রাজমোহনের স্ত্রী/সপ্তম পরিচ্ছেদ



সপ্তম পরিচ্ছেদ

 লেখক এই অধ্যায়ে কয়েকটি অপদেবতার অবতারণা করিবার সুবিধা পাইয়াও হারাইয়াছেন এবং তাঁহার তরুণ পাঠক-পাঠিকাদিগকে বঞ্চিত করিবার জন্য অনুতপ্ত হইতেছেন।

 অলক্ষ্যে থাকিয়া যে ভয়াবহ কথোপকথন মাতঙ্গিনী শুনিল, তাহার প্রত্যেকটি কথা তাহার কানে প্রবেশ করিয়া আতঙ্কে তাহার বুকের রক্ত হিম করিয়া দিতে লাগিল। তবু কথাবার্ত্তা যতক্ষণ চলিল, সে তাহার কম্পিত দেহলতাকে ভাঙিয়া পড়িতে দিল না, ভয়াবহ কৌতূহলের বশবর্তী হইয়া পূর্ব্বাপর সমস্তটা দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া শুনিল, কিন্তু কথা সমাপ্ত হইবার সঙ্গে সঙ্গে সে মৃতবৎ মেঝেতে লুটাইয়া পড়িল। কিয়ৎকাল ভয় ও যন্ত্রণার আতিশয্যে মুহ্যমান হইয়া মূর্চ্ছিতের মত সে পড়িয়া রহিল। ধীরে ধীরে তাহার চিন্তাশক্তি ফিরিয়া আসিতেই সে যাহা শুনিয়াছে, তাহার যথার্থ অর্থ হৃদয়ঙ্গম করিবার চেষ্টা করিল। তাহার স্বামীর চরিত্র ও জীবনের নূতন ও ভীষণ একটা দিক অকস্মাৎ আলোক-সম্পাতে তাহার নিকট স্পষ্ট হইয়া উঠিল। সে এতদিন পশুপ্রবৃত্তিসম্পন্ন স্বামীর কঠোর হৃদয় ও পশুর মত মেজাজের পরিচয়ই পাইয়াছিল, আজ দস্যুদলের সহকারী, সম্ভবত নিজে দস্যু, স্বামীর নূতন মূর্ত্তি দেখিয়া কদর্য্য গ্লানিতে তাহার দেহ ও মন কুঞ্চিত হইয়া উঠিল; তাহার স্মৃতি এই ভাবিয়াই পীড়িত হইতে লাগিল যে, এই ব্যক্তিই এতকাল তাহার নিষ্কলঙ্ক বক্ষে বিহার করিয়াছে। ভবিষ্যতের কথাও তাহার মনে হইল—এখন হইতে জানিয়া শুনিয়াই এই ব্যক্তির বীভৎস আলিঙ্গনে তাহাকে ধরা দিতে হইবে, নিজেকে দূরে রাখিবার উপায় নাই। সে সম্পূর্ণ শক্তিহীন। উপায় নাই, উপায় নাই, তাহাকে চিরকাল এই অভিশপ্ত জীবন যাপন করিতে হইবে।

 এক-একবার এই সকল চিন্তায় তাহার বক্ষ উদ্বেলিত ছিন্নভিন্ন হইতে লাগিল—পরক্ষণেই যে পাপকর্ম্মে তাহার স্বামী সহায় হইতে যাইতেছে, তাহার ভীষণতা তাহার মানসচক্ষে স্পষ্ট হইয়া উঠিতে লাগিল। এই দুশ্চিন্তায় সে কম্পান্বিত-কলেবর হইতে লাগিল। এই ভীষণ দুষ্কার্য্যের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হইবে তাহারই হেমাঙ্গিনী এবং তাহারই মাধব। তাহার গাত্র রোমাঞ্চিত হইল, শিরায় শিরায় যেন ফুটন্ত রক্ত প্রবাহিত হইল, সে মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করিল। তাহার অত্যন্ত প্রিয় আপনার জন, যাহারা নিশ্চিন্ত নির্ভয়ে নিদ্রাগত অথচ যাহাদের দ্বারে দারিদ্র্য ও দুর্ভোগ, সম্ভবত ভীষণতর কিছু, তাহাদিগকে দণ্ডকালমধ্যে গ্রাস করিবার জন্য ওত পাতিয়া বসিয়া আছে, তাহাদের মঙ্গলচিন্তায় সে নিজের অভিশপ্ত ভবিষ্যৎ ও লাঞ্ছিত নারীত্বের কথা পর্য্যন্ত বিস্মৃত হইল। যদি নিজের জীবন দিয়াও তাহাদিগকে বাঁচাইতে হয়, তাহাও করিতে হইবে।

 নিজেদের বাড়ির সকলকে জাগাইয়া তুলিবার কথাই তাহার সর্ব্বপ্রথমে মনে হইল। কিন্তু পর-মুহূর্ত্তেই সে বুঝিতে পারিল, তাহা সুবুদ্ধির কাজ হইবে না। রাজমোহন যে এরূপ করিতে পারে, তাহা সে বলিলেও কে বিশ্বাস করিবে? তাহার পিসীমা বিশ্বাস করিবে! তাহার বোন! তাহারা মনে করিবে, নিশ্চয়ই তাহার মাথা খারাপ হইয়া গিয়াছে। সে স্বপ্ন বা বিকারের ঘোরে প্রলাপ বকিতেছে। যদি তাহারা বিশ্বাসও করে, মাধবকে বাঁচাইবার জন্য রাজমোহনের বিপদ তাহারা কখনও ডাকিয়া আনিবে না। তাও যদি তাহারা করিতে চায়, মাধবকে কি তাহারা বাঁচাইতে পারিবে? না, তাহারা আত্মীয় রাজমোহনকে এমনই ভয় করিয়া চলে যে তাহার বিরুদ্ধে একটি কথাও বলিতে পারিবে না। যদি তাহারা তাহাকে বিশ্বাস না করে এবং সে যাহা বলিয়াছে তাহা রাজ— মোহনের নিকট প্রকাশ করিয়া দেয়, তাহা হইলে তাহার সর্বনাশ অবশ্যম্ভাবী।

 কনকের কথা তাহার মনে হইল—মাধবের বাড়িতে খবর দিবার জন্য কনককে পাঠাইলে হয় না? কনকদের বাড়ি বেশি দূরে নয়, চুপি চুপি নিজের ঘর হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া রাজমোহনকে বিপন্ন না করিয়া মাধবের বিপদের কথা তাহাকে জানাইয়া দিবার মত খবর কনককে দিয়া আসিলেই হইতে পারে। একেবারে অসম্ভব না হইলেও এই উপায় সুবিধার মনে হইল না। কনকের মাকে না জাগাইয়া কনককে সে জাগাইতে পারে না, কারণ সে জানে দুইজনে এক ঘরেই শোয়। কনক বিনাবাক্যব্যয়ে তাহার কথা বিশ্বাস করিবে, কিন্তু তাহার মা তাহা করিবে না; তাহাকে ব্যাপারটা বুঝাইতে হইলে আগাগোড়া সমস্ত খুলিয়া বলিতে হইবে, তাহাতে স্বামীও জড়াইয়া পড়িবেন। কিন্তু ঈশ্বর ও মানুষকে সাক্ষী করিয়া একদিন যাহার নিকট সে আত্মসমর্পণ করিয়াছে, তাহার বিরুদ্ধে সে কিছুতেই কিছু বলিতে পারে না। কনককে একলা ডাকিয়া লইয়া এই মধ্যরাত্রির অভিযানের উদ্দেশ্য প্রকাশ করিয়া বলা সম্ভব নয়। কনকের মা কন্যাকে মাঝরাত্রে একলা বাড়ির বাহিরে যাইতে দিতে না পারে—সঙ্গে অন্য স্ত্রীলোক থাকিলেও ব্যাপারটাকে সে সমান খারাপ মনে করিবে। হিতে বিপরীতও ঘটিতে পারে—সে মাতঙ্গিনীদের ঘরের সকলকে জাগাইয়া তাহাদের হাতে মাতঙ্গিনীকে সঁপিয়া দিতে চাহিবে ইহাই স্বাভাবিক। মাতঙ্গিনী পাগল অথবা দুশ্চরিত্র হইয়াছে এরূপও ভাবিতে পারে। যদি তাহার মা অনুমতিও দেয়, তাহা হইলেও কি কনক এত রাত্রিতে এমন পথে একলা অথবা তাহারই মত একজন স্বীলোকের সঙ্গে যাইতে সাহস করিবে, বিশেষ করিয়া ডাকাতেরা বাহির হইয়াছে, পথের ধারে লুকাইয়া থাকা তাহাদের পক্ষে বিচিত্র নয়।

 মাতঙ্গিনী হতাশ হইয়া বুঝিল যে, যাহা করিবার তাহাকে নিজেকেই করিতে হইবে; তাহাকেই যাইতে হইবে। ভাবিতেই, ভয়ে তাহার সমস্ত অন্তরাত্মা শিহরিরা উঠিল। রাস্তায় সাক্ষাৎ বিপদ যদিও অনেক, তবু সেগুলিই বড় বিপদ নয়। নিশীথ রাত্রের ভয়সঙ্কুল নির্জনতায়, অরণ্যসঙ্কুল পথে একা যুবতী নারী সে,—স্বভাবতই সে সব কিছুকেই বিশ্বাস করিত—বনে বনে যে সকল অলৌকিক জীবের বিহারভূমি তাহাদের সম্বন্ধে শৈশবে অনেক গল্প সে শুনিয়াছে, তাহার কল্পনাপ্রবণ মনে সেগুলি আরও ভীষণ, আরও ভয়াবহ রূপ ধরিয়া বাসা বাঁধিয়া আছে। তাহা ছাড়া, ভীষণ একদল দস্যু নিকটেই কোথায় রহিয়াছে, যদি তাহাদের হাতে পড়ে! ফল কি হইবে কল্পনায় ভাবিয়া লইয়া সে শিহরিয়া উঠিল। যদি এই দস্যুদলে তাহার স্বামী থাকে! মাতঙ্গিনী আবার শিহরিল।

 কিন্তু মাতঙ্গিনীর হৃদয়ে সাহস ছিল, তাহার ভগিনী ও ভগিনীপতির জন্য জীবন পর্য্যন্ত বিসর্জ্জন দিতে পারে, ইহা সে মনে মনে অনুভব করিল।

 ভয়াবহ বিপদের কথা তাহার যতই মনে হইতে লাগিত, তাহার হৃদয়ের মহৎ প্রেম ততই যেন বৃদ্ধি পাইয়া উদ্বেল হইতে লাগিল, এই প্রেমের বেদীতে সে তাহার ভগ্ন হৃদয়ের দুঃসহ ভারস্বরূপ জীবনকেই উৎসর্গ করিতে চাহিল। কিন্তু নারী-হৃদয়ের অন্য এক অনুভূতি বাধার সৃজন করিল। নিশীথ রাত্রে একাকী মাধবের গৃহে সে যাইবে। তাহাকে কে বিশ্বাস করিবে? মাধব নিজে কি ভাবিবে? ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া নিশ্চলভাবে দাঁড়াইয়া সে ভাবিতে লাগিল।

 কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ়া মাতঙ্গিনী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল, ঘরের গুমট গরমে সে পীড়িত হইতেছিল—সাহস করিয়া সে ছোট জানালাটি খুলিয়া ফেলিল। গাছের ছায়া দীর্ঘ হইয়া পড়িয়াছে এবং দূর চক্রবাল-সীমান্তে চাঁদ ঝুলিয়া পড়িয়াছে। তাহার রশ্মি ক্ষীণ। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে চন্দ্র অন্তর্হিত হইবে, দস্যুদের উন্মাদ চীৎকার শ্রুত হইবে। মাতঙ্গিনী ভাবিল, তখন? তাহাদের প্রাণরক্ষার বহু বিলম্ব ঘটিয়া যাইবে। আসন্ন বিপদের শঙ্কা তাহার মনের সকল বিচারবুদ্ধি দূর করিল, তাহার ভালবাসা দশ গুণ হইয়া ফিরিয়া আসিল, মাতঙ্গিনী আর দ্বিধা করিল না।

 নিজেকে আপাদমস্তক একটা মোটা বিছানার চাদরে আবৃত করিয়া মাতঙ্গিনী সন্তর্পণে দরজা খুলিয়া ঘরের বাহির হইয়া রাজমোহন যেমন করিয়া বাহির হইতে দরজা বন্ধ করিয়াছিল ঠিক সেই ভাবে অত্যন্ত সাবধানতার সহিত দরজা বন্ধ করিল। সীমাহীন শূন্যের তলদেশে দণ্ডায়মান হইয়া নীল আকাশের অনন্ত নীরবতা এবং দূরে বৃক্ষশ্রেণীর ঘন-সন্নিবিষ্ট শীর্ষদেশের নিঃশব্দতার মধ্যে তাহার হৃদয় দুর্ব্বল হইয়া পড়িতেছিল, পা যেন চলিতে চাহিতেছিল না। বুকের উপর দুই হাত চাপিয়া সে আর্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করিল, “দেবতা, শক্তি দাও।” তারপর মনের সমস্ত শক্তি একত্র করিয়া সে দ্রুত অথচ নিঃশব্দ পদচারণা করিতে শুরু করিল। অরণ্যপথে চলিতে চলিতে তাহার হৃদয় স্পন্দিত হইতে লাগিল। অরণ্যের ভয়াবহ নীরবতা ও ছায়াময় অন্ধকার তাহাকে আতঙ্কিত করিল। বনস্পতিসমূহের গ্রস্থিল কাণ্ডগুলি যেন প্রেতমূর্ত্তি ধরিয়া সেই কুটিল অন্ধকারে তাহার গতি পর্য্যবেক্ষণ করিতেছিল। পত্রাচ্ছাদিত এক-একটি বৃক্ষশাখা অন্ধকার পথে মাথার উপর দিয়া চলিয়া যায়, আর তাহার মনে হয় যেন তাহাদের অন্তরালে এক-একটি দৈত্য লুকাইয়া আছে। অন্ধকারাচ্ছন্ন বনস্থলীর এখানে সেখানে যেন এক-একটি প্রেত অথবা দস্যু ওত পাতিয়া আছে—তাহাদের প্রজ্জ্বলিত চক্ষু। গল্পে শোনা যে সব ভয়ঙ্কর মূর্ত্তি ও পৈশাচিক হাসি গভীর নিশীথে পথিককে আতঙ্কিত করিয়া মৃত্যুমুখে ঠেলিয়া দেয়, সেই সব মূর্ত্তি ও হাসি যেন তাহার কল্পনায় ভিড় করিয়া আসিল। স্খলিত বৃক্ষপত্রের মৃদু মর্ম্মরধ্বনি; চকিত নৈশ বিহঙ্গের অন্ধকার বৃক্ষশাখার অদৃশ্য স্থান হইতে স্থানান্তরে সরিয়া বসিবার নিমিত্ত পক্ষবিধুনন শব্দ; পতিত বৃক্ষপত্রের উপর সরীসৃপের সামান্য গতিশব্দ। এমন কি তাহার নিজের পদধ্বনিও তাহার হৃদয়কে ভয়চকিত করিয়া তুলিতেছিল। তথাপি সে বুক বাঁধিয়া চলিতে লাগিল, মনে মনে সহস্র বার ইষ্টদেবতার নাম স্মরণ করে—কখনও বা অর্দ্ধোচ্চারিত মন্ত্র পড়িতে থাকে। দুই উচ্চ ভূমিখণ্ডের মধ্যবর্ত্তী সমতল পথের উপরেই অন্ধকার নিবিড়তম; একদিকে ঘন কাঁটাগুল্মের বেড়াঘেরা বৃহৎ আম্রবন, অন্যদিকে একটি পুকুরের উঁচু পাড়—ছোট ছোট গুল্মে নিবিড়ভাবে আচ্ছাদিত এবং ইহাদিগকে ছাইয়া তিনটি বটগাছের পত্রাচ্ছাদিত বৃহৎ শাখা আন্দোলিত হইতেছে। নিম্নের ছায়াচ্ছন্ন পথ বটগাছের জন্য আরও অন্ধকার দেখাইতেছে। মাতঙ্গিনী সভয়ে চক্ষু ফিরাইল, আম্রবনের মধ্য হইতে একটা তীব্র আলোকরশ্মি আসিতেছিল এবং অশান্ত চাপাকণ্ঠের আওয়াজও যেন শুনিতে পাওয়া যাইতেছিল। সে যাহা ভয় করিতেছিল তাহাই বুঝি শেষ পর্য্যন্ত ঘটিয়া যায়! এই তো সেই ডাকাতের দল। মাতঙ্গিনী চিত্রার্পিতের ন্যায় দাঁড়াইয়া রহিল—এক পা চলিতে পারিল না। বিপদের উপর বিপদ, পথশায়িত একটি কুকুর নিশীথ রাত্রের পথিকের পদশব্দে জাগরিত হইয়া উচ্চৈস্বরে চীৎকার শুরু করিল। অমনই আমবাগান হইতে আগত কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হইল। এইটুকু বুঝিতে পারিবার মত প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব মাতঙ্গিনীর তখনও ছিল যে, দস্যুরা কুকুরের ইঙ্গিত অবজ্ঞা করে নাই এবং তাহারা ধরা পড়িতে বিলম্ব হইবে না। নূতন বিপদের আশঙ্কায় সে যেন শক্তি ফিরিয়া পাইল। হরিণের মত নিঃশব্দ চঞ্চল চরণে সে পুকুরের অন্ধকার পাড়ের দিকে ধাবমান হইয়া দ্রুত জলের ধারে পৌঁছিল। পায়ে-চলার পথে যাহারা তাহাকে খুঁজিবে, পুকুরের খাড়া পাড় তাহাদের দৃষ্টিপথ হইতে তাহাকে আড়াল করিল বটে, কিন্তু দস্যুরা যদি যে পাড়ে বটগাছগুলি ছিল সেই পাড়ে আসিয়া তাহার খোঁজ করে, তাহা হইলে আর রক্ষা নাই। কাছাকাছি ঝোপঝাড়ও ছিল না যে, সে লুকাইয়া বাঁচিবে। কিন্তু মাতঙ্গিনী তখন সাহস সঞ্চয় করিয়াছে—সে কালবিলম্ব করিল না। কুকুরটা তখনও ঘেউ ঘেউ করিতেছিল। মাতঙ্গিনী চক্ষের নিমিষে জলের ধার হইতে খানিকটা ভারী কাদা তুলিয়া লইয়া গায়ের মোটা চাদরে তাহা বাঁধিয়া ফেলিল। এইভাবে আসন্ন বিপদের হাত হইতে নিজেকে রক্ষা করিবার জন্য সে প্রস্তুত হইয়া রহিল, ভাবিল, সূক্ষ্ম পরিধেয় বস্ত্রাদি সামলাইয়া লইতে বেশি বেগ পাইতে হইবে না। পুকুরের অন্য পাড়ে পদশব্দ স্পষ্ট শোনা যাইতে লাগিল—চাপা কণ্ঠস্বর কানে আসিল। সে ধীরে ধীরে চাদরের পুঁটলিটি জলে ডুবাইল—জলে কোনও দ্রব্যপতনের শব্দমাত্র হইল না। তারপর বটগাছের ছায়া যেখানে ঘন হইয়া পড়িয়াছিল এমন একটা জায়গা বাছিয়া সে নিজেও জলে ডুব দিল। নিজের নাসিকার প্রান্তভাগ পর্য্যন্ত নিমজ্জিত করিয়া বসিয়া রহিল—কালো জলে বটগাছের কালো ছায়ায় যদি দেখিবার সম্ভাবনাও থাকিত, তাহা হইলে তাহার মাথা ছাড়া আর কিছু দেখিবার উপায় রহিল না। তবুও পাছে তাহার কমলের মত মুখের গৌরবর্ণ তাহাকে বিপদে ফেলে, সে খোপা খুলিয়া ফেলিয়া আলুলায়িত কৃষ্ণ কেশদাম মুখের চারিদিকে ছড়াইয়া দিল—খুব নিবিষ্ট দৃষ্টিও এখন আর কালো জলের সঙ্গে সেই কালো কেশের পার্থক্য ধরিতে পারিবে না।

 দেখিতে দেখিতে পদশব্দ ও কণ্ঠস্বর পুকুরের সেই পাড়ে আসিয়া মাঝপথে থামিল। মাতঙ্গিনী শুনিল, কিন্তু মাথা নাড়িল না।

 একজন বলিল, তাজ্জব ব্যাপার, আমি যে ঝোপের ফাঁক দিয়ে স্পষ্ট দেখলাম রাস্তায় আপাদমস্তক চাদর মোড়া একটা মূর্ত্তি দাঁড়িয়ে আছে।

 অন্য একজন বলিল, না হে না, তুমি গাছকে মানুষ ঠাউরে থাকবে— মানুষ হ’লে এর মধ্যেই হাওয়া হয়ে গেল কি ক’রে? তা ছাড়া এই দারুণ গ্রীষ্মে অমন চাদরমুড়ি দিয়ে মাথা খারাপ না হ’লে তো কেউ বের হবে না।

 জবাব শোনা গেল, “ঠিক বলেছ দাদা, হয়তো অপদেবতাই একটা দেখে থাকব।”

 মাতঙ্গিনীও একবার চকিতের মত মুখ ফিরাইয়া দেখিল, আগন্তকেরা সেই নিরীহ শান্তিভঙ্গকারিণীর সন্ধান না পাইয়া ফিরিয়া গেল।

 মাতঙ্গিনী আর ও কিয়ৎকাল জলের ভিতরে রহিল, যখন তাহাদের পদশব্দ দূরে সম্পূর্ণ মিলাইয়া গেল, সে বুঝিল তাহারা আমবাগানে প্রবেশ করিয়াছে। তখন সে সলিল-আশ্রয় ছাড়িয়া বাহিরে আসিল এবং ধীরে পরে শাড়ির জল নিংড়াইয়া ফেলিল, চাদরটি জলাশয়েই রহিল। পুনরায় সেই ভয়াবহ পায়ে-চলার পথ ধরিয়া চলিবার দুঃসাহস না দেখাইয়া সে জলের ধারে ধারে চলিল—যে পাড় ছাড়িয়া আসিল তাহারই পাশের পাড় ধরিয়া। আতঙ্কিত দৃষ্টিতে সে বার বার পিছনে চাহিয়া দেখিতে লাগিল। এখানকার পথঘাট তাহার সম্পূর্ণ পরিচিত, কারণ মধুমতীতে স্নান করিতে যাওয়া সম্পূর্ণ বারণ হইলেও এই পুকুরে স্নানাদির জন্য আসার নিষেধ ছিল না। দুঃসাহসিকা সুন্দরী এই পাড় হইতে যে পাড় সে ছাড়িতে বাধ্য হইয়াছে সেই পাড়ে যাওয়ার একটি সংকীর্ণ পথ ধরিয়া চলিল—গভীর ঝোপের ভিতর দিয়া এই পথ। অবশেষে সে নানা আশঙ্কার কল্পনা করিতে করিতে সেই পরিত্যক্ত পাড়ে আসিয়া পৌঁছিল, যে আম্রকুঞ্জ এবং তৎসন্নিহিত যে জানোয়ারটি তাহাকে বিপন্ন করিয়াছিল, তাহা হইতে অনতিদূরে সে দাঁড়াইল। কিন্তু নূতন এক বিপদ আসিয়া যেন তাহার পথরোধ করিল। রাধাগঞ্জে আসা অবধি সে মাত্র দুইবার তাহার বোনের বাড়ি গিয়াছে এবং কোন বারেই পায়ে হাঁটিয়া যায় নাই, বদ্ধ পাল্কীতে যাতায়াত করিয়াছে। যতটুকু পথের সন্ধান সে রাখিত তাহা লোকের মুখে মুখে শুনিয়া। সুতরাং চৌমাথার কাছে আসিয়া তাহাকে দাঁড়াইতে হইল। নিতান্ত বিপন্নের মত সে চারিদিকে দৃষ্টিপাত করিতে করিতে হঠাৎ যেন ভাগ্যবলে দীর্ঘ দেবদারুগাছের মাথা দেখিতে পাইল। সে জানিত, এই দেবদারুগাছটি মাধবের বাড়ির ঠিক সম্মুখে অবস্থিত। সে তৎক্ষণাৎ সেই দিকের পথ ধরিয়া চলিতে চলিতে অনতিবিলম্বে মাধবের বৃহৎ প্রসাদের নিকট আসিয়া পড়িল এবং খিড়কির দুয়ার লক্ষ্য করিয়া চলিতে লাগিল।

 শেষ বিপদ উত্তীর্ণ হইতে তখনও বাকি ছিল। সেই সময়ে বাড়ির সকলে নিদ্রিত। ভিতরে কেমন করিয়া প্রবেশ করিবে—ইহাই হইল সমস্যা। খিড়কির পাশের ঘরে করুণা শয়ন করিত, মাতঙ্গিনী তাহা জানিত। করুণা বাড়ির দাসী।

 কয়েকবার দ্বারে করাঘাত করিতেই করুণার নিদ্রাভঙ্গ হইল। বিরক্তিকঠোর কণ্ঠে সে বলিয়া উঠিল, এতরাত্রে দুয়ার ঠেলে কে? মাতঙ্গিনী অধীর কণ্ঠে বলিল, করুণা, তাড়াতাড়ি দরজা খোল।

 অসময়ে মধুর-নিদ্রা-ভঙ্গকারী আগন্তুকের প্রতি করুণার করুণা হইবার কথা নয়, সে কঠোর কণ্ঠে জবাব দিল, তুমি কে গো যে, এতরাত্রে তোমাকে দরজা খুলে দিতে হবে?

 নিজের নাম বলিতে অনিচ্ছুক মাতঙ্গিনীর কণ্ঠস্বরে ব্যগ্রতা ফুটিয়া উঠিল, শিগগির এস, দেখলেই বুঝতে পারবে।

 করুণা ধৈর্য্য হারাইল, চীৎকার করিয়া হাঁকিল, কে গা তুমি?

 মাতঙ্গিনী জবাব দিল, আমি একজন সামান্য স্ত্রীলোক, চোর নই। দেখই না এসে!

 করুণার সহজ বুদ্ধি তখন ফিরিয়া আসিতেছিল। তাহার বোধ হইল, চোরের গলা এমন মিঠা হয় না। আর কথা-কাটাকাটি না করিয়া সে দরজা খুলিয়া দিল।

 মাতঙ্গিনীকে দেখিয়া করুণার বিস্ময়ের অবধি রহিল না। সে চীৎকার করিয়া উঠিল, ঠাকরুণ, তুমি?

 মাতঙ্গিনী বলিল, আমি হেমের সঙ্গে দেখা করতে চাই, আমাকে তার কাছে নিয়ে চল।

 করুণার বুদ্ধি যেন আবার লোপ পাইতেছিল। সে বিস্ময়ের মাত্রা চড়াইয়া আবার প্রশ্ন করিল, এতরাত্রে তুমি এখানে? কি হয়েছে মা? তোমার কাপড় ভিজে—ব্যাপার কি?

 অধীর মাতঙ্গিনী তাহার প্রশ্নের জবাব না দিয়া আদেশের ভঙ্গীতে বলিল, হেমের কাছে আমাকে নিয়ে চল।

 করুণা বলিল, সে ঘুমুচ্ছে। তাকে জাগাচ্ছি, কিন্তু ততক্ষণে তুমি ভিজে কাপড়গুলো ছেড়ে ফেল, মা।

 পার তো শিগগির একটা শাড়ি দাও, কিন্তু দেরি করো না।

 করুণা হাতের কাছে যে শাড়ি পাইল তাহাই তাহাকে দিল। মাতঙ্গিনী চক্ষের নিমেষে বস্ত্র পরিবর্ত্তন করিয়া দোতলায় হেমাঙ্গিনীর কক্ষে যাইবার জন্য করুণার অনুসরণ করিল।