রাজমোহনের স্ত্রী/প্রথম পরিচ্ছেদ



রাজমোহনের স্ত্রী

প্রথম পরিচ্ছেদ

বারিবাহিনী

 মধুমতী নদীর তীরে রাধাগঞ্জ একটি ক্ষুদ্র গ্রাম হইলেও কয়েকজন বর্দ্ধিষ্ণু জমিদারের বাস আছে বলিয়া গ্রামটিতে লক্ষ্মীশ্রীও আছে। একদা চৈত্রের দিবাবসানে ত্রিংশবর্ষবয়স্কা একটি রমণী এই গ্রামের অতিক্ষুদ্র এক পর্ণকুটীরে দ্বিপ্রহরের নিদ্রা হইতে জাগরিত হইয়া প্রসাধনে রত হইল। স্বভাবত এই কাজে স্ত্রীলোকেরা প্রভূত সময়াতিপাত করিয়া থাকেন, কিন্তু এই রমণী মোটেই সেরূপ করিল না। একখানি টিনেমোড়া চারি আঙুল পরিমাণ আয়না এবং সুবৃহৎ একটি চিরুনি ও খানিকটা জলের সাহায্যে প্রসাধন সারিয়া রমণী ললাটে সিন্দূর পরিল এবং তাম্বূলরাগে ঠোঁট দুইখানি রাঙাইয়া কলসী কাঁখে গজগমনে গ্রামের পথে বাহির হইল।

 কিন্তু সোজা গ্রামের বাপীতটে উপস্থিত না হইয়া রমণী দরজার বাঁশের ঝাঁপ তুলিয়া কোনও প্রতিবেশীর গৃহে প্রবেশ করিল। সেখানে চারিটি চালাঘর, মাটির পোতা এবং ঝাঁপের বেড়া। তকতকে ঝকঝকে উঠান ও ঘরগুলি গৃহকর্ত্তার সাচ্ছল্যের পরিচয় দিতেছিল। উঠানের চারি কোণে চারিটি ঘর, তিনটির দরজা উঠানমুখী, চতুর্থটির বহির্মুখী—অর্থাৎ পূর্ব্বোক্ত তিনখানি অন্তঃপুর এবং চতুর্থটি বৈঠকখানা। সদর-বাড়ির মণ্ডপের সামনের উঠানে কিছু বেগুন ও শাক জন্মিয়াছিল। বাড়ির চারিদিকে নলচিতের বেড়া, দরমার ঝাঁপ, সুতরাং উক্ত গৃহমধ্যে প্রবিষ্ট হইতে রমণীকে বেগ পাইতে হইল না।

 প্রবেশ করিয়াই সে বরাবর অন্তঃপুরে চলিল। সেখানে দুইটি প্রাণী ব্যতীত অপর কাহাকেও দেখা যাইতেছিল না, দিবানিদ্রা সারিয়া অপর পুরবাসিনীগণ সম্ভবত এদিক ওদিক ছড়াইয়া পড়িয়াছিল। দুইটি প্রাণী— একটি অষ্টাদশবর্ষীয়া যুবতী, অপরটি চারি বৎসরের এক শিশু। তরুণী কাপড়ের উপর ফুল তুলিতে ব্যস্ত ছিল, শিশু আপনমনে খেলা করিতেছিল। সে অপরূপ এক খেলা, পার্শ্বস্থিত দোয়াতের সবখানি কালি একেবারে মুখে মাখিয়া তাহার আনন্দের অবধি ছিল না, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা পাঠশালায় যাইবার সময় অনবধানতাবশতঃ দোয়াতটি সেখানে ফেলিয়া গিয়া থাকিবে, দুষ্ট শিশু দাদার ভুলের শাস্তি ভাল করিয়াই দিতেছিল।

 আগন্তুক তরুণী পাশে মাটিতে বসিয়া পড়িয়া জিজ্ঞাসা করিল, কি করছিস লা?

 আনন্দে তরুণীর মুখে হাসি দেখা দিল, বলিল, কি ভাগ্যি, দিদির আজ এত দয়া! না জানি কার মুখ দেখে আজ উঠেছি! অভ্যাগতাও হাসিল, হাসিয়া বলিল, কার মুখ দেখে উঠবে আবার? রোজ যার মুখ দেখ, তার মুখই দেখেছ।

 কিন্তু এই কথাতে যুবতীর মুখ সহসা কালো হইয়া উঠিল। অভ্যাগতা অপ্রস্তুত হইল, তাহারও মুখের হাসি মিলাইয়া গেল।

 “অভ্যাগতা যে ত্রিংশৎবর্ষবয়স্ক একথা পূর্ব্বেই বলিয়াছি। সে শ্যামবর্ণা—কাল নয়—কিন্তু তত শ্যামও নয়। মুখকান্তি নিতান্ত সুন্দর নয়, অথচ কোন অংশ চক্ষুর অপ্রিয়কর নয়; তন্মধ্যে ঈষৎ চঞ্চল মাধুরী ছিল, এবং নয়নের ‘হাসিহাসি’-ভাবে সেই মাধুরী আরও মধুর হইয়াছিল। দেহময় যে অলঙ্কার সকল ছিল, তাহা সংখ্যায় বড় অধিক না হইবে, কিন্তু একটি মুটের বোঝা বটে। যে শঙ্খবণিক সেই বিশাল শঙ্খ নির্মাণ করিয়াছিলেন, তিনি বিশ্বকর্ম্মার অতিবৃদ্ধ প্রপৌত্র সন্দেহ নাই। আভরণময়ীর স্থূলাঙ্গে একখানি মোটা শাটী ছিল; শাটীখানি বুঝি রজকের উপর রাগ করিয়াছিল, তাই সে পথে অনেককাল গতিবিধি করে নাই।

 “অষ্টাদশবর্ষীয়ার কোমল অঙ্গে এতাদৃশ অলঙ্কার বেশী ছিল না। বস্তুতঃ তাহার বাক্যালাপে পূর্ব্ববঙ্গীয় কোনরূপ কণ্ঠবিকৃতি সংলক্ষিত হইত না; ইহাতে স্পষ্ট অনুভূত হইতে পারে যে, এই সর্ব্বাঙ্গসুন্দর রমণীকুসুম মধুমতী-তীরজ নহে—ভাগীরথী-কূলে রাজধানী সন্নিহিত কোনও স্থানে জাতা ও প্রতিপালিতা হইয়া থাকিবেক। তরুণীর আরক্ত গৌরবর্ণচ্ছটা মনোদুঃখ বা প্রগাঢ় চিন্তাপ্রভাবে কিঞ্চিৎ মলিন হইয়াছিল; তথাচ যেমন মধ্যাহ্নরবির কিরণে স্থলপদ্মিনী অর্দ্ধপ্রোজ্জ্বল, অর্দ্ধশুষ্ক হয়, রূপসীর বর্ণজ্যোতি সেইরূপ কমনীয় ছিল। অতিবর্দ্ধিত কেশজাল অযত্নশিথিল গ্রন্থিতে স্কন্ধদেশে বদ্ধ ছিল; তথাপি অলককুন্তল সকল বন্ধনদশায় থাকিতে অসম্মত হইয়া ললাট কপোলাদি ঘিরিয়া বসিয়াছিল। প্রশস্ত পূর্ণায়ত ললাটতলে নির্দ্দোষ বঙ্কিম ভ্রূযুগল ব্রীড়াবিকম্পিত; নয়নপল্লবাবরণে লোচনযুগল সচরাচর অর্দ্ধাংশ মাত্র দেখা যাইত; কিন্তু যখন সে পল্লব উর্দ্ধোত্থিত হইয়া কটাক্ষ স্ফুরণ করিত, তখন বোধ হইত যেন নৈদাঘ মেঘমধ্যে সৌদামিনী-প্রভা প্রকটিত হইল। কিন্তু সে যৌবনমদমত্ত তীক্ষ্ন দৃষ্টিক্ষেপে চিন্তাকুলতা প্রতীত হইত; এবং তথায় ক্ষুদ্র ওষ্ঠাধর দেখিলেই বুঝা যাইত, সে হৃদয়তলে কত সুখদুঃখ বিরাজ করিতেছে। তাহার অঙ্গ-সৌষ্ঠব ও নির্ম্মাণ-পারিপাট্য, শারীরিক বা মানসিক ক্লেশে অনেক নষ্ট হইয়াছিল; তথাচ পরিধেয় পরিষ্কার শাটীখণ্ড মধ্যে যাহা অর্দ্ধদৃষ্ট হইতেছিল, তাহার অনুরূপ শিল্পকর কখনও গড়ে নাই। সেই সুঠাম অঙ্গ প্রায় নিরাভরণ, কেবলমাত্র প্রকোষ্ঠে ‘চুড়ী’ ও বাহুতে ‘মুড়কিমাদুলী’, ইহাও বড় সুগঠন।”

 তরুণী হাতের কাজ এক পাশে রাখিয়া অভ্যাগতার সহিত আলাপ করিতে বসিল। অভ্যাগতাও নিজের সংসারযন্ত্রণার কথা এক কাহন করিয়া বলিতে শুরু করিল; আসলে হয়তো সে সকল অনুযোগের কোনও যথার্থ ভিত্তি নাই। তথাপি বলিতে বলিতে তাহার চোখে জল আসিল। কর্দমাক্ত অঞ্চলে নয়নাশ্রু যত মুছে, ততই তাহা উথলিয়া উঠিতে থাকে। শেষে সে প্রায় জাঁকাইয়া কাঁদিবার উপক্রম করিতেছে, এমন সময়ে ভাগ্যক্রমে শিশুর কালি-মাথা মুখের দিকে তাহার দৃষ্টি গেল, আর কাঁদা হইল না, রমণী হাসিয়া ফেলিল।

 এদিকে প্রায় সন্ধ্যা নামিয়া আসিল দেখিয়া আগন্তুকা ঘাটে জল আনিবার জন্য তরুণীকে আমন্ত্রণ করিল। কিন্তু তরুণী রাজি হইল না। অপর কিন্তু নাছোড়বান্দা। শেষে গম্ভীর মুখে নবীনা বলিল, তুই জানিস তে কনকদিদি, আমি কখনও জল আনিতে যাই না।

 কনক বলিল, সেই জন্যেই তো যেতে বলি, তুই কেন দিনরাত্তির এই খাঁচায় বন্ধ থাকবি? অন্য বাড়ির বউ ঝি সবাই তো জল আনে।

 তরুণী তথাপি অটল; বলিল, ঝগড়ায় কাজ কি কনক! তুই তো জানিস স্বামী আমার ঘাটে যাওয়া পছন্দ করেন না। তাঁকেও তো তুই জানিস?

 কনক উত্তর না দিয়া চারিদিকে একবার চকিতে দেখিয়া লইল, কি যেন বলিবে ইচ্ছা করিয়া কিয়ৎকাল নতমস্তকে বসিয়া রহিল। তরুণী প্রশ্ন করিল, কনক, কি ভাবছিস?

 কনক বলিল, তোর চোখ থাকলে—

 তরুণী ইঙ্গিতে তাহাকে অধিক অগ্রসর হইতে নিষেধ করিয়া বলিল, চুপ, বুঝেছি। কিছুক্ষণ অত্যন্ত চিন্তাকুল চিত্তে সে বসিয়া রহিল, পরে কহিল, চল্, কিন্তু পাপ হবে না তো?

 কনক হাসিল, হাসিতে হাসিতে কহিল, আমি ভট্টাচায্যি বামুন নই, পাপ-পুণ্যের খবর রাখি না। কিন্তু আমার আড়াই কুড়ি মিনসে থাকলেও আমি ভয় করতাম না।

 “বড় বুকের পাটা—বলিয়া হাসিতে হাসিতে যুবতী কলসী আনিতে উঠিল; পঞ্চাশটা! হ্যালো, এতগুলি কি তোর সাধ?

 “কনক দুঃখের হাসি হাসিয়া কহিল, মুখে আনিতে পাপ; কিন্তু বিধাতা যে একটা দিয়েছেন, পঞ্চাশটাও যদি তেমনি হয়, তবে কোটী খানেকেই বা কি ক্ষতি? কাহারও সঙ্গে যদি দেখাসাক্ষাৎ না হইল তবে আমি কোটী পুরুষের স্ত্রী হইয়াও সতীসাধ্বী পতিব্রতা।

 “কুলীনে কপাল—বলিয়া তরুণী চঞ্চল পদে পাকশালা হইতে একটি ক্ষুদ্র কলসী আনয়ন করিলেন। যেমন বারিবাহিনী তেমনই কলসী। তখন উভয়ে প্রবাহিনী অভিমুখে যাত্রা করিলেন। কনক হাসিতে হাসিতে কহিল, এখন এস দেখি মোর গৌরবিনী, হাঁ-করাগুলোকে একবার রূপের ছটাটা দেখাইয়া আনি।

 “মর পোড়ার বাঁদর—বলিয়া কনকের সমভিব্যাহারিণী অবগুণ্ঠনে সলজ্জবদন আচ্ছন্ন করিলেন।”