রবীন্দ্রনাথ (১৯৬০)/৬
৬
‘খেয়া’র কবিতার এই সময়েই আরম্ভ। এই ফলাফলবিবেচনাহীন ত্যাগই, ‘রাজার দুলাল যাবে আজি মোর ঘরের সমুখ-পথে’ কবিতাটিতে সুন্দরভাবে প্রকাশ পাইয়াছে।
ঘোমটা খসায়ে বাতায়নে থেকে
নিমেষের লাগি নিয়েছি মা দেখে,
ছিঁড়ি মণিহার ফেলেছি তাহার
পথের ধুলার ’পরে।
মোর হার-ছেঁড়া মণি নেয় নি কুড়ায়ে,
রথের চাকায় গেছে সে গুঁড়ায়ে,
চাকার চিহ্ন ঘরের সমুখে
পড়ে আছে শুধু আঁকা।
আমি কী দিলেম কারে জানে না সে কেউ—
ধুলায় রহিল ঢাকা।
তবু রাজার দুলাল গেল চলি মোর
ঘরের সমুখপথে,
মোর বক্ষের মণি না ফেলিয়া দিয়া
রহিব বলো কী মতে?
“আগমন” কবিতাটিতে ‘বাংলা দেশের অখণ্ড স্বরূপের’ এই প্রচণ্ড আবির্ভাবের কথাই লিখিতে হইয়াছে। এই রাজার আগমনের অনেক আভাস ইঙ্গিত অনেক দিন হইতেই পাওয়া যাইতেছিল, তাঁহার দূতের পদধ্বনিকে বাতাসের শব্দ, তাঁহার চাকার ঝনঝনিকে মেঘের গর্জন মনে করিয়া দেশ আলস্যে সুপ্ত ছিল। রাজা যখন আসিলেন তখন সমস্ত রিক্ত— কোনো আয়োজনই নাই। কিন্তু সেই ভালো হইল, দরিদ্র ঘরে যাহা-কিছু আছে তাহাই দিয়া তাঁহাকে বরণ করিতে হইল এই ভালো— ত্যাগ ইহাতেই পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল।
“দান” কবিতাটিও ঐ একই সময়ের লেখা। তাহাতেও ঐ ত্যাগকঠিন সাধনার রুদ্রগীতি ফুটিয়াছে।
ভেবেছিলেম চেয়ে নেব,
চাই নি সাহস ক’রে—
সন্ধেবেলায় যে মালাটি
গলায় ছিলে প’রে,
আমি চাই নি সাহস ক’রে।
মালা লইতে আসিয়া চাহিয়া দেখেন যে
এ তো মালা নয় গো, এ যে
তোমার তরবারি।
এই তরবারি, এই বেদনা, এই সুকঠিন ত্যাগ, ইহাকেই জীবনময় গ্রহণ করিবার কথা ‘খেয়া’র আরম্ভের কথা।
এমন সময় হঠাৎ কবি আন্দোলন হইতে আপনাকে বিচ্ছিন্ন করিয়া লইলেন। ন্যাশন্যাল বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি সকল উদ্যোগের অগ্রণী হইয়া, পল্লী-সমিতি স্বদেশী-সমাজ প্রভৃতি গঠনের প্রস্তাব ও পরামর্শ ও কিছু কিছু কাজ আরম্ভ করিয়া দিয়া, যখন সমস্ত কর্ম হইতে তিনি সরিয়া পড়িলেন, তখন তাঁহার পরম ভক্তগণও একটু বিস্মিত হইয়াছিলেন। এ একেবারে অপ্রত্যাশিত। বেশ মনে আছে, দেশের লোকের কাছে ইহার জন্য তাঁহাকে কী নিন্দাবাদ, কী বিদ্রূপই সহ্য করিতে হইয়াছিল। কিন্তু কেন এরূপ করিলেন?
ইহার উত্তর আমি পূর্বেই দিয়াছি। তিনি এক দিকে ক্রমাগত আপনার কল্পনা-রচিত ভাবের মধ্যে দেশকে যে রূপে উপলব্ধি করিবার চেষ্টা করিতেছিলেন, কর্মক্ষেত্রে নামিয়া সে ভাব বাস্তবের আঘাতে ক্রমাগতই ভাঙিয়া যাইবার দশায় পড়িয়াছিল। অন্য দিকে যে তপোবনের বিশ্ববোধের সাধনায়, আপনাকে সকল হইতে বঞ্চিত করিয়া সকলকে আপনার মধ্যে অনুভব করিবার সাধনায়, তিনি তপস্যা করিবেন সংকল্প করিয়া আশ্রম প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন, সে চিরজীবনের তপস্যা কর্মের সাময়িক উত্তেজনায় ও উন্মত্ততায় আবিল হইয়া বিলুপ্তপ্রায় হইবার উপক্রম করাতেই তাঁহার ক্ষুধিত চিত্ত আপনাকে সকল বন্ধন হইতে বিচ্ছিন্ন করিতে দ্বিধামাত্র বোধ করিল না।
এই ঘটনাই কবিজীবনে বারম্বার ঘটিয়াছে। কেবলই বন্ধনে জড়ানো এবং কেবলই বন্ধন ছিন্ন করা। কখনো সৌন্দর্যে, কখনো প্রেমে, কখনো স্বদেশের কর্মক্ষেত্রে, যখনই যাহাতে ঢুকিয়াছেন— কী তীব্র আবেগে তাহাদের অনুরঞ্জিত করিয়া অপরূপ করিয়া দেখিয়াছেন! বাস, ঐখানেই সমাপ্তি। বীণায় যেই তাহার পরিপূর্ণ সংগীত ঝংকৃত হইয়া উঠিয়াছে, অমনি কি তার ছিঁড়িল এবং আবার নুতন তারে নুতন গান গাহিবার জন্য সমস্ত প্রাণ ব্যাকুল হইয়া উঠিল!
‘খেয়া’র অবশিষ্ট কবিতায় আবার একটি নূতন অপেক্ষার বেদনা।
আমার গোধূলি-লগন এল বুঝি কাছে
গোধূলি লগন রে!
বিবাহের রঙে রাঙা হয়ে আসে
সোনার গগন রে!
স্বদেশের কর্মক্ষেত্রের কাছে এবারে বিদায়:
বিদায় দেহ, ক্ষম আমায় ভাই!
কাজের পথে আমি তো আর নাই!
এগিয়ে সবে যাও-না দলে দলে,
জয়মাল্য লও-না তুলি গলে,
আমি এখন বনচ্ছায়াতলে
অলক্ষিতে পিছিয়ে যেতে চাই—
তোমরা মোরে ডাক দিয়ো না ভাই!···
মেঘের পথের পথিক আমি আজি,
হাওয়ার মুখে চলে যেতেই রাজী,
অকুল-ভাসা তরীর আমি মাঝি
বেড়াই ঘুরে অকারণের ঘোরে—
তোমরা সবে বিদায় দেহ মোরে।
আবার সেই সর্বানুভূতির কথা! আমি আমার এই প্রবন্ধের গোড়ায বলিয়াছিলাম যে, এই সর্বানুভূতিই কবির জীবনের ও কাব্যের মূল সুর। তাঁহার বীণায় সরু মোটা অন্যান্য তারে কখনো প্রেমের কখনো সৌন্দর্যের কখনো স্বদেশানুরাগের বিচিত্রগম্ভীর বিশ্বব্যাপী সুদূরবিস্তৃত ঝংকার বাজিয়াছে, কিন্তু সকল সুর ছাপিয়া এই সর্বানুভূতির মূলরাগিণীই কেবলই জাগিয়া জাগিয়া উঠিয়াছে। জলস্থল-আকাশ সমস্ত মনুষ্যলোককে আপনার চৈতন্যের আনন্দময় বিস্তারের দ্বারা পরিপূর্ণরূপে উপলব্ধির জন্যই তিনি এই তপোবন গড়িয়াছিলেন। কিন্তু অনেক দিন পর্যন্ত এই আশ্রমেরও গভীরতর সাধনাটি কী তাহা তাঁহার ধারণার মধ্যে সুস্পষ্ট হইয়া উঠে নাই। আশ্রমের সঙ্গে যাঁহারা দীর্ঘকাল সংযুক্ত আছেন তাঁহারা জানেন যে, স্বাদেশিক উত্তেজনার একটা ঢেউ ইহার উপর দিয়াও বহিয়া গিয়াছিল। জানি না বিধাতা বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে কবির চিত্তবীণাকে কেমন নিগূঢ় উপায়ে একই ছন্দে বাঁধিয়া দিয়াছেন— যে জন্য কোনো খণ্ডতার মধ্যে তাঁহার চিত্ত দীর্ঘকাল থাকিতে পারে না, নানা পথ ঘুরিয়া অবশেষে আবার ইহারই মধ্যে প্রত্যাবর্তন করে।
আকাশ ছেয়ে মন-ভোলানো হাসি
আমার প্রাণে বাজালো আজ বাঁশি।
লাগল আলস পথে চলার মাঝে,
হঠাৎ বাধা পড়ল সকল কাজে,
একটি কথা পরান জুড়ে বাজে—
‘ভালোবাসি হায় রে ভালোবাসি’।
সবার বড়ো হৃদয়-হরা হাসি।
কিন্তু এ ওজর তো দেশের লোকে শুনিবে না। এ যে কর্মভীরুতা নয়, কিন্তু কর্মকে অতিক্রম করিয়া জীবনকে অনন্তের মধ্যে, আনন্দের মধ্যে একেবারে বিলীন করিয়া দেওয়া— এ কথা কাহাকেও বুঝাইয়া বলিবার নয়। তাই
আমার দলের সবাই আমার পানে
চেয়ে গেল হেসে—
লাজের ঘায়ে উঠিতে চাই,
মনের মাঝে সাড়া না পাই,
মগ্ন হলেম আনন্দময়
অগাধ অগৌরবে
পাখির গানে— বাঁশির তানে—
কম্পিত পল্লবে!···
ভুলে গেলেম কিসের তরে
বাহির হলেম পথের ’পরে,
ঢেলে দিলেম চেতনা মোর
ছায়ায় গন্ধে গানে।
তখন দেখি, আর-একটি গভীর নিবিড় স্পর্শ সেই বিপুল বিরতির ভিতর হইতে পাওয়া গেল:
চেয়ে দেখি কখন এসে
দাঁড়িয়ে আছ শিয়রদেশে
তোমার হাসি দিয়ে আমার
অচৈতন্য ঢাকি।
আমি জোর করিয়া বলিতেছি যে, এ কথা মনে করা ভুল হইবে যে, আপনার চিরাভ্যস্ত সৌন্দর্যপ্রিয় কবি-প্রকৃতির জন্য তিনি এমন করিয়া স্বদেশের কর্মক্ষেত্র হইতে বিদায় লইলেন। ভোগের জীবন অনেক দিনই শেষ হইয়া গিয়াছে— সে আমরা ‘কল্পনা’ ‘ক্ষণিকা’তেই দেখিয়া আসিয়াছি— কর্মের জীবন যখন তাহার সর্বোচ্চ সফলতা লাভ করিয়াছে তখন সেই কর্মের ফল হইতে নিজেকে বঞ্চিত করিবার মধ্যে একটা কঠিন আত্মপীড়ন আছে সে কথা আপনারা বিস্মৃত হইবেন না। সেই পীড়া এবং মুক্তির আনন্দ, সেই বৃহৎ উদার বিশ্বভুবনের মধ্যে আপনার অস্তিত্বকে জলাঞ্জলি দিবার বৃহৎ আনন্দ, এ দুইই ‘খেয়া’র কবিতার মধ্যে একসঙ্গে আছে। ‘কৃপণ’ বলিতেছে— আমি কেবল পাইতেই থাকিব এই আশায় রাজার দর্শনে বাহির হইয়াছিলাম, কিন্তু তিনি যখন আমার কাছে চাহিলেন তখন বেশি কিছু দিতে পারিলাম না; একটি কণা মাত্র দিলাম; ঘরে আসিয়া দেখি তাহাই সোনা হইয়া গিয়াছে! তখন কাঁদিয়া বলি:
তোমায় কেন দিই নি আমার
সকল শূন্য ক’রে!
তার মানে, আপনার দিকে কিছুই রাখিলে চলিবে না— আমার কাজ, আমার দেশ, আমাদের সফলতা, আমাদের শক্তি— ‘আমার’ ‘আমার’ এই বন্ধনের মধ্যে সমস্ত বিশ্বভুবনের নিবিড় আনন্দস্বরূপ জীবনের সেই অধীশ্বর নাই। এইটিকেই খুব শক্ত আঘাতে ছিন্ন করিলে তখনই তাঁহার আবির্ভাব সর্বত্র প্রত্যক্ষ হইয়া উঠিবে।
হেরে তোমার করব সাধন,
ক্ষতির ক্ষুরে কাটব বাঁধন,
শেষ দানেতে তোমার কাছে
বিকিয়ে দেব আপনারে।
আপনার বন্ধনই বন্ধন; এই আপনাকে যত বড় নামই দাও, তাহাকে যত জ্ঞান যত কর্ম যত মহত্ত্ব যত সৌন্দর্য দিয়াই আবৃত কর না কেন, সে ‘বন্দী’র অবস্থা— আপনার কৃতকীর্তির মধ্যে আপনি বন্দী হইয়া থাকা।
“বন্দী” কবিতাটিতে কবি তাহাই বলিতেছেন:
ভেবেছিলাম আমার প্রতাপ
করবে জগৎ গ্রাস,
আমি রব একলা স্বাধীন
সবাই হবে দাস।
তাই গড়েছি রজনী-দিন
লোহার শিকলখানা—
কত আগুন কত আঘাত
নাইকো তার ঠিকানা।
গড়া যখন শেষ হয়েছে
কঠিন সুকঠোর
দেখি আমায় বন্দী করে
আমারই এই ডোর।
“ভার” কবিতাটিতেও ঐ একই কথা। আপনার দিকেই সমস্ত ভার— তাঁহার দিকেই মুক্তি।
এ বোঝা আমার নামাও, বন্ধু, নামাও—
ভারের বেগেতে ঠেলিয়া চলেছে,
এ যাত্রা মোর থামাও।
‘খেয়া'র আর একটিমাত্র কবিতার উল্লেখ করিয়া আমার এ সমালোচনা শেষ করিব— সেটি “সব-পেয়েছির দেশ”।
উপনিষদে অনন্ত সত্যস্বরূপকে আনন্দের দ্বারা উপলব্ধি করিবার কথা আছে। যতো বাচো নিবর্তন্তে— বাক্য যাঁহা হইতে নিবৃত্ত হয়— আনন্দং ব্রহ্মণো বিদ্বান্ ন বিভেতি কুতশ্চন— ব্রহ্মের সেই আনন্দকে জানিয়া সাধক কিছু হইতেই ভয় পান না।
উপনিষদ্ আনন্দস্বরূপের উপলব্ধিকে কেবল অন্তরের জিনিস করিয়া রাখেন নাই। উপনিষদে নিখিল সত্যের সঙ্গে আনন্দের পরিপূর্ণ যোগ, সত্যের সঙ্গে রসের কোনো বিচ্ছেদ নাই। এই রস পাইয়াই লোকে আনন্দী হয়।
সেইজন্য এই অনন্ত সত্য এবং অনন্ত আনন্দকে উপনিষদ্ ‘এষঃ’ বলিয়াছেন। এষঃ অর্থে ইনি। এষহ্যেবানন্দয়াতি। ইনিই আনন্দ দিতেছেন। ইনি কে? ইনি কোথায়?
স এবাধস্তাৎ স উপরিষ্টাৎ স পশ্চাৎ স পুরস্তাৎ স দক্ষিণতঃ স উত্তরতঃ— ইনি এই-যে অধে, ইনি এই যে ঊর্ধ্বে, ইনি এই পশ্চাতে, ইনি এই সম্মুখে, ইনি দক্ষিণে, ইনি উত্তরে— এই সমস্তই আনন্দরূপমমৃতম্— অনন্ত আনন্দে অনন্ত অমৃতে পরিপূর্ণ।
আমরা দেখিয়া আসিয়াছি যে, জগতের এই রসময় উপলব্ধি কবির একেবারে প্রকৃতিগত জিনিস। বস্তুতঃ সেইজন্য উপনিষদের মধ্যে কবি যত মজিয়াছেন এমন আর দ্বিতীয় কোনো গ্রন্থের মধ্যে নহে।
“সব-পেয়েছির দেশ” এই ‘এষহ্যেবানন্দয়াতি’র উপলব্ধির কবিতা।
আমরা জানি যে, সৌন্দর্যবোধ যতক্ষণ পর্যন্ত পরিপূর্ণ না হয়, অর্থাৎ যতক্ষণ পর্যন্ত তাহার মধ্যে ভোগ-প্রবৃত্তির মোহ মিশিয়া থাকে, ততক্ষণ আমরা অপরূপকাল্পনিক ইন্দ্রিয়গত সৌন্দর্যকে সৌন্দর্য বলি এবং শুচিবায়ুগ্রস্তের ন্যায় পৃথিবীর বারো আনা জিনিসেই সৌন্দর্যের অভাব দেখিয়া খুঁত খুঁত করিতে থাকি। কবির প্রথম অবস্থার কাব্যের মধ্যে সৌন্দর্যবোধের এই তীব্রতা ছিল; তখন সৌন্দর্যবোধ বিশ্বমঙ্গলের সঙ্গে, বিশ্বসত্যের সঙ্গে সংযুক্ত হয় নাই। ‘ক্ষণিকা’য় আমরা প্রথম দেখিলাম ভোগবিরত সরল গ্রাম্য সৌন্দর্যের পরিপূর্ণ উপলব্ধি। ‘চৈতালি’ হইতে সুর বদলাইয়া আসিতেছিল, কিন্তু ‘ক্ষণিকা’তেই শেষাশেষি সৌন্দর্যের ‘কল্যাণী’ মূর্তি উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল।
রূপসীরা তোমার পায়ে
রাখে পূজার থালা,
বিদুষীরা তোমার গলায়
পরায় বরমালা।
তার পর ক্রমেই এই কল্যাণময় সৌন্দর্যবোধ বিশ্বসত্যের সঙ্গে মিলিত হইতে চলিয়াছে। ‘সব-পেয়েছির দেশে’ ক্ষণিকা হইতে আর-এক ধাপ উপরে উঠা গিয়াছে। এখানে, ‘যাহা-কিছু প্রকাশ পাইতেছে তাহাই পরিপূর্ণ আনন্দরূপ’ উপনিষদের এই কথাই কবির উপলব্ধির মধ্যে আসিয়া পৌঁছিয়াছে।
এই ‘সব-পেয়েছির দেশে' অসাধারণত্ব কিছুই নাই, সুতরাং
এক রজনীর তরে হেথা
দূরের পান্থ এসে
দেখতে না পায় কী আছে এই
সব-পেয়েছির দেশে।
তবে ‘সব-পেয়েছি’ কিসে? এই-যে
পথের ধারে ঘাস উঠেছে
গাছের ছায়াতলে,
এই-যে
স্বচ্ছ তরল স্রোতের ধারা
পাশ দিয়ে তার চলে,
এই-যে
কুটিরেতে বেড়ার ’পরে
দোলে ঝুম্কা লতা,
সকাল হ’তে মৌমাছিদের
ব্যস্ত ব্যাকুলতা—
ইহারই মধ্যে সব পেয়েছি, ইহারই মধ্যে পরমা তৃপ্তি, এইখানেই কবি তাঁহার শেষজীবনের কুটিরখানি তুলিয়াছেন।
এই সাধনার মধ্যে কবি যে এখনও নিমগ্ন হইয়া আছেন— সকল সত্যকে রসময় করিয়া প্রত্যক্ষ উপলব্ধি করিবার সাধনায়, সমস্ত বিশ্বপ্রকৃতিকে মানবপ্রকৃতিকে মানব-ইতিহাসকে একের মধ্যে অখণ্ড করিয়া বোধ করিবার সাধনায়, তাহা কি আর বলিয়া দিতে হইবে? ‘রাজা’ নাট্যে সৌন্দর্যবোধের পরিপূর্ণতার অভাবের বেদনা সুদর্শনার চরিত্রের মধ্যে কবি দেখাইয়াছেন— সে সুবর্ণের চোখ-ভোলানো রূপ দেখিয়া মজিল এবং তাহার স্বামীর ‘সব-রূপ-ডোবানো রূপ’কে প্রবৃত্তির মোহে পড়িয়া অবজ্ঞা করিল! সেই আপনার প্রকৃতির বিশেষ একটি আবরণের মধ্যে বাঁধা থাকিবার জন্য, সেই প্রবল আত্মাভিমানের জন্য, তাহার কী জ্বালা, কী ভয়ংকর ছট্ফটানি। তাহার উল্টা দিকে ঠাকুরদার চরিত্রে কবি সকলের মধ্যে একটি অবাধ প্রবেশের আনন্দের ভাবকে কী উজ্জ্বল করিয়া তুলিয়াছেন! ঠাকুরদা এই নিখিল উৎসবের প্রাঙ্গণে ‘ফোটা ফুলের মেলা’র সঙ্গে সঙ্গে ‘ঝরা ফুলের খেলা’ দেখিতেছেন, নানা বিচিত্র লোকের সকল বিচিত্রতার সুরই যে একতানের মধ্যে সম্মিলিত হইতেছে ইহা অনুভব করিতেছেন।
কী আনন্দ! কী আনন্দ! কী আনন্দ!
দিবারাত্রি নাচে মুক্তি, নাচে বন্ধ।
কিন্তু সুদর্শনার যে অহংকারের চিত্র কবি অঙ্কিত করিয়াছেন তাহার মূল্য আছে। ‘রাজা’ নাট্যের ভিতরে এই অহংকারের বিশেষ একটি তত্ত্ব আছে। ইহা যদিচ আমাদের নিজেদের ভালো লাগার এক-একটি বিশেষ আয়োজনের মধ্যে ক্ষণকালীন তৃপ্তি দিয়া অবশেষে দশগুণ অতৃপ্তির বেদনাকে জাগায়, তথাপি এই অহংকারটিই আমাদের জীবনের সেই রাজার, সেই স্বামীর কামনার ধন। তিনি চান যে, এইটিই তাঁর পায়ে আমরা বিসর্জন করি। সেইজন্য সুদর্শনা যখন তাঁহাকে আঘাত করিয়া চলিয়া গেল তিনি তাহাকে নিবারণ করিলেন না। তিনি তাঁহাকে সাত রাজার সাত রিপুর টানাটানির হাত হইতে রক্ষা করিলেন, কিন্তু দেখা দিলেন না। তিনি জানেন যাহার যতখানি অহংকারের আয়োজন তাহার বেদনার গভীরতা ততখানি বেশি এবং বেদনা-অন্তে তাঁহার সঙ্গে মিলনও তাহার ততই সম্পূর্ণতর।
সুরঙ্গমা সরল বিশ্বাসী ভক্তের একটি চিত্র। তাহার প্রকৃতির মধ্যে বিচিত্রতা নাই— সে এক সময় পাপের পথে গিয়া পড়িয়াছিল, তার পর রাজার দাসী সাজিয়া সকলের সেবায় সে কৃতার্থতা লাভ করিয়াছে।
সে সুদর্শনার সঙ্গে সঙ্গে থাকিয়া সেই সরল ভক্তির সুরটি হিমবিন্দুর মতো তাহার ক্ষুব্ধ অভিমানের শিখার উপরে ধরিতে লাগিল। অহংকারের আগুন যখন বেদনার অশ্রুজলে নিভ-নিভ হইয়া আসিল তখন বেদনার মধ্যে সেই স্বামীর গোপন বীণা সুদর্শনার ভিতরে ভিতরে বাজিতেছিল। এবং সেই বীণার সুরে বিগলিত হৃদয় যখন ধূলামাটির মধ্যে, সকলের মধ্যে, নম্র নত হইয়া আপনাকে একেবারে বিসর্জ্জন দিল তখনই রাজার সঙ্গে তাহার পূর্ণ মিলন ঘটিল।[১]
বাংলাদেশ ধন্য যে এমন একটি পরিপূর্ণ জীবন তাহার সম্মুখে স্তরে স্তরে স্তবকে স্তবকে এমন করিয়া উদ্ঘাটিত হইল।
আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের সাধনা, আমাদের দেশের সাধনা, আমাদের সৌন্দর্যের সাধনা, আমাদের ধর্মের সাধনা কালে কালে যতই অগ্রসর হইতে থাকিবে ততই এই জীবনটির আদর্শ জাজ্বল্যমান হইয়া আমাদিগকে সকল সাধনার অন্তরতর ঐক্য কোথায়, সকল খণ্ডতার চরম পরিণাম পরম পূর্ণতা কোথায় তাহাই নির্দেশ করিয়া দিবে। আমি দিব্যচক্ষে দেখিতেছি যে, বিশ্বমানবের বিচিত্র সভ্যতার সকল আয়োজন সুদূর ভবিষ্যতে একদিন যখন এই ভারতবর্ষের নানা অনুষ্ঠানে পরিপূর্ণ সামঞ্জস্য লাভ করিবার জন্য সমাগত হইবে, তখন ভারতবর্ষের পূর্বপ্রান্তে এই অখ্যাত বাংলাদেশের মহাকবির মহান্ আদর্শের তলব পড়িবেই এবং বাত্যাক্ষুব্ধ সমুদ্রপথে নাবিকের চক্ষের সমক্ষে অন্ধকার রজনীতে ধ্রুবতারার দীপ্তির ন্যায় এই পরিপূর্ণ আদর্শের দিগ্ দিগন্তব্যাপী রশ্মিচ্ছটা সকল সংশয়ের অন্ধকারকে দূর করিবে।
- ↑ লেখকের ‘কাব্যপরিক্রমা’ গ্রন্থে ‘রাজা’ নাট্যের বিস্তৃত আলোচনা দ্রষ্টব্য।