্পন্ন করিয়াছেন, অনেক সুপ্তিহীন জ্যোৎস্নারাত্রি ছাদের উপর কাটিয়া গিয়াছে। হিমালয়ভ্রমণের পরে এমন আনন্দময় স্থান আর কোথাও তিনি পান নাই ।

 গদ্যে তখন ‘ভারতী’তে ‘বিবিধ প্রসঙ্গ’ বাহির হইতেছে, ‘বউঠাকুরানীর হাট’ও লেখা চলিতেছে।

 ‘সন্ধ্যাসংগীতে’ সর্বপ্রথমে নিজের সুর আবিষ্কার করিবার আনন্দ কবি অনুভব করিয়াছিলেন। ইহার ভাষা, ছন্দ ও ভাব হইতে তাহা স্পষ্টই বুঝা যায়। ছন্দ এলোমেলো, কিন্তু ধার করা নয়। অনুকরণ ছাড়াইয়া যে একটি স্বাধীন ব্যক্তি তাঁহার মধ্যে ফুটিয়াছিল তাহা ইহার সমস্ত অসম্পূর্ণ প্রকাশের মধ্যেও প্রকট।

 নবযৌবনের আরম্ভে অন্তরে যখন হৃদয়াবেগ প্রবল হইয়া উঠিতেছে অথচ বিশ্বজগতের সহিত তাহার যথোচিত যোগ ঘটিতেছে না, হৃদয়ের অনুভূতির সহিত জীবনের অভিজ্ঞতার যখন সামঞ্জস্য হয় নাই, তখন নিজের মধ্যে অবরুদ্ধ অবস্থার যে অধীরতা তাহাই ‘সন্ধ্যাসংগীতে’র কবিতার মধ্যে ব্যক্ত হইবার চেষ্টা করিয়াছে।

 মোহিতবাবু তাঁহার সম্পাদিত কাব্যগ্রন্থে এই শ্রেণীর কবিতার “হৃদয়ারণ্য” নাম দিয়াছিলেন। আবেগগুলা সত্য হইলেও বাস্তব জগতে তাহাদের কোনো অধিকার ছিল না বলিয়া তাহারা বাড়াবাড়ির মধ্যে প্রকাশ পাইবার চেষ্টা করিতেছিল, অসুস্থ মূর্তি ধারণ করিতেছিল। প্রায় কবিতার নাম হইতে তাহা বুঝা যায়—“আশার নৈরাশ্য”, “সুখের বিলাপ”, “তারকার আত্মহত্যা”, “দুঃখ আবাহন” ইত্যাদি। কেবল কান্না:

বিরলে বিজন বনে বসিয়া আপন মনে
ভূমি-পানে চেয়ে চেয়ে, একই গান গেয়ে গেয়ে,
দিন যায়, রাত যায়, শীত যায়, গ্রীষ্ম যায়,···
বসিয়া বসিয়া সেথা বিশীর্ণ মলিন প্রাণ
গাহিতেছে একই গান, একই গান, একই গান।

 অথচ আশ্চর্য এই যে, ইহারই মধ্যে ভিতরে ভিতরে আর-একটা বেদনা ছিল, এবং ইহার বিরুদ্ধে একটা সংগ্রাম ছিল— আপনার সেই প্রথম বাল্যকালের সহজ সুন্দর ভাবের মধ্যে প্রবেশ করিবার জন্য, বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে সেইরকম আনন্দিত হইবার জন্য, আপনার ‘সুকুমার আমি’কে আবার ফিরিয়া পাইবার জন্য। “পরাজয়সংগীত”, “আমিহারা” প্রভৃতি কবিতা হইতে তাহা স্পষ্টই বুঝিতে পারা যায়:

কে গো সেই, কে গো হায় হায়,
জীবনের তরুণ বেলায়
খেলাইত হৃদয়-মাঝারে,
দুলিত রে অরুণ-দোলায়?
সচেতন অরুণকিরণ
কে সে প্রাণে এসেছিল নামি?
সে আমার শৈশবের কুঁড়ি
সে আমার সুকুমার আমি!

 তার পরে

প্রতিদিন বাড়িল আঁধার,
পথমাঝে উড়িল রে ধূলি,
হৃদয়ের অরণ্য-আঁধারে
দুজনে আইনু পথ ভুলি···
ধূলায় মলিন হল দেহ,
সভয়ে মলিন হল মুখ;
কেঁদে সে চাহিল মুখপানে,
দেখে মোর ফেটে গেল বুক!···
অবশেষে একদিন, কেমনে কোথায় কবে
কিছুই যে জানি নে গো হায়,
হারাইয়া গেল সে কোথায়!···
হারায়েছি আমার আমারে,
আজি আমি ভ্রমি অন্ধকারে।

ইহার পরেই ‘প্রভাতসংগীত’। কিন্তু তাহার সঙ্গে এ ভাবের সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। ‘প্রভাতসংগীতে’ বিশ্বপ্রকৃতির আনন্দকে যেন হঠাৎ ফিরিয়া পাইলেন।

আপন জগতে আপনি আছিস
একটি রোগের মতো—

সেই অসুস্থ অবসাদের ভাব একেবারে কাটিয়া গেল। নিঝরের স্বপ্নভঙ্গ হইল এবং সে অন্ধকার হৃদয়গুহা ভেদ করিয়া বাহির হইল।

বহুদিন পরে         একটি কিরণ
গুহায় দিয়েছে দেখা,
পড়েছে আমার       আঁধার সলিলে
একটি কনকরেখা।
প্রাণের আবেগ রাখিতে নারি,
থর থর করি কাঁপিছে বারি,
টলমল জল করে থল থল,
কল কল করি ধরিছে তান।

‘সন্ধ্যাসংগীত’ হইতে অকস্মাৎ এরূপ ভাবব্যতিক্রমের একটু বিশেষ ইতিহাস আছে। সেটি দিলেই আপনারা বুঝিতে পারিবেন, আমি প্রবন্ধের গোড়াতে যে বলিয়াছি বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে অন্তরতম যোগের অনুভূতি কবির কাব্যের মূল সুর, তাহার সত্যতা কোথায়।

 কবির ভাষাতেই সে ইতিহাসটি দিই:

 ‘সদর স্ট্রীটের রাস্তাটার পূর্ব প্রান্তে বোধ করি ফ্রী স্কুলের বাগানের গাছ দেখা যায় । একদিন সকালে বারান্দায় দাঁড়াইয়া এই গাছগুলির পল্লবান্তরাল হইতে যেমনি আমি সূর্যোদয় দেখিলাম অমনি আমার চোখের উপর হইতে যেন পর্দা উঠিয়া গেল। একটি অপরূপ মহিমায় বিশ্বসংসার আচ্ছন্ন হইয়া গেল— আনন্দ এবং সৌন্দর্য সর্বত্র তরঙ্গিত হইতে লাগিল।··· আমার কাছে তখন কেহই এবং কিছুই অপ্রিয় রহিল না। পূর্বে যাহাদের সঙ্গ আমার পক্ষে বিরক্তিকর ছিল তাহারা কাছে আসিলে আমার হৃদয় অগ্রসর হইয়া তাহাদের গ্রহণ করিতে লাগিল। রাস্তা দিয়া মুটে মজুর যে কেহ চলিত তাহাদের গতিভঙ্গী, তাহাদের শরীরের গঠন, তাহাদের মুখশ্রী আমার কাছে সৌন্দর্যময় বোধ হইত। সকলেই যেন নিখিল সমুদ্রের উপর দিয়া তরঙ্গলীলার মতো বহিয়া যাইত। রাস্তা দিয়া একটি যুবক আর একটি যুবকের কাঁধে হাত দিয়া যখন হাসিতে হাসিতে অবলীলাক্রমে চলিয়া যাইত তখন তাহা আমার কাছে একটি অপরূপ ব্যাপার বলিয়া ঠেকিত— বিশ্বজগতে অফুরান রসের ভাণ্ডার, হাসির উৎস যেন আমার চোখে পড়িত। কাজ করিবার সময় মানবশরীরে যে আশ্চর্য গতিবৈচিত্র্য প্রকাশিত হয় পূর্বে তাহা আমি লক্ষ্য করি নাই— এখন মুহূর্তে মুহূর্তে সমস্ত মানবদেহের চলনের সংগীত আমাকে একটি বৃহৎ ভাবে মুগ্ধ করিতে লাগিল।

হৃদয় আজি মোর কেমনে গেল খুলি,
জগৎ আসি সেথা করিছে কোলাকুলি।
ধরায় আছে যত     মানুষ শত শত
আসিছে প্রাণে মোর, হাসিছে গলাগলি।
এসেছে সখা–সখী,     বসিয়া চোখোচোখি
দাঁড়ায়ে মুখোমুখি হাসিছে শিশুগুলি!···
পরান পুরে গেল, হরষে হল ভোর,
জগতে কেহ নাই, সবাই প্রাণে মোর।···
যে দিকে আঁখি চায় সে দিকে চেয়ে থাকে,
যাহারি দেখা পায় তারেই কাছে ডাকে।

 আমার খুব বিশ্বাস যে ‘প্রভাতসংগীতে’ই কবির সমস্ত জীবনের ভাবটির ভূমিকা নিহিত হইয়া আছে। অংশের মধ্যে সম্পূর্ণকে, সীমার মধ্যে অসীমকে নিবিড়রূপে উপলব্ধি করাই রবীন্দ্রনাথের সমস্ত জীবনের সাধনা— আমি পূর্বে বলিয়া আসিয়াছি যে এই সর্বানুভুতিই তাঁহার কাব্যের মূলসুর এবং এই ভাবটি সংগীতের প্রেরণা হইতে একটি নূতন চেতনার মতো তাঁহার মধ্যে বরাবর কাজ করিয়া আসিয়াছে। যদি এ কথা সত্য হয়, তবে স্বীকার করিতেই হইবে যে, দৃষ্টির এই আকস্মিক আবরণ-উন্মোচন, সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এই আনন্দময় উপলব্ধি, এইটি প্রথমে অখণ্ড ভাবে দেখা দিয়া, তার পর জীবনের বিচিত্রতার খণ্ড খণ্ড পথ বাহিয়া আবার ঐ অখণ্ড সৌন্দর্যের দৃষ্টি লাভ করিবার দিকে শেষবয়সে কবিকে তপস্যায় নিযুক্ত রাখিয়াছে।

 ‘প্রভাতসংগীতে’র আর একটি মাত্র কবিতার আমি এখানে উল্লেখ করিতে চাই, সেটি “প্রতিধ্বনি”। এটি দার্জিলিঙে লেখা। তখন এই আবরণোন্মুক্ত দৃষ্টিটি হারাইয়াছেন। কবিতাটির ভাব এই যে, বস্তুজগতের অন্তরালে যে একটি অসীম অব্যক্ত গীতজগৎ আছে, যেখানে সমস্ত জগতের বিচিত্র ধ্বনি সংগীতে পরিপূর্ণ হইয়া ‘অনাহত শবদে’ নিরন্তর বাজিতেছে— তাহার আভাস, তাহার প্রতিধ্বনি প্রত্যেকটি খণ্ড সৌন্দর্যে খণ্ড সুরে পাওয়া যায়, সেইজন্যই তাহারা প্রাণের মধ্যে এমন সুতীব্র একটি ব্যাকুলতাকে জাগায়। বস্তুত পাখির গান পাখিরই নয়, নির্ঝরের কলশব্দ নির্ঝরেরই নয়, তাহা সেই মূল সংগীতেরই নানা প্রতিধ্বনি— এইজন্যই জগতের যে-সকল সুর ধ্বনিত হইতেছে এবং যাহারা ধ্বনিত হইতেছে না, সকলে মিলিয়া আমাদের মনে একই সৌন্দর্যবেদনাকে জাগাইয়া তুলিতেছে। আমরা নানা প্রতিধ্বনি শুনিতে শুনিতে সেই মূল সংগীতকে শুনিবার জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠিতেছি।

তোর মুখে পাখিদের গুনিয়া সংগীত,
নির্ঝরের শুনিয়া ঝর্ঝর···
তোর মুখে জগতের সংগীত শুনিয়া
তোরে আমি ভালোবাসিয়াছি;
তবু কেন তোরে আমি দেখিতে না পাই,
বিশ্বময় তোরে খুঁজিয়াছি।···
দেখা তুই দিবি না কি? না হয় না দিলি
একটি কি পুরাবি না আশ?
কাছে হতে একবার শুনিবারে চাই
তোর গীতোচ্ছ্বাস।
অরণ্যের পর্বতের সমুদ্রের গান,
ঝটিকার বজ্রগীতম্বর,
দিবসের প্রদোষের রজনীর গীত,
চেতনার নিদ্রার মর্মর,
বসন্তের বরষার শরতের গান,
জীবনের মরণের স্বর,
আলোকের পদধ্বনি মহা অন্ধকারে
ব্যাপ্ত করি বিশ্বচরাচর,
পৃথিবীর চন্দ্রমার গ্রহ- তপনের,
কোটি কোটি তারার সংগীত,
তোর কাছে জগতের কোন্ মাঝখানে
না জানি রে হতেছে মিলিত।
সেইখানে একবার বসাইবি মোরে,
সেই মহা আঁধার নিশায়,

শুনিব রে আঁখি মুদি বিশ্বের সংগীত
তোর মুখে কেমন শুনায়।

 রবীন্দ্রনাথ গীতিকবি হৃদয়াবেগকে সুরের অনির্বচনীয় ভাষায় ব্যক্ত করাই তাঁহার চিরজীবনের কাজ। গানের সুরে কবির কাছে জগতের একটি অপরূপ রূপান্তর ঘটে। হঠাৎ চোখে দেখা জগৎ ক্ষণকালের জন্য যেন সুরের জগৎ কানে—শোনা জগৎ হইয়া উঠে— সমস্ত বিশ্বস্পন্দনকে কেবল আলোকরূপে বস্তুরূপে না দেখিয়া তাহাকে একটি অপরূপ সংগীতের মতো যেন কবি অনুভব করিতে থাকেন। একটা চিঠিতে আছে:

 ‘অনন্তের মধ্যে যে একটি প্রকাণ্ড অখণ্ড চির বিরহবিষাদ আছে, সে এই সন্ধ্যাবেলাকার পরিত্যক্ত পৃথিবীর উপরে কি একটি উদাস আলোকে আপনাকে ঈষৎ প্রকাশ করে দেয়— সমস্ত জলে স্থলে আকাশে কি একটি ভাষাপরিপূর্ণ নীরবতা— অনেকক্ষণ চুপ করে অনিমেষনেত্রে চেয়ে দেখতে দেখতে মনে হয়, যদি এই চরাচরব্যাপ্ত পূর্ণ নীরবতা আপনাকে আর ধারণ করতে না পারে, সহসা তার অনাদি ভাষা যদি বিদীর্ণ হয়ে প্রকাশ পায়, তা হলে কি একটা গভীর গম্ভীর শান্ত সুন্দর করুণ সংগীত পৃথিবী থেকে নক্ষত্রলোক পর্যন্ত বেজে ওঠে। আসলে তাই হচ্ছে। কেননা জগতের যে কম্পন কানে এসে আঘাত করছে সে শব্দ। আমরা একটু নিবিষ্টচিত্তে স্থির হয়ে চেষ্টা করলে জগতের সম্মিলিত আলোক এবং বর্ণের বৃহৎ হার্মনিকে মনে মনে একটি বিপুল সংগীতে তর্জমা করে নিতে পারি।’

 রবীন্দ্রনাথের কবিতার মধ্যে যে অনেকে একটা অস্পষ্টতা অনুভব করেন সে এই সুরের আবেগের জন্য। ‘সংগীতস্রোতে ভেসে যাই দূরে, খুঁজে নাহি পাই কূল’। তাহার কারণ গানের সুর আমাদের মনে যে সৌন্দর্যকে জাগায় তাহাকে কোনো সংকীর্ণ কথার দ্বারা আমরা সুস্পষ্ট প্রকাশ করিতে পারি না। তাহা যদি পারিতাম তবে সুরের প্রয়োজনই ছিল না। সেইজন্য সুরে যখন কোনো অনুভূতি বাজে তখন তাহার চারি দিকে একটি অনির্বচনীয়তার হিল্লোল খেলিতে থাকে— সে যাহা বলে তার চেয়ে ঢের বেশি না-বলার দ্বারা বলে— গীতের প্রকাশ সেইজন্য কথার প্রকাশের পরবর্তী সপ্তকে লীলা করিতে থাকে।

 এই গান যে কেবল কাব্যে, তাহা নহে, রবীন্দ্রনাথের সমস্ত রচনার মধ্যেই ইহা কাজ করিয়াছে দেখিতে পাই। তাঁহার দৃষ্টিটাই গানের দৃষ্টি— খণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে তাহার নিত্যসহচররূপে অখণ্ডকে দেখা। সুর যেমন প্রত্যেক কথাটির মধ্যে অনির্বচনীয়কে উদ্ঘাটন করে, তাঁহার হৃদয় সেইরূপ সমস্ত দেখার সঙ্গে সঙ্গে একটি অপরূপকে দেখিয়া তৃপ্তিলাভ করিতে চায়। আমার মনে হয় তাঁহার অধিকাংশ গদ্যগল্পগুলিও এইরকম এক-একটি গীত। তাহা এক-একটি ঘটনাকে আশ্রয় করিয়া সেই ঘটনার মূলগত এক-একটি বিশ্বব্যাপী সুরের অনুরণনে পাঠকের মনকে পূর্ণ করিয়া তুলিতে চায়।

 প্রভাতসংগীতের পর ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ নামক একটি নাট্যকাব্য লিখিত হয়। এই নাটকের নায়ক এক সন্ন্যাসী সমস্ত স্নেহবন্ধন ছিন্ন করিয়া প্রকৃতির উপরে জয়ী হইবার ইচ্ছা করিয়াছিল। অবশেষে একটি বালিকা তাহাকে ভালোবাসিয়া তাহাকে সংসারের মধ্যে ফিরাইয়া আনিল। তাহার তখন এই উপলব্ধিটি হইল যে, সীমার মধ্যেই অসীমতা, প্রেমের বন্ধনই যথার্থ বন্ধনমুক্তি। যে জগৎকে তাহার অত্যন্ত বিরূপ ও ক্ষুদ্র লাগিয়াছিল তাহাই তাহার কাছে আনন্দময় হইয়া দেখা দিল।

 আমার নিজের বিশ্বাস যে নাটকের কাহিনীটি যেমনি হউক না, ইহাও একপ্রকার প্রভাতসংগীতেরই অনুবৃত্তি। এক সময়ে যে তাঁহার প্রকৃতির সহিত বিচ্ছেদ হইয়াছিল, আপনার মধ্যে আপনি অবরুদ্ধ হইয়া তিনি বেদনা পাইতেছিলেন, সেইটা কাটিয়া গিয়া পুনরায় বিশ্বের আনন্দলোকের সঙ্গে মিলিত হইবার আত্মকাহিনীর এক অংশ এই নাটকের মধ্যে আছে।

 ‘ছবি ও গানে’র অধিকাংশ কবিতা এই সময়েই লিখিত হয়। ‘কড়ি ও কোমল’ তাহার পরে। কবিতা এই সময় হইতেই অনেকটা সংহত আকার ধারণ করিয়াছে— চিত্রগুলি নির্দিষ্ট, হৃদয়ভাবগুলিও স্পষ্ট এবং ভাষা ও ছন্দ নিয়মিত। কিন্তু এই সময়ের সকল কবিতার মধ্যেই কল্পনার একটা স্বপ্নাবেশ লাগানো আছে। কল্পনার রঙে সমস্ত সৌন্দর্যকে একটু বিশেষ ঘের দিয়া লইবার ও ভোগ করিবার একটি ভাব ইহাদের মধ্যে আছে। বাস্তব বলিতে যাহা বুঝায়, এ কবিতাগুলি তাহা নয়— বাস্তব জগতের সঙ্গে ইহাদের সম্বন্ধ অল্পই। ইহাদের মধ্যে আপনারই কল্পনার রসকে বাহিরের জিনিসে স্থাপিত করিয়া দেখিবার একটি আনন্দ আছে। যেটুকু বিশেষভাবে ভোগের সীমায় আসিয়া ধরা দেয়, কল্পনার রঙে রঙিন হইয়া হৃদয়কে তৃপ্ত করে, সেইটুকু চুনাইয়া লইবার একটি প্রয়াস। সৌন্দর্যভোগের একটি বিশেষ অবস্থার কাব্য ছবি ও গান, এবং কড়ি ও কোমল। এই দুই কাব্যের মধ্যে প্রভেদ কেবল এই যে, ছবি ও গানে কল্পনার ভাগটা বেশি, কড়ি ও কোমলে হৃদয়াবেগ বেশি।

 মোহিত বাবু-সম্পাদিত গ্রন্থাবলীতে এই সময়কার অধিকাংশ কবিতাকে ‘যৌবন-স্বপ্ন’ নামের মধ্যে ফেলা হইয়াছে। পক্ষীদের মধ্যে যেমন দেখা যায় যে, তাহাদের মিলনের কাল উপস্থিত হইলে তাহাদের ডানাগুলি বিচিত্র রঙেচঙে মণ্ডিত হইয়া উঠে, তেমনি হৃদয়বৃত্তির মুকুলিত অবস্থায় একটি স্বপ্নাবেশ আছে— একটি স্বর্ণ-আভাময় মোহ তখন নানা বিচিত্র কল্পনার ছবিতে এবং সুরে আপনাকে প্রকাশ করিতে থাকে। এ সম্পূর্ণরূপে বাস্তব নহে, এ অনেক পরিমাণে স্বপ্নই। কিন্তু এই ‘মধুর আলস, মধুর আবেশ, মধুর মুখের হাসিটি, মধুর স্বপনে প্রাণের মাঝারে বাজিছে মধুর বাঁশিটি’র রাজ্য বড় মোহময়।

 যাঁহারা সৌন্দর্যের এই মোহকে ভোগলালসা নাম দিতে চান এবং সেইজন্য এই-সকল শ্রেণীর কবিতাকে অপবাদ দিয়া থাকেন, আমি তাঁহাদের সঙ্গে কোনমতেই মিলিতে পারিলাম না। মানুষের মনে অনেক সময়ে সৌন্দর্যের সঙ্গে সঙ্গে ভোগের ইচ্ছা আসিয়া পড়ে, কিন্তু তাই বলিয়া তাহাদের মধ্যে অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ আছে এ কথা মানি না। ভোগের সমস্ত ক্ষণিকতা ও ব্যর্থতাকে অতিক্রম করিয়া সৌন্দর্যের একটি অসীমমুক্ত রূপ আছে— সেই রূপটিকে সত্যভাবে দেখিতে পাইলেই ভোগের লালসা আপনি ক্ষয় হইয়া যায়। এইজন্য মানবের দেহে এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গে যে একটি প্রাণময় মনোময় অত্যাশ্চর্য সৌন্দর্যের প্রকাশ আছে তাহার লোকাতীত রহস্যময় পরমবিস্ময়কর সুরটিকে যদি ধরিতে পারি তবে রক্তমাংসময় স্থূলবস্তুই একান্ত সত্যরূপে আমাদিগকে আকর্ষণ করে না— তখন তাহার অন্তরতম অনন্ত সত্যটিই আমাদের নিকট হইতে পূজা গ্রহণ করিবার জন্য আবির্ভূত হয়। মানবদেহের এই নিবিড় সৌন্দর্যের সুরটিকে কবি তাঁহার বীণা হইতে নির্বাসিত করিয়া দিতে পারেন না। এ সুর বিধাতার জগতে বাজিতেছে, এ সুর কবির বীণাতেও বাজিয়া উঠিবে। কেবল দেখিবার বিষয় এই যে, এই সুর বিশ্বসংগীতের অন্য-সকল তানকে অতিমাত্রায় আচ্ছন্ন করিয়া নিজেকেই একান্ত প্রবল করিরা না তোলে। আমাদের ভোগস্পৃহার নিগূঢ় উত্তেজনা-বশতই সেই অপরিমিত প্রবলতার আশঙ্কা আছে। সেইজন্যই প্রবৃত্তির পাল এবং নিবৃত্তির হাল, এই দুইয়ের সহযোগেই তবে সৌন্দর্যের তরীটিকে সত্যের পথে ঠিক বিনা বিপদে চালনা করা সম্ভবপর হয়।

 আমি জানি কড়ি ও কোমলের অনেকগুলি কবিতা এবং ‘চিত্রাঙ্গদা’ কাহারও কাহারও কাছে ইন্দ্রিয়াসক্তির কাব্য বলিয়া নিন্দনীয় হইয়াছে। উক্ত কাব্যদ্বয়ে ভোগের সুর যে কিছুমাত্র লাগে নাই তাহা আমি বলি না, কিন্তু সেই সুরই উহাদের মধ্যে একান্ত নহে। বরং তাহাকে চরম স্থান না দিবার এবং তাহার সীমা নির্ণয় করিয়া দেখাইবার একটি ভাব ঐ দুই কাব্যের মধ্যে প্রবল। চিত্রাঙ্গদার রূপটা যে বাহিরের জিনিস, ক্ষণিক বসন্তের প্রদত্ত একটি অস্থায়ী সৌভাগ্যের মতো, তাহা বিশেষ করিয়া নাট্যের মধ্যে ঘটাইবার একটু উদ্দেশ্য আছে। বাহ্যিক রূপ এবং অন্তরের মানুষ এ দুয়ের দ্বন্দ্ব যে কি প্রবল তাহা আর কোনো উপায়ের দ্বারাই দেখানো যাইত না। আমি তো বরং মনে করি যে, চিত্রাঙ্গদা কাব্যখানি সৌন্দর্যকে বাহিরের দিক হইতে ভোগের একটা মস্ত প্রতিবাদ। ইহাতে ভোগকে যেমন উজ্জ্বল বর্ণে আঁকা হইয়াছে, ভোগের অবসাদকে এবং শূন্যতাকেও তেমনি করিয়া দেখানো হইয়াছে।

সংসার-পথের
পান্থ, ধুলিলিপ্ত বাস, বিক্ষত চরণ,
কোথা পাব কুসুমলাবণ্য, দুদণ্ডের
জীবনের অকলঙ্ক শোভা!

 সেই সমস্ত অসম্পূর্ণতা-খণ্ডতার মধ্যেই প্রেমের যে ‘এক সীমাহীন অপূর্ণতা অনন্ত মহৎ’ বিদ্যমান, সেই জায়গাটাতেই কি জোর দিয়া বাহ্য সৌন্দর্যের মায়াময় আবরণকে কবি চিত্রাঙ্গদায় ছিন্ন করিয়া ফেলেন নাই?

 কড়ি ও কোমলের শেষের দিকেও ভোগকে একেবারে দলিত করিয়া তাহার কারাগার হইতে বাহির হইয়া পড়িবার জন্য বারম্বার একটি ক্রন্দন আছে:

কুসুমের কারাগারে রুদ্ধ এ বাতাস,
ছেড়ে দাও ছেড়ে দাও বদ্ধ এ পরান।

 সেইজন্য স্পষ্টই বুঝা যায় যে কবির সৌন্দর্যসাধনায় ভোগ কখনোই একান্ত হইয়া উঠিতে পারে নাই।

 সৌন্দর্যের বেলা যেমন দেখা গেল, প্রেমের বেলাতেও ঠিক তাই। ‘মানসী’র প্রেমের কবিতাগুলিতে যদিচ প্রেমের জীবনের খুব গভীরতার পরিচয় আছে, যে প্রেম আপনার ‘জীবনমরণময় সুগম্ভীর কথা’ বলিবার জন্য ব্যাকুল, যে প্রেমের ধ্যাননেত্রে ‘যতদূর হেরি দিক্‌দিগন্ত তুমি আমি একাকার’, যে প্রেম আপনাকে জন্মজন্মান্তরে অনন্ত বলিয়া জানে— তথাপি সে প্রেম যে জীবনের সব নয়, তাহাকে যে চরম করিয়া তোলা চলে না, এমন একটা ভাব মানসীর অধিকাংশ কবিতার মধ্যে বারম্বার প্রকাশ পাইয়াছে।

 “নিষ্ফল কামনা”র কথা পূর্বেই উল্লেখ করিয়াছি। “নিষ্ফল প্রয়াসে”র মধ্যেও সেই একই কথা। “আঁখির অপরাধ” (সুরদাসের প্রার্থনা) কবিতাটিতে প্রেম যে সমস্ত হরণ করিয়া একটি মূর্তির মধ্যেই বাঁধা পড়িয়া গেছে সেই মূর্তির বন্ধন হইতে মুক্তিলাভের জন্য ব্যাকুলতা প্রকাশ পাইয়াছে:

ভুবন হইতে বাহিরিয়া আসে ভুবনমোহিনী মায়া,
যৌবনভরা বাহুপাশে তার বেষ্টন করে কায়া।

 এই ‘মায়ার খেলা’ হইতে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা কি তীব্র:

যাক, তাই যাক। পারি নে ভাসিতে কেবলি মুরতি-স্রোতে।
লহো মোরে তুলে আলোকমগন মুরতিভুবন হতে।

আঁখি গেলে মোর সীমা চলে যাবে— একাকী অসীম-ভরা
আমারি আঁধারে মিলাবে গগন, মিলাবে সকল ধরা।

 একবার এই আঁখির জগৎ মুছিয়া গেলে তার পর আবার সমস্ত সৌন্দর্য তাহার নবীন নির্মলতায় যখন প্রকাশ পাইবে তখনই এই বেদনা মুছিয়া যাইবে, এই আশ্বাসের কথা “আঁখির অপরাধ” কবিতাটির শেষে আছে ।

 তবেই দেখা যাইতেছে যে, সৌন্দর্য ও প্রেম যেখানেই সমগ্রকে আচ্ছন্ন করিয়া বাসনার সংকীর্ণতার মধ্যে ঘুরাইয়া মারিয়াছে, সেখানেই কবির চিত্তে বেদনা জাগিয়া সেই বাসনাপাশ ছিন্ন করিবার জন্য লড়াই করিয়াছে। সেই “ভৈরবী গানে”র

ওই মন-উদাসীন,  ওই আশাহীন
ওই ভাষাহীন কাকলি
দেয় ব্যাকুল পরশে সকল জীবন
বিকলি।

 সমস্ত মানসীর মধ্যে থাকিয়া থাকিয়া সেই ভৈরবীর বৈরাগ্যের বিকল-করা সুর শুনিতে পাওয়া যায়, ইহা আমার বিশ্বাস।

 ‘মানসী’র মধ্যে যে-সকল ব্যঙ্গ কবিতা স্থান পাইয়াছে, যথা “বঙ্গবীর”, “দেশের উন্নতি”, “ধর্মপ্রচার” প্রভৃতি, তাহাদের মধ্যেও একটি বেদনা আছে। আমাদের দেশের চারি দিকের ক্ষুদ্র কথা, ক্ষুদ্র চিন্তা, ক্ষুদ্র পরিবেষ্টন, ক্ষুদ্র কাজকর্ম কবিকে তখন বড়ই আঘাত দিতেছিল। নিজেরও কেবলই অনুভূতিময় জীবনের মধ্যে আবিষ্ট হইয়া থাকিবার জন্য একটা আপনার সঙ্গে আপনার সংগ্রাম চলিতেছিল— খুব একটা বড় ক্ষেত্রে আপনার সুখদুঃখের বিরাট প্রকাশ দেখিবার জন্য চিত্ত ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছিল— ‘দুরন্ত আশা’ কবিতাটি হইতে তাহা বেশ বুঝিতে পারা যায়:

ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুয়িন!
চরণ-তলে বিশাল মরু দিগন্তে বিলীন!···
নিমেষ-তরে ইচ্ছা করে বিকট উল্লাসে
সকল টুটে যাইতে ছুটে জীবন উচ্ছ্বাসে—
শূন্য ব্যোম অপরিমাণ মদ্য-সম করিতে পান
মুক্ত করি রুদ্ধ প্রাণ ঊর্ধ্ব নীলাকাশে।
থাকিতে নারি ক্ষুদ্র কোণে আম্রবনছায়ে
সুপ্ত হয়ে লুপ্ত হয়ে গুপ্ত গৃহবাসে।

 এই সময়ের একটু ইতিহাস দেওয়া দরকার। মানসীর অধিকাংশ কবিতাই গাজিপুরে লেখা। কবির ইচ্ছা হইয়াছিল যে পশ্চিমের কোনো রমণীয় স্থানে তিনি একটি নিভৃত কবিকুঞ্জ রচনা করিয়া জীবনটিকে সৌন্দর্যের স্রোতে ভরা কবিত্বের হাওয়ার মধ্যে ভাসাইয়া দেন। কিন্তু সেখানে গিয়া কিছুদিন কাটানোর পরেই তিনি অনুভব করিলেন যে এ সৌন্দর্যের কল্পলোকের মধ্যে চিত্তের তৃপ্তি নাই। কর্মহীন জীবনের একটা অবসাদ তাঁহার চিত্তকে পীড়িত করিতে লাগিল।

 রাজা ও রানীতে প্রধান নায়ক বিক্রমের একান্ত ভোগ প্রধান প্রেমের অমন ভয়ানক পরিণাম অঙ্কিত করিবার কারণ, সে প্রেম আপনাকে খাইয়া এবং আপনার সমস্ত নিত্য আশ্রয়কে খাইয়া আপনি বাঁচিবার ব্যর্থ চেষ্টা করিয়াছিল— মঙ্গলকর্মে বৃহৎ ক্ষেত্রে আপনাকে ব্যাপ্ত করিয়া সফল হইয়া উঠে নাই। নিদারুণ দুঃখের প্রলয়ঘাতে সেই ভীষণ প্রেমের নাগপাশ হইতে মানুষ মুক্তিলাভ করে ইহাই এই নাটকের শেষ কথা।