রাজমোহনের স্ত্রী/চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ



চতুর্দ্দশ অধ্যায়

দাম্পত্য-কলহ সম্বন্ধে গবেষণা—আক্রমণ ও সন্দেহজনক আত্মসমর্পণ

 পূর্ব্ব পরিচ্ছেদ হইতে পাঠক নিশ্চয়ই বুঝিয়াছেন যে, মথুর ঘোষ দুই বিবাহ-বন্ধনজনিত সৌভাগ্য-সুখ অথবা দুর্ভাগ্য-পীড়ার মধ্যে, দুই পত্নীর দাসত্ব বা প্রভুত্ব অথবা দুইই করিয়া দিনাতিপাত করিতেছিল। জ্যেষ্ঠা তারার পরিচয় আমরা দিয়াছি; কনিষ্ঠা চম্পক, বয়সে তারা অপেক্ষা অন্তত আট বছরের ছোট। কি দেহসৌষ্ঠবে কি বর্ণগৌরবে সপত্নী অপেক্ষা সে অনেকাংশে শ্রেষ্ঠ। তদুপরি স্বভাবতই চপল সৌন্দর্য্যের মায়াজাল বিস্তারে সে পটু ছিল, তাহার ফলে তাহার সমস্ত অঙ্গভঙ্গীতে এমন একটা দাম্ভিক ও কঠোর রূপ ফুটিয়া উঠিত যে, সে অঞ্চলের রূপসীরা রূপগর্ব্বে তাহার নিকট পরাজয় মানিয়াছিল; সকলে তাহাকে এজন্য হিংসা করিত। গর্ব্বিতা ও প্রভুত্বপরায়ণা চম্পক বাড়ির সকলকে সর্ব্বময়ী কর্ত্রী হইয়া শাসন করিত। বাড়ির লোকজন তাহাকে ভয় করিত, হয়তো ভিতরে ভিতরে অপছন্দও করিত, কেন না তাহার রুক্ষ মেজাজের পরিচয় পাইয়া সকলেই বুঝিয়াছিল যে, মুখের সৌন্দর্য্যের সহিত হৃদয়ের ঔদার্য্যের বড় বেশি সম্পর্ক নাই এবং ঠিক এই জন্যই জ্যেষ্ঠ হিসাবে সতীন তারার দাবি বেশি হওয়া উচিত হইলেও—সেই ছিল সংসারের সকলের কাছে আসল গৃহকর্ত্রী। মথুর ঘোষের স্বভাবে অবশ্য ভালবাসিবার বা ভালবাসা পাইবার মত কিছু ছিল না; এবং ইহাও নিশ্চয় যে প্রেম তাহার মনের শ্রেষ্ঠ বৃত্তিও নয়, কিন্তু সৌন্দর্য্যের মোহ সকলের উপরেই প্রভাব বিস্তার করে, তাই মথুরও তাহার দ্বিতীয়া স্ত্রীর অনুরক্ত ছিল। মনের সুরুচি ও সুবুদ্ধি প্রণয়বৃত্তিকে আবেগময় ও স্বর্গীয় করিয়া হৃদয়ে হৃদয়ে মিলন ঘটায়, কিন্তু ইন্দ্রিয়পরবশ মনে, ইহা কামলালসা অথবা নারী-মাধুর্য্যের অজানা রহস্যের কাছে অন্ধ আত্মসমর্পণেই শেষ হয়। কিন্তু হৃদয়-বৃত্তির প্রবলতা দুই ক্ষেত্রেই সমান তীক্ষ্ন হইতে পারে। সুতরাং ইহা আশ্চর্য্যের বিষয় নয় যে মথুর চম্পককে ভালবাসিত, ভালবাসা যদি নাও বলা চলে, সে চম্পকের প্রতি অধীর ও অন্ধ ভাবে অনুরক্ত ছিল।

 চারিপাশের সকলের স্বার্থকে নিজের স্বার্র্থসিদ্ধির প্রয়োজনে লাগাইয়া কঠিন মনের শক্তিতে যে ব্যক্তি সকলের প্রভু হইয়াছিল, এই ছলনাময়ীর ইচ্ছাশক্তির কাছে সে ছিল একেবারে ক্রীতদাস। তারার স্বভাবে এমন মাধুর্য্য ও ধৈর্য্য ছিল যে তাহার বিরুদ্ধে ক্রোধের কোন কারণ তাহার থাকিতে পারে না, কিন্তু তারা সম্বন্ধে মথুর উদাসীন ছিল, হয়তো সে ঔদাসীন্য এত বেশি যে তারার প্রতি সে কোনদিন দুর্ব্ব্যবহারও করিতে পারিত না।

 রাজমোহনের স্ত্রী তাহাদের বাড়িতে আশ্রয় লইবে, ইহার অনুমতি স্বামীর নিকট হইতে পাইতে তারার বেগ পাইতে হয় নাই। উত্তরে মথুর বলিয়াছিল, দেবতা ও ব্রাহ্মণের আশীর্ব্বাদে আমার বাড়িতে খাওয়া-পরার অসদ্ভাব নাই; আর তুমি যখন বলছ, মেয়েটির স্বভাব ভাল, তখন যতদিন ইচ্ছা সে আমার এখানে থাকতে পারে। কিন্তু সরলমনা তারা বুঝিয়া উঠিতে পারে নাই যে, কাজে ইহার প্রতিকূলাচরণ হইবে এবং তাহা তাহার এই সহৃদয়তাকে ব্যর্থ করিবে। চম্পক পছন্দ করে নাই যে, তাহার সতীনের আনুকূল্যে এ বাড়িতে বাহিরের কেহ আশ্রয় পায়।

 মথুর ঘোষের অট্টালিকার উপর অস্তমান সূর্য্যের ম্লান কিরণ আসিয়া পড়িয়াছে—মাতঙ্গিনীর ভাগ্যে যে দিন নানা অশুভ বিপদজালের সূচনা দেখা দিয়াছে, সে দিনখানি সন্ধ্যার দিকে ঢলিয়া পড়িয়াছে। তেতলার এক খোলা বারান্দার উপর তির্য্যকভাবে সূর্য্যকিরণ রহিয়া রহিয়া দেখা দিতেছে। শুধু বারান্দার উপর বসিয়া তারা তাহার মেয়ের খোঁপা বাঁধিতে ব্যস্ত ছিল, কিন্তু সে বিনুনি মা কিংবা মেয়ে কাহারও পছন্দমাফিক হইতেছে না। মাতঙ্গিনী কাছেই বসিয়া ‘হুঁ, হাঁ’ করিয়া কতকগুলি অশিষ্ট ও বিরক্তিকর প্রশ্নের উত্তর দিতেছে। প্রশ্নকারিণী চম্পক—মুখরা এক নাপিতানীর সাহায্যে সে তাহার ছোট পা দুইটিতে আলতা পরিতে পরিতে মাতঙ্গিনীকে অনর্গল প্রশ্ন করিয়া যাইতেছিল। কেমন করিয়া ইহা সে বুঝিবে যে, তাহার স্বামী যাহাকে কৃপাপরবশ হইয়া গৃহে আশ্রয় দিয়াছে এবং ইচ্ছা করিলে যে কোন মুহূর্ত্তে সে যাহাকে ঘরছাড়া করিতে পারে, সেই আশ্রিতা তাহার মুখের কোন প্রশ্নের জবাব দিতে অনিচ্ছুক হইতে পারে। মাতঙ্গিনী অত্যন্ত সংক্ষেপে ও বিনীতভাবে উত্তর দিতেছিল, কিন্তু তাহাতে এই সুন্দরীর গর্ব্বে আঘাত লাগায় সে আরও চটিয়া উঠিতেছিল।

 মাতঙ্গিনীকে আহ্বান করিয়া তারা বলিল, দেখছ, দুপুর বেলা থেকে চেষ্টা করেও এ মেয়ের খোঁপা কিছুতে বেঁধে উঠতে পারলাম না। তুমি বোধ হয় ভাল পার। যদি তুমি এই বিনুনিটা কি করে বাঁধি দেখিয়ে দাও, তবে কাজটা শেষ করতে পারি। মাতঙ্গিনী সেদিনকার জন্য খোঁপা বাঁধিবার অনুমতি চাহিল। বলিল, আমিও ভাল পারি না, কিন্তু চেষ্টা করে দেখি।

 মেয়ের পিছনে বসিয়া মাতঙ্গিনী বিনুনি খুলিয়া নূতন করিয়া খোঁপা বাঁধিতে লাগিল। চম্পক বাধা দিয়া বলিল, আহা! দিদি বুঝি নিজেদের সেই পশ্চিমী খোঁপা বাঁধছ। যেমন ছিল তাই বরং ভাল।

 মাতঙ্গিনী উত্তর দিল, এ দেশের মত খোঁপা বাঁধতে আমি যদি পারি, তবে এই সুন্দর মুখকে আরও সুন্দর দেখাবে।

 চম্পক হাঁ হাঁ করিয়া উঠিল, না বাপু না, এ খোঁপা বাঁধতে হবে না, নষ্টা স্ত্রীলোকেরা অমন খোঁপা বাঁধে। গেরস্থের মেয়ের এ খোঁপা ভাল মানাবে না।’

 তারা বাধা দিয়া বলিল, ছিঃ! নষ্টা মেয়ে যদি সুন্দরী হয়, তবে সৌন্দর্য্যকে কি কেউ অবজ্ঞা করে নাকি! তুমি যা বলছ বোন, সেদিক দিয়ে হিসেব করলে, তোমার অমন সুন্দর মুখকেও কুশ্রী করে রাখা উচিত। না বাপু, নষ্টা মেয়েদের একমাথা চুল আছে বলে গেরস্থের মেয়ের তা থাকবে না, এ কেমনধারা কথা! যেমন করে খুশি তুমি খোঁপা বাঁধ দিদি —মাতঙ্গিনীর উদ্দেশে সে বলিল।

 চম্পক উত্তর দিল না বটে, কিন্তু তাহার মুখ যে রকম অন্ধকার হইয়া উঠিল তাহাতে ইহা স্পষ্ট বোঝা গেল যে, তারার মুখে তাহার প্রশংসাও সে নিজের খেয়ালে যে বাধা পাইয়াছে, তাহার জ্বালা ভুলাইতে পারে নাই। ঠিক এই সময়ে নীচের সিঁড়িতে ভারী পায়ের শব্দ শোনা গেল এবং মথুর ঘোষ বারান্দায় আসিয়া দাঁড়াইল। চম্পক চিবুক অবধি ঘোমটা টানিয়া ত্বরিতপদে নিজের ঘরে চলিয়া গেল, দৌঁড়াইতে গিয়া তাহার পায়ের মল বাজিয়া উঠিল। তারাও অবশ্য মাথায় ঘোমটা টানিল, কিন্তু অতখানি নয়, এবং যাইবার জন্য আস্তে উঠিয়া বসিল। মাতঙ্গিনী সর্ব্বাঙ্গ ঢাকিয়া এক পাশে দাঁড়াইয়া রহিল। মথুর ঘোষ দাঁড়াইয়া মেয়ের সহিত দুই-একটি কথা কহিল। দরজার আড়াল হইতে চম্পক তাহাকে লুকাইয়া লক্ষ্য করিতেছিল—সে সন্দিগ্ধা প্রকৃতির, সুতরাং তাহার নজর এড়াইল না যে, মেয়ের সহিত কথা কহিতে কহিতে নবাগতার বস্ত্রাচ্ছাদিত মূর্ত্তির দিকেও স্বামীর সতৃষ্ণ দৃষ্টি মাঝে মাঝে পড়িতেছে। মথুর ঘোষ দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর কক্ষাভিমুখে চলিয়া গেলে, মেয়েরা আবার নিজেদের কাজে আসিয়া বসিল। শুধু চম্পক বাদ রহিল। তাহার স্বামী গিয়া তাহাকে ঘরেই পাইল।

 চম্পক বেশ জানিত যে, তাহার স্বামী তাহার কক্ষেই আসিবেন, তাহার নিজের দেখা করিবার দরকারও ছিল। কিন্তু পাছে কেহ বোঝে যে, তাহার সহিত দেখা করিতেই সে ঘরে আসিয়াছে, তাই স্বামীকে বারান্দা হইতে এদিকে আসিতে দেখিয়াই সে তাড়াতাড়ি একটি বাক্স খুলিয়া তাহার ভিতর হইতে পানের সহিত চিবাইবার জন্য কয়েকটি ভাল মসলা বাহির করিতে ব্যস্ত হইয়া পড়িল। মথুর ঘোষ ঘরে আসিয়া দেখিল যে, মেঝেতে একরাশ রূপা, শিঙ ও কাঠের কৌটা এখানে ওখানে ছড়ানো। সে ঘরে ঢুকিয়াছে, ইহা তাহার স্ত্রী লক্ষ্য করিয়াছে বলিয়াও মনে হইল না। তখনও তাহার মুখের কিয়দংশ ঘোমটায় ঢাকা ছিল, স্বামীর দিকে পিছন ফিরিয়া সে দারচিনি, এলাচ, লবঙ্গ, জায়ফলের ছোট ছোট কৌটা মেঝের উপর ছড়াইয়াই চলিয়াছিল। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া মথুর বলিল, আবার কি হল! ঝড়ের পূর্বলক্ষণ বলে যেন মনে হচ্ছে।

 চম্পক উত্তর না দিয়া কৌটার পর কৌটা মেঝের উপর সাজাইয়া চলিল। মথুর বলিল, বুঝলাম। এখন বল তো আমার কোন অপরাধের এই দণ্ড?

 কিন্তু তবু চাঁপা উত্তর দিল না। যেন যাহা খুঁজিতেছিল তাহা পাইয়াছে, এইভাব দেখাইয়া সে এবারে কৌটাগুলি গুছাইয়া বাক্সে তুলিয়া চাবি বন্ধ করিয়া উঠিয়া ঘর হইতে বাহির হইবার জন্য দোরের দিকে গেল।

 মখুর তাহার হাত ধরিয়া সেদিকে যাইতে না দিয়া বলিল, তা হবে না প্রেয়সী, এই কুশ্রী ঘোমটারই বা এখানে কি প্রয়োজন? বলিয়া সে তাহার মাথার ঘোমটা টানিয়া খুলিয়া ফেলিল।

 চম্পক তাহার দিকে অত্যন্ত বিরক্তিভরা দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল, কেন আমার কাজে বাধা দিচ্ছ?

 —বলই না, আমি কি করেছি যে আমার প্রতি এই বিরূপ দৃষ্টি! চাঁপা শুধু বলিল, আমাকে ছাড়, যেতে দাও। যাইতে ইচ্ছা থাকিলে সে অবশ্য অনায়াসেই যাইতে পারিত। কেন না তাহার স্বামী অত্যন্ত সোহাগে, সন্তর্পণে তাহার হাত ধরিয়াছিল—সে হাত ছাড়াইতে কাকুতির প্রয়োজন ছিল না—ছাড়, আমার কাজ আছে।

 —কমলমুখীর বুঝি কাজ আছে! কি সে কাজ? মথুর হাসিয়া প্রশ্ন করিল।

 রুক্ষ দৃষ্টি দিয়া সে উত্তরে বলিল, আমাকে পান সাজতে হবে।

 মথুর বলিল এখানেই সাজ, আমাকেও দুই-একটি পান দিতে হবে।

 সে আবার বলিল, ছাড় না, যেতে দাও।

 মথুর অনুরাগভরে বলিল, কেন, কি হয়েছে? কি অপরাধ করেছি তা বল, এখনই তার প্রায়শ্চিত্ত করছি।

 আদর কাড়াইয়া সে তেমন করিয়াই উত্তর দিল, আমার কাছে অপরাধ—আমার কাছে আবার তুমি কি অপরাধ করবে! আমি এমন কে যে তোমার অপরাধ নিতে পারি! না, তোমার যা খুশি তাই করতে পার—কে তোমার অপরাধ নেবে! আমি আবার একটা লোক! মথুর বলিল, সাবাস! এ যে ভয়ানক রাগ দেখি। এখন বল তো প্রাণেশ্বরী, আমাকে কি দুঃসাধ্য কাজ করতে হবে—আমি তা এখুনি করছি।

 সে বলিল, যাও যে-বউকে ভালবাস তার কাছে, সেই বলবে তোমাকে কি অকাজ করতে হবে—তাই করো। আমি বেচারী লোক, তোমার বাড়িতে থাকা ছাড়া তোমার ঐশ্বর্য্যে আর কি ভাগ বসিয়েছি —আমার কথা তুমি কেন শুনবে! আর তোমার এবাড়িতে তো যে-সেই থাকতে পারে।

 ব্যাপার কি বুঝিয়া মথুর বলিল, তাই নাকি? সে বলিতে যাইতেছিল—সতীনের কথায় ওই গরিব মেয়েটিকে আশ্রয় দিয়াছি বলিয়াই এই রাগ! কিন্তু নিজেকে সংযত করিয়া সে থামিয়া গেল।

 —তোমার বাড়ি, যাকে খুশি আশ্রয় দিতে পার। এখনও রাগ যেন যায় নাই এমনই ভাবে সে এই উত্তর দিল, কিন্তু তাহার বিরক্তির কারণ যে স্বামী এতক্ষণে বুঝিয়াছে, ইহাতে সে মনে মনে কতকটা খুশি হইয়াছিল।

 এবার মথুর গম্ভীরভাবে বলিল, মেয়েলি রাগ রেখে সত্য করে বল তো এই অনাথ স্ত্রীলোটিকে কিছুকালের জন্যে আশ্রয় দিতে তোমার কি আপত্তি! চম্পক উত্তর দিল, অনাথ স্ত্রীলোক! কেন, অন্যায় করেছে, বাড়ি থেকে তাড়িয়ে তো দেবেই।

 —কিন্তু সে যে অন্যায় করেছে, তা তুমি কি করে জানলে?

 —কেন, তুমি কি ভাব যে মিছামিছি ওকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে? নিজের স্ত্রীকে কেউ কখনও খেয়ালে পড়ে বাড়ি থেকে তাড়ায়?

 —হাঁ, হতে পারে বটে সেই অন্যায় করেছে; কিন্তু তার স্বামীও অন্যায় করতে পারে। কিন্তু সে যাই হোক, বাড়িতে তাকে আশ্রয় দেওয়া কোনও ক্রমেই অন্যায় হতে পারে না।

 আবার চম্পক বিরক্ত হইয়া উত্তর দিল, যা খুশি তা হলে কর— আমার মত চাও কেন?

 —আবার! ছিঃ! মেয়েমানুষের প্রাণে আরও বেশি দয়া থাকা উচিত।

 —যোগ্য হলে কে না দয়া দেখায়! ভালমন্দ সকলকেই কি দয়া করা উচিত?

 —কিন্তু কে তোমাকে বলল যে ও সত্যিই দুরবস্থায় পড়ে নি! লোকে তো ওর স্বভাব ভাল বলেই জানে।

 —লোকে বলে! চম্পক তাহার সুন্দর সুবৃহৎ নথের এক ঝাঁকুনি দিয়া বলিল, সুকীর মায়ের বাজে বকুনি থেকে তুমি তো সব সংবাদ পেয়েছ, ওর ওই মিথ্যে প্রমাণকে তুমি লোকজনের কথা বলে বিশ্বাস করছ কেন শুনি?

 মথুর একটু বিস্মিত হইয়া প্রশ্ন করিল, কেন, তুমি কি ওর সম্পর্কে ভাল ছাড়া খারাপ কিছু কাউকেও বলতে শুনেছ?

 সে বলিল, পুরুষের চাইতে মেয়েদের কথা মেয়েরাই বেশি জানে।

 মথুর আবার প্রশ্ন করিল, তুমি কি শুনেছ?

 এইবার একটু বক্রোক্তি করিয়া সে উত্তর দিল, মেয়েদের গোপন কথা শুনবার ব্যগ্রতা দেখাতে তোমার ভদ্রতায় বাধে না?

 মথুর ঘোষ বিরক্ত বোধ করিল। যে উদ্দেশ্যেই হউক মথুরের নিশ্চিত ইচ্ছা ছিল মাতঙ্গিনী তাহার আশ্রয়ে থাকিবে। এখন নিজের ইচ্ছামত সকল কাজ হউক যে ভাবে—স্ত্রীর কাছ হইতে এই অপ্রত্যাশিত বিরুদ্ধ ব্যবহার পাইয়া সে বিরক্ত বোধ করিল।

 কিছুকাল চিন্তা করিয়া সে বলিল, অন্তত তুমি এটা নিশ্চয়ই স্বীকার কর যে, আত্মীয় স্ত্রীলোককে বাড়ির বার করে দেওয়া অত্যন্ত খারাপ দেখায়। তুমি তো জান ও আমাদের আত্মীয়া—আমাদের ওপর ওর কি কোন দাবি নেই?

 —আর একজনের আত্মীয়তাসূত্রেই তো ও আমাদের আত্মীয়া!— উত্তর যেন প্রস্তুতই ছিল—বোনের বাড়িতে ও আশ্রয় নিল না কেন? নিজের বোনের চেয়ে আমরা কি ওর বেশি আপন, না প্রিয়জন? তারা ওকে ভাল করেই জানে বলে বোধ হয় সেখানে ও আশ্রয় নিতে যায় নি।

 মথুর অত্যন্ত বিরক্তমনে কহিল, তুমি অত্যন্ত ছোটলোক। পৃথিবীতে যে নিরাশ্রয়, তারও বিরুদ্ধে তোমার রাগ! আমার বাড়িতে খাওয়া-পরার অভাব আছে নাকি?

 অভিমান করিয়া চম্পক বলিল, না। সে যাই হোক্, ও যদি এ বাড়িতে আশ্রয় পায়, আমি আমার অংশ ছেড়ে চলে যাব। দাও আমাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে, ও থাকুক এখানে। যে বাড়িতে ও রকম মেয়েমানুষ বাস করে নিজের মেয়ের সেখানে থাকা পছন্দ করার মত লোক আমার বাবা নন।

 মথুর তিক্ত হইয়া বলিল, এসব আবার কি?

 —না, আমাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দাও। সে উত্তর দিল।

 এইবারে মথুর নরম হইয়াছিল, বলিল, জান তো আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারি না! এ ছেলেমানুষি রাখ।

 উত্তর হইল, তা হলে ওকে তাড়াও —ওকে তাড়াও, ও তোমার কে যে ওকে তাড়াতে বাধা হবে।

 —আচ্ছা, একটু ভাববার সময় দাও।

 এই কথা বলিয়া মথুর ঘর ছাড়িয় চলিয়া গেল। মনে থাকিল, যত দিন স্ত্রীর মত না বদলায়, ততদিন তাহাকে কোনও প্রকারে ভুলাইয়াভালাইয়া ঠেকাইয়া রাখিবে।

 সেদিন সন্ধ্যায় সে যখন পুনরায় এই ঘরে ফিরিল, তখন এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখিল। ঘরের এক কোণে, তাহার শয্যা হইতে অনেক দূরে—অপর ঘর হইতে একটি সামান্য খাট আনাইয়া, তদুপরি আর একটি বিছানা পাতা হইয়াছে।

 —এ কার জন্যে? অতিরিক্ত শয্যার প্রতি দৃষ্টি পড়াতে মথুর জিজ্ঞাসা করিল। চম্পক কথা কহিল না, শুধু শয্যার উপর নিজেকে নিক্ষেপ করিয়া কোন উত্তর না দিয়া ঘুমাইয়া পড়িল।

 স্ত্রৈণ মথুর ঘোষের সে রাত্রি কেমন কাটিল, তাহা আমাদের পাঠকবৃন্দ অনুমান করিবেন। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙিয়া বৈঠকখানায় গিয়া সে দেখিল, তাহার জন্য এক ব্যক্তি অপেক্ষা করিতেছে—রাজমোহন ঘোষ বলিয়া সে নিজের পরিচয় দিল। সে মথুরকে তাহার আগমনোদ্দেশ্য বুঝাইয়া বলিল। সে সংবাদ পাইয়াছে যে, তাহার স্ত্রী এখানে—সে মনোমালিন্যের ওজুহাতে বাড়ি ছাড়িয়া আসিয়াছে, তাহাকে ফিরিয়া যাইবার সাহায্যার্থে অনুরোধ করিতে সে আসিয়াছে। মথুর স্বামীর কাছে স্ত্রীকে ফিরাইয়া দিবার এ অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করিতে পারিল না,— চম্পকের হাসিমুখ দেখিবার ও সাংসারিক শান্তির ইচ্ছা তো ছিলই আরো অন্যান্য অনেক দিক বিচার করিয়া ইহা ছাড়া অপর কোন পন্থাও সে দেখিতে পাইল না।

 যখন মাতঙ্গিনীকে সংবাদ দেওয়া হইল তাহাকে যাইতে হইবে, নিজের ভাগ্যে যাহা ঘটিবে সে কথা ভাবিয়া তাহার শরীরের রক্ত হিম হইয়া গেল। প্রায় জীবন্মৃত অবস্থায় সে সুকীর মায়ের পিছনে পিছনে চলিল, তাহাকে বাড়িতে রাখিয়া আসিবার ভার সুকীর মায়ের উপর পড়িয়াছিল। তারা খিড়কির দোর অবধি তাহাকে আগাইয়া দিল, এবং সম্ভব হইলে আরও খানিক আগাইয়া দিত। তাহাকে সে ভারীমনে বিদায় দিল এবং স্বামীর সহিত মনোমালিন্য ভুলিয়া সুখে শান্তিতে থাকিবার কথা সে মাতঙ্গিনীকে বার বার করিয়া বলিল।