রাজমোহনের স্ত্রী/দশম পরিচ্ছেদ

দশম পরিচ্ছেদ

প্রত্যাবর্ত্তন

 প্রভাত হইতে তখনও ঘণ্টাখানেক বিলম্ব ছিল, বিষাদিত অন্তঃকরণে ও শ্লথ পদক্ষেপে মাতঙ্গিনী আবার সেই কুপথ ধরিয়া ফিরিয়া চলিল, করুণা নিঃশব্দে তাহাকে অনুসরণ করিতে লাগিল। নক্ষত্রখচিত ম্লান নীলাকাশ ততক্ষণে সঞ্চরমান লঘু মেঘখণ্ডে অর্দ্ধেক আবৃত হইয়াছে—ঘন কৃষ্ণ একটা মেঘ দূর দিক্‌চক্রবালের প্রান্তে ভাসিতেছিল, তাহারই ধূসর ছায়া প্রতিফলিত হওয়াতে দূরে দূরে ছায়ামাত্রে পর্য্যবসিত বৃক্ষচূড়াগুলি গম্ভীরদর্শন মূর্ত্তি ধরিয়াছিল। কৃষ্ণ অরণ্যের উপর দিয়া দিগ্‌ভ্রান্ত চঞ্চল বাতাস মাঝে মাঝে একটানা একটা অশুভ আর্ত্ত বিলাপধ্বনি সৃষ্টি করিতেছিল; কচিৎ বা ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি ধরাবক্ষে অথবা ঘনসন্নিবিষ্ট বৃক্ষপত্রের উপর পতিত হইয়া একটা স্বরের সৃষ্টি করিতেছিল। মাতঙ্গিনী নিজের ভাবনায় এমনই ডুবিয়াছিল যে, বহিঃপ্রকৃতির এই রূপ দেখিবার অবকাশ তাহার ছিল না; সে শুধু ইহাই অনুভব করিয়া লইয়াছিল যে তাহার চারিদিকের প্রকৃতি যেন দুঃখভারাক্রান্ত। নিষিদ্ধ অথচ আকাঙ্খিত মিলনের স্মৃতিটুকু তাহার মনকে ভরিয়া রাখিয়াছিল—বাড়িতে গেলে তাহারা কি ভাবে তাহাকে অভ্যর্থনা করিবে, তাহার স্বামী এই ঘটনার কথা জানিতে পারিলেই বা তাহার কতখানি বিপদ ঘটিতে পারে—এই সকল দুশ্চিন্তা সেই মিলন-দৃশ্যের স্পষ্টতাকে বিন্দুমাত্র ছায়াচ্ছন্ন করিতে পারে নাই; সেই স্মৃতিই তাহার মানস-চক্ষে কখনও উজ্জ্বল রঙে কখনও গভীর কালিমায় ফুটিয়া উঠিতেছিল। সে মাধবকে কথা দিয়াছে, সে ভুলিয়া যাইবে; কিন্তু মাধবের সান্নিধ্য ত্যাগ করিয়াই সর্ব্বপ্রথমে সে এই স্মৃতিরই পূজা করিতে লাগিল—মাধব যতগুলি কথা উচ্চারণ করিয়াছিল তাহার প্রত্যেকটি সে মনে করিয়া করিয়া তাহা লইয়াই স্বপ্নরচনা করিতে লাগিল, মাধবের প্রত্যেক অশ্রুবিন্দুর স্মৃতি তাহাকে পাগল করিতে লাগিল। এবং ক্ষণে ক্ষণে তাহার এই মনের উন্মাদনা কাটিয়া গিয়া নিজের অন্তরের পাপের স্মৃতি, সে যে দেবতাদের ও মানুষের ঘৃণ্য হইয়া উঠিয়াছে, এই কথা ভাবিয়া অভিভূত হইয়া পড়িল।

 কিয়দ্দূর অগ্রসর হইতে না হইতে আকাশ ক্রমেই কালো মূর্ত্তি ধরিতেছে দেখিয়া তাহারা বুঝিতে পারিল যে, একটা ঝড় আসন্ন। সেই সুদীর্ঘ নীরবতা ভঙ্গ করিয়া করুণা বলিয়া উঠিল, ঠাকুরুণ, তাড়াতাড়ি চল, এখুনি ঝড় উঠবে, তার আগে বাড়ি পৌঁছতে হবে।

 অন্যমনস্ক মাতঙ্গিনী উত্তর দিল, হ্যাঁ, তাই চল।

 করুণার গতি দ্রুততর হইল, মাতঙ্গিনীও কোনও প্রয়োজনের বোধে নয়, শুধু তাহার দেখাদেখি দ্রুত চলিতে লাগিল।

 করুণা বলিল, ওই দেখ গাছের পাতায় বড় বড় ফোঁটা পড়তে শুরু হয়েছে—

 তাই নাকি?—মাতঙ্গিনী এই প্রথম তাহার স্বপ্নলোক হইতে জাগরিত হইয়া কথা বলিল। পরক্ষণেই কান পাতিয়া শুনিবার জন্য দাঁড়াইয়া বলিতে লাগিল, না না, এ তো জলের ফোঁটার শব্দ নয়, তবে কি? মনে হচ্ছে যেন মানুষের পায়ের শব্দ, কারা যেন গাছের পাতা মাড়িয়ে চলেছে—

 করুণা আর্ত্তকণ্ঠে বলিল, তাই নাকি ঠাকরুণ? সে তাহার গতি দ্রুত বাড়াইয়া দিল, দেরি হইলে সে অরণ্যে ইতস্ততবিচরণশীল ডাকাতদের হাতে পড়িতে পারে ভাবিয়া ভয়ে শিহরিয়া উঠিল।

 কিন্তু তাহাদিগকে বেশিদূর চলিতে হইল না—ক্রোধোন্মত্ত বাতাস জাগিয়া উঠিল, বিদ্যুৎ চমকাইতে লাগিল, বজ্রগর্জ্জনে আকাশ মুখর হইল, বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা পড়িয়া সন্দেহের অবকাশ দিল না।

 করুণা বলিল, বৃষ্টিতে ভিজে আজ মরণ হবে দেখছি। গাছতলায় দাঁড়িয়ে মাথাটা বাঁচিয়ে নিলে হ’ত না?

 মাতঙ্গিনী বলিল, আচ্ছা, তাই চল। বহুবিস্তৃত একটা তেঁতুলগাছের পত্র-শাখার নীচে আশ্রয় লইবার জন্য মাতঙ্গিনী অগ্রসর হইল, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে ক্ষণিক বিদ্যুতালোকে তাহারা দেখিতে পাইল, তাহাদের অনতিদূরে সেই গাছেরই তলায় একটি মনুষ্যমূর্ত্তি দাঁড়াইয়া আছে।

 করুণা অস্ফুট চীৎকার করিয়া বলিল, পালাও পালাও, এবং উত্তরের অপেক্ষা না করিয়াই প্রাণপণে বিমূঢ় মাতঙ্গিনীর হাত ধরিয়া টানিতে টানিতে ছুটিতে শুরু করিল। ঝড়জলের মধ্য দিয়া ছুটিতে ছুটিতে সে বার বার চীৎকার করিতে লাগিল, পালাও পালাও। এবং যতক্ষণে না বাড়ির দরজায় পৌঁছিল ততক্ষণ উর্দ্ধশ্বাসে ছুটিতে লাগিল। সৌভাগ্যক্রমে বাড়ি বেশি দূরে ছিল না—তাহারা বাড়িতে আসিয়া পৌঁছিল।

 বাড়ি পৌঁছিলে মাতঙ্গিনী বলিল, তুমি ফিরে যাও করুণা। এত রাত্রে তোমাকে ফিরে যেতে বলাটা অন্যায় হচ্ছে বুঝি, কিন্তু তুমি থাকলে বিপদের ভয় আরও বেশি। তার চাইতে এক কাজ কর, কনকদের বাড়ি যাও, তাদের বারান্দায় গিয়ে শুয়ে থাক, ঝড়টা একটু থামলে, একটু ফরসা হ’লেই ওদের বাড়ির কেউ জাগবার আগেই তুমি চলে যেও।

 এই কথা বলিয়া মাতঙ্গিনী তাহার শয়ন-কক্ষের দ্বার খুলিতে অগ্রসর হইল, করুণা চলিয়া গেল। মাতঙ্গিনী দেখিল, দরজা তখনও অর্গলবদ্ধ। কয়েক ঘণ্টা পূর্ব্বে রাজমোহন যে কৌশলে দ্বারটি অর্গলমুক্ত করিয়াছিল, সেই কৌশল প্রয়োগ করিয়া দ্বার খুলিয়া মাতঙ্গিনী নিঃশব্দে কক্ষে প্রবেশ করিল। সে পুনরায় দরজা বন্ধ করিতে যাইবে, দেখিল তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আর একটি মূর্ত্তি ঘরে ঢুকিয়া ভারী হুড়কাটি লাগাইয়া দিল। পা ফেলার ধরনে ও শব্দে মাতঙ্গিনীর বুঝিতে বিলম্ব হইল না যে, আগন্তুক তাহারই ভয়ঙ্কর পতিদেবতা।

 রাজমোহন কোনও কথা কহিল না, নিঃশব্দে অন্ধকারে হাতড়াইয়া চক্‌মকি আর সোলা বাহির করিয়া আলো জ্বালিয়া যথাস্থানে সেটিকে রাখিল। তখনও সে নির্ব্বাক, তক্তপোশের এক ধারে বসিয়া সে হিংস্র দৃষ্টিতে মাতঙ্গিনীকে দেখিতে লাগিল। সেই দৃষ্টি দেখিয়া মাতঙ্গিনী বুঝিল তাহার ভাগ্যে কি আছে। সে বিবর্ণ বা ভয়কম্পিত না হইয়া সগর্ব্বে দৃঢ় ভাবে দাঁড়াইয়া রহিল—তাহার সমস্ত দেহে তেমনই প্রখর শ্রী ও সাহস ফুটিয়া উঠিল, যাহা দেখিয়া সেই দিনই সন্ধ্যায় তাহায় বর্ব্বর স্বামীর ক্রোধ অন্তর্হিত হইয়াছিল। বাহিরের ঝড়ের আর্ত্তনাদ, বারিপতনশব্দ ও ঊর্দ্ধাকাশের ক্রুদ্ধ মেঘের গর্জ্জন ক্ষণে ক্ষণে গৃহাভ্যন্তরের ভয়াবহ নীরবতা ভঙ্গ করিতেছিল।

 পরিশেষে রাজমোহন কথা কহিল, হতভাগী—! তাহার কণ্ঠস্বর তীব্র হইলেও সচরাচর রুক্ষ মেজাজের দরুন তাহার কথায় যে রূঢ় কর্কশতা থাকে এখন তাহা মোটেই ছিল না। সে বলিল, হতভাগী, উপপতি করতে গিয়েছিলি?

 মাতঙ্গিনী নিরুত্তর, রাজমোহন মেঝেতে পদাঘাত করিয়া চাপা অথচ ভীষণ গম্ভীর কণ্ঠে আবার বলিল, বল্ বলছি।

 অর্দ্ধদোষী ও অর্দ্ধনির্দ্দোষী মাতঙ্গিনী উত্তর দিল, এসব কথার আমি কোনও জবাব দেব না।

 জবাব দিবি না হারামজাদী?—রাজমোহন হঠাৎ যেন ক্ষেপিয়া উঠিল, দাঁতে দাঁত ঘষিতে ঘষিতে এই কথা বলিয়াই সে হঠাৎ আবার নিজেকে সামলাইয়া লইয়া বলিল, তুই আজ রাত্রে মাধব ঘোষের বাড়ি গিয়েছিলি কি না?

 মাধবের নাম শুনিবামাত্র মাতঙ্গিনীর ভাবান্তর হইল, সে সহসা উত্তেজিত হইয়া বলিয়া ফেলিল, হ্যাঁ, গিয়েছিলাম, তোমরা তার বাড়িতে ডাকাতি করবে মতলব করেছিলে, আমি তাকে বাঁচাতে গিয়েছিলাম।

 রাজমোহন দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করিয়া বিছানা ছাড়িয়া লাফাইয়া উঠিল। বজ্রকণ্ঠে হাঁকিল, দেখ মাগী, আমাকে ঠকাতে পারবি না তুই। তুই জানিস না তোকে আমি কি ভাবে পাহারা দি। যেদিন থেকে তোর রূপ হয়েছে তোর অভিশাপ, সেইদিন থেকে তোকে আমি চোখে চোখে রেখেছি। তুই ভাবিস না, তুই কি করিস না করিস আমি দেখি না।

 হঠাৎ কিছু শান্ত হইয়া সে বলিতে লাগিল, হতে পারি আমি পশু, তবু আমার রূপবতী স্ত্রীর জন্যে আমার গর্ব্ব ছিল; বাঘিনী যেমন ক’রে তার বাচ্চাকে আগলে বেড়ায়, আমিও তেমনই তোকে আগলে থাকতাম। আমি কি দেখি নি, তোর বয়স পাকবার আগেই ওই হতভাগার পীরিতে তুই মজেছিলি? আমি কি জানি না, আস্তে আস্তে আজ ওটাই তোর পাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে! কি, বিশ্বাস হচ্ছে না? আজকে বিকেলেই যখন ওই বেশ্যামাগী, তোর ওই সাধের সইয়ের কুমতলবে ভুলে কাউকে কিছু না ব’লে ঘরের বাইরে গিয়েছিলি, তখনও আমি তোকে চোখে চোখে রেখেছিলাম—এটা জেনে রাখ্! বল্ তুই যাস নি। বাগানের কাছে গিয়ে ইচ্ছে ক’রে মনে পাপ নিয়ে ঘোমটা খুলিস নি? নাগরের সঙ্গে শুভদৃষ্টি হবে, চোখ জ্ব’লে যাবে না তোর? পিছু নিয়ে চলতে চলতে একবার তোকে হারিয়ে ফেললাম—হায় হায়, একটু হুঁশিয়ার থাকলেই হ’ত! বাড়ি ফিরে খালি ঘর দেখে আমার কি বুঝতে দেরি হয়েছিল, কোন্ সাপের গর্ত্তে পাপকীট গিয়ে ঢুকেছে? ওদের খিড়কির দরজা থেকেই আমি তোর কাছে কাছেই ছিলাম এবং এই ঝড়জলের মধ্যে তখন থেকে এখন পর্য্যন্ত আমি তোর পিছু নিয়ে আসছি। তুই অসতী হয়েছিস—তোকে আর বেঁচে থাকতে দেওয়া নয়, আজকে রাত্রেই ছোরা শাণিয়েছি, তোকে নিকেশ ক’রে তবে ছাড়ব।

 রাজমোহন থামিল, তাহার চক্ষু দিয়া যেন অগ্নিবৃষ্টি হইতেছিল। মাতঙ্গিনীর অসাড় দেহখানার দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া সে যেন শেষ দেখিয়া লইল। ক্ষণিক স্তব্ধতার মধ্যে বাহিরে ঝড়ের হাহাকার মাত্র শোনা গেল। অবশেষে মাতঙ্গিনী কথা বলিল —সে মরীয়া হইয়া উঠিয়াছে, তবু অত্যন্ত ধীরভাবে বলিতে লাগিল, তোমার কথা ঠিক, আমি তাকে ভালবাসি, গভীরভাবে ভালবাসি—বহুদিন এ ভালবাসা আমার মনে বাসা বেঁধেছে। এ কথাও তোমাকে বলছি—আমি উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলাম, নিজেকে সামলাতে পারি নি। সেই ভালবাসার উন্মাদনায়, তুমি আমার অবস্থা ঠিক বুঝতে পারবে না, আমার মুখ দিয়ে কয়েকটা কথা বেরিয়েছে এই মাত্র, এ ছাড়া আমি আর তোমার কাছে দোষী নই। আমাকে কি তোমার বিশ্বাস হয়?

 রাজমোহন উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, না। তোকে মেরেই ফেলব। ইহা বলিয়া সে কোমর হইতে বস্ত্রমধ্যে লুক্কায়িত একটা ছুরিকা টানিয়া বাহির করিল। “মা, মা, বাবা গো, তোমরা কোথায়?”—এই কথাগুলি মাত্র মাতঙ্গিনীর মুখ হইতে নিঃসৃত হইল, পরক্ষণেই সে অচেতনের মত মেঝেতে পড়িয়া গেল। নিষ্ঠুর অস্ত্রখানি তাহার মাথার উপর ঝকঝক করিতে লাগিল—কম্পিতা মাতঙ্গিনীর বক্ষে তাহা প্রোথিত হইল বলিয়া। এমন সময় হঠাৎ বাধা পড়িল, জানালায় কিসের ভয়ানক শব্দ হইল। রাজমোহন কারণ বুঝিবার জন্য মুখ ফিরাইয়া দেখিল ঝাঁপ খুলিয়া গেল এবং খোলা পথে দুইটি কৃষ্ণকায় পালোয়ানের মত মূর্ত্তি পর পর লাফাইয়া ঘরে পড়িল। তাহাদের দেহ বৃষ্টিজলে আর্দ্র, কর্দ্দমাক্ত এবং তাহাদের ভয়াবহ রক্তচক্ষুর অন্তরাল হইতে যেন আগুনের হল্কা বাহির হইতেছিল।