রাজমোহনের স্ত্রী/দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ



বন্ধুসমাজে আগন্তুক

 সদ্য বারিধারায় স্নাত প্রভাত মনোহর প্রাণচঞ্চল নবীনতায় ঝলমল করিয়া উঠিল। ভাসমান মেঘপুঞ্জকে পশ্চাতে ফেলিয়া তরুণ তপন ক্রমশ উর্দ্ধগামী হইতে লাগিলেন; নীলোজ্জ্বল অনন্ত আকাশ-প্রান্তরে গতিশীল সূর্য্য; গৃহচূড়া এবং বৃক্ষচূড়া-নারিকেল ও খর্জ্জুর শাখা, আম ও বাবলা গাছগুলি যেন অপরূপ আলোক-বন্যায় স্নান করিয়া হাসিতে লাগিল। বৃক্ষ-লতার পাতায় পাতায় পতনোন্মুখ জলবিন্দু প্রভাতসূর্য্যের তির্য্যক রশ্মিস্পর্শে লক্ষ লক্ষ মুক্তাবিন্দুর মত শোভা পাইতে লাগিল। বৃক্ষকুঞ্জের ঘনসন্নিবিষ্ট শাখার অবকাশপথ দিয়া মুক্ত রশ্মি নিম্নের আর্দ্র তৃণভূমির উপর ঘন দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল। সদ্যোজাগ্রত ও আনন্দিত পক্ষীকুল তাহাদের সহস্র কণ্ঠের কোলাহলে বনভূমি মুখর করিয়া তুলিল; শুধু থাকিয়া থাকিয়া পাপিয়ার সুমিষ্ট কুহুধ্বনি স্পন্দমান বাতাসে ভাসিয়া আসিতে লাগিল। লঘু পেঁজা তুলার মত সাদা মেঘ আকাশের সদ্য পরিশুদ্ধ নীলে নিঃসঙ্গভাবে বিচরণ করিতেছিল; দোদুল্যমান ব্যাকুল শাখাগ্রবর্ত্তী জলবিন্দু ঝরাইবার জন্যই যেন একটা মুক্ত বাতাস সহসা উত্থিত হইয়া আকাশের নিঃসঙ্গ মেঘমালাকে দোলাইতে লাগিল।

 পাঠক, আমাদিগকে অনুসরণ করিয়া গত রাত্রে মাতঙ্গিনী যে পুকুরের পাড়ে ক্ষণিকের জন্য বিপন্ন হষ্টয়া আবার বিপদ্‌মুক্ত হইয়াছিল, সেইখানে আসুন। সূর্য্যদেব আকাশমার্গে এক প্রহরের পথ অতিক্রম করিয়াছেন। একটি অনতিপ্রাচীন তেঁতুলগাছের নীচে লতাগুল্মের আচ্ছাদনে মাতঙ্গিনী ভিজা ঘাসের উপর বসিয়া ছিল। তাহার বস্ত্র সিক্ত, কর্দ্দমাক্ত, বৃষ্টিবিধৌত কুঞ্চিত কেশদাম আলুলায়িত হইয়া গুচ্ছে গুচ্ছে তাহার স্কন্ধদেশ ও বাহু দুইটি ছাইয়া ফেলিয়াছে। সে মস্তক ঈষৎ আনত করিয়া ঘন মেঘের চাইতে কালো কেশ সূর্য্যকিরণে শুকাইয়া লইতেছিল। পাশেই যৌবন-পরিপুষ্ট পূর্ণাঙ্গী কনকের দেহ সদ্য তৈলমাজ্জিত হইয়া মসৃণ দেখাইতেছিল। তাহার কাঁধে ময়লা একটি গামছা— সুবৃহৎ কলসিটি পাশে খালি পড়িয়া ছিল; মিশি-প্রয়োগে-মলিন দাঁতগুলি ইহাই বলিয়া দিতেছিল যে,প্রাতঃকৃত্য সম্পাদনে কনক ঘরের বাহিরে আসিয়াছে বটে, কিন্তু এখনও তাহা বাকি আছে। দুই সখীতে গভীর কোনও বিষয়ের আলোচনায় ব্যাপৃত ছিল। পাঠককে বলিয়া দিতে হইবে না যে, তাহাদের বার্ত্তালাপের বিষয় আমাদের অজ্ঞাত নহে। মাতঙ্গিনী তাহার একমাত্র বিশ্বাসী ও বুদ্ধিমতী সখীর নিকট বিগত রাত্রির ঘটনাপরম্পরা মৃদুস্বরে বিবৃত করিতেছিল। পাঠকের অনুমতি লইয়া এই কথোপকথনের শেষাংশ তাহার অবগতির জন্য উদ্ধৃত করিতেছি।

 কিছুক্ষণ অবাকবিস্ময়ে এই বর্ণনা শুনিয়া; কনক শিহরিয়া বলিয়া উঠিল, মাগো, আমি হ’লে তো ভয়েই ম’রে যেতাম। ধন্যি সাহস তোর, দিদি। আচ্ছা, এখন তুই তোর বরের কাছে ফিরে যাবি?

 মাতঙ্গিনী সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়িয়া বলিল, আর কোথাই বা যাব!

 কনক অধীরভাবে বলিয়া উঠিল, আমার মাথা খাস দিদি, সেখানে আর ফিরিস না। তারা তোকে জ্যান্ত রাখবে না।

 মাতঙ্গিনী কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, মরতে আমাকে হবেই ভাই, অদৃষ্টের লেখা কে খণ্ডাবে? আর কোথায় আমি আশ্রয় পেতে পারি, বল্।

 বন্ধুর দুঃখে সহানুভূতিতে কনকের চোখ জলে ভরিয়া আসিল, সে বলিল, আমি বেশ বুঝছি দিদি, আমাদের বাড়িতে থাকা তোমার চলবে না। কিন্তু বাড়িতে তুমি কিছুতেই ফিরো না। হ্যাঁ, তোমার বোনের কাছে যেতেই বা তোমার আপত্তি কি?

 এই কথায় মাতঙ্গিনীর দেহে এক অপূর্ব্ব ভাবান্তর ঘটিল। উদ্গত অশ্রু মুছিয়া ফেলিয়া যে কঠিন সংযত ভাষায় সে মাধবের কাছ হইতে বিদায় লইয়াছিল, কথায় তেমনই জোর দিয়া সে বলিল, অসম্ভব, এ জীবনে আর সেখানে যেতে পারি না।

 মাতঙ্গিনীর ভাবভঙ্গী দেখিয়া কনক আর প্রতিবাদ করিতে সাহস করিল না। সে আঁচলে মুখ ঢাকিয়া কাঁদিতে লাগিল।

 হঠাৎ পিছন হইতে কে বলিয়া উঠিল, আরে বেটীরা, এগানে লুকিয়ে লুকিয়ে কি পরামর্শ হচ্ছে শুনি! আহা, তোমরা কাঁদছ, কেন, কি হয়েছে মা?

 ভয়চকিত সখীদের পাশে আসিয়া যে দাঁড়াইল সে একজন শ্যামাঙ্গী প্রৌঢ়া রমণী। তাহার চুলে পাক ধরিয়াছে। দেহ বার্দ্ধক্যবশত কুঞ্চিত হইতে শুরু হইয়াছে। তাহার পরনে একটা মোটা পরিষ্কার ঠেঁটি, মুখ তৈলাক্ত, কাঁধে মলিন গামছা এবং কোমরের খালি কলসি তাহার সেখানে আগমনের কারণ বলিয়া দিতেছিল।

 কনক একমুহূর্ত্তে চোখের জল ভুলিয়া গেল, হাস্যোজ্জ্ব্ল-মুখে সে বলিয়া উঠিল, আরে, এ যে দেখছি, সুকীর মা। হ্যাঁ সুকীর মা, ফুলপুকরে আজ যে বড় হঠাৎ এলে?

 সুকীর মা অত্যন্ত প্রসন্নভাবে উত্তর দিল, উঠতে আজ বড় বেলা হয়ে গেল মা, ভাবলাম, যাই, ঘরের কাজে হাত দেবার আগে চট্ করে একট ডুব দিয়ে আসি। কিন্তু, বাছা তোদের কি হয়েছে বল্ তো? দুজনেই কাঁদছিস কেন?

 কনকের চোখ দুইটি আবার অশ্রুসজল হইয়া উঠিল, সে বলিল, আর বলো না, সুকীর মা! এ হতভাগীর দুঃখের কথা তোমাকে আর কি বলব! মাতঙ্গিনী নীরব অর্থপূর্ণ দৃষ্টি প্রেরণ করিয়া কনককে সাবধান করিয়া দিল—সেই দৃষ্টি যেন বলিল, আমার দুঃখের কথা যাহাকে তাহাকে বলিবার নয়, কিছু প্রকাশ করি ও না। কনকও তেমনই অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে জবাব দিল, ভয় নাই, তোমার গুপ্তকথা ব্যক্ত হইবে না।

 কনক আগন্তুককে লক্ষা করিয়া বলিল, ওর দুঃখের কথা আর বলো না। হতভাগিনীকে ওর স্বামী ঘর থেকে বের করে দিয়েছে, এখন ও কোথায় গিয়ে আশ্রয় নেবে তাই ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছে না।

 সুকীর মা বলিল, আরে ছ্যাঁ, এতেই কান্না! স্বামীস্ত্রীতে সকালে ঝগড়া করে, সন্ধ্যেয় আবার তাদের মিল হয়—এ তো সবাই জানে। এখন তার রাগ আছে, রাগ পড়লেই সে সেধে তোমাকে ঘরে নিয়ে যাবে। ছিঃ মা, এর জন্য কান্না কেন? জানিস কনক, আমার জামাই যথন শ্বশুর-ঘর করতে আসে, এমন একটা রাত যায় না; যখন আমার মেয়ের সঙ্গে সে ঝগড়া করে না। কিন্তু তাতে কি, তাই বলে, আমার মেয়েকে সে কোন ও স্বামীর চাইতে কম ভালবাসে না। এই গেলো বুধবারের কথাই ধর। জামাই তো এল চমৎকার একটা সোনার নথ নিয়ে—এমন নথ, তোকে কি বলব কনক—

 কনক কিন্তু সুকীর মায়ের জামায়ের মিষ্টি স্বভাবের পরিচয় সম্পূর্ণ করিতে দিল না, সে মাঝখানেই বলিয়া উঠিল, যা বলেছ ঠিক সুকীর মা, কিন্তু এ আলাদা ব্যাপার। রাজুদা আর একটা মেয়েকে বিয়ে করতে চায়-সেই যে জঙ্গলবেড়ে থেকে সম্বন্ধ এসেছিল সেই মেয়ে। এখন বুঝতেই পারছ, একে বার বার এমনভাবে যন্ত্রণা সে দিচ্ছে কেন। এ আর স্বামীর ঘর করতে যাবে না, সুকীর মা। আর এমনভাবে কারও যাওয়া উচিতও নয়। সেখানে গেলে অপমান আর দুর্ব্বাক্য ছাড়া আর কিই বা জুটবে? এর জন্যে ফিরে যাবে ও! আবার এদিকে কোথায় যে যাবে তারও ঠিক নেই—হতভাগীর বাপের বাড়ি কাছে হ’লেও বা কথা ছিল, তারা তো আর ঠেলতে পারত না।

 সহৃদয়া বৃদ্ধা বলিয়া উঠিল, পোড়া কপালই বটে। তুই ঠিকই বলেছিস কনক, এমন হ’লে কিছুতেই আর ওর ফিরে যাওয়া উচিত নয়। আবার বিয়ে করবে? বলি, এমন সোনার চাঁদের মত বউ কোথায় পাবে সে? আর একটা কচি মেয়েকে ঘরে আনলেই সে কি ঘরগেরস্থালী সামলাতে পারবে? না মা, তুমি ঘরে ফিরো না, বরঞ্চ তোমার বোনের ঘরে গিয়ে দেখ ও কি করে।

 কনক বলিল, তাই কি হবার জো আছে সুকীর মা, বোনের ঘরে যাওয়ার মুখও ওর নাই। মাতঙ্গিনী লজ্জায় ও ঘৃণায় অধোবদন হইয়া রহিল। কনক বলিতে লাগিল, মাধববাবু তাদের বাড়িতে গেল শ্রাদ্ধের সময় রাজুদাকে নেমন্তন্ন করে নি বলে ও ওর বোনের সঙ্গে কি কম ঝগড়াটাই করেছে! আমাদের বাড়িতেই ওকে রাখতে পারতাম, কিন্তু জানই তো সুকীর মা, আমরা কত গরিব। ওকে নিয়ে যাব, আর ও উপোস করে মরবে। এটাই কি ভাল?

 সুকীর মা কপালে করাঘাত করিয়া বলিল, মরণ! কি বোকা মেয়ে তুমি বাছা। অমন স্বামীর জন্যে বোনের সঙ্গে ঝগড়া করা! হ’ত আমার জামাই—আমি কি শুধু তাকেই কথা শোনাতাম! তার বা মারও কি রক্ষে থাকত নাকি? মরুকগে, আয় মা, তুই আমার সঙ্গে। বিপন্ন ও স্তব্ধ মাতঙ্গিনীর দিকে ফিরিয়া সে বলিল, আমার সঙ্গে এসো, আমাদের গিন্নীর সঙ্গে যতদিন খুশি তুমি থাক্‌বে। বড় ঠাকরুণ তোমাকে বড্ড ভালবাসেন, তোমাকে পেলে তিনি খুশিই হবেন। তারপর তোমার স্বামীর রাগ পড়লে, তা সে শিগগিরই পড়বে, তোমাকে বাড়িতে যেতে সাধাসাধি করলে তবে তুমি যেয়ো। দেখো, যেন চট করে আবার তার কথায় ভুলে যেয়ো না; নাকের জলে চোখের জলে হয়ে দাঁতে খড় কেটে সে তোমাকে নিয়ে যাবে, তবে যাবে তুমি।

 কনকের আনন্দ আর ধরে না, উল্লসিত হইয়া সে বলিয়া উঠিল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক বলেছ সুকীর মা, ও তোমার সঙ্গেই এখন যাক। কি বলিস দিদি? সুকীর মায়ের সঙ্গে যাওয়াটাই কি সব চাইতে ভাল হবে না? আমি জানি, বড় ঠাকরুণ তোকে ভালবাসেন। তুই গেলে তিনি খুশিই হবেন। চুপ করে আছিস কেন দিদি, কথা বল্।

 মাতঙ্গিনী যেন বিরক্ত হইয়া ভ্রূকুঞ্চিত করিয়াছিল, কিন্তু মুখরা কনক সে দিকে লক্ষ্য না করিয়াই বলিতে লাগিল, হ্যাঁ হ্যাঁ, ও যাবে। তুমি যাও সুকীর মা, চানটা সেরে এস, তোমার সঙ্গে এখনি ও যাক। যাও, দেরি ক’রো না।

 সুকীর মা আর বিলম্ব না করিয়া স্নান করিতে গেল। মাতঙ্গিনী বলিল, এতও আমার কপালে ছিল, কনক।

 কনক উত্তেজিত হইয়া জোরের সঙ্গে বলিল, ‘না’ ব’লো না দিদি, এতে মত না দিলে তুমি আমার রক্ত খাবে। এখন যাও, সন্ধ্যে বেলায় আমি তোমার সঙ্গে দেখা করব। আর কথা ব’লো না |

 কনক আর উত্তরের প্রতীক্ষা না করিয়া তাড়াতাড়ি তাহার কলসী তুলিয়া লইল এবং দ্রুতপদে জলের পারে গিয়া সুকীর মায়ের সঙ্গে স্নান করিতে নামিল।