নবম পরিচ্ছেদ।

 রাণা অনন্ত মিশ্রকে তাঁহার প্রতীক্ষা করিতে বলিয়া গিয়াছিলেন, অনন্ত মিশ্রও তাঁহার অপেক্ষা করিতেছিলেন— কিন্তু তাঁহার চিত্ত স্থির ছিল না। অশ্বারোহীর যোদ্ধৃবেশ এবং তীব্র দৃষ্টিতে তিনি কিছু কাতর হইয়াছিলেন! একবার ঘোরতর বিপদ্‌গ্রস্ত হইয়া ভাগ্যক্রমে প্রাণে রক্ষা পাইয়াছেন কিন্তু আর সব হারাইয়াছেন— চঞ্চলকুমারীর আশা ভরসা হারাইরাছেন—আর কি বলিয়া তাহার কাছে মুখ দেখাইবেন? ব্রাহ্মণ এইরূপ ভাবিতেছিলেন, এমত সময়ে দেখিলেন পর্ব্বতের উপরে দুই তিন জন লোক দাঁড়াইয়া কি পরামর্শ করিতেছে। ব্রাহ্মণ ভীত হইলেন; মনে করিলেন, আবার নূতন দস্যুসম্প্রদায় আসিয়া উপস্থিত হইল না কি? সেবার— নিকটে যাহা হয় কিছু ছিল, তাহা পাইয়া দস্যুরা তাঁহার প্রাণবধে বিরত হইয়াছিল— একবার যদি ইহারা তাঁহাকে ধরে তবে কি দিয়া প্রাণ রাখিব? এইরূপ ভাবিতেছিলেন, এমত সময়ে দেখিলেন, যে পর্ব্বতারূঢ় ব্যক্তিরা হস্ত প্রসারণ করিয়া তাঁহাকে দেখাইতেছে এবং পরস্পর কি বলিতেছে। ইহা দেখিবামাত্র, ব্রাহ্মণের যে কিছু সাহস ছিল, তাহা গেল—ব্রাক্ষণ পলায়নের উদ্যোগে উঠিয়া দাঁড়াইলেন। সেই সময়ে পর্ব্বতবিহারীদিগের মধ্যে একজন পর্ব্বত অবতরণ করিতে আরম্ভ করিল— দেখিয়া ব্রাহ্মণ উর্দ্ধশ্বাসে পলায়ন করিল।

 তখন ধর ধর করিয়া তিন চারিজন তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ছুটিল—ব্রাহ্মণও ছুটিল—অজ্ঞান, মুক্তকচ্ছ, তথাপি নারায়ণ নারায়ণ স্মরণ করিতে করিতে ব্রাহ্মণ তীরবৎ বেগে পলাইল। যাহারা তাহার পশ্চাদ্ধাবিত হইয়াছিল, তাহারা তাহাকে শেষে আর না দেখিতে পাইয়া প্রতিনিবৃত্ত হইল।

 তাহারা অপর কেহই নহে— মহারাণার ভৃত্যবর্গ। মহারাণার সহিত এস্থলে কি প্রকারে আমাদিগের সাক্ষাৎ হইল, তাহা এক্ষণে বুঝাইতে হইতেছে। রাজপুতগণের শিকারে বড় আনন্দ, অদ্য মহারাণা শত অশ্বারোহী এবং ভৃত্যগণ সমভিব্যাহারে মৃগয়ায় বাহির হইয়াছিলেন। এক্ষণে তাঁহারা শিকারে প্রতিনিবৃত্ত হইয়া উদয়পুরাভিমুখে যাইতেছিলেন। রাজসিংহ সর্ব্বদা প্রহরিগণ কর্ত্তৃক পরিবেষ্টিত হইয়া রাজা হইয়া থাকিতে ভালবাসিতেন না। কখন কখন অনুচরবর্গকে দূরে রাখিয়া একাকী অশ্বারোহণ করিয়া ছদ্মবেশে প্রজাদিগের অবস্থা দেখিয়া শুনিয়া বেড়াইতেন। সেইজন্য তাঁহার রাজ্যে প্রজা অত্যন্ত সুখী হইয়া উঠিয়াছিল; স্বচক্ষে সকল দেখিতেন, স্বহস্তে সকল দুঃখ নিবারণ করিতেন।

 অদ্য মৃগরা হইতে প্রত্যাবর্ত্তনকালে তিনি অনুচরবর্গকে পশ্চাতে আসিতে বলিয়া দিয়া, বিজয়নামা দ্রুতগামী অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করিয়া একাকী অগ্রসর হইয়াছিলেন। এই অবস্থায় অনন্ত মিশ্রের সহিত সাক্ষাৎ হইলে যাহা ঘটিয়াছিল, তাহা কথিত হইয়াছে। রাজা দস্যুকৃত অত্যাচার শুনিয়া স্বহস্তে ব্রহ্মস্ব উদ্ধারের জন্য ছুটিয়াছিলেন। যাহা দুঃসাধ্য এবং বিপদপূর্ণ তাহাতেই তাঁহার আমোদ ছিল।

 এদিকে অনেক বেলা হইল দেখিয়া কতিপয় রাজভৃত্য দ্রুতপদে তাঁহার অনুসন্ধানে চলিল। অবতরণকালে দেখিল রাণার অশ্ব দাঁড়াইয়া রহিয়াছে—ইহাতে তাহারা বিস্মিত এবং চিন্তিত হইল। আশঙ্কা করিল যে রাণার কোন বিপদ্ ঘটিয়াছে। নিম্নে শিলাখণ্ডোপরি অনন্ত ঠাকুর বসিয়া আছেন দেখিয়া তাহারা বিবেচনা করিল যে এই ব্যক্তি অবশ্য কিছু জানিবে। সেই জন্য তাহারা হস্ত প্রসারণ করিয়া সেদিকে দেখাইয়া দিতেছিল। তাঁহাকে জিজ্ঞাসাবাদ করিবার জন্য তাহারা নামিতেছিল, এমত সময়ে ঠাকুরজি নারায়ণ স্মরণপূর্ব্বক প্রস্থান করিলেন। তখন তাহারা ভাবিল, তবে এই ব্যক্তি অপরাধী। এই ভাবিয়া তাহারা পশ্চাৎ ধাবিত হইল। ব্রাহ্মণ এক গহ্বরমধ্যে লুকাইয়া প্রাণরক্ষা করিল।

 এদিকে মহারাণা চঞ্চলকুমারীর পত্রপাঠ সমাপ্ত ও মাণিকলালকে বিদায় করিয়া অনন্ত মিশ্রের তল্লাসে গেলেন। দেখিলেন সেখানে ব্রাহ্মণ নাই—তৎপরিবর্ত্তে তাঁহার ভৃত্যবর্গ, এবং তাঁহার সমভিব্যাহারী অশ্বারোহিগণ আসিয়া অধিত্যকার তলদেশ ব্যাপিত করিয়াছে। রাণাকে দেখিতে পাইয়া সকলে জয়ধ্বনি করিয়া উঠিল। বিজয়, প্রভুকে দেখিতে পাইয়া, তিন লম্ফে অবতরণ করিয়া তাঁহার কাছে দাঁড়াইল। রাণা তাহার পৃষ্ঠে আরোহণ করিলেন। তাঁহার বস্ত্র রুধিরাক্ত দেখিয়া সকলেই বুঝিল, যে একটা কিছু ক্ষুদ্র ব্যাপার হইয়া গিয়াছে। কিন্তু রাজপুত্রগণের ইহা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার— কেহ কিছু জিজ্ঞাসা করিল না।

 রাণা কহিলেন, “এইখানে এক ব্রাহ্মণ বসিয়াছিল; সে কোথায় গেল— কেহ দেখিয়াছিল?”

 যাহারা উহার পশ্চাদ্ধাবিত হইয়াছিল তাহারা বলিল; “মহারাজ সে ব্যক্তি পলাইয়াছে।”

 রাণা। শীঘ্র তাহার সন্ধান করিয়া লইয়া আইস।

 ভৃত্যগণ তখন সবিশেষ কথা বুঝাইয়া নিবেদন করিল, যে আমরা অনেক সন্ধান করিয়াছি, কিন্তু পাই নাই।

 অশ্বারোহিগণ মধ্যে রাণার পুত্ত্রদ্বয়, তাঁহার জ্ঞাতি ও অমাত্যবর্গপ্রভৃতি ছিল। রাজা পুত্ত্রদ্বয় ও অমাত্যবর্গকে নির্জ্জনে লইয়া গিয়া কথাবার্ত্তা বলিলেন। পরে ফিরিয়া আসিয়া আর সকলকে বলিলেন,

 “প্রিয়জনবর্ণ! আজি অধিক বেলা হইয়াছে; তোমাদিগের সকলের ক্ষুধাতৃষ্ণা পাইয়াছে সন্দেহ নাই। কিন্তু আজ উদয়পুরে গিয়া ক্ষুধাতৃষ্ণা নিবারণ করা, আমাদিগের অদৃষ্টে নাই। এই পার্ব্বত্য পথে আবার আমাদিগকে ফিরিয়া যাইতে হইবে। একটি ক্ষুদ্র লড়াই জুটিয়াছে—লড়াইয়ে যাহার সাধ থাকে আমার সঙ্গে আইস—আমি এই পর্ব্বত পুনরারোহণ করিব। যাহার সাধ না থাকে উদয়পুরে ফিরিয়া যাও।”

 এই বলিয়া রাণা পর্ব্বত আরোহণে প্রবৃত্ত হইলেন; অমনি “জয় মহারাণা কি জয়! জয় মাতা জী কি জয়!” বলিয়া সেই শত অশ্বারোহী তাঁহার পশ্চাতে পর্ব্বত আরোহণে প্রবৃত্ত হইল। উপরে উঠিয়া হর! হর! হর! শব্দে, রূপনগরের পথে ধাবিত হইল। অশ্বক্ষুরের আঘাতে অধিত্যকায় ঘোরতর প্রতিধ্বনি হইতে লাগিল।