রবীন্দ্রনাথ (১৯৬০)/৫
৫
কবিজীবনকে নিঃশেষিত করিয়া যে নূতন আধ্যাত্মিক জীবনে কবি জন্মলাভ করিলেন, তাহার পরিপুষ্টির স্তন্যদুগ্ধ ছিল প্রাচীন ভারতবর্ষের আদর্শে—‘কথা’র মধ্যে যাহাকে নানা কাহিনীতে প্রকাশ করা হইয়াছে।
‘নৈবেদ্যে’ সেই প্রাচীন তপোবনের ঋষিদের সাধনার আদর্শকে জীবনের মধ্যে সত্যভাবে লাভ করিবার জন্য ব্যাকুল ইচ্ছা প্রকাশ পাইয়াছে।—
তাঁহারা দেখিয়াছেন—বিশ্ব চরাচর
ঝরিছে আনন্দ হ’তে আনন্দনির্ঝর।
অগ্নির প্রত্যেক শিখা ভয়ে তব কাঁপে
বায়ুর প্রত্যেক শ্বাস তোমারি প্রতাপে
তোমারি আদেশ বহি মৃত্যু দিবারাত
চরাচর মর্মরিয়া করে যাতায়াত।
গিরি উঠিয়াছে ঊর্ধ্বে তোমারি ইঙ্গিতে,
নদী ধায় দিকে দিকে তোমারি সংগীতে।
শূন্যে শূন্যে চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা যত
অনন্ত প্রাণের মাঝে কাঁপিছে নিয়ত।
তাঁহারা ছিলেন নিত্য এ বিশ্ব আলয়ে
কেবল তোমারি ভয়ে তোমারি নির্ভয়ে,
তোমারি শাসনগর্বে দীপ্ত তৃপ্ত মুখে
বিশ্বভুবনেশ্বরের চক্ষুর সম্মুখে।····
আমরা কোথায় আছি—কোথায় সুদূরে
দীপহীন জীর্ণভিত্তি অবসাদপুরে
ভগ্ন গৃহে; সহস্রের ভ্রূকুটির নীচে
কুব্জপৃষ্ঠে নতশিরে; সহস্রের পিছে
চলিয়াছি প্রভুত্বের তর্জনী-সংকেতে
কটাক্ষে কাঁপিয়া; লইয়াছি শিরে পেতে
সহস্রশাসন-শাস্ত্র·····
‘নৈবেদ্যে’র সময় হইতে, অর্থাৎ ১৩০৮ সালে ‘বঙ্গদর্শনে’র সম্পাদকতার ভার গ্রহণের সময় হইতে, রবীন্দ্রনাথের স্বাদেশিক জীবনের আরম্ভ।
প্রসঙ্গতঃ একটা কথা এখানে বলা দরকার। আমরা ইতিপূর্বে দেখিয়া আসিয়াছি যে, প্রবল অনুভূতি এবং কল্পনার যোগে সমস্ত জিনিসকে দেখিবার দরুন যখনই কোনো খণ্ডতার মধ্যে কবি গিয়া পড়েন—হোক তাহা বাহ্য সৌন্দর্য, হোক মানবপ্রেম, হোক স্বদেশানুরাগ—তখন সেই খণ্ডতাকে খণ্ডতা বলিয়া জানিবার কোনো উপায় তাঁহার থাকে না। জীবনের অন্যান্য সকল দিককে আচ্ছন্ন করিয়া সে বড় হইয়া এবং একান্ত হইয়া উঠে। কিন্তু এইটি ঘটিবার সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিক্রিয়াও অমনিই শুরু হয়। খণ্ডতাকে বিদীর্ণ করিয়া আবার তাঁহার সর্বানুভূতি আপনাকে সমগ্রের মধ্যে নির্বোধ ও মুক্ত করিতে সক্ষম হয়।
স্বাদেশিক জীবনেও এই কাণ্ডটিই হইয়াছে। কেবল যে প্রাচীন ভারতবর্ষের আধ্যাত্মিক সাধনার আদর্শ তাঁহার নিজের জীবনের পূর্ণতার পক্ষে প্রয়োজন ছিল বলিয়া সেই আদর্শটুকুই তিনি গ্রহণ করিয়াছিলেন তাহা নহে। স্বদেশ তাঁহার কল্পনানেত্রে তাহার অতীত ও বর্তমান, তাহার হীনতা ও বিকৃতি, তাহার আশা ও নৈরাশ্য, সমস্ত লইয়াই অখন্ডরূপে দেখা দিয়াছিল। দেশের সেই অখণ্ড ভাবরূপ তাঁহার সমস্ত চিত্তকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করাতেই হিন্দুসমাজকেও সেই ভাবের দ্বারা সম্পূর্ণ করিয়া দেখিবার একটা উদ্যোগ তাঁহার মনের মধ্যে জাগ্রত হইয়া উঠিল।
আমি এই সময়ে কোনো কোনো বিশিষ্ট লোকের মুখে অনেকবার শুনিয়াছি যে, প্রাচীন ভারতবর্ষের প্রতি অন্ধভক্তিবশতঃ কবি বৈরাগ্য এবং সংসারবিমুখতার সাধনাকে সর্বশ্রেষ্ঠ সাধনা মনে করিয়া তাহারই একটি ক্ষেত্রের জন্য বোলপুরে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন। অবশ্য এই সময়েই বোলপুর-আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়— ১৩০৮ সালের ৭ই পৌষে।
আমি কোনোমতেই স্বীকার করিতে চাহি না যে, আমাদের দেশের আধুনিক সন্ন্যাসের আদর্শ, কামিনীকাঞ্চনবর্জনের আদর্শ, কবিকে কোনো দিন কিছুমাত্র অধিকার করিয়াছিল। তার প্রমাণ ‘নৈবেদ্যে’ই আছে:
বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি সে আমার নয়।
অসংখ্যবন্ধন মাঝে মহানন্দময়
লভিব মুক্তির স্বাদ। এই বসুধার
মৃত্তিকার পাত্রখানি ভরি বারম্বার
তোমার অমৃত ঢালি দিবে অবিরত
নানাবর্ণগন্ধময়। প্রদীপের মতো
সমস্ত সংসার মোর লক্ষ বর্তিকায়
জ্বালায়ে তুলিবে আলো তোমারি শিখায়
তোমার মন্দিরমাঝে। ইন্দ্রিয়ের দ্বার
রুদ্ধ করি যোগাসন, সে নহে আমার!
যে কিছু আনন্দ আছে দৃশ্যে গন্ধে গানে
তোমার আনন্দ রবে তার মাঝখানে।
মোহ মোর মুক্তিরূপে উঠিবে জ্বলিয়া,
প্রেম মোর ভক্তিরূপে রহিবে ফলিয়া।
আমি এই প্রবন্ধের আরম্ভে বলিয়াছি যে, কবির জীবনে আধ্যাত্মিকতার এই নুতন ভাবটি আকাশ হইতে হঠাৎ-পড়া কোনো আকস্মিক ব্যাপার নয়, তাহা তাঁহার কবি-জীবনেরই স্বাভাবিক পরিণতি— এবং আশা করি যে, যাহারা আমার এই সমগ্র প্রবন্ধটি অনুধাবন করিবেন তাঁহারা সেই পরিণতির ক্রমগুলিও একে একে চক্ষের সমক্ষে স্পষ্টরূপেই দেখিতে পাইবেন।
কবির পক্ষে প্রয়োজন ছিল বিচিত্রতার জীবনকে এবং আধ্যাত্মিক জীবনকে একসঙ্গে মেলানো— ভোগ এবং ত্যাগের সামঞ্জস্যের একটি সাধনার পথ আবিষ্কার করা।
আমি বলিয়া আসিয়াছি যে, একটা বড় মঙ্গলের ক্ষেত্র, ত্যাগের ক্ষেত্র, এই কারণে তাঁহার প্রয়োজন হইয়াছিল। দেশের কোথাও যখন এমন কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না, তখন তাঁহাকে নিজের চেষ্টায় এই বোলপুরে সেরূপ একটি ক্ষেত্র গড়িয়া লইতে হইল।
ভারতবর্ষের প্রাচীন চতুরাশ্রমধর্মের আদর্শ, তপোবনের আদর্শ— সংসার এবং পরমার্থ, ভোগ এবং ত্যাগ, এই পরস্পরবিপরীত জিনিসের সমন্বয় কী করিয়া সাধিত হইতে পারে তাহা নির্দেশ করিয়া দিয়াছে। আধুনিক কালের পক্ষে যে এই আদর্শের উপযোগিতা সকলের চেয়ে বেশি, সে কথা জগতে নানা জায়গাতেই আজ উঠিয়া পড়িয়াছে, ভারতবর্ষেও সে কথা প্রথম ধ্বনিত হইল কবিকণ্ঠে— এ এক আশ্চর্যের ব্যাপার।
ইউরোপে আজকাল কথা উঠিয়াছে— ব্যক্তিস্বাধীনতাকে ভিত্তিস্বরূপ করিয়া যে সমাজরচনার চেষ্টা ফরাসীবিপ্লবের সময় হইতে চলিয়া আসিয়াছিল তাহা মিথ্যা, তাহা কখনোই ভিত্তি হইতে পারে না। সমাজকে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তির সমষ্টি বলিয়া জানা ভুল— সমাজ একটি অবিচ্ছিন্ন কলেবর, অঙ্গাঙ্গিভাবে প্রত্যেক ব্যক্তিই তাহার ভিতরে সম্বন্ধ। সোস্যালিজম্ প্রভৃতির আন্দোলনের ধারা এই আদর্শের দিকেই প্রধাবিত। মিল, হর্বাট স্পেন্সর প্রভৃতি সমাজতত্ত্ববিদদের তাই আধুনিক ইউরোপ ব্যক্তিতন্ত্রের গোঁড়া বলিয়া গাল দিয়া থাকে।
কেবল বৈজ্ঞানিক ভাবে চুল-চেরা বিশ্লেষণ করিয়া জড়শক্তির মতো মনুষ্যসমাজের নানা বিচিত্র শক্তিগুলিকে সাজাইয়া তোলা যায় না— স্টেট গড়ার বৈজ্ঞানিক আদর্শও ইউরোপে ম্লান হইয়া আসিয়াছে। মানুষ তো কেবল প্রয়োজনসাধনের কল মাত্র নহে— সুতরাং ব্যবহারিক দিক দিয়া তাহার রাষ্ট্র রচনা করিতে গেলেই রাষ্ট্রের ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থের মধ্যে যে প্রবল সংঘাত বাধিয়া যাইবে তাহার কোনো সমাধান খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না। ধর্মের নূতন আন্দোলনের ভিতর দিয়া সেই কথাটা ইউরোপের চেতনার মধ্যে পৌঁছিয়াছে। রাষ্ট্রের সঙ্গে সমাজের বেশ সহজ এবং অঙ্গাঙ্গী যোগ কী ভাবে সাধিত হইতে পারে ইউরোপের তাহাই এখন একটা বড় সমস্যা।
ইউরোপীয় দর্শন, সাহিত্য, আর্ট, সমাজনীতি, সমস্তের ভিতর দিয়াই এই সমন্বয়াদর্শ কাজ করিতেছে দেখিতে পাই।
কবি রবীন্দ্রনাথও ভারতবর্ষে এই আদর্শকেই তাহার প্রাচীন তপস্যার ভিতর হইতে নিজের জীবনের প্রয়োজনের ক্ষুধায় আবিষ্কার করিয়াছেন। ভারতবর্ষে ধর্ম এবং সমাজ, পরমার্থ এবং সংসার, আধুনিক কালে পরস্পরবিচ্ছিন্ন হইয়া ধর্মকে নিশ্চেষ্ট নিষ্ক্রিয় এবং সমাজকে আধ্যাত্মিকতাশূন্য আচারপরায়ণমাত্র করিয়া আমাদের দুর্বল করিয়া ফেলিয়াছে। সেইজন্য আমরা বলি যে, সংসার করিতে গেলে আচারের বন্ধনকে স্বীকার করিতে হইবে এবং আধ্যাত্মিক জীবন যাপন করিতে গেলে সংসার ত্যাগ করিয়া সন্ন্যাসী হইতে হইবে। এই দুই কী উপায়ে মিলিতে পারে এবং সমস্ত দেশ এই দুইকে সম্মিলিত করিবার সাধনার দ্বারা কিরূপে বলিষ্ঠ হইয়া পুনরায় জাগ্রত হইতে পারে তাহা দেশের চক্ষের সামনে কবি প্রাণপণে ধরিবার চেষ্টা করিয়াছেন।
সুতরাং যাঁহারা মনে করেন যে, তাঁহার তপোবন-রচনার কল্পনা সংসারবিমুখতার নামান্তর, তাঁহারা ভারতবর্ষের আদর্শকে কবি কী চক্ষে দেখেন তাহা ভালো করিয়া বুঝিতে পারিয়াছেন বলিয়া মনে হয় না। এই বিদ্যালয় সম্বন্ধেও তাই তাঁহারা কতগুলি অমূলক কল্পনাকে মনের মধ্যে পোষণ করিয়া ইহার প্রতি যথোচিত শ্রদ্ধা রক্ষা করেন নাই এবং ইহার কাজকে অগ্রসর করিয়া দেবার জন্য অণুমাত্রও চেষ্টা করেন নাই।
কবির “তপোবন” নামক একটি প্রবন্ধ হইতে কিয়দংশ উদ্ধৃত করিয়া দিলেই আশ্রমপ্রতিষ্ঠার সময়ে কী আদর্শ যে তাঁহার মনের মধ্যে কাজ করিয়াছিল তাহা পরিস্ফুট হইবে:
‘ভারতবর্ষ যে সাধনাকে গ্রহণ করেছে সে হচ্ছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে চিত্তের যোগ, আত্মার যোগ, অর্থাৎ সম্পূর্ণ যোগ। কেবল জ্ঞানের যোগ নয়, বোধের যোগ।··· অতএব আমরা যদি মনে করি ভারতবর্ষের এই সাধনাতেই দীক্ষিত করা ভারতবাসীর শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত তবে এটা মনে স্থির রাখতে হবে যে, কেবল ইন্দ্রিয়ের শিক্ষা নয়, কেবল জ্ঞানের শিক্ষা নয়, বোধের শিক্ষাকে আমাদের বিদ্যালয়ে প্রধান স্থান দিতে হবে। অর্থাৎ, কেবল কারখানার দক্ষতা-শিক্ষা নয়, স্কুলকালেজে পরীক্ষায় পাস করা নয়, আমাদের যথার্থ শিক্ষা তপোবনে; প্রকৃতির সঙ্গে মিলিত হয়ে, তপস্যার দ্বারা পবিত্র হয়ে। আমাদের স্কুল-কালেজেও তপস্যা আছে, কিন্তু সে মনের তপস্যা, জ্ঞানের তপস্যা। বোধের তপস্যা নয়।··· বোধের তপস্যার বাধা হচ্ছে রিপুর বাধা— প্রবৃত্তি অসংযত হয়ে উঠলে চিত্তের সাম্য থাকে না, সুতরাং বোধ বিকৃত হয়ে যায়।···
‘এইজন্যে ব্রহ্মচর্যের সংযমের দ্বারা বোধশক্তিকে বাধামুক্ত করবার শিক্ষা দেওয়া আবশ্যক। ভোগবিলাসের আকর্ষণ থেকে অভ্যাসকে মুক্তি দিতে হয়, যে-সমস্ত সাময়িক উত্তেজনা লোকের চিত্তকে ক্ষুব্ধ এবং বিচারবুদ্ধিকে সামঞ্জস্যভ্রষ্ট করে দেয়, তার ধাক্কা থেকে বুদ্ধিকে সরল করে বাড়তে দিতে হয়।
‘যেখানে সাধনা চলছে, যেখানে জীবনযাত্রা সরল ও নির্মল, যেখানে সামাজিক সংস্কারের সংকীর্ণতা নেই, যেখানে ব্যক্তিগত ও জাতিগত বিরোধবুদ্ধিকে দমন করবার চেষ্টা আছে, সেইখানেই ভারতবর্ষ যাকে বিশেষভাবে বিদ্যা বলেছে তাই লাভ করবার স্থান।’
এই ব্রহ্মচর্যাশ্রমের আদর্শ চারি আশ্রমধর্মের আদর্শের অংশমাত্র। কবিকে যেখানে প্রাচীন ভারতবর্ষ মুগ্ধ করিয়াছিল সে ওই চতুরাশ্রমের আদর্শ। “ততঃ কিম্” নামক প্রবন্ধে তিনি এই আদর্শটিকে ফলাইয়া ব্যাখ্যা করিয়াছেন, তাহারই কিয়দংশ এখানে দিলাম:
‘জগতের সম্বন্ধগুলিকে আমরা ধ্বংস করিতে পারি না, তাহাদের ভিতর দিয়া গিয়া তাহাদিগকে উত্তীর্ণ হইতে পারি।··· এই ভিতর দিয়া যাওয়াটাই সাধনা।··· গ্রহণ এবং বর্জন, বন্ধন এবং বৈরাগ্য, এই দুটাই সমান সত্য— একের মধ্যেই অন্যটির বাসা, কেহ কাহাকেও ছাড়িয়া সত্য নহে।··· শংকর ত্যাগের এবং অন্নপূর্ণা ভোগের মূর্তি— উভয়ে মিলিয়া যখন একাঙ্গ হইয়া যায় তখনই সম্পূর্ণতার আনন্দ।···
‘প্রাচীন সংহিতাকারগণ হিন্দুসমাজে হরগৌরীকে অভেদাঙ্গ করিতে চাহিয়াছিলেন।··· শিব ও শক্তির, নিবৃত্তি ও প্রবৃত্তির সম্মিলনই সমাজের একমাত্র মঙ্গল··· ইহাই তাঁহারা বুঝিয়াছিলেন।···
‘ভারতবর্ষ জানিত, সমাজ মানুষের শেষ লক্ষ্য নহে, মানুষের চির-অবলম্বন নহে— সমাজ হইয়াছে মানুষকে মুক্তির পথে অগ্রসর করিয়া দিবার জন্য।···
‘এইজন্য ভারতবর্ষ মানুষের জীবনকে যেরূপে বিভক্ত করিয়াছিলেন কর্ম তাহার মাঝখানে ও মুক্তি তাহার শেষে।
‘দিন যেমন চার স্বাভাবিক অংশে বিভক্ত—পূর্বাহ্ন, মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ন এবং সায়াহ্ন ভারতবর্ষ জীবনকে সেইরূপ চারি আশ্রমে ভাগ করিয়াছিল। এই বিভাগ স্বভাবকে অনুসরণ করিয়াই হইয়াছিল । আলোক ও উত্তাপের ক্রমশ বৃদ্ধি এবং ক্রমশ হ্রাস যেমন দিনের আছে, তেমনি মানুষের ইন্দ্রিয়শক্তির ক্রমশ উন্নতি এবং ক্রমশ অবনতি আছে।··· প্রথমে শিক্ষা, তাহার পরে সংসার, তাহার পরে বন্ধনগুলিকে শিথিল করা, তাহার পরে মুক্তি ও মৃত্যুর মধ্যে প্রবেশ— ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ ও প্রব্রজ্যা।···
‘ত্যাগ করিতেই হইবে, ত্যাগের দ্বারাই আমরা লাভ করি।···
‘প্রাচীন সংহিতাকারগণ আমাদের শিক্ষাকে, আমাদের গার্হস্থ্যকে অনন্তের মধ্যে (শরীর হইতে সমাজে, সমাজ হইতে নিখিলে, নিখিল হইতে অধ্যাত্মক্ষেত্রে)[১] সেই শেষ পরিণামের অভিমুখ করিতে চাহিয়াছিলেন।···সেইজন্য আমাদের শিক্ষা কেবল বিষয়শিক্ষা, কেবল গ্রন্থশিক্ষা ছিল না, তাহা ছিল ব্রহ্মচর্য।’
আমি যে লেখাটি হইতে যে যে স্থান উদ্ধার করিলাম তাহাতে প্রাচীন ভারতবর্ষের আদর্শ কবি কী বুঝিয়াছিলেন তাহা পরিষ্কার বোধগম্য হইবে। এ কথা যেন কেহ না মনে করেন যে, স্বাদেশিকতার প্রথম মত্ততা তাঁহার কাটিয়া গিয়াছে বলিয়া এ আদর্শও তাঁহার মন হইতে সরিয়া গিয়াছে। বস্তুতঃ উপনিষদের
ঈশাবাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ।
তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ মা গৃধঃ কস্যস্বিদ্ধনম্॥
এই মহাবাক্যটি যেমন তাঁহার পিতার জীবনে মূলমন্ত্রস্বরূপ হইয়াছিল, তাঁহার জীবনেও এই আদর্শেরই প্রভাব কাজ করিতেছে দেখিতে পাওয়া যায়। কেবল ব্যক্তিগত জীবনে নয়, আমাদের সমাজতত্ত্বের মধ্যে যে এই আদর্শটি রহিয়াছে, যাহার জন্য সমাজ বন্ধন না হইয়া মুক্তির কারণ হয়, আমাদের দেশের প্রাচীন ইতিহাসের বৃহৎ জীবনক্ষেত্রে এই ঈশ্বরের দ্বারা সমস্ত পূর্ণ করিয়া দেখিবার আদর্শকে কবি প্রত্যক্ষ করিলেন। সংসারকে পুরাপুরি গ্রহণ করিয়া তাহাকে অতিক্রম করিলে তাহাকে সংসার ত্যাগ করা বলে না। সংসারকে অতিক্রম করা মানেও এ নয় যে সংসারের সঙ্গে কোনো সম্বন্ধই থাকিবে না— সংসারকে অতিক্রম করার অর্থ সংসারকে ব্রহ্মের মধ্যে সত্য করিয়া জানা। তেমন করিয়া জানিতে গেলে বন্ধন এবং মুক্তি এক কথা হইয়া পড়ে, ভোগ এবং ত্যাগে কোনো বিচ্ছেদ থাকে না।
আমি যদি ভুল বুঝিয়া না থাকি তবে এই কি তাঁহার প্রতিষ্ঠিত ব্রহ্মচর্যাশ্রমের ভিতরকার কথা নয়? কর্মের দ্বারাই কর্মবন্ধনকে অতিক্রম করিয়া সর্বত্র ব্রহ্মের উপলব্ধিকে প্রত্যক্ষ করার সাধনাই কি এ আশ্রমের মর্মের মধ্যে নাই? বস্তুতঃ আমি এখানকার কর্ম অংশটুকুকে এই বড় সাধনার অঙ্গীভূত বলিয়া জানি, সেইজন্য ইহাকে কোনোদিনই প্রাধান্য দিই না। এখানে বিশ্বপ্রকৃতির উদার সহবাসে এবং মঙ্গলকর্মে মন নির্মল হইয়া জলস্থল-আকাশে, সমস্ত মনুষ্যলোকে, সর্বত্র আপনার চেতনাকে প্রসারিত করিয়া দিবে এবং ব্রহ্মের দ্বারা সমস্তই পরিব্যাপ্ত করিয়া দেখিবে— কোনো সামাজিক সংস্কারের দ্বারা নহে, কোনো জাতিগত বিরোধবুদ্ধির দ্বারা নহে। এ আশ্রমের আকাশ, দিগন্তপ্রসারিত প্রান্তর, তরুলতা সেই বিরাট অনুশাসনকে প্রচার করিতেছে যে, যাহা-কিছু আছে তাহা ঈশ্বরের মধ্যে আচ্ছন্ন করিয়া সত্য করিয়া জানো।
যে সুবৃহৎ ধর্মের আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত হইয়া কবি প্রাচীন ভারতবর্ষের দিকে ঝুঁকিয়া পড়িয়াছিলেন তাহার সঙ্গে স্বাদেশিকতার একটা প্রবল উত্তেজনা এক সময়ে মিশিয়াছিল কেন, এখানে এ প্রশ্নটি ওঠা স্বাভাবিক। আমি পূর্বেই এক রকম করিয়া ইহার উত্তর দিয়া আসিয়াছি। আমি বলিয়াছি যে, স্বদেশের একটি অখণ্ড ভাবরূপ তাঁহার চিত্তকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করাতে তিনি হিন্দুসমাজকে কেবল তাহার বিকৃতি ও দুর্বলতার দিক হইতে না দেখিয়া আপনার অখণ্ড ভাবের দ্বারা খুব বৃহৎ খুব মহৎ করিয়া দেখিয়াছিলেন। ভাবের দ্বারা অনুরঞ্জিত করিয়া সব জিনিসকে দেখা কবির প্রকৃতিসিদ্ধ। এ দেখাকে নিন্দা করা চলে না, কারণ, সত্যকে তাহার অন্তরতম জায়গায় দেখিতে গেলেই সমস্ত বাহ্য আবরণকে ভেদ করিয়া দেখিতে হইবে। তথাপি ভাব যদি বাস্তবমূলক না হয়, তবে সে অসত্যকেই সত্যের স্থানে বসাইয়া ফেলে। তখন অনুভূতি মাত্রা ছাড়াইয়া যায়, কোনটা গ্রহণীয় এবং কোনটা বর্জনীয় তাহা বিচার করিবার সাধ্য থাকে না। সমাজকে যাহা শিথিল ও জড়প্রায় করিয়াছে, ইহার প্রকৃত মহত্ত্বকে যা অবরুদ্ধ ও আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছে, বড় আদর্শের সঙ্গে তাহাও একীভূত হইয়া খিচুড়ি পাকাইয়া বসে। ভাবের সঙ্গে বাস্তবের বিচ্ছেদ এইজন্যই কোনো ক্ষেত্রেই বাঞ্ছনীয় নহে।
তাঁহার আধুনিক উপন্যাস ‘গোরা’ যাঁহারা পাঠ করিয়াছেন তাঁহারা এই অবস্থারই একটি চিত্র গোরা-চরিত্রের মধ্যে নিঃসন্দেহ দেখিতে পাইয়াছেন। কিন্তু গোরার ন্যায় কবি রবীন্দ্রনাথকেও এ অবস্থার ভিতর দিয়া যাইতে হইয়াছিল এবং যাইবার প্রয়োজনও ছিল। প্রয়োজন ছিল বলিতেছি কেন তাহার কারণ আছে। আমাদের দেশের আধুনিক কালে সকলের চেয়ে বড় সমস্যাটা কী তাহা আলোচনা করিলেই আমার এরূপ কথা বলিবার তাৎপর্য নির্ণীত হইবে।
পাশ্চাত্য সভ্যতার আঘাতে আমাদের এই সুপ্ত দেশ যখন জাগিয়া উঠিল, তখন আমাদের প্রাচীন সমাজ আচারবিচারের সহস্র বেষ্টন তুলিয়া বিশ্ব হইতে আমাদের চিত্তকে অবরুদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে ইহাই আমরা অনুভব করিলাম। আমাদের দেশের ইতিহাসের যে বিপুল ধারা বিচিত্র জাতির বিচিত্র আদর্শের সমন্বয়ে পরিপুষ্ট হইয়া এক যুগ হইতে অন্য যুগে এতাবৎকাল সমান বেগে প্রবাহিত হইয়া আসিতেছিল, তাহার সেই স্রোত এক সময়ে বন্ধ হইলে আমরা তাহার পূর্ব-ইতিহাসের কোনো সংবাদই পাইলাম না— জীর্ণ লোকাচারের শৈবালবন্ধনে তাহার অচল অসাড় জীবনহীন ভাব দেখিয়া আমরা ভাবিলাম যে, আমাদের দেশে প্রাণের বুঝি চিরকালই এমনিতর অভাব। দেশের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা থাকিল না।
সুতরাং আমরা পশ্চিমের সভ্যতার দ্বারা অভিভূত হইয়া সমাজকে ভাঙিলাম। আমরা বলিলাম, ব্যক্তির স্বাধীনতা দিতে হইবে— ব্যক্তি যাহা জ্ঞানপূর্বক বুঝিবে তাহাই সে আচরণ করিবে— সমাজ তাহাকে শাসন করিলে সে শাসন তাহার অস্বীকার করাই কর্তব্য।
ইউরোপে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য আছে বটে, কিন্তু তাহাকে ধারণ করিয়া রাখিয়াছে রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্রের সূত্রে সকলের ঐক্য থাকার জন্য সেখানে মানুষে মানুষে বিচ্ছেদ দাঁড়ায় না, মানুষে মানুষে সকল বিষয়েই সম্মিলিত হইয়া সকল প্রতিষ্ঠানকে স্থায়ী ও পাকা করিয়া গড়িয়া তোলে। আমাদের রাষ্ট্রীয় ঐক্য নাই— সমাজকেও যখন আমরা ভাঙিলাম তখন দেখিতে দেখিতে প্রতিক্রিয়া আরম্ভ হইল। একদল লোকে বুলি ধরিল, সমাজসংস্কারের প্রয়োজন নাই শুধু নয়, হিন্দুসমাজের মতো আদর্শ সমাজ কোথাও হইতে পারে না— ইহার সকল প্রথা সকল আচারেরই সার্থকতা আছে।
এরূপ হওয়াই স্বাভাবিক। ইহাতে প্রমাণ হয় যে, সমাজের মধ্যে আত্মরক্ষার প্রবৃত্তি একেবারে ক্ষীণ হইয়া যায় নাই।
‘গোরা’ যাঁহারা পাঠ করিয়াছেন তাঁহারা জানেন সমাজের এই সকল বিচিত্র ঘাতপ্রতিঘাত সেই উপন্যাসটিতে কেমন আশ্চর্য শক্তির সঙ্গে দেখানো হইয়াছে। তাহাতে আধুনিক কালের যে সমস্যাটি আমাদের চক্ষের সম্মুখে দেদীপ্যমান হইয়া উঠিয়াছে তাহা এই যে, ভাষা জাতি ধর্ম ও সমাজের বহুতর ভাগবিভাগে আমাদের দেশ শতধা বিচ্ছিন্ন, কিন্তু তাহাদের ঐক্য দান করিবার জন্য কোনো শক্তি এ দেশে কাজ করিতেছে না। আমাদের দেশের মধ্যে সৃজনীশক্তির কোনো প্রকাশ নাই। আমরা যাহা-কিছু গড়ি তাহা সাম্প্রদায়িকতার ক্ষুদ্র সংকীর্ণতার সীমা ছাড়াইয়া যায় না— ব্যক্তিগত মতামত কেবলই ফাটল ধরাইয়া ভিত্তিকেই দীর্ণ করিতে থাকে— আমাদের অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানগুলি উপস্থিত এবং অনাগত সমস্ত দেশবাসীর একত্রিত চিত্তের মিলনমন্দিরস্বরূপ হয় না, তাহার মধ্যে বিশ্বমানবের রূপ প্রকাশ পায় না।
এ সমস্য| বাস্তবিকই জীবন-মৃত্যুর সমস্যা। যে দেশের মর্মের মধ্যে সৃজনীশক্তি দুর্বল, বাহিরের আঘাতে তাহার মৃত্যু ঘটে। জগতের বহু জাতিকে এইরূপ কারণে বিলুপ্ত হইতে দেখা গিয়াছে।
সমস্যাটা এত বড় গুরুতর ইহা অনুভব করিয়াই রবীন্দ্রনাথ হিন্দুসমাজকে স্বাদেশিকতার একটা পরিপূর্ণ ভাবের দ্বারা বড় করিয়া অনুভব করিয়া সজোরে আঁকড়াইয়া ধরিতে চাহিয়াছিলেন।
তাঁহার মনে হইত বঙ্গদর্শনের অনেক প্রবন্ধে এ কথা তিনি ব্যক্ত করিয়াছেন যে, ইউরোপীয় জাতিদের যেমন নেশন সকল স্বাতন্ত্র্যকে সকল বিচ্ছেদকে একটা ঐক্য দিয়া রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে জোরালো করিয়া রাখিয়াছে, আমাদের তেমনি বহুকালের একটা সমাজ আছে, তাহার ভালোমন্দ-বিচার পরে হইবে, কিন্তু তাহাকে প্রাণ দিয়া খাড়া করিয়া রাখাই আগে প্রয়োজন। সেইখানেই আমাদের সমস্ত জাতি মিলিবে। সেইখানেই আমাদের সমস্ত সেবা, সমস্ত পূজা আসিয়া উপস্থিত হইবে। সেই ‘স্বদেশী সমাজ’কে জাগ্রত না করিলে আমরা বিদেশের আক্রমণস্রোতে ভাসিয়া যাইব, পৃথিবীর ইতিহাস হইতে আমাদের নাম বিলুপ্ত হইয়া যাইবে। বস্তুতঃ এ দিক হইতে দেখিলে, ইহার বিরুদ্ধে কোনো যুক্তি নাই। যদি ইহা সত্য হয় যে, অনুকরণ করিয়া আমরা বাঁচিব না— কোনো জাতিই কোনোদিন বাঁচে নাই— তবে আমাদের ইতিহাসের ভিতর হইতেই আমাদের প্রাণ পাইতে হইবে। এবং আমাদের ইতিহাসে যখন কোনোদিনই আমরা নেশন গড়ি নাই, অথচ সমাজের সূত্রে যখন আমাদের ঐক্যও একটা স্থির হইয়াছিল এবং আছে এখনও, তখন সেই সমাজকে কালের উপযোগী করিয়া অথচ প্রাচীনের নিত্য আদর্শের সঙ্গে সংগত করিয়া গড়িতেই হইবে।
বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত ‘সমাজভেদ’, ‘ব্রাহ্মণ’, ‘হিন্দুত্ব’, ‘চীনেম্যানের চিঠি’ প্রভৃতি প্রবন্ধ পাঠ করিলে আপনারা এই ভাবেরই পরিচয় পাইবেন।
গোরা চরিত্রটিকেও রবীন্দ্রনাথ সমাজের মধ্যে এই স্বাজাত্যের উদ্বোধকরূপে চিত্রিত করিয়াছেন। বর্ণাশ্রমধর্ম ছিল আমাদের প্রাচীন আর্যসমাজের ভিত্তিমূল। ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য এই তিন বর্ণ ই পূর্বে দ্বিজ বলিয়া পরিচিত হইতেন, বৃত্তিভেদ ভিন্ন তাঁহাদের মধ্যে আর কোথাও কোনো বৈষম্য ছিল না। কালক্রমে দ্বিজত্বের সাধনা যেমন বিলুপ্ত হইয়াছে এবং দ্বিজত্ব কেবলমাত্র ব্রাহ্মণের মধ্যেই আবদ্ধ হইয়া পড়িয়াছে, স্ব স্ব বৃত্তির অনুশীলনও তেমনি ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের দ্বারা আচরিত হইতেছে না। ব্রাহ্মণ যিনি নির্লিপ্ত থাকিয়া তপস্যা করিবেন, সমাজের ত্যাগের নিত্য আদর্শটিকে বিশুদ্ধভাবে নিজ-জীবনে রক্ষা করিবেন, তিনি সে বৃত্তি রক্ষা না করিয়া দশের ভিড়ে মিশিয়া শুদ্রবৃত্তি গ্রহণ করিয়াছেন। বৃত্তিভেদমূলক সমাজব্যবস্থাকে সেইজন্য পুনরায় তাহার পূর্বতন বিশুদ্ধতায় দৃঢ় করিতে হইবে, নহিলে আমাদের সমাজের কল্যাণ নাই— রবীন্দ্রনাথ এই কথাটিই ঘোষণা করিতেন।
এখানে একটি কথা বলিয়া রাখি। আধুনিক নব্য হিন্দুদলের গোঁড়া হিঁদুয়ানির পৃষ্ঠপোষক রবীন্দ্রনাথ কোনো অবস্থাতেই ছিলেন না। যাহা আছে তাহাই বেশ আছে এবং থাকিবে, এ কথা তিনি কোথাও বলেন নাই। ‘ব্রাহ্মণ’ নামক প্রবন্ধে তিনি স্পষ্টই বলিয়াছিলেন যে, কায়স্থ সুবর্ণবণিক প্রভৃতি জাতিরা যদি দ্বিজপদবাচ্য না হন তবে ব্রাহ্মণ দাঁড়াইবার বল পাইবেন না। তাঁহার ভাব ছিল এই যে, সমাজকে দেশবোধে পূর্ণ হইয়া উঠিয়া একটা শক্তি হইয়া উঠিতে হইবে, যাহার মধ্যে প্রত্যেক ব্যক্তি আপনার একটা গৌরব অনুভব করিতে পারিবে।
কিন্তু সেইজন্য এ কথা বলিতে হইবে যে, এমন করিয়া দেখা কেবলমাত্র আপনার ভাবের দ্বারাই দেখা। ভাব যতই প্রবল হয়, বাস্তবকে সে ততই অবজ্ঞার দ্বারা দূরে খেদাইয়া রাখে। ভাবুকের ভাব যে তাহারই একটি বিশেষ শক্তি, অন্যের যে তাহা নাই এবং অন্য লোক যে তাহার সঙ্গে সায় দিতেও অক্ষম, সে কথা এই শ্রেণীর ভাবুক চিন্তার মধ্যেই আনেন না। ক্রমাগত বাস্তবক্ষেত্রে তাই এই ভাবুকদের আঘাত খাইতে হয় এবং ক্রমে তাঁহারা বুঝিতে পারেন যে, বাস্তবের সঙ্গে কারবার করিতে হইলে বিকারকে মিথ্যাকে কদাচারকে মন হইতে আড়াল করিয়া রাখিলে চলে না— তাহাদের কঠিন আঘাত দেওয়াই দরকার। প্রকাণ্ড একটি বিশ্বসত্যের মধ্যে সমস্ত কর্মকে অনুষ্ঠানকে প্রতিষ্ঠানকে আবৃত করিয়া না দেখিলে অসত্যে সত্যে, অনিত্যে নিত্যে এমন গোল পাকাইয়া থাকে যে, কাজের পথে এক পা’ও অগ্রসর হওয়া যায় না।
গোরাকে বাস্তবক্ষেত্রে ক্রমাগত টানিয়া গ্রামের ভিতরে ঘুরাইয়া নানা উপায়ে তাহার সুকঠিন ভাবুকতার দুর্গটিকে কবির সজোরে ভাঙিতে হইয়াছে— সে যে এমন একটি ভাবের দ্বারা আবিষ্ট হইয়া আছে, যাহা দেশের কাহারও মধ্যে নাই, তাহার নিজের জন্মবৃত্তান্তই চোখে আঙুল দিয়া তাহাই সর্বশেষে তাহাকে দেখাইয়া দিল। তখন সে ভারতবর্ষকে যে উদার সত্যদৃষ্টিতে দেখিল তাহা বিশেষভাবে হিন্দুর ভারতবর্ষ নহে, কিন্তু সমস্ত মানবজাতির মহাসম্মিলনক্ষেত্র।
রবীন্দ্রনাথকেও এক সময়ে খুব উগ্র স্বাদেশিক উত্তেজনা হইতে সরিয়া আসিয়া আবার দেশকে তাহার যথার্থ স্বরূপে এবং আপনার সাধনাকে তাহার যথার্থ সত্যে দেখিতে হইয়াছিল।
এখানে একটি ঘটনার উল্লেখ করা প্রয়োজন। বঙ্গদর্শন-সম্পাদনের দ্বিতীয় বৎসরে ৭ই অগ্রহায়ণ ১৩০৯ সালে কবির স্ত্রীবিয়োগ হয়।
এ আঘাত তাঁহার চিত্তকে খুব কঠিন ত্যাগের দিকে, আত্মোৎসর্গের দিকেই অগ্রসর করিয়া দিল। তখন হইতেই সংসার হইতে তিনি একপ্রকার বিচ্ছিন্ন। আপনার শক্তি সামর্থ্য অর্থ সময় সমস্তের দ্বারা তাঁহার ত্যাগের তপস্যাকে পূর্ণ করিতে লাগিলেন।
স্ত্রীবিয়োগের পর, বৎসর যাইতে না যাইতেই মধ্যমা কন্যার মৃত্যু হইল। তাহাকে বায়ুপরিবর্তন করাইবার জন্য যখন তিনি আলমোড়া পাহাড়ে ছিলেন তখন একটি নূতন কাব্য সেখানে রচনা করিয়াছিলেন, তাহার নাম ‘শিশু’। পীড়িতা কন্যা, মাতৃহীন শিশুপুত্র শমী, কবির কাছে পিতার এবং মাতার উভয়ের স্নেহ লাভ করিয়াছিল। সেই একটি গভীর স্নেহ হইতে উৎসারিত এই কাব্যটি বাৎসল্যরসে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে। পুত্রের মধ্যে আপনার কল্পনা প্রবণ বালকহৃদয়ের সুখদুঃখ, জাগিয়া এই কাব্যে শিশুজীবনের আনন্দলোককে উদ্ঘাটিত করিয়াছে।
খোকা মাকে শুধায় ডেকে,
‘এলেম আমি কোথা থেকে,
কোন্খেনে তুই কুড়িয়ে পেলি আমারে?’
মা শুনে কয় হেসে কেঁদে
খোকারে তার বুকে বেঁধে,
‘ইচ্ছা হয়ে ছিলি মনের মাঝারে!’
মায়ের বাল্যের সমস্ত খেলাধূলা পূজা-অর্চনা ও যৌবনের তরুণতার মধ্যে শিশু ছড়াইয়া ছিল— সে একটি বিশ্বের চিরনবীনতার রহস্যে মণ্ডিত ভাব, বিশ্বের আনন্দ-উৎস হইতে মূর্তি ধরিয়া প্রকাশ পাইয়াছে । এ সেই বৈষ্ণব মাধুর্যতত্ত্ব— ভগবানকে যাহারা বাৎসল্যরসের ভিতর দিয়া দেখে তাহাদের সেই মাধুর্যের স্রোতটি ইহার মধ্যে আগাগোড়া প্রবাহিত ।
রঙিন খেলেনা দিলে ও রাঙা হাতে
তখন বুঝি রে বাছা, কেন যে প্রাতে
এত রঙ খেলে মেঘে, জলে রঙ ওঠে জেগে,
কেন এত রঙ লেগে ফুলের পাতে—
রাঙা খেলা দেখি যবে ও রাঙা হাতে।
কবি যে তাঁহার স্বাদেশিকতার অবস্থায় হিন্দুসমাজের গুণকীর্তন করিতেন তাহার একটা কারণ এই যে, আমাদের দেশের সমস্ত সম্বন্ধের মধ্যে একটা অনন্তের রহস্যবোধ আছে। অনন্ত যে মুহূর্তে মুহূর্তে সমস্ত সৌন্দর্যকে সমস্ত মানবসম্বন্ধকে রন্ধ্র, করিয়া আপনার অপরূপ প্রকাশকে ধ্বনিত করিয়া তুলিতেছেন, হিন্দুর চিত্ত সে কথা গভীরভাবে স্বীকার করিয়া থাকে। স্বামীকে তাই দেবতারূপে পূজা করা হিন্দু সতী স্ত্রীর পক্ষে স্বাভাবিক, পত্নীর মধ্যেও হিন্দু স্বামী জগতের সৌন্দর্য ও কল্যাণের অধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মীর প্রতিমা সন্দর্শন করিয়া থাকেন। পুত্রের মধ্যে গোপাল রূপে ভগবান পিতার সঙ্গে লীলা করেন, কন্যার মধ্যে তাঁহার অন্নপূর্ণা মাতৃমুর্তি প্রত্যক্ষ হইয়া উঠে। কোনো সম্বন্ধই প্রয়োজনের সম্বন্ধ নয়, সে অনাদিকালের সম্বন্ধ, সে জন্মজন্মান্তরের সম্বন্ধ এবং তাহারই মধ্যে দেবতার প্রকাশ— হিন্দুর অবতারবাদী ভক্তিপ্রবণ হৃদয় এ কথা না বলিয়া থাকিতে পারে না। বৈষ্ণবধর্মের ভিতরকার এইটিই আসল কথা— ভগবানকে নানা রসে নানা সম্বন্ধে উপলব্ধি করা। ‘নৌকাডুবি’ উপন্যাসটি ইহার অনতিকাল পরেই লিখিত— তাহার মধ্যে এই দিকটাই দেখানো হইয়াছে। সেই উপন্যাসের নায়িকা কমলা যখন জানিল যে রমেশ তাহার স্বামী নহে, তখন এক মুহূর্তেই তাহার রমেশের সঙ্গে সম্বন্ধ ঘুচিয়া গেল— সে যে ব্যক্তিকে ভালো বাসে নাই, স্বামীকে ভালো বাসিয়াছে— সেই স্বামী যখন ব্যক্তিবিশেষ নয় তখন তাহার প্রতি হৃদয়ের কোনো অনুরাগ তাহার থাকিতেই পারে না। তার পর দাসীবেশে যখন সে আপন স্বামীর আলয়ে ছিল তখনও কেবলমাত্র গোপন পূজার দ্বারা সে আপনাকে চরিতার্থ জ্ঞান করিয়াছে, আর কিছুই তাহার পক্ষে প্রয়োজন হয় নাই। হিন্দুভাবের খুব গভীরতার মধ্যে প্রবেশ না করিলে এ রকমের জিনিস কবির হাত হইতে বাহির হইতেই পারিত না।
১৩১২ সালে বঙ্গব্যবচ্ছেদ উপলক্ষে দেশব্যাপী যে তুমুল আন্দোলন উপস্থিত হইল, রবীন্দ্রনাথ সেই আন্দোলনের একজন প্রধান উদ্যোগী ছিলেন। সংগীতের দ্বারা, বক্তৃতার দ্বারা, তিনি দেশবাসীর চিত্তকে দেশের আদর্শ ও সত্যের দিকে জাগাইয়া তুলিলেন। তখন স্বাদেশিকতার জীবনের মধ্যাহ্নকাল। কবির বীণা তখন রুদ্রসুরে বাঁধা; তিনি ক্রমাগত ত্যাগের, কঠিনকর্মভার গ্রহণের কথাই আমাদিগকে শুনাইতেছিলেন।
এই সময়ে তাঁহার যে-সকল গদ্য রচনা বাহির হইয়াছে তাহাদের তুলনা নাই। দু-একটি স্থান এখানে তুলিয়া দিলে আশা করি পাঠকদের বিরক্তি উৎপাদন করিবে না:
'যিনি আমাদের দেশের দেবতা, যিনি আমাদের পিতামহদের সহিত আমাদিগকে এক সূত্রে বাঁধিয়াছেন, যিনি আমাদের সন্তানের মধ্যে আমাদের সাধনাকে সিদ্ধিদান করিবার পথ মুক্ত করিতেছেন··· দেশের অন্তর্যামী সেই দেবতাকে··· এখনো আমরা সহজে প্রত্যক্ষ করিতে পারি নাই। যদি অকস্মাৎ কোনো বৃহৎ ঘটনায়, কোনো মহান্ আবেগের ঝড়ে, পর্দা একবার একটু উড়িয়া যায়, তবে এই দেবাধিষ্ঠিত দেশের মধ্যে হঠাৎ দেখিতে পাইব, আমরা কেহই স্বতন্ত্র নহি, বিচ্ছিন্ন নহি— দেখিতে পাইব, যিনি যুগযুগান্তর হইতে আমাদিগকে এই সমুদ্রবিধৌত হিমাদ্রি-অধিরাজিত উদার দেশের মধ্যে এক ধনধান্য—এক সুখদুঃখ— এক বিরাট প্রকৃতির মাঝখানে রাখিয়া নিরন্তর এক করিয়া তুলিতেছেন, সেই দেশের দেবতা দুর্জেয়, তাঁহাকে কোনোদিন কেহই অধীন করে নাই··· তিনি ইংরেজ রাজার প্রজা নহেন·· তিনি প্রবল, তিনি চিরজাগ্রত— ইহার এই সহজ মুক্ত স্বরূপ দেখিতে পাইলে তখনই আনন্দের প্রাচুর্যবেগে আমরা অনায়াসেই পূজা করিব, ত্যাগ করিব, আত্মসমর্পণ করিব।·· তখন দুর্গম পথকে পরিহার করিব না, তখন পরের প্রসাদকেই জাতীয় উন্নতিলাভের চরম সম্বল মনে করাকে পরিহাস করিব এবং অপমানের মূল্যে আশু ফললাভের উঞ্ছবৃত্তিকে অন্তরের সহিত অবজ্ঞা করিতে পারিব।’[২]
ঐ বৎসরে বিজয়াসম্মিলনের বক্তৃতার অগ্নিময়ী বাণী আমাদের অন্তরে এখনও দু-একটা স্ফুলিঙ্গ রক্ষা করিয়াছে। সে-সকল বাণী স্মরণ করিলে সমস্ত শরীর রোমাঞ্চে কণ্টকিত হইয়া উঠে:
‘ঈশ্বরের কৃপায় আজ বিজয়ার মিলনকে আমরা নূতন করিয়া বুঝিলাম— এতদিন আমরা তাহার যথাযোগ্য আয়োজন করি নাই।··· আজ বুঝিয়াছি যে মিলন আমাদিগকে বরদান করিবে, জয়দান করিবে, অভয়দান করিবে, সে মহামিলন গৃহপ্রাঙ্গণের মধ্যে নহে— সে মিলন দেশে। সে মিলনে কেবল মাধুর্যরস নহে, সে মিলনে উদ্দীপ্ত অগ্নির তেজ আছে— তাহা কেবল তৃপ্তি নহে, তাহা শক্তি দান করে।···
‘বাংলাদেশে চিরকাল বাস করিয়াও বাংলাদেশের এমন অখণ্ড স্বরূপ আমরা আর কখনো দেখি নাই।···সেই জন্যই আজ আমাদের চিরন্তন দেবমন্দিরে কেবল ব্যক্তিগত পূজা নহে, সমস্ত দেশের পূজা উপস্থিত হইতেছে।··· আজ হইতে আমাদের সমস্ত সমাজ যেন একটি নূতন তাৎপর্য গ্রহণ করিতেছে। আমাদের গার্হস্থ্য, আমাদের ক্রিয়াকর্ম, আমাদের সমাজধর্ম একটি নূতন বর্ণে রঞ্জিত হইয়া উঠিতেছে— সেই বর্ণ আমাদের সমস্ত দেশের নব-আশা- প্রদীপ্ত হৃদয়ের বর্ণ। ধন্য হইল এই ১৩১২ সাল, বাংলাদেশের এমন শুভক্ষণে আমরা যে আজ জীবন ধারণ করিয়া আছি আমরা ধন্য হইলাম।·· মনে রাখিতে হইবে, আজ স্বদেশের স্বদেশীয়তা আমাদের কাছে যে প্রত্যক্ষ হইয়া উঠিয়াছে ইহা রাজার কোনো প্রসাদ বা অপ্রসাদের উপর নির্ভর করে না; কোনো আইন পাস হউক বা না হউক, বিলাতের লোক আমাদের করুণোক্তিতে কর্ণপাত করুক বা না করুক, আমার স্বদেশ— আমার চিরন্তন স্বদেশ, আমার পিতৃপিতামহের স্বদেশ— আমার সন্তানসন্ততির স্বদেশ, আমার প্রাণদাতা শক্তিদাতা সম্পদদাতা স্বদেশ। কোনো মিথ্যা আশ্বাসে ভুলিব না, কাহারো মুখের কথায় ইহাকে বিকাইতে পারিব না, একবার যে হস্তে ইহার স্পর্শ উপলব্ধি করিয়াছি সে হস্তকে ভিক্ষাপাত্র বহনে আর নিযুক্ত করিব না— সে হস্ত মাতৃসেবার জন্য সম্পূর্ণভাবে উৎসর্গ করিলাম।··· যে পথ কঠিন, যে পথ কণ্টকসংকুল, সেই পথে যাত্রার জন্য প্রস্তুত হইয়াছি।’