রাজা সাহেব/চতুর্থ পরিচ্ছেদ
চতুর্থ পরিচ্ছেদ।
নূতন রাজ-পরিচয়।
মুক্তা ক্রয়ের গেলযােগ মিটিয়া যাইবার দুইদিবস পরে ভগবান দাস একাকী আসিয়া পুনরায় সেক্রেটারী বাবুর সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। ভগবান দাসকে দেখিয়াই সেক্রেটারী বাবু, সবিশেষ সন্তুষ্ট হইলেন, এবং তাহাকে সেইস্থানে বসিতে আসন দিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন মহাশয়! শারীরিক ভাল আছেন ত?”
ভগবান। আমার শরীরটা নিতান্ত ভাল নাই; এই নিমিত্তই মহাশয়ের নিকট আসিতে দুইদিবস বিলম্ব হইয়াছে। কিন্তু আমি আপনার নিকট আসিতে পারি নাই বলিয়া যে আপনার কোন কার্য্য করি নাই, তাহা নহে। আমি একজন বিশিষ্ট ধনী মহাজন স্থির করিয়াছি। কোন ব্যক্তি, কি বন্ধুকে, কত টাকা কর্জ্জ লইবেন, তাহার সবিশেষ বিবরণ অবগত হইতে পারিলেই এখন সমস্ত স্থির করিয়া ফেলিতে পারি।
বাবু। আমিও মনে মনে তাহাই ভাবিয়াছিলাম। ভাবিয়াছিলাম যে, আপনার আসিতে যখন বিলম্ব হইতেছে, তখন নিশ্চয়ই আপনি একটা কিছু স্থির করিয়াই আসিবেন। সে যাহা হউক, কোন ব্যক্তি টাকা ধার করিবেন, এবং কিরূপে ধার করিতে চাহেন, তাহা আপনি এখনই জানিতে চাহেন কি?
ভগবান। সেই নিমিত্তই আমি আজ আপনার নিকট আগমন করিয়াছি। কারণ, ওদিকে আমি যে প্রকার স্থির করিয়া আসিয়াছি, তাহাতে বোধ হয় যে, আপনার কার্য্য শীঘ্রই শেষ করিয়া দিব।
বাবু। কার্য্য যত শীঘ্র শেষ করিতে পারেন, ততই ভাল। কারণ, কেবলমাত্র সেই কার্য়্যর নিমিত্তই আমাকে খরচপত্র করিয়া কলিকাতায় অবস্থান করিতে হইতেছে। যে অর্থ কর্জ্জ লইবার কথা হইতেছে, তাহা আমি নিজে গ্রহণ করিব না, আমার মনিব উহা গ্রহণ করিবেন।
ভগবান। আপনার মনিব কে?
বাবু। আমার মনিব একজন নিতান্ত সামান্য ব্যক্তি নহেন জানিবেন। তিনি ** নামক স্থানের স্বাধীন রাজা। তাহার নাম ***।
ভগবান। আপনি যে স্থানের কথার উল্লেখ করিলেন, আমি পূর্বে সেইস্থানের নাম শুনিয়াছি। সেইস্থানের রাজা প্রকৃতই স্বাধীন। তিনি তাঁহার রাজত্বে আপনার প্রণীত আইন চালান। নিজের ইচ্ছামত দোষী ব্যক্তিকে ফাঁসী দেন, ইহাতে ইংরাজ পর্য্যন্ত কথাটা কহেন না। তিনি টাকা কর্জ্জ করিবেন! এরূপ লোকের টাকা কর্জ্জ করিতে আর কোনরূপ কষ্টই হইবে না। যিনি অবগত হইতে পারিবেন, তিনিই উঁহাকে টাকা ধার দিবেন। তাঁহার কত টাকা লইবার প্রয়োজন? বাবু। কম সুদে পাইলে, আপাততঃ তিন লক্ষ টাকা হইলেই চলিতে পারিবে।
ভগবান। কম সুদ, আপনি কত পর্য্যন্ত সুদ দিতে সম্মত আছেন?
বাবু। শত করা বাৎসরিক ছয় টাকার অধিক দিতে পারিব না। ইহা অপেক্ষা যত কম হয়, ততই ভাল। ভগবান। যদি আমি পাঁচ টাকায় করিয়া দিতে পারি? বাবু।
তাহা হইলে ত উত্তমই হয়।
ভগবান। কি বন্ধক দিয়া তিনি এই টাকা গ্রহণ করিতে চাহেন?
বাবু। আবশ্যক হইলে তাঁহার রাজত্ব পর্যন্ত বন্ধক দিতে তিনি প্রস্তুত আছেন।
এই কয়েকটী কথাবার্তার পর ভগবান দাস সেইদিবস চলিয়া গেলেন। যাইবার সময় বলিয়া গেলেন যে, কথাবার্তা স্থির করিয়া পরদিবস তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিবেন।
ভগবান দাস চলিয়া যাওয়ার পর সেক্রেটারী বাবু মনে মনে বলিতে লাগিলেন যে, এ ব্যক্তি নামেও ভগবান, কাজেও ভগবান। টাকা ধার করিবার কথা ইতিপূর্ব্বে কত লোককে বলিয়াছি; কিন্তু কেহই তাহার কোনরূপ সংগ্রহ করিয়া উঠিতে পারেন নাই। পরন্তু ইহার নিকট প্রস্তাব করিতে না করিতেই এ সমস্ত ঠিক করিয়া ফেলিল। আবার সেই টাকা পাওয়া -যাইতেছে-তাহাও অল্প সুদে। এখন আমার নিশ্চয়ই বোধ হইতেছে যে, ভগবান দাস কর্তৃক আমার সমস্ত টাকা সংগৃহীত হইবে। ভগবান দাস যেরূপ বলিয়া গিয়াছিলেন, পরদিবস ঠিক সেই সময় আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং বাকুকে কহিলেন, “আমি সমস্তই প্রায় ঠিক করিয়া আসিয়াছি। এখন আপনি দেখিয়া শুনিয়া সমস্ত ঠিক করিয়া লউন। এই আমার নিবেদন।”
বাবু। তোমার কথায় আমি অতিশয় সন্তুষ্ট হইলাম। কোন্ ব্যক্তি টাকা দিতে প্রস্তুত আছেন, তাহার নাম জানিতে পারি কি?
ভগবান। যিনি ঋণ গ্রহণ করিবেন, তিনি যেরূপ উচ্চ পদস্থ ব্যক্তি, যাঁহার নিকট হইতে ঋণ গ্রহণ করা যাইবে, তিনিও সেই প্রকার উচ্চ পদস্থ ব্যক্তি। ইনিও একজন রাজা। সম্প্রতি কোন কার্য্য-বশতঃ কলিকাতায় আগমন করিয়াছেন, এবং আরও কিছুদিবস এইস্থানে অবস্থিতি করিবেন। আমি আপনাকে সঙ্গে করিয়া তাহার দরবারে লইয়া যাইতেছি, তাহা হইলেই আপনি বুঝিতে পারিবেন, আমার কথা প্রকৃত কি না। আমি দালালী ব্যবসা দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করি সত্য; কিন্তু যিনি যেরূপ পদস্থ, তাঁহাকে সেইরূপে সেইস্থানেই লইয়া গিয়া থাকি।
বাবু। আমাকে কোন্ সময়ে সেই রাজ-দরবারে গমন করিতে হইবে? ভগবান। আপনি এখনই চলুন, আমি এখনই আপনাকে লইয়া গিয়া মন্ত্রী মম্ভাশয়ের সহিত আলাপ পরিচয় করিয়া দি। আপনি রাজ-কর্ম্মচারী; সুতরাং রাজগণের কার্যপ্রণালী আপনি উত্তমরূপেই অবগত আছেন। এতদ্দেশীয় রাজামাত্রই প্রায় নামে। রাজকর্য়্যদি যাহা কিছু সমস্তই মন্ত্রী বা সেই প্রকার উচ্চপদস্থ কর্মচারীর হস্তে।
বাবু। রাজগণের কার্য আমি উত্তমরূপেই অবগত আছি, তা। আর তোমাকে বলিয়া দিতে হইবে না। এখন কোন সময়ে তুমি আমাকে মন্ত্রী মহাশয়ের নিকট লইয়া যাইরে, তাহাই বল।
ভগবান। আপনি প্রস্তুত হইয়া আসুন, এখনই আমি আপনাকে সঙ্গে লইয়া মন্ত্রী মহাশয়ের সহিত আলাপ পরিচয় করাইয়া দিব। - ভগবান দাসের কথা শ্রবণ করিয়া সেক্রেটারী বাবুও আর কালবিলম্ব করিলেন না। নিয়মিত সজ্জায় সুসজ্জিত হইয়া তখনই তাহার সহিত আপন বাসা পরিত্যাগ করিলেন। এখানে বাবুর নিজের গাড়ী ঘোড়া প্রভৃতি কিছুই ছিল না; সুতরাং ভাড়াটিয়া গাড়ীতেই বাবুকে রাজবাড়ী গমন করিতে হইল বলিয়া, মনে মনে যেন একটু লজ্জিত হইলেন। ভগবান দাসের নির্দেশ-মত এ গলি ও গলি দিয়া গাড়ী ক্রমে গমন করিতে করিতে অর্ধঘণ্টার মধ্যেই একখালি বাড়ীর সম্মুখে গিয়া উপস্থিত হইল। সেই স্থানে উপস্থিত হইবামাত্র ভগবান দাস কহিলেন, “রাজা মহাশয় এই বাড়ীতেই অবস্থিতি করেন।”
ভগবান দাসের কথা শ্রবণ করিয়া সেইস্থানে সেক্রেটারী বাবু গাড়ী হইতে অবতরণ করিয়া, ভগবান সে পশ্চাৎ পশ্চাৎ সেই বাড়ী ভিতর প্রবেশ করিলেন। কোচমনি খালি গাড়ী ঘুরাইয়া লইয়ায় একপার্শ্বে রাখিয়া দিল। যে বাড়ীর ভিতর সেক্রেটারী বাবু ভগবান দাসের সহিত প্রবেশ করিলেন, সেই বাড়ীর অবস্থা পাঠকবর্গের এইস্থানে একটু জানা আবশ্যক। যে দ্বার দিয়া তাহারা বাড়ীর ভিতর প্রবিষ্ট হইলেন, সেই দ্বারে দুইজন প্রহরী সিপাহীর সাজে সজ্জিত হইয়া সেঙ্গিয়ান বন্দুক লইয়া পাহারায় নিযুক্ত আছে। তাহাদিগের পোষাক এবং চাকচিক্যময় সেঙ্গিয়ান বন্দুকের অবস্থা দেখিয়া বাবুর মনে মনে একটু ভয় হইল। তিনি একটু ইতস্ততঃ করিয়া ভগবান দাসের সঙ্গে সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলেন। সিপাহীদ্বয় বাবুকে একবার আপদ-মস্তক দর্শন করিল মাত্র, কিন্তু কিছু বলল না। তাহাদিগের ভাব-ভঙ্গীতে বোধ হইল, যেন ইহারা সহজে বাবুকে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে দিত না; কেবল ভগবান দাসের সহিত যাইতেছেন বলিয়া কোন কথা কহিল না।
দ্বার অতিক্রম করিলেই বিস্তৃত প্রাঙ্গণ, তাহার মধ্যে মনোহর পুষ্পেদ্যান। এই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পুষ্পোদ্যানের ভিতর দিয়া কিছুদুর গমন করিলে, একটা দ্বিতল বাটীতে উপনীত হওয়া যায়। সেই বাটী দেখিলে বোধ হয় যে, অতি অল্প দিবস হইল, উহা উত্তমরূপে মেরামত হইয়া মনোহর সঙ্গে রঞ্জিত হইয়াছে। ভগবান দাসের সহিত সেক্রেটারী বাবু সেই পুষ্পেদানের মধ্য দিয়া সেই দ্বিতল বাড়ী অভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। পথিমধ্যে কেবল মাত্র দুইজন উড়িয়া মালির সহিত সাক্ষাৎ হইল। তাহারা উঁহাদিগের দিকে লক্ষ্যই করিল না। বোধ হইল, ইহারা আপন কার্য্যেই ব্যস্ত। সেই সুবিস্তৃত প্রাঙ্গণের মধ্যস্থিত পুষ্পেদ্যান অতিক্রম করিয়া ক্রমে ক্রমে তাঁহারা সেই দ্বিতল গৃহের সন্নিকটে গিয়া উপনীত হইলেন। সেইস্থানে কেবলমাত্র একজন চাপরাশীর সহিত উহাদিগের সাক্ষাৎ হইল। ভগবান দাস সেই চাপরাশীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মন্ত্রী মহাশয় আসিয়াছেন কি?” উত্তরে চাপরাশী কহিল, “না,—মন্ত্রী মহাশয় এখনও আগমন করেন নাই। তাঁহার আগমন করিবার সময় হইয়াছে, এখনই তিনি আগমন করিবেন। দাওয়ানজী মহাশয় প্রভৃতি অন্যান্য কর্মচারীগণ প্রায় সকলেই রাজ-দরবারে উপস্থিত আছেন। আপনারাও সেইস্থানে গমন করুন।”
চাপরাশীর এই কথা শুনিয়া সম্মুখবর্ত্তী সোপান দিয়া ভগবান দাস উপরে আরোহণ করিলেন। সেক্রেটারী বাবুও তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ উপরে গমন করিলেন। উপরে আরোহণ করিয়াই সম্মুখবর্ত্তী একটি প্রশস্ত গৃহের ভিতর উভয়েই প্রবেশ করিলেন। এই গৃহটা যেমন দীর্ঘ, তেমনি প্রশস্ত, এবং একখানি উৎকৃষ্ট কার্পেট দ্বারা উহার মেজে আবৃত। সেই কার্পেটের বা গৃহের মধ্যস্থলের কিয়দংশ স্থানে অতি উৎকৃষ্ট কিংখাপের চাদর পাতা, তাহার উপর সেইরূপ কিংখাপেয় কয়েকটী তাকিয়া বা সুন্দর উপাদান। দেখিলে বোধ হয়, রাজা বাহাদুর যখন এই দরবারে আগমন করেন, তখন সেই সুসজ্জিত সুপরিষ্কৃত স্থানেই উপবেশন করেন। এই গৃহে চতুম্পার্শ্বস্থ মধ্যবর্তী দেওয়াল নয়ন-মনোরম-বর্ণে সুরঞ্জিত ও শিল্পীদ্বারা নানাবর্ণে অতি উৎকৃষ্টরূপে চিত্রিত। মধ্যে মধ্যে, এক একখানি উৎকৃষ্ট অয়েল পেনটিং বড় বড় প্রতিকৃতি সেই দেওয়ালের আরও শোভা বৃদ্ধি করিতেছে।
এই গৃহের মধ্যে তিন চারিজন বেশ পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন বস্ত্রাদি পরিধান করিয়া উপবিষ্ট আছেন। তাঁহাদিগকে দেখিলে বোধ হয় যে, একান্ত মনোযোগিতার সহিত তাহারা আপন আপন কার্যে নিযুক্ত আছেন।
ভগবান দাস সেক্রেটারী বাবুর সহিত সেই গৃহের ভিতর প্রবিষ্ট হইবামাত্র উপবেশনকারী ব্যক্তিগণের মধ্য হইতে এক ব্যক্তি কহিলেন, “কেও, ভগবান দাস! কখন আগমন করিলে, সমস্ত মঙ্গল ত? এই বাবুটী কে?
উত্তরে ভগবান দাস কহিলেন, “আমরা এখনই আগমন করিতেছি। আর যে স্বাধীন রাজার কর্মচারীর কথা আমি আপনাদিগকে বলিয়াছিলাম, “ইনি সেই কর্মচারী। রাজা মহাশয়ের সহিত সমস্ত বিষয় স্থির করিবার নিমিত্ত আমি ইহাকে সঙ্গে করিয়া এইস্থানে আনিয়াছি।
ভগবান দাসের কথা শ্রবণ করিবামাত্র পুনরায় তিনি বাবুর প্রতি লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, “আসুন মহাশয়! এইদিকে আসুন। আপনার সহিত পরিচয় হওয়ায় অদ্য যে কি পরিমাণে সুখী হইলাম, তাহা বলিতে পারি না।” এই বলিয়া তিনি গাত্রোখান করিয়া সেক্রেটারী বাবুর হস্ত ধরিয়া আপনার বসিবার স্থানে লইয়া গেলেন, ও আপনার সন্নিকটে বসাইলেন। এই সময়ে ভগবান দাস বলিয়া দিলেন, “দাওয়ানজী মহাশয় আপনাকে যে সকল কথা জিজ্ঞাসা করেন, তাহার যথাযথ উত্তর প্রদান করিবেন। কারণ, আপনি যে কার্য্যের নিমিত্ত আগমন করিয়াছেন, সেই কার্য্য সম্পন্ন হইবার মুলই ইনি। তাহার পর মন্ত্রী মহাশয়, এবং সর্বশেষে রাজা মহাশয়।” এই বলিয়া ভগবান দাসও সেইস্থানে উপবেশন করিলেন। সেক্রেটারী বাবু দাওয়ানজী মহাশয়ের নিকট উপবেশন করিলে দাওয়ানজী মহাশয় তাহাকে কহিলেন, “আমরা আপনার সবিশেষ পরিচয় এ পর্যন্ত প্রাপ্ত হই। নাই। কেবল এইমাত্র জানিতে পারিয়াছি যে, আপনি ** রাজ্যের একজন প্রধান কর্মচারী। যদি আত্মপরিচয় প্রদানে আপনার কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতা না থাকে, তাহা হইলে আমাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিলে সবিশেষ সুখী হইব।”
বাবু। আমার বাসস্থান ঢাকা জেলার অন্তর্গত * * গ্রামে। কিন্তু বহুদিবস হইতে রাজ-সরকারে কর্ম করিতেছি, এই নিমিত্ত এখন সেইস্থানেই একরূপ বাসস্থান হইয়াছে।
দাওয়ান। রাজ-সরকারে আপনি কি কার্য্যে নিযুক্ত আছেন?
বাবু। আমি রাজার এসিষ্টেণ্ট সেক্রেটারী। রাজ্যের প্রায় সমস্ত কার্যের উপর আমায় লক্ষ্য রাখিতে হয়।
দাওয়ান। আপনার উপর আর কয়জন কর্মচারী আছেন? বাবু। একজন। সেক্রেটারী আমার উর্দ্ধতন-কর্মচারী।
দাওয়ান। যাহা হউক, মহাশয় একজন বড়লোক। মহাশয়ের সহিত অদ্য বিশেষরূপে পরিচয় হওয়ায় যে কি পর্যন্ত আনন্দিত হইলাম, তাহা বলিতে পারি না। যে কার্য্যের নিমিত্ত মহাশয়ের এইস্থানে শুভাগমন হইয়াছে, তাহা অনায়াসেই হইয়া যাইবে। মন্ত্রী মহাশয় আগমন করিলে তাঁহার সহিত আপনার পরিচয় আমি করাইয়া দিব, এবং যাহাতে আপনার কার্য্য শীঘ্র শীঘ্র সম্পন্ন হয়, তাহারও বন্দোবস্ত করিয়া দিব।
বাবু। আপনার অনুগ্রহ। এখন আমি আপনার নিকট আগমন করিয়াছি,—আপনার যাহা ভাল বিবেচনা হয়, তাহাই করিবেন।
এসিষ্টেণ্ট সেক্রেটারী ও দাওয়ানজী মহাশয়ের মধ্যে এইরূপ কথাবার্তা হইতেছে, এমন সময় একজন চাপরাশী আসিয়া সংবাদ প্রদান করিল যে, মন্ত্রী মহাশয় আসিতেছেন। এই সংবাদ পাইবামাত্র সকলেই উঠিয়া দাড়াইলেন, দেখিতে দেখিতে মন্ত্রী মহাশয় গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া আপন স্থানে উপবেশন করিলেন। মন্ত্রী মহাশয়ের অভ্যর্থনার নিমিত্ত যখন সকলেই গাত্রোত্থান করিয়া দণ্ডায়মান হইলেন, তখন এসিষ্টেণ্ট সেক্রেটারী বাবুও দাঁড়াইলেন, এবং সকলে যখন উপবেশন করিলেন, তখন তিনিও সেই সময় উপবেশন করিলেন। উপবেশনকালীন মন্ত্রী মহাশয় দাওয়ানজীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ বাবুটা কে? ইহাকে ত আমি চিনিতে পারিলাম না।”
দাওয়ান। ইহাকে আপনি পূর্বে কখনও দেখেন নাই, এই নিমিত্ত চিনিতে পারিতেছেন না। যে স্বাধীন রাজ্যের রাজ-কর্মচারীর কথা পুর্বে আপনাকে বলা হইয়াছিল, ইনিই সেই রাজ-কর্মচারী। ইনি একজন সামান্য কর্মচারী, নহেন, ইনি মহারাজের এসিষ্টেণ্ট সেক্রেটারী। এক কথায়, রাজকার্যের সমস্ত ভাই ইহার উপর। অত বড় স্বাধীন রাজ্যের সমস্ত কর্ম্মই ইহাকে নির্বাহ করিতে হয়। এদিকে চাকা জেলার সম্ভ্রান্ত কায়স্থ বংশে ইহার জন্ম।
বাবুর পরিচয় পাইয়া দুই চারিটী মিষ্টকথায় তাহাকে সন্তুষ্ট করিয়া তাহাকে সেইস্থানে বসিতে কহিলেন, এবং রাজাকে বলিয়া তাঁহার কার্য্য যত শীঘ্র পারেন, সম্পন্ন করিয়া দিবেন বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিলেন। সেই সময়ে আরও তিন চারি জন লোক সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলেন। দাওয়ানজী মহাশয় ও মন্ত্রী মহাশয় উভয়েই তাহাদিগকে অভ্যর্থনা করিয়া সেইস্থানে বসাইলেন। ইঁহাদিগের কথার ভাবে বোধ হইল যে, ইঁহারা সেক্রেটারী বাবুর ন্যায় অপরিচিত নহে, সকলেই পূর্ব্ব হইতে পরস্পরের পরিচিত। তাঁহারা সেইস্থানে উপবেশন করিলে একজন কর্মচারী কহিলেন, “রাজা মহাশয় বলিয়া দিয়াছেন যে, ইঁহারা আগমন করিবামাত্র যেন তাহার নিকট সংবাদ প্রেরণ করা হয়।”
কর্মচারীর কথা শুনিয়া রাজা মহাশয়কে সংবাদ দিবার নিমিত্ত মন্ত্রী মহাশয় স্বয়ং গমন করিলেন। সেই সময়ে সেই নবাগত ব্যক্তিগণের মধ্যস্থিত এক ব্যক্তি দাওয়ানজী মহাশয়কে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, “কল্য আপনি আমাদিগের যেরূপ উপকার করিয়াছিলেন, অন্যও যদি সেইরূপ করেন, তাহা হইলে কল্য যেরূপ লভ্যাংশের অর্ধেক আপনার হইয়াছিল, অদ্যও তাহাই হইবে।” এই কথার উত্তর দাওয়ানজী মহাশয় বলিলেন, “এ অতি সামান্য কথা। রাজা মহাশয়কে আমি চিরকাল দেখিয়া আসিতেছি; সুতরাং উঁহার ভার গতিক আমি যতদুর অবগত আছি, ততদুর আর কেহই অবগত নহেন। মনে করিলে ইহার প্রত্যেক হাত আমি জিতিয়া লইতে পারি; কিন্তু মনিবের সঙ্গে বসিয়া ক্রীড়া করা উচিত নহে বলিয়াই, আমি চুপ করিয়া থাকি। আপনি আমার সঙ্কেত অনুযায়ী কার্য্য করিবেন; দেখিবেন, আপনি কত অর্থ উপার্জন করিয়া লইয়া যাইতে পারেন।”
দাওয়ানজী মহাশয়ের সহিত নবাগত ব্যক্তি এইরূপ কথোপকথন হইতেছে, এমন সময় মন্ত্রী মহাশয় সেইস্থানে প্রত্যাগমন করিয়া আপন স্থানে উপবেশন করিলেন। তাঁহার আগমনের সঙ্গে সঙ্গে দাওয়ানজী মহাশয় প্রভৃতির কথা বন্ধ হইয়া গেল। কিয়ৎক্ষণ সকলেই স্থিরভারে সেইস্থানে উপবেশন করিয়া রহিলেন।