রাজমোহনের স্ত্রী/ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ

ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ

তারা ও মাধব

 শৈশব হইতেই মাধব ও তারা পরস্পর পরিচিত। তারার পিতা মাধবের মাতামহ একই গ্রামের অধিবাসী ছিলেন; শৈশবাবস্থায় মাধব ঘন ঘন সেখানে যাতায়াত করিত, তারা এই সময়ে তাহার খেলার সঙ্গিনী ছিল। দূর হইলেও তাহাদের পরস্পরের একটা সম্পর্ক ছিল এবং এই সম্পর্ক হেতুই অতি শিশুকাল হইতে তাহারা ঘনিষ্ঠভাবে মিলিত হইয়া খেলা করার সুযোগ পাইয়াছিল। তারা মাধব অপেক্ষা দুই চারি বৎসরের বড় হওয়া সত্ত্বেও মাধব তাহাকে ‘তারা’ বলিয়াই ডাকিত। মথুরের সহিত তাহার বিবাহ হইলেও তাহাদের পরস্পরের মনোভাবের পরিবর্ত্তন হয় নাই, শৈশবের অবাধ মিলনের ফলে যে প্রীতি তাহারা পরস্পরের প্রতি অনুভব করিত তাহা অক্ষুণ্ণই ছিল। খুড়ীর সহিত মাধবের মকদ্দমায় অপরিমিত বিষয়লোলুপতাবশত গোপনে গোপনে মথুর তাঁহাকে সাহায্য করিয়াছিল এ কথা মাধবের অবিদিত ছিল না এবং সেই হইতেই দুই জ্ঞাতিভ্রাতার পরস্পর সৌহার্দ্দ্যে ছেদ পড়ে; পূর্ব্বে যে মাধব ঘন ঘন মথুরের গৃহে যাতায়াত করিত তাহাও বন্ধ হইয়া যায়। মথুর অপেক্ষা মাধব বয়সে অনেক ছোট হওয়ার দরুন জেনানা আইনে তারার সহিত মাধবের প্রায়শ কথাবার্ত্তা আলাপ আলোচনায় বাধিত না; মাধব ও যথাসম্ভব এই সুযোগ লইতে ছাড়িত না। পরস্পর এইভাবে ভাবের আদান-প্রদান উভয়ের পক্ষেই প্রীতিকর ছিল, কারণ উভয়ে উভয়কেই শ্রদ্ধা করিত। কিন্তু এই সম্প্রীতির মধ্যে মনের কোনও কলুষ ছিল না। শৈশবের ভালবাসা পরবর্ত্তী জীবনে প্রতিদিনকার ব্যবহারে এবং পরস্পরের নৈতিক আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধায় উত্তরোত্তর বর্দ্ধিত হইয়া এমন একটা স্নেহের সম্পর্ক গড়িয়া তুলিয়াছিল, ভ্রাতা ও ভগিনীর ভালবাসার সহিত যাহাকে পৃথক করা যায় না।

 এতদ্‌সত্ত্বেও গুদাম মহলে মাধব ও তারা যখন পরস্পরের সম্মুখীন হইল, তখন উভয়েই অস্বস্তি বোধ করিতে লাগিল। কিয়ৎকালের জন্য কেহই কোনও কথা বলিতে পারিল না। তারা প্রথমে নীরবতা ভঙ্গ করিল; বলিল, মাধব, তুমি এখানে?

 মাধব পালটাইয়া তারাকে প্রশ্নটা করিতে পারিল না এবং কি জবাব দিবে বুঝিতে না পারিয়া চুপ করিয়া রহিল। তারাও এই অদ্ভুত অবস্থাবিপর্য্যয়ে পড়িয়া বিমূঢ় হইয়াছিল, কিন্তু এইরূপ অবস্থায় স্ত্রীলোকেরা পুরুষ অপেক্ষা সহজেই প্রকৃতিস্ত হইতে পারে। তাহার নিজের চরিত্রের উপর যথেষ্ট আস্থা ছিল এবং অপর-পক্ষের নিকট হইতেও ভয়ের কোনও আশঙ্কা নাই তাহাও সে ভাল করিয়াই জানিত, তাহার প্রতি মাধবের শ্রদ্ধা যে কতখানি তাহার তাহা জানিতে বাকি ছিল না। সুতরাং ব্যাপারটার একটা সুরাহা হওয়া প্রয়োজন এই বিবেচনা করিয়া তারা প্রশ্ন করিল, ঠাকুরপো, প্রথমে আমাকে বল যমদূতের মত যে দুজন লোক এখনই ছুটে বেরিয়ে গেল, ওরা কে? ও ধরনের লোকের সঙ্গে এখানে আমাদের বাড়িতে তোমার কি দরকার থাকতে পারে, তা আমি ভেবে ঠিক করতে পারছি না। আমি যখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, তখন ওদের মধ্যে একজন আমার দিকে কটমট ক’রে চেয়েছিল, আমাকে পেত্নী ভেবেই বোধ হয় ভয়ে পালিয়ে গেল।

 —তা হ’লে তুমিই ওই দরজাটা খুলে শেকলের আওয়াজ করেছিলে?

 —হ্যাঁ, দরজা আমিই খুলেছিলাম বটে, দরজা খুলে তুমি যে ঘর থেকে বের হলে সেই ঘরে ঢুকতে যাচ্ছি, হঠাৎ এই দুটো যমদূতকে দেখে ভয় পেয়ে ফিরে যাচ্ছিলাম।

 —কিন্তু ওই শব্দ আসছিল কোত্থেকে?

 —শব্দ?

 —তুমি অদ্ভুত কোনও আওয়াজ শোন নি?

 —শুনেছি, যন্ত্রণার চাপা আর্ত্তনাদ, আমার মনে হ’ল, সেটা তোমার ঘর থেকেই আসছিল।

 —না।

 —না? আমাকে নিশ্চয়ই ভয় দেখাচ্ছ না? তা হ’লে আমি ফিরে যাব।

 —আমি এখানে কেন এসেছি, না জেনেই ফিরে যাবে?

 —না না, বল, তুমি এখানে কেন এসেছ, আমার এখানে আসবার কারণও বলব। তাড়াতাড়ি কর।

 মাধব জবাব দিল, স্বচ্ছন্দে; কিন্তু তার আগে একটু সাবধান হয়ে নিই। এ কথা কেন বলছি ক্রমশ বুঝতে পারবে।

 মাধব একবার বাহিরে গেল এবং গুদাম-মহল হইতে বাহিরে যাইবার দরজার ভারী হুড়কোটি খুলিয়া দিল। তাহার পর যে ঘরে কয়েদ ছিল, সেই ঘরেই সে ফিরিয়া গেল—তারাকে সঙ্গে যাইতে বলিল। উভয়ে উপবিষ্ট হইলে সে তাহার বন্দী হওয়ার ইতিহাস বলিতে শুরু করিল। সে কিছু গোপন করিল না অথবা বাড়াইয়া বলিবারও চেষ্টা করিল না। তাহার মনে ঘৃণা ও বিরক্তির অন্ত ছিল না এবং এ বিশ্বাসও ছিল যে তারা তাহার স্বামীকে যতই ভালবাসুক তাহার হৃদয়ের পবিত্রতা কিছুতেই তাহার ঘৃণিত ব্যবহারকে সমর্থন করিতে দিবে না। তারা ঘন্ত্রণায় ছটফট করিতে লাগিল, নৈরাশ্যে তাহার মন ভরিয়া উঠিল।

 তারা বলিল, তা হ’লে আমি যা খুঁজতে বের হয়েছি তুমি তা নয়, তুমি সবে এই সন্ধ্যায় এখানে এসেছ, কিন্তু যে সন্দেহের বশবর্ত্তী হয়ে আমি এখানে এসেছি, দুদিন আগে সেই সন্দেহের কারণ ঘটেছে।

 তারা কেন সেখানে উপস্থিত হইয়াছে, তাহা খুলিয়া বলিল। পাঠককে তাহা বিস্তারিতভাবে বলিবার প্রয়োজন নাই। স্বামীকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখিয়া সে নানা সম্ভব অসম্ভব কল্পনায় নিজে পীড়িত হইয়াছে, কিন্তু স্বামীর চিন্তার কোনই কারণ স্থির করিতে পারে নাই। স্বামীকে জিজ্ঞাসা করিয়াও সে জবাব পায় নাই। সে লুকাইয়া লুকাইয়া স্বামীকে চোরের মত গুদাম-মহলের দিকে যাইতে দেখিয়াছে এবং তাহার বিশ্বাস হইয়াছে যে, কারণ সেখানেই নিহিত। গুদাম-মহলে যেমন করিয়া হউক, প্রবেশ করিয়া অনুসন্ধান করিয়া সে সেই কারণ জানিবে, মনে মনে এই প্রতিজ্ঞা করিয়া ঘুমন্ত স্বামীর বালিশের তলা হইতে চাবি চুরি করিয়া সেখানে উপস্থিত হইয়াছে।

 তারা বলিতে লাগিল, সেই চুরি-করা চাবি নিয়ে আমি যখন এই ভীষণদর্শন দেওয়ালের ধারে ধারে এই অন্ধকার পথে আসছিলাম, তখন আমার মনে আশা আকাঙ্ক্ষা ভয় ও নৈরাশ্যের যে দ্বন্দ্ব চলছিল, তা তুমি অনুভবে বুঝতে পারবে, তা বর্ণনা করার সামর্থ্য আমার নেই। কিন্তু ফিরে যাওয়ার শক্তি আমার ছিল না, কোন ও অজানা অপার্থিব শক্তি যেন আমাকে টেনে আনছিল। আমার স্বামীর দুঃখ যদি আমি প্রাণ দিয়েও ঘোচাতে পারতাম, তা হ’লে প্রাণ দিতেও আমি দ্বিধা করতাম না। সুতরাং ভেবে দেখ, তোমাকে দেখে আমার মনের কি অবস্থা হয়েছিল প্রথমটা! আমার স্বামীর দুশ্চিন্তার সঙ্গে তোমাকে জড়িয়ে আমার মন বিরূপ হয়ে উঠেছিল, কিন্তু তুমি বলছ, তুমি মাত্র আজ সন্ধ্যায় এখানে এসেছ। তা হ’লে নিশ্চয়ই অন্য কারণ আছে।

 প্রত্যুত্তরে মাধব বলিল, তোমাকে নিরাশ হয়ে ফিরতে হবে না— ওই যে শব্দ—তুমি কোন শব্দ শোন নি? রহস্যের সমাধান এখনও হয় নি।

 তারা ভয়ে বিবর্ণ হইয়া গেল।

 মাধব বলিল, ভয় পেও না, ভয় পাবার কিছু নেই। আমি যা দেখেছি এবং শুনেছি, তা বলছি। তুমি যদি আমাকে কথা দাও যে অনাবশ্যক ভয় তুমি পাবে না তবেই বলব—কথা দাও।

 তারা বহুকষ্টে চাপা গলায় বলিল, বল। মাধব তখন ডাকাতদের সহিত কথোপকথনকালে যে সকল শব্দ শুনিয়াছিল তাহার বর্ণনা করিল। সে যতদূর পারিল এমন ভাবে বলিল, যাহাতে তারা ব্যাপারটিকে ভৌতিক কিছু মনে না করে।

 অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক দুশ্চিন্তায় তারা পীড়িত হইতেছিল। স্ত্রীলোকেরা দার্শনিক নহে, ভূতের ভয় তাহারা স্বভাবতই করিয়া থাকে। তাহার মনে এই ভূতের ভয়ের সঙ্গে কৌতূহলও ছিল। স্বামীর দুশ্চিন্তার কারণ খুঁজিতে আসিয়া ভয়াবহ এমন কিছুর সন্ধান যে পাইবে, তাহা সে ভাবিতে পারে নাই। তাহার অনুতাপও হইতেছিল। সে মাধবকে তাহাকে বাড়ির ভিতরে পৌঁছাইয়া দিবার জন্য অনুরোধ করিল।

 মাধব উত্তেজিত হইয়া বলিল, এত সহজেই হাল ছেড়ে দেবে? আমি তোমাকে শপথ ক’রে বলছি যে, ভয়ের কোনই কারণ নেই।— মাধবের কৌতূহল এত অধিক পরিমাণে উদ্রিক্ত হইয়াছিল যে, সে নিজের বিপন্ন অবস্থার কথা এমন কি তারার সঙ্গে এভাবে এমন স্থানে এমন সময়ে একাকী থাকা যে নিন্দনীয়, তাহাও ভুলিয়া গিয়াছিল। তাহার কৌতূহল চরিতার্থ করিতেই হইবে।

 তারা কিয়ৎকাল নীরব রহিল। পরে মনে মনে সাহস সঞ্চয় করিয়া বলিল, কিন্তু খুঁজবে কোথায়? ডাকাতরা কি কোনও জায়গা খুঁজতে বাকি রেখেছে?

 —খুঁজেছে বটে, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে একটা জায়গা তারা দেখে নি। ওই যে দরজা দেখছ। —মাধব আঙুল দিয়া একটা ছোট লোহার দরজা দেখাইল, সেটা এখনও খোলা হয় নি।

 — ওটা নিশ্চয়ই ওঘরে যাবার পথ, ডাকাতরা তো ওঘরটা দেখেছে।

 এই সময়ে আবার সেই চাপা কাতর আর্ত্তনাদ শোনা গেল। খুব স্পষ্ট, যেন অতি নিকটে কোথায়ও। শ্রোতা দুই জনেই চমকিয়া উঠিল। যন্ত্রণার সেই আর্ত্তস্বর যেন উভয়কেই পীড়া দিতেছিল।

 মাধবের মাথার মধ্যে যেন কে কষাঘাত করিল—একটা অবর্ণনীয় ব্যথায় সেও যেন পাগলের মত হইয়া উঠিল। তারার হাত হইতে সজোরে চাবির গোছা ছিনাইয়া লইয়া সে লাফ দিয়া সেই লোহার দরজার সমীপবর্ত্তী হইয়া হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া চাবির গর্ত্তে একটি চাবি ঢুকাইয়া দিল। কিন্তু চাবি ঘুরিল না। মাধব উন্মত্তের মত পর পর আরও দুইটা চাবি প্রয়োগ করিল, কিন্তু কোনই ফল হইল না। মাধব পারিলে সেই ধাতুময় দরজা ভাঙিয়া ফেলিত, কিন্তু চতুর্থ চাবিটি লাগাইতেই স্প্রিঙের দরজা এমন সজোরে খুলিয়া গেল যে, মনে হইল যেন হাওয়ায় একটা পালক উড়িল।

 উত্তেজিত মাধবের তখন কোনও জ্ঞান নাই। সে চীৎকার করিয়া উঠিল, তারা, তারা, দেরি ক’রো না। আমার পেছনে পেছনে এস। বলিয়া সে পাগলের মত দরজা দিয়া ভিতরে ঢুকিল, উত্তেজনার আতিশয্যে তাহার গা ছড়িয়া গেল।

 তারার মনেও তখন সেই উত্তেজনা সংক্রামিত হইয়াছে, তারা আলো লইয়া অগ্রসর হইল। আনন্দ ও বিস্ময়ে নির্ব্বাক মাধব ইটের একধাপ সিঁড়ি আবিষ্কার করিয়াছে। সিঁড়ি খুব সঙ্কীর্ণ ও খাড়া, মাকড়সার জালে ভর্ত্তি। বাক্যব্যয় না করিয়া মাধব লাফে লাফে সেই সিঁড়ি বাহিয়া উপরে উঠিতে লাগিল এবং বিস্ময়ে বিমূঢ় তারাও দ্রুতপদে তাহার অনুসরণ করিল। সিঁড়ি পার হইয়া একটি দরজা—আপাতদৃষ্টিতে দোতলার কোনও ঘরেরই দরজা বলিয়া মনে হয়, কিন্তু আসলে দোতলা নয়। ঘরটির উচ্চতা দেখিয়াই মাধব বুঝিতে পারিল যে, তাহা একটি চোরা-কুঠরি—অতি কৌশলে সকলের দৃষ্টিকে প্রতারিত করিবার জন্যই কুঠরিটি নির্ম্মিত। বাড়ির অন্য কোনও স্থান হইতে এই কুঠরি পরিলক্ষিত হয় না, কারণ একই কামরাকে উপর নীচে ভাগ করিয়া দুইখানি কামরা করা হইয়াছে; পাশের অন্যান্য কামরা ও বারান্দার উচ্চতা এই দুই কামরার সম্মিলিত উচ্চতার সমান হইলেও কোন স্থান হইতে তুলনা করিয়া বুঝিবার উপায় নাই। উপরের কুঠরি একেবারে জানালাবর্জ্জিত।

 মাধব কম্পান্বিত দেহে অত্যন্ত উত্তেজিত অবস্থায় এই দরজার তালা খুলিতে চেষ্টা করিল; দুই-তিনবার বিফল হইয়া আকস্মিক চেষ্টায় রক্তাক্ত আঙুল লইয়া মাধব শেষে সে দরজাও খুলিয়া ফেলিল। ঝন ঝন শব্দ ও তাহার প্রতিধ্বনিতে কক্ষ মুখর হইল। তারা তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ প্রবেশ করিল, তাহার হাতে প্রদীপ—প্রদীপের ক্ষীণ আলোকে তাহারা একটা অপ্রত্যাশিত দৃশ্য দেখিল। বার্নিস-করা মেহগনির একটি খাট-ক্রেপের ঝালরে ঢাকা, এবং খাটের উপর একটি নারীমূর্ত্তি। তারা ও মাধব উভয়েই ছুটিয়া খাটের নিকটে গেল। প্রদীপের অস্পষ্ট আলোকেই শয্যাশায়িত মূর্ত্তিটি প্রকট হইয়া যাহার কথা মনে করাইয়া দিল সে মাতঙ্গিনী; শীর্ণ কৃশ, কিন্তু তথাপি অপার্থিব রূপ, সুন্দর।