রাজমোহনের স্ত্রী/চতুর্থ পরিচ্ছেদ



চতুর্থ পরিচ্ছেদ

একটি জমিদার-বংশের উত্থান-পতনের ইতিহাস

 বাংলার বহু প্রসিদ্ধ জমিদার-বংশ যে নীচকুলোদ্ভব ইহা নিন্দার কথা হইলেও সত্য।

 বংশীবদন ঘোস পূর্ব্ববঙ্গের এক বৃদ্ধ জমিদারের খানসামা ছিল। এই জমিদারের নাম এবং বংশ এখন উভয়ই লোপ পাইয়াছে। প্রথম বিবাহ নিষ্ফল হওয়াতে জমিদারটি বুড়া বয়সে দ্বিতীয় দারপরিগ্রহ করেন। কিন্তু সন্তানের মুখ দেখিয়া বাঁচা এবং মরা কোনটাই তাঁহার অদৃষ্টে ছিল না। অবশ্য, সন্তান-ভাগ্যের পরেই তিনি যে বস্তুটি এই বৃদ্ধবয়সে সর্ব্বাপেক্ষা কাম্য মনে করিতেন তাহা তাঁহার ভাগ্যে জুটিয়াছিল—একটি যুবতী ও সুন্দরী স্ত্রী তিনি পাইয়াছিলেন। এ কথা সত্য যে তাঁহার দুই জীবনসঙ্গিনীর পরস্পর কলহ-বিবাদে প্রায়ই তাঁহার পারিবারিক শান্তিতে বিঘ্ন ঘটিত, কারণ অধিকবয়স্কা যিনি তিনি সর্ব্বক্ষণ উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করিতেন, যে আগে আসিয়াছে তাহার দাবি আগে, এ বিষয়ে সংশয় থাকিতে পারে না। বৃদ্ধ কিন্তু এ বিষয়ে নিসংশয় হইতে পারেন নাই। গতিক যখন খুবই খারাপ তখন এমন একজন মধ্যস্থ আসিয়া বিচারনিম্পত্তি করিয়া দিলেন যে, কাহারও কিছু প্রশ্ন করিবার রহিল না। বড়র নিঃসংশয় দাবি যথাযথ স্বীকার করিয়া তিনি তাহাকে ইহলোক হইতে অপসারিত করিলেন। বৃদ্ধ এবং তাহার তরুণী ভার্য্যা নিশ্চিন্ত হইলেন বটে, কিন্তু এই ঘটনা যেন বৃদ্ধকে সতর্ক করিয়া দিয়া গেল; তিনি মনে মনে অনুভব করিলেন, তাঁহার ডাক পড়িতেও আর বেশি দিন নাই। পুত্র-মুখ দেখিবার কোনও সম্ভাবনাই আর রহিল না। বৃদ্ধের মন এই ভাবিয়া তিক্ত হইয়া গেল যে, তাঁহার এই বিশাল সম্পত্তি এমন সকল লোকের ভোগে আসিবে যাহাদিগকে তিনি চেনেন না বলিলেই চলে। পত্নীর জীবিতকাল পর্য্যন্তও না হয় সম্পত্তি তাহার হাতছাড়া হইতে পারিবে না, কিন্তু আইন তাহাকে স্বামীর সম্পত্তি হইতে সামান্য ভরণপোষণের উপযোগী একটা ভাতা ছাড়া আর কিছুই লইতে দিবে না। তাঁহার অবর্ত্তমানে তাঁহার যুবতী পত্নী যাহাতে সম্পত্তির পূরা মালিক হইতে পারে বৃদ্ধ সে বিষয়ে অবহিত হইলেন; যুবতী পত্নীর পরামর্শ ও যুক্তি তাঁহাকে চালিত করিতে লাগিল। এ বিষয়ে নিজের মনোহর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে এই যুবতীর অতি পরিষ্কার ধারণা ছিল বলিয়া সে স্বামীকে দিয়া ভবিষ্যতের পথ নিষ্কণ্টক করিতে লাগিল। সমস্ত স্থাবর সম্পত্তিকে অস্থাবর করিবার দিকে বৃদ্ধ ঝোঁক দিলেন। জমিদারিকে যতটা পারেন নগদ টাকা ও অস্থাবর সম্পত্তিতে তিনি রূপান্তরিত করিতে লাগিলেন। নগদ টাকা সম্বন্ধে তাঁহার এই লোভ এমনই বৃদ্ধি পাইয়াছিল যে, তিনি যেদিন মৃত্যুমুখে পতিত হইলেন তাঁহার উত্তরাধিকারিণী সেদিন যে বিপুল ধন-সম্পত্তির মালিক হইয়া বসিল- স্থাবর জোতজমা তাহার অতি সামান্য অংশ মাত্র।

 করুণাময়ী যে বুদ্ধিমতী, সে বিষয়ে আমাদিগকে সন্দেহ করিবার অবকাশ মাত্র না দিবার জন্য স্থির করিল, রূপ এবং রূপ নামক যে দুইটি পদার্থের সে অধিকারিণী সেই দুইটিরই সদ্গতি করিতে হইবে। সে নিজেকে বুঝাইল, ঈশ্বরের অবতার রামচন্দ্র সীতাবিরহে কাতর হইয়া প্রিয়তমা পত্নীর প্রতি গভীর প্রেমের নিদর্শনস্বরূপ স্বর্ণ-সীতা নির্ম্মাণ করাইয়া নিজেকে সান্ত্বনা দিতে চাহিয়াছিলেন। মৃত স্বামীর প্রতি তাহার প্রভূত ভালবাসা এই প্রকারের প্রতিনিধি-পদ্ধতির সাহায্যেই বা সার্থক হইবে না কেন? সে আরও ভাবিল যে, যে প্রিয় চলিয়া গিয়াছে, যাহাকে সে হারাইয়াছে এবং যাহার বিরহে সে শোকার্ত্ত, সামান্য ধাতুমূর্ত্তিকে তাহার প্রতিনিধি না করিয়া যদি একজন রক্তে-মাংসে গড়া মানুষকেই সেই পদ দেওয়া যায়, তাহা হইলে এই পদ্ধতিকে আরও উন্নত করা হয়, কারণ, মানুষ-প্রাণীটাই একটা মহত্তর ব্যাপার, ধাতুদ্রব্য অপেক্ষা মানুষের সহিত-নিশ্চয়ই উহার মিল বেশি এবং এই মিল শুধু বাহিরের অবয়বের মিল নহে। এরূপ তর্কের দ্বারা মনকে দৃঢ় করিয়া মৃতের প্রতি শ্রদ্ধাবশতঃও বটে আবার দেবতাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়াও বটে, অনতিকাল মধ্যে সে একজন প্রতিনিধি নির্ব্বাচন করিয়া লইল। বাবুর খানসামা বংশীবদন-ঘোষের ললাটে রাজটীকা পড়িল। ধূর্ত্ত বংশীবদনও এই সুবিধা ছাড়িবার পাত্র নয়। প্রভু-পত্নীর দেহ-সাম্রাজ্যের অধিপতি হইয়া সে তাহার অস্থাবর সম্পত্তিরও মালিক হইবে না—এমন কথা ভাবিতে পারিল না। সম্পত্তির মালিক হইতে তাহাকে মোটেই বেগ পাইতে হইল না; খানসামা হইতে সদর নায়েব পদে উন্নতি দেখিতে দেখিতে হইল।

 এদিকে করুণাময়ীর তখন প্রত্যহই ঘুসঘুসে জ্বর হইতেছিল—সেই জ্বর অজ্ঞাত কারণে কিংবা হয়তো বা অত্যন্ত জ্ঞাত কারণেই হঠাৎ বাড়িয়া ভীষণ মূর্ত্তি ধারণ করিল এবং লুব্ধ বিধবার মনের আগুন নিবিবার বহু পূর্ব্বেই অকস্মাৎ তাহাকে তাহার সংসার ও সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী হইতে অপসারিত করিল। এই ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই তাহার স্বামীর দূরসম্পর্কের লোলুপ আত্মীয়েরা একে একে সম্পত্তির লোভে আসিয়া হতাশ হইয়া দেখিল, সামান্য দুই-একটি দরিদ্র গ্রাম ছাড়া আর কিছুই নাই। তাহারা শুনিল, অস্থাবর সম্পত্তি অতি সামান্যই ছিল এবং যাহা ছিল তাহাও বিধবার স্বামীর দাস-দাসীদের মধ্যে বণ্টন করিয়া দেওয়া হইয়াছে।

 বংশীবদন বিপুল সম্পত্তি লইয়া রাধাগঞ্জে তাহার দরিদ্র পৈতৃক ভিটাতে উপস্থিত হইল। অত্যন্ত বুদ্ধিমান বলিয়া সে যে প্রভূত ধনের মালিক হইয়া আসিয়াছে তাহার পরিচয় মাত্র প্রকাশ করিল না, সাধারণ রকম আরামে থাকিতে গেলে যেটুকু করা দরকার, তাহার অধিক খরচ সে করিল না। তাহার মৃত্যুর পর তাহার তিন পুত্রের ভাগ্যেই ভাগবাঁটোয়ারা হইয়া প্রচুর পৈতৃক অর্থলাভ ঘটিল। বহুদিনের অধিকারের ফলে তখন তাহারা এই অর্থের মালিকান স্বত্ব সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হইয়াছে— তাহাদিগের পিতা যে ভয়ে সংযত হইয়া জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করিয়াছিল তাহারা তাহা করা আবশ্যক মনে করিল না। তাহারা জমিদারি খরিদ করিতে লাগিল, বড় বড় ইমারত নির্ম্মাণ করাইল এবং তাহাদের অর্থের অনুপাতে আড়ম্বর ও চাল বাড়াইয়া চলিল। জ্যেষ্ঠ রামকান্ত খুব হিসাব করিয়া সুপরিচালনার ফলে তাহার নিজের অংশ যথেষ্ট বৃদ্ধি করিল এবং বুড়া বয়স পর্য্যন্ত বাঁচিয়া একমাত্র পুত্র মথুরের সক্ষম হাতে সম্পত্তি ন্যস্ত করিয়া গেল। মথুরের সঙ্গে ইতিপূর্ব্বে পাঠকের পরিচয় হইয়াছে। পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রকোপে দেশের প্রাচীন রীতিনীতির যে পরিবর্ত্তন সাধিত হইতেছিল, রামকান্তের তাহা ভাল ঠেকিত না। সে বরাবরই ইংরেজী স্কুলে পুত্রের শিক্ষা দেওয়ার বিরুদ্ধে ছিল। কারণ, এই ইংরেজী স্কুলগুলিকে সে শুধু অনাবশ্যক মনে করিয়াই ক্ষান্ত ছিল না, ইহাদের দ্বারা দেশের সত্যকার ক্ষতির আশঙ্কা করিত। মথুর বাল্যকাল হইতে পিতাকে জমিদারি পরিচালনায় সাহায্য করিত এবং জাল-জুয়াচুরি প্রজাশাসন ইত্যাদি ব্যাপারে খুব পাকা হইয়া উঠিয়াছিল।

 বংশীবদনের দ্বিতীয় পুত্র রামকানাইয়ের ভাগ্য ছিল সম্পূর্ণ অন্যরূপ। সে স্বভাবতই অলস ও অমিতব্যয়ী ছিল বলিয়া অত্যল্পকাল মধ্যে নানা বৈষয়িক গোলযোগের সৃষ্টি করিল। তাহার বাড়ি ও বাগান ছিল সব চাইতে জমকালো, কিন্তু তাহার স্থাবর সম্পত্তির আয় ছিল না বলিলেই হয় এবং বৈষয়িক এমন অব্যবস্থাও আর কাহারও ছিল না। তাহার চারি পাশে একদল ফন্দীবাজ মোসাহেব জুটিয়া নানা ফিকিরে তাহার বিশ্বাসী হইয়া উঠিয়াছিল। অবস্থা যখন খারাপ তখন তাহারা নিজেদের কল্পিত কোনও বিশেষ ব্যবসায়ে যোগদান করিলে কি ভাবে অবস্থা ফিরানো যাইতে পারে, সে বিষয়ে রঙ চড়াইয়া নানা কথা বলিয়া তাহাকে প্রলুব্ধ করিল। রামকানাই তাহাদের উপদেশ গ্রহণ করিল এবং নিজেকে সম্পূর্ণ তাহাদের হাতে ছাড়িয়া দিয়া কলিকাতায় বাস উঠাইয়া আনিল। বলা বাহুল্য, পরামর্শদাতারা একটু একটু করিয়া ব্যবসায়ে সে যে টাকা ফেলিয়াছিল তাহার সবটুকুই গ্রাস করিয়া তাহাকে এমন অবস্থায় আনিয়া ফেলিল যে, অনতিবিলম্বে তাহার অব্যবস্থিত ও অবহেলিত স্থাবর সম্পত্তি নিলামে চড়িল।

 রামকানাইয়ের শহরে বাস করার একটি ফল হইয়াছিল ভাল—শহরের লোকদের দেখাদেখি সে তাহার পুত্রের কলিকাতায় যতটা সম্ভব ততটা শিক্ষা পাইবার ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছিল। হিন্দু পিতার যাহা চরম কাম্য—এক অপরূপ সুন্দরী বালিকার সঙ্গে পুত্রের বিবাহ দিয়া সে কামনাও সে চরিতার্থ করিয়াছিল।

 কলিকাতার সন্নিকটবর্ত্তী কোনও গ্রামের এক দরিদ্র কায়স্থ বড়াই করিত যে, দেবতা তাহাকে যে মহামূল্য সম্পত্তির অধিকারী করিয়াছেন তাহার তুলনা মেলে না—রূপে, গুণে, কর্ত্তব্যবুদ্ধিতে ও বিনয়নম্র ব্যবহারে তাহার দুই কন্যার জোড়া নাই। কিন্তু যে অদৃষ্ট-দেবতা কোমলপ্রাণ বাঙালী ঘরের অপরূপ সুন্দরী ও অতিকোমলপ্রাণা বালিকাদের সঙ্গে অতি অপদার্থদের যোগ ঘটাইয়া থাকেন, তিনিই তাহার জ্যেষ্ঠা কন্যা সহৃদয়া ও সুন্দরী মাতঙ্গিনীকে বর্ব্বর রাজমোহনের বাহুবন্ধনে নিক্ষেপ করিলেন। বিবাহ হওয়ার পরেও মাতঙ্গিনীর পিতার বিশ্বাস ছিল যে, বর মাতঙ্গিনীর অনুপযুক্ত হয় নাই। রাজমোহন তখন পূরা জোয়ান; বয়সের বৈষম্য সত্ত্বেও তাহা মানিবার প্রয়োজন হয় নাই। রাজমোহন দেখিতে সুপুরুষ ছিল না; কিন্তু লোকে তখন কিশোর বর খুঁজিতে গেলেই সৌন্দর্য্য দেখিত—যৌবনে যে পা দিয়াছে তেমন বরের চেহারার দিকে লক্ষ্য দেওয়া হইত না। পাশের গ্রামেই তাহার বাস ছিল; বিবাহ হইয়া গেলেও কন্যা যে পিতার নিকট হইতে বহুদূরে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িবে না, এই বিবাহের পক্ষে ইহাও একটি কারণ ছিল। রাজমোহনকে যাহারা জানিত তাহারা তাহার সবল দেহ ও অপরিমেয় দেহশক্তিকে হিংসা করিত ও সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাহাকে না দেখিয়া পারিত না। সে অত্যন্ত কর্ম্মক্ষম ও পরিশ্রমী ছিল এবং কোনও কিছুতেই পশ্চাদ্‌পদ হইত না বলিয়া তাহার পিতা তাহার জন্য কিছুই না রাখিয়া যাওয়া সত্ত্বেও এবং তাহাকে মোটেই শিক্ষাদীক্ষা না দিতে পারিলেও সে কখনও অভাব-অনটনে কষ্ট পাইত না। মাতঙ্গিনীর পিতা রাজমোহনের এই ক্ষমতার পরিচয় পাইয়াছিল এবং কন্যা যে কোনও দিন অভাবের তাড়না সহ্য করিবে না, এ বিষয়ে স্থিরনিশ্চয় হইয়াই এই বিবাহ ঘটাইয়াছিল। দ্বিতীয় এবং অপেক্ষাকৃত ভাগ্যবতী কন্যা হেমাঙ্গিনীই বালক মাধবের বধূ হইল।

 মাধবের পিতা রামকানাই মাধবের কলেজের পাঠ সম্পূর্ণ হইবার পূর্ব্বেই মৃত্যুমুখে পতিত হন। মাধব পিতার মৃত্যুতে কপর্দ্দকহীন হইত, কিন্তু সকলের অজ্ঞাতসারে এমন একটি ঘটনা ঘটিল যাহা তাহাকে এই দুর্দ্দশা হইতে রক্ষা করিল।

 বংশীবদনের তৃতীয় পুত্র রামগোপাল জ্যেষ্ঠ রামকান্তের মত ভাগ্যবানও ছিল না এবং মধ্যম রামকানাইয়ের মত হতভাগ্যও ছিল না। সে নিঃসন্তান অবস্থায় অল্পবয়সে ইহলীলা সম্বরণ করে এবং ভ্রাতুষ্পুত্র মাধবের হাতে নিজের প্রায় সমুদয় সম্পত্তি এই সর্ত্তে দিয়া যায় যে, যতদিন তাহার বিধবা পত্নী মাধবের আশ্রয়ে থাকিবে ততদিন মাধব তাহার ভরণপোষণ করিবে।

 শিক্ষা সম্পূর্ণ না হওয়া পর্য্যন্ত মাধব পড়াশুনা লইয়াই রহিল, তাহার অবর্ত্তমানে ও তাহার সাবালক হওয়া পর্য্যন্ত কর্ম্মচারীরাই সম্পত্তি দেখাশুনা করিতে লাগিল। বৎসর সমাপ্ত হইবার পূর্ব্বেই সে তরুণী সুন্দরী স্ত্রীসমভিব্যাহারে শহর ছাড়িয়া দেশে যাইবার আয়োজন করিতে লাগিল। যাত্রার পূর্ব্বে তাহার পিতামাতার নিকট বিদায় লইবার জন্য সে পত্নীকে পিতৃগৃহে লইয়া গেল। হেমাঙ্গিনী মাতঙ্গিনীর অত্যন্ত স্নেহের পাত্রী ছিল—ভাগ্যচক্রে হউক অথবা যে কারণেই হউক, ঠিক এই সময়ে রাজমোহনের স্ত্রী মাতঙ্গিনী ও পিতৃগৃহে উপস্থিত ছিল।

 শ্বশুরালয়ে বেশিদিন থাকিবার ইচ্ছা মাধবের ছিল না। পিতামাতা ও ভগ্নীর নিকট হইতে অনির্দ্দিষ্ট কালের জন্য বিচ্ছিন্ন হইবার আশঙ্কায় হেমাঙ্গিনী খালি কাঁদিত। তাহার মনে হইত সে দূরে—বহুদূরে চলিয়া যাইতেছে এবং হয়তো কখনও বাল্যের স্নেহস্মৃতিসম্বলিত পিতৃগৃহে ফিরিয়া আসিবে না। তাহার পিতামাতা কি কখনও তাহাকে দেখিতে যাইবেন? বাবা বলিয়াছেন, তিনি যাইবেন। কিন্তু মা? দিদি? মা ও দিদি উত্তর দেয় নাই, নীরবে কাঁদিয়াছিল? তাহাকে আশীর্ব্বাদ করিয়াছিল।

 মাতঙ্গিনী একদিন ভগিনীর হাত ধরিয়া তাহাকে এক পাশে লইয়া গিয়া বলিল, হেম, তোকে একটা কথা বলব, রাখবি? হেমাঙ্গিনী জবাব না দিয়া ডাগর কালো চোখের বিস্মিত আয়ত দৃষ্টি মেলিয়া দিদির দিকে চাহিল।

 মাতঙ্গিনী আবার বলিল, হেম, কালকে আমাদের ছাড়াছাড়ি হবে, নয়? হেমাঙ্গিনী আর থাকিতে পারিল না, ঝরঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল। মাতঙ্গিনী নিজে বহুকষ্টে কান্না সামলাইয়া বলিল, কাঁদিস নে বোন, কাঁদিস নে। ভগবান তোর মঙ্গল করবেন। মাধবের মত স্বামী পেয়েছিস, সে তোকে অসুখী করবে না —এই কথা বলিতে বলিতে তাহার চোখে অশ্রুর বান ডাকিল; গাল ছাপাইয়া ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু হেমাঙ্গিনীর পদ্মের মত শুভ্র হাতের উপর পড়িল। হাতখানি মাতঙ্গিনীর হাতে ধরা ছিল।

 চোখ মুছিয়া হেমাঙ্গিনী জিজ্ঞাসা করিল, আমাকে কিছু বলছিলে দিদি?

 —হেম, আমি বড় গবীব—এত গরীব, তবু শুধু নিজের জন্যে হ’লে তোকে কিছু বলতাম না। কিন্তু আমার স্বামী, সে যাই হোক বোন, ভগবান তাকে অমনই গড়েছেন—তবু সে আমার সব, তার জন্যে আমাকে ভাবতে হয়; সে এখন বেকার ব’সে আছে, অবস্থা তার ভারী খারাপ। তার হয়ে মাধবের কাছে তোকে কিছু বলতে বলেছে, পারবি?

 —পারব না কেন দিদি, কিন্তু কি বলব?

 —বলবি যদি সে তার একটা চাকরি জুটিয়ে দিতে পারে—এমন কিছু যাতে সংসারটা চ’লে যায়।

 —নিশ্চয়ই বলব দিদি।

 হেমাঙ্গিনী প্রতিশ্রুত হইল। তারপর দুই ভগিনী অন্য বিষয় লইয়া কথা বলিতে লাগিল।

 কিন্তু হেমাঙ্গিনী দিদির প্রতি স্নেহের প্রাবল্যে এমন একটি কাজের ভার লইল, যাহা সে কেমন করিয়া করিয়া উঠিবে, ভাবিয়া পাইল না। তাহার বয়সটা এমন কাঁচা যে, এ বয়সে আমাদের দেশের মেয়েরা স্বামীর সঙ্গে ভাল করিয়া কথাই বলিতে পারে না, এমন একটা বিষয় লইয়া কথা তো বলেই না। তবু সে মন স্থির করিয়া স্বামীকে তাহার দিদির সহিত যে কথাবার্ত্তা হইয়াছিল তাহা বলিয়া ফেলিল। মাধব সাধ্যমত চেষ্টা করিবে বলিল।

 রাজমোহন গোঁয়ারদের স্বাভাবিক সঙ্কোচবশতঃ সরাসরি ভায়রাভাইয়ের নিকট নিজের প্রয়োজনের কথা না জানাইয়া সাধারণত দরিদ্র আত্মীয়েরা যে পন্থার আশ্রয় লয়, সেই পথে শাড়ি-রাজ্যের প্রতিনিধির আশ্রয় লওয়াই যুক্তিযুক্ত মনে করিয়াছিল। মাধব কিন্তু রাজমোহনকে নিজেই জবাব দিবে স্থির করিল এবং পরদিন প্রাতে রাজমোহনের সহিত এ বিষয়ে কথাবার্ত্তা শুরু করিল। সে যতটা সম্ভব বিনীত ভাবে রাজমোহনের বর্ত্তমান অবস্থা ও কাজকর্ম্মের সম্বন্ধে প্রশ্ন করিল। রাজমোহন অন্ধ গর্ব্ব অথবা লজ্জা অথবা অন্য কোনও মতলবের বশবর্ত্তী হইয়া নিজের দুরবস্থা স্বীকার না করিয়া, শুধু বলিল—বর্ত্তমানে তেমন কিছু করিতেছে না। মাধব তখন তাহাকে জানাইল যে, তাহার জমিদারির কিয়দংশের পরিচালনার ভার লইতে পারে এমন একজন বিশ্বাসী কর্ম্মঠ আত্মীয়ের সাহায্য তাহার আবশ্যক এবং রাজমোহনের যদি রাধাগঞ্জে গিয়া বাস করিবার কোনও আপত্তি না থাকে, তাহা হইলে এই আত্মীয়ের কাজটুকু করিয়া দিবার জন্য সে তাহার সাহায্য প্রার্থনা করে।

 রাজমোহন জবাব দিল, তা হয় না ভায়া এদের রেখে যাব কার কাছে?

 মাধব বলিল, সে কথা কি না ভেবেই বলছি। রাধাগঞ্জেই একটা ভাল দেখে বাড়ি ঠিক ক’রে দেব।

 রাজমোহন ভায়রাভাইয়ের দিকে তীব্র ক্রুদ্ধ দৃষ্টিপাত করিল। বলিল, রাধাগঞ্জে গিয়ে থাকবে! অসম্ভব, তার চাইতে জেলখানায় প’চে মরা ভাল।—বলিয়াই রাগে গরগর করিতে করিতে সে চলিয়া গেল।

 মাধব রাজমোহনের এই অকারণ ক্রোধ দেখিয়া বিস্মিত হইল, কিন্তু কিছু বলিল না। রাজমোহনের কিন্তু বাছিয়া লইবার মত অন্য পথ ছিল না। তাহার স্ত্রীরও অজ্ঞাত এমন একটি কারণ ছিল যে জন্য অবিলম্বে বাসস্থান পরিবর্ত্তন তাহার পক্ষে নিতান্ত প্রয়োজন হইয়াছিল; কিন্তু সে রাধাগঞ্জে যাওয়ার কথা ভাবে নাই। সে দারিদ্র্যের দোহাই দিয়া আবেদন করিয়াছিল বটে, কিন্তু আবেদনের মূলে দারিদ্র্যের হাত সামান্যই ছিল। মাধবের প্রস্তাবে সে অত্যন্ত বিরক্ত হইয়াছে—এরূপ ভাব প্রকাশ করিল। চাদর লইয়া সে বাড়ির বাহির হইয়া গেল। মধ্যাহ্নের খররৌদ্রে ফাঁকা মাঠের পথে সে একটানা চলিতে লাগিল—দৌড়াইতে লাগিল বলিলেই যেন ঠিক বলা হয়। কোথাও সে দাঁড়াইল না, কাহারও সহিত সে কথা কহিল না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলিয়া গেল, রাজমোহন ফিরিল না।

 অবশেষে যখন সে ফিরিয়া আসিল, তখন সে গম্ভীর—মুখে বিরক্তির চিহ্ন পরিস্ফুট। সে সপরিবারে রাধাগঞ্জে যাওয়াই স্থির করিয়াছে। সে মাধবকে তাহার সঙ্কল্পের কথা নিতান্ত ভদ্রভাবে বলিল না। মাধব তাহার যাওয়ার আয়োজন করিবার সুবিধা দিবার জন্য আরও কিছুদিন থাকিয়া গেল এবং আয়োজন সম্পূর্ণ হইলে সকলে মিলিয়া শহর ত্যাগ করিয়া অল্পদিনের মধ্যেই রাধাগঞ্জে পৌঁছিল।

 রাজমোহনের ব্যবহার যত কর্কশই হউক, যে অভদ্রতার সঙ্গেই সে তাহার সাহায্য গ্রহণ করিয়া থাকুক, মাধব তাহার প্রতি অতি সুন্দর ব্যবহার করিতে লাগিল। বর্ব্বর ভায়রাভাইয়ের দুর্নীতিপরায়ণ অকৃতজ্ঞ চরিত্রের কথা জানিয়াও শুধু মাতঙ্গিনীর অকারণ দুর্ভাগ্যের প্রতি সহানুভূতি দেখাইবার জন্য সে মাত্র একখানি গ্রামের তত্ত্বাবধানের ভার রাজমোহনের হাতে ছাড়িয়া দিল বটে, কিন্তু তাহার মোটা মাহিনার বন্দোবস্ত করিয়া দিল। রাজমোহনের জন্য একটি বাড়িও নির্ম্মিত হইল, এই বাড়ির সহিতই আমরা গ্রন্থারম্ভে পাঠকের পরিচয় করাইয়াছি। মাধব রাজমোহনকে জন-মজুরের সাহায্যে চাষ করিবার উপযুক্ত জমি দিল। রাজমোহন শেষের কাজটা লইয়াই প্রায় সমস্ত সময় ব্যাপৃত থাকিত, জমিদারি শেরেস্তার কাজ সে বুঝিত না বলিলেই হয়।

 কিন্তু এত করিয়াও মাধব রাজমোহনের মন জয় করিতে পারিল না। রাধাগঞ্জে পদার্পণ করা অবধি রাজমোহন হৃদয়হীন ব্যবহারে মাধবকে পীড়িত করিতে লাগিল। মাধবের সহৃদয় ব্যবহারের পরিবর্ত্তে রাজমোহনের ব্যবহারকে শুধু হৃদয়হীন বলিলেই যথেষ্ট হইবে না, রাজমোহন নিষ্ঠুর ব্যবহার করিতে লাগিল, এবং দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে সম্পর্ক সামান্যই রহিল। মাধব বাহিরে রাজমোহনের এই অদ্ভুত আচরণ যেন লক্ষ্যই করিল না, করিলেও সে নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখিয়াই চলিতে লাগিল, কিন্তু এই অকৃতজ্ঞ ব্যক্তির প্রতি সমান দাক্ষিণ্য দেখাইতে সে কুণ্ঠিত হইল না। দুই পক্ষের এই মনোভাবের ফলে পরস্পর অত্যন্ত স্নেহসম্পন্না দুই ভগিনীর মেলামেশার অবকাশ অত্যন্ত কমিয়া গেল।