রাজসিংহ (১৮৮৫)/প্রথম পরিচ্ছেদ
রাজসিংহ।
প্রথম পরিচ্ছেদ।
রাজস্থানের পার্ব্বত্যপ্রদেশে রূপনগর নামে একটী ক্ষুদ্র রাজ্য ছিল। রাজ্য ক্ষুদ্র হউক, বৃহৎ হউক, তার একটা রাজা থাকিবে। রূপনগরেরও রাজা ছিল। কিন্তু রাজ্য ক্ষুদ্র হইলে রাজার নামটি বৃহৎ হওয়ায় আপত্তি নাই—রূপনগরের রাজার নাম বিক্রমসিংহ। বিক্রমসিংহের আরও সবিশেষ পরিচয় আমরা এক্ষণে দিতে ইচ্ছুক নহি।
সম্প্রতি তাঁহার অন্তঃপুরমধ্যে প্রবেশ করিতে আমাদিগের ইচ্ছা। ক্ষুদ্র রাজ্য; ক্ষুদ্র রাজধানী; ক্ষুদ্র পুরী। তন্মধ্যে একটী ঘর বড় সুশোভিত। সাদা পাতরের মেঝ্যা; সাদা পাতরের প্রাচীর; তাহাতে বহুবিধ লতা পাতা, পশু পক্ষী এবং মনুষ্যমূর্ত্তি খোদিত। বড় পুরু গালিচা পাতা, তাহার উপর এক পাল স্ত্রীলোক, দশ জন কি পনর জন। নানা রঙের বস্ত্রের বাহার দিয়া বসিয়া, কেহ তাম্বূল চর্ব্বণ করিতেছে, কেহ আলবোলাতে তামাকু টানিতেছে—কাহারও নাকে বড় বড় মতিদার নথ দুলিতেছে, কাহারও কাণে হীরকজড়িত কর্ণভূষা দুলিতেছে। অধিকাংশই যুবতী; হাসি টিটকারির কিছু ঘটা পড়িয়া গিয়াছে—একটু রঙ্গ জমিয়া গিয়াছে।
যুবতীগণের হাসিবার কারণ, এক প্রাচীনা, কতকগুলি চিত্র বেচিতে আসিয়া তাঁহাদিগের হাতে পড়িয়াছিল। হস্তিদন্তনির্ম্মিত ফলকে লিখিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অপূর্ব্ব চিত্রগুলি; প্রাচীনা বিক্রয়াভিলাষে এক একখানি চিত্র বস্ত্রাবরণ মধ্য হইতে বাহির করিতেছিল; যুবতীগণ চিত্রিত ব্যক্তির পরিচয় জিজ্ঞাসা করিতেছিল।
প্রাচীনা প্রথম চিত্রখানি বাহির করিলে, এক কামিনী জিজ্ঞাসা করিল, “এ কাহার তসবীর আয়ি?”
প্রাচীনা বলিল, “এ সাহজঁহা বাদশাহের তসবীর।”
যুবতী বলিল, “দূর মাগি, এ দাড়ি যে আমি চিনি। এ আমার ঠাকুর দাদার দাড়ি।”
আর একজন বলিল, “সে কি লো? ঠাকুরদাদার নাম দিয়া ঢাকিস্ কেন? ও যে তোর বরের দাড়ি।” পরে আর সকলের দিকে ফিরিয়া রসবতী বলিল “ঐ দাড়িতে একদিন একটা বিছা লুকাইয়াছিল—সই আমার ঝাড় দিয়া সেই বিছাটা মারিল।“
তখন হাসির বড় একটা গোল পড়িয়া গেল। চিত্রবিক্রেত্রী তখন আর একখানা ছবি দেখাইল। বলিল এখানা জাহাঙ্গীর বাদশাহের ছবি।
দেখিয়া রসিকা যুবতী বলিল “ইহার দাম কত?”
প্রাচীনা বড় দাম হাকিল।
রসিকা পুনরপি জিজ্ঞাসা করিল, “এত গেল ছবির দাম। আসল মানুষটা নুরজাঁহা বেগম কতকে কিনিয়াছিল?”
তখন প্রাচীনাও একটু রসিকতা করিল; বলিল,
“বিনামূল্যে।”
রসিকা বলিল, “যদি আসলটার এই দশা, তবে নকলটা ঘরের কড়ি কিছু দিয়া আমাদিগকে দিয়া যাও!”
আবার একটা হাসির গোল পড়িয়া গেল। প্রাচীনা বিরক্ত হইয়া চিত্রগুলি ঢাকিল। বলিল, ‘হাসিতে মা তসবীর কেনা যায় না। রাজকুমারী আসুন তবে আমি তসবীর দেখাইব। আজ তাঁরই জন্য এ সকল আনিয়াছি।”
তখন সাতজন সাত দিক্ হইতে বলিল, “ওগো আমি রাজকুমারী! ও আয়ি বুড়ী আমি রাজকুমারী।” বৃদ্ধা ফাঁপরে পড়িয়া চারিদিকে চাহিতে লাগিল, আবার আর একটা হাসির গোল পড়িয়া গেল।
অকস্মাৎ হাসির ধূম কম পড়িয়া গেল— গোলমাল একটু থামিল—কেবল তাকাতাকি আঁচাআঁচি, এবং বৃষ্টির পর মন্দ বিদ্যুতের মত ওষ্ঠপ্রান্তে একটু ভাঙ্গা হাসি। চিত্রস্বামিনী ইহার কারণ সন্ধান করিবার জন্য পশ্চাৎ ফিরিয়া দেখিলেন তাঁহার পিছনে কে একখানি দেবীপ্রতিমা দাঁড় করাইয়া গিয়াছে!
বৃদ্ধা অনিমিক্ লোচনে সেই সর্ব্বশোভাময়ী ধবল প্রস্তর-নির্ম্মিতা প্রতিমা পানে চাহিয়া রহিল—কি সুন্দর! বুড়ী বয়সদোষে একটু চোখে খাট, তত পরিষ্কার দেখিতে পায় না—ডাহা না হইলে দেখিতে পাইত যে, এ শ্বেতপ্রস্তরের বর্ণ নহে; সাদা পাতর এত গোলাবি আভা মারে না। পাতর দূরে থাকুক কুসুমেও এ চারুবর্ণ পাওয়া যায় না। দেখিতে দেখিতে বৃদ্ধা দেখিল যে প্রতিমা মৃদু মৃদু হাসিতেছে। ও মা—পুতুল কি হাসে। বুড়ী তখন মনে মনে ভাবিতে লাগিল এ বুঝি পুতুল নয়—ঐ অতি দীর্ঘ, কৃষ্ণতার, চঞ্চল, সজল, বৃহচ্চক্ষুর্দ্বয় তাহার দিকে চাহিয়া হাসিতেছে।
বুড়ী অবাক্ হইল—এর ওর তার মুখপানে চাহিতে লাগিল—কিছু ভাবিয়া ঠিক পাইল না। বিকলচিত্ত রসিকা রমণী মণ্ডলীর মুখপানে চাহিয়া, বৃদ্ধা হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল,
“হা ঁগা তোমরা বল না গা?”
এক সুন্দরী হাসি রাখিতে পারিল না—রসের উৎস উছলিয়া উঠিল—হাসির ফোয়ারার মুখ আপনি ছুটিয়া গেল—যুবতী হাসিতে লুটাইয়া পড়িল। সে হাসি দেখিয়া বিস্ময়বিহ্বলা বুড়ী কাঁদিয়া ফেলিল।
তখন সেই প্রতিমা কথা কহিল। অতি মধুরস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “আয়ি, কাঁদিস্ কেন গো?”
তখন বুড়ী বুঝিল, যে এটা গড়া পুতুল নহে—আদত মানুষ—রাজমহিষী বা রাজকুমারী হইবে। বুড়ী তখন সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করিল। এ প্রণাম রাজকুলকে নহে—এ প্রণাম সৌন্দর্য্যকে। বুড়ী যে সৌন্দর্য্য দেখিল তাহা দেখিয়া প্রণত হইতে হয়।
আমি জানি রূপের গৌরব ঘরে ঘরে আছে। ইহাও জানি, অনেকে সেই রূপসীগণপদতলে গড়াগড়ি দিয়া থাকেন। কিন্তু সে প্রণাম রূপের পায়ে নহে। সে প্রণাম সম্বন্ধের পায়ে। “তুমি আমার গৃহিণী—অতএব তোমাকে আমি প্রণাম করি—আমাকে একমুঠা খাইতে দিও”—সে প্রণামের এই মন্ত্র। কিন্তু বুড়ীর প্রণাম সে দরের নহে। বুড়ী বুঝি অনন্ত সুন্দরের অনন্ত সৌন্দর্য্যের ছায়া দেখিল, তিনিই রূপ; তিনি গুণ। যেখানে সে অনন্ত রূপের ছায়া দেখা যায়, সেইখানেই মনুষ্যমস্তক আপনি প্রণত হয়। অতএব বুড়ী সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করিল।