রাজমোহনের স্ত্রী/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

মুদিতচক্ষু ব্যক্তি মাত্রই নিদ্রিত নয়; প্রস্তর-প্রাচীরের

মত মৃত্তিকা-প্রাচীরেরও কান থাকে।

 আসুন পাঠক, আমরা মাতঙ্গিনীর নিকট ফিরিয়া যাই। স্বামী কর্তৃক কঠোরভাবে লাঞ্জিত হইবার পর সেই যে তাহার পিসশাশুড়ী তাহাকে তাহার শয়ন-কক্ষে টানিয়া আনিয়াছিলেন, তখন পর্য্যন্ত সে বাহিরে আসে নাই। দ্বার রুদ্ধ করিয়া আপনার যন্ত্রণায় মুহ্যমান হইয়া সে পড়িয়া ছিল। বৃদ্ধা যথাসময়ে নৈশ আহার প্রস্তুত করিয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহার এবং ননদী কিশোরীর সকল অনুরোধ-উপরোধই ব্যর্থ হইয়াছিল, সে বাহিরে আসিয়া খাইতে বসে নাই। তাঁহারা শেষে হাল ছাড়িয়া দিয়া নিজের দুশ্চিন্তা লইয়া তাহাকে পড়িয়া থাকিতে দিয়াছিলেন।

 শয্যায় শুইয়া শুইয়া মাতঙ্গিনী ভাবিতেছিল, এই ভাবেই তাহাকে সারা-জীবন দুঃখ-যন্ত্রণা ভোগ করিতে হইবে। সে জানিত তাহার স্বামী সে রাত্রে আর তাহার সহিত দেখা করিবে না; তাহার প্রতি কুপিত হইলে এরূপ করাই তাহার স্বভাব। ইহাতে সে কতকটা খুশিই ছিল, কারণ একা থাকিতে পাইলে সে নিজের ভাবনা চিন্তা লইয়া নিরুপদ্রবে থাকিবে।

 রাত্রি গভীর হইলে বাটীর সকলে একে একে শয়ন করিতে গেল। ঘরে ও বাহিরে গভীর শান্তি বিরাজ করিতে লাগিল। মাতঙ্গিনীর কক্ষে প্রদীপ ছিল না, গাঢ় অন্ধকারে কক্ষ আচ্ছন্ন ছিল, কেবল ক্ষুদ্র গবাক্ষের ফাটল দিয়া খানিকটা প্রদীপ্ত চন্দ্রকিরণ ঠাণ্ডা মাটির মেঝের উপরে আলোর একটি রেখা টানিয়া দিয়াছিল! উপাধান হইতে ঈষৎ ঊর্দ্ধে আপনার বাহুর উপর মাথা রাখিয়া, প্রচণ্ড গ্রীষ্মের প্রকোপে বক্ষদেশ হইতে অঞ্চলথানি কোমর অবধি টানিয়া সেই চন্দ্রকিরণরেখার পানে একদৃষ্টে চাহিয়া থাকিতে থাকিতে মাতঙ্গিনীর স্মৃতিপথে তাহার শৈশবের কথা উদিত হইল—যখন সে ভাবনা-বিরহিত লঘু শিশু-চিত্ত লইয়া সায়াহ্নসূর্য্যকরে নাচিয়া খেলিয়া বেড়াইত। হায় রে শৈশব! স্নেহের হেমাঙ্গিনীর সঙ্গে হাত ধরাধরি করিয়া খোলা আকাশের তলে শুইয়া স্নিগ্ধরশ্মি-বিকিরণকারী সীমাহীন নীল আকাশ-সমুদ্রে সন্তরমান রৌপ্যগোলকের দিকে চাহিয়া কাটানো শৈশব! শিশুমনের প্রিয় কত কাহিনীই যে তাহারা পরস্পরকে শুনাইত, অথবা স্নেহময়ী ঠাকুরমার মুখে শুনিত—কি সে একাগ্রতা আর আনন্দ! এই আট বৎসরে কত পরিবর্ত্তনই যে ঘটিয়াছে! সেই উচ্চ কলকণ্ঠ কোথায় মিলাইয়াছে, যে মুখগুলিকে সে ভালবাসিত, যাহাদের স্মৃতি তাহার অন্তরে সযত্নে রক্ষিত ছিল, সেগুলি পর্য্যন্ত যে কোথায় অন্তর্হিত হইয়াছে! সেই স্মিত হাসি, সেই স্নেহবিজড়িত কণ্ঠস্বর—হায় রে, সেই হাসি দেখিবার জন্য ও সেই স্নেহমস্বর শুনিবার জন্য আজ সে তাহার সর্বস্ব দিতে পারে। তাহার অন্তরের প্রেম-প্রস্রবণ নিত্য উৎসারিত হইতে চায়, কিন্তু পাষাণের অন্তরায়। উৎস-মুখেই সেই স্বর্গ-মন্দাকিনী-ধারা কাহার রূঢ় নিশ্বাসে স্তব্ধ হইয়া গিয়াছে। বেদনাময় একটি স্মৃতি—বেদনাময় তবু এত মধুর যে বারম্বার সেই কথাই ঘুরিয়া ফিরিয়া মনে জাগে—তাহার অতীত সৌভাগ্যের সহিত বর্ত্তমান দুর্ভাগ্যের সংযোগ রক্ষা করিতেছিল। সেই স্মৃতি সে ভুলিতে চায়, কিন্তু পারে কই? ভাবিতে ভাবিতে কনকের কথা তাহার মনে পড়িল; তাহার কাছাকাছি সেই এখন একমাত্র প্রাণী, যে তাহাকে ভালবাসে। ছলচাতুরীহীন সরল কনক; শুধু তাহাকেই সে তাহার মনের গোপন স্মৃতির কথা নিবেদন করিয়াছে। এইটুকু ছাড়া মাতঙ্গিনীর জীবনের ইতিহাস, নিরবচ্ছিন্ন দুঃখ-যন্ত্রণা ভোগের ইতিহাস মাত্র। মাতঙ্গিনী এই কথা ভাবিতে ভাবিতেই কাঁদিতেছিল যে, এই নিদারুণ যন্ত্রণা হইতে তাহার অব্যাহতি নাই।

 গ্রীষ্মের গুমট গরম ক্রমশঃ অসহ্য বোধ হইতে লাগিল, মাতঙ্গিনী শয্যা ছাড়িয়া জানালাটা খুলিয়া দিবার জন্য উঠিল। কিন্তু জানালা খোলা হইল না—অতি মৃদু ও সতর্ক পদক্ষেপ-শব্দ সহসা তাহার কর্ণগোচর হইল। ঘরের বাহিরের শব্দ হইলেও দূরের নহে, যে জানালার ধারে সে দাঁড়াইয়াছিল, ঠিক যেন তাহার পশ্চাতেই শব্দ হইতেছিল। মেটে ঘরের জানালা যেমন সাধারণত হয় এই জানালাটি সেই ধরনেরই ছিল—খুব ছোট, দৈর্ঘ্যে প্রস্থে তিন আর দুই ফুটের বেশি হইবে না, এবং ঘরের মেঝে হইতে ইহার উচ্চতাও দুই ফুটের অধিক নহে।

 মাতঙ্গিনী থামিল, থামিয়া জানালার ফাটল দিয়া বাহিরে দেখিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু অনতিদূরে একসারি গাছ এবং দূরে চন্দ্রালোকিত আকাশের পটভূমিতে অপর কতকগুলি গাছের আন্দোলিত শীর্ষদেশ ছাড়া কিছুই দেখিতে পাইল না।

 পদশব্দ যেখান হইতে আসিতেছিল, সেখানে বা তাহার কাছাকাছিও কোনও পায়ে-চলার পথ ছিল না; মাতঙ্গিনী ভীত হইল, পাষাণপুত্তলিকার মত দাঁড়াইয়া উৎকর্ণ হইয়া আবার সেই শব্দ শুনিতে চেষ্টা করিল। পদধ্বনি তাহার অত্যন্ত নিকট পর্য্যন্ত আসিয়া থামিয়া গেল। মাতঙ্গিনী শুনিতে পাইল, কাহারা অতি মৃদুস্বরে যেন কানে কানে কথা কহিতেছে; কথোপকথন-নিরতদের মধ্যে একজনের কণ্ঠ তাহার স্বামীর কণ্ঠ বলিয়া চিনিতে পারাতে মাতঙ্গিনীর কৌতূহল ভয়ানক বাড়িয়া গেল; ওই কণ্ঠ অপেক্ষাকৃত উচ্চস্বরে কথা বলিতেছিল। মাতঙ্গিনী ও ইহাদের মধ্যে তখন একটি সামান্য মেটে দেওয়াল ছাড়া অন্য ব্যবধান ছিল না বলিয়া একেবারে স্পষ্ট সব কথা শুনিতে না পাইলেও বক্তাদের উদ্দেশ্য বুঝিবার মত সব কিছুই শুনিতে পাইতেছিল।

 পরস্পর কিঞ্চিৎ বাক্যবিনিময় হওয়ার পর একজন বলিল, অত জোরে কথা বলছ কেন? তোমার বাড়ির লোকে শুনতে পাবে যে!

 মাতঙ্গিনী গলার আওয়াজে বুঝিল, রাজমোহন বলিতেছে—এত রাত্রে কেউ জেগে নেই।

 —আচ্ছা দেখ, দেয়ালের কাছ থেকে একটু স’রে গিয়ে কথা বললে হয় না? যদি কেউ জেগে থাকেও আমাদের কথা সে শুনতে পাবে না—অপর ব্যক্তি এই মন্তব্য করিল।

 রাজমোহন বলিল, না হে, না, তোমার কথা যদি সত্যিও হয়, কেউ যদি জেগেও থাকে; তা হ’লে আমরা এই জায়গাটাতেই সব চাইতে নিরাপদ আছি—দেয়ালের আর চালের আড়ালে বাড়ির ভেতর থেকে কেউ আমাদের দেখতে পাবে না, জানলার ফাটল দিয়েও এখানটা দেখা যায় না। এত রাত্রে যদি কেউ বাইরে আসে, তা হ’লেও আমাদের দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা কম।

 অন্যজন উত্তর দিল, ঠিক। আচ্ছা, এ ঘরটায় কে থাকে?

 রাজমোহন বলিল, সে খোঁজে তোমার কাজ কি? কিন্তু পরক্ষণেই সামলাইয়া লইয়া বলিল, তোমাকে বলতে বাধা নেই, এটা আমার শোবার ঘর, আমার স্ত্রী ছাড়া এ ঘরে কেউ নেই।

 অন্যজন প্রশ্ন করিল, তোমার স্ত্রী তো জেগে থাকতেও পারে।

 —ঘুমুচ্ছে নিশ্চয়ই, তবু দেখে আসি। তুমি এখানেই দাঁড়াও।

 মাতঙ্গিনী শুনিল, পায়ের শব্দ ধীরে ধীরে দূরে যাইতেছে। মৃদু নিঃশব্দ পদসঞ্চারে সে শয্যার সমীপবর্ত্তী হইয়া অত্যন্ত সতর্কতার সহিত তাহার উপর উঠিল—আঁচলের খসখস শব্দ ও শোনা গেল না; তারপর অত্যন্ত সন্তর্পণে ঘুমন্ত লোক যে ভাবে শয়ন করে, ঠিক সেইভাবে শুইয়া পড়িয়া চক্ষু মুদ্রিত করিল।

 রাজমোহন তাহার শয়ন-কক্ষের দ্বার অবধি আসিয়া মৃদুভাবে তাহাতে আঘাত করিল, কেহ দরজা খুলিল না। ধীরে ধীরে সে স্ত্রীর নাম ধরিয়া ডাকিল। তাহাতেও কোন ফল হইল না। রাজমোহন বুঝিল, মাতঙ্গিনী নিশ্চয়ই ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। তাহার উপর রাগ করিয়া চুপ করিয়া থাকাও অসম্ভব নয় ভাবিয়া সে ঘরে ঢুকিয়া দেখিবে স্থির করিল। রাগের কারণ তো যথেষ্ট ঘটিয়াছে। রাজমোহন রান্নাঘরে ঢুকিয়া প্রদীপ জ্বালিল এবং সেই প্রদীপ হাতে ফিরিয়া শোবার ঘরের দরজার পাশে প্রদীপ নামাইল, তারপর এক পায়ের সাহায্যে দরজার এক পাল্লা চাপিয়া ধরিয়া এক হাত দিয়া অন্য পাল্লাটি সজোরে টানিতেই দুই পাল্লার মাঝখানে খানিকটা ফাঁক হইল। রাজমোহন সেই পথে আঙুল ঢুকাইয়া পরীক্ষা করিল, কাঠের বড় হুড়কো, ছোট থিল এবং লোহার ছিটকিনি সবগুলিই বন্ধ আছে কি না! শুধু কাঠের বড় হুড়কোটিই লাগানো ছিল; রাজমোহন বুঝিল যে তাহাকে তাহার ইচ্ছামত ঘরে ঢুকিতে দিবার জন্যই মাতঙ্গিনী খিল সম্বন্ধে সাবধান হয় নাই—বাহির হইতে হুড়কো খুলিয়া ফেলা যায়। রাজমোহন দুইটি আঙুল ঢুকাইয়া হুড়কো উপরে তুলিয়া আঙুল সরাইয়া তাহা খুলিয়া ফেলিল এবং দীপহস্তে ঘরের ভিতর ঢুকিল।

 রাজমোহন দেখিল, তাহার স্ত্রীর দেহ শয্যায় এলানো, সে ঘুমাইতেছে সে কয়েকবার এমন মুদুস্বরে মাতঙ্গিনীর নাম ধরিয়া ডাকিল, ঘুমাইয়া থাকিলে সে যাহাতে না জাগিয়া পড়ে; অতি মধুর কণ্ঠে ডাকিল। রাগ বা অভিমানের বশে যদি সে চুপ করিয়া থাকে, মিষ্টস্বর শুনিয়া রাগ অভিমান ভুলিয়া হয়তো সে জবাব দিবে। মাতঙ্গিনী তবুও নীরব, তাহার নিঃশ্বাস ঘন হইয়া পড়িতেছে। মাতঙ্গিনীর ঘুমের ভান করিবার কোনই কারন রাজমোহন ভাবিয়া পাইল না, সে তাহার ঘুম সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হইয়া ঘরে বাহিরে আসিয়া যে কৌশলে দরজা খুলিয়াছিল, ঠিক সেই কৌশলে আবার তাহা বন্ধ করিল। তাহার পর, প্রদীপ নিবাইয়া বাড়ির চারিদিকে একবার টহল দিতে দিতে প্রত্যেক ঘরের দরজায় মৃদু আঘাত করিয়া নিদ্রিতদের নাম ধরিয়া ধীরে ধীরে ডাকিয়া কাহাকেও জাগ্রত না দেখিয়া তাহার সঙ্গীর কাছে ফিরিয়া গেল।

 স্বামীর পদশব্দ মিলাইতে না মিলাইতে মাতঙ্গিনী শয্যা ত্যাগ করিয়া আবার নিঃশব্দপদসঞ্চারে জানালার ধারে আসিয়া দাঁড়াইয়া নিম্নলিখিত কথাবার্তা শুনিল।

 কোন দিক দিয়া ভয়ের কোনও আশঙ্কা নাই জানিয়া রাজমোহনের অজ্ঞাত সঙ্গী কহিল, তুমি তা হ’লে এই ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করতে রাজি আছ?

 বিশেষ রাজি নই।—রাজমোহন জবাব দিল।—অবিশ্যি এতদূর এগিয়ে সাধুগিরি ফলাবার মতলব আমার নেই, কিন্তু লোকটাকে আমি পছন্দ না করলেও সে আমার অনেক উপকার করেছে।

 ধূর্ত্ত আগন্তুক প্রশ্ন করিল, তা হ’লে তাকে তোমার ভাল লাগে না কেন?

 রাজমোহন বলিল, কেন? ভাল সে আমার অনেক করেছে বটে, কিন্তু মন্দও কম করে নি, সম্ভবত ভালর চাইতে মন্দই করেছে বেশি।

 —তা হ’লে আমাদের সাহায্য করছ না কেন?

 —করব, কিন্তু আমি যা চাইব তা আমাকে দিতে হবে। আমি এ পাপ জায়গা ছেড়ে অন্যত্র উঠে যেতে চাই, কিন্তু অন্যত্র গেলে আমার দুবেলা দুমুঠো অন্ন জোটা ভার হবে। সুতরাং যাতে অন্য জায়গায় উঠে গেলেও আমার বিপদ হবে না, সেই পরিমাণ টাকা আমার চাই। তোমাদের সাহায্য করলে তোমরা যদি টাকাটা পাইয়ে দাও, আমি রাজি আছি।

 আগন্তুক বলিল, তোমার কত চাই, বল।

 রাজমোহন জবাব দিল, আমাকে কি করতে হবে, তা জানতে পারলে আমার দাবির কথা বলতে পারি।

 —ইতিপূর্ব্বে একবার যা করেছ তাই করতে হবে। তার অস্থাবর সম্পত্তি যা কিছু সরাতে হবে, এই কাজে তোমার সাহায্য দরকার। এবারে নগদ টাকা ছাড়া আর যা কিছু পাব সব তোমার জিম্মায় রেখে দেব; কিন্তু কাজটা আজ রাত্রেই করা চাই।

 রাজমোহন বলিল, বুঝতে পারছি, কিন্তু আমার সাহায্য তোমাদের কতখানি দরকার সে খবর আমার কাছে লুকুলে তোমাদের বিশেষ সুবিধা হবে না। অমন ডাকসাইটে ধনীর ঘরে অমন ব্যাপার করার ফল কি দাঁড়াবে বুঝতেই পারছ—সম্পত্তির খোঁজে কি ভয়ঙ্কর খবরদারি আর খানাতল্লাসি যে চলবে! তোমরা চাইছ এমন একজন লোক যে ততদিন পর্য্যন্ত তোমাদের এই অপহৃত সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ করবে, যতদিন না তোমরা সম্পূর্ণ নিরাপদ হয়ে তার উপস্বত্ব ভোগ করতে পার—এমন লোক হওয়া চাই যে একেবারেই বিশ্বাসঘাতকতা করবে না। আমাকে পাকড়াও করেছ ঠিকই, কারণ তোমরা জান এ কাজ আমার মত আর কেউ করতে পারবে না, আমাকে কেউ সহজে সন্দেহ করবে না, তা ছাড়া ওসব জিনিস লুকিয়ে রাখবার মত জায়গাও আমার আছে। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে, আমার দাবি তোমাদের কাছে বেশি মনে হবে।

 পাঠককে বলিয়া দিতে হইবে না যে, আগন্তুক একজন ডাকাত-সে বলিল, বুঝতেই যখন পারছ, একটু হিসেব করে বল।

 রাজমোহন বলিল, আমি দরকষাকষি করতে চাই নে—তোমরা সম্পত্তি বিক্রি ক’রে যা পাবে, তার চার ভাগের এক ভাগ আমাকে দিতে হবে।

 দস্যু রাজমোহনকে ভাল রকমই চিনিত, সে বুঝিল, রাজমোহন অবস্থা বুঝিয়া দাঁও মারিবার চেষ্টায় আছে। কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া সে বলিল, আমার কথা যদি শুনতে চাও, আমি রাজি। কিন্তু অন্যদের মতও তো নেওয়া দরকার। অবিশ্যি তুমি জান আমার কথায় তারা অমত করবে না।

 রাজমোহন বলিল, তা আমি জানি, কিন্তু আমার আর একটা কথা আছে; মাল সরিয়ে ফেলবার আগে, আন্দাজে একটা দাম ধ’রে আমাকে নগদ তার একের চার ভাগ দিতে হবে। অবিশ্যি, বিক্রি করতে গিয়ে যদি দাম কম পাও, আমি টাকা ফেরত দেব, বেশি পেলে, তোমরা বাকিটা পরে দেবে

 বেশ বেশ, তাতে আর কথা কি, কিন্তু আমাদের আর একটা শর্ত্ত আছে—আর একটা কাজ তোমাকে করতে হবে।

 —তার জন্যে আলাদা ইনাম দিলে নিশ্চয়ই করব।

 —ইনাম পাবে বই কি। মাধব ঘোষের সম্পত্তি আমরা নিজেদের জন্যে চাই, অন্য একজনের আর একটা ফরমাস আছে।

 কৌতুহলী রাজমোহন প্রশ্ন করিল, কি আবার?

 —মাধব ঘোষের খুড়োর উইল।

 রাজমোহন সামান্য বিচলিত হইল। শুধু বলিল, হুঁ।

 —হ্যাঁ, দাম আমরা এর জন্যে দেব। এই উইল সে কোথায় রাখে তোমাকে বলতে হবে।

 —আমি নিজেও ঠিক জানি না, তবে একটা হাতবাক্স থেকে তার জরুরী কাগজপত্র বের করতে আমি দেখেছি; কিন্তু সেটা কোথায় থাকে আমি জানি না, অন্য কোনও বাক্সে, কি সিন্দুকে কিংবা আলমারিতে হয়তো সেটা থাকে। আমি ঠিক জানি না—কিন্তু জিজ্ঞেস করি, এটা কার ফরমাস বল তো?

 —তা বলতে আমরা বাধ্য নই।

 —আমাকেও বলবে না?  —কাউকে না।

 —মথুর ঘোষ, নয়?

 —হতে পারে, না হতেও পারে। আচ্ছা, বাক্সটা কি রকমের?

 —আমাকে দিচ্ছ কি?

 —কি চাও তুমি?

 —নগদ দুশো টাকা।

 —দুটো কি তিনটে কথার জন্যে দুশো টাকা? বড্ড বেশি। কিন্তু আমাদের কাজও তো ঢের।—দস্যু যেন নিজের মনেই বলিতে লাগিল, সমস্ত রাত ধ’রে একটা কাগজের টুকরো খোঁজা! বাক্সটা নিশ্চয়ই শোবার ঘরের লোহার সিন্দুকে আছে; বাক্সটা দেখতে কেমন জানতে পারলে আর বের করা কঠিন হবে না। তোমার সঙ্গে ছ্যাঁচড়ামি করা বৃথা— বেশ, তোমার কথাতেই রাজি।

 রাজমোহন বলিল, বাক্সটা হাতির দাঁতের, ডালার ওপর সোনা দিয়ে লেখা তিনটি ইংরেজী অক্ষর—তার নামের প্রথম অক্ষর তিনটি।

 দস্যু বলিল, সবই তো পাকাপাকি কথা হ’ল। এখন তুমি আমার সঙ্গে এস, দলের লোকের সঙ্গে কথা বলা যাক। আমরা একটা জায়গা ঠিক ক’রে দেব, তুমি সেখানে আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে। এস, আর দেরি করার সময় নেই, চাঁদ ডুববার সঙ্গে সঙ্গে কাজ আরম্ভ করতে হবে। গ্রীষ্মকালের রাত—বড্ড শিগগির ফুরিয়ে যায়।

 এই বলিয়া দস্যু ও তাহার সহকারী ধীরে ধীরে দেওয়ালের ছায়ার আড়াল ছাড়িয়া পরস্পর কিছু ব্যবধান রাখিয়া বনের পথ ধরিয়া চলিতে চলিতে অচিরকালমধ্যে এক অন্ধকার স্থানে আসিয়া মিলিত হইল। এদিকে মাতঙ্গিনী বিস্ময়ে ও আতঙ্কে বিমূঢ় হইয়া মেঝেতে লুটাইয়া পড়িল।