রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/পূর্বকথা
পূর্ব্বকথা
ত্রিপুরা রাজ্যের ধারাবাহিক ইতিহাস রাজমালা নামক গ্রন্থে কবিতায় ভিন্ন ভিন্ন সময়ে রচিত হইয়া কৃষ্ণকিশোরমাণিক্য অবধি লিপিবদ্ধ হইয়াছে। সুতরাং রাজমালাই ত্রিপুরা রাজ্যের ইতিহাসের...মূল উপাদান। রাধাকিশোরমাণিক্যের দরবার হইতে পণ্ডিত শ্রীযুত চন্দ্রোদয় বিদ্যাবিনোদ কর্ত্তৃক রাজমালা ৬ খণ্ডে সম্পূর্ণ মুদ্রিত হয়। তৎপর বীরেন্দ্রকিশোরমাণিক্যের রাজত্বের শেষভাগে ঐতিহাসিক তথ্য সংযোজিত হইয়া রাজমালা গ্রন্থ সম্পাদনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হওয়ায়, ঐ ভার ত্রিপুরারাজ্য সম্বন্ধে বহুদর্শী সুলেখক কালীপ্রসন্ন বিদ্যাভূষণ মহাশয়ের উপর ন্যস্ত হয়। বিদ্যাভূষণ মহাশয় বর্ত্তমান মহারাজের আমলে মহারাজকুমার শ্রীল শ্রীযুত ব্রজেন্দ্রকিশোরের পরিচালনায় উক্ত গ্রন্থ রাজোচিত ভাবে সম্পাদন করিতে আরম্ভ করেন।
ক্রমে ক্রমে তৃতীয় লহর পর্য্যন্ত উক্ত পুস্তক প্রশংসার সহিত সম্পাদন করেন। ইহা গভীর পরিতাপের বিষয় যে চতুর্থ লহর (ভাগ) পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত হইয়া মুদ্রিত হইবার পূর্ব্বেই তিনি লোকান্তর প্রাপ্ত হন।
বিদ্যাভূষণ মহাশয় তদীয় গ্রন্থের প্রথম লহরে রাজমালা রচনার একটি ক্রম দিয়াছেন। এই ক্রম দৃষ্টে অনায়াসেই বুঝিতে পারা যায় তাঁহার আরও তিন লহর ছাপা বাকি রহিয়া গিয়াছে। উক্ত তিন লহর অচিরে মুদ্রিত হওয়া একান্ত আবশ্যক, অসমাপ্ত কার্য্য দ্বারা সুধীগণ মধ্যে এইরূপ একখানি ঐতিহাসিক গ্রন্থের মর্য্যাদা যথোচিতরূপে প্রকাশ পায় না বলাই বাহুল্য।
প্রথম লহর
বিষয়—দৈত্য হইতে মহামাণিক্য পর্য্যন্ত বিবরণ।
বক্তা—বাণেশ্বর, শুক্রেশ্বর ও দুর্ল্লভেন্দ্র নারায়ণ।
শ্রোতা—মহারাজ ধর্ম্মমাণিক্য।
রচনাকাল—খৃঃ পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রারম্ভ।
দ্বিতীয় লহর
বিষয়—ধর্ম্মমাণিক্য হইতে জয়মাণিক্য পর্য্যন্ত বিবরণ।
বক্তা—রণচতুর নারায়ণ।
শ্রোতা—মহারাজ অমরমাণিক্য।
রচনাকাল—খৃঃ ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগ।
তৃতীয় লহর
বিষয়—অমরমাণিক্য হইতে কল্যাণমাণিক্য পর্য্যন্ত বিবরণ।
বক্তা—রাজমন্ত্রী।
শ্রোতা—মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য।
রচনাকাল—খৃঃ সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগ।
চতুর্থ লহর
বিষয়—গোবিন্দমাণিক্য হইতে কৃষ্ণমাণিক্য পর্য্যন্ত বিবরণ।
বক্তা—জয়দেব উজীর।
শ্রোতা—মহারাজ রামগঙ্গামাণিক্য।
রচনাকাল—খৃঃ অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ।
পঞ্চম লহর
বিষয়—রাজধরমাণিক্য হইতে রামগঙ্গামাণিক্য পর্য্যন্ত বিবরণ।
বক্তা—দুর্গামণি উজীর।
শ্রোতা—মহারাজ কাশীচন্দ্রমাণিক্য।
রচনাকাল—খৃঃ ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ।
ষষ্ঠ লহর
বিষয়—রামগঙ্গামাণিক্য হইতে কাশীচন্দ্রমাণিক্য পর্য্যন্ত বিবরণ।
বক্তা—দুর্গামণি উজীর।
শ্রোতা—মহারাজ কৃষ্ণকিশোরমাণিক্য
রচনাকাল—খৃঃ ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ।
ৰহুবৎসর পূর্ব্বে আমি যখন উমাকাপ্ত একাডেমীতে ছাত্র ছিলাম তখন কবি শ্রীযুত যতীন্দ্রমোহন বাগ্চী পরিচালিত “মানসী” পত্রিকায় ‘ইতিহাসে রূপকথা’ নামে ধন্যমাণিক্যের শৈশব জীবনের একটি চিত্র আঁকিয়াছিলাম, কিন্তু ঐ লেখা ইহার পর আর অধিক অগ্রসর হয় নাই। কিন্তু তখন জানিতাম না যে ঐ লেখা এইভাবে আমাকে সমাপ্ত করিতে হইবে। এই দিক দিয়া ভাবিলে কবির উক্তি—
জীবনে যত পূজা হল না সারা
জানি হে জানি তাও হয়নি হারা
—যথার্থই মনে হয়।
জার্ম্মাণ মনীষী Mommsen-এর বিশ্ববিখ্যাত History of Rome-এর Every man's Libraryর ইংরেজী সংস্করণ-এর পুরোভাগে Carlyle-এর একটা অমর বাণী উদ্ধৃত হইয়াছে।
Consider History with the beginnings of it stretching dimly into the remote time, emerging darkly out of the mysterious eternity, the true Epic Poem.
রাজমালায় ত্রিপুরার পুরা কাহিনী বৈদিক যুগের প্রান্ত হইতে নির্গত হইয়াছে এবং তাহা কবিতায় বর্ণিত হইয়াছে। স্বীয় জয় পরাজয় ও দোষগুণের প্রবেশ দ্বারা ইহা যথার্থ ভাবেই বলা হইয়াছে মনে করা যাইতে পারে। আমি আমার ক্ষুদ্র শক্তিতে রাজমালার সেই কবিত্ব রূপকথার ভাষায় ইতিহাসের আকারে ফুটাইতে চাহিয়াছি, এক্ষণে ইহা কোমলমতি বালকগণের উপযোগী হইলেই শ্রম সার্থক জ্ঞান করিব।
এই গ্রন্থ স্বর্গীয় কালীপ্রসন্ন বিদ্যাভূষণ সম্পাদিত রাজমালার পাঠ অনুযায়ী মহারাজ কল্যাণমাণিক্য অবধি রচিত হইয়াছে, তৎপরের অংশ গোবিন্দমাণিক্য হইতে কৃষ্ণকিশোরমাণিক্য পর্য্যন্ত পণ্ডিত শ্রীযুক্ত চন্দ্রোদয় বিদ্যাবিনোদ সম্পাদিত রাজমালা অবলম্বনে রচিত। স্বর্গীয় বিদ্যাভূষণ মহাশয়ের ঐতিহাসিক তথ্য দ্বারা বিশেষ উপকৃত হইয়াছি তজ্জন্য সর্ব্বপ্রথমে তাঁহার অমর আত্মার নিকট কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করিতেছি।
এতৎ প্রসঙ্গে সাহিত্য জগতে সুপরিচিত কৈলাসচন্দ্র সিংহ মহাশয়ের নামোল্লেখ করা একান্ত কর্ত্তব্য। বহুবর্ষ পূর্ব্বে যখন বাঙ্গালা ভাষায় বর্ত্তমানের ন্যায় ঐতিহাসিক গবেষণার পথ সুগম ছিলনা তখনকার দিনে সুমার্জ্জিত ভাষায় তিনি তাঁহার “রাজমালা” প্রণয়নে বঙ্গ সাহিত্যে একটি বিশিষ্ট দান রাখিয়া গিয়াছেন। তাঁহার গবেষণা মূলক গ্রন্থ হইতে আমি অনেক সহায়তা লাভ করিয়াছি। দ্বিতীয় রাজধরমাণিক্য হইতে কৃষ্ণকিশোরমাণিক্য পর্য্যন্ত মূল রাজমালার রচনা পরিপাট্যহীন ও অনেক স্থলেই একরূপ দুর্ব্বোধ্য। সিংহ মহাশয়ের রচনা পাঠ দ্বারা ঐ ঐ অংশের ভাব গ্রহণ অনেক সময়ই সম্ভবপর হইয়াছে। কৃষ্ণকিশোরমাণিক্যের পরবর্ত্তী রাজগণের বিবরণ লইয়া আর রাজমালার নূতন ভাগ রচিত হয় নাই। সিংহ মহাশয়ের গ্রন্থ হইতে ঈশান চন্দ্রের রাজত্বের সম্পূর্ণ ও বীরচন্দ্রের আংশিক ঐতিহাসিক উপাদান সংগৃহীত হইয়াছে।
বীরচন্দ্রের অর্দ্ধ ও রাধাকিশোরের সম্পূর্ণ আলেখ্য কর্ণেল মহিমচন্দ্রের ‘দেশীয় রাজ্য’ হইতে লওয়া হইয়াছে। বীরেন্দ্রকিশোরের রাজত্বে ব্যবসায় উন্নয়ন বিষয়টি চুণ্টা প্রকাশের সুযোগ্য সম্প্রাদক শ্রীযুক্ত অপূর্ব্বচন্দ্র ভট্টাচার্য্যের ইংরাজী পুস্তক Progressive Tripura হইতে গৃহীত হইয়াছে, তজ্জন্য কৃতজ্ঞতা জানাইতেছি।
পরিশেষে পিতৃদেব স্বর্গত শীতলচন্দ্র চক্রবর্তী, এম. এ. বিদ্যানিধি প্রণীত গবেষণামূলক ত্রিপুরার প্রাচীন ইতিহাস গ্রন্থ হইতে সাহায্য লাভের কথা উল্লেখ করিতেছি। তদীয় মুখবন্ধে তিনি লিখিয়াছেন—শুক্রেশ্বর বাণেশ্বর কর্ত্তৃক বঙ্গভাষায় বিরচিত “রাজমালা” বঙ্গ সাহিত্যে প্রাচীন গ্রন্থ। ইহা চৈতন্য চরিতামৃত ও কীর্ত্তিবাসের রামায়ণের পূর্ব্ববর্ত্তী। ইহা পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে মহারাজ ধর্ম্মমাণিক্যের সময় প্রথম সঙ্কলিত হয়। ইহার প্রাচীনত্ব সম্বন্ধে ইহার প্রথম পাশ্চাত্য সার সঙ্কলন কর্ত্তা রেভাঃ লং সাহেব এইরূপ মন্তব্য করিয়াছেন:—
We may consider this then as the most ancient work in Bengali that has come down to us as the Chaitanya Charitamrita was not written before 1557 and Kirttibas subsequently translated the Ramayan...... The Rajmala of the Tipperah Family which bears all the marks of antiquity is kept with the greatest care. I have every reason to believe it to be a genuine record of the Tipperah Family. —Analysis of Rajmala.
ডাঃ ওয়াইজ তদীয় ভ্রাতার উল্লিখিত রূপ মত উদ্ধৃত করিয়া ‘রাজমালা’র কথিত প্রতিলিপি এসিয়াটিক সোসাইটি দ্বারা মুদ্রিত হইবার জন্য প্রেরণ করিলে, তদুপলক্ষে লংসাহেব কর্ত্তৃক রাজমালার সার সঙ্কলিত হইয়া তদীয় মন্তব্যসহ সোসাইটি পত্রিকায় মুদ্রিত হয়। তদীয় মন্তব্যে রাজমালাই ত্রিপুরা ইতিহাসের মূল ভিত্তিরূপে স্বীকৃত হইয়াছে।
রাজমালার সংশ্লিষ্ট উপকরণ মধ্যে হস্ত লিখিত নিম্নোক্ত পুঁথিগুলি বিশেষ উল্লেখ যোগ্য:—
১। চম্পক বিজয়
২। কৃষ্ণ মালা
৩। গাজিনামা (সমসের গাজি)
এই পুঁথিগুলি রাজমালা আফিসে অন্যান্য প্রাচীন উপাদান মধ্যে সুরক্ষিত হইয়া আসিতেছে। বিদ্যাবিনোদ সম্পাদিত রাজমালার অধুনা লুপ্তপ্রায় শেষ খণ্ডটির সহিত এইগুলি ব্যবহার করিবার জন্য রাজমালা আফিসের ভারপ্রাপ্ত কার্য্যকারক সুহৃদ্বর শ্রীযুত সত্যরঞ্জন বসু বি. এ. মহাশয় ও তদীয় সহকারী স্নেহভাজন শ্রীমান্ মহেন্দ্রনাথ দাসের বিশেষ সহায়তা লাভ করায় আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করিতেছি।
পরিশেষে বক্তব্য এই, ত্রিপুরার প্রাচীন কীর্ত্তি বাঙ্গলা দেশের এবং বাঙ্গালী জাতির যে এক অভিনব গর্ব্বের বিষয় তাহা রাজমালা প্রচারের স্বল্পতা হেতু অতি ক্ষুদ্র গণ্ডীতে আজিও নিবদ্ধ রহিয়া গিয়াছে। বাঙ্গালী যদি নিজ অতীত ইতিহাসের প্রতি সময়ে শ্রদ্ধাবান্ হইয়া উঠে তবে যে রাজমালা আজ ত্রিপুরার তাহা কালক্রমে সমগ্র বাঙ্গালার হইতে বাধা দেখা যায় না।
শ্রীকৃষ্ণার্পণমস্তু
লোকবত্তু লীলা কৈবল্যম্
বেদান্তদর্শন—২৷১৷৩৩
যথাচ উচ্ছ্বাস প্রশ্বাসাদয়ঃ......স্বভাবাদেব ভবন্তি এবম্—ঈশ্বরস্য অনপেক্ষ্য কিঞ্চিৎ প্রয়োজনান্তরঃ স্বভাবাদেব কেবলং লীলারূপা প্রবৃত্তি ভবিষ্যতি। —শঙ্কর।
“এই জগৎ-রচনা ঈশ্বরের লীলা-স্বরূপ, যেমন শ্বাস-প্রশ্বাস কেবল মাত্র স্বভাবের বশে প্রবৃত্ত হইতে দেখা যায়, সেইরূপ ঈশ্বরের প্রবৃত্তিও বিনা উদ্দেশে বিনা প্রয়োজনে কেবল মাত্র স্বভাবের বশে নিষ্পন্ন হইতে পারে।”
স যথা আৰ্দ্রৈধাগ্নেরভ্যাহিতাৎ পৃথক্-ধূমা বিনিশ্চরন্তি এবং বা অরেঽস্য মহতো ভূতস্য নিঃশ্বসিতমেতৎ যদৃগ্বেদ......ইতিহাস পুরাণং...
“আর্দ্রকাষ্ঠ প্রদীপ্ত হইলে যেরূপ নানা প্রকার ধূম নির্গত হয়, হে মৈত্রেয়ি, তদ্রূপ পরব্রহ্মের অযত্ন প্রসূত নিঃশ্বাস স্বরূপ চতুর্ব্বেদ, ইতিহাস পুরাণ প্রভৃতি।”
যথা দীপ সহস্রাণি দীপ একঃ প্রসূয়তে।
তথা রূপ সহস্রাণি স এব একঃ প্রসূয়তে॥