রাজমোহনের স্ত্রী/ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

আশ্রয়দাত্রী

 মথুর ঘোষের বাসভবন পল্লীগ্রামের সমৃদ্ধির সহিত পরিচ্ছন্নতার অভাবের একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত।

 বহুদূরবিস্তৃত ধানের ক্ষেতের ওপার হইতে বৃক্ষশাখাপত্রের অবকাশপথ দিয়া বাড়িটির ছাদের আলিসা ও কালো প্রাচীর নজরে পড়ে। কাছে আসিলে দেখা যায় যে স্থানে স্থানে প্রাচীন চুন-বালির সম্ভ্রান্ত বুনিয়াদ জরাজীর্ণ পুরাতন ইষ্টক-ভিত্তি ত্যাগ করিয়া খসিয়া পড়িবার মতলব করিতেছে, কোথায়ও বা একটা বিশ্রী রঙ-ওঠা জানালার পাল্লা একটি কব্জা মাত্র আশ্রয় করিয়া ঝুলিতে ঝুলিতে গত বৎসরে অন্তর্হিত সঙ্গী অপর পাল্লাটির বিরহে কাতরতা প্রকাশ করিতেছে; কোনও কোনও জানালায় কব্জা বা পাল্লার চিহ্নমাত্র নাই; নীচজাতীয় টাটের পরদা তাহাদের স্থান অধিকার করিয়া বসিয়া আছে। সেই সুবৃহৎ অট্টালিকার বহির্ভাগের সামান্য স্থানেই চুনবালির প্রলেপ পড়িয়াছিল। চুনবালিশোভিত অপেক্ষাকৃত ভাগ্যসম্পন্ন অংশ, মথুর ঘোষ স্বয়ং না হউন্ তাঁহারই মত মহামহিমান্বিত কেহ যে অধিকার করিয়াছিলেন তাহাতে সন্দেহ নাই; এখানে খুঁজিলে ভিনিসিয়ান খড়খড়ির দুই একটা টুক্‌রা যে না মিলিবে তাহা নয়, কিন্তু দৈত্যের মত ওই বাড়ীটা ওরূপ সূক্ষ্ম অলঙ্কারে শোভিত হইতে প্রস্তুত ছিল না। এই অট্টালিকার বহির্ভাগের অধিক অংশেই চুনবালির ছোঁয়াচ লাগে নাই অনাবৃত ইষ্টকস্তূপের উপর ধূলাকাদা ও কালিঝুলির প্রলেপ পড়িয়া একটা বীভৎস সৌন্দর্য্যের সৃষ্টি করিয়াছিল। এখানে সেখানে ইটের দেওয়াল ফুঁড়িয়া এক-আধটা তরুণ বট অথবা অপেক্ষাকৃত নিম্ন শ্রেণীর কোনও গাছ মাথা খাড়া করিয়া যেন কোনও পারস্ত-সম্রাট-কল্পিত শূন্যস্থিত উদ্যানের একটি ছোটখাট সংস্করণ গড়িয়া তুলিবার বাসনা করিতেছিল।

 বাড়ীটি চারিটি সম্পূর্ণ পৃথক মহলে বিভক্ত। সম্মুখ দিয়া ঢুকিতে গেলেই এক জোড়া ভারী লোহার পাতমোড়া আলকাতরামাখানো কবাট পার হইতে হয়, তাহার পরেই প্রশস্ত উঠান। উঠানের তিন দিক দোতলা বারান্দা দিয়া ঘেরা-বারান্দা খুব উঁচু নয়। তোরণের ঠিক বিপরীত দিকেই পাঁচ খিলানের উপর দণ্ডায়মান সুপ্রশস্ত হল-ঘর। হলঘরের ভিতর-বাহির সর্বত্রই চুনবালির কাজ করা, কিন্তু বহু বর্ষার অত্যাচারে সাদা চুনকাম করা দেওয়ালে কিঞ্চিৎ রঙের সমাবেশ হইয়াছে, বিশেষ করিয়া যে সকল স্থানে ছাদের জলনিকাশের জন্য পাইপ বসানো ছিল, সেই সেই স্থান একেবারে কালো হইয়া গিয়াছে। হল-ঘর হইতে অন্দর-মহলে যাইতে হইলে গোলকধাঁধার মত অন্ধকার ও স্যাৎসেতে অনেকগুলি কামরা পার হইয়া যাইতে হয়। অন্দরমহলটা চকমিলান বাড়ি; মধ্যস্থলে প্রাঙ্গণ এবং প্রাঙ্গণের চারিপাশে পূর্ব্বের মতই বারান্দা। চুনবালির কাজ এখানেও আছে, কিন্তু অধিকাংশ থামের নগ্নমূর্ত্তি কালের প্রকোপে প্রকট হইয়া পড়িয়াছে। বাড়ির শিশুরাও এই কার্য্যে কম সহায়তা করে নাই। উপরের এবং নীচের সকল ঘরের দেওয়ালেই অসংখ্য লাল সাদা কালো সবুজ চিহ্ন, এক কথায় রামধনুর সাতরঙে রঙিন। অতিরিক্ত পান খাওয়ার ফলে রসস্থ মুখের ভার-লাঘবকারী পিচে, অথবা চিন্তালেশচীন কোনও দাসীর কর্দ্দম-আধারের ভার সহিতে না পারিয়া গোলা–হাঁড়ি ভাঙিয়া ফেলিবার ফলে অথবা পানসাজা রূপ সুখকর কাজের ভার যাহার উপর,দেওয়ালকে তোয়ালে ভাবে ব্যবহার করিয়া তাহার কাজের পরিচয় অঙ্গুলিচিহ্নরূপে ঘন ঘন দেওয়ালের গায়ে মুদ্রিত করিয়া দিবার জন্যই এরূপ হইয়াছে। কয়লার সাহায্যে অঙ্কিত বহু চিত্র, এঞ্জেলোর কল্পনা অথবা গুইডোর বর্ণগৌরব না থাকিলে ও দুষ্ট বালকদের সময় নষ্ট করিবার অথবা বুদ্ধিমতী বালিকাদের ক্ষুধিত প্রহরযাপনের প্রচেষ্টার সাক্ষ্যরূপে বর্ত্তমান ছিল! উঠানে ইট বা টালির বালাই ছিল না, জননী বসুন্ধরা সকল প্রকার উদ্ভিজ্জগৌরবে শোভমানা ছিলেন। গৌরবটা বেশি ছিল চারিটি কোণে। উঠানের মাঝগানে এদিক ওদিক চারিদিকে যাওয়ার পথ। সংসারের মত আবর্জ্জনা আর ময়লা জল মিলিয়া ঘন কালো হইয়া উঠানের একদিকে যেন যুগ যুগ ধরিয়া বিশ্রাম করিতেছে—সে কালোর তুলনা নাই।

 এখান হইতে একটা সঙ্কীর্ণ গলিপথ দিয়া অপরিসর অথচ দৃঢ় একটি দরজা পার হইলেই বাড়ির তৃতীয় মহল। এখানেই রান্নাঘর, দুই দিকে সারি সারি একতলা কতকগুলি কুঠরি, মধ্যে বিস্তৃত প্রাঙ্গণ, উদ্ভিজ্জগৌরবে পূর্ব্বের প্রাঙ্গণ হইতেও সমৃদ্ধ। এখানে ধরিত্রীজাত শাকসব্জির উপর যে অকথিত অত্যাচার প্রত্যহই অবিরত করা হইতেছে তাহার নিদর্শন বর্ত্তমান; সলিলনিবাসী মীনজাতীয় জীবেদের উপর এই বিভাগের কর্ত্রীঠাকুরাণীরা যে অত্যাচার করেন, তাহারও চিহ্ন রহিয়াছে। অপ্রতিহত গৌরবে যুগযুগসঞ্চিত ঝুল এখানে রাজত্ব করিতেছে।

 চতুর্থ অর্থাৎ শেষ মহল রান্নাঘরের পিছনে অবস্থিত, কিন্তু এদিক হইতে ও-মহলে প্রবেশ করিবার সকল পথই অবরুদ্ধ। বাড়ির মেয়েদের মধ্যে যাহারা কদাচিৎ এই মহলে প্রবেশাধিকার পাইয়াছে, তাহাদের সংখ্যা খুব কম।

 পুরুষেরা এই মহলটিকে গুদাম-মহল বলিত। বাহির হইতে গুদামমহলে প্রবেশ করিবার একটিমাত্র দরজা—অত্যন্ত স্থূল, প্রায় নিরেট। এই মহলের তিন দিকে খাড়া উঁচু প্রাচীর, বাহিরের কেহ যাহাতে বাড়ির এই অংশে সহসা প্রবেশ করিতে না পারে, সেই জন্য এই প্রাচীরের উপরিভাগ বোতলের ভাঙা কাঁচ দিয়া দুর্গম করা হইয়াছে। চতুর্থ অর্থাৎ বাকি দিকে সারি সারি একতলা কতকগুলি ঘর। প্রত্যেক ঘরের দেওয়াল অসম্ভব রকম পুরু, দরজাগুলি ছোট, কিন্তু লোহার পাতমোড়া; জানালার বালাই কোনটিতেই নাই। সম্ভব অসম্ভব সকলপ্রকার দ্রব্য সুরক্ষিত রাখিবার জন্য এই গুদাম-ঘরগুলি ব্যবহৃত হয় সকলে এইরূপ জানিত। বাড়িটির এক দিকে সুপ্রশস্ত সুপারিবাগান, মাঝে মাঝে বকুলগাছ, চতুর্দ্দিক ইষ্টক-প্রাচীর দিয়া ঘেরা এবং ঠিক মধ্যস্থলে কানায় কানায় পরিপূর্ণ একটি পুকুর। এই অংশটিকে বাড়ির খিড়কি বলা হইত। রন্ধনশালার নিকট দিয়া এই অংশে আসিতে হয়, ইহার পরই আর একটি দরজা পার হইলেই গৃহসংলগ্ন উদ্যান।

 পাঠক, আসুন, আপনাকে সঙ্গে লইয়া আমরা এতক্ষণ যে সুবৃহৎ অট্টালিকার পরিচয় দিতেছিলাম, তাহারই দ্বিতীয় মহল অর্থাৎ, অন্দর-মহলের দ্বিতলে গমন করি। সিঁড়ি অত্যন্ত অপ্রশস্ত এবং অন্ধকার; নিরেট ইটের স্তুপ ধাপে ধাপে উপর পর্য্যন্ত গিয়াছে। আমরা পাঠককে দুর্গম ও দুরতিক্রম্য আর এক রাজ্যে যাইতে আহ্বান করিতেছি—স্বয়ং মথুর ঘোষের শয়ন-কক্ষে তাঁহাকে যাইতে হইবে। এই কক্ষের প্রাচীরগাত্রের পালিস-করা চুনবালির আবরণ যথাসম্ভব পরিষ্কার আছে, দুই-এক স্থলে যে ইহার পবিত্রতা বিনষ্ট হয় নাই তাহা নহে; এখানে ওখানে দুই-একটা কলঙ্কের দাগ, ক্কচিৎ দুই-একটা আঁচড়ও দেখা যাইতেছে। এই কক্ষের এক দিকের একটা কোণ ঘেঁষিয়া অনাবৃত মেঝের উপরে সেগুনকাঠের একটা ভারী এবং উঁচু খাট দাঁড়াইয়া আছে। কাষ্ঠনির্ম্মিত ফ্রেমটির সহিত সামঞ্জস্যবিহীন ভাবে একটা ডোরাকাটা জালি-পরদা চারিপাশে মাটির উপর পর্য্যন্ত ঝুলিতেছে। কাঠের কয়েকখানা বিপুলকায় আলমারি এবং চেস্ট-অব-ড্রয়ার্সও ছিল; কালের প্রকোপে ও অযত্নব্যবহারে সেগুলির বার্নিশ বিশেষভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হইয়াছে। এগুলি ঠিক পালঙ্কটির বিপরীত দিকে দেয়াল ঘেঁষিয়া বিরাজ করিতেছিল। একটি কি দুইটি ড্রয়ারসমন্বিত লিখিবার টেবিল, কয়েকটি অতি সাধারণ গ্রাম্য বাক্স ও সিন্ধুক, তাহাদের ডালার চারিটা ধার মোটা মোটা পিতলের পাত দিয়া মোড়া এবং মধ্যে মধ্যে চন্দনকাঠের টুকরা বসানো—ইহাই হইল সেই কক্ষটির কাঠের আসবাবের সম্পূর্ণ পরিচয়। বিপরীত দুই দেওয়ালের মাথা হইতে পরস্পর মুখামুখি ভাবে দুইটি সুবৃহৎ চিত্র ঝুলিতেছিল—একটি মা কালীর কালো মূর্ত্তি এবং অন্যটি মা দুর্গার ছবি, দূর হইতে দেখিলে এটি কাঁকড়ার ছবির মত বোধ হয়।

 অন্য দুই বিপরীত প্রাচীরগাত্রে করালবদনী কালী ও ভগবতী দুর্গার মত অত উঁঁচুতে নয়, দেওয়ালের মাঝামাঝি সারি সারি ইউরোপীয় শিল্পকলার কয়েকটি নমুনা রক্ষিত ছিল। কুমারী মাতা মেরী ও তাঁহার শিশু সম্পর্কিত অপরূপ শিল্প যে-কক্ষের শোভা বর্দ্ধন করিতেছিল তাহার অধিবাসীরা শিল্পীর প্রতিভা অথবা খোদাইকরের কলা-কৌশল যথার্থ কি প্রকাশ করিতে চাহিতেছে সে বিষয়ে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ। এই কক্ষে একটি জানালার ঠিক পাশে একটি রমণী উপবেশন করিয়া ছিলেন—তাঁহার বয়স আটাশের কাছাকাছি হইবে। তাঁহার মুখ এবং গড়ন এখনও সুন্দর বলা যায়। তাঁহাকে শ্যামাঙ্গী বলিতে হইবে; তাঁহার চক্ষুদ্বয় আয়ত ও ভ্রমরকৃষ্ণ, মুদু অথচ হাস্যোজ্জ্বল, একটা জ্যোতি সে দুটিতে জ্বলজ্বল করিতেছিল। ইহা ছাড়া এই রমণীর আর কিছু বিশেষ লক্ষ্য করিবার মত ছিল না, কিন্তু মোটের উপর তাঁহার দেহে এমন একটা মাধুর্য্যের বিকাশ দেখা যাইতেছিল, যাহা তাঁহার সহজাত, এক মুহূর্ত্তের জন্যও এই মাধুর্য্য তাঁহার অঙ্গ ছাড়িয়া যায় নাই। তাঁহার সুডৌল দেহখানিকে বেষ্টন করিয়া একটি পরিষ্কার শাড়ি শোভা পাইতেছিল, কিন্তু মহিলাটির মস্তকে কোনও আবরণ ছিল না। সদ্যস্নানসিক্ত উজ্জ্বল কুঞ্চিত কেশদাম আলুলায়িত হইয়া তাহার পৃষ্ঠদেশে ছড়াইয়া পড়িয়াছিল, চিরুনির সাহায্যে তাহা সংস্কৃত হয় নাই, বিশৃঙ্খল বলিয়াই যেন অধিকতর মনোহারী বোধ হইতেছিল; সচরাচর যে রকম ভারী ভারী গহনা আমাদের চোখে পড়ে, তাহা অপেক্ষা হালকা সুবর্ণ অলঙ্কারে তাহার কান, গলা, বুক, বাহু ও প্রকোষ্ঠ শোভিত ছিল। যে কারণেই হউক, তাহার নাসিকারন্ধ্র ও গণ্ডদেশে নথের সূক্ষ্ম এবং হালকা বৃত্তটি শোভা পাইতেছিল না, কিন্তু পায়ের যথাস্থানে থাকিয়া মলগুলি রুনুঝুনু করিতেছিল। জানালার চৌকাঠে মানুষের চুলের কয়েকটি গুচ্ছ ঝুলিতেছিল —রমণীর অঙ্গুলিগুলি ইহাদের সাহায্যে কিশোরী বালিকাগণের কাম্য বিনুনির গোছানির্ম্মাণে ব্যস্ত ছিল। দশ বছরের একটি বালিকা তাহার নিকটে উপবিষ্ট ছিল। তাহার অপরূপ সুন্দর মুখশ্রীতে বয়স্ক রমণীটির মুখের আদল খুঁজিয়া পাওয়া দুষ্কর নয়। বালিকা যেরূপ ব্যাকুলভাবে তাহার মায়ের শিল্পনির্ম্মাণকার্য্য দেখিতেছিল তাহাতে বোধ হয় যে, তাহারই উন্মত্ত কেশপাশকে বন্ধনদশায় দেখিবার জন্যই তাহার মাতার এই মধুর পরিশ্রম। ইঁহাদের নিকট হইতে একটু দূরে বিনম্রভাবে আর একটি স্ত্রীলোক উপবিষ্ট ছিল। তাহাকে দেখিয়া বোধ হইতেছিল, তাহার চিত্ত অশান্ত হইয়াছে, মনে কোনও গভীর দুঃখ বাসা বাধিয়াছে। এই রমণী কে, সহৃদয় পাঠককে নিশ্চয়ই তাহা বলিয়া দিতে হইবে না। সুকীর মা, শাশুড়ী-জগতে তাহার স্থান যে কতখানি উচ্চে তাহার নিজের ভাষাতেই পাঠক তাহার পরিচয় পাইয়াছেন। সুকীর মা তাহার কথা রক্ষা করিয়াছে। সে দ্বিধাগ্রস্ত মাতঙ্গিনীকে তাহার কর্ত্রীঠাকুরাণী অর্থাং মথুর ঘোষের প্রথম পত্নীর নিকটে হাজির করিয়া দিয়াছে। তিনি তাঁহারই নিমিত্ত চুলের গুছি প্রস্তুত করিতেছিলেন।

 মথুরের গৃহিণী ও মাতঙ্গিনীতে অত্যন্ত নিম্ন স্বরে কথাবার্ত্তা হইতেছিল, সুকীর মা অদূরে বসিয়া আপনার মনে বকর বকর করিয়া যাইতেছিল— উভয়ের কাহাকেও সে বাধা দিতেছিল না। এই কথোপকথন অথবা বকুনি বিস্তৃতভাবে পাঠককে শুনাইবার প্রয়োজন নাই। কারণ তাহার বুদ্ধিবৃত্তির প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করিয়া ধরিয়া লইতেছি যে, তিনি অনুমানে ইহাদের কথাবার্ত্তা কি ধরনের হইবে তাহা বুঝিয়া লইয়াছেন। কনকের মিথ্যা গল্প হইতে সুকীর মা হতভাগিনী পলাতক মাতঙ্গিনী সম্বন্ধে যতটুকু সংবাদ আহরণ করিতে পারিয়াছিল, তাহার উপর নিজের কল্পনার অনেকখানি রঙ চড়াইয়া, অনেকগুলি ভাল ভাল প্রক্ষিপ্ত বর্ণনা যোগ করিয়া দিয়া তাহার দুরবস্থা সম্বন্ধে কর্ত্রীঠাকুরাণীকে ওয়াকিবহাল করিয়া দিয়াছে। পরিশেষে নিজের সুখী কন্যার দৃষ্টান্ত উদ্ধৃত করিয়া বিবাহিত জীবনের সুখ সম্বন্ধে মন্তব্য করিতেও সে ছাড়ে নাই। সহৃদয়া বৃদ্ধা ঠিকই বিচার করিয়া দেখিয়াছিল যে, এই সকল অতিরঞ্জন বা প্রক্ষিপ্ত বর্ণনায় তাহার মক্কেলের কোনই ক্ষতি হইবে না, অথচ তাহার নিজের বাকচাতুর্য্য দেখাইবার যথেষ্ট অবকাশ সে পাইবে। এই বৃদ্ধার সম্মুখেই আসল ব্যাপারটা খুলিয়া বলিবার সাহস মাতঙ্গিনীর হইল না। ভাল মানুষ সুকীর মা যতক্ষণ তাহার সম্বন্ধে গল্প বলিয়া গেল, সে নীরবে বসিয়া শুনিল এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিনা প্রতিবাদে সুকীর মার প্রায় সকল কথাই মানিয়া গেল। মনে মনে সে ইহা স্থির করিয়া লইল যে, যদি প্রয়োজন হয়, যদি তাহাকে অধিক দিন ধরিয়া এই নবপরিচিতার দয়ার আশ্রয়ে থাকিতে হয়, তাহা হইলে ভবিষ্যতে কোনও সময়ে তাহাকে সব কথা খুলিয়া বলিলেই চলিবে—অবশ্য তাহার স্বামী যে হীনতার মধ্যে ডুবিয়াছেন, যতদূর সম্ভব সে সংবাদ গোপন করিয়াই চলিতে হইবে।

 মথুরের স্ত্রী যথেষ্ট আন্তরিকতার সহিত তাহাকে গ্রহণ করিলেন; তাহার হৃদরের স্বতঃস্ফুর্ত্ত উদারতা, শুদ্ধমাত্র শুষ্ক ভব্যতা নয়, মাতঙ্গিনীর নিকট ইহা স্পষ্ট করিয়া দিল যে তিনি তাহাকে আশ্রয় দিতেছেন না, নিমন্ত্রণ করিয়া কাছে রাখিতে চাহিতেছেন। অবশ্য মাতঙ্গিনী এই বাড়ির একজন হইয়া যাইবার পূর্ব্বে আর একটি কাজ করিতে হইবে। মথুরবাবুর অনুমতি এ বিষয়ে আবশ্যক। স্বামীর নিকট এই অনুমতি প্রার্থনা করিবার অভিলাষে একবার এক মিনিট তাঁহাকে ভিতরে আসিবার অনুরোধ জানাইবার জন্য সুকীর মাকে সদরে পাঠাইলেন। বৃদ্ধ তখনও তাহার কন্যার স্বামী-সৌভাগ্য সম্বন্ধে বক্তৃতায় ক্ষান্ত দেয় নাই। স্বামীকে কি জন্য ডাকিতেছেন তাহা তিনি মাতঙ্গিনীর নিকট ভাঙিলেন না। কয়েক মিনিট পরে তাহার স্বামী কক্ষে প্রবেশ করিলেন, তিনি মাথার ঘোমটা টানিয়া দিলেন। মাতঙ্গিনীর পক্ষে আর সেখানে বসিয়া থাকা রীতিবিগর্হিত, সুতরাং সে কক্ষ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইল, কিন্তু তাহার পূর্ব্বেই গৃহস্বামীর অপলক চোখে পরিচয় ও বিস্ময়ের একটা দৃষ্টি সে যেন দেখিতে পাইল।