রাজমোহনের স্ত্রী/অষ্টম পরিচ্ছেদ

অষ্টম পরিচ্ছেদ

সতর্ক করা, না সশস্ত্র করা

 মাতঙ্গিনী একটা খোলা বারান্দায় দাঁড়াইয়া ভগিনীকে জাগাইয়া তাহার কাছে লইয়া আসিবার জন্য করুণাকে আদেশ করিল। হেমাঙ্গিনী তখনও ঘুমায় নাই, মুহূর্ত্তকাল পরে সে উপস্থিত হইল। তাহার মুখে চোখে বিস্ময়ের চিহ্ন পরিস্ফুট, সাগ্রহ-সম্ভাষণে অসময়ে অপ্রত্যাশিত ভাবে মাতঙ্গিনীর আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করিল।

 মাতঙ্গিনী বলিল, তোমাদের বাড়িতে আজ ডাকাতি হবে, আমি তোমাদের সাবধান করতে এসেছি।

 বিমূঢ় হেমাঙ্গিনী অর্দ্ধস্ফুট কণ্ঠে প্রায় চীৎকার করিয়া উঠিল, ডাকাতি!

 করুণাও ‘মাগো’ বলিয়া আর্ত্তনাদ করিয়া উঠিল। মাতঙ্গিনী বলিল, করুণা, চুপ কর। হেম, গোল করিস না। এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না। তোর স্বামীকে সাবধান ক’রে তৈরি হতে বল্ গিয়ে।

 কিন্তু হেমাঙ্গিনীর সে কার্য্য করিবার সাধ্য ছিল না। সে ভয়ে বিবর্ণ ও কম্পান্বিতকলেবর, তাহার মুখ দিয়া কথা ফুটিল না, পা চলিতে চাহিল না। মাতঙ্গিনীও কিংকর্ত্তব্যবিমুঢ় হইল। সে দেখিল, তাহার ভগিনী আতঙ্কে আত্মহারা হইয়াছে। এদিকে সময় নষ্ট করিলে চলিবে না। মুখরা করুণা অধীর হইয়া উঠিতেছিল, এমন ভয়ঙ্কর একটা সংবাদবহনের প্রথম দূতী হইবার প্রলোভন ত্যাগ করা তাহার পক্ষে অসম্ভব, তাহা ছাড়া এই অপ্রত্যাশিত সংবাদে তাহার আতঙ্ক এমন প্রচণ্ড মূর্ত্তি ধারণ করিল যে, সে নিজেই মাতঙ্গিনীর দুশ্চিন্তা দূর করিবার জন্য ব্যাকুল হইল। মৎস্যকুলবিনাশিনী করুণা অমঙ্গলের দূতী হওয়াটা মহাগর্ব্বের ব্যাপার মনে করিয়া যে কার্য্য ন্যায়ত হেমাঙ্গিনীর করা উচিত ছিল সেই কার্য্য সাধন করিবার জন্য মাধবের শয়নকক্ষ লক্ষ্য করিয়া ধাবিত হইল।

 অনতিবিলম্বে ফিরিয়া আসিয়া মাতঙ্গিনীকে জানাইল, মাধব তাহার কথা বিশ্বাস করিতেছে না; বিশেষত মাতঙ্গিনী মাধবের বাড়িতে উপস্থিত এবং সে-ই এই সংবাদ বহন করিয়া আনিয়াছে—করুণার মুখে এইরূপ কথা শুনিয়া মাধব আরও অবিশ্বাসী হইয়াছে; মাধব বলিয়াছে, সে যদি এখানে এসে থাকে, তার কাছ থেকেই খবরটা শুনতে চাই। তাকে আমার কাছে নিয়ে আয়, তার মুখে শুনলেই বুঝতে পারব বিপদ কতখানি। তাকে এখানে আসতে বল।

 মাতঙ্গিনী ভগিনীকে বলিল, তুই যা হেম, মাধবকে বল গিয়ে যে আমি এসেছি এবং যা বলছি তা সত্যি। তোর কথা সে বিশ্বাস করবে।

 হেমাঙ্গিনী বলিল, সে আমি পারব না, তুমি নিজে যাও দিদি, তিনি যা জিজ্ঞেস করবেন, তার জবাব আমি দেব কেমন ক’রে? তুমিই সব কথার জবাব দাও গিয়ে। আর সময় নষ্ট ক’রো না। তুমি যা বলছ, তাই যদি হয় তা হ’লে—

 —আমার না যাওয়াটাই ভাল হেম। তাকে বল্ গিয়ে আমি এসব কথা বলেছি আর সত্যি কথা বলেছি।

 অনিচ্ছুক হেমাঙ্গিনী বালিকার মত গোঁ ধরিয়া বলিল, না দিদি, তুমিই যাও।

 মাতঙ্গিনী অত্যন্ত গম্ভীর হইয়া বিচলিতস্বরে বলিল, আমি যেতে পারি না, আমি যাব না হেম।

 করুণা হাসিতে হাসিতে চীৎকার করিয়া উঠিল, হায় কপাল, তা হ’লে এসব কিছু নয়। তোমার দিদি তোমাকে ভয় দেখাচ্ছে মা।

 হেমাঙ্গিনীর মুখ সহসা উজ্জ্বল হইয়া উঠিল, সত্যি দিদি, আমাকে ভয় দেখাচ্ছ শুধু? আমার কিন্তু বড্ড ভয় হয়েছে। এখন বল না, কেন এসেছ।

 মাতঙ্গিনী কিয়ৎকাল নীরব থাকিয়া কি চিন্তা করিল, তারপর মনে মনে কর্ত্তব্য স্থির করিয়া লইয়া সে বলিল, আচ্ছা, আমি যাচ্ছি। হেম, তুই আমার সঙ্গে আয়।

 দিদির সম্মুখে স্বামীসন্নিধানে যাইতে লজ্জাশীলা হেমাঙ্গিনী কিছুতেই রাজী হইল না, যদিও মুখ ফুটিয়া সে সে কথা বলিতে পারিল না।

 তা হ’লে এখানে থাক্, আমি না আসা পর্য্যন্ত আমার কথা বা এই খবর ঘূণাক্ষরেও কাউকে বলিস না—এই কথা বলিয়া মাতঙ্গিনী ঝড়ের মত বারান্দা পার হইয়া গেল। ইতিমধ্যেই সে লক্ষ্য করিয়াছে বৃক্ষশীর্ষের অন্তরালে চাঁদ ডুবিতে বসিয়াছে। কিন্তু মাধবের কক্ষের দ্বারে আসিয়া মাতঙ্গিনীর পা কাঁপিতে লাগিল, আমবাগানে ডাকাতদের প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ডের আলোকে দাঁড়াইয়াও তাহা এমন করিয়া কাঁপে নাই। শাড়ির আঁচলটা মাথার উপর খানিকটা টানিয়া দিয়া সে ধীরে যেন নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে অগ্রসর হইল। একবার পিছাইয়া, আবার আগাইয়া, খানিক থামিয়া সে দরজা ঠেলিল, আবার থামিল এবং অবশেষে কক্ষে প্রবেশ করিল। সুসজ্জিত কক্ষে একটিমাত্র দীপ জ্বলিতেছিল এবং মূল্যবান সোফার উপর হেলান দিয়া যুবক মাধব উপবিষ্ট ছিল। মাতঙ্গিনী দেয়াল ঘেষিয়া যুবতীসুলভ লজ্জায় নতশির হইয়া দাঁড়াইল, ভগিনীপতির দিকে সে কচিৎ নেত্রপাত করিতেছিল। মাধব চমকিয়া উঠিল এবং অর্দ্ধশায়িত অবস্থা হইতে আপনাকে কিঞ্চিৎ উত্থিত করিল।

 কিন্তু উভয়ের কাহারও বাক্যস্ফুর্ত্তি হইল না; একজন যে ভয়াবহ সংবাদ বহন করিয়া আনিয়াছিল তাহা জ্ঞাপন করিতে উৎসুক, অপরে সে সংবাদ শ্রবণ করিবার জন্যও আগ্রহাম্বিত। এই নীরবতায় উভয়েই অস্বস্তি বোধ করিতেছিল। পরিশেষে মাধব পরস্পরের সম্পর্কজনিত পরিহাসের সুবিধা লইয়া কহিল, তুমি ইংরেজ মেমসাহেব হ’লে ভাল হ’ত দিদি, তা হ’লে তোমাকে আসন এগিয়ে দিয়ে বসতে অনুরোধ করতাম। —মাধবের মুখে মৃদু হাসি দেখা দিল।

 —তা, দিদি, তুমি বস্‌ছ না কেন? এই—এখানে—

 মাতঙ্গিনী মাধবকে বিপদ হইতে উদ্ধার করিয়া অত্যন্ত চাপা গলায় কহিল, আমি যা বলেছি শুনেছ?

 মাধব গম্ভীর হইয়া বলিল, শুনেছি। সত্যি?

 সেইরূপ অর্দ্ধস্ফুট কণ্ঠেই মাতঙ্গিনী জবাব দিল, সত্যি।

 —আজ রাত্রেই?

 —হ্যাঁ, আজ রাত্রেই, চাঁদ ডুবলেই তারা আক্রমণ করবে, চাঁদ ডুবতেও আর আধ দণ্ডের বেশি দেরি নেই।

 —তাই নাকি? তা হ’লেই তে সর্ব্বনাশ! কিন্তু দিদি, তুমি এসব খবর পেলে কি ক’রে?

 মাতঙ্গিনী এবার অবগুণ্ঠন ঈষৎ উন্মোচিত করিয়া পরিষ্কার কণ্ঠে কহিল, ও কথা জিজ্ঞেস ক’রো না।

 মাধব বলিল, তোমার কথার কুল-কিনারা পাচ্ছি না। ভাববার পর্য্যন্ত ক্ষমতা আমার নেই।

 মাতঙ্গিনী এবার মুখখানি সম্পূর্ণ অনাবৃত করিয়া মাধবের মুখের দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া স্পষ্টতর কণ্ঠে বলিল, আমাকে কি তুমি ভুলে গেছ মাধব? তোমাকে আমি মিথ্যে বলতে পারি? আর এই অসময়ে তোমার বাড়িতে একা যে আমি এসেছি—

 মাধব বলিল, সত্যি, আমার ভুল হয়েছিল। তুমি এখানে দাঁড়াও দিদি, আমি লোকজনকে ডাকি।

 মাধব উঠিতে যাইতেছিল, কিন্তু মাতঙ্গিনী তাহার প্রতি একটি দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া তাহাকে নিরস্ত করিল, বলিল, আমাকে একটা কথা দিয়ে যাও।

 মাধব বলিল, বল।

 —তোমার খুড়োর উইল কোথায় আছে? সেটার বিষয়ে সাবধান থেকো। ওদের মতলব উইল চুরি করা।

 মাধব বলিল, হুঁ। খুড়ীমার মকদ্দমার কথা ভাবিয়া সে হঠাৎ যেন ব্যাপারের একটা সূত্র খুঁজিয়া পাইল। বলিল, সে গুড়ে বালি।

 —এই ঘরে একটা হাতীর দাঁতের বাক্সে তুমি সেটা রাখ, না?

 —হ্যাঁ, কিন্তু সে খবর পেলে কোথায়? মাধবের বিস্ময়ের অবধি রহিল না।

 মাতঙ্গিনী জবাব দিল, আমি কেন, তারাও এ খবর জানে।

 মাধব বলিল, বুঝতে পারছি, তুমি অনেক কথাই শুনেছ। মাধব উঠিল।

 —কিন্তু আর একটা কথা, আমার একটা অনুরোধ আছে, রাখবে?

 —বল। নিশ্চয়ই রাখব।

 —আমি যে তোমাকে এ খবর দিয়েছি কিংবা এ বাড়িতে রাত্রে এসেছি যেন আর কেউ না জানতে পারে। জানতে পারলে প্রাণ নিয়ে টানাটানি হবে।

 মাধব তাচ্ছিল্যভরে গলা চড়াইয়া বলিল, প্রাণ? তোমার প্রাণ নিয়ে টানাটানি করবে কে শুনি?

  মাতঙ্গিনী বলিল, চুপ।

 মাধব নিজেকে সংযত করিয়া কহিল, ওঃ, আমার খেয়াল ছিল না। আর ভুল হবে না।

 —করুণা আর হেমকেও ব’লে যাও তারা যেন গোল না করে।

 —করুণাকে সামলানোই মুশকিল, আমি মাগীকে দাবড়ি দিয়ে চুপ করিয়ে রাখব। তুমি হেমের সঙ্গে দরজায় খিল দিয়ে থাকবে—বাড়ির আর কেউ যেন তোমায় না দেখতে পায়। আমি ফিরে এসে তোমাকে আরও নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাব।

 এই কথা বলিয়া মাধব তাহার পত্নী এবং করুণার নিকটে গিয়া মাতঙ্গিনীর বিষয় তাহাদিগকে সম্পূর্ণ নীরব থাকিতে বলিয়া দ্রুতপদে বহির্ব্বাটীর দিকে ধাবিত হইল ও অচিরাৎ দারোয়ানমহলে উপস্থিত হইল।

 মাতঙ্গিনীর বুদ্ধিকে মাধব শ্রদ্ধা করিত, সে যে প্রতারিত হয় নাই ইহা ঠিক, তাহা ছাড়া তাহাকে ঠকাইতে সে এত ক্লেশ স্বীকারই বা করিবে কি জন্য? সুতরাং ডাকাতদলকে বাধা দিবার জন্য সে উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়া গেল। ধরণী-বক্ষ নিবিড় অন্ধকারে নিমজ্জিত হইবার পূর্ব্বেই দেখা গেল, গৃহের ছাদে বহু মনুষ্যাকৃতি জীব আকাশের পটভূমিতে নড়িয়া চড়িয়া বেড়াইতেছে। ইহারা জমিদারের বাছা বাছা প্রজা, জমিদার-বাড়ির সন্নিকটেই বাস করে এবং যে কোনও সময়ে দেখিতে দেখিতে ইহাদের মধ্য হইতে একদল লাঠিয়াল সংগ্রহ হইতে পারে। লাঠি, সড়কি, ইট প্রভৃতি অস্ত্র-শস্ত্রে ইহাদের প্রায় সকলেই সজ্জিত ছিল—আক্রমণকারীরা প্রাচীরের ধারে আসিলে অথবা বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করিলে এগুলির প্রয়োগে তাহাদিগকে বিপর্য্যস্ত করিবার জন্য তাহারা উদ্যত হইয়া রহিল। এ কথা আমরা বলি না যে, নিশীথরাত্রের এই যোদ্ধৃবৃন্দ সকলেই তাহাদের হস্তধৃত লাঠির মত কঠিনহৃদয় ছিল, অনেকেই যে অকালনিদ্রাভঙ্গে বিরক্ত হইয়াছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই। তাহাদের জমিদারের ঘন ঘন কঠোর আদেশ শ্রবণ করিয়া যদি না তাহারা বুঝিতে পারিত যে পলাইয়া তাহার বিরক্তির উদ্রেক করা অপেক্ষা সেখানে দণ্ডায়মান থাকাই অধিকতর নিরাপদ, তাহা হইলে অনেকেই মহানন্দে পলায়ন করিত। অবশ্য সকলের মনেই যথেষ্ট সাহস ছিল, কারণ, বাড়ির ছাদে লোভনীয় কিছু না থাকাতে ডাকাতেরা সেখানে পৌঁছিবে না, এ কথা তাহারা জানিত; সুতরাং আশ্বস্ত হইয়া সাহসী বীরেরা সদম্ভে নিজ নিজ নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়াইয়া রহিল। উত্তরপশ্চিমাঞ্চলের পাঁড়ে ও চৌবে বংশের পাঁচ ছয় জন তলোয়ার, ঢাল, সড়কি ও গাদাবন্দুক হাতে সদর-দরজায় পাহারা দিতে লাগিল। চার-পাঁচজন সতর্ক দৃষ্টি রাখিয়া এদিক ওদিক টহল দিয়া ফিরিতে লাগিল, প্রয়োজন বুঝিলেই তাহারা অন্যদের সতর্ক করিবার জন্য আদিষ্ট হইল। বাড়ির ভিতরে যে সমস্ত বাক্স ও সিন্দুকে মূল্যবান তৈজসাদি, গহনা, নগদ টাকা, ক্ষুদ্রায়তন অথচ বহুমূল্য বাসন-কোসন ছিল, পূর্ব্বোক্ত হাতীর দাঁতের বাক্সটিসহ সেগুলি কোথায় যেন অন্তর্দ্ধান করিল। সেই সুবৃহৎ প্রাসাদের অসংখ্য কক্ষশ্রেণীর মধ্যে গুপ্ত স্থানসমূহে সেগুলি আশ্রয় লাভ করিল— এই সকল গুপ্ত স্থানের সন্ধান যাহারা জানে না, তাহাদের পক্ষে সেগুলি খুঁজিয়া বাহির করা কঠিন। বাটীস্থ অনেকেই এসবের খবর জানিত না।

 সাধারণত মাধব মৃদুস্বভাব ও নমনীয়, কিন্তু উত্তেজনার মুহূর্ত্তে তাহার শক্তি ও কার্য্যতৎপরতা এমন প্রচণ্ড বেগ ধারণ করিত যে, ভীরু ও অস্থিরচিত্ত ব্যক্তিরা সন্ত্রস্ত হইয়া পড়িত। এতদসত্ত্বেও এমন স্ত্রীলোকের অভাব হইল না, যাহার এক হাতে উলঙ্গ শিশুদের টানিতে টানিতে অন্য হাতে বড় বড় বোঁচকা সামলাইতে সামলাইতে সেই বিপন্ন গৃহ ত্যাগ করিয়া গোপনে প্রতিবেশীদের কুটীরে আশ্রয় লইতে ছুটিল না—তাহারা ভাবিল, সেই অনাড়ম্বর কুটীরগুলিতে দস্যুরা হস্তক্ষেপ করিবে না, সুতরাং তাহাদের সম্পত্তিগুলি রক্ষা পাইবে। গত সন্ধ্যায় যে বিবেকসম্পন্ন পাচিকা কর্ত্রীর সহিত যুদ্ধে জয়লাভ করিয়াছিল, দেখা গেল বোঁচকাবুঁচকী সমেত সেইই সর্ব্বাপেক্ষা কৌশলে দ্রুত ধাবিত হইল। গত সন্ধ্যার যুদ্ধজয়ের বিজয়মাল্যস্বরূপ ঘিয়ের পাত্রটি সে সঙ্গে লইতে ভুলিল না।

 উদ্যোগ-পর্ব্বের কলকোলাহল প্রশমিত হইল, আয়োজন সম্পূর্ণ করিয়া অধীর লোকজন নীরবে প্রতীক্ষা করিতে লাগিল। চন্দ্র অস্ত গিয়াছে। মাতঙ্গিনীর কথার সত্যতা সম্বন্ধে মাধবের সন্দেহ হইতে লাগিল। এই সন্দেহ মাধবের মনের মধ্যে ভাল করিয়া রূপ ধরিতে না ধরিতেই একজন দারোয়ান তাহার কাছে আসিয়া হিন্দীতে বলিল, যাহারা পাহারা দিবার কার্য্যে নিযুক্ত ছিল, তাহাদের মধ্যে একজন পুরানো বাগানের দিকে একটা আলোক দেখিয়াছে। মাতঙ্গিনী যে আমবাগানে দস্যুদের হাতে পড়িতে পড়িতে রক্ষণ পাইয়াছে সেইটিকেই পুরানো বাগান বলা হইত। সে আরও বলিল যে, সে ব্যক্তি সাহস করিয়া বাগানের কাছাকাছি গিয়া দেখিয়াছে কয়েকজন সশস্ত্র লোক সেখানে সম্মিলিত হইয়াছে।

 সংবাদবাহক জিজ্ঞাসা করিল, হুজুর হুকুম দিন, আমরা আগে ওদের উপর লাঠি চালাই।

 মাধব বলিল, না ভূপসিং, তার দরকার নেই; তোমরা কম লোক গেলে ওদের কাছে কাবু হয়ে পড়বে, বেশি লোক গেলে বাড়ি পাহারা দেবে কে? হয়তো ওদের আর একটা দল কোথাও আছে।

 দারোয়ান বলিল, মহারাজের যা হুকুম। তা হ’লে আমরা যেমন আছি, তেমনি থাকি?

 —হ্যাঁ, আর এক কাজ কর, তোমরা সবাই মিলে এক সঙ্গে হাঁক দাও, ওদের সমঝিয়ে দাও আমরা তৈরি আছি।

 মাধব এই কথা বলিতে না বলিতে একটানা প্রচণ্ড হুঙ্কারে নিশীথ বায়ুমণ্ডল বিদীর্ণ হইল। স্ত্রীলোকের কক্ষাভ্যন্তরে কম্পান্বিতকলেবরে আতঙ্কিত বিস্ময়ে সেই হুঙ্কার শুনিয়া ভাবিল, বিপদ আসন্ন। পরক্ষণেই চারিদিক স্তব্ধতায় থমথম করিতে লাগিল।

 মাধব বলিল, আর একবার, আর একবার।

 আবার সেই হুঙ্কারে নিশীথিনী যেন কাঁপিতে লাগিল। ইহার প্রতিধ্বনি মিলাইতে না মিলাইতে নির্জ্জন বনভূমি হইতে এক হৃদয়বিদারক আর্ত্তনাদ শ্রুত হইল, যেন মধ্যরাত্রির অন্ধকারে পিশাচদের উল্লাসধবনি। সেই আর্ত্তনাদ কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইয়া শ্রোতাদের শোণিতপ্রবাহ বন্ধ করিয়া দিল।

 মাধব চীৎকার করিয়া বলিল, আবার, আবার, আরও জোরে হাঁক দাও। তাহার ভয় হইতেছিল পাছে দস্যুদলের চীৎকারে তাহার লোকজন আতঙ্কিত হইয়া পড়ে। অনুচরেরা সোল্লাসে এবং সোৎসাহে তাহার আদেশ প্রতিপালন করিতে না করিতে পুরানো বাগান হইতে জবাব আসিল। কিন্তু এবার তীব্র আর্ত্তনাদ নয়, পলায়নপর দস্যুদলের ক্ষীণ কণ্ঠধ্বনি।

 তারস্বরে অনেকে চীৎকার করিয়া উঠিল, ওরা পালাচ্ছে, ওরা পালাচ্ছে —হঠে যাবার শব্দ ওটা।

 মাধব বলিল, হবে, কিন্তু তোমরা তা ব’লে নিশ্চিন্ত থেকো না— এখনও খাড়া থাক। মাধব অনুচরদের সহিত বহুক্ষণ অপেক্ষা করিল, কিন্তু আর কিছু ঘটিল না। মাধব আর একবার তাহার পাইকবরকান্দাজদের পাহারা কড়া রাখিতে ও সমস্ত রাত্রি জাগিয়া থাকিতে হুকুম দিয়া যে দুঃসাহসিনী রমণী তাহাকে আসন্ন বিপদ হইতে রক্ষা করিয়াছে, তাহাকে ধন্যবাদ দিবার জন্য অন্দর-মহলের দিকে অগ্রসর হইল।