রবীন্দ্রনাথ গাজিপুর হইতে ফিরিয়া আসিলেন। তখন তাহার সংকল্প হইয়াছিল যে একটা গোযানে করিয়া গ্র্যাণ্ডট্রাঙ্ক রোড ধরিয়া একেবারে পেশোয়ার পর্যন্ত পর্যটনে দীর্ঘকালের মতো বাহির হইয়া পড়িবেন— ‘শূন্যব্যোম অপরিমাণ মদ্য-সম করিতে পান’। এমন সময়ে তাঁহার পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ তাঁহাকে জমিদারির কাজকর্ম দেখিবার জন্য অনুরোধ করিলেন। কাজের নামে প্রথমে কবি একটু ভীত হইয়া পড়িয়াছিলেন, কিন্তু শেষে সম্মত হইয়া জমিদারিতে গেলেন। তখন হইতেই শিলাইদহের জীবনের আরম্ভ।

 কেবল ভাব আপনার মধ্য হইতে আপনি খোরাক সংগ্রহ করিয়া যখন প্রাণধারণের চেষ্টা করে, তখন সে ক্রমেই বাস্তবসম্পর্কশূন্য একটা অলীক জিনিস হইয়া পড়ে। এই যে কাজ হাতে আসিল, বাংলাদেশের গ্রাম্য জীবনযাত্রার সুখদুঃখের সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটিতে লাগিল, ইহাতে দেখিতে দেখিতে কবির রচনা ব্যক্তিত্বের বন্ধন ছাড়াইয়া বাস্তুব সত্যের উপরে প্রতিষ্ঠা লাভ করিল। অনুভূতিগুলির প্রকাশ ব্যক্তিগত না হইয়া বিশ্বের হইয়া উঠিল ।

 ‘সাধনা’র এই সময়েই জন্ম। ১২৯৮ সাল- তখন কবির ত্রিশ বৎসর বয়স; এই সময় হইতেই গল্পগুচ্ছেরও সূত্রপাত। ‘সাধনা’র পূর্বে তাঁহার ‘বিবিধ প্রসঙ্গ’, ‘আলোচনা’ প্রভৃতি কিছু কিছু গদ্য রচনা বাহির হইয়াছিল— বালকেও ভ্রমণবৃত্তান্ত ও কিছু কিছু প্রবন্ধ তিনি লিখিয়াছিলেন। কিন্তু সে-সকল গদ্য ভাব কিম্বা ভাষার দিক হইতে তেমন বড় স্থান অধিকার করিতে পারে না। সাধনাতেই প্রথম পঞ্চভূতের ডায়ারি, গল্প, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রবন্ধ প্রভৃতি অনেক গদ্য রচনা বাহির হয়। ইহার কারণ সর্বাঙ্গীণ মানসোৎকর্ষের একটা ক্ষুধা পূর্বে এমন করিয়া জাগে নাই—দেশবিদেশের সকল প্রকার চেষ্টা ও চিন্তার প্রবাহের সঙ্গে নিজের যোগ রক্ষা করিবার কোনো তাগিদই কবির মনে পূর্বে ছিল না। সাধনার সময়কার রচনা বিচিত্র দিকে— সাময়িক ইংরেজি মাসিক পত্রিকা হইতে সারসংকলন, বৈজ্ঞানিক সংবাদ, রাজনীতির আলোচনা, সমাজতত্ত্ব— প্রতি মাসে মাসে গল্প ও কাব্য বাদে এই প্রকারের বিবিধ রচনা সাধনাতে প্রকাশিত হইত। যথার্থ ই সেটা একটা সাধনার কাল ছিল।

 সমাজের ক্ষুদ্র আচারবিচার-লোকাচারের অন্ধ অনুবর্তিতাকে তখন সাধনায় কবি সুতীব্র আঘাত দিতেন। ‘সোনার তরী’ কাব্যের মধ্যেও তাহার কিছু কিছু চিহ্ন আছে। এবং রাজনীতিক্ষেত্রে কর্মের দায়িত্বহীন নাকী সুরের নালিশ, রাজদ্বারে “আবেদন এবং নিবেদনে”র লজ্জাকর হীনতাকেও কবি কম আঘাত করিতেন না।

 অথচ এ সময়ের জীবনটি প্রকৃতির একটি অতি নিবিড় উপভোগের মধ্যে নিমগ্ন হইয়া ছিল। নৌকাবাসের জীবন— নদীতে নদীতে ভ্রমণ— কখনো জনশূন্য পদ্মার বালুচরে, কখনো গ্রামের ধারে বোট বাঁধিয়া থাকা। ‘ছোটোখাটো গ্রাম, ভাঙাচোরা ঘাট, টিনের ছাত-ওয়ালা বাজার, বাঁখারির-বেড়া-দেওয়া গোলাঘর, বাঁশঝাড়, আম কাঁঠাল খেজুর শিমুল কলা আকন্দ ভেরেণ্ডা ওল কচু লতাগুল্ম তৃণের সমষ্টিবদ্ধ ঝোপঝাড় জঙ্গল, ঘাটে-বাঁধা মাস্তুল-তোলা বৃহদাকার নৌকোর দল, নিমগ্নপ্রায় ধান’-এর পাশ দিয়া নৌকাযাত্রা— কি চমৎকার পরিপূর্ণ দিনগুলি তখনকার, তাহা কেবল কবিতা হইতে নহে, তাঁহার গল্পগুচ্ছ এবং সেই বয়সের অনেকগুলি চিঠি হইতে বেশ বুঝিতে পারি। বস্তুত অধিকাংশ গল্পই প্রকৃতির এক-একটি অনুভাবকে প্রকাশ করিবার আবেগেই লিখিত। বাংলা গ্রাম্য জীবনের যে-সকল ছবি যে-সকল ঘটনা চোখে পড়িতেছিল বা কানে আসিতেছিল তাহাকে গল্পের সূত্রে ধরিয়া প্রকৃতির ভাবের দ্বারা গাঁথিয়া তুলিয়া প্রকাশ করাই গল্প লিখিবার ভিতরের কারণ। দৃষ্টান্তস্বরূপে ধরা যাক “অতিথি” গল্পটা। সেটা একটি যাত্রার দলের ছেলের গল্প—সে কোথাও স্থায়ীভাবে বাঁধা পড়িতে চাহিত না। সে পর্যায়ক্রমে নানা দলে ভিড়িয়াছিল; তাহার ঔৎসুক্য সকল বিষয়ে সজীব ছিল বলিয়া সে সর্বত্রই অবাধে মিশিয়া যাইতে পারিত। কিন্তু সে বন্ধন মানিত না। অবশেষে জমিদার মতিবাবুর আশ্রয়ে দীর্ঘকাল থাকিয়া লেখাপড়া শিখিয়া যখন তাহার মন বসিয়াছে মনে হইল, তখন তাঁহার কন্যার সহিত বিবাহের রাত্রে অকারণে সে হঠাৎ পলায়ন করিল। গল্পটা কিছুই নহে, বিশ্বপ্রকৃতির চিরচঞ্চল অথচ চিরনির্লিপ্ত একটি ভাবকে ঐ একটু গল্পের সূত্রের মধ্যে ধরিবার এক রকমের চেষ্টা।

 শিলাইদহের একটা চিঠির খানিকটা অংশ এখানে তুলিয়া দিলাম—

 ‘আজকাল মনে হচ্ছে, যদি আমি আর কিছুই না ক’রে ছোটো ছোটো গল্প লিখতে বসি তা হলে কতকটা মনের সুখে থাকি এবং কৃতকার্য হতে পারলে হয়তো পাঁচজন পাঠকেরও মনের দুখের কারণ হওয়া যায়। গল্প লেখবার একটা সুখ এই, যাদের কথা লিখব তারা আমার দিনরাত্রির সমস্ত অবসর একেবারে ভরে রেখে দেবে, আমার একলা মনের সঙ্গী হবে, বর্ষার সময় আমার বদ্ধ ঘরের সংকীর্ণতা দূর করবে, এবং রৌদ্রের সময়ে পদ্মাতীরের উজ্জ্বল দৃশ্যের মধ্যে আমার চোখের ’পরে বেড়িয়ে বেড়াবে। আজ সকালবেলায় তাই গিরিবালা— নাম্নী উজ্জ্বলশ্যামবর্ণ একটি ছোটো অভিমানী মেয়েকে আমার কল্পনারাজ্যে অবতারণ করা গেছে । সবেমাত্র পাঁচটি লাইন লিখেছি এবং সে পাঁচ লাইনে কেবল এই কথা বলেছি যে, কাল বৃষ্টি হয়ে গেছে, আজ বর্ষণ-অন্তে চঞ্চল মেঘ এবং চঞ্চল রৌদ্রের পরস্পর শিকার চলছে—’

 তবেই দেখা যাইতেছে, প্রকৃতির একটি সুন্দর ছায়ারৌদ্রমণ্ডিত শ্যামল বেষ্টনের মধ্যে মানুষের জীবনের সমস্ত সুখদুঃখকে গাঁথিবার আবেগ গল্পগুলির আসল উৎপত্তির উৎসস্বরূপ। ‘সোনার তরী’র কবিতাগুলির মধ্যেও বাহিরের সঙ্গে অন্তরের, মানুষের সঙ্গে বিশ্বপ্রকৃতির সম্পূর্ণ মিলনের ভাবটি জাগ্রত । বিচ্ছিন্ন কোনো ভাবের মধ্যে, আপনার মনগড়া কল্পনার মধ্যে জীবনকে খণ্ডিত করিবার মিথ্যাকে এবং ব্যর্থতাকে সোনার তরীর প্রায় সকল কবিতায় প্রদর্শন করা হইয়াছে। প্রথম কবিতা “সোনার তরী”র ভিতরের কথাটিই তাই। সৌন্দর্যের যে সম্পদ জীবনের নানা শুভ মুহূর্তে একটি চিরপরিচিত অথচ অজানা সত্তার স্পর্শের ভিতর দিয়া ক্রমাগতই জীবনের ভিতরে সঞ্চিত হইয়াছে, তাহাকে নিজের ভোগের গণ্ডি দিয়া রাখিতে গেলেই সে পলায়ন করে— সে যে বিশ্বের, সে যে সকলের। “পরশপাথর”এও সেই একই কথা। পরশপাথরই নানা সৌন্দর্যের ভিতর দিয়া জীবনকে গভীরভাবে স্পর্শ করিতেছে— সেই বাস্তব সত্য ছাড়িয়া কল্পনায় তাহার অন্বেষণ করিতে গেলে কোনোদিনই তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না। “বৈষ্ণব-কবিতা”র মধ্যেও সেই একই ভাব। বাস্তব প্রেমের মধ্যেই দেবত্ব নিহিত— প্রেমকে বাস্তব ক্ষেত্র হইতে সরাইয়া অপ্রকৃতের মধ্যে স্থাপন করা যায় না। “দুই পাখি”, “আকাশের চাঁদ”, “দেউল” প্রভৃতি সকল কবিতার ভিতরেই আপনার কল্পনার দিক হইতে বিশ্বের দিকে পরিপূর্ণ অনুভূতি লইয়া প্রবেশ করিবার সাধনার সংবাদ সোনার তরী কাব্যখানির আদ্যন্ত-মধ্যে পাওয়া যায়। “পুরস্কার” কবিতাটিতে—

শ্যামলা বিপুলা এ ধরার পানে
চেয়ে দেখি আমি মুগ্ধ নয়ানে,
সমস্ত প্রাণে কেন—যে কে জানে
ভ’রে আসে আঁখিজল,—
বহু মানবের প্রেম দিয়ে ঢাকা,
বহু দিবসের সুখে দুখে আঁকা,
লক্ষ যুগের সংগীতে মাখা
সুন্দর ধরাতল।

ইত্যাদি শ্লোকে যে ভাব ব্যক্ত হইয়াছে— অথবা “দরিদ্রা” কবিতাটিতে যে সকরুণ অশ্রুসজল ভাবটি প্রকাশ পাইয়াছে তাহা পরবর্তী “স্বর্গ হইতে বিদায়”এর ভাবের অনুরূপ।

দরিদ্রা বলিয়া তোরে বেশি ভালোবাসি
হে ধরিত্রী, স্নেহ তোর বেশি ভালো লাগে
বেদনা-কাতর মুখে সকরুণ হাসি,
দেখে মোর মর্ম-মাঝে বড়ো ব্যথা জাগে।
আপনার বক্ষ হতে রসরক্ত নিয়ে
প্রাণটুকু দিয়েছিস সন্তানের দেহে,
অহর্নিশি মুখে তার আছিস তাকিয়ে,
অমৃত নারিস দিতে প্রাণপণ স্নেহে।
কত যুগ হতে তুই বর্ণগন্ধগীতে
সৃজন করিতেছিস আনন্দ-আবাস,
আজো শেষ নাহি হল দিবসে নিশীথে—
স্বর্গ নাই, রচেছিস স্বর্গের আভাস।
তাই তোর মুখখানি বিষাদকোমল,
সকল সৌন্দর্যে তোর ভরা অশ্রুজল।

 “স্বর্গ হইতে বিদায়” নামক রবীন্দ্রবাবুর যে পরমাশ্চর্য কবিতাটির উল্লেখ করিলাম তাহার ভিতরের ভাবটি এই:

 স্বর্গে কেবলমাত্র আনন্দ, তাহার মধ্যে কোথাও কোনো দুঃখের ছায়ামাত্র পড়ে না। সে আনন্দ যে পৃথিবীর আনন্দ নহে পৃথিবীর ইহাই গৌরব, মানবজীবনের ইহাই গৌরব। পৃথিবীতে আমাদের যে সবই হারাইতে হয়, সেইজন্যই আমাদের এখানকার প্রেম, আমাদের এখানকার আনন্দ এত নিবিড়— স্বর্গে লক্ষ লক্ষ বৎসর চক্ষের পলকটুকুর মতোও নহে, কারণ সেখানে কোনো বৈচিত্র্য নাই, কিন্তু আমাদের পৃথিবীর জীবনের মধ্যে প্রতি মুহূর্তের দেখাশোনা, কথাবার্তা, মেলা মেশা কি বেদনাময়, প্রেমের দ্বারা কি নিবিড় রহস্যময়! তাই—

স্বর্গে তব বহুক অমৃত,
মর্তে থাক্ সুখে-দুঃখে-অনন্ত-মিশ্রিত
প্রেমধারা অশ্রুজলে চিরশ্যাম করি
ভূতলের স্বর্গখণ্ডগুলি।

সোনার তরীর পরশপাথর, দেউল প্রভৃতি কবিতায় যে বাস্তব জগৎ হইতে, জীবন হইতে বিমুখ হইবার ভাবের প্রতিবাদ দেখিতে পাওয়া যায় তাহা প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশের মজ্জাগত বৈরাগ্যেরই প্রতিবাদ। জগৎটাকে মায়া ছায়া, সংসারকে অনিত্য, স্নেহপ্রেমকে মোহ বলিয়া ঘোষণা করিবার জন্য আমরা পরশপাথরের সন্ন্যাসীর মতো সকল হইতে বিচ্ছিন্ন একটা কাল্পনিক ভাবের মধ্যে থাকিয়া মাটি হইতে উপড়াইয়া-ফেলা গাছের মতো শুকাইয়া মরি। সেই শুষ্কতার সাধনাকেই আবার আমরা অদ্বৈতের সাধনা, মুক্তির সাধনা বলিয়া গর্ব করিয়া থাকি। যেন অদ্বৈত একটা মনের ভাব মাত্র, তাহার বাস্তবিক সত্তা কিছুই নাই।

 জগতে যাহা-কিছু আমরা পাই তাহাকে যে হারাইতেই হইবে, সমস্তই যে একে একে মৃত্যুর হাতে ছাড়িয়া দিতে হয়, ইহার বেদনা যে কী সুতীব্র তাহা “যেতে নাহি দিব”, “প্রতীক্ষা” প্রভৃতি কবিতা পড়িলেই বুঝা যাইবে। তথাপি আমাদের দেশের প্রকৃতি অনুসরণ করিয়া কবি ইহাকে মায়ামোহ বলিয়া উড়াইয়া দিয়া বৈরাগ্যের মহিমা কীর্তন করিতে পারিলেন না। পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য ক্ষণিক বলিয়াই, স্নেহপ্রেমের সমস্ত সম্বন্ধ অনিত্য বলিয়াই কবির কাছে তাহা পরম রহস্যময়। ক্ষণিক না হইলে এমন আশ্চর্য হইতেই পারিত না। এই যে ক্ষণকালের জন্য চাহিয়া দেখা এ দেখার মধ্যে কি অপরিসীম করুণা! এ দেখায় অন্ত কোথায়? এ দেখা তাই বলে, ‘জনম অবধি হম রূপ নেহারনু নয়ন না তিরপিত ভেল।’

 এই ক্ষণিক মেলামেশার মধ্যে যে একটি অপরূপ ব্যাকুলতা উদ্‌বেল হইয়া উঠে, লক্ষযুগ ধরিয়া হইলে এমনটি কি কখনো হইত? এ মেলামেশাও তাই “নিমেষে শতেক যুগ করি মানে।”

একদিন এই দেখা হয়ে যাবে শেষ,
পড়িবে নয়ন ’পরে অন্তিম নিমেষ।
পরদিনে এইমত পোহাইবে রাত,
জাগ্রত জগৎ-’পরে জাগিবে প্রভাত।···
সে কথা স্মরণ করি নিখিলের পানে
আমি আজি চেয়ে আছি উৎসুক নয়ানে।
যাহা-কিছু হেরি চোখে কিছু তুচ্ছ নয়;
সকলি দুর্লভ ব’লে আজি মনে হয় ।
দুর্লভ এ ধরণীর লেশতম স্থান,
দুর্লভ এ জগতের ব্যর্থতম প্রাণ ।

একটা চিঠির মধ্যে আছে:

 ‘প্রতিদিনের অভ্যাসের জড়ত্ব হঠাৎ একমুহূর্তের জন্য এক-এক সময়ে কেন যে একটুখানি ছিঁড়ে যায় জানি নে, তখন যেন সদ্যোজাত হৃদয় দিয়ে আপনাকে, সম্মুখবর্তী দৃশ্যকে এবং বর্তমান ঘটনাকে অনন্তকালের চিত্রপটের উপর প্রতিফলিত দেখতে পাই।··· আমি অনেক সময়েই একরকম ক’রে জীবনটাকে এবং পৃথিবীটাকে দেখি যাতে ক’রে মনে অপরিসীম বিস্ময়ের উদ্রেক হয়, সে আমি হয়তো আর কাউকে ঠিক বোঝাতে পারব না।’

 আর একটা চিঠির খানিকটা অংশ এখানে না দিয়া থাকিতে পারিলাম না:

 ‘আমার বিশ্বাস, আমাদের প্রীতি মাত্রই রহস্যময়ের পূজা; কেবল সেটা আমরা অচেতনভাবে করি। ভালোবাসা মাত্রই আমাদের ভিতর দিয়ে বিশ্বের অন্তরতম একটি শক্তির সজাগ আবির্ভাব, যে নিত্য আনন্দ নিখিল জগতের মূলে সেই আনন্দের ক্ষণিক উপলব্ধি।’

 এইবার সোনার তরী ও চিত্রার “ জীবনদেবতা” কবিতাগুলির সম্বন্ধে কথা বলিবার সময় আসিয়াছে।

 আমি সেই কথা বলিয়াই আরম্ভ করিয়াছি। আমি দেখাইবার চেষ্টা পাইয়াছি যে, যখন প্রবল অনুভূতি এবং কল্পনা কোনো একটি খণ্ডের মধ্যে আপনাকে উপলব্ধি করিতে চায়— যেমন বাহ্য সৌন্দর্য বা মানবপ্রীতিতে ধরা যাক— তখন কিছুকালের মতো সেই খণ্ডতা তাহার কাছে সব হইয়া উঠে, অনুভূতি এবং কল্পনা তাহাকে আপনার ভাবের দ্বারা সম্পূর্ণ করিয়া দেখিবার চেষ্টা করে। ইংরেজি অনেক প্রেমের কাব্যে আমরা ইহার পরিচয় পাইয়াছি। কিন্তু কবির মূলসুর কিনা সর্বানুভূতি, সেইজন্য খণ্ড হৃদয়াবেগ আপনার ইন্ধনকে আপনি নিঃশেষিত করিয়া ফেলিয়া খণ্ডতার বাধাকে বিদীর্ণ করিয়া বাহির হইতে বাধ্য হয়। কড়ি ও কোমলে ও মানসীতে আমরা সেই ছবিই দেখিয়া আসিয়াছি।

 অথচ অংশের মধ্যেই সম্পূর্ণতার তত্ত্ব নিহিত হইয়া আছে। শারীরিক সৌন্দর্য সেইজন্য অনির্বচনীয়; মানবপ্রেম অনির্বচনীয়, কবি কোথাও বিস্ময়ের অন্ত পান না, তাঁহার কাছে সমস্তই ‘রহস্যময়ের পূজা।’

 সমস্ত অংশকে খণ্ডকে অসম্পূর্ণকে যখন সেই পরিপূর্ণ সমগ্রের মধ্যে অখণ্ড করিয়া উপলব্ধি করা যায়, তখন বেশ বুঝিতে পারা যায় যে, সব বিচিত্রতা এক জায়গায় গিয়া মিলিয়াছে, সব ভাঙাচোরা এক জায়গায় অক্ষত সুন্দর হইয়া আছে। আমাদের জীবনের মধ্যে এই দ্বিতীয় জীবন এই অন্তরতর জীবনকে কি কোনো শুভ মুহূর্তে আমরা অনুভব করি নাই? নহিলে এত বার বার আঘাত কিসের জন্য? যেখানেই বিচ্ছিন্নতা সেখানেই ক্রন্দন। সেই কান্না যে কবির সমস্ত জীবন ভরিয়া। সেই পরিপূর্ণ সব-মেলানো আনন্দময় গভীরতর জীবন সৃষ্টির মধ্যেই বিষাদের অশ্রুলীলাও এমন সুমধুর হইয়া ফুটিয়াছে। সেই পূর্ণ জীবন যাঁহার অখণ্ড আনন্দ অনুভূতির মধ্যে রহিয়াছে তিনিই জীবনদেবতা।

 আমি জানি এ জিনিসটা অনেকের কাছে মিস্টিসিজম্ বা হেঁয়ালি। কিন্তু খণ্ডের মধ্যে সম্পূর্ণতার বোধটাই একটা হেঁয়ালি, যদিচ হিগেলীয় দর্শনশাস্ত্র এবং আমাদের বৈষ্ণব ভেদাভেদ দর্শনশাস্ত্র সেই তত্ত্বটিকেই প্রমাণ করিবার জন্য বিধিমতে প্রয়াস পাইয়াছে। যাহারা বিশুদ্ধ অদ্বৈতবাদী তাহারা একমাত্র শুদ্ধবুদ্ধমুক্ত অখণ্ড সত্য আছেন এই কথা স্বীকার করিয়া থাকে এবং আমরা যে নানা নাম ও রূপের মধ্যে সকল জিনিসকে বিচিত্র করিয়া দেখি তাহাকে মায়া বলে, ভ্রম বলে। অথচ এটা কেবলমাত্র একটা তত্ত্বকথা— তাহার কারণ সকলকে বাদ দেওয়া যে অদ্বৈত, সেও একটা নাম মাত্র, তাহার সঙ্গে সমস্ত জীবনের কোনো যোগ হওয়া কোনোমতেই সম্ভাবনীয় নহে। আমি যাহা ভাবি তাহা ভুল, আমি যাহা দেখি তাহা ভুল, সমস্তই যদি ভুল হয় তবে অদ্বৈত এ কথাটা বল আর নাই বল তাহাতে কিছুই আসে যায় না। যে তত্ত্ব এখন সমস্ত দার্শনিকসমাজ মানিয়া লইতেছে তাহা এই যে— অদ্বৈত সকলকে বাদ দিয়া নাই, সকল বৈচিত্র্যকে লইয়া সকল বৈচিত্র্যের অন্তরতম হইয়া আছে। আমাদের জানা ক্রমেই বড় ও ব্যাপক হইতেছে, সে সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে এক নিয়মকে অনুসন্ধান করিয়া ফিরিতেছে। অদ্বৈতের এইখানেই প্রকাশ। আমাদের অনুভূতি সাহিত্য শিল্পে ক্রমশই বিশ্ববোধে পূর্ণ হইয়া উঠিতেছে— অদ্বৈতের সঙ্গে তাহার এই তো যোগ। আমাদের সমস্ত চেষ্টা চিন্তা কল্পনা ক্রমাগত খণ্ডতাকে পরিহার করিয়া ভূমার সঙ্গে আপনার যোগকে অনুভব করিবার জন্য কত কী করিয়া মরিতেছে— জগৎ জুড়িয়া আমরা তাহার নিদর্শন দেখিতেছি। সুতরাং আমরা যদিও অদ্বৈত নহি, অদ্বৈত হইতে ভিন্ন, তথাপি অদ্বৈত আমাদেরই ভিতর দিয়া প্রকাশ পাইতেছেন— ভিন্ন হইয়াও তাই আমরা অদ্বৈতের সঙ্গে এক এবং অভিন্ন। এই ভেদাভেদ তত্ত্বটি সর্বত্র এখন প্রাধান্য লাভ করিতেছে।

 বস্তুত আমাদের চেতনার প্রবাহ জাগরণ-সুষুপ্তির জোয়ার-ভাঁটার মধ্য দিয়া আমাদিগকে গানের মতো একবার অহংবোধের খণ্ড চেতনার বিচিত্র তানের মধ্যে ছাড়িয়া দিতেছে এবং আর-একবার সমস্ত বিচিত্রতার সমাপ্তি বিশ্বচৈতন্যের অখণ্ড সমের মধ্যে বিলীন করিতেছে— এই ভেদাভেদের ছন্দেই মুহূর্তে বিশ্বসংগীত রচিত হইয়া উঠিতেছে। সাধনার দ্বারা আমরা একই কালে এই বিচিত্রকে এবং এককে, তানকে এবং সমকে একত্রে মিলাইয়া বিশ্ববোধে এবং আত্মবোধে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিতে পারি। বুঝিতে পারি মুহূর্তে মুহূর্তে বিশ্বের বিচিত্র রূপ, প্রলয়ের মূর্ছনার তানে তানে অসংখ্য আকারে বিকীর্ণ হইতেছে, আমাদের চেতনা সেই অসংখ্যের অন্তহীন সূত্রগুলি গণনা করিয়া শেষ পাইতেছে না এবং তৎসঙ্গেই মুহূর্তে মুহূর্তে সৃজনের পরিপূর্ণ সংগীত অখণ্ডতার মধ্যে সমস্ত বিলীন করিয়া দিয়া অন্তরের আনন্দকে সর্বত্র প্রত্যক্ষ জাজ্বল্যমান করিয়া তুলিতেছে।

 বিশ্বজীবনে ভেদাভেদের লীলারূপ দর্শনশাস্ত্র দেখিতে পাইতেছেন, ব্যক্তিগত জীবনে কবি সেই একই জিনিস উপলব্ধি করিতেছেন। এ কি রকম? না,—সৌরজগতে যে আকর্ষণ-বিকর্ষণের শক্তি বিচিত্রভাবে কাজ করিতেছে, সেই শক্তির অণুপরমাণুর মধ্যেও ক্রিয়াশীল— বিশ্বের সর্বত্র এই একই নিয়মকে দেখিতে পাওয়া যেমন, ব্যক্তিগত জীবনের বিশ্বজীবনের লীলাকে প্রত্যক্ষ করা ঠিক তেমনি। বিশ্বে এমন কিছুই নাই যাহা আমরা এই জীবনের অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়া অনুভব করিতে না পারি।

 সুতরাং এই যে আমাদের ক্ষণিক জীবন এবং চিরন্তন জীবন উপনিষদে কথিত একই বৃক্ষে নিষণ্ণ দুই পক্ষীর মতো পাশাপাশি লাগিয়া আছে বলা গেল, ইহাকে হেঁয়ালি মনে করিবার কোনো তাৎপর্যই আমি খুঁজিয়া পাই না। অনন্তকে সকল সীমার মধ্যে, নিজের জীবনে এবং বিশ্বে, পূর্ণরূপে অনুভব করা আমাদের দেশে ঘরের কথা। আমরা অনায়াসেই বুঝিতে পারি যে, আমাদের মধ্যে যে-একজন সুখদুঃখ ভোগ করে মাত্র সে একজন, সুখদুঃখের ভিতর হইতে সারাংশ গ্রহণ করিয়া জীবনকে ক্রমাগত বড়র দিকে অনন্তের দিকে যে আর-একজন নিয়তই সৃষ্টি করিয়া তোলে তাহা হইতে সম্পূর্ণরূপে স্বতন্ত্র। একজন বিচ্ছিন্ন এক-একটি সুর, আর-একজন অখণ্ড রাগিণী। এই দুইই এক— ইহাদের মধ্যে সত্যকার কোনো বিচ্ছেদ নাই। রাগিণীর মধ্যে যেমন সুর অবিচ্ছেদে রহিয়াছে, চিরন্তন জীবনের মধ্যে ক্ষণিক জীবন তেমনিই রহিয়াছে।

 সেইজন্যই জীবনে বাল্যের সেই বিশ্বজগতের পরমরহস্যময় অনুভূতি সেই শরতের প্রত্যুষে সূর্যোদয় হইতে-না-হইতে বাড়ির বাগানে গিয়া উপস্থিত হওয়া, কি যেন একটা আশ্চর্য নূতনত্ব উদ্ঘাটিত হইবে ভাবিয়া আনন্দ, সেই ঘাসের উপর ফোঁটা ফোঁটা শিশির এবং বাগানের ভিজে গন্ধ এবং তাহারই উপরে অজস্রবিস্তীর্ণ কাঁচা সোনালি শরতের রৌদ্রের অনির্বচনীয় মোহ— এ অনুভূতির সুর সেই সাক্ষিজীবনের সেই চিরন্তনজীবনের অখণ্ড রাগিণীর মধ্যে রহিয়া গিয়াছে। বাল্য তাঁহারই মধ্যে পূর্ণ হইয়া আছে।

অয়ি মোর জীবনের প্রথম প্রেয়সী,
মোর ভাগ্যগগনের সৌন্দর্যের শশী,
মনে আছে, কবে কোন্ ফুল্লযুথীবনে,
বহুবাল্যকালে, দেখা হত দুই জনে
আধো-চেনাশোনা? তুমি এই পৃথিবীর
প্রতিবেশিনীর মেয়ে, ধরার অস্থির
এক বালকের সাথে কি খেলা খেলাতে
সখী, আসিতে হাসিয়া তরুণ প্রভাতে
নবীন বালিকামূর্তি, শুভ্র বস্ত্র পরি’
উষার কিরণধারে সদ্য স্নান করি’
বিকচ কুসুমসম ফুল্ল মুখখানি
নিদ্রাভঙ্গে দেখা দিতে, নিয়ে যেতে টানি

উপবনে কুড়াতে শেফালি। বারে বারে
শৈশবকর্তব্য হ’তে ভুলায়ে আমারে,
ফেলে দিয়ে পুঁথিপত্র, কেড়ে নিয়ে খড়ি,
দেখায়ে গোপন পথ দিতে মুক্ত করি
পাঠশালা-কারা হতে—

 বাল্যে এই যিনি অনন্ত বাল্য, যৌবনের নানা প্রেম-সম্বন্ধের মধ্যে গভীরতর বাসনা ও বেদনার মধ্যেও তিনি কি ধরা দেন নাই? ঐ যে পত্রাংশ পূর্বেই তুলিয়াছি “আমাদের সব স্নেহ সব ভালোবাসাই রহস্যময়ের পূজা”, সকল মানুষের ভিতর দিয়া ক্ষণে ক্ষণে কি সেই প্রেমাস্পদ রহস্যময়ের আবির্ভাব হয় নাই? সেই সাক্ষিজীবনের মধ্যেই যৌবনের সমস্ত আবেগ পূর্ণ হইয়া আছে।

তার পরে একদিন—কি জানি সে কবে···
চমকিয়া হেরিলাম— খেলাক্ষেত্র হতে
কখন অন্তরলক্ষ্মী এসেছ অন্তরে
আপনার অন্তঃপুরে গৌরবের ভরে
বসে আছ মহিষীর মতো।···
ছিলে খেলার সঙ্গিনী,
এখন হয়েছ মোর মর্মের গেহিনী,
জীবনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। কোথা সেই
অমুলক হাসি-অশ্রু! সে চাঞ্চল্য নেই,
সে বাহুল্য কথা। স্নিগ্ধ দৃষ্টি সুগম্ভীর
স্বচ্ছনীলাম্বরসম; হাসিখানি স্থির
অশ্রুশিশিরেতে ধৌত; পরিপূর্ণ দেহ
মঞ্জরিত বল্লরীর মতো।

 বাল্যের যৌবনের এই প্রবল সৌন্দর্যের ও প্রেমের অনুভব যদি কেবল বিচ্ছিন্ন হৃদয়াবেগ মাত্র হইত, যদি এই সাক্ষিজীবনের মধ্যে ইহাদের কোনো অখণ্ডতা না থাকিত তবে সৌন্দর্যবোধের কোনো তাৎপর্যই থাকিত না। তবে জীবনের মধ্যে এ সকল সুখদুঃখের খেলার কোনো অর্থ ই ছিল না। সেই সাক্ষিজীবন সেই এক জীবন সেই নিত্য-পরিপূর্ণ জীবন আমাদেরই মধ্যে আছেন এবং আমাদেরই ভিতরে তাঁহার একটি অপরূপ অপূর্ব কাব্যকে রচনা করিতেছেন, এই কথা জানার জন্যই বাহিরেও ক্ষণে ক্ষণে উপলব্ধ সমস্ত বিচিত্র সৌন্দর্যমালা সেই একের মধ্যে গ্রথিত হইয়া একটি মূর্তি ধরিয়া উঠিতেছে:

এখন ভাসিছ তুমি
অনন্তের মাঝে; স্বর্গ হতে মর্তভূমি
করিছ বিহার; সন্ধ্যার কনকবর্ণে
রাঙিছ অঞ্চল; উষার গলিতস্বর্ণে
গড়িছ মেখলা; পূর্ণ তটিনীর জলে
করিছ বিস্তার তলতল-ছলছলে
ললিত যৌবনখানি···
সেই তুমি
মূর্তিতে দিবে কি ধরা? এই মর্তভূমি
পরশ করিবে রাঙা চরণের তলে?
অন্তরে বাহিরে বিশ্বে শূন্যে জলে স্থলে
সব ঠাই হ’তে সর্বময়ী আপনারে
করিয়া হরণ— ধরণীর এক ধারে
ধরিবে কি একখানি মধুর মুরতি?

 মানসসুন্দরী বা মানসমূর্তির অর্থ বুঝিতে পারা যায়, কিন্তু আলোচ্য কবিতাটিতে কেবল মানসমূর্তি নহে বাস্তবমূর্তিতেও সকল অনুভূতি এবং সকল সৌন্দর্যের সমঞ্জসীভূত এবং সারভূত জীবনদেবতাকে জড় চক্ষে দেখিবার আকাঙ্ক্ষা যেন প্রকাশ পাইয়াছে। বৈষ্ণবেরা যে নিখিলরসামৃতমূর্তি বলেন, সকল সৌন্দর্যের মূর্তির ভিতরে যে অনন্ত প্রেমস্বরূপ ভগবান আপনাকে প্রত্যক্ষ চক্ষে দেখা দেন বলেন, জানি না সেইরকম ভাবে এই সমস্ত বাহিরের বিচিত্র সৌন্দর্যকে অখণ্ডভাবে দেখিবার আকাঙ্ক্ষা ইহাতে ব্যক্ত হইয়াছে, না, বাস্তবিকই একটি বিশেষ নারীমূর্তির মধ্যে সমগ্রকে পাইবার ইচ্ছা প্রকাশিত হইয়াছে?

 পরবর্তী কোনো কবিতায় যে কবি বলিয়াছেন:

ভাব পেতে চায় রূপের মাঝারে অঙ্গ,
রূপ পেতে চায় ভাবের মাঝারে ছাড়া।
অসীম সে চাহে সীমার নিবিড় সঙ্গ,
সীমা চায় হতে অসীমের মাঝে হারা।

তাহার ভাব এ নয় যে, অনন্তভাব আপনাকে একটিমাত্র রূপের মধ্যে আবদ্ধ করিয়া দেখিতে চান— প্রত্যেক খণ্ডরূপের মধ্যেই তাঁহার ভাতি, তাঁহার পরিপূর্ণ প্রকাশ।

 আর বাস্তবিকই “জীবনদেবতা” শীর্ষক সকল কবিতার মধ্যে আমাদেরই জীবনের মধ্যে যে আর-একটি জীবনের কথা বলা হইয়াছে তাঁহাকে কোনো বিশেষ একটি মূর্তিতে পাইবার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পায় নাই । কারণ জীবনদেবতার স্বরূপই হইতেছে বিশ্ববোধ। তিনি কি না জীবনের সমস্ত ভালোমন্দ সমস্ত ভাঙাগড়ার ভিতর দিয়া জীবনকে একটি অখণ্ড তাৎপর্যের মধ্যে উদ্ভিন্ন করিয়া তুলিতেছেন এবং তিনিই আবার কবির কাব্যে উপস্থিতকে চিরন্তনের সঙ্গে, ব্যক্তিগত জিনিসকে বিশ্বের সঙ্গে, খণ্ডকে সম্পূর্ণের সঙ্গে মিলিত করিয়া কাব্যকেও তাহার ভাবী পরিণামের দিকে অগ্রসর করিয়া দিতেছেন।

 “অন্তর্যামী” কবিতাটিতে এই দুই দিক দিয়া জীবনের এবং কাব্যে জীবনদেবতার স্বজনলীলার আশ্চর্য রহস্য বর্ণিত হইয়াছে।

একি কৌতুক নিত্যনূতন
ওগো কৌতুকময়ী!
আমি যাহা কিছু চাহি বলিবারে
বলিতে দিতেছ কই?
অন্তরমাঝে বসি অহরহ
মুখ হতে তুমি ভাষা কেড়ে লহ,
মোর কথা লয়ে তুমি কথা কহ
মিশায়ে আপন সুরে।···
যে কথা ভাবি নি বলি সেই কথা,
যে ব্যথা বুঝি না জাগে সেই ব্যথা,
জানি না এনেছি কাহার বারতা
কারে শুনাবার তরে!

ইহার অর্থ এই যে, যে ব্যক্তি কাব্য রচনা করে সে যেটুকু সীমার মধ্যে আপনার বলিবার কথাকে কল্পনা করিয়া রাখিয়াছে, এই কৌতুকময়ী জীবনদেবতা সেই সীমাবদ্ধ ছোট কথারই মধ্যে আপনার নিত্য বাণীর সুর যখন মিশাইয়া দেন তখন কবি অবাক হইয়া যান। এ বিস্ময় কেবলই কাব্যে নয়, জীবনেও:

একদা প্রথম প্রভাতবেলায়
সে পথে বাহির হইনু হেলায়,
মনে ছিল দিন কাজে ও খেলায়
কাটায়ে ফিরিব রাতে।

পদে পদে তুমি ভুলাইলে দিক,
কোথা যাব আজি নাহি পাই ঠিক,
ক্লান্তহৃদয় ভ্রান্ত পথিক
এসেছি নূতন দেশে।

জীবনকেও তো দেখা গিয়াছে এই জীবনদেবতাই ক্রমাগত ছোট দিক্‌ হইতে আরামের দিক্ হইতে পরম দুঃখের মধ্যে উপনীত করিতেছেন— সে যখনই কোনো একটি বিশেষ দিকে একটি প্রবৃত্তির মধ্যে বাঁধা পড়িতেছে তখনই বেদনার দ্বারা সেই সীমা বিদীর্ণ করিয়া তিনি তাহাকে আবার সমস্ত বিশ্বজগতের সঙ্গে যুক্ত করিতেছেন— কড়ি ও কোমল, মানসী প্রভৃতি সকল পূর্ব পূর্ব কাব্যেই তাহা আমরা দেখিয়া আসিয়াছি।

 এই জীবনদেবতাকে আর-একটি হৃদয়ের গভীরতম প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিবার আছে— আমাতে কি তুমি তৃপ্ত? অর্থাৎ যদিচ বলা হইল যে ইনি জীবনের বিচিত্র মালমসলা জড়ো করিয়া জীবনের ভিতর হইতে একটি পরিপূর্ণতাকে একটি বিশ্বব্যাপী সার্থকতাকে কাব্যের মধ্যে প্রকাশমান করিতেছেন তথাপি তাঁহার সঙ্গে আরো একটু নিবিড় যোগ আছে কি না। উপনিষদে কথিত দুই পাখির মতন যাহার জীবন লইয়া এই রচনাকার্য চলিতেছে তাহার অনুভূতির মধ্যে সার্থকতার কি কোনো আনন্দ বাজিতেছে না? তাই তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিতে হয়— আমার মধ্যে কি তুমি তৃপ্ত? আমি যে নানা সুখদুঃখের আঘাতে ক্রমাগত আপনাকে গলাইয়া আমার শ্রেষ্ঠ জিনিসগুলি তোমাকে উৎসর্গ করিয়া দিয়াছি তাহা কি তুমি লইয়াছ— আমার সমস্ত আনন্দোচ্ছ্বাস আমার সমস্ত দুঃখবেদনা কি তুমি গ্রহণ করিয়াছ? আমি যেখানে “অকৃত কার্য, অকথিত বাণী, অগীত গান, বিফল বাসনারাশি” লইয়া আসিয়াছি আমার সেই ব্যর্থতাও কি তোমার মধ্যে সার্থকতা লাভ করিয়াছে?

ওহে অন্তরতম,
মিটেছে কি তব সকল তিয়াষ
আসি অন্তরে মম?
দুঃখসুখের লক্ষ ধারায়
পাত্র ভরিয়া দিয়েছি তোমায়,
নিঠুর পীড়নে নিঙাড়ি বক্ষ
দলিত দ্রাক্ষাসম।···
লেগেছে কি ভালো হে জীবননাথ,
আমার রজনী, আমার প্রভাত—
আমার নর্ম, আমার কর্ম
তোমার বিজন বাসে?···
করেছ কি ক্ষমা যতেক আমার
স্খলন পতন ত্রুটি?
পূজাহীন দিন, সেবাহীন রাত,
কত বারবার ফিরে গেছে নাথ—
অর্ঘ্যকুসুম ঝ’রে প’ড়ে গেছে
বিজন বিপিনে ফুটি।

 এক-একবার আশঙ্কা হয় যে, এ জীবনে যাহা-কিছু ছিল সমস্তই বুঝি শেষ হইয়াছে, কিন্তু জীবনদেবতার এই লীলার কি এই জীবনেই আরম্ভ? কত জন্মজন্মান্তর যুগযুগান্তর ধরিয়া এই খেলা চলিয়াছে, জীবনকে ক্রমাগত বিশ্বচরাচরের সঙ্গে যুক্ত করিয়া তিনি তাহার অর্থকে বিপুল বিপুলতর করিতেছেন।

আমার মিলন লাগি তুমি
আসছ কবে থেকে।
তোমার চন্দ্র সূর্য তোমায়
রাখবে কোথায় ঢেকে।

 এই জীবনের ধারাটিকে সকল হইতে স্বতন্ত্র করিয়া অনাদিকাল হইতে এই জীবনদেবতা বহন করিয়া আনিতেছেন। অনন্ত সৃষ্টির মাঝখানে এই একটি বিশেষ ধারা অক্ষুণ্ণভাবে প্রবাহিত। জীবনে জীবনে এই বিশেষের সঙ্গে এই জীবনদেবতার নূতন নূতন লীলা।

জীবনকুঞ্জে অভিসারনিশা
আজি কি হয়েছে ভোর?
ভেঙে দাও তবে আজিকার সভা,
আনো নব রূপ, আনো নব শোভা,
নূতন করিয়া লহো আরবার
চিরপুরাতন মোরে।
নূতন বিবাহে বাঁধিবে আমায়
নবীনজীবনডোরে।

আমিত্বের এ এক নূতন তত্ত্ব রবীন্দ্রনাথের মধ্যে ফুটিয়াছে। স্বর্গীয় মোহিতবাবু তাঁহার সম্পাদিত ‘কাব্যগ্রন্থাবলী’র ভূমিকায় লিথিয়াছিলেন যে, জীবনদেবতাকে বিশ্বদেবতা কল্পনা করিলে ভুল হইবে। সে এই কারণেই। এই যে আমি আমাকে বলি ‘আমি’— এই আমির ক্ষেত্রে এই বিশেষের মধ্যেই জীবনদেবতার বিশেষ লীলা, এই ব্যক্তিত্বটিকেই তিনি জীবনে জীবনে ক্রমাগত সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল পদার্থের সঙ্গে সংযুক্ত করিয়া ইহাকে বৃহৎ বৃহত্তর করিয়া সৃষ্টি করিয়া চলিয়াছেন। সুতরাং বিশ্ব অভিব্যক্তির ধারা যেমন বিজ্ঞানে আমরা অনুসরণ করিয়া দেখিয়াছি, দেখি তেমনি এই আমি-অভিব্যক্তির একটি ধারাও সেই সঙ্গে সঙ্গে চলিয়া আসিয়াছে। এই ‘আমি’ যে বলে যে আমার সঙ্গে সমস্ত বিশ্বজগতের একেবারে নাড়ীর যোগ, আমরা একই ছন্দে বসানো, তাহার কারণ এই, যে জীব অভিব্যক্তির পর্যায়ে এই ‘আমি’ কত কি বস্তুর ভিতর দিয়া যাত্রা করিয়া আসিয়াছে— তাহার মধ্যে সেই সকল বিচিত্র জীবনের বিস্মৃত স্মৃতি নিশ্চয়ই কোনো-না-কোনো আকারে রহিয়াছে। যে জীবকোষ উদ্ভিদে সেই জীবকোষই যখন আমাদের শরীরে বুদ্ধিকে সঞ্চার করিতেছে, তখন এমন মনে করা কেন চলিবে না যে, আমারই জীবকোষরাজি বহু যুগের বহু বিচিত্র জীব-জীবনের বিস্মৃত স্মৃতিকে বহন করিতেছে। তাই তো আমি সমস্ত বিশ্বপ্রাণের আনন্দকে অনুভব করিতে পারি— তরুলতার পশুপক্ষীর জীবন-চেষ্টার আনন্দ আমায় স্পর্শ করে— ইহা তো কল্পনামাত্র নয়— আমাদের দেশের ঋষিকবিগণ ইহা উপলব্ধি করিয়াছেন, বিদেশেরও ওয়ার্ডস্বার্থ প্রভৃতি কবিগণ ইহা অনুভব করিয়াছেন— ইহা যদি কেবল একটা উড়ো কল্পনামাত্র হইত তবে অনুভূতি এমন ব্যাপ্ত দেশকালে কখনোই মিলিত না। এ কল্পনা নিশ্চয়ই কোনো অনাবিষ্কৃত সত্যকে আশ্রয় করিয়া আছে। এবং নিশ্চয়ই আমি-বোধ অথবা ব্যক্তিত্ব-বোধের মূল একেবারে বিশ্ব অভিব্যক্তির প্রারম্ভকালে গিয়া পৌঁছে, যেজন্য এই আমি-বোধের মধ্যে বিশ্ববোধ এমন সহজে এমন আনন্দে এমন প্রবলভাবে প্রকাশ পায়।

 প্রসঙ্গতঃ এখানে বলিয়া রাখি যে, ইউরোপে যাঁহারা মনস্তত্ত্ব ও জীবতত্ত্বকে একত্র করিয়া আলোচনা করিতেছেন এমন একদল পণ্ডিত বলেন যে আমার ব্যক্তিত্ব (personality) বিচিত্র ব্যক্তিত্বের সমষ্টি—এবং খুব সম্ভব আমাদের প্রত্যেক জীবকোষ (cell) বিচিত্র ভূতপূর্ব জীবনের বিস্মৃত স্মৃতিকে বহন করিতেছে বলিয়াই আমাদের ব্যক্তিত্ব এত জটিল হইয়াছে। আমরা এক মানুষ নহি— আমাদের মধ্যে নানা জীব-ভাব কাজ করিতেছে। অথচ এ সকল বৈচিত্র্য আমাদের এক ব্যক্তিত্বে মিলিতও হইতেছে আশ্চর্যরূপে। এখানে এ আলোচনা সম্ভবপর নহে, কিন্তু আমার এ ব্যাখ্যার পোষকতাস্বরূপ আমি এ কথাটা উত্থাপন করিলাম মাত্র।

 অতএব সমস্ত জগতের তরুলতা- পশুপক্ষীর সঙ্গে বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে কবির যে নাড়ীর যোগের কথা আমরা তাঁহার নানা কবিতায় পাইয়াছি তাহার ভিতর কবির আমিত্বের যে তত্ত্বটি আছে তাহা এই— এই আমিকে ‘আমি’র স্বামী জীবনদেবতা সমস্ত বিশ্ব অভিব্যক্তির ভিতর দিয়া সেই প্রথম বাষ্প নীহারিকা, পৃথিবীর আদিম তরুলতা হইতে আরম্ভ করিয়া সরীসৃপ পক্ষী পশু প্রভৃতি বিচিত্র প্রাণীপর্যায়ের ভিতর দিয়া, এই বর্তমান জীবনের মধ্যে উদ্ভিন্ন করিয়াছেন। জীবনদেবতা কেবল যে এই জীবনের ‘আমি’র সমস্ত সুখদুঃখ সৌন্দর্যবোধ ও প্রেমকে বিশ্বব্যাপী পরিপূর্ণতার দিকে এক করিয়া তুলিতেছেন তাহা নহে, তিনিই বিশ্ব-অভিব্যক্তির নানা অবস্থার ভিতর দিয়া প্রবাহিত এই ‘আমি’রই একটি অখণ্ড সূত্রকে অনাদিকাল হইতে ধারণ করিয়া আছেন:

আজ মনে হয় সকলের মাঝে
তোমারেই ভালোবেসেছি,
জনতা বাহিয়া চিরদিন শুধু
তুমি আর আমি এসেছি।

 “বসুন্ধরা”, “প্রবাসী”, “সমুদ্রের প্রতি” প্রভৃতি কবিতায় এই জলস্থল-আকাশের সঙ্গে একাত্মকতার ভাবটিই প্রকাশ পাইয়াছে।

তৃণে-পুলকিত যে মাটির ধরা
লুটায় আমার সামনে,
সে আমায় ডাকে এমন করিয়া
কেন যে কব তা কেমনে ।
মনে হয় যেন সে ধূলির তলে
যুগে যুগে আমি ছিনু তৃণে জলে,
সে দুয়ার খুলি কবে কোন্ ছলে
বাহির হয়েছি ভ্রমণে।···
এ সাতমহলা ভবনে আমার
চিরজনমের ভিটাতে
স্থলে জলে আমি হাজার বাঁধনে
বাঁধা যে গিঠাতে গিঠাতে ।

এই জায়গায় একটা চিঠির কিয়দংশ না দিয়া থাকিতে পারিলাম না।

 ‘আমি বেশ মনে করতে পারি, বহুযুগ পূর্বে যখন তরুণী পৃথিবী সমুদ্রস্থান থেকে সবে মাথা তুলে উঠে তখনকার নবীন সূর্যকে বন্দনা করছেন, তখন আমি এই পৃথিবীর নূতন মাটিতে কোথা থেকে এক প্রথম জীবনোচ্ছ্বাসে গাছ হয়ে পল্লবিত হয়ে উঠেছিলুম। তখন পৃথিবীতে জীবজন্তু কিছুই ছিল না, বৃহৎ সমুদ্র দিনরাত্রি দুলছে, এবং অবোধ মাতার মতো আপনার নবজাত ক্ষুদ্র ভূমিকে মাঝে মাঝে উন্মত্ত আলিঙ্গনে একেবারে আবৃত করে ফেলছে। তখন আমি এই পৃথিবীতে আমার সমস্ত সর্বাঙ্গ দিয়ে প্রথম সূর্যালোক পান করেছিলুম, নবশিশুর মতো একটা অন্ধ জীবনের পুলকে নীলাম্বরতলে আন্দোলিত হয়ে উঠেছিলুম, এই আমার মাটির মাতাকে আমার সমস্ত শিকড়গুলি দিয়ে জড়িয়ে এর স্তন্যরস পান করেছিলুম। একটা মূঢ় আনন্দে আমার ফুল ফুটত এবং নবপল্লব উদ্গত হত।...তার পরেও নব নব যুগে এই পৃথিবীর মাটিতে আমি জন্মেছি। আমরা দুজনে একলা মুখোমুখি ক’রে বসলেই আমাদের সেই বহুকালের পরিচয় যেন অল্পে অল্পে মনে পড়ে।’

 আমার মনে হয় ‘সোনার তরী’তে এবং বিশেষভাবে ‘চিত্রা’তে ও ‘চৈতালি’তে রবীন্দ্রনাথের কাব্যজীবন খুব একটি সম্পূর্ণতা প্রাপ্ত হইয়াছে ।

 জীবনদেবতার কথা বলিলাম— প্রেম, সৌন্দর্যবোধ, সমস্তই এই জীবনদেবতার বৃহৎভাবের দ্বারা কত বড় বিশ্বব্যাপকতা লাভ করিয়াছে তাহা তো দেখিতেই পাওয়া যাইতেছে। “স্বর্গ হইতে বিদায়” এর কথা পূর্বেই বলিয়াছি । এখন আর একটিমাত্র কবিতার কথা বলিব। সে কবিতাটি “উর্বশী”।

 সৌন্দর্যবোধের মধ্যে ভোগপ্রবৃত্তির মোহাবেশ মিশিয়া যে বেদনাকে জাগাইয়াছিল তাহা আমরা ‘কড়ি ও কোমলে’ ও ‘চিত্রাঙ্গদা’য় দেখিয়া আসিয়াছি। “উর্বশী” এবং “বিজয়িনী” যে দুইটি কবিতা চিত্রায় আছে তাহার মধ্যে সৌন্দর্যকে সমস্ত মানবসম্বন্ধের বিকার হইতে, সমস্ত প্রয়োজনের সংকীর্ণ সীমা হইতে দূরে তাহার বিশুদ্ধতায় তাহার অখণ্ডতায় উপলব্ধি করিবার তত্ত্ব আছে।

 আপনারা মনে রাখিবেন যে, চিত্রার এ-সকল কবিতাই “জীবনদেবতা”র অখণ্ডভাবের অন্তর্গত। ক্ষণিকের মধ্যে, বিচ্ছিন্নের মধ্যে অখণ্ডের উপলব্ধি “জীবনদেবতা”র ভিতরের কথা। অনিত্য স্নেহপ্রীতির সম্বন্ধকে অনন্তরহস্যময় করিয়া দেখিবার কথা “স্বর্গ হইতে বিদায়” কবিতাটিতে বলা হইয়াছে বলিয়া তাহা “জীবনদেবতা”রই ভাবের অন্তর্ভুক্ত কথা; এবং জগতের বিচিত্রচঞ্চল সৌন্দর্য যে সকলসম্বন্ধাতীত এক খণ্ড সৌন্দর্যে নিবিড়লীন, “উর্বশী”র এ কথাও জীবনদেবতার ভাবের অন্তর্গত।

 বাস্তবিক “উর্বশী”র ন্যায় সৌন্দর্যবোধের এমন পরিপূর্ণ প্রকাশ সমগ্র ইউরোপীয় সাহিত্যে কোথাও আছে কি না সন্দেহ। সৌন্দর্য সমস্ত প্রয়োজনের বাহিরে, সে আপনাতে আপনি সম্পূর্ণ একটি সত্তা। জগতের কোন্ রহস্যসমুদ্রের গোপন অতলতার মধ্যে তাহার সৃষ্টি! সমস্ত বিশ্ব-সৌন্দর্যের মধ্যে ক্ষণে ক্ষণে তাহার বিদ্যুৎ-চঞ্চল আঁচল দোলানোর আভাস পাওয়া যাইতেছে:

তোমারি কটাক্ষঘাতে ত্রিভুবন যৌবনচঞ্চল,
তোমার মদির গন্ধ অন্ধবায়ু বহে চারি ভিতে···
নূপুর গুঞ্জরি যাও আকুল-অঞ্চলা
বিদ্যুৎ-চঞ্চলা।

ইহারই নৃত্যের ছন্দে ছন্দে সিন্ধুর তরঙ্গ উচ্ছ্বসিত, শস্যশীর্ষে ধরণীর শ্যামল অঞ্চল কম্পিত, ইহারই স্তনহারচ্যুত মনিভূষণ অনন্ত আকাশে তারায় তারায় বিকীর্ণ, বিশ্ববাসনার বিকশিত পদ্মের উপরে ইহার অতুলনীয় পাদপদ্ম স্থাপিত ।

সুরসভাতলে যবে নৃত্য কর পুলকে উল্লসি,
হে বিলোলহিল্লোল উর্বশী,
ছন্দে ছন্দে নাচি উঠে সিন্ধু-মাঝে তরঙ্গের দল,
শস্যশীর্ষে শিহরিয়া কাঁপি উঠে ধরার অঞ্চল,
তব স্তনহার হতে নভস্থলে খসি পড়ে তারা,
অকস্মাৎ পুরুষের বক্ষোমাঝে চিত্ত আত্মহারা—
নাচে রক্তধারা।

দিগন্তে মেখলা তব টুটে আচম্বিতে,
অয়ি অসম্বৃতে।

 পাঠকেরা এই জায়গায় “প্রতিধ্বনি” কবিতাটি স্মরণ করিবেন। আমি সেখানে বলিয়াছি যে, সুর যেমন প্রত্যেক কথাটির মধ্যে অনির্বচনীয়কে উদ্ঘাটন করে, রবীন্দ্রনাথের হৃদয় সেইরূপ সমস্ত দেখার সঙ্গে সঙ্গে একটি অপরূপকে দেখিয়া তৃপ্তিলাভ করিতে চায়। উর্বশী সেই সমস্ত রূপের মধ্যে অপরূপের দৃষ্টি। এ এক আশ্চর্য কাব্য— সৌন্দর্যের এমন সুতীব্র অথচ নির্মল অনুভূতি অন্যত্র দেখি নাই।

 জীবনের এক পর্ব এইখানেই শেষ। এইবার আমরা যেখানে যাত্রা করিব সেখানে এই কাব্যজীবনের সঙ্গে একটা বিচ্ছেদের সূত্রপাত। কেন? আমাদের তো মনে হয় এইখানে কবি তাঁহার কবিত্বের উচ্চতম শিখরে আরোহণ করিয়াছেন, মানুষের মধ্যে বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে এমন সত্য প্রবেশ, জীবনকে মৃত্যুকে প্রেমকে সৌন্দর্যবোধকে এমন এক অখণ্ড জীবনের সূত্রে পরিপূর্ণ করিয়া দেখা, ইহার মধ্যে অভাব কোথায়?

 জীবনেরও এমন পূর্ণ আয়োজনটি! জমিদারির কাজ— তাহার সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অমন সুন্দর উপভোগ— নদীর উপরে বোটে করিয়া দিনরাত্রি আনন্দে যাপন, ‘সাধনা’র জন্য গদ্যে পদ্যে বিচিত্র রচনাকার্য— সকল দিক হইতে এমন আয়োজন আর কোথায় মিলিবে? চৈতালির কবিতাগুলি এবং এই সময়কার চিঠিগুলি পড়িলে বেশ বুঝিতে পারা যায়, কী মাধুর্যের স্রোতের মধ্যে এই সময়ের মধ্যে প্রত্যেকটি দিন এবং প্রত্যেকটি রাত্রি ফুলের মতো ফুটিয়া উঠিয়া নিরুদ্দেশ যাত্রায় ভাসিয়া ভাসিয়া গিয়াছে।

 একটা চিঠিতে আছে:

 ‘আমি প্রায় রোজই মনে করি, এই তারাময় আকাশের নীচে আবার কি কখনো জন্মগ্রহণ করব? যদি করি আর কি কখনো এমন প্রশান্ত সন্ধ্যাবেলায় এই নিস্তব্ধ গোরাই নদীটির উপরে বাংলাদেশের এই সুন্দর একটি কোণে এমন নিশ্চিন্ত মুগ্ধ মনে... প’ড়ে থাকতে পারব?’

 আর একটি চিঠির খানিকটা দিই:

 ‘আমার এই পদ্মার উপরকার সন্ধ্যাটি আমার অনেক দিনের পরিচিত— আমি শীতের সময় যখন এখানে আসতুম এবং কাছারি থেকে ফিরতে অনেক দেরি হত, আমার বোট ওপারের বালির চরের কাছে বাঁধা থাকত— ছোট জেলে-ডিঙি চ’ড়ে নিস্তব্ধ নদীটি পার হতুম, তখন এই সন্ধ্যাটি সুগভীর অথচ সুপ্রসন্ন মুখে আমার জন্যে অপেক্ষা ক’রে থাকত— আমার জন্যে একটি শান্তি একটি কল্যাণ একটি বিশ্রাম সমস্ত আকাশময় প্রস্তুত থাকত— সন্ধ্যাবেলাকার নিস্তরঙ্গ পদ্মার উপরকার নিস্তব্ধতা এবং অন্ধকার ঠিক যেন নিতান্ত অন্তঃপুরের ঘরের মতো বোধ হত । এখানকার প্রকৃতির সঙ্গে সেই আমার একটি মানসিক ঘরকন্নার সম্পর্ক, সেই একটি অন্তরঙ্গ আত্মীয়তা আছে যা ঠিক আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। সেটা যে কতখানি সত্য তা বললেও কেউ উপলব্ধি করতে পারবে না। জীবনের যে গভীরতম অংশ সর্বদা মৌন এবং সর্বদা গোপন, সেই অংশটি আস্তে আস্তে বের হয়ে এসে এখানকার অনাবৃত সন্ধ্যা এবং অনাবৃত মধ্যাহ্নের মধ্যে নীরব নির্ভয়ে সঞ্চরণ করে বেড়িয়েছে। আমাদের (দুটো) জীবন আছে একটা মনুষ্যলোকে আর একটা ভাবলোকে— সেই ভাবলোকের জীবনবৃত্তান্তের অনেকগুলি পৃষ্ঠা আমি এই পদ্মার উপরকার আকাশে লিখে গেছি।’

 সোনার তরী, চিত্রা ও চৈতালির এই মাধুর্যরসপূর্ণ জীবনের সঙ্গে কথা, কল্পনা, ক্ষণিকা প্রভৃতি পরবর্তী কাব্যের জীবনের যে বিচ্ছেদ তাহা এমন গুরুতর যে এ দুইটাকে দুইজন স্বতন্ত্র লোকের জীবন বলিলেও অন্যায় হয় না। কিন্তু এক জীবন হইতে অন্য জীবনে যাইবার গভীরতর কারণ আছে, আপাত-বিচ্ছেদের মধ্যেও সত্য বিচ্ছেদ কোথাও নাই। সুতরাং এখন তাহারই আলোচনায় প্রবৃত্ত হওয়া যাক্‌।