দশম পরিচ্ছেদ।

 এদিকে অনন্তমিশ্র রূপনগর হইতে যাত্রা করার পরেই রূপনগরে মহাধুম পড়িয়াছিল। মোগল বাদশাহের দুই সহস্র অশ্বারোহী সেনা রূপনগরের গড়ে আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহারা চঞ্চলকুমারীকে লইতে আসিয়াছে।

 নির্ম্মলের মুখ শুকাইল; দ্রুতবেগে সে চঞ্চলকুমারীর কাছে গিয়া বলিল, “কি হইবে সখি?”

 চঞ্চলকুমারী মৃদু হাসি হাসিয়া বলিলেন, “কিসের কি হইবে?”

 নির্ম্মল। তোমাকে ত লইতে আসিয়াছে। কিন্তু এই ত ঠাকুরজি উদয়পুর গিয়াছেন— এখনও তাঁর পৌঁছিবার বিলম্ব আছে। রাজসিংহের উত্তর আসিতে না আসিতেই তোমার লইয়া যাইবে—কি হইবে সখি?

 চঞ্চল। তার আর উপায় নাই—কেবল আমার সেই শেষ উপায় আছে। দিল্লীর পথে বিষভোজনে প্রাণত্যাগ—সে বিষয়ে আমি চিত্ত স্থির করিয়াছি। সুতরাং আমার আর উদ্বেগ নাই। একবার কেবল আমি পিতাকে অনুরোধ করির—যদি মোগলসেনাপতি সাতদিনের অবসর দেন।

 চঞ্চলকুমারী সময়মত পিতৃপদে নিবেদন করিলেন, যে “আমি জন্মের মত রূপনগর হইতে চলিলাম। আমি আর কখন যে আপনাদিগের শ্রীচরণ দর্শন করিতে পাইব আর কখন যে বাল্যসখীগণের সঙ্গে আমোদ করিতে পাইব এমত সম্ভাবনা নাই। আমি আর সাতদিনের অবসর ভিক্ষা করি—সাতদিন মোগলসেনা এইখানে অবস্থিতি করুক। আর সাতদিন আমি আপনাদিগকে দেখিয়া শুনিয়া জন্মের মত বিদায় হইব

 রাজা একটু কাঁদিলেন। বলিলেন, “দেখি, সেনাপতিকে অনুরোধ করিব কিন্তু তিনি অপেক্ষা করিবেন কি না বলিতে পারি না।”

 রাজা অঙ্গীকারমত মোগল সেনাপতির কাছে নিবেদন জানাইলেন। সেনাপতি ভাবিয়া দেখিলেন, বাদশাহ কোন সময় নিরূপিত করিয়া দেন নাই—বলিয়া দেন নাই যে এতদিনের মধ্যে ফিরিয়া আসিবে। কিন্তু সাত দিন বিলম্ব করিতে তাঁহার সাহস হইল না; ভবিষ্যৎ বেগমের অনুরোধ একেবারে অগ্রাহ্য করিতেও পারিলেন না। আর পাঁচদিন অবস্থিতি করিতে স্বীকৃত হইলেন। চঞ্চলকুমারীর বড় একটা ভরসা জন্মিল না।

 এদিকে উদয়পুর হইতে কোন সম্বাদ আসিল না—মিশ্রঠাকুর ফিরিলেন না। তখন চঞ্চলকুমারী ঊর্দ্ধমুখে, যুক্তকরে বলিল, “হে অনাথনাথ দেবাদিদেব! অবলাকে বধ করিও না।”

 তৃতীয় রজনীতে নির্ম্মল আসিয়া তাঁহার কাছে শয়ন করিল। সমস্ত রাত্রি দুইজনে দুইজনকে বক্ষে রাখিয়া রোদন করিয়া কাটাইল। নির্ম্মল বলিল, “আমি তোমার সঙ্গে যাইব।” কয়দিন ধরিয়া সে এই কথাই বলিতেছিল। চঞ্চল বলিল, “তুমি আমার সঙ্গে কোথায় যাইবে? আমি মরিতে যাইতেছি।” নির্ম্মল বলিল “আমিও মরিব। তুমি আমার ফেলিয়া গেলেই কি আমি বাঁচিব?” চঞ্চল বলিল, “ছি। অমন কথা বলিও না—আমার দুঃখের উপর কেন দুঃখ বাড়াও?” নির্ম্মল বলিল, “তুমি আমাকে লইয়া যাও, বা না যাও, আমি নিশ্চয় তোমার সঙ্গে যাইব—কেহ রাখিতে পারিবে না।” দুইজনে কাঁদিয়া রাত্রি কাটাইল।

 এদিকে, সৈয়দ হাসান আলি খাঁ, মনসবদার—মোগল সৈন্যের সেনাপতি, রাত্রি প্রভাতে রাজকুমারীকে লইয়া যাইবার সকল উদ্যোগ করিয়া রাখিলেন।