রাজমোহনের স্ত্রী/ষোড়শ পরিচ্ছেদ



ষোড়শ পরিচ্ছেদ

আমাদের নায়কের ভাগ্যে কি ঘটিল

 পূর্ব্বপরিচ্ছেদ বর্ণিত ঘটনার পর তিন দিন অতিবাহিত হইয়াছে। সেদিন কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি, অন্ধকার। মাধবের কক্ষের উজ্জ্বল কম্পমান আলোক বহুদূর হইতে দৃষ্ট হইতেছিল; বাহিরের সূচীভেদ্য অন্ধকারের মধ্যে আলোর এই প্রাচুর্য্য অসাম্যতায় অপরূপ দেখাইতেছিল। মাধব একা ছিল, সাটিনবস্ত্রাচ্ছাদিত একটি মেহগনি কৌচে অর্দ্ধশায়িতাবস্থায় সে বসিয়া ছিল। কক্ষে একটি মাত্র আলো সমুজ্জ্বল। কৌচের উপর দুই-তিনটি ইংরেজী পুস্তক বিক্ষিপ্ত, তাহারই একটি মাধবের হস্তধৃত ছিল, কিন্তু সে তাহা পাঠ করিতেছিল এমন বোধ হইতেছিল না। উন্মুক্ত বাতায়নপথে তারকাখচিত অন্ধকার আকাশের যতটুকু দৃষ্টিগোচর হইতেছিল, মাধব সেই দিকে উদাস দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া উপবিষ্ট ছিল। তাহার চিন্তাক্লিষ্ট মন বিষয় হইতে বিষয়ান্তরে ভ্রমণ করিয়া ফিরিতেছিল। মকদ্দমার ফলাফল সম্বন্ধে তাহার মনে নানা আশঙ্কার উদয় হইতেছিল; তাহার ধূর্ত্ত এবং কৌশলী প্রতিদ্বন্দ্বীরা যে-সকল বিবেকবিচারশূন্য ব্যক্তিদের তাহার বিরুদ্ধে নিযুক্ত করিয়াছিল, তাহারা করিতে পারে না এমন পাপ নাই; তাহাদেরই অস্ত্রপ্রয়োগে তাহাদের সহিত যুঝিয়া উঠার ইচ্ছা ও সামর্থ্য মাধবের ছিল না। যদি তাহারা সফলকাম হয় মাধবের ভবিষ্যৎ যে কি হইবে, কে জানে? মাতঙ্গিনীর কপালেই না জানি কি আছে—তাহার ভাগ্যদেবতা যে সুগম পথে তাহাকে লইয়া যাইবে না, তাহা নিশ্চিত। মথুর ঘোষের গৃহে আশ্রয় লওয়া, সেখান হইতে প্রত্যাবর্ত্তন এবং সহসা তাহার অন্তর্দ্ধান হওয়ার সংবাদ সে পাইয়াছিল। কি কারণে একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত ব্যক্তির আশ্রয় লইতে সে বাধ্য হইয়াছিল, তাহা মাধব অবগত ছিল না। গুজব যে কিছু না শুনিয়াছিল তাহা নয়, তবে মাতঙ্গিনীকে সে এত ভাল করিয়া জানিত যে, সামান্য কোনও কারণে যে, এই সাহসী যুবতী এই উপায় অবলম্বন করে নাই ইহা নিশ্চিত; মাতঙ্গিনী সহসা রমণী ও পত্নী সুলভ ধৈর্য্য হারাইয়া নিজের দুঃখ ডাকিয়া আনিবার পাত্রী নয়। আশ্রয় ও সাহায্যের প্রয়োজন সত্ত্বেও সে যে কেন ভগিনীর শরণাপন্ন হয় নাই, মাধব তাহা ভাল রকমেই জানিত এবং মনে মনে এই কার্য্যের প্রশংসা করিত। কিন্তু তাহার গৃহত্যাগ করিবার কি হেতু ঘটিতে পারে, তাহা সে ভাবিয়া উঠিতে পারে নাই। সহসা অদ্ভুতভাবে অন্তর্দ্ধান ব্যাপারটা তাহার কাছে অধিকতর বিস্ময়কর ঠেকিয়াছিল। মাতঙ্গিনী যে তাহার সম্পত্তি অপহরণ করিবার উদ্দেশ্যে ডাকাতদের মন্ত্রণার কথা জানিতে পারিয়া তাহারা কাজ হাসিল করিবার পূর্ব্বেই যথাসময়ে তাহাকে তাহা জ্ঞাপন করাইয়া তাহাদের উদ্দেশ্য পণ্ড করিয়াছিল—এই কথা ভাবিয়া মাতঙ্গিনীর ভাগ্য সম্বন্ধে সহস্র দুশ্চিন্তা তাহাকে পীড়া দিতেছিল; এক-একবার সে এক-একরকম ভাবে, পরক্ষণেই অবিশ্বাস্য ও অসম্ভব জ্ঞানে সে চিন্তাকে দূরে ঠেলিয়া দেয়। তাহার চরিত্র সম্বন্ধে সে বিশেষভাবে জ্ঞাত ছিল বলিয়াই এক বিষয়ে সে নিশ্চিন্ত হইল যে, মাতঙ্গিনীর দুর্ভাগ্য যে রূপ লইয়াই আসুক, কোনও পাপ উদ্দেশ্য লইয়া সে পতিগৃহ ত্যাগ করে নাই। বিপদ যে তাহার একটা কিছু ঘটিয়াছে সে সম্বন্ধেও তাহার কোনই সন্দেহ ছিল না, তাই সে অসহ্য মানসিক যন্ত্রণায় পীড়িত হইতেছিল। মাতঙ্গিনী সম্বন্ধে তাহার মনে যে গভীর অথচ মধুর ভাব স্বতই জাগিতেছিল, বহুকষ্টে দমন করিতে হইতেছিল বলিয়া বহ্নির মত তাহা তাহার বুকে জ্বলিতে লাগিল। সেই বিদায়-দৃশ্যের স্মৃতি তাহার মনে স্পষ্ট হইয়া উঠিতেছিল, মাতঙ্গিনীর প্রত্যেকটি কথা স্মরণে উদিত হইয়া তাহার চক্ষু অশ্রুসজল হইয়া উঠিল। সে বহুক্ষণ ধরিয়া নীরবে অশ্রু বিসর্জ্জন করিল। পরে আসন ত্যাগ করিয়া বাহিরের স্নিগ্ধ বাতাসের স্পর্শে দুশ্চিন্তার আক্রমণ হইতে আত্মরক্ষা করিবার বাসনায় বাহিরের বারান্দায় গিয়া দাঁড়াইল। কিন্তু সেখানেও দুশ্চিন্তা তাহাকে পরিহার করিল না। রেলিঙে ভর দিয়া দাঁড়াইয়া করতলের উপর মাথা রাখিয়া সেই নক্ষত্রখচিত আকাশ এবং দূর সুনীল চন্দ্রাতপের গায়ে গাঢ় কালো ছায়ায় সজ্জিত দীর্ঘ দেবদারুগাছের সারির দিকে অপলক চক্ষে চাহিয়া থাকিতে থাকিতে আবার সে সেই বিপদ-সাগরে ডুবিয়া গেল। নির্নিমেষে চাহিয়া থাকিতে থাকিতে সহসা তাহার দৃষ্টি একটা অদ্ভুত বস্তুতে আকৃষ্ট হইল। আকাশের পটভূমিতে একটি দেবদারুকাণ্ডোত্থিত শাখা যেখানে গাঢ় কালো ছায়ার মত কিছুকাল তাহার দৃষ্টিপথে ছিল, হঠাৎ মনে হইল সেই ছায়া যেন মিলাইয়া গেল। মানুষেব মনের এক অদ্ভুত বিশেষত্ব এই যে, যখন সে নিজের দুশ্চিন্তায় গভীরভাবে ডুবিয়া থাকে, এক-একটা অতি অকিঞ্চিৎকর ঘটনাও মাঝে মাঝে তাহার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। গাছের গুঁড়িসংলগ্ন এই কালো ছায়ার হঠাৎ অপসরণ মাধবের কাছে বিস্ময়কর বলিয়া বোধ হইল। তাহার যে ভুল হয় নাই ইহা স্থির, কোনও কর্ত্তিত শাখার শেষাংশ অথবা গ্রন্থিবহুল কাণ্ডের বিস্তার, যাহাই হউক, বস্তুটি স্থান পরিবর্ত্তন করিয়াছে। তথাপি সেই মুহূর্ত্তের জন্য ব্যাপারটাকে উপেক্ষা করিয়া নিজের চিন্তায় ব্যস্ত মাধব হৃদয়ের খুব সমীপবর্ত্তী বস্তু লইয়াই আবার ভাবিতে বসিল। কয়েক মুহূর্ত্ত অতীত হইতে না হইতেই মাধব আবার পূর্ব্বোক্ত বৃক্ষকাণ্ডের দিকে চাহিয়াই বুঝিতে পারিল, অন্তর্হিত ছায়া পুনরায় যথাস্থানে আসিয়াছে। এইবার সামান্য কৌতূহলের উদ্রেক হওয়াতে সে পূর্ব্বাপেক্ষা অধিকতর অভিনিবেশসহকারে কিছুক্ষণ ধরিয়া স্থানটি লক্ষ্য করিতে লাগিল। আবার হঠাৎ বস্তুটি সরিয়া গেল। স্পষ্ট বুঝা গেল উহা গতিশীল। সে ভাবিল, ব্যাপারখানা কি? প্রথমে মনে হইল, পেঁচা কিংবা ওই জাতীয় নিশাচর পাখী হইবে; অন্ধকার এবং দূর বলিয়া শাখার উপর নিদ্রিত প্রাণীটিকে দেখা যাইতেছে না। ছায়াটি আবার দেখা গেল। মাধব এবার বিশেষভাবে লক্ষ্য করিয়াও বাদুড় অথবা অন্য কোনও পাখীর আকৃতির সহিত ছায়াটির সাদৃশ্য খুঁজিয়া পাইল না। বরঞ্চ মানুষের মাথার সহিত উহার যেন অনেকটা মিল আছে। আকাশের গায়ে ছায়া স্পষ্ট হইল; মাধবের মনে হইল, গাছের গুঁড়ির অন্তরালে যেন গলার খানিকটাও সে দেখিতে পাইল। অবশ্য এমন উচ্চে ছায়াটি পরিলক্ষিত হইল, যেখানে সচরাচর মানুষ উঠে না। বার বার ছায়ার আবির্ভাব ও তিরোভাবে মাধবের কৌতূহল অথবা আশঙ্কা অথবা উভয়ই এমনই বাড়িয়া উঠিল যে, সে কাছে গিয়া পরীক্ষা করিতে চাহিল। মাধব প্রথম ভাবের ধাক্কাতেই কাজে নামিয়া যায়; এক্ষেত্রেও পরীক্ষার কথাটা মনে উদিত হওয়া মাত্রই সে নিজে গিয়া গাছের আড়ালে কেহ আছে কি না, তাহা নির্দ্ধারণ করিবে স্থির করিল। বৈঠকখানায় যে ক্ষুদ্র রৌপ্যমণ্ডিত তরবারি ঝুলিতেছিল, তাহা লইয়া নিজেকে সশস্ত্র করিয়া সে সিঁড়ি দিয়া নীচে নামিয়া গেল। পুনয়ায় সে সদর দেউড়ি হইতে গাছটির দিকে ভাল করিয়া চাহিল; দেউড়ি হইতে দেবদারু সারির দূরত্ব বেশি নয়। কিন্তু নির্দ্দিষ্টস্থানে সে কিছুই দেখিতে পাইল না। এদিক ওদিক সন্ধান করিয়াও খোঁজ পাওয়া গেল না। সুতরাং গাছের গোড়া পর্য্যন্ত তাহাকে যাইতে হইল। কিন্তু সেখান পৌছিতে না পৌছিতেই পেঁচার কর্কশ চীৎকারের মত একটা শব্দ তাহাকে চমকাইয়া দিল এবং দেখিতে দেখিতে কঠিন একটা আঘাতে তাহার হাত হইতে কে যেন তরবারিটি কাড়িয়া লইল। এই হঠাৎ আক্রমণকারী কে, বা কোথায় লুকাইয়া আছে, তাহা বুঝিবার পূর্ব্বেই একটা বলিষ্ঠ হাতের বৃহৎ এবং কর্কশ থাবা তাহার মুখের উপর আসিয়া পড়িল এবং সঙ্গে সঙ্গে বিপুলকায় একটি লোক গাছ হইতে মাটিতে লাফাইয়া পড়িল। মাধব ঘোষ তাহার সম্মুখে এক দীর্ঘাকৃতি ভীষণদর্শন পুরুষকে দেখিতে পাইল। তাহার দেহ তেজোব্যঞ্জক এবং সে সশস্ত্র ছিল।

 মাধবের অস্ত্র যে ব্যক্তি কাড়িয়া লইয়াছিল, তাহাকে লক্ষ্য করিতে অপর ব্যক্তি অতি মৃদুস্বরে বলিল, বেঁধে ফেল্, বেঁধে ফেল্; মেঘ না চাইতেই দেখছি জল। আগে ওর মুখ বন্ধ কর্।

 অন্য ব্যক্তি ততক্ষণে একটা গামছা ও খানিকটা দড়ি তাহার কোমর হইতে বাহির করিয়া গামছা মুখে পুরিয়া মাধবের কণ্ঠরোধ করিয়া তাহার হাত পা বাঁধিতে লাগিল। প্রথমোক্ত ব্যক্তি মাধবকে চাপিয়া ধরিয়া রহিল। মাধব দেখিল, ধস্তাধস্তি করিয়া কোনও লাভ নাই, চীৎকার করিয়া কোনও লাভ নাই, চীৎকার করিয়া সাহায্য প্রার্থনা করাও অসম্ভব; সে নিঃশব্দে আত্মসমর্পণ করিল।

 পূর্ব্ববৎ নিম্নস্বরে পুনরায় হুকুম হইল, একে পাঁজাকোলা ক’রে ধ’রে নিয়ে চল্।

 বন্ধনকারী মাধবকে তাহার বিরাট বাহুর সাহায্যে শূন্যে তুলিল এবং প্রায় অবলীলাক্রমে সেই হতভাগ্য যুবককে লইয়া চলিল। অন্যজন তাহারা অনুসরণ করিল। তাহারা এমন নিঃশব্দে ও তৎপরতার সহিত কার্য্য সমাধা করিল যে, বাড়ির কেহই এই ব্যাপারের বিন্দুবিসর্গও জানিল না।