রাজসিংহ (১৮৮৫)/ষোড়শ পরিচ্ছেদ
ষোড়শ পরিচ্ছেদ।
তখন “দীন! দীন!” শব্দে পঞ্চশত অশ্বারোহী কালান্তক যমের ন্যায় পর্ব্বতে আরোহণ করিল। পর্ব্বত অনুচ্চ ইহা পূর্ব্বেই কথিত হইয়াছে—শিখরদেশে উঠিতে তাহাদের বড় কাল- বিলম্ব হইল না। কিন্তু পর্ব্বতশিখরে উঠিয়া দেখিল যে, কেহ ত পর্ব্বতোপরে নাই। যে রন্ধ্রপথমধ্যে প্রবেশ করিয়া তিনি নিজে পরাভূত হইয়া ফিরিয়া আসিয়াছিলেন, এখন মবারক বুঝিলেন যে, সমুদায় দস্যু—মবারকের বিবেচনায় তাহারা রাজপুত দস্যুভিন্ন আর কিছুই নহে—সমুদার দস্যু সেই রন্ধ্র পথে আছে। তাহার দ্বিতীয় মুখ রোধ করিয়া তাহাদিগের বিনাশ সাধন করিবেন, মরারক এইরূপ মনে মনে স্থির করিলেন। হাসান আলি আর মুখে কামান পাতিয়া বসিয়া আছেন। এই ভাবিয়া, তিনি সেই রন্ধ্রের ধারে ধারে সৈন্য লইয়া চলিলেন। ক্রমে পথ প্রশস্ত হইয়া আসিল; তখন মবারক পাহাড়ের ধারে আসিয়া দেখিলেন—চল্লিশজনের অনধিক রাজপুত, শিবিকাসঙ্গে রুধিরাক্ত কলেবরে সেই পথে চলিতেছে। মবারক বুঝিলেন যে অবশ্য ইহারা নির্গমপথ জানে; ইহাদের উপর দৃষ্টি রাখিয়া ধীরে ধীরে চলিলে, রন্ধ্রদ্বারে উপস্থিত হইব। তাহা হইলে যেরূপ পথে রাজপুতেরা পর্ব্বত হইতে নামিয়াছিল সেইরূপ অন্য পথ দেখিতে পাইব। রাজপুতেরা যে আগে উপরে ছিল পরে নামিয়াছে তাহার সহস্র চিহ্ন দেখা যাইতেছিল। মবারক সেইরূপ করিতে লাগিলেন। কিছু পরে দেখিলেন, পাহাড় ঢালু হইয়া আসিতেছে, সম্মুখে নির্গমের পথ। মবারক অশ্ব সকল তীরবেগে চালাইয়া পর্ব্বততলে নামিয়া রন্ধ্রমুখ বন্ধ করিলেন। রাজপুতেরা রন্ধ্রের বাঁক ফিরিয়া যাইতেছিল— সুতরাং তাহারা আগে রন্ধ্রমুখে পৌঁছিতে পারিল না। মোগলেরা পথরোধ করিয়া রন্ধ্রমুখে কামান বসাইল; এবং আগতপ্রায় রাজপুতগণকে উপহাস করিবার জন্য তাহার বজ্রনাদ একবার শুনাইল—দীন! দীন! শব্দের সঙ্গে পর্ব্বতে পর্ব্বতে সেই ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হইল। শুনিয়া উত্তরস্বরূপ রন্ধ্রের অপর মুখে হাসান আলিও কামানের আওয়াজ করিলেন; আবার পর্ব্বতে পর্ব্বতে প্রতিধ্বনি বিকট ডাক ডাকিল। রাজপুতগণ শিহরিল— তাহাদের কামান ছিল না।
রাজসিংহ দেখিলেন, আর কোন মতেই রক্ষা নাই। তাঁহার সৈন্যের বিশগুণ সেনা, পথের দুই মুখ বন্ধ করিয়াছে— পথান্তর নাই—কেবল যমমন্দিরের পথ খোলা। রাজসিংহ স্থির করিলেন সেই পথেই যাইবেন। তখন সৈনিকগণকে একত্রিত করিয়া বলিতে লাগিলেন।
“ভাই বন্ধু, যে কেহ সঙ্গে থাক, আজি সরলান্তঃকরণে আমি তোমাদের কাছে ক্ষমা চাহিতেছি। আমারই দোষে এ বিপদ ঘটিয়াছে— পর্ব্বত হইতে নামিয়াই এ দোষ করিয়াছি। এখন এ গলির দুই মুখ বন্ধ— দুই মুখেই কামান শুনিতেছ! দুই মুখে আমাদের বিশগুণ মোগল দাঁড়াইয়া আছে—সন্দেহ, নাই। অতএব আমাদিগের বাঁচিবার ভরসা নাই। নাই——তাহাতেই বা ক্ষতি কি? রাজপুত হইয়া কে মরিতে কাতর? সকলেই মরিব—একজনও বাঁচিব না—কিন্তু মারিয়া মরিব। যে মরিবার আগে দুইজন মোগল না মারিয়া মরিবে—সে রাজপুত নহে—বিজাতক। রাজপুতেরা শুন। এ পথে ঘোড়া ছুটে না—সবাই ঘোড়া ছাড়িয়া দাও। এসো আমরা তরবারি হাতে লাফাইয়া গিয়া তোপের উপর পড়ি। তোপ ত আমাদেরই হইবে—তার পর দেখা যাইবে কত মোগল মারিয়া মরিতে পারি।”
তখন রাজপুগণ, অশ্ব হইতে লাফাইয়া পড়িয়া একত্র অসি নিষ্কোষিত করিয়া “মহারাণাকি জয়” বলিয়া দাঁড়াইল। তাহাদের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মুখকান্তি দেখিয়া রাজসিংহ বুঝিলেন যে, প্রাণরক্ষা না হউক—একটি রাজপুতও হটিবে না। সন্তুষ্টচিত্তে রাণা আজ্ঞা দিলেন,“দুই দুই করিয়া সারি দাও।” অশ্বপৃষ্ঠে সবে একে একে যাইতেছিল—পদব্রজে দুইয়ে দুইয়ে রাজপুত চলিল—রাণা সর্ব্বাগ্রে চলিলেন। আজ আসন্ন মৃত্যু দেখিয়া তিনি প্রফুল্লচিত্ত।
এমত সময়ে সহসা পর্ব্বতরন্ধ্র কম্পিত করিয়া, পর্ব্বতে প্রতিধ্বনি তুলিয়া, রাজপুতসেনা শব্দ করিল “মাতাজিকি জয়! কালীমায়িকি জয়!”
অত্যন্ত হর্ষসূচক ঘোর রব শুনিয়া রাজসিংহ পশ্চাৎ ফিরিয়া দেখিলেন ব্যাপার কি? দেখিলেন, দুই পার্শ্বে রাজপুতসেনা সারি দিয়াছে—মধ্যে বিশাললোচনা, সহাস্যবদনা, কোন দেবী আসিতেছে। হয় কোন দেবী মনুষ্যমূর্তি ধারণ করিয়াছে— নয় কোন মানবীকে বিধাতা দেবীর মূর্ত্তিতে গঠিয়াছেন। রাজপুতেরা মনে করিল, চিতোরাধিষ্ঠাত্রী রাজপুতকুলরক্ষিণী ভগবতী এ শঙ্কটে রাজপুতকে রক্ষা করিতে স্বয়ং রণে অবতীর্ণ হইয়াছেন। তাই তাহারা জয়ধ্বনি করিতেছিল।
রাজসিংহ দেখিলেন—এ ত মানবী, কিন্তু সামান্যা মানবী নহে। ডাকিয়া বলিলেন,
“দেখ, দোলা কোথায়?”
একজন পিছু হইতে বলিল, “দোলা এই দিকে আছে?”
রাণা বলিলেন, “দেখ, দোলা খালি কি না?”
সৈনিক বলিল, “দোলা খালি। কুমারী জী মহারাজের সাম্নে।”
চঞ্চলকুমারী তখন রাজসিংহকে প্রণাম করিলেন। রাণা জিজ্ঞাসা করিলেন,
“রাজকুমারি—আপনি এখানে কেন?”
চঞ্চল বলিলেন, “মহারাজ! আপনাকে প্রণাম করিতে আসিয়াছি। প্রণাম করিয়াছি—এখন একটি ভিক্ষা চাহি। আমি মুখরা—স্ত্রীলোকের শোভা যে লজ্জা তাহা আমাতে নাই, ক্ষমা করিবেন। ভিক্ষা যাহা চাহি—তাহাতে নৈরাশ করিবেন না।”
চঞ্চলকুমারী হাস্য ত্যাগ করিয়া, যোড়হাত করিয়া কাতর স্বরে এই কথা বলিলেন। রাজসিংহ বলিলেন,
“তোমারই জন্য এতদূর আসিয়াছি—তোমাকে অদেয় কিছুই নাই—কি চাও, রূপনগরের কনো?”
চঞ্চলকুমারী আবার যোড়হাত করিয়া বলিল, “আমি চঞ্চলমতি বালিকা বলিয়া আপনাকে আসিতে লিখিয়াছিলাম; কিন্তু আমি নিজের মন আপনি বুঝিতে পারি নাই। আমি এখন মোগলসম্রাটের ঐশ্বর্য্যের কথা শুনিয়া বড় মুগ্ধ হইয়াছি। আপনি অনুমতি করুন—আমি দিল্লী যাইব।”
রাজসিংহ বিস্মিত ও বিরক্ত হইলেন। বলিলেন, “তোমার দিল্লী যাইতে হয় যাও—আমার, আপত্তি নাই—স্ত্রীলোক চিরকাল অস্থিরচিত্ত। কিন্ত আপাততঃ তুমি যাইতে পাইবে না। যদি এখন তোমাকে ছাড়িয়া দিই, মোগল মনে করিবে যে প্রাণভয়ে ভীত হইয়া তোমাকে ছাড়িয়া দিলাম। আগে যুদ্ধ শেষ হউক—তার পর তুমি যাইও। যওয়ান্ সব—আগে চল।”
তখন চঞ্চলকুমারী মৃদু হাসিয়া মর্ম্মভেদী মৃদু কটাক্ষ করিয়া, দক্ষিণহস্তের কনিষ্ঠাঙ্গুলিস্থিত হীরকাঙ্গুরীয় বামহস্তের অঙ্গুলিদ্বয়ের দ্বারা ফিরাইয়া রাজসিংহকে দেখাইতে দেখাইতে বলিলেন, “মহারাজ! এই আঙ্গটিতে বিষ আছে। দিল্লীতে না যাইতে দিলে, আমি বিষ খাইব।”
রাজসিংহ তখন হাসিলেন—বলিলেন, “বুঝিয়াছি রাজকুমারী—রমণীকুলে তুমি ধন্যা! কিন্তু তুমি যাহা ভাবিছে তাহা হইবে না। আজ রাজপুতের বাঁচা হইবে না; আজি রাজপুতকে মরিতেই হইবে—নহিলে রাজপুতনামে বড় কলঙ্ক হইবে। আমরা যতক্ষণ না মরি—ততক্ষণ তুমি বন্দী। আমরা মরিলে তুমি যেখানে ইচ্ছা সেইখানে যাইও।”
চঞ্চলকুমারী হাসিল— অতিশর প্রণয় প্রফুল্ল ভক্তিপ্রমোদিত, সাক্ষাৎ মহাদেবের অনিবার্য্য এক কটাক্ষবাণ রাজসিংহের উপর ত্যাগ করিল। মনে মনে বলিতে লাগিল, “বীরচূড়ামণি! আজি হইতে আমি তোমার মহিষী হইলাম! যদি তোমার মহিষী না হই—তবে চঞ্চল কখনই প্রাণ রাখিবে না।” প্রকাশ্যে বলিল, “মহারাজ! দিল্লীশ্বর যাহাকে মহিষী করিতে অভিলাষ করিয়াছেন, সে কাহারও বন্দী নহে। এই আমি মোগল সৈন্যসম্মুখে চলিলাম—কাহার সাধ্য রাখে দেখি?”
এই বলিয়া চঞ্চলকুমারী—জীবন্ত দেবীমূর্তি, রাজসিংহকে পাশ করিয়া রন্ধ্রমুখে চলিল। তাঁহাকে স্পর্শ করে কাহার সাধ্য? এজন্য কেহ তাঁহার গতিরোধ করিতে পারিল না। হাসিতে হাসিতে, হেলিতে দুলিতে সেই স্বর্ণমুক্তাময়ী প্রতিমা রন্ধ্রমুখে চলিয়া গেল।
একাকিনী চঞ্চলকুমারী সেই প্রজ্জ্বলিত বহ্নিতুল্য রুষ্ট, সশস্ত্র পঞ্চশত মোগল অশ্বারোহীর সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইলেন। যেখানে সেই পথরোধকারী কামান—মনুষ্যনির্ম্মিত বজ্র, অগ্নি উদ্গীর্ণ করিবার জন্য হাঁ করিয়া আছে—তাহার সম্মুখে, রত্নমণ্ডিতা লোকাতীত সুন্দরী দাঁড়াইল। দেখিয়া বিস্মিত মোগলসেনা মনে করিল—পর্ব্বতনিবাসিনী পরি আসিয়াছে।
মনুষ্যভাষায় কথা কহিয়া চঞ্চলকুমারী সে ভ্রম ভাঙ্গিল।— বলিল “এ সেনার সেনাপতি কে?”
মবারক স্বয়ং রন্ধ্রমুখে রাজপুতগণের প্রতীক্ষা করিতেছিলেন—তিনি বলিলেন, “ইহারা এখন অধমের অধীন। আপনি কে?”
চঞ্চলকুমারী বলিলেন,
“আমি সামান্যা স্ত্রী। আপনার কাছে কিছু ভিক্ষা আছে—,যদি অন্তরালে শুনেন তবেই বলিতে পারি।”
মরারক বলিলেন, “তবে রন্ধ্রমধ্যে আগু হউন।” চঞ্চলকুমারী রন্ধ্রমধ্যে অগ্রসর হইলেন—মবারক পশ্চাৎ পশ্চাৎ গেলেন।
যেখানে কথা অন্যে শুনিতে পায় না এমতস্থানে আসিয়া চঞ্চলকুমারী বলিতে লাগিলেন,
“আমি রূপনগরের রাজকন্যা। বাদশাহ আমাকে বিবাহ করিবার অভিলাষে আমাকে লইতে এই সেনা পাঠাইয়াছেন—একথা বিশ্বাস করেন কি?”
মবারক। আপনাকে দেখিয়াই সে বিশ্বাস হয়।
চঞ্চল। আমি মোগলকে বিবাহ করিতে অনিচ্ছুক—ধর্ম্মে পতিত হইব মনে করি। কিন্তু পিতা ক্ষীণবল—তিনি আমাকে আপনাদিগের সঙ্গে পাঠাইয়াছেন। —তাঁহা হইতে কোন ভরসা নাই বলিয়া আমি রাজসিংহের কাছে দূত প্রেরণ করিয়াছিলাম—আমার কপালক্রমে তিনি পঞ্চাশজন মাত্র শিপাহী লইয়া আসিয়াছেন—তাঁহাদের বলবীর্য্য ত দেখিলেন?
মবারক চমকিয়া উঠিয়া বলিলেন, “সে কি—পঞ্চাশন শিপাহী এক সহস্র মোগল মরিল?”
চঞ্চল। বিচিত্র নহে— হলদীঘাটে ঐ রকম কি একটা হইয়াছিল শুনিয়াছি। কিন্তু সে যাহাই হউক—রাজসিংহ এক্ষণে আপনার নিকট পরাস্ত। তাঁহাকে পরাস্ত দেখিয়াই আমি আসিয়া ধরা দিতেছি। আমাকে দিল্লী লইয়া চলুন—যুদ্ধে আর প্রয়োজন নাই।
মবারক বলিল, “বুঝিয়াছি, নিজের সুখ বলি দিয়া, আপনি রাজপুতের প্রাণরক্ষা করিতে চাহেন। তাঁহাদেরও কি সেই ইচ্ছা?”
চ। সেও কি সম্ভবে? আমাকে আপনারা লইয়া চলিলেও তাহারা যুদ্ধ ছাড়িবে না। আমার অনুরোধ, আমার সঙ্গে একমত হইয়া আপনি তাহাদের প্রাণরক্ষা করুন।
ম। তাহা পারি। কিন্তু দস্যুর দণ্ড অবশ্য দিতে হইবে। আমি তাঁহাদের বন্দী করিব।
চ। সব পারিবেন—সেইটা পারিবেন না। তাঁহাঁগিকে প্রাণে মারিতে পারিবেন কিন্তু বাঁধিতে পারিবেন না। তাঁহারা সকলেই মরিতে স্থির প্রতিজ্ঞ হইয়াছেন— মরিবেন।
মবা। তাহা বিশ্বাস করি। কিন্তু আপনি দিল্লী যাইবেন ইহা স্থির?
চ। আপনাদিগের সঙ্গে আপাতত যাওয়াই স্থির। দিল্লী পর্য্যন্ত পৌঁছিব কি না সন্দেহ।
মবা। সে কি?
চ। আপনারা যুদ্ধ করিয়া মরিতে জানেন, আমরা স্ত্রীলোক, আমরা কি শুধু শুধু মরিতে জানি না?
মবা। আমাদের শত্রু আছে, তাই মরি। ভুবনে কি আপনার শত্রু আছে?
চ। আমি নিজে।—
ম। আমাদের শত্রুর অনেক প্রকার অস্ত্র আছে—আপনার?
চ। বিষ।
ম। কোথায় আছে?
বলিয়া মবারক চঞ্চলকুমারীর মুখপানে চাহিলেন। বুঝি অন্য কেহ হইলে তাহার মনে মনে হইত, নয়ন ছাড়া আার কোথাও বিষ আছে কি?” কিন্তু মবারক সে ইতর প্রকৃতির মনুষ্য ছিলেন না। তিনি রাজসিংহের ন্যায় যথার্থ বীরপুরুষ। তিনি বলিলেন,
“মা, আত্মঘাতিনী কেন হইবেন? আপনি যদি যাইতে না চাহেন তবে আমাদের সাধ্য কি আপনাকে লইয়া যাই? স্বয়ং দিল্লীশ্বর উপস্থিত থাকিলেও আপনার উপর বল প্রকাশ করিতে পারিতেন না—আমরা কোন ছার? আপনি নিশ্চিত থাকুন—কিন্তু এ রাজপুতেরা বাদসাহের সেনা আক্রমণ করিয়াছে—আমি মোগল সেনাপতি হইয়া কি প্রকারে উহাদের ক্ষমা করি?”
চ। ক্ষমা করিয়া কাজ নাই—যুদ্ধ করুন।
এই সময়ে রাজপুতগণ লইয়া রাজসিংহ সেইখানে উপস্থিত হইলেন—তখন চঞ্চলকুমারী বলিতে লাগিলেন, “যুদ্ধ করুন— রাজপুতের মেয়েরাও মরিতে জানে।”
মোগলসেনাগতির সঙ্গে লজ্জাহীনা চঞ্চল কি কথা কহিতেছে শুনিবার জন্য রাজসিংহ এই সময়ে চঞ্চলের পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইলেন। চঞ্চল তখন তাঁহার কাছে হাত পাতিয়া হাসিয়া বলিলেন, “মহারাজাধিরাজ! আপনার কোমরে যে তরবারি দুলিতেছে, রাজপ্রসাদ স্বরূপ দাসীকে উহা দিতে আজ্ঞা হউক!”
রাজসিংহ হাসিয়া বলিলেন, “বুঝিয়াছি তুমি সত্য সত্যই ভৈরবী।” এই বলিয়া রাজসিংহ কটি হইতে অসি নির্ম্মুক্ত করিয়া চঞ্চলকুমারীর হাতে দিলেন। চঞ্চল অসি ঘুরাইয়া মবারকের সম্মুখে তুলিয়া ধরিয়া বলিল,
“তবে যুদ্ধ করুন। রাজপুতেরা যুদ্ধ করিতে জানে। আর রাজপুতানার স্ত্রীলোকেরাও যুদ্ধ করিতে জানে। খাঁ সাহেব! আগে আমার সঙ্গে যুদ্ধ করুন। স্ত্রীহত্যা হইলে, আপনার বাদসাহের গৌরব বাড়িতে পারে।”
শুনিয়া, মোগল ঈষৎ হাসিল। চঞ্চলকুমারীর কথায় কোন উত্তর করিল না। কেবল রাজসিংহের মুখপানে চাহিয়া বলিল, “উদয়পুরের বীরেরা কত দিন হইতে স্ত্রীলোকের বাহুবলে রক্ষিত?”
রাজসিংহের দীপ্ত চক্ষু হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইল। তিনি বলিলেন, “যত দিন হইতে মোগল বাদশাহ অবলাদিগের উপর অত্যাচার আরম্ভ করিরাছেন, ততদিন হইতে রাজপুতকন্যাদিগের বাহুতে বল হইয়াছে।” তখন রাজসিংহ সিংহের ন্যায় গ্রীবাভঙ্গের সহিত, স্বজনবর্গের দিকে ফিরিয়া বলিলেন,“রাজপুতেরা বাগ্যুদ্ধে অপটু। বৃথা কালহরণে প্রয়োজন নাই—পীপিলিকার মত এই মোগলদিগকে মারিয়া ফেল।”
এতক্ষণ বর্ষণোন্মুখ মেঘের ন্যায় উভয় সৈন্য স্তম্ভিত হইয়া ছিল—প্রভুর আজ্ঞা ব্যতীত কেহই যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইতে পারিতেছিল না। এক্ষণে রাণার আজ্ঞা পাইয়া “মাতাজী কি জয়!” শব্দে রাজপুতেরা জলপ্রবাহবৎ মোগলসেনার উপরে পড়িল। এদিকে মবারকের আজ্ঞা পাইয়া, মোগলেরা “আল্লা—হো—আকবর!” শব্দ করিয়া তাহাদের প্রতিরোধ করিতে উদ্যত হইল। কিন্তু সহসাভয়সেউনাই নিষ্পন্দ হইয়া দাঁড়াইল! সেই রণক্ষেত্রে উভয়সেনার মধ্যে অসি উত্তোলন করিয়া—স্থিরমূর্ত্তি চঞ্চলকুমারী দাঁড়াইয়া— সরিতেছে না।
চঞ্চলকুমারী উচ্চৈঃস্বরে বলিতে লাগিলেন,
"যতক্ষণ না একপক্ষ নিবৃত্ত হয়—ততক্ষণ আমি এখান হইতে নড়িব না। অগ্রে আমাকে না মারিয়া কেহ অস্ত্র চালনা করিতে পারিবে না।”
রাজসিংহ রুষ্ট হইয়া বলিলেন,
“তোমার এ অকর্ত্তব্য। স্বহস্তে তুমি রাজপুতকুলে এই কলঙ্ক লেপিতেছ কেন? লোকে বলিবে, আজ স্ত্রীলোকের সাহায্যে রাজসিংহ প্রাণরক্ষা করিল।”
চ। মহারাজ! আপনাকে মরিতে কে নিষেধ করিতেছে? আমি কেবল আগে মরিতে চাহিতেছি। যে অনর্থের মূল— তাহার আগে মরিবার অধিকার আছে।
চঞ্চল নড়িল না—মোগলেরা বন্দুক উঠাইয়াছিল—নামাইল। মবারক চঞ্চলকুমারীর কার্য্য দেখিয়া মুগ্ধ হইলেন। তখন উভয় সেনাসমক্ষে মবারক ডাকিয়া বলিলেন, “মোগল বাদশাহ স্ত্রীলোকের সহিত যুদ্ধ করেন না— অতএব বলি আমরা এই সুন্দরীর নিকট পরাভব স্বীকার করিয়া যুদ্ধ ত্যাগ করিয়া যাই। রাণা রাজসিংহের সঙ্গে যুদ্ধে জয় পরাজয়ের মীমাংসা ভরসা করি, ক্ষেত্রান্তরে হইবে। আমি রাণাকে অনুরোধ করিয়া যাইতেছি, যে সেবার যেন স্ত্রীলোক সঙ্গে করিয়া না আইসেন।”
চঞ্চলকুমারী মবারকের জন্য চিন্তিত হইলেন। মবারক তখন তাঁহার নিকটে—অশ্বে আরোহণ করিতেছে মাত্র। চঞ্চলকুমারী তাঁহাকে বলিলেন, “সাহেব! আমাকে ফেলিয়া যাইতেছ কেন? আমাকে লইয়া যাইবার জন্য আপনাদের দিল্লীশ্বর পাঠাইয়া দিয়াছেন। আমাকে যদি না লইয়া যান, তবে বাদশাহ কি বলিবেন?”
মবারক বলিল, “বাদশাহের বড় আর একজন আছেন। উত্তর তাঁহার কাছে দিব।”
চঞ্চল। সে ত পরলোকে, কিন্তু ইহলোকে?
মবারক! মবারক আলি, ইহলোকে কাহাকেও ভয় না। ঈশ্বর আপনাকে কুশলে রাখুন—আমি বিদায় হইলাম।
এই বলিয়া মবারক অশ্বে আরোহণ করিলেন। তাঁহার সৈন্যকে ফিরিতে আদেশ করিতেছিলেন, এমত সময়ে পশ্চাতে একবারে সহস্র বন্দুকের শব্দ শুনিতে পাইলেন। একেবারে শত মোগল যোদ্ধা ধরাশায়ী হইল। মবারক দেখিলেন, ঘোর বিপদ—