রাজমোহনের স্ত্রী/সপ্তদশ পরিচ্ছেদ

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ

সতর্ক প্রেম

 আমাদের উপন্যাসের নায়কের ভাগ্যে সহসা এরূপ বিপর্য্যয় যখন ঘটিল, (পাঠক, নিশ্চয়ই মাধবকেই এই উপন্যাসের নায়ক বলিয়া বুঝিয়াছেন।) মথুর ঘোষ তখন বিশ্রামসুখমগ্ন, অথবা আরও যথাযথ বর্ণনা করিতে হইলে বলিতে হয়, সে তারার কক্ষে বিশ্রাম করিবার চেষ্টায় ব্যাপৃত ছিল। তাহার অর্দ্ধশায়িত দেহের সন্নিকটে কৌচের উপরই বসিয়া বসিয়া তারা হাতের ক্ষুদ্র সূক্ষ্মকারুকার্য্যমণ্ডিত খস্‌খস্‌নির্ম্মিত পাখার সাহায্যে স্বামীর ক্ষুব্ধ আত্মাকে সস্নেহে ও পরম ধৈর্য্যের সহিত ঘুম পাড়াইতে চেষ্টিত ছিল। কিন্তু তাহার চেষ্টা সাফল্যমণ্ডিত হইতেছিল না, কারণ যদিচ মথুর ঘোষ নীরব ও মুদিতনেত্র অবস্থায় ছিল, ক্ষণে ক্ষণে তাহার বক্ষ ভেদ করিয়া গভীর দীর্ঘশ্বাস বাহির হইয়া তাহার মনের আশঙ্কা-ব্যগ্রতার পরিচয় দিতেছিল; স্বামীর এই ব্যাকুলতার কারণ তারার সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিল। সেই নীরবতা ভঙ্গ করিয়া তারাই কথা কহিল।

 তারা বলিল, তুমি যে ঘুমোচ্ছ না!

 —ঘুম আস্‌ছে না, ঘুমের সময় তো আমার ঠিক এটা নয়।

 —তবে ঘুমুতে এলে কেন? দেখ, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব, আমার আস্পর্দ্ধা ভেবে তুমি যদি রাগ না কর তো বলি।

 —কিছু বলবার থাকে তো বলই না!

 —তোমার মনে সুখ নেই; যে তোমাকে সত্যিই ভালবাসে, তারও কাছে কি তার কারণ বলতে বাধা আছে?

 মথুর চমকিয়া উঠিল, কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলাইয়া লইয়া ব্যাপারটাকে লঘু করিয়া দিবার জন্য হাসিবার ভঙ্গীতে জবাব দিল বটে, কিন্তু তারার স্নেহ-দৃষ্টির কাছে তাহার এই প্রয়াস ধরা পড়িতে বিলম্ব হইল না। মথুর বলিল, পাগল! যত আজগুবি কথা! আমার আবার দুঃখ হবে কেন?

 তারা ব্যগ্র অথচ স্নেহপূর্ণস্বরে বাধা দিয়া বলিল, প্রিয়তম, আমাকে ফাঁকি দেবার চেষ্টা ক’রো না। আমি জানি তুমি আমাকে আর আমার ভালবাসাকে উপেক্ষা কর। আমরা মেয়েমানুষ, স্বামী যে আমাদের কি— আমি জানি না, স্বামী আমাদের কি নয়! তুমি সারা সংসারকে ফাঁকি দিতে পারবে, কিন্তু আমাকে পারবে না।

 মথুর বলিল, তুমি পাগল না হ’লে আমার সম্বন্ধে এমন কথা ভাবতে না —তাহার কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল, যাহা তাহার নিজের কথারই প্রতিবাদ করিতেছিল —এসব ভাবার কারণটাই খুলে বল।

 তারা বলিল, এর কারণ তুমি নিজে। শোন। জানি, অনেক বিষয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে হয়; তোমার তালুক, তোমার মামলা-মকদ্দমা, তোমার খাজনা, তোমার কাছারি, তোমার বাড়ি, বাগান, দাসদাসী, তোমার সংসার—অনেক কিছু নিয়েই তোমাকে ভাবতে হয়; আমার কি আছে? আমার স্বামী আর আমার মেয়ে। আমি যদি বলি, গত তিন দিন ধ’রে আমি লক্ষ্য করছি আমার স্বামীর চলার ভঙ্গীতে পূর্ব্বেকার সেই তেজ আর গর্ব্বের অভাব হয়েছে, তাতে অবাক হবার কি আছে? তোমার চোখে শূন্য দৃষ্টি, মাঝে মাঝে কেমন অদ্ভুত ভাবে তুমি চেয়ে থাক। তুমি আগের চাইতে কথা কম বল, তোমার হাসি তোমার অন্তরের হাসি নয়। দেখ, মায়ের চোখ এটা লক্ষ্য করতে কখনও ভুল করে না যে, তার সন্তানকে তার বাবা আগের মত তেমন আদরের সঙ্গে বুকে নেয় না! হ্যাঁ, গত তিন দিন ধ’রেই আমি দেখছি, বিন্দু যখনই তোমার হাত ধরেছে কিংবা তোমার কাছে ব’সে খেলা করেছে, তুমি তার সঙ্গে কথা বল নি। চাঁপার সঙ্গেও তো কই তোমাকে কথা বলতে দেখি না।

 সতীনের কথা বলিতে বলিতে মুহূর্ত্তকালের জন্য তারার ব্যগ্র মুখভঙ্গীর কিঞ্চিৎ পরিবর্ত্তন ঘটিল; একটা কুটিল হাসি তাহার মুখে খেলিয়া গেল। কিন্তু সে মুহূর্ত্তের জন্য। তারা বলিতে লাগিল, চাঁপাও দেখছি এ ক’দিন খুব দাপাদাপি ক’রে বেড়াচ্ছে, তবু তুমি ভদ্রভাবে তার কোনও কথাই শুনছ না। আর তোমার এই দীর্ঘনিঃশ্বাস! তুমি কি এখনও বলতে চাও, তোমার কিছু হয় নি?

 মথুর উত্তর দিল না।

 স্বামীকে নিরুত্তর দেখিয়া তারা আবার বলিতে লাগিল, তুমি কি আমাকে তোমার দুঃখের অংশভাগী হওয়ার উপযুক্ত মনে কর না? আমি জানি, তুমি আমাকে ভালবাস না।

 তারা স্বামীর উত্তরের প্রতীক্ষায় কিছুক্ষণ চুপ করিল। মথুর তখনও নিরুত্তর। প্রেমময়ী পত্নীর পবিত্র মুখমণ্ডলের দিকে স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া সে বসিয়া রহিল; তাহার বক্ষোদেশ ভেদ করিয়া একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়িল।

 তারা আর আপনাকে ধরিয়া রাখিতে পারিল না, অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, তোমার মনে কোনও মুখ নেই, তুমি আমার কাছে গোপন ক’রো না, ফাঁকি দিও না আমাকে—গভীর যন্ত্রণায় তাহার কণ্ঠ প্রায় রুদ্ধ হইয়া যাইতেছিল—আর ঠকিও না আমাকে, কিছু লুকিও না আমার কাছে, সব খুলে বল। আমার জীবন দিয়েও যদি তোমার মনের সুখ ফিরিয়ে আনতে পারি আমি তাই ক’রব—তুমি সুখী হও।

 মথুর তবুও নির্ব্বাক হইয়া রহিল। উপহাস, তর্ক বা অস্বীকার করিবার প্রবৃত্তি তাহার ছিল না। একটা কঠোর গাম্ভীর্য্যের আবরণে সে বসিয়া রহিল এবং ইতিপূর্ব্বে তাহার মুখভাগে যে প্রাণহীনতা ও কপটতা আনিয়া সে তাহার পত্নীর প্রশ্নধারা এড়াইয়া চলিতেছিল, তাহা দূর হইয়া তাহার মুখে সত্যকার ব্যাকুলতা প্রকাশ পাইল; এই ব্যাকুলতা তাহার প্রতি দর্শকের হৃদয় আর্দ্র করিয়া তুলিলেও কোথায় যেন একটা বাধা ঘটাইতেছিল। তারার দুই চোখ বহিয়া অশ্রু গড়াইয়া পড়িল। রমণীসুলভ হৃদয়ের ব্যাকুলতা ও সূক্ষ্ম অনুভূতির দ্বারা সে স্বামীর মুখভাবের এই অস্বাভাবিক পরিবর্ত্তন লক্ষ্য করিল।

 ব্যথিত পত্নী বলিয়া উঠিল, কি কুক্ষণেই না আমি জন্মেছিলাম! এখনও আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত বুঝি হয় নি! তোমাকে যদি প্রাণ দিয়েও সুখী করতে পারি, তাও আমি করব! কি শুভক্ষণেই না জানি জন্মেছিলাম! তোমার দুঃখের কারণটাও আমি জানতে পাব না?

 স্ত্রীর ক্রন্দন মথুরের হৃদয় স্পর্শ করিল। অপরাধ স্বীকারের ভঙ্গীতে সে অবশেষে বলিল, আমার দুশ্চিন্তার কারণ তোমার কাছ থেকে গোপন রেখে লাভ নেই, তারা। তোমার কাছেও আমি কিছু খুলে বলতে ভরসা করছি না—তুমি সে জন্য দুঃখ ক’রো না। তোমার শোনার উপযুক্ত কথা সে নয়।

 স্বামীর এই কথা শুনিয়া তাহার ম্লান অথচ মহিমান্বিত মুখমণ্ডলে মুহূর্ত্ত কালের জন্য গভীর যন্ত্রণার রেখা ফুটিয়া উঠিল, কিন্তু পরক্ষণেই সে শান্ত সহজভাবে দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিল, তা হ’লে আমার একটা সামান্য অনুরোধ রাখবে বল, আমাকে কথা দাও।

 কিন্তু তাহার কথা সমাপ্ত হইবার পূর্ব্বেই অদূরে পেঁচার চীৎকারের মত এক বিকট কর্কশ-হুঙ্কার শোনা গেল। সেই শব্দ শুনিয়া মথুর চকিতে উঠিয়া দাঁড়াইল।

 তারা জিজ্ঞাসা করিল, হ্যাঁ গো, তুমি চমকালে কেন? শব্দটা শুনে আমার বড্ড ভয় হ’ল বটে, কিন্তু ও তো প্যাঁচার ডাক।

 আরও কর্কশ আরও ভীষণভাবে সেই শব্দ আবার বাতাসে ভাসিয়া আসিল। তারা কিছু বলিবার পূর্ব্বেই মথুর বেগে সেই কক্ষ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইল।

 তারা বিস্মিত হইল। শব্দটা যে পেঁচার চীৎকার সে বিষয়ে তাহার সন্দেহ হইল না—পেঁচার ডাক না হইলেও তাহা এমন কিছু ভয়াবহ নয়। অন্তত তাহার মনে হইল যে, এক ভাবী অমঙ্গলের আশঙ্কা ছাড়া উহাতে ভয়ের বিশেষ কিছু নাই—এই অমঙ্গল-ধ্বনি লোকে তো প্রত্যহ শোনে এবং সহ্য করে। তাহার একবার শুধু মনে হইল আওয়াজটা যেন নিশাচর পাখীর ডাকের মতনই কিন্তু ঠিক যেন পেঁচার ডাক নয়। তাহার কৌতুহল উদ্রিক্ত হওয়াতে সেও কক্ষের বাহিরে আসিল। স্বামী সিঁড়ি দিয়া নীচে নামিয়া গিয়াছেন বুঝিয়া সে উপরের সিঁড়ি দিয়া ছাদে গিয়া উঠিল, সেখান হইতে ব্যাপারটার কিছু কিনারা হইতেও পারে! যেদিক হইতে শব্দটা আসিয়াছিল, সেদিকে কিছুক্ষণ নিবিষ্টচিত্তে চাহিয়া থাকিয়াও সে কিছু বুঝিতে পারিল না। সুতরাং শব্দটা পেঁচারই চীৎকার হইবে এইরূপ ভাবিয়া লইয়া সে সেদিকে বেশি নজর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করিল না। পাখীটা নিশ্চয়ই কাছাকাছি ডালপালার অন্তরালে অথবা ছাদের কোণে কার্নিশের উপর কোথাও বসিয়া আছে—স্বামী এই সুযোগে হঠাৎ কক্ষ ত্যাগ করিয়া তাঁহার মনের কোণে যে দুর্ব্বলতা প্রকাশ পাইতেছিল তাহাই সামলাইয়া লইলেন। তারা নীচে নামিতে যাইবে এমন সময় সহসা দেখিল, একটি মনুষ্য-মূর্ত্তি তাহাদের খিড়কির দরজা দিয়া বাহির হইতেছে— বাড়ির কোনও স্ত্রীমূর্ত্তি তাহা নয়—স্পষ্ট পুরুষের মূর্ত্তি। ভাল করিয়া দেখিতে গিয়া তারা বুঝিল মূর্তিটি স্বামীর—মথুর দরজা পার হইয়া দ্রুতবেগে জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করিল। তারা বিস্ময়বিমূঢ় হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। তাহার সমস্ত দেহ থরথর করিয়া কাঁপিতে লাগিল। তাহার ভয় হইল, সে মূর্চ্ছিত হইয়া পড়িয়া যাইবে। সহস্র অনিশ্চিত আশঙ্কা ও যন্ত্রণাদায়ক সন্দেহ তাহার মনে ঝড়ের মত বহিয়া গেল। তাহার স্বামী অপদার্থ হওয়া সত্ত্বেও সে তাহাকে ভালবাসিত, কোনও পৈশাচিক পাপকার্য্যে যে সে সহায় হইতে পারে, এরূপ ভাবা তাহার পক্ষে সম্ভব হইল না। তথাপি স্বামীর ভবিষ্যৎ বিপদের আশঙ্কায় তাহার মন বিষন্ন হইল, সে সেখানেই প্রায় স্থাণুর মত দাঁড়াইয়া রহিল ; নীচু আলিসার উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়া সে স্থির অথচ উদাস দৃষ্টিতে স্বামীর প্রত্যেকটি গতি-বিধি নিরীক্ষণ করিতে লাগিল । হঠাৎ আর সে স্বামীকে দেখিতে পাইল না। তবু সে সেদিকেই চাহিয়া রহিল—অন্ধকারের মধ্যে সবল দীর্ঘ মথুরের কোন চিহ্নই সে দেখিল না। সে এদিক ওদিক চাহিল—তাহার ভয় দশগুণ বাড়িয়া গেল। সেই বৃহৎ প্রাসাদের শিখরে অবিচলিত ভাষাহীন মর্ম্মরমূর্ত্তির মত শোভমানা তারা অনেক — অনেক ক্ষণ ধরিয়া নির্নিমেষ নেত্রে অরন্যের দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। অবশেষে হতাশ হইয়া স্বামীর সন্ধান ছাড়িয়া দিবে, এমন সময় সহসা তাহার প্রার্থিত মূর্ত্তি তাহার চঞ্চল দৃষ্টিপথে পড়িল। মথুর তখন ( পাঠকের নিকট ) ‘গুদাম-মহল’ নামে পরিচিত বাড়ির পরিত্যক্ত অংশ হইতে বাহির হইবার ক্ষুদ্র লৌহ–দরজা দিয়া নিঃশব্দে নিষ্ক্রান্ত হইতেছিল ।

 স্বামীকে নিজ গৃহের অংশ বিশেষে দেখিতে পাইয়া তারা অনেকটা নিশ্চিন্ত হইল। তথাপি তাহার ভয় তখনও সম্পূর্ণ দূর হয় নাই । বাড়ির বাহিরে স্বামীর এই নৈশ গোপন অভিসার, রাত্রির এই প্রহরে এবং বাড়ির এই অংশে যেখানে কেহ সচরাচর পদার্পণ করে না, সেখানে তাহার গতিবিধি — পূর্ব্বের আশঙ্কা ও ভীতি এবং সেই নিশাচর পক্ষীর অশুভ চীৎকার, যাহা তখনও তাহার কানে বাজিতেছিল—এই সব কিছু মিলিয়া তারার মনে অজ্ঞাত কোনও বিপদের সূচনা করিতেছিল । তারা তাহার পৰ্য্যবেক্ষণ-স্থান পরিত্যাগ না করিয়া পুনরায় স্বামীর আবির্ভাবের প্রতীক্ষা করিতে লাগিল । আবার কিছুকাল সে কিছুই দেখিতে পাইল না। প্রায় অর্দ্ধঘন্টা নিষ্ফল প্রতীক্ষায় কাটিয়া গেল, তাহার স্বামী সেই গুপ্ত দরজা দিয়া আর ফিরিল না। দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া সে ক্লান্ত হইয়া পড়িল, তাহার স্বামীর ব্যক্তিগত কোনও বিপদাপদ ঘটার কোন ও আশঙ্কা নাই বুঝিয়া সে পুনরায় নিজের কক্ষে ফিরিয়া আসিল।

 হঠাৎ তাহার মনের অন্ধকারে সে যেন আলোকরেখা দেখিতে পাইল। আচ্ছা, এই ঘটনার সহিত তাহার স্বামীর গুপ্তকথার কোনও সম্বন্ধ নাই তো! তারা কি করিবে স্থির করিয়া ফেলিল।

 কয়েক মুহূর্ত্ত পরে মথুর সে কক্ষে প্রবেশ করিল, তাহাকে আরও অস্থির আরও চঞ্চল দেখাইতেছিল বটে, কিন্তু তাহার চোখের কোণে যেন একটা গর্ব্বের আনন্দ। তারা যাহা দেখিয়াছে, সে সম্বন্ধে একটি কথাও বলিল না।