রাজমোহনের স্ত্রী/বিংশ পরিচ্ছেদ

বিংশ পরিচ্ছেদ

অনেক নারী অনেক পুরুষের সমকক্ষ

 তারা ও মাধব মাতঙ্গিনীর প্রায়-নির্জ্জীব দেহখানি ধরাধরি করিয়া এমন একটি ঘরে লইয়া গেল, যেখানে অন্য কাহারও হঠাৎ প্রবেশের সম্ভাবনা ছিল না। তারার অসাধারণ সেবায় এবং বদ্ধ বায়ুতে অনেক দিন থাকার পর নির্ম্মল মুক্ত বাতাসের স্পর্শে তাহার বিবর্ণ মুখ রক্তাভ হইল এবং ঊষার অরুণরাগ পূর্ব্বগগন রঞ্জিত করিবার পূর্ব্বেই মাতঙ্গিনী পুনর্জ্জীবন লাভ করিল। তাহাকে আহার্য্য দেওয়া হইল, কিন্তু মাতঙ্গিনী সামান্যই আহার করিল। কিন্তু তাহাতেই সে খানিকটা বল পাইল। তারা জানালার উপর বসিয়া ধূসর পূর্ব্বাকাশের পানে চাহিয়া চাহিয়া মাতঙ্গিনীর দুঃখের ইতিহাস শুনিতে লাগিল। মাতঙ্গিনী মৃদুস্বরে ধীরে ধীরে সে কেমন করিয়া জীবিত অবস্থাতেই মৃতের কবরে নিক্ষিপ্ত হইয়াছিল তাহাই বলিতেছিল।

 সংক্ষেপে সেই অন্ধকার ইতিহাস এইরূপ। মথুর ঘোষ সুকীর মায়ের সঙ্গে যখন তাহাকে তাহার বাড়িতে পাঠাইয়াছিল, তখন মাতঙ্গিনী ধারণা করিতেই পারে নাই যে, কি সাংঘাতিক রাক্ষসের কবলে সে পতিত হইয়াছে। সুকীর মাকেও যথেষ্ট তালিম দেওয়া হইয়াছিল, পথে যাইতে যাইতে সে মাতঙ্গিনীকে জিজ্ঞাসা করিল, স্বামীর ঘরে তাহার ফিরিয়া যাইতে ভয় হইতেছে কি না!

 মাতঙ্গিনী উত্তর করিয়াছিল, সুকীর মা, সত্যি কথা বলতে কি, যদি পৃথিবীতে অন্য কোথাও যাবার জায়গা আমার থাকত, তা হ’লে সেখানে আমি ফিরতাম না।

 সে শয়তানী বলিয়াছিল, সত্যি? আমি কিন্তু তোমাকে কিছু সাহায্য করতে পারতাম। আমি তোমাকে এমন জায়গায় লুকিয়ে রাখতে পারি, যেখান থেকে কেউ তোমাকে খুঁজে বের করতে পারবে না।

 মাতঙ্গিনী অনেক চিন্তা করিয়া বলিয়াছিল, না, আমি লুকিয়ে থাকব না; দুষ্টলোকে কুৎসা রটনা করতে পারে।

 —তা হ’লে তোমার বোনের বাড়ি চল না কেন।

 মাতঙ্গিনী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিয়াছিল, না, তা হতে পারে না!

 বুড়ী কৌশলী কম নহে, সে মাতঙ্গিনীর অসহায় অবস্থার সুবিধা লইয়া তাহার প্রতি গভীর সহানুভূতি দেখাইবার ভান করিল এবং পরিশেষে তাহাকে তাহার বাপের বাড়ি লইয়া যাইতে চাহিল।

 মাতঙ্গিনী দুঃখিতভাবে বলিল, কিন্তু যাবার খরচ তো নেই।

 —ও! তা সে তোমাকে ভাবতে হবে না, বড়গিন্নী নিশ্চয়ই তোমাকে নৌকো ভাড়া করে দেবেন, আমি সঙ্গে গিয়ে তোমাকে সেখানে রেখে আসব।

 মাতঙ্গিনী কাঁদিয়াছিল, তাহার প্রতি কৃতজ্ঞতায় তাহার অন্তর পূর্ণ হইয়াছিল।

 —আমি গিয়ে তা হ’লে এ কথা বড়গিল্পীকে বলি?

 হর্ষোৎফুল্ল হইয়া মাতঙ্গিনী বলিয়াছিল, তাই বল গিয়ে।

 —তা হ’লে আমি তোমাকে যেখানে রেখে যাব, সেখানেই চুপ ক’রে থেক, কেউ সেখানে তোমাকে দেখতে পাবে না। এস।

 সেই শয়তানীকে অনুসরণ করিয়া মাতঙ্গিনী পূর্ব্ববর্ণিত গুদাম-মহলের চোরা-কুঠরিতে উপস্থিত হইয়াছিল। ভয়াবহ নির্জ্জন সেই কক্ষে উপস্থিত হইবার পূর্ব্বেই ভয়ে মাতঙ্গিনীর অন্তরাত্মা শুকাইয়া গিয়াছিল। কক্ষের ভিতরে প্রবেশ করিয়া সেই নির্জ্জন অন্ধকার ঘরের অপরূপ সজ্জা দেখিয়া সে বিস্মিতও হইয়াছিল। সুকীর মাকে ইহার কারণ জিজ্ঞাসা করিতে গিয়া সে আরও চমৎকৃত হইয়া দেখিয়াছিল যে, বুড়ী অন্তর্দ্ধান করিয়াছে এবং বাহির হইতে দরজাও বন্ধ।

 বুদ্ধিমতী মাতঙ্গিনী অবিলম্বে বুঝিতে পারে যে সে ফাঁদে পা দিয়াছে এবং সেই অবস্থায় কি করা কর্ত্তব্য তাহা নির্দ্ধারণ করিতেও তাহার বিলম্ব হয় নাই।

 সন্ধ্যায় মথুর ঘোষ আসিয়া আপনাকে তাহার চরণপ্রান্তে নিক্ষেপ করে, মাতঙ্গিনী তাহাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করায় আহত ও ব্যথিত মথুর মনে মনে স্থিরপ্রতিজ্ঞ হয় যে, যেমন করিয়াই হউক সে তাহার প্রতিহিংসা ও লালসা চরিতার্থ করিবে।

 মথুর বিদায় লইবার সময় পৈশাচিক দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলে, তোমাকে আমার কাছে আত্মসমর্পণ করতেই হবে, প্রাণেশ্বরী।

 মাতঙ্গিনীর দৃষ্টিতে যে আগুন ঝলকিয়া উঠিয়াছিল, তাহাতে কুড়িজন পুরুষের দৃষ্টি প্রতিহত হয়। সে বলিল, কখনই না, কখনই আমি তোমার হব না —তারপর সে মথুরের ঠিক সম্মুখে গিয়া দীর্ঘ দেহ দীর্ঘতর করিয়া বলিয়াছিল, দেখ, আমার দিকে চাও, আমি নারী হ’লেও যুবতী, গায়ের জোর তোমার চাইতে আমার কম নয়; —না, তুমি বুঝি সাঙ্গোপাঙ্গ ডাকবে?

 মথুর ঘোষ শক্তিপরীক্ষার এই অপরূপ আহ্বানে স্তম্ভিত হইয়াছিল। কিয়ৎক্ষণ পরে আত্মস্থ হইয়া সে বলিয়াছিল, তোমার জঠরাগ্নি আমার সাহায্য করবে, স্ত্রীলোকের বিরুদ্ধে আমি অন্য অস্ত্র প্রয়োগ করি না।

 মাতঙ্গিনী বলিয়াছিল, হ্যাঁ, উপবাসই আমার একমাত্র সহায়।

 মথুর স্থির করিয়াছিল মাতঙ্গিনীকে খাইতে না দিয়া তাহার প্রস্তাবে রাজি করাইবে, মাতঙ্গিনী স্থির করিয়াছিল সে উপবাস করিয়া মরিবে।

 উভয়ে উভয়ের প্রতিজ্ঞা পালন করিয়াছিল। মথুর প্রত্যহ একবার দেখিয়া আসিত তাহার ঔষধ ধরিতেছে কি না! মাধব যখন মাতঙ্গিনীকে উদ্ধার করিল, তখন সে অনাহারে মৃতপ্রায়।

 ভোর হইবার পূর্ব্বেই মাধব চলিয়া গেল, দুর্ব্বলতাবশত মাতঙ্গিনী তখনই যাইতে পারিল না; মাধব ও তারা পরামর্শ করিয়া স্থির করিল যে, সন্ধ্যা পর্য্যন্ত মাতঙ্গিনী তারার কাছেই থাকিবে, করুণা আসিয়া সন্ধ্যার পর তাহাকে লইয়া যাইবে।

 মাধবকে নিরাপদে বাড়ির বাহিরে পাঠাইয়া তারা মাতঙ্গিনীর নিকট ফিরিয়া আসিয়া ঠাট্টা করিয়া বলিল, এবার তাহাকে বন্দী করিয়া রাখিবার পালা তাহার—এই বলিয়া সে সাবধান হইবার জন্য দরজা বন্ধ করিয়া দিল। তারা তারপর স্বামীর কক্ষে ফিরিয়া চাবির গোছা যথাস্থানে রাখিয়া শয্যায় শয়ন করিল, যেন রাত্রিকালে সে বাড়িতে একটি মূষিকও নড়াচড়া করে নাই, এইরূপ ভাব। শয়ন করিয়া তারা কি নিদ্রা যাইতে পারিল? না, সে স্বামীর গোপন কথাটি জানিয়াছে এবং তাহার উদার মনে সে জ্ঞান অসম্ভব দুঃখ বহন করিয়া আনিয়াছে। সেই রজনীর দৃশ্যপটে যাহার যাহার আবির্ভাব হইয়াছিল, এই বিশ্বস্তা এবং প্রেমময়ী পত্নীই তাহাদের মধ্যে যন্ত্রণা ভোগ করিল সর্ব্বাপেক্ষা অধিক—স্বামীর গুপ্ত রহস্যের জঘন্যতায় সে শিহরিয়া উঠিয়াছিল।

 মাতঙ্গিনী সমস্ত দিনটা তাহার নির্জ্জন কক্ষে নিরাপদে কাটাইল। সন্ধ্যার পরে করুণা পূর্ব্ব বন্দোবস্তমত আসিয়া তাহাকে লইয়া গেল। বহুদিনের দুর্দ্দশা ও দুঃখ ভোগের পর মাতঙ্গিনী হেমাঙ্গিনীকে বুকে চাপিয়া ধরিল।

 মিলনের আনন্দ কতকটা প্রশমিত হইলে হেম বলিল, দিদি, তুমি বল, আর কখনও আমাকে ছেড়ে যাবে না?

 মাতঙ্গিনী দীর্ঘশ্বাস ফেলিল, তাহার চোখ দুইটি জলে ভরিয়া গেল।

 হেম অস্থিরভাবে বলিয়া উঠিল, দিদি, জবাব দিচ্ছ না কেন? হায় হায়, আবার বুঝি আমাদের ছাড়াছাড়ি হবে!

 হতাশ হেম পুনরায় বলিল, আচ্ছা দিদি, তুমি কার জন্যে আমাদের ছেড়ে যাবে?

 মাতঙ্গিনী বলিল, বাবার কাছে যাব।