রাজমোহনের স্ত্রী/পঞ্চম পরিচ্ছেদ

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

একটি পত্র—অন্তঃপুর

 মাধব জ্যেষ্ঠতাত-পুত্রের নিকট বিদায় লইয়া বাগান হইতে ফিরিয়া দেখিল, একটি লোক ‘জরুরী’ মার্কা এক চিঠি লইয়া তাহার অপেক্ষা করিতেছে। মাধব ব্যস্তসমস্তভাবে খামখানি ছিড়িয়া অধীর আগ্রহে চিঠি পড়িতে লাগিল। জেলার সদর হইতে তাহার উকিল এই চিঠি পাঠাইয়াছে। চিঠিখানি পড়িতে পড়িতে মাধব মনে মনে যে সকল মন্তব্য করিল, সেইগুলি শুদ্ধ উহা উদ্ধৃত করিতেছি। মাধব পড়িল—

“মহার্ণব,

 অধীন সদরে থাকিয়া বিশেষ যত্নসহকারে হুজুরের মামলা পরিচালনার কার্য্যে নিযুক্ত আছে এবং সবগুলিতেই যে জয়লাভ ঘটিবে অধীন এইরূপ আশা পোষণ করে।”

 মাধব ভাবিল—সবগুলিতেই...তুমি তা বলিতে পার উকিল, কারণ কোনটাই আমার মিথ্যা মামলা নয়। কিন্তু আদালতেই কি আর সব সময় ন্যায়বিচার হয়?··· তোমার কথা কিছু বাদসাদ দিয়াই ধরিতে হইবে। লোকটা কাজের বটে, মামলা যে ভাল চালায়—এ কথা স্বীকার করিতেই হইবে...আর এই সব হাঙ্গামাহুজ্জুত যদি চুকিয়া যাইত! কিন্তু প্রতিবেশীরা কি আবার মকদ্দমা বাধাইতে ছাড়িবে? হ্যাঁ, তারপর? মাধব পড়িতে লাগিল—

 “নিতান্ত দুঃখের সহিত জানাইতেছি যে, অদ্য অছির সাহায্যে হুজুরের খুড়ীমাতা সদর আমীনের আদালতে হুজুরের নামে এই মর্ম্মে এক মকদ্দমা দায়ের করিয়াছেন যে, তাঁহার স্বামীর উইল জাল এবং তিনি ওয়াশীলাৎ সহ তাহার সম্পত্তি ফিরিয়া পাইবার দাবি করেন।”

 খুড়ীমা!··· বিহ্বল মাধবের হাত হইতে চিঠিখানা পড়িয়া গেল। খুড়ীমা! হায় ভগবান! আমার সমস্ত সম্পত্তি ফিরাইয়া চান! আমি জাল করিয়াছি। হতভাগীকে লাথি মারিয়া বাড়ি হইতে দূর করিয়া দিব।

 মাধব কয়েক মুহূর্ত্ত দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া কি ভাবিল এবং দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া রাগে ফুলিতে লাগিল, শেষে নিজেকে কিঞ্চিৎ শান্ত করিয়া সে চিঠিখানা কুড়াইয়া লইয়া পড়িতে লাগিল।

 “তাহাকে এইরূপ করিবার পরামর্শ কে দিয়াছে, প্রত্যক্ষভাবে অবগত নহি; অধীন অনুসন্ধানের ত্রুটি করে নাই। কারণ, কেহ যে ইহার পিছনে আছে সে বিষয়ে সন্দেহ থাকিতে পারে না, এবং সে একজনের নামও শুনিয়াছে। এই কার্য্যের সঙ্গে মহদাশয়েরা সব যুক্ত আছেন।”

 মাধব ভাবিল, পরামর্শদাতা? কাহারা হইতে পারে? সে অনুমান করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। প্রথমে মনে হইল একজন প্রতিবেশী জমিদারের কথা। তারপর আর একজনের কথা মনে হইল, কিন্তু কোনও নামটাই সম্ভব বলিয়া বোধ হইল না। মাধব পড়িতে লাগিল—

 “কিন্তু হুজুরের ভয় পাইবার কোনই কারণ নাই। আমি জানি উইল জাল নহে এবং যতোধর্ম্মস্ততোজয়ঃ। কিন্তু তবুও সাবধান হইতে হইবে। জজ-কোর্টের অমুক বাবুকে ও অমুক উকিলকে ওকালতনামা দিতে হইবে এবং প্রয়োজন হইলে সদর আদালত হইতেও একজনকে নিযুক্ত করা প্রয়োজন। উভয় পক্ষের সওয়ালজবাবের দিন এবং শেষ শুনানীর তারিখেও সুপ্রীম কোর্টের একজন ব্যারিস্টার রাখিলে ভাল হয়। মোট কথা অধীনের যতটুকু ক্ষমতা আছে, ততটুকু প্রয়োগ করিতে কুন্ঠিত হইব না; এই মকদ্দমার জন্য প্রাণ দিয়াও চেষ্টা করিব। হুজুরের অনুমতির প্রতীক্ষায় রহিলাম। ইতি

সেবকাধম 
শ্রীগোকুলচন্দ্র দাস 

 পুঃ—প্রয়োজনীয় ব্যয় বহনের জন্য আপাততঃ এক হাজার টাকা হইলেই চলিবে।”

 চিঠি পড়িয়াই মাধবের প্রথম মনে হইল, সে খুড়ীমার নিকট গিয়া এই অদ্ভুত আচরণ সম্বন্ধে তাঁহার কি বলিবার আছে তাহা জানিবে। মাধব দ্রুত ভিতর-মহলে প্রবেশ করিল বটে, কিন্তু সেখানে জেনানাজীবনের অতিশয় চাঞ্চল্যের মধ্যে তাহার ক্ষীণ কণ্ঠ তলাইয়া গেল। গোলগাল কালো একটি ঝি, ঠিক কাহাকে লক্ষ্য করিয়া মাধব বুঝিল না, গৃহস্থালীর খুঁটিনাটি দ্রব্যের অভাব লইয়া উচ্চকণ্ঠে চীৎকার করিতেছিল। অপর একজন, দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ বিষয়ে সেও কম ভাগ্যবতী নয়, এবং ভগবানের দেওয়া বিরাট দেহখানি যতখানি সম্ভব প্রকট করিতে সে গর্ব্বই অনুভব করিতেছিল—ঝাঁটা হাতে মেঝেয় ইতস্ততবিক্ষিপ্ত স্তূপীকৃত তরিতরকারির খোসা প্রভৃতি জঙ্গল সাফ করিতে করিতে সমানে জিহ্বার ব্যবহার করিতেছিল। যে তরকারি কুটিয়াছে ঝাঁটার প্রত্যেক প্রহারের সঙ্গে সঙ্গে তাহার বিরুদ্ধে এই অর্দ্ধ-উলঙ্গিনী নারী সশব্দ অভিশাপ বর্ষণ করিতেছিল |

 তৃতীয় একজন উঠানের একপাশে আঁস্তাকুড়ের ধারে বসিয়া কতকগুলি পিতলের বাসন মাজিতে ব্যস্ত ছিল; তাহার বনেদি হাত দুইখানি যত দ্রুত আবর্ত্তিত হইতেছিল মুখযন্ত্রও তাহার সহিত তাল রাখিয়া হতভাগ্য রাঁধুনির বিরুদ্ধে চোখাচোখা বাণ নিক্ষেপ করিতেছিল। রাঁধুনির অপরাধ সে পিতলের পাত্রগুলিকে যথাযোগ্য ব্যবহার করিয়াছে এবং সেইজন্যই তো এত খাটিতে হইতেছে। রন্ধনকারিণী স্বয়ং তখন এই দৃশ্য় হইতে কিছু দূরে একজন বর্ষিয়সী রমণী, সম্ভবত বাড়ির কর্ত্রী অথবা গৃহিণীর, সহিত রাত্রির রান্নার ঘিয়ের পরিমাণ বিষয়ক অত্যন্ত মনোহারী প্রসঙ্গে একটু উত্তপ্ত হইয়া লিপ্ত ছিল বলিয়া বাসনমাজা ঝি তাহার ঐহিক ও পারত্রিক জীবন সম্বন্ধে যে ভয়াবহ আলোচনা করিতেছিল তাহা শুনিতে পাইতেছিল না। অন্নব্যঞ্জনপ্রস্তুতকারিণী সাধ্বী প্রয়োজনের ঠিক দ্বিগুণ ঘি মাত্র চাহিতেছিল, কারণ নিজের ব্যবহারের জন্য খানিকটা ঘি গোপনে না সরাইলে চলিবে কেন! অন্য কোণে রাত্রির আহারের ব্যবস্থা যে লোভনীয়ই হইয়াছে, তাহার প্রমাণস্বরূপ অতি মধুর ঘসঘস শব্দ সহযোগে বঁটিতে মাছ কোটা হইয়া পূর্ব্বোক্ত ধার্ম্মিকা রন্ধনকারিণীর দুঃখের কারণ ঘটাইতেছিল। দালান ও বারান্দায় এদিকে ওদিকে মলিন মৃত্তিকা-প্রদীপ জ্বালাইয়া ছোট ছোট হাতে ধরিয়া কয়েকটি মনোহর মূর্ত্তি নিঃশব্দে না হইলেও মধুর ঝঙ্কার তুলিয়া দ্রুত যাতায়াত করিতেছিল; রূপার মলের রুনুঝুনু আওয়াজ এবং ক্কচিৎ বা ততোধিক মধুর কণ্ঠে তাহাদের পরস্পরকে আহ্বানের শব্দ কানে আসিতেছিল। সম্পূর্ণ উলঙ্গ এক জোড়া শিশু এই অবসরে নিজেদের বীরত্ব প্রমাণ করার জন্য পরস্পরের চুল টানিয়া ছিঁড়িবার ব্যর্থ প্রয়াস করিতেছিল। এই সমস্ত আবর্জ্জনার মধ্যে তাহাদিগকে বেমানান ঠেকিতেছিল না। ছাদের এক কোণে বসিয়া একদল বালিকা সশব্দে আগডুম বাগডুম খেলায় মত্ত ছিল।

 মাধব ক্ষণকাল হতাশভাবে দাঁড়াইয়া রহিল—এই প্রচণ্ড কলকোলাহলের মধ্যে তাহার কথা শুনিবে কে?

 শেষে যখন অসহ্য হইল, গলাটা যতদূর সম্ভব চড়াইয়া সে বলিল, আরে এই মাগীরা, তোরা থাম্ দেখি, একটা কথা বলতে দে।

 এই অল্প কয়টি কথাই যেন যাদুমন্ত্রের কাজ করিল। গৃহস্থালীর অনির্দিষ্ট তৈজসপত্রাদির অভাব সম্বন্ধে যাহার উচ্চ কণ্ঠ এতক্ষণ বায়ুমণ্ডল আলোড়িত করিতেছিল, একটা বিপুল আর্ত্তনাদের মাঝখানেই সে থামিয়া গেল—সেই গোলগাল কালো বপুখানি আর দেখা গেল না। ঝাঁটাহস্তেন সংস্তিতা শ্রীমতীর হস্ত হইতে প্রচণ্ড অস্ত্রখানি খসিয়া পড়িল; সর্পাহতার ন্যায় মুহূর্ত্তকাল সেখানে দাঁড়াইয়া সে দ্রুতপদে তাহার অর্দ্ধউলঙ্গ মেদভার কোনও অন্ধকার কোণে লুকাইবার প্রয়াস করিল। পিত্তল বাসন মাজিবার কার্য্যে যে অনলবর্ষিণী রত ছিল, তাহার কণ্ঠের মধুর অভিশাপবাণী অসম্পূর্ণ রহিয়া গেল; তাহার বাহু ও জিহ্বার আবর্ত্তন সম্পূর্ণ না হইতে হইতেই থামিল। মৎস্যকুলের নিধন-সাধনে যে ব্যস্ত ছিল, সেও খানিক বাধা পাইল এবং যদিও সাহস সঞ্চয় করিয়া পুনরায় সে কার্য্যে মনোনিবেশ করিল, তেমন আওয়াজ আর তাহার কণ্ঠ হইতে নিঃসৃত হইল না। রন্ধনশালায় অধিষ্ঠাত্রী দেবীর ঘৃতবিষয়ক প্রস্তাব অসম্পূর্ণ রহিয়া গেল বটে, কিন্তু তাড়াতাড়িতে পলাইতে গিয়া সে ভুলক্রমে ঘিয়ের পাত্রটাই লইয়া গেল—ইহারই অংশবিশেষের জন্যই এতক্ষণ বাগ্‌বিতণ্ডা হইতেছিল। প্রদীপ হস্তে ইতস্ততসঞ্চরণশীল মূর্ত্তিরা দ্রুতধাবনে অন্তর্দ্ধান করিল বটে, তাহাদের চরণের অলঙ্কার মুখর হইয়া তাহাদিগের আত্মগোপনের পথে বাধা জন্মাইল। অন্ধকারে দুই উলঙ্গ বীরের যুদ্ধ দুই পক্ষেরই পৃষ্ঠপ্রদর্শনে সমাপ্ত হইল; তবে অপেক্ষাকৃত কৃতী যোদ্ধা যে, সে পলাইবার মুখেও বিপক্ষের পশ্চাতে একটি লাথি মারিয়া নিজের প্রাধান্য প্রচার করিতে ছাড়িল না। এই বীরের পশ্চাৎ পশ্চাৎ আগডুম বাগডুম খেলায় রত বালিকারা খেলা ছাড়িয়া হাসি চাপিবার বৃথা চেষ্টা করিতে করিতে পলাইল। ইতিপূর্ব্বে যে দৃশ্যের কলকোলাহলের তুলনা ছিল না, সেই দৃশ্যই হঠাৎ একেবারে নীরব হইয়া গেল, শুধু ঘরের প্রবীণা গৃহিণীই শান্ত স্থির ভাবে গৃহকর্ত্তার সম্মুখে দাঁড়াইয়া রহিলেন।

 প্রবীণাকে সম্বোধন করিয়া মাধব বলিল, মাসী, ব্যাপার কি? বাড়িতে বাজার বসেছে যে!

 মাসী প্রসন্ন স্নেহের হাসি হাসিয়া বলিলেন, পাঁচজন মেয়ে এক জায়গায় হ’লে যা হয় তাই হচ্ছে বাছা, চ্যাঁচানোই তো স্বভাব ওদের।

 —খুড়ীমা কোথায় মাসী?

 —সেই কথা তো আমিও ভাবছি বাপু। সকাল থেকেই তাকে দেখতে পাচ্ছি না।

 মাধব বিস্মিত হইয়া বলিল, সকাল থেকে দেখতে পাচ্ছ না? কথাটা তা হ’লে দেখছি সত্যি।

 —কি সত্যি বাবা?

 —এমন কিছু নয় মাসী, তোমাকে পরে বলব। তা হ’লে তিনি গেলেন কোথায়? জিজ্ঞেস ক’রে দেখ তো কেউ তাকে দেখেছে কি না!

 মাছ ও পিতলের বাসন লইয়া যাহারা ব্যস্ত ছিল, তাহাদিগকে সম্বোধন করিয়া প্রবীণা কহিলেন, অম্বিকা, শ্রীমতী, তোরা কি তাকে দেখেছিস?

 মৃদু কণ্ঠে তাহারা জবাব দিল, না।

 প্রবীণা কহিলেন, আশ্চর্য্য! তারপর যেন দেওয়ালকে সম্বোধন করিয়াই কহিলেন, কেউ দেখে নি তাকে?

 দেওয়ালের ওপাশ হইতে কে জবাব দিল, স্নানের সময় তাকে বড়বাড়িতে দেখে এসেছি।

 প্রবীণা বিস্মিত হইয়া কহিলেন, বড়বাড়িতে?

 মাধবও বলিয়া উঠিল বড়বাড়িতে? মথুরদাদার বাড়িতে?—মাধব হঠাৎ যেন ব্যাপারটা বুঝিতে পারিল; অর্দ্ধস্ফুট স্বরে বলিল, মথুরদাদা! তা হ’লে কি তিনিই এসব করাচ্ছেন? না, না, তা হতে পারে না। আমি অন্যায় সন্দেহ করছি।

 পরক্ষণেই একটু উচ্চকণ্ঠে উপস্থিত স্ত্রীলোকদের একজনকে সম্বোধন করিয়া মাধব কহিল, বড়বাড়িতে গিয়ে দেখ, সেখানে যদি খুড়ীমা থাকেন, তাকে এখনই আসতে বল। যদি তিনি আসতে না চান, তারও কারণ জেনে এস।