রাজসিংহ (১৮৮৫)/তৃতীয় পরিচ্ছেদ
তৃতীয় পরিচ্ছেদ।
বুড়ী বাড়ী আসিল। তাহার বাড়ী বুঁদী। সে চিত্রগুলি দেশে বিদেশে বিক্রয় করে। বুড়ী রূপনগর হইতে বুঁদী গেল। সেখানে গিয়া দেখিল, তাহার পুত্ত্র আসিয়াছে। তাহার পুত্ত্র দিল্লীতে দোকান করে।
কুক্ষনে বুড়ী রূপনগরে চিত্র বিক্রয় করিতে গিয়াছিল। চঞ্চলকুমারীর সাহসের কাণ্ড যাহা দেখিয়া আসিয়াছিল, তাহা কাহারও কাছে বলিতে না পাইয়া, বুড়ীর মন অস্থির হইয়া উঠিয়াছিল। যদি নির্ম্মলকুমারী তাহাকে পুরষ্কার দিয়া কথা প্রকাশ করিতে নিষেধ করিয়া না দিত, তবে বোধ হয় বুড়ীর মন এত বাস্ত না হইলেও হইতে পারিত। কিন্তু যখন সে কথা প্রকাশ করিবার জন্য বিশেষ নিষেধ হইয়াছে তখন বুড়ীর মন, কাজে কাজেই কথাটি বলিবার জন্য বড়ই আকুল হইয়া উঠিল। বুড়ী কি করে, একে সত্য করিয়া আসিয়াছে, তাহাতে হাত পাতিয়া মোহৱ লইয়া নিমক খাইয়াছে, কথা প্রকাশ পাইলেও দুরন্ত বাদশাহের হস্তে চঞ্চলকুমারীর বিশেষ অনিষ্ট ঘটিবার সম্ভাবনা তাহাও বুঝিতেছে। হঠাৎ কথা কাহারও সাক্ষাতে বলিতে পারিল না। কিন্তু বুড়ীর আর দিবসে আহার হয় না রাত্রে নিদ্রা হয় না। শেষ আপনা আপনি শপথ করিল যে এ কথা কাহারও সাক্ষাতে বলিব না। তাহার পরেই তাহার পুত্ত্র আহার করিতে বসিল—বুড়ী আর থাকিতে পারিল না—শপথ ভঙ্গ করিয়া পুত্ত্রের সাক্ষাতে সবিস্তারে, চঞ্চলকুমারীর দুঃসাহসের কথা বিবৃত করিল। মনে করিল, আপনার পুত্ত্রের সাক্ষাতে বলিলাম তাহাতে ক্ষতি কি? পুত্ত্রকে বিশেষ করিয়া বলিয়া দিল—আমার দিব্য এ কথা কাহারও কাছে বলিও না।
পুত্ত্র স্বীকার করিল, কিন্তু দিল্লী ফিরিয়া গিয়াই, আপনার উপপত্নীর আছে গল্প করিল! বলিয়া দিল জান্! কাহারও সাক্ষাতে বলিও না। জান্ তখনই আপনার প্রিয় সখীর কাছে গিয়া বলিল। তাহার প্রিয়সখী দুই চারি দিন পরে বাদশাগের অন্তঃপুরে গিয়া বাঁদী স্বরূপ নিযুক্ত হইল। সে অন্তঃপুরে পরিচারিকাগণের নিকট এই রহস্যের গল্প করিল। ক্রমে বাদশাহের বেগমেরা শুনিল। যোধপুরী বেগম বাদশাহের কাছে গল্প করিল।
ঔরঙ্গজের সসাগর ভারতের অধীশ্বর। ঈদৃশ ঐশ্বর্য্যশালী রাজাধিরাজ এক চঞ্চলা বালিকার কথায় রাগ করিবেন ইহা কোন প্রকারে সম্ভব নহে। কিন্তু ক্রুরমনা ঔরঙ্গজেব সে প্রকৃতির বাদশাহ ছিলেন না। যে যত ক্ষুদ্র হৌক, যে যেমন মহৎ হউক, কেহ তাঁহার প্রতিহিংসার অতীত নহে। অমনি স্থির করিলেন, যে সেই অপরিপক্কবুদ্ধি বালিকাকে ইহার গুরুতর প্রতিফল দিবেন। বেগমকে বলিলেন, “রূপনগরের রাজকুমারী দিল্লীর রাজপুরে আসিয়া বাঁদীদিগের তামাকু সাজিবে।”
যোধপুরেশ্বরকুমারী শিহরিয়া উঠিল— বলিল “সে কি জাঁহাপনা! যাহার আজ্ঞায় প্রতিদিন রাজরাজেশ্বরগণ রাজ্যচ্যুত হইতেছে—এক সামান্যা বালিকা কি তাহার ক্রোধের যোগ্য!”
রাজেন্দ্র হাসিলেন—কিছু বলিলেন না কিন্তু সেই দিনেই চঞ্চলকুমারীর সর্ব্বনাশের উদ্যেগ হইল। রূপনগরের ক্ষুদ্র রাজার উপর এক আদেশপত্র জারি হইল। যে অদ্বিতীয় কুটিলতা ভয়ে জয়সিংহ ও যশোবন্ত সিংহ প্রভৃতি সেনাপতিগণও আজিম শাহ প্রভৃতি শাহজাদাগণ সর্ব্বদা শশব্যস্ত—যে অভেদ্য কুটিলতাজালে বদ্ধ হইয়া চতুরাগ্রগণ্য শিবজীও দিল্লীতে কারাবদ্ধ হইয়াছিলেন—এই আজ্ঞাপত্র সেই কুটিলতা প্রসূত। তাহাতে লিখিত হইল যে, “বাদশাহ রূপনগরের রাজকুমারীর অপূর্ব্ব রূপলাবণ্য শ্রবণে মুগ্ধ হইয়াছেন। আর রূপনগরের রাজার সৎস্বভাব ও রাজভক্তিতে বাদশাহ প্রীত হইয়াছেন। অতএব বাদশাহ রাজকুমারীর পাণিগ্রহণ করিয়া তাঁহার সেই রাজভক্তি পুরস্কৃত করিতে ইচ্ছা করেন। রাজা কন্যাকে দিল্লীতে পাঠাইবার উদ্যোগ করিতে থাকুন; শীঘ্র রাজসৈন্য আসিয়া কন্যাকে দিল্লীতে লইয়া যাইবে।”
এই সম্বাদ রূপনগরে আসিবামাত্র মহাহুলস্থুল পড়িয়া গেল। রূপনগরে আর আনন্দের সীমা রহিল না। যোধপুর, অম্বর প্রভৃতি বড় বড় রাজপুত রাজগণ মোগল বাদশাহকে কন্যাদান করা অতি গুরুতর সৌভাগ্যের বিষয় বলিয়া বিবেচনা করিতেন। সেস্থলে রূপনগরের ক্ষুদ্রজীবী রাজার অদৃষ্টে এই শুভ ফল বড়ই আনন্দের বিষয় বলিয়া সিদ্ধ হইল। বাদশাহের বাদশাহ— যাঁহার সমকক্ষ মনুষ্যলোকে কেহ নাই—জিনি জামাতা হইবেন—চঞ্চলকুমারী পৃথিবীশ্বরী হইবেন—ইহার অপেক্ষা আর সৌভাগ্যের বিষয় কি আছে? রাজা, রাজরাণী, পৌরজন, রূপনগরের প্রজাবর্গ আনন্দে মাতিয়া উঠিল। রাণী একলিঙ্গের পুজা-পাঠাইয়া দিলেন; রাজা এই সুযোগে কোন ভূম্যধিকারীর কোন্ কোন্ গ্রাম কাড়িয়া লইবেন তাহার ফর্দ করিতে লাগিলেন।
কেবল চঞ্চলকুমারীর সখীজন নিরানন্দ। তাহারা জানিত যে এ সম্বন্ধে মোগলদ্বেষিণী চঞ্চলকুমারীর সুখ নাই।