রাজসিংহ (১৮৮৫)/সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
সপ্তদশ পরিচ্ছেদ।
মাণিকলাল পার্ব্বত্যপথ হইতে নির্গত হইয়াই ঘোড়া ছুটাইয়া একেবারে রূপনগরের গড়ে গিয়া উপস্থিত হইয়াছিলেন। রূপনগরের রাজার কিছু সিপাহী ছিল, তাহারা বেতনভোগী চাকর নহে; জমী করিত; ডাক হাঁক করিলে ঢাল, ঘাঁড়া, লাঠি, সোঁটা লইয়া আসিয়া উপস্থিত হইত; এবং সকলেরই এক একটি ঘোড়া ছিল। মোগলসেনা আসিলে রূপনগরের রাজা তাহাদিগকে ডাক হাঁক করিয়াছিলেন। প্রকাশ্যে তাহাদিগের ডাকিবার কারণ, মোগলসৈন্যের সম্মান ও খবরদারিতে তাহাদিগকে নিযুক্ত করা। গোপন অভিপ্রায় যদি মোগলসেনা হঠাৎ কোন উপদ্রব উপস্থিত করে তবে তাহার নিবারণ। ডাকিবামাত্র রাজদূতেরা ঢাল খাঁড়া, ঘোড়া লইয়া গড়ে উপস্থিত হইল—রাজা তাহাদিগকে, অস্ত্রাগার হইতে অস্ত্র দিয়া সাজাইলেন। তাহারা নানাবিধ পরিচর্য্যায় নিযুক্ত থাকিয়া মোগল সৈনিকদিগের সহিত হাস্য পরিহাস ও রঙ্গরসে কয়দিবস কাটাইল। তাহার পর ঐ দিবস প্রভাতে মোগলসেনা শিবির ভঙ্গ করিয়া রাজকুমারীকে লইয়া যাওয়াতে, রূপনগরের সৈনিকেরাও গৃহে প্রত্যাগমন করিতে আজ্ঞা পাইল। তখন তাহারা অশ্ব সজ্জিত করিল এবং অস্ত্র সকল রাজার অস্ত্রাগারে ফিরাইয়া দিবার জন্য লইয়া আসিল, রাজা স্বয়ং তাহাদিগকে একত্রিত করিয়া স্নেহসূচকবাক্যে বিদায় দিতেছিলেন, এমত সময়ে আঙ্গুলকাটা মাণিকলাল ঘর্ম্মাক্ত কলেবরে অশ্ব সহিত সেখানে উপস্থিত হইল।
মাণিকলালের সেই মোশগলসৈনিকের বেশ। একজন মোগলসৈনিক অতি ব্যস্ত হইয়া গড়ে ফিরিয়া আসিয়াছে, দেখিয়া সকলে বিস্মিত হইল। রাজা জিজ্ঞাসা করিলেন,
“কি সম্বাদ?”
মাণিকলাল অভিবাদন করিয়া বলিল, “মহারাজ, বড় গণ্ডগোল বাঁধিয়াছে, পাঁচহাজার দস্যু আগিয়া রাজকুমারীকে ঘেরিয়াছে। জুনাব হাসান আলি খাঁ বাহাদুর, আমাকে আপনার নিকট পাঠাইলেন—তিনি প্রাণপণে যুদ্ধ করিতেছেন, কিন্তু আর কিছু সৈন্য ব্যতীত রক্ষা পাইতে পারিবেন না। আপনার নিকট সৈন্য সাহায্য চাহিয়াছেন।”
রাজা ব্যস্ত হইয়া বলিলেন, “সৌভাগ্যক্রমে আমার সৈন্য সজ্জিতই আছে।” সৈনিকগণকে বলিলেন, “তোমাদের ঘোড়া তৈয়ার, হাতিয়ার হাতে! তোমরা সওয়ার হইয়া এখনই যুদ্ধে চল। আমি স্বয়ং তোমাদিগকে লইয়া যাইতেছি।”
মাণিকলাল বলিল, “যদি এ দাসের অপরাধ মাপ হয়, তবে আমি নিবেদন করি যে, ইহাদিগকে লইয়া আমি অগ্রসর হই। মহারাজ যার কিছু সেনা সংগ্রহ করিয়া লইয়া আসুন। দস্যুরা সংখ্যায় প্রায় পাঁচহাজার। আরও কিছু সেনাবল ব্যতীত মঙ্গলের সম্ভাবনা নাই।”
স্থূলবুদ্ধি রাজা তাহাতেই সম্মত হইলেন। সহস্র সৈনিক লইয়া মাণিকলাল অগ্রসর হইল; রাজা আরও সৈন্যসংগ্রহের চেষ্টার গড়ে রহিলেন। মাণিক সেই রূপনগরের সেনা লইয়া যুদ্ধক্ষেত্রাভিমুখে চলিল।
পথে যাইতে যাইতে মাণিকলাল একটি ছোট রকম লাভ করিয়া চলিল। পথের ধারে একটি বৃক্ষের ছায়ায় একটি স্ত্রীলোক পড়িয়া আছে—বোধ হয় যেন পীড়িতা। অশ্বারোহী সৈন্য প্রধাধিত দেখিয়া সে উঠিয়া বসিল—দাঁড়াইবার চেষ্টা করিল—বোধ হয় পলাইবার ইচ্ছা, কিন্তু পারিল না। বল নাই। ইহা দেখিয়া মাণিকলাল ঘোড়া হইতে নামিয়া তাহার নিকটে গেল। গিয়া দেখিল, স্ত্রীলোকটি অতিশয় সুন্দরী। জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কে গা এখানে এ প্রকারে পড়িয়া আছ?”
যুবতী জিজ্ঞাসা করিল, “আপনারা কাহার ফৌজ?”
মাণিকলাল বলিল, “আমি রাণা রাজসিংহের ভৃত্য।”
যুবতী বলিল, “আমি রূপনগরের রাজকুমারীর দাসী।”
মাণিক। তবে এখানে এ অবস্থায় কেন?
যুবতী। রাজকুমারীকে দিল্লী লইয়া যাইতেছে। আমি সঙ্গে যাইতে চাহিয়াছিলাম, কিন্তু তিনি আমাকে সঙ্গে লইয়া যাইতে রাজি হয়েন নাই। ফেলিয়া আসিয়াছেন। আমি তাই হাঁটিয়া তাঁহার কাছে যাইতেছিলাম!
মাণিকলাল বলিল, “তাই পথভ্রান্ত হইয়া পড়িয়া আছ?”
নির্ম্মল কুমারী বলিল, “অনেক পথ হাঁটিয়াছি—আর পারিতেছি না।”
পথ এমন বেশী নয়—তবে নির্ম্মল কখন পথ হাঁটে নাই তার পক্ষে অনেক বটে।
মাণিক। তবে এখন কি করিবে?
নির্ম্মল। কি করিব—এইখানে মরিব।
মাণিক। ছি। মরিবে কেন? রাজকুমারীর কাছে চল না কেন?
নি। যাইব কি প্রকারে? হাঁটিতে পারিতেছি না, দেখিতেছ না।
মাণিক। কেন ঘোড়ায় চল না?
নির্ম্মল হাসিল। বলিল, “ঘোড়ায়?”
মাণিক। ঘোড়ায়। ক্ষতি কি?
নির্ম্মল। আমি কি শিপাহী?
মাণিক। হও না।
নির্ম্মল। আপত্তি নাই। তবে একটা প্রতিবন্ধক আছে— ঘোড়ায় চড়িতে জানি না।
মাণিক। তার জন্য কি আটকায়। আমার ঘোড়ার চড় না?
নি। তোমার ঘোঁড়া কলের? না মাটীর?
মাণিক। আমি ধরিয়া থাকিব।
নির্ম্মল, লজ্জারহিতা হইয়া রসিকতা করিতেছিল—এবার মুখ ফিরাইল। তারপর ভ্রূকুটি করিল; রাগ করিয়া বলিল, “আপনি আপনার কাজে যান, আমি আমার গাছতলায় পড়িয়া থাকি। রাজকুমারীর সঙ্গে সাক্ষাতে আমার কাজ নাই।” মাণিকলায় দেখিল মেয়েটা বড় সুন্দরী। লোভ সামলাইতে পারিল না। বলিল,
“হাঁ গা! তোমার বিবাহ হইয়াছে?”
রহস্যপরায়ণা নির্ম্মল মাণিকলালের রকম দেখিয়া হাসিল। বলিল, “না।”
মাণিকলাল। তুমি কি জাতি?
নি। আমি রাজপুতের মেয়ে।
মাণিক। আমিও রাজপুতের ছেলে। আমারও স্ত্রী নাই আমার একটি ছোট মেয়ে আছে, তার একটি মা খুঁজি। তুমি তার মা হইবে? আমায় বিবাহ করিবে? তা হইলে আমার সঙ্গে একত্র ঘোচায় চড়ায় কোন আপত্তি হয় না।
নি। শপথ কর।
মাণিক। কি শপথ করিব?
নি। তরবার ছুঁইয়া শপথ কর যে আমাকে বিবাহ করিবে।
মাণিকলাল তরবারি স্পর্শ করিয়া শপথ করিল যে, “যদি আজিকার যুদ্ধে বাঁচি, তবে তোমাকে বিবাহ করিব।”
নির্ম্মল বলিল, “তবে চল ঘোড়ায় চড়ি।”
মাণিকলাল তখন সহর্ষ চিত্তে নির্ম্মলকে অশ্বপৃষ্ঠে উঠাইয় সাবধানে তাহাকে ধরিয়া অশ্বচালনা করিতে লাগিল।
বোধ হয় কোর্টশিপটা পাঠকের বড় ভাল লাগিল না। আর কি করিব? ভালবাসাবাসির কথা একটাও নাই—বহুকাল সঞ্চিত প্রণয়ের কথা কিছু নাই—“হে প্রাণ।” “হে প্রাণাধিক।” সে সব কিছুই নাই— ধিক্!