রাজসিংহ (১৮৮৫)/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।
এই ভুবনমোহিনী সুন্দরী, যারে দেখিয়া চিত্রবিক্রেত্রী প্রণাম করিল, রূপনগরের রাজার কন্যা চঞ্চলকুমারী। যাহারা এতক্ষণ বৃদ্ধাকে লইয়া রঙ্গ করিতেছিল, তাহারা তাঁহার সখীজন এবং দাসী। চঞ্চলকুমারী সেই ঘরে প্রবেশ করিয়া সেই রঙ্গ দেখিয়া নীরবে হাস্য করিতেছিলেন। এক্ষণে প্রাচীনকে মধুরস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কে গো?”
সখীগণ পরিচয় দিতে ব্যস্ত হইল। “উনি তসবীর বেচিতে আসিয়াছেন।”
চঞ্চলকুমারী বলিল, “তা তোমরা এত হাসিতেছিলে কেন?”
কেহ কেহ কিছু কিছু অপ্রতিভ হইল। যিনি সহচরীকে ঝাড়ুদারি রসিকতাটা করিয়াছিলেন তিনি বলিলেন,
“আমাদের দোষ কি? আয়ি বুড়ী যত সেকেলে বাদশাহের তসবীর আনিয়া দেখাইতেছিল—তাই আমরা হাসিতেছিলাম— আমাদের রাজা রাজড়ার ঘরে আক্বর বাদশাহ্ কি জাঁহাগীর বাদশাহের তসবীর কি নাই?”
“বৃদ্ধা কহিল ’থাক্বে না কেন মা? একখানা থাকিলে কি আর একখানা নিতে নাই? আপনারা নিবেন না, তবে আমরা কাঙ্গাল গরীব প্রতিপালন হইব কি প্রকারে?”
রাজকুমারী তখন প্রাচীনার তসবীর সকল দেখিতে চাহিলেন। প্রাচীনা একে একে তসবীরগুলি রাজকুমারীকে দেখাইতে লাগিল। আক্বর বাদশাহ্, জাঁহাগীর, শাহজাঁহা, নূরজাঁহা, নুরমহালের চিত্র দেখাইল। রাজকুমারী হাসিয়া হাসিয়া সকলগুলি ফিরাইয়া দিলেন—বলিলেন, “ইহারা আমাদের কুটুম্ব, ঘরে ঢের তসবীর আছে। হিন্দুরাজার তসবীর আছে?”
“অভাব কি?” বলিয়া প্রাচীনা, রাজা মানসিংহ, রাজা বীরবল, রাজা জয়সিংহ প্রভৃতির চিত্র দেখাইল। রাজপুত্রী তাহাও ফিরাইয়া দিলেন, বলিলেন, “এও লইব না। এ সকল হিন্দু নয়, ইহারা মুসলমানের চাকর।”
প্রাচীনা তখন হাসিয়া বলিল, “মা কে কার চাকর তা আমি ত জানি না। আমার যা আছে, দেখাই পসন্দ করিয়া লও।”
প্রাচীনা চিত্র দেখাইতে লাগিল। রাজকুমারী পসন্দ করিয়া রাণা প্রতাপ, রাণা অমরসিংহ, রাণা কর্ণ, যশোবন্ত সিংহ প্রভৃতি কয়খানি চিত্র ক্রয় করিলেন। একখানি বৃদ্ধা ঢাকিয়া রাখিল—দেখাইল না।
রাজকুমারী জিজ্ঞাসা করিলেন “ওখানি ঢাকিয়া রাখিলে, যে?” বৃদ্ধা কথা কহে না। রাজকুমারী পুনরপি জিজ্ঞাসা করিলেন।
বৃদ্ধা ভীতা হইয়া, করযোড়ে কহিল, “আমার অপরাধ লইবেন না—অসাবধানে ঘটিয়াছে—অন্য তসবীরের সঙ্গে আসিয়াছে।”
রাজকুমারী বলিলেন, “অত ভয় পাইতেছ কেন? এমন কাহার তসবীর যে দেখাইতে ভয় পাইতেছে?”
বুড়ী! দেখিয়া কাজ নাই। আপনার ঘরের দুষ্মনের ছবি।
রাজকুমারী। কার তসবীর?
বুড়ী। (সভয়ে)। রাণা রাজসিংহের।
রাজকুমারী হাসিয়া বলিলেন, “বীরপুরুষ স্ত্রীজাতির কখনও শত্রু নহে। আমি ও তসবীর লইব।”
তখন বৃদ্ধা রাজসিংহের চিত্র তাঁহর হস্তে দিল। চিত্র হাতে লইয়া রাজকুমারী অনেকক্ষণ ধরিয়া তাহা নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন; দেখিতে দেখিতে তাঁহার মুখ প্রফুল্ল হইল; লোচন বিস্ফারিত হইল। একজন সখী, তাঁহার ভাব দেখিয়া চিত্র দেখিতে চাহিল—রাজকুরামী তাহার হস্তে চিত্র দিয়া বলিলেন, “দেখ। দেখিবার যোগ্য বটে। বীবপুরুষের চেহারা।”
সখীগণের হাতে হাতে সে চিত্র ফিরিতে লাগিল। রাজসিংহ যুবাপুরুষ নহে—তথাপি তাঁহার চিত্র দেখিয়া সকলে প্রশংসা করিতে লাগিল।
বৃদ্ধা সুযোগ পাইয়া এই চিত্রখানিতে দ্বিগুণ মুনাফা করিল। তার পর লোভ পাইয়া বলিল,
“ঠাকুরাণি যদি বীরের তসবীর লইতে হয়, তবে আর একখানি দিতেছি। ইহার মত পৃথিবীতে বীর কে?”
এই বলিয়া বৃদ্ধা আর একখানি চিত্র বাহির করিয়া রাজপুত্ত্রীর হাতে দিলেন।
রাজকুমারী জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ কাহার চেহারা?
বৃদ্ধা। বাদশাহ আলমগীরের।
রাজকুমারী। কিনিব।
এই বলিয়া একজন পরিচারিকাকে রাজপুত্ত্রী ক্রীত চিত্রগুলির মূল্য আনিয়া বৃদ্ধাকে বিদায় করিয়া দিতে বলিলেন। পরিচারিকা মূল্য আনিতে গেল, ইত্যবসরে রাজপুত্ত্রী সখীগণকে বলিলেন,
“এসো একটু আমোদ করা যাক্।”
রঙ্গপ্রিয়া বয়স্যাগণ বলিল, “কি আমোদ বল! বল!”
রাজপুত্ত্রী বলিলেন, “আমি এই আলমগীর বাদশাহের চিত্রখানি মাটীতে রাখিতেছি। সবাই উহার মুখে এক একটি বাঁ পায়ের নাতি মার। কার নাতিতে উহার নাক ভাঙ্গে দেখি।”
ভয়ে সখীগণের মুখ শুকাইয়া গেল। একজন বলিল,
“অমন কথা মুখে আনিও না, কুমারীজী। কাক পক্ষীতে শুনিলেও রূপনগরের গড়ের একখানি পাতর থাকিবে না।”
হাসিয়া রাজপুত্ত্রী চিত্রখানি মাটীতে রাখিলেন,
“কে নাতি মারিবি মার।”
কেহ অগ্রসর হইল না। নির্ম্মল নাম্নী একজন বয়স্যা আসিয়া রাজকুমারীর মুখ টিপিয়া ধরিল। বলিল, “অমন কথা আর বলিও না।”
চঞ্চলকুমারী ধীরে ধীরে অলঙ্কারশোভিত, বামচরণখানি ঔরঙ্গজেবের চিত্রের উপরে সংস্থাপিত করিলেন—চিত্রের শোভা বুঝি বাড়িয়া গেল। চঞ্চলকুমারী একটু হেলিলেন—মড় মড় শব্দ হইল—ঔরঙ্গজেব পাদশাহের প্রতিমূর্ত্তি রাজপুত কুমারীর চরণতলে ভাঙ্গিয়া গেল।
“কি সর্ব্বনাশ! কি করিলে!” বলিয়া সখীগণ শিহরিল!
রাজপুতকুমারী হাসিয়া বলিলেন, “যেমন ছেলেরা পুতুল খেলিয়া সংসারের সাধ মিটায়, আমি তেমনি মোগল বাদশাহের মুখে নাতি মারার সাধ মিটাইলাম।” তার পর নির্ম্মলের মুখ চাহিয়া রলিলেন, “সখি নির্ম্মল! ছেলেদের সাধ মিটে; সময়ে তাহাদের সত্যের ঘর সংসার হয়। আমার কি সাধ মিটিবে না? আমি কি কখন জীবন্ত ঔরঙ্গজেবের মুখে এইরূপ—”
নির্ম্মল, রাজকুমারীর মুখ চাপিয়া ধরিলেন। কথাটা সমাপ্ত হইল না—কিন্তু সকলেই তাহার অর্থ বুঝিল। প্রাচীনার হৃদয় কম্পিত হইতে লাগিল—এমন প্রাণসংহারক কথাবার্ত্তা যেখানে হয়, সেখান হইতে কতক্ষণে নিষ্কৃতি পাইবে? এই সময়ে তাহার বিক্রীত তসবীরের মূল্য আসিয়া পৌঁছিল। প্রাপ্তিমাত্র প্রাচীনা উর্দ্ধশ্বাসে পলায়ন করিল।
সে ঘরের বাহিরে আসিলে, নির্ম্মল তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ছুটিয়া আসিল। আসিয়া, তাহার হাতে একটি মোহর দিয়া বলিল, “আয়িবুড়ী, দেখিও, যাহা শুনিলে, কাহারও সাক্ষাতে মুখে আনিও না। রাজকুমারীর মুখের আটক নাই—এখনও উহাঁর ছেলে বয়স।”
বুড়ী মোহরটি লইয়া বলিল, “তা এ কি আর বল্তে হয় মা। আমি তোমাদের দাসী—আমি কি আর এ সকল কথা মুখে আনি।”
নির্ম্মল সন্তুষ্ট হইয়া ফিরিয়া গেলেন।