রাজমোহনের স্ত্রী

রাজমোহনের স্ত্রী
সজনীকান্ত দাস অনূদিত

রাজমোহনের স্ত্রী

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

অনুবাদক

শ্রীসজনীকান্ত দাস

ঈষ্টার্ণ পাবলিশার্স সিণ্ডিকেট লিঃ

৮সি রমানাথ মজুমদার স্ট্রীট, কলিকাতা

প্রকাশক
শ্রীজিতেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, বি. এ.
৮সি রমানাথ মজুমদার স্ট্রীট, কলিকাতা

দাম দুই টাকা

৯ ভাদ্র ১৩৫১

মুদ্রাকর
শ্রীপ্রভাতচন্দ্র রায়
শ্রীগৌরাঙ্গ প্রেস
৫ চিন্তামনি দাস লেন, কলিকাতা

ভূমিকা

 উপন্যাস হিসেবে ‘রাজমোহনের স্ত্রী’র (Rajmohan’s Wife) মূল্য যাহাই হউক ইহার ঐতিহাসিক মূল্য অসামান্য। বাংলাদেশের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিকের প্রথম উপন্যাস বাঙালী পাঠকের কাছে চিরদিনই কৌতুক ও কৌতূহলের বিষয় হইয়া থাকিবে। বঙ্কিমচন্দ্রের বাল্য ও কৈশোরের সাহিত্য-সাধনার যে মুদ্রিত ইতিহাস পাওয়া যায় তাহাতে দেখা যায় যে, তিনি ১৮৫২ খ্রীষ্টাব্দের ২৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে (১৩ বৎসর ৮ মাস বয়সে) কবিবর ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত ‘সংবাদ প্রভাকরে’ সর্ব্বপ্রথম লিখিতে আরম্ভ করেন এবং প্রায় দুই বৎসরকাল ওই পত্রিকাতেই নানাবিধ গদ্য-পদ্য রচনা প্রকাশ করেন। তাঁহার প্রথম গ্রন্থ ‘ললিতা। পুরাকালিক গল্প। ‘তথা মানস’ ১৮৫৩ খ্রীষ্টাব্দেই রচিত হইয়াছিল। ইহা পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয় ১৮৫৬ খ্রীষ্টাব্দে। ওই সালে বঙ্কিমচন্দ্র কদর্য্য বাংলা গদ্যে ওই পুস্তকের এক পৃষ্ঠা ভূমিকা মাত্র লিখিয়াছিলেন। ১৮৫৩ হইতে ১৮৬৪ খ্রীষ্টাব্দ পর্য্যস্ত তাঁহার অন্য কোন সাহিত্যকর্ম্মের ইতিহাস আমরা অবগত নই। এই কালের মধ্যে তিনি এণ্ট্রান্স হইতে বি. এ. পর্য্যন্ত পাঠ সমাপ্ত করিয়াছেন এবং ১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দের ৭ আগস্ট হইতে ডেপুটিগিরি চাকুরিতে বহাল হইয়া যশোহর-মেদিনীপুর-খুলনা-বারুইপুর করিয়া ফিরিতেছেন। এই সময়ে তিনি খাঁটি ইংরেজীনবিশ; মাতা বঙ্গবীণাপাণির প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করিয়া বিমাতার সেবায় মগ্ন। ১৮৬৪ খ্রীষ্টাব্দে কিশোরীচাঁদ মিত্র সম্পাদিত ‘ইণ্ডিয়ান ফীল্ড’ নামক ইংরেজী সাপ্তাহিকে বাংলাভাষার শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিকের প্রথম উপন্যাস ইংরেজী ভাষায় লিখিত Rajmohan’s Wife ধারাবাহিকভাবে বাহির হইতে থাকে। ‘ইণ্ডিয়ান ফীল্ডে’ সম্পূর্ণ হইলেও এই পুস্তক বঙ্কিমচন্দ্রের জীবিতকালে পুস্তকাকারে বাহির হয় নাই।

 কারণ অনুমান করা যায় যে, মাতৃভাষার প্রতি বঙ্কিমচন্দ্রের আকর্ষণ এই বৎসরেই প্রবল হইয়া থাকিবে। তিনি সম্ভবত ইংরেজীতে মৌলিক সৃষ্টির আশা পরিত্যাগ করিয়া মাতৃভাষার সাহায্যই গ্রহণ করিতে মনস্থ করিয়াছিলেন। নিজের রচিত ইংরেজী উপন্যাসেরই অনুবাদ করিয়া তিনি এই সঙ্কল্প কাজে পরিণত করিতে চাহিলেন। এক অধ্যায় দুই অধ্যায় করিয়া মাত্র সপ্তম পরিচ্ছেদের প্রায় শেষ পর্য্যন্ত (পংক্তি কয়েক বাকি ছিল) অনুবাদ করিয়া তিনি আর পারিলেন না। তাঁহার মত মৌলিক সৃষ্টি-প্রতিভা যাঁহার, তিনি অনুবাদ বা অনুসরণে তৃপ্তিলাভ করিতে পারেন না, তা সে হউক না নিজেরই অনুসরণ। সুতরাং ‘রাজমোহনের স্ত্রী’র বঙ্কিমকৃত বাংলারূপ আর প্রকাশ পাইল না, প্রায় সূত্রপাতেই বিনষ্ট হইল।

 কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয়, সেই পাতা কয়টা রহিয়া গিয়াছে। বঙ্কিমচন্দ্রের মৃত্যুর পর তাঁহার দপ্তর ঘাঁটিয়া ভ্রাতুষ্পুত্র ও জীবনীকার শচীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মহাশয় সেই খণ্ডিত অনুবাদের পাণ্ডুলিপিটি সংগ্রহ করেন। শচীশচন্দ্র যদিও জানিতেন যে, বঙ্কিমচন্দ্র একদা Rajmohan's Wife লিখিয়াছিলেন[] তথাপি কেন জানি না পাণ্ডুলিপি পড়িয়া সেটি যে ওই Rajmohan's Wifeএর অনুবাদ তাহা তিনি পরিতে পারেন নাই, সেই পাণ্ডুলিপিতে রাজমোহন ও রাজমোহনের স্ত্রীর বারংবার উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও। যাহা হউক, তিনি সেই পাণ্ডুলিপিটিকে বঙ্কিমচন্দ্রের সর্ব্বশেষ উপন্যাসের সূত্রপাত কল্পনা করিয়া নিজের খেয়ালমত তাহা সম্পূর্ণ করেন এবং ‘বারি-বাহিনী’ নাম দিয়া ১৩২৫ বঙ্গাব্দে পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন। এই পুস্তকে বঙ্কিমচন্দ্র-অনূদিত প্রথম সাত পরিচ্ছেদ, নয় পরিচ্ছেদে বিভক্ত হইয়া বাহির হয়। Rajmohan's Wifeএর সহিত ‘বারি-বাহিনী’র শেষ অংশের কোনই মিল নাই। শচীশচন্দ্র পুস্তকের “ভূমিকা”য় লেখেন—

 পরমারাধ্য বঙ্কিমচন্দ্র মৃত্যুর অনতিপূর্ব্বে—১৩০০ বঙ্গাব্দে—এই আখ্যায়িকা লিখিতে আরম্ভ করেন; কিন্তু শেষ করিয়া যাইতে পারেন নাই। তাঁহার পুত্র ও শিষ্য আজ তাহা ছাব্বিশ বৎসর পরে শেষ করিল।

 ‘বঙ্কিম-জীবনী’তেও “জীবনের শেষ কয়েক বৎসর” অধ্যায়ে শচীশচন্দ্র লিখিয়াছেন:

 কিছু করেন নাই বলিলে চলিবে না। তিনি একখানি সামাজিক উপন্যাস লিখিতেছিলেন। কিন্তু তাহা সম্পূর্ণ করিয়া যাইতে পারেন নাই—কয়েকটি পরিচ্ছেদ লিখিত হইতে না হইতে কাল তাঁহাকে কাড়িয়া লইয়া গেল। তাহার কয়েক বৎসর পরে উপন্যাসখানি সম্পূর্ণ করিয়া প্রকাশ করিয়াছি। তৃতীয় সংস্করণ, পৃ. ১৫২

 এইরূপ ভ্রমের প্রধান কারণ সম্ভবত এই যে, ‘ইণ্ডিয়ান ফীল্ড’ হইতে Rajmohan’s Wife তখন পর্য্যন্ত আবিষ্কৃত হয় নাই। শ্রীযুক্ত ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় পরে ইহা আবিষ্কার করেন ও ১৯৩৫ খ্রীষ্টাব্দে পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন। ‘ইণ্ডিয়ান ফীল্ডে’র যে যে সংখ্যায় প্রথম তিন অধ্যায় বাহির হইয়াছিল, সেই সেই সংখ্যা খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই বলিয়া ‘বারি-বাহিনী’ হইতেই প্রথম তিন অধ্যায়ের অনুবাদ দিয়া পুস্তক সম্পূর্ণ করা হইয়াছে। অর্থাং প্রথম তিন অধ্যায় বঙ্কিমচন্দ্রের বাংলা অনুবাদের ইংরেজী অনুবাদ। পরে বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ কর্ত্তৃক প্রকাশিত বঙ্কিমচন্দ্রের সম্পূর্ণ রচনাবলীর ইংরেজী খণ্ডে Rajmohan’s Wife এবং “বিবিধ” খণ্ডে ‘বারি-বাহিনী’ হইতে বঙ্কিমচন্দ্র-কৃত সাত পরিচ্ছেদের অনুবাদ প্রকাশিত হইয়াছে।

 Rajmohan's Wifeএর মৎকৃত অনুবাদ। চতুর্থ পরিচ্ছেদ হইতে) ‘বঙ্গশ্রী’ পত্রিকায় ১৩৩৯ বঙ্গাব্দের মাঘ হইতে ১৩৪০ বঙ্গাব্দের মাঘ পর্য্যন্ত ১৩ মাস ধরিয়া বাহির হয়। এই পুস্তকে ‘বারি-বাহিনী’র সহায়তায় প্রথম তিন পরিচ্ছেদও যুক্ত হইয়াছে। এই তিন পরিচ্ছেদে কোটেশন-মার্কা দেওয়া অংশ বঙ্কিমচন্দ্রের অনুবাদ। বঙ্কিমচন্দ্রের নিজের কৃত চতুর্থ পরিচ্ছেদ হইতে সপ্তম পরিচ্ছদের অনুবাদ থাকা সত্ত্বেও এই পুস্তকে তাহা ব্যবহার করি নাই, কারণ আমরা মূল ইংরেজীরই যথাযথ অনুসরণ করিয়াছি। বঙ্কিমচন্দ্রের স্বহস্ত-লিখিত পাণ্ডুলিপির একটি পৃষ্ঠা শচীশচন্দ্র ‘বারি-বাহিনী’তে প্রকাশ করিয়াছেন। আমরা এই পুস্তকে তাহারই একটি প্রতিলিপি দিলাম।

 ‘রাজমোহনের স্ত্রী’র বঙ্কিম-কৃত অনুবাদ-অংশের ভাষা লইয়া কিছু আলোচনা আবশ্যক, কারণ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এই অনুবাদটুকু বঙ্কিমের ভাষার ক্রমপরিণতির পরিচয় বহন করিতেছে। এই কাঁচা-পাকা ভাষার সংমিশ্রণ দৃষ্টে শচীশচন্দ্রের মনেও সংশয় জাগিয়াছিল। সেই কারণেই তিনি ‘বারি-বাহিনী’র “ভূমিকা”য় লিখিয়াছিলেন—

 বঙ্কিমচন্দ্র তাঁহার সাধারণ ভাষা পরিত্যাগপূর্ব্বক এক অভিনব ভাষায় এই পুস্তকখানির রচনায় প্রবৃত্ত হইয়া ছিলেন।

 আসলে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের প্রভাববর্জ্জিত ভাবে এই কয়টি পৃষ্ঠাই বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম বাংলা-গদ্যরচনা। ইতিপূর্ব্বে ‘সংবাদ প্রভাকরে’ তাঁহার যে গদ্যরচনা বাহির হইয়াছিল, তাহাকে অপাঠ্য গদ্য বলিলে অপরাধ হয় না। ‘রাজমোহনের স্ত্রী’ অনুবাদ করিতে বসিয়া বঙ্কিমচন্দ্র সেই ভাষাকে নির্ম্মমভাবে ত্যাগ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। টেকচাঁদ ঠাকুর—প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘মাসিক পত্রিকা’ এবং ‘আলালের ঘরের দুলাল’ ও ‘হুতোম প্যাঁচার নক্‌শা’ তখন প্রকাশিত হইয়াছে। বিদ্যাসাগরী-রীতি ও আলালী-রীতির পার্থক্য তিনি ধরিতে পারিয়াছেন এবং নিজের অসাধারণ প্রতিভাবলে বুঝিয়াছেন যে, এই দুই রীতির সমন্বয় ব্যতিরেকে বাংলা ভাষার উন্নতি সম্ভব নহে। তিনিই এই সমন্বয়সাধনে সচেষ্ট হইলেন। ‘রাজমোহনের স্ত্রী’র তৎকৃত অনুবাদে এই দুই রীতির দ্বন্দ্ব স্পষ্ট। বিদ্যাসাগরী-রীতির দৃষ্টান্ত—

 এই সর্ব্বাঙ্গসুন্দর রমণীকুসুম মধুমতী তীরজ নহে— ভাগীরথী কূলে রাজধানীসন্নিহিত কোনও স্থানে জাতাও প্রতিপালিতা হইয়া থাকিবেক।—ইত্যাদি। প্রথম পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য। এবং ইহারই পাশে আলালী-রীতির দৃষ্টান্ত—

 মথুর। কাজ ত সব জানি।— কাজের মধ্যে নূতন ঘোড়া নূতন গাড়ি—ঠক বেটাদের দোকানে টো টো করা—টাকা উড়ান—তেল পুড়ান—ইংরাজিনবিশ ইয়ার বক্‌শিকে মদ খাওয়ান—আর হয়ত রসের তরঙ্গে ঢলাঢল। ইত্যাদি। ঐ।

 প্রাচীন ও নবীন রীতির এই দ্বন্দ্বের মধ্যেই বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যজীবনের আদিপর্ব্বের সমাপ্তি এবং যথার্থ বঙ্কিম-প্রতিভার অভ্যুদয়। ‘দুর্গেশনন্দিনী’তে (১৮৬৫) সার্থকভাবে এই ভাষাসমন্বয়ের সূত্রপাত দেখিতে পাই। ‘বঙ্গদর্শনে’র যুগে দেখি বঙ্কিমচন্দ্র তাঁহার পথ খুঁজিয়া পাইয়াছেন।

শ্রীসজনীকান্ত দাস

  1. “বঙ্কিমচন্দ্রও একদিন “Rajmohan's wife” নামক গল্প ইংরাজি ভাষায় লিখিয়াছিলেন। গল্প শেষ হইবার পূর্ব্বেই তাঁহার ভুল ভাঙ্গিয়াছিল। তিনি “Rajmohan's wife” ও “Adventures of a young Hindu” ছাড়িয়া “দুর্গেশনন্দিনী” লিখিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন।”—শচীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘বঙ্কিম-জীবনী’ তৃতীয় সংস্করণ, পৃ. ১০৮। শেষের সংবাদও ঠিক নহে, Rajmohan's Wife ‘ইণ্ডিয়ান ফীল্ডে’ সম্পূর্ণ বাহির হইয়াছিল। শেষোক্ত পুস্তক Adventures of a Young Hinduর কোনো সন্ধান আজও পর্য্যন্ত পাওয়া যায় নাই।

পরিচ্ছেদসমূহ (মূল গ্রন্থে নেই)

সূচীপত্র