রাজমোহনের স্ত্রী/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

প্রথম সন্দর্শন

 “অপনীত সূর্য্যকর নারিকেলাদি বৃক্ষাগ্রভাগ হইতে অন্তর্হিত হইয়াছে; কিন্তু এখন পর্য্যন্ত নিশা ধরাবাসিনী হয় নাই। এমন সময় কনক ও তাহার সমভিব্যাহারিণী কলসীকক্ষে গৃহে প্রত্যাবর্ত্তন করিতেছিল। পথিপার্শ্বে একটি ক্ষুদ্র উদ্যান ছিল; পূর্ব্ববঙ্গ মধ্যে তদ্রূপ উদ্যান বড় বিরল। সুশোভন লৌহরেলের পরিধি মধ্য হইতে অসংখ্য গোলাপ ও মল্লিকার কলি পথিকার নেত্রমোদন করিতেছিল। পূর্ব্বতন পদ্ধতিমত চতুষ্কোণ ও অণ্ডাকার বহুতর চান্‌কার মধ্যে পরিষ্কার ইষ্টকচূর্ণপথ সুরচিত ছিল। উদ্যানমধ্যে একটি পুষ্করিণী। তাহার তীর কোমল তৃণাবলিতে সুসজ্জিত; একদিকে ইষ্টকনির্ম্মিত সোপানাবলী। ঘাটের সম্মুখে বৈঠকখানা। বৈঠকখানার বারাণ্ডায় দাঁড়াইয়া দুই ব্যক্তি কথোপকথন করিতেছিল।

 “বয়োধিক যে ব্যক্তি, তাহার বয়স ত্রিশ বৎসরের ঊর্দ্ধ হইবে; দীর্ঘ শরীর, স্থুলাকার পুরুষ। অতি স্থুলকায় বলিয়াই সুগঠন বলা যাইতে পারিল না। বর্ণ কঠোর শ্যাম; কান্তি কোনও অংশে এমত নহে যে, সেব্যক্তিকে সুপুরুষ বলা যাইতে পারে; বরং মুখে কিছু অমধুরতা ব্যক্ত ছিল। বস্তুতঃ সে মুখাবয়ব অপর সাধারণের মুখাবয়ব নহে; কিন্তু তাহার বিশেষত্ব কি যে, তাহাও হঠাৎ নিশ্চয় করা দুর্র্ঘট। কটিদেশে ঢাকাই ধুতি, লম্বা লম্বা পাকান ঢাকাই চাদরে মাথায় পাগড়ি বাঁধা। পাগড়িটির দৌরাত্ম্যে, যে দুই একগাছি চুল মাথায় ছিল, তাহাও দেখিতে পাওয়া ভার। ঢাকাই মলমলের পিরহাণ গাত্রে;—সুতরাং তদভ্যন্তরে অন্ধকারময় অসীম দেহখানি বেশ দেখা যাইতেছিল —আর সঙ্গে সঙ্গে সোনার কবচখানিও উঁকি ঝুঁকি মারিতেছিল। কিন্তু গলদেশে যে হেলেহার মন্দরপর্ব্বতে বাসুকীর ন্যায় বিরাজ করিতেছিল, সে একেবারে পিরহণের বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল। পিরহণে সোনার বোতাম, তাহাতে চেন লাগান; প্রায় সকল আঙ্গুলেই অঙ্গুরীয়; হস্তে যমদণ্ডতুল্য পিচের লাঠি। বামনদেবের পাদপদ্মতুল্য দুইখানি পায়ে ইংরাজী জুতা।

 “ইহার সমভিব্যাহারী পরম সুন্দর, বয়স অনুমান বাইশ বৎসর। তাঁহার সুবিমল স্নিগ্ধ বর্ণ, শারীরিক ব্যায়ামের অসদ্ভাবেই হউক, বা ঐহিক সুখসম্ভোগেই হউক, ঈষৎ বিবর্ণ হইয়াছিল। তাঁহার পরিচ্ছদ অনতিমূল্যবান, একখানি ধুতি, অতি পরিপাটী একখানি চাদর, একটি কেম্ব্রিকের পিরাণ; আর গোরার বাটীর জুতা পায়। একটি আঙ্গুলে একটী আংটি; কবচ নাই, হারও নাই।”

 অপেক্ষাকৃত বয়স্ক ব্যক্তি কহিল, মাধব, আবার কলকাতা ধরেছ? এ একটা রোগ, বুঝলে?

 মাধব বলিল, রোগ কিসের? মথুরদা, কলকাতার ওপর টান যদি আমার রোগ হয়, তা হ’লে তোমার রাধাগঞ্জের ওপর টানও রোগ।

 মথুর। কেন?

 মাধব। নয় কেন? রাধাগঞ্জের আমবাগানের ছায়ায় তুমি জীবন কাটিয়েছ তাই তুমি ‘রাধাগঞ্জ রাধাগঞ্জ’ কর— কলকাতার দুর্গন্ধের মধ্যে আমি এতকাল বাস করেছি তাই কলকাতার ওপর আমার টান। তা ছাড়া কলকাতায় আমার কাজ আছে।

 মথুর। “কাজ ত সব জানি।— কাজের মধ্যে নূতন ঘোড়া নূতন গাড়ি—ঠক বেটাদের দোকানে টো টো করা—টাকা উড়ান—তেলপুড়ান ইংরাজিনবিশ ইয়ার বক্‌শিকে মদ—খাওয়ান—আর হয়ত রসের তরঙ্গে ঢলাঢল। হাঁ করিয়া ওদিকে কি দেখিতেছ? তুমি কি কখনও কন্‌কিকে দেখ নাই? না, ওই সঙ্গের ছুঁড়িটা আস্‌মান থেকে পড়েছে?—তাই ত বটে! ওর সঙ্গে ওটি কে?”

 মাধব লজ্জিত হইল কিন্তু লজ্জা গোপন করিয়া কথাটা ঘুরাইয়া দিবার জন্য বলিল, কনকের কপালে বিধাতা এত দুঃখ লিখেছেন, তবুও ও হাসছে।

 মথুর কিন্তু ইহাতে নিরস্ত হইল না; সে কনকের সঙ্গিনীর পরিচয় জানিতে চাহিল। মাধব নিজেও তখন পর্য্যন্ত জানিত না, সে কে, কারণ রমণীর মুখ অবগুণ্ঠনাবৃত ছিল। সেও কিন্তু কম মুগ্ধ হয় নাই। রমণীর গতিভঙ্গী অপরূপ, দেহলাবণ্যের কিছু কিছু আভাসও পাওয়া যাইতেছিল। এই সময়ে সহসা বায়ুতাড়নায় রমণীর অবগুণ্ঠন কিঞ্চিৎ সরিয়া যাওয়াতে মাধব চমকিয়া উঠিল। মথুর তাহা লক্ষ্য করিয়া বলিল, দেখছি, তুমি ওকে চেন। কে ও?

 মাধব বলিল, আমার শ্যালী।

 মথুর। কে, রাজমোহনের স্ত্রী?

 মাধব বলিল, হ্যাঁ, সেই। মথুর সন্দিগ্ধভাবে বলিল, রাজমোহনের স্ত্রী? অথচ আমি তে কখনও ওকে দেখি নি।

 মাধব বলিল, কেমন ক’রে দেখবে? উনি বাড়ির বার হন না।

 মথুর। তবে আজ যে বড় বার হয়েছেন!

 মাধব। কি জানি।

 মথুর এ-কথা সে-কথার পর রাজমোহনের স্ত্রীর চরিত্র কেমন, ঘুরাইয়া ফিরাইয়া তাহাই জানিতে চাহিল ও কিছু অশ্লীল ইঙ্গিতও করিল। মাধব ইহাতে বিরক্ত হইয়া বলিল, ভদ্রলোকের স্ত্রী পথে যাচ্ছে, তার সম্বন্ধে এত খবরে কি প্রয়োজন?

 “মথুর কহিল, বলিয়াছি ত দু’পাত ইংরাজি উল্‌টাইলে ভায়ারা সব অগ্নি-অবতার হইয়া বসেন। আর ভাই, শ্যালীর কথা কব না ত কাহার কথা কব? বসিয়া বসিয়া কি পিতামহীর যৌবন বর্ণনা করিব? যাক্ চুলায় যাক; মুখখানা ভাই, সোজা কর—নইলে এখনই কাকের পাল পিছনে লাগিবে। রাজমুহুনে গোবর্দ্ধন এমন পদ্মের মধু খায়?

 "মাধব কহিল, বিবাহকে বলিয়া থাকে সুরতি খেলা।”

 দুইজনে দুইদিকে চলিয়া গেল।